নাসরীন জাহান যখন ‘'আমার জন্ম'’ গল্পের প্রথম বাক্যে লিখছেন, ‘‘আমার চতুর্থ বোনটির জন্মের পর আমার বাবা ওই টুকুন নবজাত শিশুকে পাঁজা কোলা করে অন্ধকার উঠানে ছুঁড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন’’ কিংবা রোমানিয়ার কথাকার আনা ব্লানডিয়ানা যখন‘খোলা জানালা’ গল্পের সূচনা অংশে জানাচ্ছেন জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে ঢুকে গল্পের নায়ক একটা উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখবে বলে দেয়ালে একটি খোলা জানালা এঁকে ফেলে তখনই সুচারু একটা টোপ গিলে ফেলছি। এরপর বড়শিতে আটকানো মাছের মতো শব্দে শব্দে ঘাই মারছি আরও সামনে যাবো বলে। এই গল্প শেষ না হলে যেন মুক্তি নেই। তাই গল্পের কাছে এর প্রারম্ভেই চাই টোপ।
এরপর গল্পের শব্দে শব্দে, বাক্যের পরতে পরতে চাই গল্পের বুদবুদ। বুদবুদ উঠছে, নামছে...মিলিয়ে যাচ্ছে আবার। ধরতে পারছি না, দেখতে পাচ্ছি না। বিশ্বাস করছি এমনটা হয়, হতে পারে, আবার থেকে থেকে অবিশ্বাসের ঘূর্ণি উঠছে; মুখ খুলে যাচ্ছে বন্ধ কৌটার, বেরিয়ে আসছে আশ্চর্য সব আখ্যান। পড়ছি আর ভাবছি, কেন এমন হচ্ছে? গল্পের মুখ্য চরিত্র বা পার্শ্ব চরিত্রটি কেন এমন করছে? কেন এমন নির্মম হচ্ছেন গল্পকার?
মাঝেমাঝে গল্প ভাববারও সুযোগ দিচ্ছে না, নিটোল চৌকাঠে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভাবনার সুতো, গুটি পাকিয়ে সামনে যতোই এগোচ্ছি খুলে যাচ্ছে বিস্ময়ের দুয়ার।
গল্পের কাছে বিস্ময় চাই কিন্তু গল্প পড়ে মুহুর্মুহু চমকে যেতে চাই না। ঘটনার ঘনঘটা চাই না। চাই না কৃত্রিম বিন্যস্ত পরিসর। চাই ঘটনার অদেখা অভিঘাত, আখ্যানের মোচড়। চাই অভিনব কিছু, যা আগে ঘটতে দেখিনি, তাই দেখতে চাই।
গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘মেয়ে' গল্পের মতো অভিনব আখ্যান চাই গল্পে। যে গল্প পড়তে বসে শেষ না করে আর উঠার উপায় থাকবে না। গল্প পড়তে পড়তে মনের ভেতরে তৈরি হওয়া কৌতূহলের নির্বাণ চাই গল্পের ভেতরেই। যেমন করে মেয়ে গল্পে অন্তঃসত্ত্বা লিপির জন্য বরাদ্দকৃত বাড়ির সব ভারি ভারি কাজ কে করে দিচ্ছে তা জানতে উদগ্রীব হয়েছি; লিপির সংসার সাফ সুতরো করে উঠান ঝাঁট দেওয়া, রান্না-বান্না করা, কলসিতে করে পানি তোলা ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজকর্ম চোখের নিমিষে হয়ে যাওয়ার অভিনবত্বে চমকে গেছি তেমন অভিনব কিছু চাই গল্পের কাছে। লিপির মতো অবাক দৃষ্টিতে দেখতে চাই, পরির মতো সুন্দর, চাঁপাকলির মতো আঙুল আর হরিণ চোখের একটি মেয়ে কী করে পেটের ওপর থেকে বেরিয়ে আসছে, একে একে ঘটছে অভিনব সব ঘটনা, চেনা আখ্যানটিও ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে। গল্পের কাছে চাই জীবনের চেনা বৃত্তের এমনই অচেনা পরিধি।
দাদীর মুখে গল্প শুনতাম ছোট বেলায়। থুত্থুড়ি বুড়ি, দাঁতহীন বুড়ি ঘুরেফিরে একই গল্প বলতো। সওদাগর বিবিকে রেখে বাণিজ্যে গেছে, ময়ূর পঙ্খি নাওয়ে চড়ে। মস্ত সে নাও। ময়ূরের মতো অগ্রভাগ তার। ঝড়ঝঞ্জা-উন্মত্ত ঢেউ কেটে কেটে নাও চলছে দেশ ছেড়ে ভিনদেশে। তীরে নাও ভিড়িয়ে সওদা করছে সওদাগর। আর তার বিবির জীবনে হচ্ছে দুঃখের সওদা। তার গর্ভে সওদাগরের সন্তানের বদলে সাপ বড় হচ্ছে। ঢাউস হচ্ছে পেট, দুষ্ট দাসী পানির সঙ্গে সাপের বাচ্চা খাইয়ে দিয়েছে বিবিকে। বানিজ্য সেরে সওদাগর বাড়িতে ফিরে চরিত্রহীন অপবাদে বিবিকে গৃহছাড়া করছে। আহা, বনবাসী বিবির শিথানে বিনবিন করছে দুঃখ। দুঃখে রাজ্যের পশুপাখি কাঁদছে, গুমরে মরছে দিনের আলো, রাতের অন্ধকার। দুঃখ-বেদনায় আমিও মুষড়ে যাচ্ছি...এই তো গল্প…তারপর কী হলো? সওদাগর কবে বিবিকে ঘরে তুললো? দুষ্ট দাসীর কী শাস্তি হলো?
এই তো গল্প…কী হলো কী হলো ঔৎসুক্যে মিশে থাকছে হাহাকার, তবু গল্পের সমাপ্তিতে যেতে চাইছি। আবার গল্পের কাছে এমন এক মর্মভেদী সমাপ্তি চাইছি যেন চোখ বুঁজে ফেলার পরেও আত্মার ভেতরে নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি বেজে চলে।
এখন সমাপ্তিটা যেমন চাই, যা চাই তা যখন পাই না তখনই আরেকবার গল্পটি বিশেষ একটি গল্প হয়ে উঠছে। যে উদগ্র ইচ্ছে নিয়ে মনে মনে শেষটার ছক কষে রেখেছি সেখান থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে যখন ভিন্ন একটি দিকে গল্পকার গল্পের প্রবাহটি ঘুরিয়ে দিচ্ছেন তখনই আবার গল্পটির শুরুতে চলে যাচ্ছি, পুনরায় পড়বো বলে। হোক সেই দিন বা অন্যদিন, গল্পটি পড়তে হচ্ছে দ্বিতীয় বার।
এদিকে এমনও হয়-ক্ষোভ জন্মে, অসহিষ্ণু হয়ে উঠি গল্পকারের বাল্যখিল্যতা বা নির্মমতায়, এমনটি হলো কেন? না হলেও তো পারতো। খুব কি অনিবার্য ছিল এমন সমাপ্তি?
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের "টোপ" গল্পের সমাপ্তিতে যখন জানতে পারছি, "কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়েল বেঙ্গলটা মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর-লোককে ডেকে দেখানোর মতো" তখন হরেক ভাবনা চেপে বসছে মনে। এই যে ভাবছি… ভাবছি…গল্পটিশেষ হয়েও "মনোরম চটিজোড়া" দগদগে ঘায়ের মতো জেগে থাকছে মনেসেই গল্পই চাইছি গল্পের কাছে।
গল্পের কাছে চাইছি আঘাত, আঘাতের ঘায়ে ভেঙেচুরে যেতে চাইছি, সময়মতো আঘাত থেকে প্রত্যাবর্তনও করতে চাইছি।
গল্পের সৃষ্টিকর্তার কাছে, তার গল্পের কাছে গল্পই চাই; নীতিকথা চাইনা, হিসাব পাল্টাতে চাই না জীবনের। গল্পের কাছে চাই গাল গপ্পো, যা কখনো কখনো সওদাগরের বিবির পেটে বড় হতে থাকা সাপের মতো গাঁজাখুরি মনে হবে, কখনো কখনো যা কঠিন, নিষ্ঠুর আর অবিচল সত্য হয়ে থাকবে।
8 মন্তব্যসমূহ
কী দারুণ লিখলে!সত্যিই গল্পের কাছে শুধু গল্পই চাই।
উত্তরমুছুননা না জানা কে হে এই শুভাকাঙ্ক্ষী...অনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনবাহ্। চমৎকার লিখেছ। গল্পের কাছে শেষ পর্যন্ত গল্পই চাই।
উত্তরমুছুনতোমার গল্পের কাছেও প্রত্যাশা অনেক রে বইন
মুছুনমাঝে মাঝে গল্প ভাবনার সুযোগ দেয় না একথা সত্য। সুন্দর সহজাত লেখা তোমার।
উত্তরমুছুনপাঠের জন্য ধন্যবাদ জানাই আপা
মুছুনএত সুন্দর ব্যাখ্যা। সত্যিই তো গল্পের কাছে এমন কিছু চাই যা পাঠ করার পরেও পাঠককে ভাবায়। প্রাঞ্জল লেখা, সাদিয়া।
উত্তরমুছুননগদে পড়ে ফেলেছো আপা ❤️
মুছুন