- হ্যাঁ। শুরু করা যাক্, বলল সারাহ।
- প্রেমিকের সাথে যে গোপনে সম্পর্ক রেখেছিলে, এমনকি টাকা-পয়সা পই পই করে সরিয়ে নিয়েছো, এসব করতে লজ্জা হলো না?
সারাহ চুপ। শরীরের গোলাপী আভাটা নিমেষেই উবে গেল। পিঠের উপর যেন কেউ চাবুক মারল। পিঠটান করে বলল,
- এগুলোতো কথা না। হুমকি। তুমি আমাকে কথা বলতে ডেকেছ।
মোজাম্মেল হক উচ্চস্বরে হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,
- তোমার প্রেমিকের টাকার দরকার ছিল সেটা বললেইতো পারতে, আমি সাহায্য করতাম। করতাম না?
- গলা নামিয়ে কথা বলো,... না করতে না। তুমি একটা আস্ত শয়তান।
- রিয়েলি? আমি শয়তান?
- হ্যাঁ, তুমি একটা পশু। শরীর ছাড়া কিচ্ছু বোঝ না। একটা মেয়ের শরীরে কি থাকে জানো? বৃষ্টির ভেতর ভিজে যাওয়ার শীতল এক অনুভব। সেই বোধটাকি তুমি চেনো?
- নাই যদি চিনি তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন? কুমিল্লার কাছাকাছি পৌছে দুজন একটা হোটেলে গিয়ে থেকেছো, দুপুরে ভাত খেয়েছো, রাতে জানালার বেগুনী পর্দা সরিয়ে বিছানায় প্রেম করেছ, ঘুমিয়েছ, এসব খবরতো তখন থেকেই আমার কানে আসছে। তোমার কি মনে হয় না চাইলেই আমি তখনই তোমাদের খুন করে ফেলতে পারতাম?
- হ্যাঁ পারতে। করলে না কেন?
- তোমাদের নাটক দেখবো বলে। কুমিল্লা থেকে যখন তোমরা কক্সবাজার গেলে। তোমার প্রেমিক গিটার বাজিয়ে ঐ গানটা শোনাচ্ছিল, ‘তুঝে ইয়াদ কারলিয়া হ্য্যয় আয়াত কি তেরা.....।’
- লোক লাগিয়েছিলে দেখ্ছি, হিন্দি গানের কথাও দেখছি ভালই মনে রেখেছ, একটু বাঁকা হেসে বলল সারাহ।
- তুমি পদ্মগন্ধার অভিনয় করেছ আর আমি সামান্য গানের দুলাইন মনে রাখতে পারবোনা! এই দেখো, বলেই তিনি ফোন খুলে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখাবার চেষ্টা করলেন।
- সারাহ বলল, ব্ল্যাকমেইল করছো?
- তোমার তুলনায় এ তো কিছুই না। কতকিছুইতো করতে পারি, তুমি জানো। অথবা অন্তত অনুমান করতে পারো।
- হ্যাঁ পারি। তবে করছো না কেন?
- জানিনা... তবে একটা শর্তে তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।
- কি শর্ত?
- যদি তুমি শেষবারের মতন গভীরভাবে আমাকে একটা চুমু খাও।
- অসম্ভব। আগেইতো বলেছি, তোমাকে ভালোবাসি না।
- তবে তোমাকে জোর করে ধরে আমি চুমু খাবো। বলেই তিনি সারাহর হাত দুটো শক্ত করে ধরে ফেললেন। সারাহ চিৎকার করতে লাগল, ‘একবার ধরেছোতো তোমার নাক ফাটিয়ে দেবো।’
ধড়ফর করে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন মোজাম্মেল হক। বড্ড সিনেম্যাটিক স্বপ্নদৃশ্য। দরদর করে ঘামছেন তিনি। রক্তে লোহিত কণিকাগুলো প্রবল বেগে ছুটছে। শরীরটাও ফুঁসছে। জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য খুঁজছে। মাথাটা ঘুরিয়ে বেডসাইড টেবিলে রাখা যুগল ছবিটার দিকে তাকালেন। বিয়ের ছবি। উজ্জ্বল সোনালী রঙের উপর সাদা পাথর বসানো মসলিন সিল্ক শাড়ী পরা। কাল্পনিক অথবা অতীত স্ত্রী। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। কীযে অপূর্ব লাগছে দেখতে। পাশে ছাইরঙা স্যুট-টাই পরা মোজাম্মেল হক ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছেন সারাহকে।
বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গেলেন তিনি। বাড়িটা সুনসান । কাজের লোকেরা ঘুমিয়ে আছে। হাত মুখ ধুলেন। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে নিজেই চা বানালেন। এই ঘন দুধের চা টা সারাহর খুব পছন্দ ছিল। মোজাম্মেল হক ধবধবে সাদা মগে ঘন চা’টা ঢেলে একটা চুমুক দিয়েই উচ্চারণ করলেন, ‘আহ!’
২
ঘটনাটা মোজাম্মেল হককে একটা গাঢ় বিষাদ আর বিপর্যস্ত অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। একটা উচ্ছন্ন বোধ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি আয়নায় দিয়ে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছেন। বিয়ের মাত্র ছ’মাসের মাথায় গয়নাগাটি, দামী কাপড়চোপড়, এমনকি বিছানার চাদরশুদ্ধ টেনে তুলে নিয়ে চম্পট মেরেছে তার নায়িকা!!! জনপ্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে বহাল একটা মানুষের পক্ষে এটা হজম করা কি সহজ? অভিমানে পাথর হয়ে বসে রইলেন তিনি কিছুদিন। একটু বেশী বয়সেই সারাহকে বিয়ে করেছিলেন। ঝগড়াঝাটি কিচ্ছু হয়নি। হানিমুনে দুজনে বালি দ্বীপে বেড়াতে গেছেন। সৈকতের আরাম কেদারায় শুয়ে ডাবের জল পান করেছেন। সূর্যাস্ত উপভোগ করেছেন। রাজনীতি অর্থনীতি এসব বিষয় ছাড়া মোজাম্মেল হকের ঝুড়িতে বেশী কিছু ছিল না।
হালকা গয়না আর ফুলের মালায় অপূর্ব দেখাত সারাহকে। ঘুমে, স্নানে, প্রসাধণে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁকে দেখতেন মোজাম্মেল হক। ধূসর নীল চোখের মনিতে মগ্ন হয়ে ডাকতেন, ‘পদ্মগন্ধা’। হাসিটা দেখলেই প্রেমে ডুবে যেতেন। শেষ পর্যন্ত লোভ সামলাতে না পেরে খুব তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা সেরে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন এই বয়সের প্রেম কি আর অত ঘন হয়? যা হয়েছে ওতেই বেশ চলবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, সব জলে গেছে। প্রেম ট্রেম কিচ্ছু ছিল না। হয়ত অনেক পুরুষই সারাহর প্রতি অনুরক্ত ছিল। অথবা সারাহও অনুরাগী ছিল অন্য পুরুষে। কে জানত!
ঘটনার সময় তিনি অফিসের কাজে বিদেশ ভ্রমণ করছিলেন। ফিরে এসে দেখেন পুরো বাড়ি খালি। ড্রাইভার, পিয়ন, বাবুর্চি, সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বউ ভেগে গেছে এক গায়কের সাথে! মোজাম্মেল হকের মনে বিষয়টি গভীর দাগ কাটল। শোক হজমের প্রক্রিয়া হিসেবে একটা অদ্ভূত জগতে প্রবেশ করলেন তিনি। কিছুদিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম নিলেন। তারপরও বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা থামে না। পেট গুড় গুড়, বুক ধড়ফড়, মাথায় চিন চিন ব্যাথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তুখোড় ছাত্র, চাকরীতে যার তরতর প্রমোশন হয়েছে, প্রতিদ্বন্দিতায় কেউ হারাতে পারেনি তাঁকে। তিনিই কিনা এত বড় একটা ধোঁকা খেলেন? মনে মনে হিসেব কষলেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার কি শাস্তি হওয়া উচিত? অবিশ্বাস্য কিছু পরিকল্পনাও তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকল।
শেষবার বিদেশ যাবার সময় সকালে চায়ের কাপটা নিজের হাতেই বয়ে এনেছিল সারাহ। ঘন হয়ে পাশে বসতেই পদ্মগন্ধার গায়ের কামগন্ধ মোজাম্মেল হককে উষ্ণ প্রেমে উৎক্ষিপ্ত করে। ঘন হয়ে পাশে বসতেই মোজাম্মেল হক খপ্ করে তার স্তনগুলো ধরে টিপে টিপে গভীর কামনা নিয়ে আদর করতে চাইলে বাঁধা দেয় সারাহ। আর তখনই গরম চা’টা উপচে পড়ে সারাহ’র নাইট গাউনে। অস্বস্তিটাও ঢেকে রাখতে পারে না সে। কোমল স্বরে বলে, ‘ইউ আর এ বিচ। দিলে তো চা টা ফেলে?’
সেটিই ছিল দুজনার শেষ দেখা।
৩
কয়েকজন দুর্ধর্ষ খুনীকে চেনেন মোজাম্মেল হক। তারমধ্যে উলফাৎ আর ময়নাই সবচাইতে ধাঁরালো। এরা এক পোচে কেটে আসে। দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। জেলে ঢুকলে তিনদিনের মাথায় খালাস পেয়ে নির্বিঘ্নে চলাফেরা শুরু করে। তবে এদের বুকিং পাওয়াটাই একটু মুশকিল। একেতো টাকার পরিমাণ বিশাল। দ্বিতীয়ত গা ঢাকা থাকলে চট্ করে ওঁদের খুঁজেও পাওয়া যায় না। প্রথমে যে খুনীর কথাটা মোজাম্মেল হকের মাথায় এলো তার নাম উলফাৎ তরফদার। সে কলকাতার বালিগঞ্জের একটা গলিতে ভাড়া থাকে। এলাহীর মাধ্যমে মোজাম্মেল হকের সংগে তার যোগাযোগ। ‘ভারতীয় হিন্দু’ তার পরিচয়। মুসলমান হলেও শরীরে কোন মুসলমানির চিন্থ নেই। শৈশবেই বাবা-মা মারা যাওয়ায় একেবারে টোকাই হয়ে বড় হওয়া। ধর্মীয় পরিচয়ের আলাদা কোন অনুভূতিও নেই তার। এমনকি খোঁজ করার মত কোন লোকও পৃথিবীতে নেই। এলাহী এঁকে কোথা থেকে খুঁজে বের করল কে জানে! এসব ব্যাপারে তাঁকে বিদগ্ধ বা কোপনস্বভাবের দুটোই বলাই যায়। মোজাম্মেল হক সরাসরি এঁদের কারো সাথেই যোগাযাগ করেন না। এলাহীই বলেছিল, ‘বুঝলেন স্যার, কেউ প্যান্ট খুইলা দ্যাখলেও সমস্যা নাই। যখন যে দেশে যেমুন, উলফাৎও তেমুন। টেনশন নিয়েন না। খালি অর্ডার মারবেন। কাম খতম।’ বাংলাদেশে এসে একেকটা মিশন শেষ করেই আবার সে ভারতে গা ঢাকা দেয়।
দ্বিতীয়জনের নাম মালিক এস্কান্দার ওরফে ময়না। পেশাদার খুনী। অভাবের সংসারে চাপ সামলে উঠতে না পেরে অপরাধ জগতে ঢুকে পড়েছে। অপরাধ, যৌনতা, দুটোই নিয়মিত চলে তার। কয় জোড়া মামলা কাঁধে নিয়ে ঘুরছে কে জানে। তারপরও খুনের নেশা থামে না। একেকটা খুন করেই সে ভ্যানিশ হয়ে যায়। কেউ তাকে ধরতে পারে না। ছোট্ট এক টুকরো ছাদ বা অন্ধকার সিঁড়ি বা ঘরের কোণই ওঁর জন্যে যথেষ্ট। নেশার মধ্যে নাক ডুবিয়ে ফুক ফুক করে সিগারেটের ধোঁয়া টেনেই চলে যায় জীবন। মাঝে মাঝে পতিতালয়ে যায়। কিন্তু মেয়ে মানুষ তাকে বিশেষ একটা টানে না। সত্যি হলো, ইশ্বরের আগে বা পরে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা হলো ‘টাকা’। ছন্নছাড়া স্বভাব হলে কি হবে, চিন্তায় সে প্রখর। টাকা না হলে ড্রাগ হবে না। কাজেই মোজাম্মেল হককে খদ্দের করতে তাঁর কোন অসুবিধেই নেই।
খুনিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে গোটা একদিন মোট দশবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলেন মোজাম্মেল হক। বুকের কেশসম্ভারের দিকে তাকিয়ে আগের সেই সাহস সঞ্চিত আছে বলে মনে হলো না। বাবার সেই মৃত্যু তুফান এখনও তাঁকে ক্ষুদ্র করে তোলে। তিনি ভাবলেন, খুনের কথা চিন্তা করার আগে যে গায়কের সাথে সারাহ ভেগে গেছে তার একটা সন্ধান করা দরকার। তিনি গায়কের একটা ছবি যোগাড় করলেন। দশ বাই বারো ইঞ্চি কালার ফটো। ছবিতে গায়ক গোল গলার একটা টি শার্ট পরে আছে। গলায় ঝুলানো মোটা সোনার চেন। টি শার্টের উপর একটা চামড়ার কোটি। আর প্যান্টের সংগে মোটা বেল্ট। বেল্টের মাঝখানে বড় গোল বকলেস। বয়স বড়জোর পয়ত্রিশ কি আটত্রিশ। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। সুদর্শনও বটে। ছবি দেখে মনে পড়ল, বিয়ের রিসেপশনের দিন লোকটিকে তিনি দেখেছেন। খাওয়া দাওয়া শেষে হাত মোছার জন্য এই লোকটিই সারাহর হাতে একটা সাদা রুমাল গুজে দিয়েছিল।
ছবিটা দেখার পর থেকে মোজাম্মেল হকের ক্রোধ আট গুণ বেড়ে গেল। ব্রহ্মতালুতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। সারাহ তাকে এতটাই অবহেলা করেছিল? আগে জানলে ঐ লোকটাকে পিটিয়ে চামড়া তুলে ফেলতেন তিনি। ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে মেরে ফ্যালাটাও কঠিন কোন ব্যাপার ছিল না। তারপর সেই ঝুলন্ত মৃত শরীরটা সারাহকে দিয়ে চাটাতেন। এবং এই দৃশ্যটা মনে মনে যোগ করে ফেলে মোজাম্মেল হক কিছুটা অস্থির হলেন। নাহ! এতটা অসভ্যতাটা করাটা বোধহয় ঠিক হবে না। আবার এটাও ভাবলেন, ঐ হারামীটাতো উনার নখের ডগারও যোগ্য নয়। ওর মধ্যে কি পেল সারাহ? যা তাঁর মধ্যে নেই! মনে মনে ভাবলেন, বিয়েতে তিনি বিশ ভরি সোনার অলংকার উপহার দিয়েছিলেন। শাড়ী, গাড়ি কসমেটিকস, অন্যান্য জিনিসতো রয়েছেই। তার চেয়েও বড় কথা সারাহর শরীরে ঢুকেছে তাঁর বীর্য। তিনি অপেক্ষা করে ছিলেন রাজপুত্রের মতন দেখতে একটা ফুটফুটে নীল চোখের সন্তান হবে তাঁদের। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে তাকে। সে হয়ে উঠবে ভবিষ্যত মোজাম্মেল হক।
৪
লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের বাগান বাড়িতে বড় বড় দেশী বিদেশী রাজনীতিবীদ, সরকারী কর্মকর্তারা ছাড়াও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকদের নিয়ে পার্টি হচ্ছিল সেদিন। মোজাম্মেল হকও আমন্ত্রিত ছিলেন। ফার্স্ট লেডিরা ঘুরে ঘুরে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছিলেন। এর মধ্যে একজন বৃটিশ নাগরিক তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শাড়ী পরা বাঙালী। মোজাম্মেল হককে দেখে তিনি নিঃসংকোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ? আর ইউ এ বেঙ্গলী? মোজাম্মেল হক বললেন, ‘ইয়েস আই এম।’ ভদ্রমহিলার চোখমুখ যেন সাথে সাথে চকচক করে উঠল। উনি মোজাম্মেল হককে টপ-টু-বটম দেখে নিলেন। স্যুট টাই, চকচকে জুতো, রিমলেস চশমা, দামী ঘড়ি। আন্দাজ করলেন বয়স পঞ্চাশ বা তার একটু বেশীই হবে।
বাগানের একদিকে খাবারের ব্যবস্থা আর আরেকদিকে হালকা গান চলছে। একজন গায়ক খুব ভারী কন্ঠে গাইছে, ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে হৃদয়ের কোঠরে রাখব, আর হৃদয়ের চোখ মেলে তাঁকিয়ে সারাটি জীবন ভরে দেখবো...।’ হাইকমিশনার সাহেব সারাহর বৃটিশ স্বামীর অনুপস্থিতিতে মোজাম্মেল হকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাই ফ্রেন্ড, গিভ হার সাম টাইম।’ সেই প্রথম সারাহর সাথে পরিচয়। মা বাঙালী আর বাবা বৃটিশ। বিশ্বযুদ্ধের পর পর স্বামীর সাথে ইংল্যান্ড পাড়ি দেয় সারাহর বাবা-মা। পরবর্তীতে সারাহ একজন বৃটিশকেই বিয়ে করে। বোঝাই যাচ্ছে সেই বিয়ে সুখের হয়নি। সামান্য পরিচয় নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন মোজাম্মেল হক। এর পর নিয়মিতই ফোনে কথা হতো। কথাতো নয় যেন শরতের মেঘ উড়ে আসত। এবং শেষ পর্যন্ত সংসার ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসতেও দ্বিধা করেনি সে। সারাহ’র ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে মোজাম্মেল হকের যে একটু স্পর্শকাতরতা ছিল না তা নয়। কিন্তু প্রেমে জল পড়লে আয়নাতো একটু বেশী স্বচ্ছ লাগেই।
৫
এলাহী আর মোজাম্মেল হক একটা পরিত্যাক্ত বাড়িতে দেখা করতে এসেছে। ঢাকা শহর থেকে একটু দূরে উত্তরার পরে অনাবাসিক এলাকায়।
এলাহী প্রশ্ন করল, ‘স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা কইতে পারি?
- বলো
- নিজের স্ত্রীকে মেরে ফেলার আদেশ দিতে আপনার খারাপ লাগতেসে না?’
- না। কন্ঠস্বরে দৃঢ়তা ও রুঢ়তা দুটোই। গলার চামড়ার তলায় বেগুনী শিরাগুলো ফুলে উঠেছে।
- সত্যিই স্যার? একটুও খারাপ লাগতেসে না?
- না। ...বলেই মোজাম্মেল হক বুঝলেন, মাথার ভেতর তীব্র বিষক্রিয়া ঘটছে। শিরা-উপশিরাগুলো নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করছে।
- কেন স্যার?
- আমি বিশ্বাস করি, মানুষ মরে একবারই। ওর মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। গম্ভীরভাবে বললেন তিনি।
- বলেন কি স্যার? বলেই মনে মনে ভাবলো, ‘ওরে মোজাম্মেল, তুই একটা হারামীর হারামী, শয়তানের শয়তান! আজকে যা বলছিস্ কালই যে তা বদলে যাবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। শুয়োরের বাচ্চা কোথাকার!’
- হ্যাঁ। আমি শুধু ওকে স্বর্গে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছি। খুনের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলো এলাহী। অযথা কথা বাড়াবে না।
- এলাহী একটু বিব্রত হয়ে বলল, না...মানে স্যার, এমু...ন একজন সুন্দরী মহিলা! একটা হাত বা পা কাইটা দিতে বলি স্যার, একদম না মাইরা? বা একটা রগ কাইটা দিলেই তো হয়? অথবা স্যার, মাথায় রক্তক্ষরণ হয় এমন কিছু একটা কিছুও করা যাইতে পারে।
মোজাম্মেল হকের গলায় বিস্ফোরণ!
- আই শালা, একদম চোপ! আর একটা কথাও বলবি না। যা বলছি তাই কর! বলেই রাগে কাঁপতে থাকেন। মুখটা পাথরের মত শক্ত। পকেট থেকে একটা ইনহেলার বের করে ফস্ ফস্ করে কিছুটা বাতাস গিলে ফেলেন তিনি।
- এলাহী ঠান্ডা স্বরে বলে, এত রাইগা গেলে কি হয় স্যার? মনেতো কত প্রশ্নই আসে। আপনেরে এইসব শুনতে হইব। আমি না কইলেও মাইনষ্যেত আর মুখ বন্ধ রাখবো না। মানুষ মাইরা ফেলাতো সহজ কাম না স্যার। এইসব কাজে মাথা ঠান্ডা রাখন লাগে। আত্মহত্যা বইলা চালাইতে গেলেওতো বহুত মাথা ঘামাইতে হয়।
এর আগে মোজ্জামেল হক এলাহীর মাধ্যমেই আরেকটা খুন করিয়েছিলেন। দারুণ ঠান্ডা মাথায় কাজটা সেরেছিল সে। কাকপক্ষীও টের পায়নি। কয়েকটা টাকার বান্ডিল খোয়া যাওয়াতেই ঝামেলাটা বেঁধেছিল। অফিসের এক কর্মচারী, গরীব মানুষ। টাকাটা মারতে চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়তেই সব গোলমাল বেঁধে গেল। সাক্ষীদের এক পোচে সরিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি মোজাম্মেল হক। এবার তাঁর স্ত্রীর পালা। একেতো টাকা-পয়সা হাতিয়েছে, তার উপর তার চাইতে কম বয়েসী এক গাতকের হাত ধরে পালিয়েছে। ভেগে আর যাবে কোথায়? বড় জোর ঢাকার বাইরে অন্য কোন শহরে? অশ্ব আর গজ নিয়ে কে যে কাকে হারাবে এই খেলায়?
এলাহী বলল,
- স্যার, ম্যাডাম যেই লোকটার সাথে ভাইগা গেসে সে নাকি হিন্দু। নিচু জাতের লোক। এরা কোথাও চাকরী বাকরী পায় না। এই কারণে গান গায়। শুকর, গরু, গু-মুত সবই খায়। মদতো খায়ই। আপনি শুকরের গোশ্ত খান স্যার?
- না।
- মদ খান?
- হুম।
- স্যার, কোন্ মদ খাইলে বেহেশতের সুখ পাওয়া যায়?
- এত বক্ বক্ করো কেন এলাহী? বাজে কথা ছাড়ো। আসল কথায় আসো।
- স্যার, দুইজনই বান্দরবানের পাহাড়ে লুকায় আসে।
- লুকিয়ে আছে কেন?
- আপনার ভয়ে স্যার।
- তাও ভাল, ভয় পাচ্ছে। না পেলেই বরং আশ্চর্য্য হোতাম। তো...কাজটা কে করবে? উলফাৎ না এস্কান্দার? নাকি দুজনকেই পাঠাবে?
- টাকা কত দিবেন সেইটার উপর নির্ভর করতেসে, স্যার। সস্তায় কি কোন ভাল খুনী পাওয়া যায়?
- আমার সাথে দরদাম কবে থেকে শুরু করলা এলাহী?
- দিনকাল ভাল নাই। কামকাজ নাই। পাহাড়ে ঐগুলারে খুঁইজা বাইর করাটাইতো একটা বিশাল কাম, স্যার। তার উপর ধরেন সেনাবাহিনীর পাহারা তো আসেই। কাজটা সহজ না।
- বুঝলাম।
- স্যার... মাইরা ফ্যালানোটা কি খুব জরুরী?
- না। জরুরী না। জ্যান্ত ধরে আনতে পারলে আনো। আরো বেশী টাকা পাবে। কোনরকম রাগ না দেখিয়েই বললেন মোজাম্মেল হক।
- আপনি আসলে খুন করতে চান না স্যার।
- শোন এলাহী, আমার বাবা ছিলেন একজন কবিরাজ। টাকা-পয়সা ছিল না বলে উনি বন-জঙ্গল থেকে পাতা, কষ, এসব কুড়িয়ে এনে ঔষধী বানাতেন। তারপর সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। একবার এই অসুধ খেয়ে এক লোক মারা গেল। এই ঘটনায় গ্রামের লোকজন নির্দয়ভাবে বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করল। গাছ লতা-পাতার বিষাক্ত তরলতার নেশা আমি চিনি। কিন্তু সেই নেশায় বিশ্বাস ছিল না। কবিরাজ হবার মত যথেষ্ট প্রতিভা থাকা স্বত্তেও আমি ঘুরে ঘুরে জায়গীর থেকেছি, পড়াশুনা করেছি। খান বাহাদুরের বাড়িতে টিফিন বাক্সে ভাত দিত। একটু ভাত, একটু শাক, একটু ডাল। পেট ভরত না। ভাতের ক্ষুধা কি জিনিস, আমি জানি, এলাহী। নিজেকে হয়ত আমি খুব বেশীই ভালোবাসতাম। তাই নীতিফিতী উদম করেই এখানে এসেছি। কি বলছি, বুঝতে পারছ?
- হুম। বলেই এলাহী চুপ মেরে গেল।
৬
সব ব্যবস্থা পাকাপাকি। মোজাম্মেল হক ফোনটা হাতে নিয়ে শান্ত ও গম্ভীর কন্ঠে নাম্বারগুলো টিপলেন।
ওপাশ থেকে এলাহীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘স্যার...’
মোজাম্মেল হক একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘পোঁচ মেরে দে...।’ বাক্যটা বাতাসে ভাসতে থাকল। ‘পোচ মেরে দে...।’‘পোচ মেরে দে...।’ ‘পোচ মেরে দে...।’ যেন কথাটা আকাশে উড়ে উড়ে গিয়ে কোপ মেরে দিল যথাস্থানে।
তারপর চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক...
এর মধ্যে মোজাম্মেল হক কত কাপ চা পান করেছেন তার হিসেব নেই।
চারদিন পর চায়ের উষ্ণতা ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করলেই মোজাম্মেল হক হঠাৎই যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। এটা তিনি কি করলেন? দুজনকে না মেরে গায়কটাকে মেরে ফেললেইতো ল্যাঠা চুকে যেত। আহা এত সুন্দর দুধে-আলতা রঙের শরীর! যার পরতে পরতে ছিল সুখ! কি দরকার ছিল সেটাকে বিসর্জন দেয়ার? প্রেমের স্বার্থেই কিছুটা হলেও চঞ্চল হলেন তিনি। মনে পড়ে গেল, সারাহ যখন সাজ শেষে ঘাড়ের পেছনে চেনের হুকটা লাগিয়ে দিতে বলতো, একটা বিলেতী পারফিউমের ঘ্রাণ মগ্ন করে দিত তাঁকে। সব অসহিষ্ণুতা উবে যেত মুহূর্তেই। কী যে এক মাদকতায় ভাসতেন তিনি! কোথা থেকে যেন সেই একই সুবাতাস হঠাৎ তাঁর নাকে এসে লাগল। আবিষ্ট হয়ে রইলেন তিনি কিছুক্ষণ। ভেতরে ভেতরে তড়পাতে লাগলেন।
তারপর দ্রুত গতিতে ফোনটা হাতে নিয়ে একই নাম্বারগুলো টিপতে থাকলেন। একবার, দুবার, তিন বার, চার বার! বার বার! নাহ! এলাহী ফোনটা ধরছেই না। মনে মনে আওড়ালেন, ‘এলাহীর বাচ্চা এলাহী, ফোন ধর্! ফোন ধর্!!’
ততক্ষণে এলাহী, উলফাৎ আর এস্কান্দার বান্দরবানের পাহাড়ে।
সারাহ ও তার প্রেমিক একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে প্রকৃতির নৈর্সগিক দৃশ্য উপভোগ করছে। উপরে মেঘমালা তুলোর মতন ভাসছে। ক্ষণে ক্ষণেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে সূর্য। দূরে পাহাড়ে ছোট ছোট বাড়িগুলো ঝুলছে।
উলফাৎ আর এস্কান্দার পাহাড়ের ঢালুতে শুয়ে দৃশ্যটা দেখছে। পকেটে ভারী বস্তু। একের পর এক সিগ্রেট ফুঁকছে দুজনই। এলাহী আরেকপ্রান্তে। দ্বিধাগ্রস্ত। দূর থেকে দেখছে আর ভাবছে একটা ধাক্কা দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। একেবারে তলায় গিয়ে হয় পাথরে পিষ্ট হবে নইলে জলে ডুবে মরবে। গুলি খরচ করার তো কোন মানেই হয় না। কিন্তু তাতে অবশ্য মৃত্যু নিশ্চিত হবে এমনটা বলা যায় না। বেঁচেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ছুরি দিয়ে পোঁচ মারাটাই শ্রেয়। কিন্তু এমন প্রেমিক যুগলকে কি মেরে ফেলা ঠিক হবে?
পকেটে টাকাটা ঢুকে গেছে। এখন কি আর ফেরার উপায় আছে?
ঠিক সেই সময়ই এলাহীর ফোনটা বেজে ওঠে। অপরিচিত নাম্বার। ধরবে কি ধরবে না দ্বিধা করে সে। রিং টোনটা বেজেই চলে। পঞ্চাশ সেকেন্ড বাজবার পর বোতাম টিপে শব্দটা বন্ধ করে দেয় এলাহী।
মেঘগুলো পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খায়। ঝাকে ঝাকে পাখি উড়ে যায় দিগন্ত পানে। বনধোয়ানী ঝর্ণার জল শব্দ করে ঝরে। মাঝে মাঝে প্রাণীদের সবল চিৎকার প্রতিধ্বনি তোলে।
ঝুলে থাকা আঁঠরালতা পাতাগুলো থেকে টুপ টুপ জল পড়ে।
10 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভাল।
উত্তরমুছুনএকটানে পড়ে ফেললাম
উত্তরমুছুনপ্রেমে জল পড়লে আয়নাতো একটু বেশি স্বচ্ছ লাগেই। অসাধারন। খুব ভাল লাগলো। লেখকের জন্য শুভকামনা।
উত্তরমুছুনদারুণ!
উত্তরমুছুনভালো লেগেছে। কিছু বানান যেমন শুনশান(হবে সুনসান), দুর্ধষ(হবে দুর্ধর্ষ)সহ আরো বেশি কিছু বানান বিভ্রাট আছে। (আমারও প্রচুর বানান নিয়ে সমস্যা আছে)। আপনাকে অভিনন্দন।
উত্তরমুছুনগল্পটি বেশ ভালো। লেখা হয়েছে কুশলী গদ্যে। কাহিনির টান অসীম। উনির এবং স্বর্ণ, এই দুটি শব্দ মনে ধরেনি।
উত্তরমুছুনচমৎকার
উত্তরমুছুনবাহ
উত্তরমুছুন'অর্থনীতি রাজনীতি এসব বিষয় ছাড়া বেশী কিছু ছিল না মোজাম্মেল হকের ঝুড়িতে' (: বাহ্
উত্তরমুছুনচমৎকার গল্পটা পড়লাম । লেখককে সালাম
চমৎকার গল্প, পড়ে বেশ ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন