শামীমার ধাক্কাধাক্কিতে মনে হয় যেনো ভূমিকম্প শুরু হয়েছে, এক্ষুনি ঘর ছেড়ে দাঁড়াতে হবে খোলা আকাশের নিচে। নইলে ঘরের ছাদটাই ভেঙে পড়বে মাথায়। বাইরে তখন মেঘের আড়ালে দুষ্ট ছেলের মত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ভোরের রোদ। প্রানপণে উষ্ণতা বিলাতে চাইছে, অথচ মায়ের কড়া শাসনের মতো মেঘ পরতে পরতে বাঁধা দিচ্ছে তাকে।
এভাবে ধাক্কাটা দিলা যেন ঘরের ছাদ ভাইঙ্গা মাথায় পড়তেছে, কথাটা বলতেই মুখ ঝামটায় শামীমা, যা না একখান ঘর, মাথায় পড়লে মাথাও শরম পাইবো। আসলেই ঘরটা খুব একটা ভালো নয় জেনেই ভাড়া নিয়েছে সে। ভাড়াটাওতো তেমনই। আমানও পাল্টা মুখ ঝামটায়,ফিরা আইসা যে একডা মাথা গুঁজার ছাদ পাইছি, এইডাই বেশি। আমানের মুখ ঝামটায় খুব একটা বদলায় না দিনের রং। বরং আকাশে আরো গাঢ় মেঘ জমে। বৈশাখের প্রথম মেঘ।যুদ্ধ ময়দানের সৈন্যদের মতো ঐক্যবদ্ধ।
আকাশের এই পোচ পোচ কালো রঙ আমানের খুব প্রিয়। ছেলেবেলার স্মৃতিরা উৎপাত করে। কাঁচা আম, মরিচ মেশানো লবণের নিরুদ্বিগ্ন বিকেল।পকেটে লুকানো ভয়ের ধারহীন ছুরি। কাদা মাখামাখি বাসায় ফেরা। আম্মার চড়-থাপ্পড়। এখন এই অবস্থায় কেউ যদি আবার তাকে কোথাও ফিরে যাওয়ার কথা বলে, মোটেই রাজধানী ঢাকা নয়। শৈশবের সেই দিনগুলোতেই ফিরে যাবে সে।
ভাঁপ উঠানো ভাত আর সেদ্ধ আলু, কাঁচা মরিচ সরিষার তেল সাজিয়ে তাড়া দেয় শামীমা, নেন খাইয়া জলদি যান। তুফান ছুটতাছে। সকালের মেঘ হিম বাতাস ছড়ায়। কাঁথার ওম প্রথম প্রেমিকার মতো জড়িয়ে ধরে,বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না। কত ইচ্ছেরই যে গলা টিপে ধরতে হয় জীবনের দায় মেটাতে!
খেতে বসা মাত্র আর শামীমার বকবক শুরু হয়, টিভিটা ছাড়লেই দেখি রোগী বাড়তাছে, শুনছি আবার লকডাউন দিবো সরকার। মরার উপ্রে খাড়ার ঘা তার মইধ্যে দেখতাছি, নোয়াগাঁওয়ের হিন্দুদের বাড়িঘর সব তছনছ কইরা ফালাইছে। কে জানে বিধান কাকারা আছে না ভাগছে!হিন্দুদের কোন বিশ্বাস নাই, আইজ টাকাটা নিয়া ফিরলে, কাইলই ফ্রিজটা কিন্যা ফালামু। তারপর আর ওই পথ ধরছো তো তোমার একদিন কী আমার একদিন!
মহামারীর অতর্কিত আক্রমণের প্রথম ধাপে পারিবারিক- অর্থনৈতিক নানাভাবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত কোটি কোটি মানুষের একজন শামীমা। কদিন যেতে না যেতেই দিব্যি ভুলে গেছে মহামারীর তাণ্ডবের দিন। ফিরে গেছে প্রাত্যহিক অভ্যাসে। ঘরের এটা-ওটা আসবাব কেনার অভ্যাসের সাথে আবশ্যিক অনুষঙ্গ এই স্বামীর চরিত্র নিয়ে সন্দেহ।
ভাত খেতে খেতে ভেতরটা ধুক ধুক করে আমানউল্লাহর। সুনামগঞ্জ শহর থেকে ঘন্টা খানেক সময় লাগে সি এন জি অটোরিকশায় শাল্লার নোয়াগাও যেতে। গিয়ে যদি টাকাটা না পাওয়া যায় তো আসা যাওয়ার শ-দুইশ ভাড়ার টাকাই পানি। আশঙ্কাটা মনে উঁকি দিতেই ত্রস্ত আমানউল্লাহ একে মনের ভেতরেই ধামাচাপা দেয় সকালের মেঘের অতলে পরাস্ত হওয়া রোদের মতো।
বিধান কাকার দরজায় লাগানো বিশাল তালাটা দেখে আমানউল্লাহর মাথায় বাজ পড়ে। যা আশঙ্কা করেছিলো, তাই। মূহুর্তে সমাধানহীন ত্রিমুখী সমস্যা বজ্রপাতে ছাই হওয়া তালগাছের মতো তাকে পরিত্রাণহীন হতাশায় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায়। অথবা এই নিরুপায় অবস্থায় তার নিজেকে মনে হতে থাকে ব্রেকফেল করা গাড়ির ড্রাইভার। অথৈ নদীতে পড়ে যাবার মূহুর্তে যার কিছুই করার থাকেনা। হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাওয়া যেন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
প্রাথমিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে হাতের মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বারকয়েক বিধানকাকার নাম্বারে ফোন দেয় সে। সুইচড অফ। বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে,আসার আগে একটা ফোন করে আসা উচিত ছিলো। ঘরে শামীমার ভয়ে দেয়া যেতো না ঠিক। কিন্তু সি এন জি স্ট্যান্ডে এসে ফোনটা দিতে পারতো সে।
ফোন করলেই বা কী হতো, সুইচ অফ পেয়ে এই শাল্লা পর্যন্ত না আসলে চলতো? হয়তো চলতো। এতে তার দুইশ টাকা যাতায়াত ভাড়া বাঁচতো। আসল সমস্যা কিছুই লাঘব হতোনা। বরং ফোন দিয়ে সুইচ অফ পেয়ে তার যে হতবিহবল অবস্থা হতো তাতে শামীমার সামনে ঘটনাটা প্রকাশ না করে পারতো না। আর সাথে সাথে ঘরে চরম অশান্তি শুরু হতো। এই মূহুর্তে যে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হলো সে, সেই নিমজ্জন শুরু হতো আরো ঘন্টা কয়েক আগেই। শামীমা যে কথায় কথায় খোঁটা দেয়, হিন্দু ব্যাটার সাথে কেউ এত্তোগুলা টেকার রিস্ক নেয়,এরা সুযোগ পাইলেই ইন্ডিয়া যায়গা। আজ হাতেনাতে কথার সত্যতা পেয়ে আক্রমণের একটা শব্দও মাটিতে পড়তে দিতোনা শামীমা।
বিধান কাকা গেলো কই! আপাতত এই ব্যাপারটা জানা জরুরি। বন্ধ তালার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকায়। ঠিক কোন ঘরটায় ঢুকে কাকে বিধানকাকার খবর জিজ্ঞেস করা যায়,সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা সে। তবে এদেরই কাউকে না কাউকে তো জিজ্ঞেস করতেই হবে! এত্তোগুলো টাকার লেনদেন বিধানকাকার সাথে!
পাড়ার প্রতিটি ঘরেই মৃত্যু নেমে আসার মতো নিস্তব্ধতা। ধ্বংসস্তুপের ফাঁকে ফাঁকে জীবন চালিয়ে যাওয়ার প্রাণহীন প্রাত্যহিকতা। উঠা, বসা ,খাওয়া জৈবিকতার আবশ্যিকতা । যেন একপাল মৃতদের জগৎ। প্রাণহীন,উদ্দীপনাহীন। এদেরকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা না করা সমান। তবু এদেরকেই জিজ্ঞেস করে একটা হদিস বের করার চেষ্টা তো করতেই হবে।
বাঁদিকের ঘরটায় ঢুকে সে। সেখানে সদ্য প্রলয়ের ধ্বংসস্তূপ মানুষগুলোর মতোই নিষ্প্রাণ। ঘরময় ভাঙা কাপ প্লেট, সোকেসের কাঁচ, স্টিল আলমিরার ভাঙা দরজা,ভাঙা ড্রয়ার, এবড়ো থেবড়ো কাপড়ের স্তুপ। দেয়ালে ঝুলানো দেবতার ছবির ভাঙা ফ্রেম। এর মাঝে হাঁটুরে লুঙ্গি পরে বসে আছেন যে বৃদ্ধ লোকটি, গলায় তুলসীর মালা। তাকে কোন ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে আমানউল্লাহ, বিধান কাকারা কই গেছে জানেন? লোকটির স্থির চোখের পাতা মোটেই কাঁপে না এই প্রশ্নের ধাক্কায়। ত্রিকালজ্ঞ ঋষির মতো নির্বিকার তার বসে থাকা, মরা মাছের চোখের মতো স্থির দৃষ্টি। প্রশ্নটি শুনেছে কি শুনেনি বুঝবার উপায় নেই। দ্বিতীয়বার একটু জোরে প্রশ্নটি করে আমানউল্লাহ,বিধানকাকারা কই গেছে জানেন? এবার ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ যেন মহাকালের সিঙ্গা বাজায়, জানিনা কই গ্যাছে, কইয়া যায় নাই। শুনছি ইন্ডিয়া গেছেগা।
এবার সত্যি আমানউল্লাহর অস্তিত্ব পুড়িয়ে বাজ পড়ে। ঠিক এই আশঙ্কাটাই ছিলো মনে মনে। এখন কোম্পানিকে সে কি জবাব দেবে, কি জবাব দেবে বউকে, দিন গুজরানই বা করবে কীভাবে! শুনা যাচ্ছে দ্বিতীয় দফা লকডাউন আসছে। এই যাত্রায় যদি এই চাকরিটাও যায় কই যাবে সে আবার চাকরি খুঁজতে? সমস্যাগুলি তার ভাবনাকে তৎক্ষনাৎ এমন এক সমাধানহীন জটিল ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়, জীবন তার কাছে এক ঘুলঘুলাইয়ার মতো বোধ হয়। সেবারতো যাই হোক মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলো, রাজধানী থেকে বাড়ি ফিরে একটা চাকরিও জুটে গিয়েছিলো। এবার বোধহয় আর উপায় নাই।
এতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমুদ্রে সাঁতার না জানা বালকের মতো হাবুডুবু খেতে খেতে নন্দিনীর কথা মোটেই মনে পড়েনা আমানউল্লাহর। নিতান্ত অপ্রধান বিষয় নন্দিনী। অথচ ঘরে এই মেয়েটাকে নিয়েই তার নিত্য অশান্তি। শামীমার বদ্ধমূল বিশ্বাস নন্দিনীর জন্যই এখানে আসে সে,ব্যবসাপাতি সব অজুহাত।
সেদিনটার কথা ভুলতে পারেনা শামীমা আমানুল্লাহ কেউই। ঘোর শত্রুর জীবনেও যেনো এরকম দিন না আসে। যেদিন অফিস থেকে ফিরে আমান বললো, আমাদের বোধহয় গ্রামের বাড়ি ফিরা যাইতে হবে, আমার চাকরিটা নাই। শামীমা প্রথমে কথাটা তেমন গায়ে মাখেনি। ঢাকা শহরের পাঁচ বছরের দাম্পত্যে এই নিয়ে তিনবার চাকরি ছাড়তে আর নতুন চাকরি ধরতে দেখেছে আমানকে। এবারও সেরকম কিছুই ভেবেছিল সে। কিন্তু এবার যে মহামারী সব উল্টেপাল্টে দিয়েছে, চাইলেও আমানের আর কোন চাকরি জুটবে না বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হয়েছে শামীমার। মাত্রই সংসারটা গুছিয়ে এনেছিলো সে। রঙিন টিভি কেনা হয়েছিলো। বেতের ডিভান দিয়ে এক টুকরো ড্রয়িংরুম। একটা ফ্রিজ না কিনলে আর চলছিলো না। এর ওর বাসায় মাছ মাংস রেখে আসতো। মুখে না বললেও সবাই যে কমবেশি বিরক্ত হয় তা অস্পষ্ট ছিলো না।
ফ্রিজ কেনার টাকাটা জমানোর জন্য কাজের বুয়া ছাড়া একা হাতে সব কাজ সামলাচ্ছিলো একবছর ধরে। চোখ বন্ধ করে বুয়ার বেতনটা আলাদা করে রাখতো। ফেসবুকে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে এটা ওটা সামনে আসতো, শাড়ি, চুরি,ফ্রাইংপ্যান। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখতো শামীমা। খুব তাড়াতাড়ি একটা ফ্রিজ না কিনলেই নয়,গজগজ করতো সারাদিন।
আর এসময় কিনা একদিন সত্যি সব গুটিয়ে ট্রাকে উঠে বাড়ি চলে আসতে হলো তাদের! গ্রামের বাড়িতো নামেই। বাকি দুই ভাই আগেই সব বিক্রি টিক্রি করে খেয়েছে। এদের করুণার দৃষ্টির সামনে অযাচিত ভিক্ষুকের মতো দাঁড়ানো ছিল ধর্ষিত হওয়া মূহুর্তের মতো দুঃসহ। কারো আপদ হওয়ার চেয়ে চাকরিহীন অনিশ্চিত ভবঘুরে দিন বয়ে বেড়ানোও যেন সহজতর। গ্রামে ফিরে দুজনের উঠতে হয়েছে ভাড়া বাসায়।
চাকরির জন্য নাহিদের কাছে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে গিয়েছিলো আমানউল্লাহ। শামীমার পীড়াপীড়িতে। একসাথে পড়েছে নাহিদ আর আমান শহরের হাইস্কুলটাতে। লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র নাহিদ এখন শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। স্কুলে বাজে ছাত্র বলে যার সাথে কোনদিন কথাই বলেনি তার কাছে চাকরির জন্য যাওয়া যতোই অসম্মান আর আত্মগ্লানির হোক,সেই মূহুর্তে আর কোন উপায় ছিলো না আমানের।
নাহিদ তাকে ফেরায়নি। বেশ কয়টা বহুজাতিক কোম্পানির এজেন্সি তার। কসমেটিক্স, ইলেকট্রনিকস। একটা ইলেকট্রনিকসের কোম্পানিতেই স্যালস ম্যানেজার হিসাবে তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাসে লক্ষাধিক টাকার টার্গেট। এই টার্গেট পূরণের উপর সেলারি। নাহিদের ব্যবহার ছিলো পুরাই পেশাদার বসের মতো। স্কুলজীবনের বন্ধুত্বের স্মারক কোন পরিচিত হাসি বা বেহিসাবি আন্তরিকতা কোথাও বিন্দুমাত্র প্রশ্রয়ের সুযোগ দেয়নি সে একদা সহপাঠী আমানউল্লাহর প্রতি।
একেতো মহামারীর ধাক্কাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি মানুষ, তায় আবার এসব সৌখিন ইলেকট্রনিকস জিনিস পত্র কেনা। তবু চাকরিটা পেয়ে হণ্যে হয়ে ঘুরছে সে শহরের আনাচেকানাচে, জনে জনে। যদি কেউ কিনে।
বিধান কাকার সাথে একদিন এক ফার্মেসিতে দেখা। খেয়াল করেনি আমান। দোকানদারকে স্বাভাবিক ভাবেই বলছিল, এক প্যাকেট কনডম দেন। পাশ থেকে তখনই কথা বলে উঠলেন বিধান কাকা। কেডা,আমাইন্না নি? আরে কাকা আপনে! তড়িঘড়ি বিধান কাকাকে বাইরে ডেকে এনে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে বাসার ঠিকানা চেয়ে রেখে, রিক্সা ডেকে উঠিয়ে দিয়ে লজ্জা থেকে বেঁচেছিলো আমানউল্লাহ। নিজেকে মনে হচ্ছিলো হঠাৎ মুরুব্বির সামনে খোলা চুলে ধরা পড়ে যাওয়া নতুন বউ। মাথায় কাপড় তুলে তড়িঘড়ি সম্ভ্রম বাঁচিয়ে রক্ষা!
যেই সেই লোক নন বিধানকাকা। তার আব্বা আজিজউল্লাহর খাতিরের মানুষ, বলা যায় একমাত্র খাতিরের মানুষ। ছোটবেলা দেখেছে শাল্লা থেকে সুনামগঞ্জ শহরে এসে আব্বার দোকানে বসে পত্রিকা পড়ে আড্ডা দিতেন এই বিধান কাকা । আমানের আব্বার ছিল রাজনীতির নেশা। আর যাই হোক প্রতিদিন আগা থেকে গোড়া পত্রিকা পড়তেন তিনি, আর বিধান কাকার সাথেই রাজ্যের আলাপ জমতো তার। কওতো বিধান এইভাবে যদি ভোট করন লাগে, তো কোটি কোটি টাকার নির্বাচন সাজাইলি ক্যান! বিধান কাকারও যুক্তির অভাব ছিলো না, শোন আজিজ ভাইজান, তারা কী কম চেষ্টা করছে শেখের নাম মুইছ্যা ফালাইতে? আর শেখের বেটির উপর গ্রেনেড হামলা সব হিসাব বদলাইয়া দিছে। অহন খালি একদলের দোষ দেখলে হবে গো ভাই। আব্বা দ্বিমত করতে পারতেন না। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেন, এইভাবে কয়দিন থাকতে পারবো ক তো বিধান! পারবো পারবো। আরে শোন সরকার বদলাইবার জইন্য কেউ এখন আর রাস্তায় নাইম্যা পুলিশের মাইর খাইত নায়। রাজনীতি কইরা সব দলের সবাই মন্ত্রি মিনিস্টার হইতে চায়। এইডা নেত্রী বুইঝ্যা ফালাইছে। তাই বইলা এরকম ভোটার ছাড়া ভোট করা ভবিষ্যতের জন্য খুব খারাপ হইলো রে বিধান, আব্বার কণ্ঠে গণক ঠাকুরের মতো হতাশা। আরে আজিজ ভাইজান, বাইচ্চা পোলাপানরে জোর কইরা যেমন এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো লাগে, তেমনি মূর্খ মাইনষেরে জোর কইরা উন্নয়ন গিলানো লাগে। হা হা হা, হাসতো দুজন। মাইনষে কয় বাপের বেটি, আমি কই এক বেটি জন্ম নিছিলো বাপের ঘরে। ক্যামন সাকা চৌধুরী আর নিজামীর মতো বাঘ-মহিষরে এক ঘাটের পানি খাওয়াইয়া ছাইড়া দিল। কইলজাডা দেখো! বলতে বলতে আবেগময় উচ্ছ্বাস লুকাতে পারতন না বিধানকাকা। পাঁড় আওয়ামী লীগার সে।
আর এই আওয়ামীলীগের আমলেই কিনা তাকে দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া যেতে হলো! আচ্ছা তিনি কি সত্যি ইন্ডিয়া গেছেন ? নাকি দেশের ভেতরেই কোথাও আত্মগোপন করে আছেন। সব কয়টা ফোন বন্ধ। বিধানকাকার মেয়ে নন্দিনীর ফোনটাও। বেশ কয়েকবার ফোন করেছে আমান।
নন্দিনীর সাথে তার প্রেমতো নয়ই,প্রেম প্রেম ভাবও নয়। হতোও না কোনদিন। নন্দিনী সুনামগঞ্জের সরকারি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ে। আমানুল্লাহ একেতো মুসলিম,করে সামান্য সেলসম্যানের চাকরি, তায় আবার বিবাহিত। আমানের প্রেমে পড়ার মতো বোকা মেয়ে নয় নন্দিনী। নন্দিনী কেন,এ যুগের কোন মেয়েই এরকম বোকা হয়না।
তবু নিয়মিত যেতে যেতে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনীর সাথে। হিন্দু মেয়েদের কোন জড়তা থাকেনা। কী সুন্দর হেসে মিশে কথা বলে। মাত্রতো কয়েক মাস। অথচ মনে হতো কতো পরিচিত। আমান ভাই পেয়ারা খান, বলে প্লেট থেকে এক টুকরো তুলে লবণ লাগিয়ে নিজেও এক টুকরো মুখে পুরতো নন্দিনী। একই প্লেটে সে আর নন্দিনী। অথচ সারাজীবন শুনে এসেছে হিন্দুরা মুসলমানের ছোঁয়া কিছু খায়না। এমন আন্তরিক ব্যবহারে প্রশ্নটা বেখাপ্পা বেমানান হতো বুঝেই আমান কোনদিন এসব প্রশ্ন তুলেনি নন্দিনীর সামনে। প্রশ্নটা করলে নন্দিনী হয়তো আদৌ বিব্রত হতোনা বরং আমানুল্লাহ নিজেই ছোট হতো।
এমন সহজ একটা সম্পর্কের মাঝামাঝি আমানুল্লাহ একদিন একটু সাহসী হয়ে উঠেছিলো। শাড়ি গয়নায় সেজে আমানুল্লাহর সামনে দিয়ে বিয়ে খেতে গিয়েছিলো নন্দিনী, আর কী কুক্ষণে যে আমান ওদের বাসা থেকে বের হয়ে মেসেজটা লিখছিলো নন্দিনীকে, তোমাকে পরীর মতো লাগছে নন্দিনী।
মেসেজ লেখাটা খুব বড় বিষয় হয়ে উঠতো না, নন্দিনী খুব সহজ ভাবেই নিয়েছিলো সেটা। কিন্তু আপদটা নিজেই ডেকে এনেছে সে, বাসায় ঢোকার আগে মেসেজটা ডিলিট করতে ভুলে গিয়ে। সেটাই পড়ে গিয়েছে শামীমার চোখে, আর যায় কই, তারপর থেকেই রক্ষে নেই। শামীমার কথার হুলে অতিষ্ঠ দিন,অতিষ্ঠ রাত, সারাদিন সন্দেহের অনুসরণ, মোবাইল চেক, কী অসহ্য। আমান ঠিক করে রেখেছিল আজ বিধানকাকার সাথে লেনদেনটা শেষ হয়ে গেলে আর এই বাড়ির পথ মাড়াবে না সে।
পেনশনের টাকায় লক্ষাধিক টাকার ইলেকট্রনিকস জিনিসপত্র কিনেছিলেন বিধান কাকা। ইনস্টলমেন্টে। সেই টাকা আনতেই বিধানকাকার বাড়ি যেতে হতো আমানুল্লাহর প্রতিমাসে নিয়ম করে। শামীমা কড়া নজরদারিতে রাখতো তাকে, কোনদিন বিধান কাকার বাড়ি যায় কখন যায়, কতোক্ষন থাকে।
অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে টাকাগুলো জমিয়েছিলো শামীমা। একটা ফ্রিজ কিনবে। এই টাকাটা দিয়ে দিয়েছে বিধান কাকার গত মাসের ইনস্টলমেন্ট। গতমাসে ইন্সটলমেন্টের টাকা দিতে পারেননি বিধানকাকা। শাল্লার হিন্দুপাড়ায় এই আক্রমণে সব হারানোর পর ইনস্টলমেন্টের টাকাটা দেয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না তিনি। বিধ্বস্ত, পরাজিত,বিভ্রান্ত একটা মানুষের কাছে চাওয়ার মতো অবস্থাও ছিলো না। পাড়ায় এই পুলিশ আসে তো এই র্যাব। এই মন্ত্রি ,মিনিস্টার, ডিসি -এস পি,এন জি ও। স্বচ্ছাসেবী সংস্থা। দম নেই এদের। এর মধ্যে টাকাটা চায় কি করে। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা সমস্ত জিনিস লুটপাট, ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে গেছে হার্মাদের দল। আদৌ কি আর বাকি টাকা দিতে পারবেন বিধানকাকা ! সন্দেহটা দানা বাঁধার আগেই একফাঁকে অশ্রু মুছতে মুছতে চণ্ডিগাছতলায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে তার হাত দুটি ধরে কথা দিয়েছিলেন, বাবা আমান তোমারে আমি বিপদে ফালাইতাম না। যেমনে পারি টাকাগুলা দিমু। কয়ডাদিন সময় দেও।
পেনশনে যাবার পর থাকার জন্য এ পাড়াটা বিধান কাকা বেছে নিয়েছিলেন হিন্দুপাড়া বলেই। ঘরে উপযুক্ত তিনটা মেয়ে। চাইলে তিনটাকেই একসাথে বিয়ে দেয়া যায়। পাত্রপক্ষ যখন তখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। পেনশনের টাকায় ঘর সাজিয়েছেন তিনি,পাত্রপক্ষের সামনে যেন মান না যায়। রঙিন টিভি, ফ্রিজ। নতুন একসেট মালয়েশিয়ান কাঠের সোফা। সব তখন ধ্বংসস্তুপ। সবাই আসে। দলে দলে। সামনে পিছনে ক্যামেরা বুম, বড় বড় কথা। কিন্তু যাদের গেছে তারা জানে এই কথার ফুলঝুরিতে কিচ্ছু ফিরবে না তাদের, না সারা জীবনের সঞ্চয় ঘরের অস্থাবর সম্পদ, না হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস আর মর্যাদা। নিঃস্বতা আসলে তাদের নিয়তিতে লেখা হয়ে গেছে অমোচনীয় কালিতে।
বিধানকাকা বলেছিলেন, এক তারিখে সঞ্চয় ব্যাংক থাইক্যা পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের ইন্টারেস্ট উঠাইমু বাবা, দুই তারিখে আইসা নিয়া যাইও। আমান এই নুয়ে পরা লাউগাছের মতো পরাজিত লোকটাকে বলতে পারেন নি গত মাসের ইনস্টলমেন্ট দেরিতে হলেও নিজের টাকায় জমা দিয়েছে সে, এইবার তারিখমতো জমা না দিতে পারলে তার চাকরি নিয়ে টান পড়বে।
অনেক অনুনয় করে শামীমার জমানো টাকাগুলো কোম্পানিতে জমা দিয়ে চাকরিটা বাঁচিয়েছে সে। দুই তারিখে আসলটাতো মিলবেই, সাথে সেলারিটাও জমা হবে একাউন্টে। হিসাবটা বুঝমত পড়ায় বিশেষ আপত্তি করেনি শামীমা। তার উপর ঘটনা যে মিথ্যা নয়, টিভি খুলেই দেখতে পায় সে। বিধ্বস্ত পাড়ার ছবি দেখে নন্দিনীর কথা তোলে খোঁটাও দেয়নি এই কয়েকদিন। বরং রাজনীতিবোধহীন আক্ষেপে অধৈর্য হয়েছে, এইডা কেমুন কথা! মগের মুল্লুক পাইছে নি! এম্নে বাড়িঘর ভাঙব,কুনু বিচার আচার নাই? কি জবাব দেবে সে শামীমাকে? কোম্পানির কাছেই বা কী জবাবদিহি করবে সে?
ফিরতি পথ ধরে আমানউল্লাহ। মাথাটা নষ্ট পানির মটরের মতো থ মেরে আছে, জীবনের যতদূর চোখ যায় সমাধানহীন আশাহীন ধূ ধূ রুক্ষ মরুভূমি। ততক্ষণে সকালে ধেয়ে আসা কালো মেঘের দল উধাও। ফকফকা সূর্যের আলো। বৈশাখের মেঘের দল, গিরগিটি নেতাদের মতো। রং পাল্টাতে সময় লাগেনা।
একদল পুলিশের মুখোমুখি হতে হতে পাশ কাটিয়ে যায় আমান। এরা প্রতিদিন দলে দলে এসে করে কী? অথচ সময়কালে কারো সাহায্য পেলোনা এই কয়ঘর হিন্দু! বিধানকাকার ঘরটা পাড়ার এককোণে, এক অলুক্ষণে বিষাদে দাঁড়িয়ে আছে যেন পুরো পাড়ার ভবিষ্যতের মতো।
পুলিশের দলটি সরে গেলে বাসার পেছনে ঢালু বিছরা থেকে কোন নারীকণ্ঠের ডাক শোনা যায়, আমান ভাই,খাড়াইন। মূহুর্তে তার মনে হয় যেনো নন্দিনীর কণ্ঠ! তবে কি যায়নি এরা, আশেপাশেই আছে?
ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখে না নন্দিনী নয়। এই মেয়েটিকে সে চিনেনা।মেয়েটি এগিয়ে এসে হাতে একটা খাম গুঁজে দেয়। নন্দিনী দিদি দিয়া গ্যাছে। খামের ভেতরে আঁটতে না পেরে হাঁসফাঁস করছে কতোগুলো কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট। নন্দিনীরা কই গ্যাছে, জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ তুলে আমান দেখে মেয়েটা এক দৌড়ে কোথায় লুকিয়ে গেছে ধ্বংসস্তুপের আড়ালে।
2 মন্তব্যসমূহ
এই সময়ের দলিল হয়ে থাকবে এই গল্প।অতিমারি, আর্থিক বিপন্নতা ও পেশাগত অনিশ্চয়তার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের অসহায়তা - সবই এসেছে কিন্তু উচ্চকিত ভাবে নয়,সেটা আকর্ষণীয়।
উত্তরমুছুনবাহ, এক ঝলকের চমৎকার কাহিনিচিত্র। ফ্লাশব্যাকে অনেক কিছু। নির্মোহভাবে সত্যের বয়ান। অসাধার।
উত্তরমুছুন