ইকবাল হাসান'এর গল্প: তেলাপোকা


                       

তেলাপোকায় ঘর ভরে গেছে। টের পাচ্ছো ? না পাচ্ছো না?

কোথায় তেলাপোকা? আমি তো দেখছি না।

তুমি কিভাবে দেখবে ? তুমি তো অন্ধ। ইউ আর সিম্পলি ব্লাইন্ড।

বাড়ি আছে বলেই তেলাপোকা, যাদের বাড়ি নাই তাদের তেলাপোকাও নাই। মনে মনে বলি। 

আমি এখন তেলাপোকা নিয়ে তেমন চিন্তিত নই, তবে অই কথাটা, ইউ আর সিম্পলি ব্লাইন্ড, কথাটা আরিজোনা, টেক্সাসের ক্যাকটাসের মতো আমাদের দুজনের কথার মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। এ নতুন কিছু নয়। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে প্রায়ই এধরনের উৎকট ব্যাপার ঘটে। কখনো মাকড়শার কঙ্কাল, করোটির হাড়, মৃতের কাফন, কখনো মরা মাছের ঘোলাটে চোখ দেখা দেয়। যেন আশেপাশেই থাকে, ও দেখে না। আমি দেখি। আজ দেখলাম, ক্যাকটাস। সারা শরীরে যেন বিষাক্ত কাঁটা।

ইউ আর সিম্পলি ব্লাইন্ড কথাটায় সত্যতা ৫০%, আমার বাম চোখে গ্লুকোমা, বছর দুই আগে অপারেশন হয়েছিল। তারপর একটু একটু দেখতে পেতাম। আর এখন কে যেন অই বাম চোখে অমাবস্যার আগের রাতের মতো হালকা একটা কালো পর্দা টানিয়ে দিয়েছে । কিন্তু ডান চোখে তো আমি ক্ষমার নাড়িভুঁড়ির ভ পর্যন্ত দেখতে পাই, রশিদ চৌধুরীর ট্যাপেষ্ট্রি ‘মানুষের হৃদপিন্ডে’র মতো। ও জানে সে কথা ।

ক্ষমা আমার স্ত্রী। তার চোখমুখ এখন লাল। রেগে গেলে ক্ষমার চোখ লাল হয়, আজও হল।

বললো, তোমাকে দেখতে হবে না। কোনো কাজ তো করো না, অন্তত একটা কাজ করো আজ। পেষ্ট কন্ট্রোলে ফোন করে এক্সটারমিনেটর ডাকতে হবে। নম্বর ফোন বুকে পাবে। আমি বাইরে যাচ্ছি।

ক্ষমার বাইরে যাওয়া আর ঘরে থাকা আমার জন্য একই কথা। আমি তো জানতে চাইনি কোথায় যাচ্ছে। মনে মনে বললাম, এটা একটা এক্সপ্লানেশন, মহিলারা বাইরে গেলে দেয়। পুরুষরা দেয় না, প্রয়োজন মনে করে না।

ইদানিং যখন তখন চলে আসে ক্ষমা, আজো এলো। বাইরে যাচ্ছি বলে চলেও গেল।

ক্ষমা চলে গেলে আমি হাসপাতালের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, দেখি তেলাপোকার মতো হালকা বরফ পড়ছে আকাশ থেকে, সাদাসাদা তেলাপোকা। আর এই ঝিরঝিরে বরফের ভিতর জানালার বাইরে পড়ে আছে পিৎজার মতো এক স্লাইস জীবন, জাষ্ট লায়িং লাইক এ স্লাইস অব পিৎজা।

আমি সারা ঘরে তেলাপোকা খুঁজতে লাগলাম।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, সদ্য কাফ্কার মেটামোরফসিস পড়ে আমি একটা গল্প ফাঁদার চেষ্টা করছি। ব্যাপারটি আদৌ তা নয়। তেলাপোকা কোন জায়েন্ট ইনসেক্ট নয়। আলো দেখলে দৌড়ে পালানো নিতান্ত ছোট্ট একটা প্রাণী, ক্ষমার মতো সব মহিলা এই প্রাণীটিকে ভয় পায়। ওর নাকি গা গিদগিদ করে।



আমি তো তেলাপোকা না। আমাকে দেখলেও তো তোমার গা গিদগিদ করে। করে না?

সব সময় করে না। কখনো কখনো করে, তুমি যখন ষ্টুপিডের মতো এ্যক্ট করো তখন।

যেমন?

যেমন তুমি যখন মানুষের সামনে নাকের ভিতর, কানের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে চুলকাও। ডিজগাষ্টিং।

তেলাপোকারা তো নাকের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে চুলকায় না। তারপরও তো তুমি বলো, তেলাপোকা ইজ ডিজগাষ্টিং।

হ্যা, বলিতো। তুমি মনোযোগ দিয়ে তেলাপোকা দেখেছো কখনো? অযথা বাহাস করছো কেন? তুমি আসলে কি বলতে চাও? হোয়াট ইজ ইওর পয়েন্ট?

বাহাস করছি না, কিছু বলতেও চাচ্ছি না এন্ড দেয়ার ইজ নো পয়েন্ট এ্যট অল।

ব্যস, তাহলে এখন চুপ করো। জাষ্ট সাটআপ।

ওকে।

কেউ সাটআপ বললে তো আর কথা বলা যায় না, অতএব আমি নিশ্চুপ থাকাই সাব্যস্ত করলাম।

ক্ষমার সামনে আমি এখন চুপচাপ বসে থাকা যেন এক অস্থিমজ্জাহীন পাথর বিশেষ।

আর আমার এই নিশ্চুপ থাকার ভিতর পথ দিয়ে সময় বয়ে গেল নিরন্তর, দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল। সহসা তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে দিয়ে বিশালকায় সাপের মতে একটা লোকাল ট্রেন চলে যাচ্ছে ধীরলয়ে, নিঃশব্দে..., জানালায় ক্ষমা! বিমর্ষ, মলিন ও ফ্যাকাশে। দৃষ্টি তার স্থির এই বিপুল পৃথিবী থেকে দূরে অন্যকোথা, অন্য কোনখানে।



এখন দুপুর না রাত, বিকেল না সন্ধ্যা মাথার উপর নক্ষত্রহীন যদিও আকাশ, সামনে লেক অন্টারিওর বিস্তৃত জলজ প্রান্তর এবং অনতিদূরের সুউচ্চ টাওয়ার দালানকোঠা এমনই ধোঁয়াশা অস্পষ্ট, সব কিছু যেন অনুমান নির্ভর, যেন পার্কের এই শীতল বে নিজেও জানে না তার অস্তিত্বের কথা, যেন বায়বীয় কোন গ্রহ, যার উপরিতল নেই কোন আর জিরো গ্রাভিটির ভিতর যেন শূন্যে ভাসমান আমি, ভেসে যাচ্ছি, ভেসেই যাচ্ছি শুধু।

ক্ষমা এসে উদ্ধার করে আমাকে।

এতো রাতে এই পার্কে একা একা বসে আছো কেন?

ক্ষমার কথায় জানা হয়, এখন রাত তাহলে !

একা কোথায় ? এই যে তুমি এসে গেছো।

এ কথায় মিষ্টি করে হাসে ক্ষমা। সহসা যেন কোথাও থেকে ছুটে আসা একটুকরো অপার্থিব আলো ক্ষমাকে উজ্জ্বল করে তুলে মুহূর্তেই নিঃশেষিত হয়ে যায় ।

তোমার এভাবে হাসপাতাল থেকে বের হওয়া ঠিক হয়নি।

হাসপাতাল থেকে বের হয়েছি মানে?


মানে আবার কী! তুমি কি ভাবছো, তুমি হাসপাতালেই আছো?

হ্যাঁ। এই যে আমার চারপাশে তুমি যা যা দেখছো সব কিছুতো এখন হাসপাতালের আওতার মধ্যে। এই যে আমি তুমি, এই যে আমরা এখানে বসে আছি, আমরা তো হাসপাতালের মধ্যেই আছি। ইটস্ অ্যান এক্সটেনশন, এক্সটেনশন অফ এ মেন্টাল হসপিটাল।

চুপ করো, এসব শুনতে আমার ভালোলাগে না।

মৃত মানুষের আবার ভালোলাগা মন্দলাগা কি!

আমি না হয় মৃত, আর তুমি?

আমার কোন ভালোলাগা মন্দলাগা নেই তোমার মতো। বেঁচে থেকেও মাঝেমাঝে মনে হয় মৃত। মনে হয়, মৃতের কাফন পরে বেঁচে আছি। তবু বেঁচে তো আছি।

না থাকার মতো। আসলে তুমি আমি আমরা সবাই মৃত। উই আর ডেড পিপল।

তুমি মৃত। আমি পুরোপুরি মরিনি এখনো।



আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না আমি কোথায় ? কেন এতো অচেনা সবকিছু ? এতো অপরিচিত লাগছে কেন?

কেন মাথার ভিতর যখন তখন ঢুকে পড়ছে অন্ধকার? আর এখন এই অন্ধকারের বিশাল জলরাশি সাতরে এ আমি কোথায় যাচ্ছি...

ক্ষমা এলো ঠিক এ সময়। এসেই বললো

কল্যাণী ফোন করেছিল এক দুপুরে, তোমাকে বলা হয়নি। তুমি তখন অসুস্থ...

আমি অন্ধকারের বিশাল জলরাশির ভিতর ভেসে যেতে যেতে বলি :

কল্যাণী! কোন্ কল্যাণী ?

চারদিকে এতো এতো ধূলো আজ, আর এতো নিকষ অন্ধকারের প্লাবন যে কোন কিছুই স্পষ্ট হতে পারছে না।

আহা, চেনো না বুঝি!

না, সত্যি বলছি, মনে করতে পারছি না।

চেষ্টা করো।

কল্যাণী, কল্যাণী..., কে যেন!

যার সঙ্গে তুমি ঘুমিয়েছিলে!

এবার মনে পড়ছে?

আমি কল্যাণীর সঙ্গে ঘুমিয়েছি ?

হা ঘুমিয়েছো।

কবে? কখন? কোথায় ঘুমিয়েছি?

আমাদের বিয়ের পরপরই, ঢাকায়। তুমি তখন সুস্থ ছিলে।

আমার মনে পড়ছে না।


স্বাভাবিক।

কি স্বাভাবিক?

এই মনে না পড়া। ঘরের কাজের মেয়ের সঙ্গে ঘুমানোর কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক।


আমার মনে পড়ছে না অথচ তুমি মরে গিয়েও সবকিছু মনে রেখেছো।

হা রেখেছি। কারণ, ওটা একটা ক্ষত, দগদগে ঘা। মরার পরও বয়ে বেরাচ্ছি। কল্যাণী ফোন না করলে আমার তো কিছুই জানা হ’ত না।

আমাদের ঘরে কাজের মেয়ে ছিল? কল্যাণী নামে?

হা ছিল। আমার মা দিয়েছিলেন ঘরের কাজে আমাকে সাহায্য করবে এক আধটু, আর তুমি তাকে লাগিয়েছিলে অন্য কাজে।

তাই নাকি?

হা তাই।

আচ্ছা একটা কথা, সবকিছু এমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন? তুমিই কল্যাণী না তো?

মরণ আমার! আমি কল্যাণী হতে যাবো কোন্ দুঃখে? আমার পেটে কি বাচ্চা এসেছিলো?

সহসা যেন ঝাপিয়ে পড়লো অন্ধকার, কী বলছো এসব? কল্যাণীর পেটে...

হা, কল্যাণীর পেটে তোমার বাচ্চা। মেয়েটা যেন সহসাই সমুদ্রে পড়লো। তারপর পালালো একদিন। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, কল্যাণী নেই !

কোথায় গেল তোমার অই গল্পের কল্যাণী ?

আমি কী করে জানবো কোথায় গেল! গল্পের কল্যাণী বলছো? ওতো গল্পের কেউ নয়, বাস্তবের। বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষ। যার সঙ্গে তুমি সেক্স করেছিলে! যে তোমার সন্তান পেটে নিয়ে পালিয়েছিল। আর তুমি..., তুমি...

আমি কি?

তুমি এতোটাই কাওয়ার্ড যে মেয়েটিকে ধরে রাখতে পারলে না। অন্ধকার ওকে গিলে ফেললো, তুমি ফিরেও তাকালে না। সেদিন ফিরে তাকালে, ধরে রাখলে আজ অন্তত কল্যাণীকে তোমার পাশে পেতে।

আমি কল্যাণী বলে কাউকে মনে করতে পারছি না।

আমাকে মনে করতে পারছো? বলো তো আমি কে?

হা, তাই তো! তুমি কে? কে তুমি? তোমাকে ক্ষমার মতো লাগছে দেখতে!

আমিই ক্ষমা, তোমার বিয়ে করা বৌ। যাকেও গিলে খেয়েছে অন্ধকার। আজ দেখো, তোমার পাশে কেউ নেই। আমিও নেই, কল্যানীও নেই। তুমি একা।



আজ কদিন ধরে মনে হচ্ছে, দেয়ালগুলো আমাকে গিলে ফেলবে! প্রথম যেদিন আমাকে এঘরটায় ঢুকানো হয়েছিলো, দেয়ালের রং ছিলো, যতোদূর মনে পড়ে, অফ হোয়াইট। আর এখন মনে হচ্ছে, কালো। ভয়াবহ রকম

ডার্ক। দেয়ালজুড়ে যেন অন্ধকারের থাবা। নিকষ কালো অন্ধকার, প্রেতের মতো যেন রাক্ষুসে ক্ষুধা নিয়ে তেড়ে আসছে আমার দিকে। আমি আজ ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে উঠছি, কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না কেউ। কেউ কি কোথাও নেই ?

আজ যেন অন্ধকারে দেয়াল ফুঁড়েই বেরিয়ে এলো ক্ষমা।
 

ওভাবে চিৎকার করছো কেন? তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

না, কষ্ট হচ্ছে না। তবে ভয় তাড়া করছে।

কিসের ভয়?

তেলাপোকার!

কোথায় তেলাপোকা?

তুমি দেখতে পাচ্ছো না? অই দেখো, দেয়াল জুড়ে লক্ষ লক্ষ তেলাপোকা! তুমি দেখতে পাবে না, ইউ আর সিম্পলি ব্লাইন্ড।

মৃতেরা সব দেখতে পায়, জীবিতরা পায় না। এই যেমন ধরো, পর্ব। একটু আগে আমি পর্বকে দেখে এসেছি। আহা, কী যে ভালো লাগলো। প্রায় প্রতিদিনই যাই, ওকে দেখে আসি।

পর্ব ? পর্ব কে?

তোমার ছেলে পর্ব, কী অবাক লাগছে ? কল্যাণী আর তোমার ছেলে পর্ব। ওর বয়স এখন সাত। ভারি ফুটফুটে, একদম মায়ের আদল পেয়েছে।

কী বলছো তুমি! পর্ব আমার ছেলে হতে যাবে কেন?

পর্ব তোমার ছেলে। যদিও সবাই জানে, কল্যাণীর আগে কোথাও একটা বিয়ে হয়েছিল, লোকটা ওকে একটা বাচ্চা দিয়ে মরে গেছে। আসলে আমি তো জানি সে মরেনি, এই তো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কাওয়ার্ড।

না কল্যাণী, না পর্ব কারো অবয়বই আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ঠিক এসময় একতাল জমাটবাঁধা অন্ধকার আমার মগজের ভিতর ঢুকে গেলে আমি সেই ঘণবদ্ধ অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে নবজাতকের মতো চিৎকার করে উঠি। আমার চিৎকারে এক তরল আলোড়নের সৃষ্টি হলে এই প্রথমবারের মতো আমি ক্ষমার স্পর্শ পেলাম, যেন আমাকে এক অর্থহীন আলিঙ্গনের ভিতর জড়িয়ে নিতে চাইলো।

তুমি আমাকে এভাবে একা রেখে চলে গেলে কেন ক্ষমা ?

আমি তো ইচ্ছে করে যাইনি। বেঁচে থাকার কোনও পথ তো তুমি আমার জন্য অবশিষ্ট রাখোনি অর্ণব।


---------------

লেখক পরিচিতি:

ইকবাল হাসান

কবি ও গল্পকার। সত্তরের জনপ্র্রিয় উল্লেখযোগ্য কবিদের অন্যতম।

জন্ম, ৪ ডিসেম্বর,১৯৫২, বরিশালে।

বর্তমানে কানাডার টরন্টোতে বসবাস করছেন।


































একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ