মৌসুমী কাদের এর গল্প: বিভ্রম



মনিকার সাথে আমার ফেসবুকে কথা হচ্ছিল ‘ভূগোল’ নিয়ে। যদিও ওটা আমার পড়াশুনোর বিষয় ছিল না তবুও 'জলবায়ূ' আর 'আবহাওয়া' নিয়ে ও যখন খুব গোলমেলে প্রশ্ন করত, তখন সেগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে একদমই গুলিয়ে ফেলতাম। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানোটা আমার পেশা, নেশা দুটোই বলা যায়। পৃথিবীর পঞ্চাশটা দেশ দেখে ফেলার ফলে ভূগোলের অভিজ্ঞতাটাকে অস্বীকারই বা করি কি করে? এর উত্তাপ, উষ্ণতা, চাপ, প্রবাহ, আর্দ্রতা, ঝড়, বৃষ্টি...এবং প্রতিদিন এগুলো নিয়ে যে হাঁটছি, চলছি, খা্‌চ্ছি-দাচ্ছি এগুলোযে আমায় কীভাবে জড়িয়ে আছে সেসব নিয়েই মনিকার সাথে কথার শুরু। আর পরিচয় হতে না হতেই প্রেম নিবেদন। এটা বোধহয় খুব অনিয়ন্ত্রিত একটা আচরণ হয়ে গেছে। এবং এ নিয়ে নিজের উপর যে ভীষণ রাগ হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবে না। আবার, এই প্রেম-আবহাওয়ারও যে খুব শিঘ্রী বদল হবে তেমন সম্ভাবনাও দেখছি না। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। কিন্তু মনিকা করে। এখন তাঁর ঈশ্বর যদি আমায় অভিশাপ দেন এবং এই শীতাঞ্চল থেকে বের করে সুদূর কোন উষ্ণ অঞ্চলে বনবাসে পাঠান তাতে অবশ্য আমার কোন আপত্তিই থাকবে না।

ফেসবুকে ওর চোখদুটো দেখেই কী যে হয়েছিল আমার, বলতে পারব না। আষাঢ়ের নববর্ষার ছায়ায়, মায়ার কাজল পরা ঐ চোখ দুটি যেন একলা হয়ে ভুল করে ঝুলে ছিল। ওটা দেখা মাত্রই আবেগের আতিশয্য ভর করেছিল। রুপ-লাবণ্য যতটা না দেখেছি তার চাইতে বেশী দেখেছি ‘চোখ’। সেই চোখে ফুটে ছিল একটা মাধ্যন্দিন রেখা। এমন একটি কাল্পনিক রেখার কথা বলছি, যেটি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ভ্রমণকালে নিরক্ষরেখার সবচাইতে উত্তরে বা দক্ষিণে সূর্যের অবাধ চলাচলটিকে দেখতে পায় না। মুহূর্তের ঝিলিকেই এই রেখাটিকেই কেন যেন আমি ওর চোখে দেখতে পেয়েছিলাম।


হাজার হাজার মাইল দূরত্বে থেকেও কুশল বিনিময়ে আমাদের কোন ঝামেলাই হয়নি। বেশ প্রাণবন্ত সে। ঝটপট ভণিতা ছাড়াই বলে দিল যে সে বিবাহিত। যদিও এসব ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার কোন আগ্রহই ছিল না। কিন্তু একথা তো মানতেই হবে যে একজন বিবাহিত নারীকে প্রেম নিবেদন করাটা আইনত অপরাধ। কিন্তু ঐ যে মাধ্যন্দিন রেখা? ওটাইতো যত সর্বনাশের মূল! আর্কটিক, প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে ঝড়ের মতন যেন মনটা তাঁর কাছে ছুটে গেল, পৃথিবীর সবচাইতে উত্তরতম বিন্দু, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে,... ।


আমি যেখানে থাকি, অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের এই ঘূর্ণন অক্ষে বরফের স্রোত কখনই স্থির থাকেনা। কারণ, উত্তর মেরুর বিন্দুটির নিচে কোন মাটি নেই। আমিও সেই রকম একজন মাটিহীন মানুষ। প্রকৃতি ও প্রেম মিলে গেলে দিনরাতের হিসেব গুলে যায়। সৌভাগ্যই বলতে হবে যে ওর সাথে আমার গ্রীষ্মকালেই পরিচয়। গ্রীষ্মকাল এখানে ১৮৭ দিন টেকে। আর ওর সাথে পরিচয় হয় ঠিক ১২৫ তম দিনে। এখানে এখন মাছ ধরার সময়। তুমুল আনন্দে মাছ, সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীরা হেসে খেলে বেড়ায়, বরফের তলায় দিব্যি নেচে নেচে চঞ্চল হয়। আর তখনই কিনা আমরা, মানে নির্মম মানুষেরা, ওদের মেরে ফেলে আনন্দ করি। এবছর সূর্যের তীব্রতা এতই প্রখর ছিল যে মন প্রাণ ঢেলে আমরা একটু বেশী বেশীই প্রকৃতিকে উপভোগ করছিলাম। উষ্ণতার আনন্দে বরফগুলোও গাইতে গাইতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভেসে বেড়াচ্ছিল। মনের মধ্যে যখন এমন একটা ভাসা ভাসা, উড়ু উড়ু ভাব, ঠিক তখনি মনিকার সাথে আমার পরিচয়।



আমি যে গাছটার নিচে বসে মনিকার সাথে কথা বলতাম, তার নাম ইস্টার্ন রেডবডস। এরা সাধারণত আর্দ্র মাটি পছন্দ করে আর বসন্তকালে ফোটে। ছোট্ট নিচু গাছ, তবে ভীষণ মার্জিত। কান্ডদুটো দুদিকে হাত বাড়িয়ে কাছে যেতে আহ্বান করে। আর লম্বা লম্বা মটরশুটির মতন বীজগুলো এমনভাবে ঝুলে থাকে যেন মনে হয় ঠাকুমা মাছের ঝুড়ি রোদে শুকোতে দিয়েছে। আর ঝলকানো হৃদয় আকৃতির পাতাগুলো থেকে কিছুদিন পর পরই সবুজ ফল বেরোয়। তখন ওরা পাতাহীন হয়ে পড়ে, আর পুরো গাছটাই গোলাপী ফুলে ভরে ওঠে। আমার কাছে ভূগোল মানে এগুলোই। গাছ-পাতার বর্ণনা, ভূমির গঠন বিন্যাস আর মানুষের নানাবিধ প্রপঞ্চ ।


শীত থেকে হেমন্ত পর্যন্ত পুরো সময়টাতেই আমি যখন ওর সাথে ফোনে কথা বলছিলাম, তখন কিন্তু এই গাছটার বদ্‌লে যাওয়ার দৃশ্যগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা দুজনই যখন রেডবডস গাছটাকে ভালোবাসছি, তখন, জীবনের সমস্ত তুফানকে অদৃশ্য করে মনিকা আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে। আমাদের সময়গুলো তখন তিরতির করে কাঁপছিল, আর এই মুহূর্তগুলো নষ্ট করা বোকামী হবে ভেবে আমি তার সমস্ত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রেম নিবেদন করে ফেলেছিলাম। এ যদি আমার লাম্পট্য হয়ে থাকে, তবে হয়ত হয়েছে।


দুর্বলতা একটা দূর্দান্ত জিনিস, যা একই সঙ্গে শক্তিতেও রূপান্তরিত হতে পারে। আমি ওর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলি। দুজন দুজনকে অদৃশ্যে আলিঙ্গন করি, ঠোঁটে ঠোঁট গলিয়ে গভীর চুমু খাই, ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে নাকে নাক ঘষি, আর ঘুমের ঘোরে ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখি সেই মাধ্যন্দিন রেখা! যা মুহূর্তের মধ্যেই বিদ্যুৎ খেলার মতন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মনে হয় প্রেম যেন ওখানেই স্থির হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় উত্তর আর কোথায় দক্ষিণ! একেই কি বলে বিপরীত মেরুর প্রেম?


ভেবেছিলাম আপনাদের কোন প্রেমের গল্প শোনাব না। কিন্তু ক্রমশ লেখাটি প্রেমের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমি না চাইলেও হচ্ছে। তো যা বলছিলাম; আমাদের প্রেম যখন তুঙ্গে অথচ কেউ কারো কাছে কথাটা স্বীকার করছি না, কিন্তু দুজনেই টের পাচ্ছি, ঠিক তখনই ওর স্বামীর কাছে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। স্বামী বেচারা জোর করে ওর মোবাইল কেড়ে নিল, পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে আমি প্রতিদিন ফেসবুক বা ওয়াটসএপ ইনবক্সে যা যা ওকে লিখেছি সেগুলো দেখে ছিঃ ছিঃ, হায় হা্‌য়, সর্বনাশ! এসব করল। তারপর ওর সামনেই মাটিতে এমন কায়দায় বারবার থু থু ফেলতে থাকল যেন মনিকার গায়ে মলমূত্র জাতিয় বর্জ্য লেগে গেছে। মনিকা স্পষ্টতই বুঝে গেল, লোকটা ভয়াবহ ঘৃণা করছে ওঁকে। কিন্তু স্ত্রীর পরকীয়া কেবলই একটা ফ্যান্টাসি ছিল কিনা, বা ঠিক কোন্‌ শূন্যতায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা আমার লেখাগুলোর উত্তর দিয়েছে, বা আদৌ ওর দিক থেকে সেগুলোকে প্রেম বলা যায় কিনা সেসব নিয়ে লোকটি খুব তীক্ষ্ণভাবে খুঁটিয়েও দেখেনি। দেখতে চায়ওনি। সে শুধু তাঁর শক্তিমত্তা দেখিয়ে সামাজিক বিপর্যয় থেকে নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে চেয়েছে। এই ধরা খাবার ঘটনাটির পর বেশ অনেকদিন ধরেই ওর সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কেমন আছে, কীভাবে ওর দিন কাটছে কিছুই জানছিনা বলে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিলাম আমি। অভিমান তীব্র হতে হতে ক্রমশ তা আক্রোশের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।


ঠিক তখনই হঠাৎ ওর এক বান্ধবী ফেসবুকে জানাল যে মনিকার বর অভিক ট্রেনের নিচে মাথা চালান করে দিয়েছে। ঘটনাটি খুবই আকস্মিক। কিন্তু যতটা না বেদনা গ্রাস করা উচিত ছিল আমার ঠিক ততটাই বিপরীত বোধ আঁকড়ে ধরেছিল। ঐ লোকটিকে কি তাহলে আমি ঘৃণা করতাম? না। তাতো নয়। কিন্তু ঐ লোকটির যেন মনিকাকে পাবার অধিকার নেই, এমন বোধ প্রায়ই আঁকড়ে ধরত। আর এই দুর্ঘটনাটির পর মনিকাকে নিজের করে পাবার আকাঙ্ক্ষাটা যেন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল।


শিলাইদহ থেকে কল্যানী সীমান্ত ট্রেন খুব যে বেশী গতিতে চলছিল তাও না। আর শিলাইদহ থেকে প্রচুর মানুষ কল্যানী সীমান্তে যায়। ঐ প্রান্তেই বাংলাদেশের বর্ডার। লোকজন গিজ গিজ করতে থাকে কামরাগুলোতে। ভীড়ের মধ্যে মানুষের গায়ের গন্ধ যেন বাইরে থেকেও টের পাওয়া যায়। এই ট্রেন দেখে মানুষের আত্মহত্যার ইচ্ছা উবে যাবার কথা। আর হলুদ রঙা ট্রেনটাযে খুব সঠিক সময়ে আসত যেত তাও নয়। অভিক রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল। এমনকি চায়ের দোকানে বসে চাও খেয়েছে। মনিকার বান্ধবী সুস্মিতার বর ওকে দেখেছে, বাদামী প্যান্ট আর হালকা নীল শার্ট পরা ছিল। ভদ্রলোক ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে কাজ করত। মাইনেও বেশ ভালই পেত।


রেললাইনের ধারে অপেক্ষার আগে অভিকের আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। স্ত্রীর পরকীয়া নিয়ে প্রথম ক’দিন খুব বাড়াবাড়ি করলেও এর কিছুদিন পরই অদ্ভূত একটা রোগ ধরা পড়েছিল ওঁর। সে দিনের বেলায় স্ত্রীর দিকে তাকালে অসুস্থ বোধ করত। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারত না। প্রায়ই অফিস ফাঁকি দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকত আর ধুম্রজালের ভেতর দিয়ে মনের ক্ষোভগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিত। তবে মাঝরাতে অন্ধকারে সুযোগ পেলেই সঙ্গমে যেতে চাইত। এতে মনিকা খুব ক্ষেপে যেত। দিনের আলোতে স্ত্রীর মুখোমুখি হলে আবার তার হাত-পা কাঁপত। এ এক অদ্ভুত রোগ! অপরাধ যদি কেউ করে থাকে সে না হয় মনিকা করেছে। কিন্তু অভিকের কেন এমন হবে? বেশ কিছুদিন এমন চলতে চলতে হঠাৎই একদিন কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে গেল অভিক। তারপর ডাক্তার, হাসপাতাল করে আবার বাড়িতে ফেরত। ডাক্তার বললেন, মৃগী রোগ হয়েছে। এটা ওনার আগে থেকেই ছিল। টের পাওয়া যায়নি।


উত্তর মেরুতে দাঁড়িয়ে আমি যখন পূর্ব গোলার্ধের খবর শুনছি তখন সেখানে খা খা রোদ। আকাশ বাতাস মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। আমি ভাবছি কী করে মনিকার সাথে একবারের জন্য হলেও কথা বলা যায়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে তন্ন তন্ন করে ওকে খুঁজে বেড়ালাম। কোথাও পেলাম না। ভয়াবহ রাগ হচ্ছিল আমার। ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলাম আমি। অনুসন্ধান করতে করতে চার জন মানুষের কাছে চার রকম তথ্য পেলাম।


প্রথমজন বলেছে; অভিক সত্যিই মারা গেছে। ট্রেনে ওর গলা কাটা গেছে। এই মৃত্যুটি দুর্ঘটনা নাকি ‘আত্মহত্যা’ সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।


দ্বিতীয়জন বলেছে; অভিক মরতে মরতে বেঁচে গেছে। রেললাইনের সামনে সে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও ঝাপ দেবার আগে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মনিকার জীবনটাও ঘুরে গেছে। ফেসবুকে ও নতুন একাউন্ট খুলেছে এবং সেখানে ফুটফুটে একটা মেয়েসহ হাসি হাসি চেহারার কিছু ছবিও পোস্ট দিয়েছে।


তৃতীয়জন বলেছে; বেশ অনেকদিন ধরেই মনিকা ফেসবুক বা ওয়াটসএপে নেই। ও আমাকে অনেক আগেই ব্লক করেছে। ওর স্বামী ফোন দখলে নিয়ে নিয়েছে এবং আমার প্রতি ওর সকল আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে।


চতুর্থজন বলেছে; পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি নির্দেশ জারী করেছে। আপাতত আন্তর্জালের ব্যবহার সীমিত রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকেও অকার্যকর করা হয়েছে। কাজেই সামাজিক মাধ্যমে মনিকাকে খুঁজে পাবার কোন সম্ভাবনাই নেই।


এদিকে উত্তর আমেরিকায় আগের জায়গাটি বদ্‌লে আমি তখন বিভিন্ন শহরে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর নদীতে বর্শী ফেলে লুটেপুটে খাচ্ছি সময়। জোয়ারের পরিবর্তনের কয়েক ঘন্টা আগে বা পরে টোপ ফেললে মাছ যেমন সহজেই ধরা পরে তেমনি জীবনের স্রোতে ভেসে ভেসে একজন মানুষের কাছে আঁটকে পড়ার ক্রোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। প্রতারিত হবার বোধও কেন জানিনা আঘাত করছিল বেশ। যদিও জানতাম সম্পর্কটায়তো কোন সিলগালা লাগানো ছিল না। তাহলে?এত প্রত্যাশা ছিল কিসের? কেন আঙুলের ডগায় ঝড় ঘুরছিল তখন? কেন তিরতির করে কাঁপছিল সময়? কেন মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল জলের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাই......মিশে যাই সমুদ্রে...মহাসমুদ্রে...


ঠিক এই রকম একটা মানসিক অবস্থায় আমার নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে হালকা পর্দার ছায়ায় আমি দেখতে পাই নীলরঙা গাউন পরা ছোটখাট একটা মেয়ে চোখের সামনে নড়াচড়া করছে। আধোদৃষ্টিতে দেখছি মেয়েটা স্যালাইনের সুঁচ লাগাচ্ছে আমার হাতে, ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। আর যখনই আমি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিতে পারছি তখনই ওর চোখে মুখে দীপ্তি ফুটে উঠছে...আমার মনে হলো এই মেয়েটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি.....এই বিছানাটাতেই এর আগেও যেন আমি কোথাও শুয়েছি, এই বাদামী দেয়াল, হলুদ বাতি, এগুলোতো গোপন ছিল এতদিন! আমি দেখছি মেয়েটা ঠোটে গোলাপী রঙ মাখছে, হালকা নীল শাড়ির পাড়টা খুলে খুলে পড়ছে, আমি উঠে ওঁর শাড়ির আঁচলটা টেনে খুলে ফেললাম, ও ক্ষেপে গেল, ওর শরীর পুরো কাঁপছিল, আমি ওকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে বিছানায় নিয়ে গেলাম। ও হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করল, আমি কোন কথাই শুনলাম না, কিছুই মানলাম না, একটা শুয়োর ভর করল যেন আমায়।


এবং এর পরপরই উত্তর গোলার্ধের কোন এক ঘূর্ণন অক্ষে এই ‘আমি’ চরিত্রটি চিরতরে বিলীন হয়ে গেল।

--------
 
লেখক পরিচিতিঃ 
মৌসুমী কাদের
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক
কানাডায় থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ অন্যরকম একটা লেখা। নামের মতই বিভ্রম জাগানো টানটান একটা গল্প!

    উত্তরমুছুন
  2. দুটো গল্পই ভালো লাগল বেশ। যেহেতু মনে না ধরলে পড়তে পারি না সে বিচারে অবশ্যই লেখা গুলো মনে ধরেছে নানা ইতস্ততের মধ্যে।

    উত্তরমুছুন