আগে রাস্তাটা ময়নার আপন, অতিক্রান্ত দুপুরে নিজের শরীরের ছায়ার মত লম্বা ছিল, আছে, যেতে আসতে, প্রয়োজনীয় কিন্তু গুরুত্বহীন। মফিজের জন্য যেমন ময়না, একফালি চ্যালা-কাঠের টুকরা। মফিজ নিজে এর উল্টোদিকে শুয়ে থাকা কুড়াল, মুখের কাছে পাকা বোয়ালের পেটির মত চকচকে ধার, সেই ধার চ্যালা কাঠের দিকে চেয়ে মিটমিট হাসে। নিজেই মনে মনে চিরে ফালি ফালি হয় ময়না, বুকের ভেতরটা একটা থরথর করা বাচ্চা পাখি, খালি কাঁপে। ভয় যদিও বা পাটির মত গুটিয়ে রাখে কিন্তু কান্না? ক্ষয় করে ফেলা নিজের মধ্যেকার ঝড়বৃষ্টি? চোখের পাড় ঘেষে কান্নার বাঁধ আরো শক্ত করে ময়না। নিজেকে সে ভেন্নার গাছ ভাববে না। কম হতে যাবে কেন? চেরা কাঠ বলে তার রকম সকম নাই? আঁচলের মাথা দলা করে থুপ থুপ চোখের পানি চেপে শুকিয়ে নেয় সে। এক গলা জোয়ার ভাসানি পানি পেলে ভেসে যাওয়ার স্বপ্নটাও দেখে ফেলতে পারতো। কিন্তু নদীই নাই, আবার জোয়ার! আর জোয়ার তো তার মত মেয়েমানুষের ইচ্ছায় গা তুলবে না, নদীর নিয়ন্তা হলো চাঁদ-সূর্য, তাদের নির্দেশক্রমে চলে। কাজেই নিজেকে উপড়ে ফেলার বিতণ্ডা ক’রে লাভ নাই। তবুও ময়নার কালো চুলের কিঞ্চিত চ্যাপ্টা মাথায় এই কথার উইপোকারা ফন ফন উড়তেই থাকে। পরখের সাহস নিয়ে দু একদিন যে বসে পড়ে না তা না..., কিন্তু আজকে সে পারাপারের সময় স্থির হয়ে থাকে। আর কোত্থেকে মফিজের মাঝারী গড়নের কেজো শরীরটা উড়ে এসে তার ছায়া হয়ে যায়, শরীরটায় গনগনে কয়লা ভরা, কালো কল্কি একদম। একেকবারে সারাজীবনের উত্তাপ নেয় ময়না।
-“ খালি ছাই তোক দিবার নোয়ায়, নাল টকটকা আগুনগুলা দিমু, তলপেটত থুইস, আগুনের ফুল নিয়া হামাক
ভালোবাইসবার হোবে...কয়া দিলাম কিন্তুক আর একটা কতা, হামরা এই ছিটমহল ছাড়ি চলি যামো, কুন্ঠে সেইটাই ভাবছু, পঁচাগড় গেলে হয় না? জনগিরস্তি ত মুই জানোই, আর তুই রান্ধাবাড়া”... বেলাহাজ রকমের শিশু শিশু
ঠেকে তখন মফিজকে। পেটের ওপরে হাত ছুঁইয়ে যদি স্বপ্নটাকে বাইরে আনা যেতো! সত্যি
কেমন গনগনে গরম! এই আগুন কোথায় তৈরী হয়?
- “উদিক দিয়া হাটিস ক্যানে মা?” কাঁটা তারের কথা খেয়াল ছিল না। দু’চারটা ঘষটা, উষ্টা, গোল্লার বাপের কথার বেমক্কা খোঁচায় আবার সোজা হয়ে হাঁটে ময়না। মফিজের মা
তার হাত টেনে থাকে বলে তার আরো অধৈর্য্য লাগে, আর কত দূর! এই বুড়ি না থাকলে
সে বিছিয়ে থাকা শিমুল ফুলের ওপর মফিজকে নিয়ে শুয়ে নিজেদের চেহারা দেখতে চেষ্টা
করতো। আজকে তো আবছা প্রায় দেখেই ফেলেছিল! মনে মনে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ে ময়না। তার চুল
খোলা, কোমর আর পিঠ অনাবৃত। দিক হারানো পায়রার পড়ো
মাঠের ধান খোটার মত মফিজ তার পিঠ খুটেঁ দেয়, ঘামাচির দানাগুলো নখের নিচে
কাতর হলে ময়না নিজেও পিঠ বুক মুচড়িয়ে আদরখাকি হয়, মফিজের ভেতরকার তাপ শান্ত
ময়ালের মত পিছলে ছেঁচড়ে ময়নার বুকের কাছে ঘূর্ণি তোলে। তার স্তনাগ্র তখন সতর্ক।
সেইবেলা তার ভাত না খাওয়া শিরদাঁড়া সজাগ হয়ে আর বাঁকা হওয়ার কথা ভুলে যায়। ধুলার
রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে দিতে ময়নার মনে হয় আজকে কতদিন মফিজের সঙ্গে তার দেখা নাই! দুই
মাস! ডান কনুইয়ের আঁচিল আরো গাঢ় বেগুনি বর্ণ ধারণ করলো? চুলগুলিতে ধুলার পুরু আস্তর? ওর দাঁতের ফাঁক থেকে এক কণা
কামড় এসে ময়নার আঙ্গুলের ডগা কাঁপিয়ে তোলে। এতও পাষাণ হয় মানুষ! যাওয়ার সময় একবারও
পেছন ফিরে চায় না,
যতবার যায় কী এক সংশয়ে ঢেকে দিয়ে যায় ময়নার দুনিয়া! গুটানো পাটিটা বিছিয়ে
আবারো কাঁদতে বসবে সে? চোখের পানিতে বুকের ভারের
ঢেকিটা তুলতে কষ্ট হয় তার।
মফিজের
মা তার নুয়ে আসা কোমর সিধা করার চেষ্টা নিয়ে দুই হাতই বাড়িয়ে দেয়। ময়নার ধ্যানভঙ্গ
হলে সে অল্প তেতে ওঠার ভঙ্গি করে- ‘হাতখান দিয়া ভর দ্যান না ক্যানে?’ তাতেই ব-দ্বীপের তাবৎ নাব্যতা
এসে নাগাল খোঁজে নিশ্চিন্তির, তখন গোল্লার বাপের বাগানো হাতও
তার সহায়। বুড়ি চলে আসে সরু রাস্তার চওড়া বুকে।
মফিজের
মা ফোঁপড়া কচুরি পানার মত তারপর হাটের মানুষের দিকে হনহনিয়ে ছুটে যায়। পেছনে
গোল্লার বাপ লুঙ্গির ভাঁজ খুলে ভদ্রস্থ হওয়া আর মফিজের মায়ের কাছাকাছি হওয়ার
দ্রুততায় ব্যাতিব্যস্ত হাঁটে। সারের ডিলার সাদেক ঝাঁপ তোলা দোকানের তদারকি রেখে
তাদের কাছে সহসাই আসে না। দূর সম্পর্কের ভাগ্নের সঙ্গে দেখা করার কথাই ভাবতে
পেরেছে মফিজের মা, সেই ভরসায় অমনোযোগ পেয়ে নিজের ছেলের কথা
মনে করে আরেকটু চোখের পানি ফেলে। ময়নার ছাপা শাড়ির ঘোমটা পড়ে যায়, ব্লাউজের বাইরে ফর্শা কাঁধের বেআইনী দাগের ওপর ভাঁজা পেয়াজের মত কড়কড়া রোদ
লাগে। তখন তার খোলা গায়ের অনধিকার চর্চা উদ্দিশ করে উচ্চস্বরে গীত শোনায় বুড়ি।
মফিজের মত ছেলেকে দূরে রেখে তার মায়ের কুঁকড়ে যাওয়া কয়লার মত দেহাবয়বের সামনে ময়না
কেন মিইয়ে যায় না- বুড়ির কন্ঠস্বরের মেজাজ এ বিষয়কে ঘিরে সাময়িক আবর্তিত হলে এ
নিয়ে ময়না নিজে দু’রকম ভাবে, এক- এ নিয়ে ভাবতে হবে কেন? নিজের অন্তলীন রক্তের চলাচল
তো সে এ ত্বকে হাত বুলিয়েই পায়, এখনো মসৃণ, কচি বেগুনের পেলবতা। এই পেলব ঘিরে সুখ-শিহরণের বাকবাকুম তাকে এখনি থামিয়ে
দিতে হবে! তার জন্য কি এপার ওপারের লেন দেন থেমে আছে?
নিজেদের
ছিটমহলের বাইরে এই হাটে ময়না আগেও এসেছে। মফিজের সাথে না, তার নিজের বাপ যেদিন গরু বিক্রির পারমিট পেতো, ঢেউ না খেলানো বুক নিয়ে সে চট আর প্লাষ্টিকের ব্যাগে দড়ির গোছ নিয়ে বসে
থাকতো, তাকে গরুর রশি ধরিয়ে দিয়ে বাপ কতদিন হাটের
তোলা দিয়ে আসতে গেছে। সারের ডিলারের দোকানের পাশ দিয়েই যাওয়া-আসা। আর এখন ময়নার
পরিচয়-‘মফিজের কথা পাকা বউ’। পানচিনি শেষ, এখন শুধু মফিজের ফেরার অপেক্ষা। সাদেক ডিলারের চোরা চোখ ময়নাকে জরিপ করে, ত্রস্ত করে। তাদেরকে বসতে আহবান জানালে বুড়ির মুখের শিরা-উপশিরা পদোন্নতির
আনন্দে চকককে হয়।
সাদেক ডিলারের গোলগাল মুখের টোলে আত্মবিশ্বাস- আগেই খবর
পেয়েছে, মফিজ থানা থেকে হাসপাতাল স্থানান্তর হয়েছে।
থানা চত্বরের নিমগাছের নিচে অপেক্ষমান ভ্যান গাড়ি পার হয়ে এই খবর দিলে ময়না, গোল্লার বাপ আর মফিজের মা পরস্পর পরস্পরের নির্বিবাদ কথা না চালাচালিতে
মন্দের ভালো বুঝে উঠতে পারে।
-‘হসপিটালত মোনে কয় না মাইর ধোর করবে’, সাদেক ডিলার এই কৌতুহলের কোন সহজপাচ্য জবাব দিতে পারে না। এলাকার মেম্বার
অথবা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে এই সংক্রান্ত ধারণা পরিস্কার হতে হয়-এটা তার মনে
হয়। তবে মফিজতো চোর বাটপার না। গোল্লার বাপের সঙ্গে জন খেটেছে সেই কিশোরকাল থেকে।
-“অয় তো প্যাটত পাত্থর বান্ধাই আছিল, কিন্তুক এইখানত থাকিয়া আর কোন
কায়-কারবার করিবা পারিবে ওয়। প্যাটের টানোত না হইলে কেউ এইরকম কারবারে
জরায়া যায় বাপ, মোর ছুয়াডা ইগলা পারে না তাকতো তুমরা চিনেন, চিনেন না?’ বছরে কতশত মানুষ এপার যায়, ওপার যায়- বর্ডারে ব্যাবসা বানিজ্য-গরুছাগল আর মানুষের পেটের ধান্ধা করে, তাদের মধ্যে শুধু মফিজ কেন অবৈধ পাচারের অভিযোগে কাঁটাতারে আটক হবে! তাকে
পিটিয়ে আধমরা করে এপারের পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে- এ বিস্ময়ের সংক্রমণ
অন্যান্যদের মধ্যে চালান করে মফিজের মায়ের অস্বস্তি জোটে। ছুটে আসা বাতাসে তার ধুলা ধুলা চুল উড়ে চলে
যেতে চায়। ময়না কপাল ঢেকে ঘোমটা দিয়েছে, তার চোখও ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে
করে। ফাল্গুনের গা এমন ঠান্ডা দিচ্ছে কেন কে জানে, একটা চাদর সঙ্গে আনলে হতো।
গোল্লার বাপের চিন্তিত কপালের নিচে দু’চোখ বন্ধ, তার চাদরের ভেতর বাতাস ঢুকে ফুলে ফুলে
উঠছে। ভ্যানগাড়ির দুলুনিতে ময়নার বেজায় ঘুম পায়।
- “ইগলা সব জানেনই তো...টাকা খিলানোর
জাগা”,- সাদেক ডিলারের দম ধরানো কন্ঠস্বর খ্যাক্কড় খ্যাক্কড় রাস্তা ভর্তি গর্তের
ঠোক্করে দুলে ওঠে। মফিজের মা ময়নাকে আঁকড়ে ধরে ভারসাম্য রাখে। ময়না পেট উপড়ে
বেরিয়ে আসা ঢেকুর আটকে রাখতে আঁচলের খুট কামড়ায়। হাসপাতাল দূরের গন্তব্য না। স্থির
হয়ে দম নেবে নাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়বে, বোঝার আগেই সরু রাস্তা ফুরিয়ে
দোকান পাট এগিয়ে আসে। রকমারী দোকান-ফার্মেসী-ফলের সমাহার আর গোস্ত ভাতের হোটেলের মাছ-মুরগীর ছবিওয়ালা
সাইনবোর্ড এর জটলার ভেতর থেকে মফিজের মায়ের কৃশকায় হাত তাকে টান দিলে তার মাথা
ঘোরে।
হাসপাতালের
ময়লা হলুদ ঘর বেঘোর বিকাল বেলায় ম্যান্দামারা হয়ে ঘুমের গুঞ্জন তুলছে। প্রবেশ পথে
কেউ আটকায় না। মফিজের মা ময়নার বাহুমূল আঁকড়ে কালসিটে দাগ করে ফেলে। ভুরুক করে
অচেনা একদলা গন্ধে ময়নার পেট উল্টিয়ে আসে। সাদেক ডিলার মুখ ফুটে গালি গালাজ করে
ওঠে- “শালার হসপিটাল? নাকি পায়খানাত আসি গেলাম!”
ঢোকার
পথ একটু বাড়তেই জরুরী বিভাগ, বাইরে এম্বুলেন্স লেখা জানলা
ভাঙ্গা গাড়ি। ভেতরে দরজার মুখে কয়েকজন মানুষের জটলা। ভেতরে টেবিলের সামনে দু’জন নারী পুরুষ বসে। মফিজের মা আর
ময়না একপাশে অপেক্ষা করলে সাদেক ডিলার গোল্লার বাপকে নিয়ে খবর আনতে যায়। নির্বিবাদ
বাতাস আরো কিছু গন্ধ উড়িয়ে আনলে ময়নার মাথা ঘোরা বেড়ে যায়। সাদেকের পরিস্কার
লুঙ্গি, ফুলহাতা শার্ট কিছু খবর সংগ্রহ করতে উদ্যত
হওয়ার আগে একজন গলায় ডাক্তারী যন্ত্র ঝুলিয়ে এসে ডিউটিরত লোকটার সঙ্গে কথা বলে।
সাদেক অতএব সমীহ করা দূরত্বে পিছিয়ে আসে। ভালো স্বাস্থ্য এই মাঝারী গড়নের লোকটা
নিশ্চয়ই ডাক্তার। ময়নার অদম্য ইচ্ছের একরত্তি স্ফুলিঙ্গ জুড়ে আগুন জ্বলে ওঠে। না, সে এই আগুন নিভতে দেবে না। বেঞ্চে বসেও ঘুরতে থাকা মাথা সবেগে নাড়িয়ে সোজা
করতে চায় সে। মফিজের জন্য এই ডাক্তারের সংগে কথা বলবে সে। দরকার হলে পা জড়িয়ে
ধরবে। চোখের পানির আবেদন নিশ্চয়ই না-মঞ্জুর হবে না!
সাদেক
ডিলার ডাক্তার আর ডিউটিরতদের কথাবার্তার মধ্যেই প্রবেশ করতে পেরেছে দেখে ময়নার
উৎসুক দাঁত আঁচলের কোনা কামড়ে কামড়ে ভেজায়। উঠে দাঁড়াতে চাইলে মফিজের মা তাকে টেনে
বসায়। বসে পড়লেও বার বার মনে হয়-সাদেক হয়তো গুছিয়ে কথাগুলি বলতে পারছে না। এক
ঝটকায় মফিজের মায়ের হাত ছাড়ানোর বেজায় ইচ্ছাকে নিমরাজী করিয়ে বসে থাকে সে। ডিলারের
ব্যাটাকে সবকিছু খুলে বলে দিলে ভালো হতো। তখন মফিজের মা চিৎকার করবে, তাকে খানকি আখ্যা দিয়ে হাসপাতালের বিল্ডিং ছত্রছান ক’রে দেবে –এ ভাবনা ময়না আর জরুরী বিভাগকে
মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন করে। বাইরে এম্বুলেন্সের ওপরে তখন একদল পাতিকাকের মিছিল শুরু
হয়।
রাস্তার
এপার-ওপার এমন পাতিকাউয়া দিয়ে ভর্তি- দেখে ময়নার নিজেরও গায়ের রংটাকে একটু বেআইনি
মনে হয়। গাছপাতার গায়ের শাদা রঙ্গের ধুলো আর তারো অধিক ফকফকা সূর্যের ধক মানুষের
ত্বক প্রকাশিত হতে দেয় না এখানে। ফলাফল তোফাজ্জল, মফিজের মামাতো ভাই, ফিরে না আসা মফিজতো বটেই
এমনকি এপার ওপারে তাবৎ মানুষের গায়ের বর্ণ
নিকষ তামাটে। তারা রাস্তা পার হয়, ওপার যায়, এপার আসে তামা বর্ণ তামা বর্ণই থাকে। তখন ময়না নামের এই মেয়েটা কোত্থেকে
পায় এই রং? যখন মফিজের মায়ের খোলা গীতের গলা ক্রন্দসী
হয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে তোলে, তখন তা আকাশ ফিরতি ময়নার
ত্বকেই ধাক্কা খায় যেন তার ত্বক সাততলা দালানের গভীর দেয়াল। তার রাগে ধুপ ধাপ শব্দ
হয় একেকবার, আর অন্যান্যবার নিংড়াতে থাকে-তাদের নীচু
হয়ে থাকা ঘরের চালে ধরে আসা বৃষ্টির ফোটার মত, থেমে গিয়েও টুপ টাপ- টাপ টুপ
ফোটায় ফোটায়।
-“মফিজ নামের কেউ এই হসপিটালত ভর্তি
হয় নাই”- কাজ শেষ করার ক্লান্তি আর
সন্তষ্টি দুইই খেলে যায় সাদেকের গলায়। থানা থেকে তিনজনকে নিয়ে এসেছিল পুলিশ। একজন
জন্ডিসের রুগী। দ্বিতীয়জনের স্ত্রী এসে তাকে দেখাশোনা করছে, অবশ্যই পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে। আর তিন নম্বর লোকটি মৃত্যুবরণ করেছে, তাকে ডোমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার নামধাম পরিচয় সাদেক ডিলারের কাছে
উদ্ঘাটন করা হয়নি- এটা পুলিশের কাছ থেকে শুধুমাত্র পরিবারের লোকজন সংগ্রহ করতে পারবে। এখন মফিজের মায়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করবে, তারা কি সেই তৃতীয় ব্যাক্তির লাশ শনাক্ত করতে যাবে? সেক্ষেত্রে তাদেরকে আবার থানায় গিয়ে পুলিশের অনুমতিপত্র আনতে হবে।
-‘অয় যে মফিজ তা কায় কবার পারবে? মফিজতো নাও হবার পারে!’- ময়নার বিড়বিড় মেঝের ঠান্ডায় চোখ বুজতে চায়।
-‘ও মাগো মোর ছাওয়ালটাক মারি ফেলাইছে?’ মফিজের মায়ের বিদীর্ণ করা চিৎকার কোন দিকনিশানা পায় না, উঁচু সিলিং এ ঠোক্কর খেয়ে নিচে নেমে আসে। পরক্ষণেই- হতেই পারে না, কিন্তু না হলে তার ছেলে কোথায় গেল ইত্যকার বিলাপে শোরগোলের মাঝখানে জরুরী
বিভাগ থেকে পুরুষ কর্মচারী বেরিয়ে আসে।
এখানে
কান্নাকাটি করা নিষেধ- এমন নোটিশ চোখে মুখে ফুটিয়ে লোকটা ফিরে গেলে ময়না ডাক্তারকে
আর খুঁজে পায় না। তার ভয়াবহ রকমের ক্ষুধা লাগে আর মনে হয় ক্ষুধার তোড়ে ভেতরের
আরেকটা হৃদস্পন্দন হজম হয়ে যাচ্ছে। ময়না মোচড়ায়, পেট-পিঠ, যেমন করতো মফিজের পাশে সংক্ষিপ্ত শোয়ার সময়।
মফিজের
দেহখান ময়না চেনে বৈকি। দিনের আলোয় এক রকম চেনে, রাতের ঝুম অন্ধকারে তার আরেক
রকম স্পর্শ চেনে। যতই না তার মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যাক, যতই তাকে অত্যাচার করা হোক, ঘুমিয়ে থাকা মফিজের ভঙ্গি চিনতে তার কোন ভুল হবে না। কিন্তু অনপনেয় কৌতুহলে, ভয়ে আর কান্নায় তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মফিজ তার ক্রমাগত উদ্ধত পৌরুষ
নিয়ে কেমন নাকাল হয়ে শুয়ে আছে চাটাই
প্যাচানো হয়ে তা না দেখার তাড়নায় সে আড় গেড়ে বসে থাকে। তার চোখ অস্থির হয় ডাক্তার
খোঁজে। আজকের মত এমন করে সে কি আর হাসপাতালে আসবে? তারাতো ছিটমহলের বাইরে সহসা
আসে না। মফিজ থাকলে আছে, না থাকলে সে কি করবে? তারচে ডাক্তারকে গিয়ে পায়ে ধরলে হয় না? সে এই আজাবের মধ্যে দিয়ে যেতে
চায় কিনা এই নিয়ে ভাবনার আর অবসর কোথায়? চোখের পানিতে দুনিয়া ভাসিয়ে সে
বলবে –‘মোর প্যাটের আগুনের ফুল উগরি ফেলাও
ডাক্তার সাব। মফিজ না থাকিলে মুই ওই ফুল দিয়া কি করি?’
নিজের
হাহাকারের সঙ্গে অনাগত সন্তানের কান্নাটা ময়নার কাছে চুড়ান্ত অচেনা। কোথায় গেল
বেজন্মা ডাক্তারটা? ময়নার চোখের সামনে থেকে কোথায় উধাও
হয়ে গেল মফিজের মতন?
হঠাৎ
জরুরী বিভাগের সামনে ভীড় বেড়ে যায়, কোন মুমূর্ষ রোগীর আগমনের
ব্যস্ততা। জরুরী বিভাগের সেই লোকটাকেও আর দেখতে পায় না ময়না। তার ঘোর লাগা চোখ
প্রায় চরকির মত ঘোরে। সাদেক ডিলার ডাক দেয়, মফিজের মা তার হাত ধরে টান
দেয়। ময়নার চোখ দেয়াল ঘেষে সটান ছাদে চলে যায়, সেখান থেকে জরুরী বিভাগের
দরজায়, ভীড়ের ফাঁকে ডাক্তারের শাদা কোট দেখা দিয়ে
ছলকে গেলে ময়না দাঁড়িয়ে পড়ে। গলায় ঝোলানো ডাক্তারী যন্ত্রটা দেয়াল ঘড়ির মত দোলে, এমন ঘড়ি ময়না কেবল ছোটবেলায় তাদের মসজিদে দেখেছে। তার ইচ্ছে করে ডাক্তার
এসে ওই যন্ত্রটা তার বুকে পেটে চেপে চেপে দেখুক, তারপর কোনভাবে তার ভেতরের
দ্বিতীয় হৃদস্পন্দনটাকে বন্ধ করে দিক। কতরকম উপায় আছে ডাক্তারের কাছে! মফিজের
কাছেই শুনেছে। নিজের বুকের ধুক ধুক বন্ধ রেখে সেখানে সে আর কারো হৃদস্পন্দন জারী
রাখতে চায় না। ভীড়ের ভেতর ডাক্তার খুঁজতে
উদ্যত হলে মফিজের মা তাকে আবারো চেপে ধরে। ময়না এবার থামে না, উড়ে যেতে চায়, ছাদে, সেখান থেকে নেমে সোজা ডাক্তারটার চেম্বারে পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু ছাদে
গিয়ে সে আটকে থাকে, মফিজের মা তার পা ধরে ঝুলতে
থাকে, তার সঙ্গে হাত লাগায় গোল্লার বাপ, লুঙ্গি কাছা মেরে নিয়ে, সাদেক ডিলার- শার্টের ফুলহাতা
গুটিয়ে। ময়না না নামতে পারছে, না পারছে উড়ে নিজের ইপ্সিত
গন্তব্যে চলে যেতে। এখানে বড় ভীড়, ময়নাকে ঘিরে মানুষের জটলা আর
হৈ চৈ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ডিউটিরত নারী পুরুষ দু’জনই ওয়েটিং রুমে। ত্রাহি
ত্রাহি চিল চিৎকার দিচ্ছে পাতিকাকগুলো। দু-একজন বলছে -‘একখান মই আনেন বাহে’।
ময়না
একটা ফোঁকর খোঁজে, যেখান দিয়ে ওই রাস্তাটার ওপারে চলে যাওয়া
যায়- কাঁটাতারের ঘোরেল বেড়া পার হয়ে রাস্তার যেখানে নদীর সাথে সংযোগ। সেখানে সে
বুক বিছিয়ে দেবে। তার ওপর দিয়ে ডিঙ্গিয়ে নিশ্চয়ই কেউ যাবে না!
0 মন্তব্যসমূহ