পাখিসব করে রব
‘পবন রে ছাইড়া দ্যাছ না ক্যান তুই?’
‘ধ্যাত। ও আমার বন্ধু ওকে ছেড়ে দেবো কেন? রোজ রোজ একই কথা বলো তুমি, ভাল্লাগে
না।’
ঘর থেকে এক ছুটে বারান্দায় চলে আসে মোতি। বুড়ি বড় জ্বালায়। বিরক্ত মোতি পবনের
খাঁচার সামনে দাঁড়াতেই ওর মন ফুরফুরে হয়ে যায়।
খাঁচার ভেতরে পবন ছটফট করে। পায়ে পায়ে তালে তালে ওর এপাশওপাশ করা দেখে
বোঝা যায়, বাইরে বের হবার জন্য এই ছটফটানি না। ঢেউখেলানো লাল ঠোঁট দিয়ে নিজের লাল- সবুজ ঘাড়ে খানিকক্ষণ আদর করে আবার ছটফট করে। থেমে থেমে বলে, ‘ও দাদাভাই ওঠ ওঠ।’
দাদাভাইটিকে আশেপাশে দেখা যায় না। বারান্দার ডানকোণে রাখা টবের ঝোপড়ানো
অলকানন্দা গাছের পেছনে নিজেকে আড়াল করেছে সে। ওদিকে ব্যস্ত পবনের লাল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নিয়মিত বিরতিতে ‘ও দাদাভাই ওঠ ওঠ’ ডাক বের হতে থাকে। তখনই কারো হাততালির শব্দ শোনা যায়। এবার কচিকণ্ঠে কেউ একজন ছন্দ কাটে,
একটা পাখি, দুইটা পাখি,
তিনটা বন্দি ঘরে।
তিনটা পাখি, দুইটা পাখি,
একটা কান্না করে।
লক্ষ পাখি, হাজার পাখি,
বুকের গোপন তারে,
হাজার পাখি, লক্ষ পাখি,
ডানা ঝাপটে মরে।
প্রিয় সঙ্গীকে দেখতে পেয়ে পবন লেজ ফুলিয়ে গদগদ স্বরে ডাকে, ‘দাদাভাই, দাদাভাই।’
পবনের সামনে দাঁড়ানো মোতি দুলে দুলে আহ্লাদি কণ্ঠে ছন্দ আওড়ায়। রোজ স্কুল থেকে ফিরে এভাবে মোতি পবনের সঙ্গে ঘন্টাখানেক সময় কাটায়। ছমাস হলো পবন এ বাড়ির সদস্য হয়েছে।
মোতির ছোটমামা ওর জন্মদিনে পবনকে উপহার দিয়েছে। সবুজ রঙের টিয়ে পাখিটির পূর্ব
মালিকের দেয়া ‘পবন’ নামটি মোতি পাল্টায়নি।
পবনের পেছনে ছমাস ধরে মোতি লেগে আছে আর মোতির পেছনে লেগে আছে ঐ বুড়ি।
মোতি গাল ফুলিয়ে বন্ধুকে এখন সেই দুঃখের কথা বলছে। অবশ্য বেশিক্ষণ মুখভার করে থাকতে পারে না সে, উৎফুল্ল মনে তালে তালে পবনকে ছড়া শোনায়।
শোবার ঘর থেকে মোতির মা সুখী সুখী দৃষ্টিতে ছেলেকে দ্যাখে। গতকাল রাতে বাবার কাছ
থেকে ছেলে ছড়া শিখেছে। দশ বছরের মোতি কোনোকিছু শুনে খুব দ্রুত আত্মস্থ করতে পারে।
পবনও ওর দাদাভাইয়ের মতো শ্রুতিধর। যা শোনে তা আয়ত্ত্ব করতে সময় নেয় না। পবন লেজ নাচায় আর টেনে টেনে বলে, ‘একটা পাখি, দুইটা পাখি।’
এসব আহ্লাদিপনা দেখে ঘরের ভেতরে থাকা একজন মানুষের খুব রাগ হতে থাকে।
মানুষটি মোতির দাদী। এসব তাকে ঠকানোর বাহানামাত্র, আর কিছুই না-সেটা ধরতে এই বয়সে তার এক মুহূর্তও দেরি হয় না।
মোতির দাদী হাতের তালুতে শুকনো তামাক পাতা গুঁড়ো করে বিছানায় ছড়ানো ছোট
নরম রুমালের ওপর রাখছেন আর জোরে শ্বাস টানছেন। এ কাজের সময় তার হাতের কাছে পত্রিকা থাকা চাই। এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে কোথাও পত্রিকার চিহ্ন দেখতে না পেয়ে তার মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ছেলে বউকে ডাকলে তার কাছ থেকে উপদেশ বাক্য শুনতে শুনতে হাঁপানির টান আবার জেগে উঠবে, এর চেয়ে মোতিকে ডেকে পত্রিকা চাওয়া স্বস্তিকর ভেবে তিনি এতক্ষণ গলা শুকিয়েছেন। ঐ ছেলেও হয়েছে একেবারে মায়ের মতো, সেই যে কখন থেকে তিনি নাতিকেডাকছেন হতচ্ছাড়া শুনতেই পাচ্ছে না।
এতকালের অভ্যাস তার, এখন নাশা টানতে না পারলে তার বুকের ভেতরে কোন সে কোন
অচিন দুঃখ থইথই করবে-তা তিনি এদেরকে কী করে বোঝাবেন?
ঈশ্বরের দূত হয়ে হঠাৎ মোতি দাদীর সামনে দাঁড়ায়। দাদীর কানে কানে বলে, ‘দাদী
তোমার বালিশের নিচে নিউজপ্রিন্টের দুটো কাগজ রেখেছি, বাবা আমার খাতা বানাতে এক দিস্তা কাগজ দিয়েছিল।’
‘ওরে সোনা ভাই, আয় আয় তোরে একখান চুমু খাই’ নিমিষেই মোতির দাদীর মন ভাল
হয়ে যায়। মোতি ভ্রু কুঁচকে দুপা পিছিয়ে যায়, ‘যাও বুড়ি... আমার গালে থুতু লাগবে।’ মোতির দাদী হাসেন, ‘ওরে আমি তো বুড়ি...ছুড়ি বউয়ের থুতু তো বড় মিঠা লাগবো তোর।’
‘ছি...ছি...ইয়াক...দাদী, তুমি একেবারে পাজীর পাজী। আরেকবার এমন বললে মাকে বলে
দেবো তোমার নাশার কথা।’
নাতির হুমকি শুনে মোতির দাদী দুই ঠোঁট ভাঁজ করে ভেঙচি কাটেন, ‘হ্যাঁ, তার মায়েরে
য্যান আমি খুব ভয় পাই! যা যা ভাগ...।’
মোতি দাদীর হাতে কাগজ দিয়ে রাগী কণ্ঠে বলে, ‘এইবারই শেষ। আর পাবে না।’
নাতির হাত থেকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাগজটা নেন মোতির দাদী। তারপর কায়দা করে ছিঁড়ে
তার ভেতরে তামাক গুঁড়ো দিয়ে বিড়ির মতো বানিয়ে মাথার দুপাশ মুড়ে ‘নাশা’ তৈরি করতে
বসেন। মোতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সাবধানী হাতে তিনি ঘরের দরজা টেনে নাশার মাথায়
আগুন জ্বালিয়ে বিড়ির মতো টান দেন। ধোঁয়া যতো ওপরে উঠতে থাকে তার স্বস্তিও তত বাড়তে থাকে। যদিও এ বাড়িতে বেশিক্ষণ স্বস্তিতে থাকার জো নেই।
মোতি হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে।
‘ও দাদী, মা আসছে...।’
হাতের অস্ত্রটি কৌশলে আড়াল করে দ্রুতপায়ে বাথরুমে ঢুকে যান মানুষটা। মিনিটখানেক
পরে মাথা বের করে চাপা কণ্ঠে বলেন, ‘কী রে আইলো তোর মা...?’
মোতি এবার হাততালি দিয়ে ওঠে, ‘ফক্কা, ফক্কা...বোকা, বোকা...খুব না বলছিলে মাকে ভয়
পাও না!’
মোতির দাদী কপট রাগে নাতির মাথায় চাটি মারেন, ‘হতচ্ছাড়া।’ নির্মল আনন্দে দুজনই
এবার হাসিতে মুখর হয়ে ওঠেন। বাইরে পবন ডেকে চলে, ‘একটা পাখি, দুইটা পাখি।’
বকুলের ঘ্রাণ
গোলগাল মাথার বকুল গাছের কালচে বাদামি বাকল খোদাই করে কেউ একটা নাম লিখে
রেখে গেছে।
রত্নেশ্বর হাতের চাকুটা কায়দা করে ধরে গাছের ছাল তোলার চেষ্টা করতেই নামের মালিক
এসে হুংকার জুড়ে দেয়, ‘করবেজের সাহস দ্যাখো! এ্যাই করবেজ বুড়ো ও গাছে হাত দিয়া দ্যাখো, ভাইরে ডাইকা আইনা তোমারে যদি মাইর না খাওয়াই! কতবার বলছি, সব গাছের কাছে গেলেও আমার এই গাছ তুমি ছুঁইবা না।’
মৃদুমন্দ বাতাসে মেয়েটির চুলের বেণি দোলে, পরনের জামা ময়ূরের পেখমের মতো তিরতির করে নাচে। কোমরে হাত দিয়ে সে অপরাধীর দিকে আগুনচোখে তাকায়।
রত্নেশ্বরের কারণে গাছের ফুল, ফল, ছাল-বাকল কিছুই রাখার উপায় নেই। গত শীতে
মেয়েটির হাতে-পায়ের চামড়া অদ্ভুত ধরনের রোগ হয়েছিল, তখন অবশ্য এই রত্নেশ্বর কবিরাজের পাচন দিয়েই সে রোগ সেরেছিল। বকুলগাছ আর তেঁতুলগাছের ছাল দিয়ে তৈরা হয়েছিল সেই পাচন। সে কথা মনে করে মেয়েটির কিছু আসে-যায় না। আসবে যাবেই বা কেন! ও তো আর পাচনের জন্য বুড়োর হাত-পা ধরেনি।
রত্নেশ্বর ঔষুধি গাছের খোঁজে এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। তার নিজের এলাকার এ বাড়ি
সে বাড়িও বাদ যায় না। গাছপালা ঘেরা এই হোসেন বাড়ির মালিক মহসিন ভাইজানের কারণে এই বাড়ির গাছ-গাছালির সঙ্গে তার গভীর সখ্য। খুঁটে খুঁটে সে এ পাড়ার প্রতিটা গাছ দ্যাখে; অভিজ্ঞ হাতে গাছের পাতা, বাকল, ফুল, ফল পরখ করে। বনকাঞ্চন,সর্পগন্ধা, বাসক পাতা, আমলকি, অর্জুন গাছের ছালে আজ সে ঝোলা ভরেছে। কাল একবার গ্রামের দিকে যাবে।
রত্নেশ্বরকে নির্বিকার দেখে চোখ রাঙিয়ে মেয়েটি আবার বলে, ‘যাও বলতাছি।’
এই বাড়ির সকলেই জানে এই বকুল গাছের সঙ্গে ওর নাড়ীপোতা টান। এ গাছের গায়ে কেউ
হাত দিলে ওর ভাল লাগে না। কিন্তু আব্বাকে কে বোঝায় সে কথা। মানুষের উপকার হচ্ছে বলে আব্বা রোজ মাথা খায় ওর।
‘মহসিন ভাইজানকে বলেছি, এক রোগীর জন্য খুব দরকার আজ। তুমি অত ক্ষেপছো কেন
গো?’
চোখ রাঙিয়ে মেয়েটি বলে, ‘যাও বলতাছি।’
রত্নেশ্বর হাসে, এইটুকুন হলে কী হবে, মেয়েটা খুব দস্যি। হবেই বা না কেন, এ বাড়ির মেয়ে
তো। মাটি থেকে ঝোলা ব্যাগখানা কাঁধে তুলতে তুলতে রত্নেশ্বর গাছের বাকলে লেখা নামের দিকে তাকায়।
‘আমি ছাল তুললে দোষ, তা অমনধারা খোদাই করে নাম লিখেছে কোন লক্ষ্মীঠাকুরণ শুনি।
দেখি।'
‘আমার গাছ আমি লিখছি। তোমার কী গো?
রত্নেশ্বর আর পিছু তাকায় না। এই মেয়ে লক্ষ্মীছাড়া, কখন কী করে একদম ঠিক নেই।
আগেরবার এই ঝোলা নিয়ে দৌড় দিয়েছিল।
রত্নেশ্বর দুপা এগিয়ে শুকনো মাটিতে আছাড় খায়। তারপর কোনোরকমে উঠে এলোমেলো
পা ফেরতে ফেলতে সামনে এগোয়। কাণ্ড দেখে পেছন থেকে হাততালি দিতে দিতে হাসিতে লুটিয়ে পড়ে মেয়েটি। খুব মজা! খুব মজা! ভাই বাড়ি ফিরলে সব বলতে হবে আজ। ভাইয়ের সঙ্গে খুব ভাব বোনটির। বাড়ির শেষ সন্তান হিসাবে তার অবাধ প্রশ্রয়ের জায়গা এই ভাই। আজ ভাইয়ের জন্য বড় একটা মালা গাঁথবে ভেবে মেয়েটি খুশিমনে ফুল কুড়াতে শুরু করে। তরতাজা বকুলের স্বর্গীয় ঘ্রাণে ধীরে ধীরে মেয়েটির কোচড় ভরে উঠতে থাকে।
বুকের গোপন তার
পবনের মুখে শব্দ দুটো শুনে মোতি চমকে যায়। এ কথা ওকে কে শেখালো? মোতি তো
শেখায়নি! আর অমন ছটফটই বা করছে কেন পবন? মনে হচ্ছে এক্ষুনি খাঁচা ভেঙে উড়ে যাবে।
স্কুল থেকে ফিরেই মোতি খেয়াল করেছে, পবন খুব ছটফট করছে। ঠোঁট দিয়ে খাঁচার তার
কাটার চেষ্টাও করেছে বারকয়েক। মোতি তখন গা করেনি। মা ওকে ধরে বেঁধে গোসলে করিয়ে ভাত খাইয়ে এক ঘন্টা পড়িয়েছে। দুদিন পর মোতির অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। পড়া শেষ করে এতক্ষণে ছাড়া পেয়েছে মোতি। ছাড়া পেয়েই পবনের কাছে দৌড়ে এসেছে।
ঠিক এই মুহূর্তে পবন যা বলছে তা শুনে মোতির চোখের মণি অক্ষিগোলক ছেড়ে বের হয়ে
আসার দশা হয়। খাঁচার ভেতরে চক্কর কাটতে কাটতে পবন বলছে, ‘ক্যালকাট্টা কিলিং...
‘ক্যালকাট্টা কিলিং...।’
মোতির এবার আর বুঝতে বাকি থাকে না এ মায়ের কাজ। নির্ঘাৎ জোরে আওয়াজ দিয়ে
টিভি দেখেছে। মা সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করে। সকালে রান্নার কাজ শেষ করে সোজা টিভির সামনে বসে পড়ে। মোতি না ফেরা পর্যন্ত টিভি দেখতেই থাকে। ওদের টিভিটা বেশি ভালো না, পুরনো হয়ে গেছে। রঙিন টিভি অথচ সব রং ফ্যাকাসে। মাঝেমাঝে মা বাবার ওপর রেগে গেলে
বলে, ঝুরঝুরে না হলে বাবা নাকি জিনিসপত্র বদলায় না। আসলে মায়ের মতো মোতিও জানে বাবার হাতে অত টাকাই থাকে না। বাবা কথা দিয়েছে ব্যবসাটা একটু ভালো হলে বাবা একটা বড় টিভি কিনবে, দাদীকেও দাদীর দেশ থেকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
‘বকুল...ফুল...বকুল...ফুল।’
মোতি আবার চমকে যায়। পবন আজ একবারও ওকে ‘দাদাভাই’ বলে ডাকেনি। এখন
আবার ফুলের নাম বলছে। মোতি বকুল ফুল চেনে। দাদীর খুব প্রিয় বকুল ফুল। ওদের এই ভাড়া বাড়িতে তেমনভাবে গাছ লাগানোর উপায় নেই তবু দাদী টবে বকুল গাছ লাগিয়েছিল। বেশি বড় হয়নি গাছটা। দাদী বলে, মাটির জিনিস মাটিতেই রাখতে হয়, তুলে এনে ঘরের ভেতরে যতই যত্নআত্তি করা হোক না কেন ও আর মন খুলে বড় হতে পারে না।
তবু দাদী বকুল গাছের যত্ন করতো খুব। গতবছর বাসা পাল্টানোর সময় টবটা ভেঙে
গেছে। এই বাড়িতে উঠে বাবা নার্সারি থেকে বকুলের একটা ছোট্ট চারা এনেছিল, গাছটা বাঁচেনি।
পরে রাগ করে দাদী আর বকুল গাছের নামই নেয়নি।
দাদীর কাছে মোতি শুনেছে ওদের পুরনো বাড়িতে অনেক গাছ ছিল। কিন্তু ঐ ভিটেবাড়িও
ওদের ছিল না। তবে অনেক খোলা জায়গা ছিল সেখানে। ঐ বাড়িতেই নাকি মোতির বাবা বড় হয়েছে, মোতি মাত্র একবার সেখানে গিয়েছিল। তখন ও আরও ছোট। এ বাড়ির কেউ আর কখনো ওখানে কেন যায়নি মোতি অতশত বোঝে না।
বাবা আর দাদীর কথোপকথন থেকে মোতি জেনেছে, ওটা সরকারি জায়গা ছিল, ওর দাদা
বাড়িঘর করেছিল সেখানে। পরে মামলা-মোকদ্দমা করে লোকজন বেদখল করেছে মোতির
দাদাকে। সেই শোকেই মোতির দাদাজান মারা গেছে।
এতসব ভেবে ভেবে মোতির বুকের ভেতরে কেমন একটা করে, মনে হয় বুকের ভেতরে
লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম একটা তারে টুংটাং করে বাজনা বাজায় কেউ, বিষয়টা ঠিক ধরতে পারে না ও।
এই ধরতে না পারা অনুভব ধীরে ধীরে ওকে কাতর করে।এখনো ওর বুকের ভেতর তা-ই হচ্ছে।
মন খারাপ করে মোতি পবনের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ায়।
পবন গলা সাধছে, ‘ক্যালকাট্টা কিলিং... ‘ক্যালকাট্টা কিলিং...।’
মা বারান্দায় এসে মোতির মতোই থমকে গেছে, ‘কী রে ওকে এসব কী শেখাচ্ছিস?’
‘আমি তো শেখাইনি মা। তুমিই শোনো ও কী অদ্ভুত কথা বলছে। ছড়াও শুনছে না।’
পবন এখন লেজ দোলাচ্ছে আর বলছে, ‘ক্যালকাট্টা...।’ নাহ, পবন বড় জ্বালাচ্ছে। আজ
মোতির মন ভাল নেই, আর মন খারাপের সময়ে এ পাখি কেন যে ওকে বিরক্ত করেই চলছে।
মোতি দাদীর ঘরের সামনে দুবার ঘুরে এসেছে, ভেতরে কোনো আওয়াজ নেই, নাশার
গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না। দাদী নিজের ঘরে যখন এভাবে ঝিম মেরে থাকে তখন মোতির ভয় ভয় করে। ঢুকবে না ঢুকবে করেও আলতো পায়ে মোতি ঘরে ঢোকে। আধো আলো আধো অন্ধকারে বিছানার ওপরে দাদী পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মোতির পায়ের শব্দ পেয়ে দাদী নড়ে ওঠে, ‘ভাই তুই আসছস?’
‘দাদী, আমি মোতি।’
‘ও ভাই...আয়।’
দাদীর কণ্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা।
‘দাদী তোমারও কি মন খারাপ?’
উত্তর না পেয়ে মোতি দাদীর গা ঘেঁষে দাদীর মতো নিশ্চুপ বসে থাকে। মোতি টের পায়
দাদীর বুকের ভেতরেও টুংটাং করে বাজনা বাজাচ্ছে কেউ।
ওপাড়-এপাড়
রত্নেশ্বরের বাড়িটা একতলা, ডানদিকের কাঠের ফ্রেম আর কাঁচের দরজা ঘেরা ঘরটি তার
ঔষধঘর। সামনে টানা বারান্দা, সারি সারি টবে নানান গাছগাছালি। বাড়ির পেছনের অংশ
আদুল থাকলেও জঙ্গলে ভরা। সামনের দিকে প্রবেশদ্বারের দুপাশে খানিকটা দেয়াল তোলা যার এক পাশ অনেকটা ভাঙা। এই বাড়িতে খুব যে নিরাপত্তা আছে তা না, তবু ওরা সবাই গতকাল মাঝরাতে রত্নেশ্বরের বাড়িতে এসে উঠেছে। এই বাড়িতে এই পরিবারটির খুব একটা আসা-যাওয়া ছিল না। অসুখ-বিসুখ ছাড়া কবিরাজ বাড়িতে কে আর আসে অত।
আব্বা-আম্মার পাশাপাশি ছোট সেই মেয়েটি বসে আছে। নাম তার সায়রা বানু। চঞ্চলা,
স্রোতস্বিনী নদীর মতো মেয়েটি আজ বড় আনমনা। আব্বা-আম্মার কপালের ভাঁজ ওর মসৃণ
কপালেও পড়েছে। চাপা আতংকে সায়রার আব্বা মহসিনের টকটকে ফর্সা চেহারা পুরনো কাগজের মতো মলিন দেখাচ্ছে। মহসিনের ঘোমটা টানা বিবিজানের মুখে আতংকে কথা ফুটছে না।
এই ঘরের একটি প্রাণি কেবল নিশ্চিন্তে বসে তার কাজ করে যাচ্ছেন, হাতের তালুতে তামাক
পাতা গুঁড়ো করে চলেছেন। মানুষটা সায়রার দাদীজান ভানু বিবি। কদিন ধরে তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না, নিজেদের ভিটেবাড়ি ছাড়তে হবে, লুকাতে হবে নিরাপদ কোনো স্থানে। কোলকাতার বাড়িতে বাড়িতে এখন উত্তপ্ত জনতা কড়া নাড়ছে। সায়রা বানুর একমাত্র ভাই ফেরদৌসের মতো কিছু মানুষ প্রাণের মায়া ছেড়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছুটছে। তাদের
পেছনে উদ্ধত ছোরা হাতে ছুটছে আরো কিছু মানুষ, যাদের কারো কারো চোখে চিতার আগুন, কারো কারো চোখে কবরের নিঃসীম অন্ধকার।
সায়রার আম্মা খুনখুন করে ছেলের জন্য কাঁদছে, রত্নেশ্বর কাঁদছে তার দাদার জন্য। এরা
দুজনই তিনদিন হলো ঘরে ফেরেনি।
হঠাৎ ঘরের কাঠের ভারি দরজা কেঁপে ওঠে। দরজায় দমাদম বাড়ি দিচ্ছে কেউ। বাইরে
একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। প্রশ্নের পুনরাবৃত্তির পূর্বেই রত্নেশ্বর মোলায়েম কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘না দাদারা, কেউ ঢোকেনি বাড়িতে। কবিরাজ বাড়িতে রোগী ছাড়া কে আসবে? আর এই দুর্দিনে অসুখ-বিসুখও পালিয়েছে দাদা।’
ঘরের প্রতিটি মানুষ শ্বাস বন্ধ করে আছে। হঠাৎ তারা টের পায় চারদিক শান্ত হয়ে গেছে।
সকলে তবু নিশ্চুপ বসে থাকে। সময়ও স্থির, অচল; যেন এক জন্ম থেকে আরেক জন্ম পর্যন্ত রাতের নিস্তব্ধতা মেপে চলছে মানুষগুলো, তবু সময় ফুরাচ্ছে না। বাইরে সর্বস্ব হারানো মানুষের মাতম, ঝড়ো হাওয়ার দাপট। ভেতরে সব নিশ্চল, বোবাগাছের মতো প্রতিক্রিয়াহীন।
মহসিনের শরীর বরফশীতল হয়ে গেছে। ছেচল্লিশের ১৬ আগস্ট তিন দিন আগেই ফুরিয়েছে। অবিশ্বাস, আতংক আর ঘৃণা ফুরায়নি। দাবানলের ক্ষিপ্রতায় এপাড়ে-ওপাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিভেদের আগুন। শুধু মহসিন আর রত্নেশ্বর নিশ্বাসের দূরত্বে দাঁড়িয়ে একে-অপরেরমাঝখানের পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলেছে।
রত্নেশ্বর দরজার পাল্লায় সতর্ক কান পাতে। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। মহসিন রত্নেশ্বরের
কাছে এসে ওর দুহাত ধরে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।
সায়রার মায়ের কণ্ঠের আয়তুল কুরসি পাঠের অপার্থিব সুরের সঙ্গে তার বুকে চেপে রাখা
কান্নার চিকন সুর একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভানু বিবি ছুটে গিয়ে সায়রাকে জড়িয়ে ধরে মৃদুস্বরে
বিপদমুক্তির দোয়া পড়েন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালিমিন...।’
সায়রা দাদীর মুখে মুখ গুঁজে কাঁদে, ‘ভাই, ও ভাই...।’
‘থামরে...ওরা চইলা গেছে। ও রত্নেশ্বর তোমার বউরে ডাকো, দুইটা ভাত দিক।’
ভানু বিবির নির্ভার কণ্ঠে একে একে বেঁচে থাকার শব্দেরা ফিরে আসে। ঘরের মেঝেতে
চাদর বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করতে থাকে শাখা-পলা পরা দুটো মায়াবী হাত। ভীতসন্ত্রস্ত
মানুষগুলো ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা ভুলে গিয়েছিল। ক্লান্ত সায়রারও খাওয়ার কথা মনে নেই।
দাদীজানের শরীর ঘেঁষে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা সায়রা তার করবেজ কাকার দিকে তাকিয়ে চাপা কণ্ঠে বলে, ‘ও করবেজ কাকা, ওরা কি চিতে ডাকাত? আমাদের মারতে আসছিল?’
দাদীজানের কাছে চিৎপুরের চিতে ডাকাতের গল্প শুনেছে সায়রা। চিৎপুরে ওর দাদার
বাড়ি। বাড়ির অদূরে জয়চণ্ডী চিত্তেশ্বরী দূর্গামন্দির। ঐ মন্দিরের দূর্গা মূর্তি তৈরি করেছিল চিতে ডাকাত। ভাগীরথী-হুগলি নদীতে ভেসে আসা নিমগাছের প্রকাণ্ড গুঁড়ি দিয়ে চিতে ডাকাত নিজে ঐ মূর্তি তৈরি করেছিল। প্রতি অমাবস্যাতিথিতে সে সেই মন্দিরে নরবলি দিতো।
নরবলির কথা মনে করে সায়রা শব্দ করে কাঁদে, ‘ওরা আমাদের বলি দিবো কাকা, মাইরা
ফেলবো?’
রত্নেশ্বর ভ্রু কুঁচকে সায়রার দিকে তাকায়, ‘এত সোজা, আমি আছি না? আর হোসেন
বাড়ির এই ডাকাবুকো মেয়ে থাকতে আমাদের কে মারবে শুনি।’
মহসিন দুহাতের তালুতে চোখের পানি মোছে, ‘ছেলেটা ঘরে ফিরা কাউরে পাইব না দাদা,
ঘরপোড়া ছাই পাইব শুধু। ওরে না পাইলে আমরা দেশ ছাড়মু কী কইরা!’
‘কদিন যাক ভাইজান, তুমি যেমন চাও তেমনভাবে তোমাদের বর্ডার পার করার ব্যবস্থা
করবো। শুধু আগুনটা একটু ঠান্ডা হতে দাও।’
বন্ধুর বিশ্বস্ত দুই হাত মহসিনের দুই কাঁধে এসে পড়ে। রত্নেশ্বর হাসে। তার কালো মুখে রত্নের মতো জ্বলজ্বলে হাসি দেখে মহসিনের বুকের জ্বালা ক্রমশ জুড়িয়ে আসতে থাকে।
জন্মভিটে
‘ও ভাই, পবন রে তুই ছাইড়া দে ভাই...। ও আমার বাপের দ্যাশে উইড়া যাক।’
এ কথা শুনে মোতি আজ আর মুখভার করে না। দাদীর মুখের ওপর ঝুঁকে মনোযোগ দিয়ে
তার কথা শোনে। দাদীর শরীর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ছোট থেকে ছোট হচ্ছে। এক প্যাঁচে পরা নরম শাড়ির মতো তার শরীরটাও নরম তুলতুলে। মোতি দাদীর মোলায়েম হাত ধরে বসে আছে।
‘মামা বলেছে, খাঁচায় থাকতে থাকতে পবন উড়তে ভুলে গেছে।’
‘না রে ভাই, পাখি কি আর মানুষের মতোন উড়তে ভুইলা যায়? ছাড়ান পাইলেই পাখি
দ্যাশের সীমানা ছাড়া হইব।’
মোতি কিছু না বুঝে মাথা নাড়ে। দাদীর শরীর ভালো নেই। বাবা ডাক্তার ডাকতে গেছে।
মা ওকে দাদীর কাছে বসিয়ে রেখে সরিষার তেল আর রসুন গরম করে আনতে গেছে, হাতে-পায়ে মালিশ করলে দাদীর আরাম হবে।
দাদীর কষ্ট কথা বলতে হচ্ছে, মোতি বুঝতে পারছে। থমথমে মুখে মোতি দাদীর কথা শুনছে
আর আলতো করে দাদীর কপালে হাত বুলাচ্ছে।
‘ওরে ছাইড়া দিবি তো ভাই?’
দাদীর চোখের কোণে পানির দাগ। গালের ভাঁজ পড়া চামড়ায় আদর করে করতে করতে
মোতি বলে, ‘ও কি পথ চিনে যেতে পারবে কোলকাতা?’
মোতিকে অবাক করে দাদীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে আলো জ্বলে ওঠে, ‘পারবো রে...তুই স্কুলে গেলে প্রত্যেকদিন আমি ওরে আমার বাপের দ্যাশের গল্প শুনাই, ও সব চিনে, ঠিকঠাক চিইন্যা যাইতে পারবো। ছাড়বি না ভাই?’
ছোট্ট মোতি যেন এক ঝটকায় বড় হয়ে যায়। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ও বারান্দায় এসে
দাঁড়ায়।
পবন সকাল থেকেই চুপচাপ। ছুটির দিন বলে সেই কোন সকাল থেকে পবনকে ছড়া শুনিয়ে যাচ্ছিল মোতি, এসব কিছুতেই চঞ্চল পবনের মন ছিল না। এই যে এখনও কেমন থেমে থেমে পবন ডানা ঝাপটাচ্ছে।
মোতি নম্রপায়ে খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ায়। পবন তার প্রিয় দাদাভাইকে দেখে ছটফট
করতে করতে বলতে থাকে, ‘বাপের ভিটে...বাপের ভিটে...।’
1 মন্তব্যসমূহ
দেশভাগ আর এপাড় ওপাড়ের টুকরো টুকরো মনেদের গল্প মানুষ ভুলতে বসেছে কারণ একটা দুইটা প্রজন্ম আর নেই। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো ঋণশোধ এর খানিক দায়ভার নেবার জন্য
উত্তরমুছুন