বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন। তল্লাটের ছেলেবুড়ো মেয়েমরদ তাকে চিনত কিন্তু তিনি কোত্থেকে এসেছেন কেউ বলতে পারত না। ফুলের মাসে সারা অঞ্চলটা নিমফুলের গন্ধে ম ম করত, দেখনচাচা মগডালে বসে পা দোলাতেন, বলতেন: বলত ছোঁড়ারা ফুলের গন্ধে গুয়ের গন্ধে তফাৎ কি? ছেলেরা কিছু বুঝতে পারত না, খুব একটা ইয়ার্কি ভেবে হি হি হেসে পালিয়ে যেত।
মানুষের ঐটেই মানায়। বাঁশবাগানে সোনার জ্যোৎস্না উঠলে তিনি ঘোড়ানিম থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, জিভ দিয়ে চেটে সেই সোনার পাতের ঠাণ্ডা নিতেন। বাঁশবাগানের গায়ে একটা ডোবা ছিল, তাতে ব্যাঙেরা ভেসে থাকত। দু হাত-দুপা দিয়ে হেঁটে দেখনচাচা সেই জলে নেমে পড়তেন। তারপর যখন তিনি উঠে আসতেন— জল-পাঁক-মাখা তার শরীর-- বুকে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকলে তাকে অতিকায় এক আদিম সরীসৃপের মত মনে হত।
দেখনচাচা বলতেন সব শালারই ফুটো-ফাটার ধান্দা! বলে থপথপ করে উরত বাজালে লোকে হাসত। বলত: ফুটোটা বুঝলুম ফুটোপয়সা কিন্তু ফাটাটা কি... হি-হি-হি। দেখনচাচা খেপে গিয়ে ‘বিশ্বাস করলি না হতভাগারা’ বলে বসতেন, তারপর একজনের গর্দান ধরে ‘ওঁ ক্লিং ক্লিং বৌটায় ফট্ সাহা’ মন্ত্র পড়লে তার চোখে দিব্য-দৃষ্টি হয়ে যেত, সে দেখত নায়েবমশাই পা টিপে টিপে তার বিধবা শালীর ঘরে ঢুকছে, হাজার একর জমির মালিক চৌধুরীমশাইয়ের গোলায় বেওয়ারিশ ইঁদুরেরা ধান খেয়ে যাচ্ছে চুপিচুপি, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জলপানি-পাওয়া ছেলে আসন্ন পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে রামপ্রসাদী গাইছে, আমায় দে মা তবিলদারী... তারপর গর্দান ছেড়ে দিয়ে বলতেন; দে শালা দে, দুটো পয়সা দিয়ে যা... অনেক দেখেছিস...
এই সব তন্ত্রমন্ত্রের জন্য সবাই দেখনচাচাকে ভয় করত, কেউ ঘাঁটাতে সাহসী হত না। খেত থেকে কলাটা মুলোটা লোকে আদর করে দিল যেত, দেখনচাচা ঘোড়ানিমের ডালে বসে সেগুলো কাঁচা চিবিয়ে খেতেন। তার পরনের কাপড়খানা অনেক সময় গাছের মগডালে থাকত। গ্রামের ঝিবৌরা যাওয়ার সময় হঠাৎ ঐভাবে দেখনচাচাকে দেখে ফেললে মুখ ঘুরিয়ে বলত: মাগো... দেখনচাচা বলতেন: মুখে যাই বলুক মনে তারা আনন্দ পাচ্ছে।
একবার এই রকম একটা ঘটনা ঘটল। চৌধুরী মশাইয়ের বড় জামাই সস্ত্রীক কলকাতা থেকে বেড়াতে এলেন। একদিন ভোরবেলা তিনি বৌ নিয়ে বেড়াচ্ছেন হঠাৎ চাচাকে গাছের আগায় ল্যাংটো হয়ে বসে থাকতে দেখলেন। দেখনচাচা তাকে দেখে হিহি করে হাসলেন, ‘চমৎকার যুবতী বৌ তো তোমার’ বললেন। সেই নবযুবকের এই সব ইতরামির মতো ব্যাপার সহ্য হল না, লোকজন ডেকে চাচাকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে কী মার! হাড়গোড় বুঝি ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল মারের পরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ‘আমি কিন্তু সত্যি কথাই বলেছিলাম’ বলে হাসতে হাসতে দেখনচাচা ঘোড়ানিমের আগায় চলে গেলেন।
মাঝরাত্তিরে দেখনচাচা কি করতেন কোথায় যেতেন কেউ জানত না। কেউ কেউ বলত তাকে দুহাতে দুপায়ে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় অন্ধকারে। কেউ কেউ বলত তিনি শব সাধনা করেন শ্মশানে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন: দেশের সমস্ত ধান ইঁদুরে খেয়ে ফেলছে দেখতে যাই, জ্যোৎস্না রাতে আকাশের চাঁদ কেমন বিধবা যুবতীর মতো এলোমেলো হয়ে যায় দেখতে যাই। এ রকম দু-একটা কথা শুনে লোকের প্রবৃত্তি হত না-- চলে যেত। দেখনচাচা তাদের চলে যাওয়ার দিকে হি হি হাসি ছুঁড়ে মারতেন।
এই রকমের ছিলেন দেখনচাচা আর তার শেষ কয়েকটা দিন বড় অদ্ভুত কাটল। গ্রামে কলেরা এসেছিল। এমন কলেরা বুড়োরাও জীবনে দেখেনি। প্রথমে এল জেলে পাড়ায়। জোয়ান বিশু জেলে দুপুরে ভাত খেয়ে মাছ ধরতে গেল, ফিরে এসে কয়েকবার ভেদবমি করল, তারপর সব ঠাণ্ডা। ঘণ্টা দুয়েক পরে বিশুর বৌয়ের হড়হড়ে পায়খানা শুরু হল। ক্রমশ সমস্ত জেলেপাড়ায় ছড়িয়ে গেল অসুখ। একরাত্রে সেখান থেকে নটা মরার সংবাদ পাওয়া গেল। সকালে বামুনপাড়ার দিকে রোগ চলে এল। সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত, কে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুপুরের মধ্যেই বামুনপাড়া থেকে গোটা-পাঁচেক মড়া বেরোতে গ্রাম ছেড়ে লোক পালাতে সুরু করল। যে যেখানে পারছে চলে যাচ্ছে। বৌ-ছেলে মা-বাপের দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই। সবাই তখন নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। সন্ধের দিকে কায়েত পাড়ায়ও ভেদবমি সুরু হল। যে কজন সাহসী লোক পাড়ায় ছিল, সাহস দেখিয়ে যায়নি, নানা ছুতোয় তারাও সরে পড়তে লাগল। গৌর মণ্ডল যুবক, তার বৌ মনোরমা একবার পায়খানা করে এসেই বারান্দায় পড়ে গেল, চোখের তারা মরা মাছের মতো নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। গৌরের বাপ বলল: গৌর যদি প্রাণে বাঁচতে চাস ত এই বেলা চল পালাই। গৌর একবার বৌয়ের দিকে চেয়ে দেখল, বৌয়ের প্রতি তার বড় টান, ওই শরীর তখনও পরিপূর্ণ যুবতী। বাপ ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল: বৌ একটা গেলে আর একটা হবে কিন্তু জান্ একবার গেলে.... বাপের বাক্য শিরোধার্য করল গৌর। বৌটা সম্ভবত কিছু আন্দাজ করে ‘আমায় নিয়া যাও আমায় ফেলে যেওনা দোহাই পায়ে পড়ি’ এই রকম বলতে বলতে রাস্তার ধারে এসে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। সে যেখানে পড়ল সেটা ঘোড়ানিমের গাছতলা, তার ওপরে দেখনচাচা বসেছিলেন। বৌটার অবস্থা দেখে নেমে এলেন, এসে টিপে টিপে হাত-পা দেখলেন, চোখের তারা দেখলেন, বুঝলেন চিকিৎসা করলে এখনও বাঁচতে পারে। কয়েকজন লোক তখন এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তিনি তাদের ডাকলেন, বললেন, মেয়েটার একটু সেবা কর বেঁচে যেতে পারে, কিন্তু তারা পালিয়ে গেল দূর দিয়ে, গাছের ছায়াও মাড়াল না। দেখনচাচা দেখলেন, দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর মিনিট-দুই কি ভেবে ‘ব্যোম তারা’ বলে হাঁটুগেড়ে বসলেন মেয়েটার কাছে, তার কোমরের কাপড় আলগা করে দিলেন। কাপড়টা গুয়ে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, মুখের গাঁজলা বমি মুছিয়ে দিলেন। জল এনে ধুয়ে মুছে তাকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন। বেশ কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় মেয়েটার জ্ঞান ফিরল, দেখনচাচা তখন তার হাতে পায়ে সেঁক দিচ্ছিলেন। একজন পুরুষমানুষের সামনে উলংগ হয়ে শুয়ে আছে বুঝতে পেরে লজ্জায় মরে যাছিল মেয়েটা, দেখনচাচা বললেন: লজ্জা কি মা, আমি তোমার ছেলের মত, সেবা করছি।
তারপর মেয়েটা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে দেখনচাচা এক কাণ্ড করে বসলেন। মেয়েটার কাছে গিয়ে বললেন: তোমাকে আমি ইচ্ছা করি।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল: কি?
দেখনচাচা বললেন: রতি যাঞ্চা চাহি।
মেয়েটা লজ্জায় মরে গেল।
দেখনচাচা বললেন: উপকার করি’ যদি দাম নাহি চায়,
হয় মিথ্যা কথা বলে না হয় ভাড়ায়।
মেয়েটা কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।
দেখনচাচা সযত্নে তার হাত ধরলেন, বললেন:
জননী জায়ার মাঝে ভেদাভেদ নাই,
একজন স্তন্যদাত্রী অন্য জন মাই।
বলে, অত্যন্ত সহজ-ভংগিতে তার বুকের কাপড় খসিয়ে নিলেন।
গ্রামের লোকেরা যখন জানল ব্যাপারটা তখন তারা দেখনচাচার ওপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগল এরকম চরিত্রহীনতা তারা সহ্য করবে না। প্রথমে একজন চরিত্রবান লোক একটা খোলামকুচি ছুঁড়ে মারল দেখনচাচার দিকে। দ্বিতীয় চরিত্রবান মারল একটা ঢিল! তৃতীয় চরিত্রবান একটা শক্ত মাটির টুকরো। আর চতুর্থ চরিত্রবান একটা আস্ত থান-ইট। ঠিক মাথার মাঝখানে ইটটা লাগতে দেখনচাচা ঘোড়ানিমের ডাল থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। এখন সমবেত চরিত্রবানেরা তাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলছিল। কিন্তু তখনো তিনি হাসছিলেন, তার কপালের রক্ত গড়িয়ে এসে ঠোটের হাসিটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল। সমবেত সেইসব চরিত্রবানেরা দেখনচাচাকে মারতে মারতে এক সময় অজ্ঞান করে ফেলল, পা দিয়ে বলের মত লুফতে থাকল, তারপর গ্রামের বাইরে নদীর ধারে জলে ফেলে দিয়ে এল। শেষ মুহূর্তেও দেখনচাচার ঠোঁটে সেই রক্তাক্ত হাসিটা লেগে ছিল।
পরের দিন গ্রামের সমস্ত চরিত্রবান লোক দেখল যেখানে যেখানে দেখনচাচার রক্ত পড়েছিল সেখানে সেখানে এক-একটা ঘোড়ানিমের গাছ জন্মে গেছে। সকাল বেলার সতেজ আলোবাতাসে সেই সব নিমগাছের কচি পাতায় কাঁপ ধরেছে।
[নভেম্বর ১৯৬৯)
9 মন্তব্যসমূহ
অভিনব গল্প। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন দেখন চাচা।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনকী অসম্ভব শক্তি এই গল্পের শব্দাবলীর।
উত্তরমুছুনসরলভাষায় বলতে গেলে--সুপার্ব। অপূর্ব।
উত্তরমুছুনসুবিমল দা'র দুর্দান্ত গল্প
উত্তরমুছুনপড়লাম।
উত্তরমুছুনসেই হ্যাকনীড মরালিটি আর ইমমরালিটির গল্প। এটাই কি এন্টি স্টোরি? এলিট পাঠকদের মধ্যে লেখক সম্বন্ধে অনেক আলোচনা শুনেছি। পরিণত পাঠক হতে হয়তো অনেক সময় লাগবে, তাই এই গল্পে অভিনবত্ব বা চমকে যাওয়ার মতো কিছু পেলাম না।
ভাষা ভালো। পাঠককে চমকে দেয়ার চেষ্টা আছে বিষয়বস্তুতে। মা ডেকে সম্ভ্রমহানী, যে কোনো বিচারেই বিকৃত চিন্তার ফল। এটা শিল্প কি? কে জানে।
উত্তরমুছুনখুবই মামুলি গল্প
উত্তরমুছুনঅসাধারণ। চমকে ওঠার মত গল্প। অনেকদিন পর এমন নাড়া দেওয়া গল্প পড়লাম।
উত্তরমুছুন