মৌকে বললাম,“ বাবা একটা কিছু শুরু করেছিল।” মৌ বলল,“ কী?” আমি বললাম,“ জানি না তবে মেমোয়ার্স জাতীয় কিছু হবে।” মৌ বলল,“ এখানে তুষার ঝড় হবে।”
—— সেকি!
—— হ্যাঁ ।
—— তুষার ঝড়?
—— হ্যাঁ। হবেই।
—— কী করে বুঝলি?
—— ভীষণ খারাপ আবহাওয়া। বরফ পড়ছে।
—— টেক্সাসে পড়ে
—— হ্যাঁ ।
—— তুষার ঝড়?
—— হ্যাঁ। হবেই।
—— কী করে বুঝলি?
—— ভীষণ খারাপ আবহাওয়া। বরফ পড়ছে।
—— টেক্সাসে পড়ে
— বরফ?
—— পড়ে কখনও কখনও, তবে এতো নয়। এবার রীতিমত তুষার ঝড়- ব্লিজার্ড।
—— সেকি!
—— পাওয়ার গ্রিড ফেল করেছে। লোকে বাড়ির ভেতর ঠাণ্ডায় জমে মরেছে।
—— ঠাণ্ডায়।
—— রুম হিটিং ফেল করেছে। বাইরের ঠাণ্ডা ভেতরে চলে এসেছে।
—— ভেতরের গরম?
—— আর নেই।
—— কী নেই?
—— কেউ গরম থাকছে না। তবে আমি ঠিক আছি।
—— ঠিক আছিস তো?
——হ্যাঁ, চিন্তা কর না আমাদের কোম্পানি দেখভাল করছে।
—— করছে?
—— হ্যাঁ , খুবই। আর এখানে পাওয়ার সাপ্লাই আছে। কোম্পানি থেকে একটা টিম তৈরি করেছে— খোঁজ নিচ্ছে সব।
—— যাক।
—— দাদুর ব্যাপারে কী বলছ?
—— হ্যাঁ - বলছিলাম একটা মেমোয়ার্স জাতীয় কিছু লিখেছিল।
—— তাই?
—— শেষ করেনি। পরিবার টরিবার নিয়ে লিখেছিল অনেকটা।
—— পরিবার?
—— নিজেকে নিয়ে লিখেছিল কিনা জানি না। পরিবার নিয়ে লিখেছিল।
—— পাঠিও।
মৌ বলেছিল টেক্সাসে তুষার ঝড়ের কথা, আমি শুনেছিলাম আর বাবার জীবনস্মৃতি বা মেমোয়ার্স নিয়ে বলেছিলাম।লিখতে গেলে সব ডায়েরির মতো হয়ে যাচ্ছে- সব। সুকান্ত শুনে বলেছিল,“ এটা তো ডায়েরি।” বাবার মেমোয়ার্সের কথা লিখলে সেটাও ডায়েরির মতো হয়ে যাবে? এই ভাবে শুধু কথোপকথন লিখতে চাইছি। পাতার পর পাতা জুড়ে শুধু কথোপকথন হবে। সব কথাবার্তা নিয়ে নিয়ে সাজিয়ে রেখে দেখব। সাজাবো আর দেখব। এ ভাবে হলে নিশ্চয়ই ডায়েরির মতো মনে হবে না। চিন্তার নদীরা চিন্তার পুকুরের সঙ্গে কথা বলবে না। চিন্তার পুকুররা থাকবে না শুধু পাড় বাঁধানো হবে। ঝকঝকে পাড় যেখানে বসে থাকলেই হাওয়া দেবে। সে হাওয়ায় দোল খেতে খেতে দেখব লেখাটা কোথায় দাঁড়ায়। লেখা দাঁড়াবে না। লেখা শুয়ে থাকবে। সে ঘুমতে চাইবে। সে মরতে চাইবে না অথচ তাকে মরে যেতেই হবে। নির্জন বারান্দায় বসে বসে মরবে। মরার সময় তার হাতের কাছে থাকবে এক বাটি মুড়ি। সে মুড়ি খাচ্ছিল । তারপর মরে যায়। সেখানে একটা পাঞ্চিং ব্যাগ ঝোলান ছিল। সে যখন মরে গেল পাঞ্চিং ব্যাগটা জুড়ে শুধু আওয়াজ হয় “মার মার মার মার মার মার .......।”
বাবার বাবার একটা ফোর্ড গাড়ি ছিল। আর ছিল ঘোড়ার গাড়ি। সে নিয়ে কোথায় কোথায় যেত সব লেখা আছে। বাবা সব লিখে রেখেছিল। ফোর্ড গাড়িটার খুঁটিনাটি বর্ণনা ছিল। এমন বর্ণনা যার থেকে গাড়ির সব কিছু বোঝা যাচ্ছিল। সে গাড় কেমন করে চলে আর চললে কী কী আওয়াজ হয় সব বোঝা যাচ্ছিল। গাড়িটা এঁকে বেঁকে যাচ্ছিল যখন যাচ্ছিল গাড়িটার ভেতর থেকে শব্দ হচ্ছিল। সে শব্দ ছাপিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে অজস্র কথাবার্তা বাইরে আসছিল। সে কথাবার্তারা গাড়ির কথা ছিল, তারা বাইরের কথাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল যাতে বোঝা যায় কিছু একটা চলছে তো চলছেই ধূলোমাখা বা পরিষ্কার রাস্তাঘাট দিয়ে আর আওয়াজ হচ্ছে প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক....... এ সব ফোর্ড গাড়ির আওয়াজ। গাড়িটা যখন প্রথম আসে তখন বাবার বাবার ঘোড়ার গাড়ি ছিল দুটো। সেই ঘোড়ার আস্তাবলের পাশেই গাড়িটা রাখা হল। তখন ঘোড়ারা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল। গাড়িটা গড়িয়ে এসে থামল। তখনও তারা তাকিয়েছিল।
তাদের খেতে দেওয়া হয়েছিল। মাটি জুড়ে ঘাসের পাহাড় এসেছিল। আস্তাবলের ভেতর ঝাঁঝালো পেচ্ছাবের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল আর ঘোড়ার গা দিয়ে তার নাদি দিয়ে গন্ধ বেরচ্ছিল। সেই সব গন্ধের ভেতর দিয়ে দৃশ্যেরা ছিল আর কোথা থেকে আলো এসে পড়েছিল। সে আলো সব জায়গায় একরকম না থেকে তীরের মতো আলোর কণা হয়ে এসে পড়ে সারা আস্তাবল আর সামনে রাখা গাড়িটায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। ঘোড়া দুটো ঘাস খেতে খেতে মাঝে মধ্যেই গাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিল। তারা গাড়িটার গা থেকে গন্ধ শুঁকেছিল কিন্তু কোন গন্ধ গাড়িটা থেকে আসছিল না দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। ঘোড়ারা কি বুঝতে পেরেছিল গাড়ির কোন নিজস্ব গন্ধ নেই। তার গন্ধ সব তেলের গন্ধ, মোবিলের গন্ধ আর হয়ত বা ধূলোর গন্ধ। ওরা কি তফাৎ করতে পেরেছিল আর না করতে পেরে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সেই আলোর মধ্যে দিয়ে যা আস্তাবলের ভেতর পড়ে তারপর তেরছা হয়ে গাড়িটার ওপর গিয়ে পড়ল এইমাত্র। তারা কি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল গাড়ির হেডলাইটের দিকে। তারপর সেই হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠলে বুঝতে পেরেছিল এ এমন একটা কিছু যার নিজস্ব আলো আছে আর সেটা নিভে গেলেও আবার জ্বলে উঠবে যে কোন সময়।
মৌ বলেছিল,“ আমি একটা কিছু লিখতে চাইছি।”
—— কী?
—— সে জন্য দাদুর ওই মেমোয়ার্সটা পাঠাও।
—— ওটা তো তৈরি লেখা নয়।
—— মানে?
—— তুই যে রকম চাইছিস সে রকম কমপ্লিট লেখা নয়।
—— সে আমি জানি না বাবা।
—— দাদুর লেখাটা চাইছি।
—— আর কিছু?
—— আর কিছু চাইতে যাব কেন?
—— তা জানি না।
—— তুমি পুরো লেখাটা পড়েছ?
—— না।
—— তবে?
—— পড়তে শুরু করেছি।
—— আর আমাকে পাঠাও।
—— স্ক্যান করে?
—— হ্যাঁ , স্ক্যান করেই পাঠাও।
—— তুই কী জানতে চাইছিস।
—— দাদুর সব জানতে চাইছি।
—— সব কি আছে?
—— মেমোয়ার্সটা আছে তো?
—— হ্যাঁ , তা আছে।
—— তবে তাই পাঠাও।
—— হ্যাঁ, সেটাই পাঠাচ্ছি।
মৌ বাবার মেমোয়ার্সের ব্যাপারে কথা বলছিল। সে নিজের লেখা লিখতে চাইছে আর বাবার লেখা পড়তে চাইছে। নিজের লেখা লেখার জন্য নিজের লেখা পড়লেই হবে কিনা এটা ওকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বলেছিঃ
—— টেক্সাসে ঝড় থেমে গেছে?
—— হয়েছিল।
—— আর এখন?
—— এখনও তুষার পড়ছে।
—— আর ঝড়?
—— ব্লিজার্ডের কথা বলছ তো?
—— হ্যাঁ।
—— হয়েছিল।
—— ক দিন ?
—— কয়েক দিন। তাতেই সব বন্ধ। সব অচল।
—— সেকি আমেরিকাতেও?
—— আমেরিকাতেও হয়।
—— হয়েছিল?
—— সব ফেল করেছিল টেক্সাসে।
ওর কথার মধ্যে দিয়ে ঝড় আসছিল। শীত লাগছিল খুব। ভাবলাম জানলাটা বন্ধ করে দিই। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম গরম আসছে খুব। গরমরা হাওয়াকে হাল্কা করেছে সেই জন্য হাওয়ারা হল্কা দিয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছিল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। দূর দিকে তাকালাম , কাছ দিকে তাকালাম। দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে তুষারের মধ্যিখানে। বাবা তুষার ঠেলে ঠেলে আমার দিকে আসছে। মাঝমধ্যে দু হাত উঁচু করে করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বাবার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বাবার মোটা মোটা ঠোঁট শীতে ফেটে গেছে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে দু হাত তুলে নাড়ছে আর খুব তুষার ঝড় হচ্ছে- ব্লিজার্ড। কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না, কোন কিছু দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা বাচ্চা প্রায় গলা অবধি বরফের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। ওর জন্ম কি ১৯৭৮ সালে? ওর চারপাশে বরফ আর ঝড়। ওই বাচ্চাটা আর হাঁটতে পারছে না এবার পড়ে যাবে। এবার বাবা আমাকে ডাকছে। দুষহাত তুলে নাড়ছে। আওয়াজ করছে,“ এই হো হো হো, এই হো হো হো, এই হো হো হো — শিগ্গির যা। বাচ্চাটাকে বাঁচা। ডুবে যাবে যে ব্লিজার্ড ব্লিজার্ড এই হো হো হো এই হো হো হো এই হো হো হো ।” আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,“ ওর কি ১৯৭৮ সালে জন্ম? ও কি মৌ?” বাবা হাত নাড়তে নাড়তে আমার দিকে এগোয়। আমি তুষার ঝড়ের ভেতর পড়ে যেতে যেতে বাচ্চাটাকে তুলে ধরেছি। গরমের হল্কা এসে নাকে চোখে লাগছে জানলার ধারে আর বাবা কফি হাউসের মধ্যিখানের কোন একটা টেবিলে বসে আছে। আমায় বলল,“ দুধ ছাড়া কফিকে বলে ইনফিউশন।”
—— কিন্তু তাতে কি চিনি দেওয়া চলে?
—— চলবে না কেন।
—— সব চলে?
—— হ্যাঁ যার যেমন পছন্দ। কেউ নেয় , কেউ নেয় না।
—— কী?
—— চিনির কথাই তো বলছিলি। আর এটা হল পাকোড়া।
—— ইনফিউশন আর পাকোড়া?
—— ইনফিউশন আর পাকোড়া।
বাবা পাকোড়া খাচ্ছিল। তারপর কফি খাবে। সেই প্রথম কফি হাউসে। এ কথা মৌকে বলাতে ও বলল,“ কফি হাউস।”
—— হ্যাঁ, কলেজ স্ট্রিটে।
—— কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস।
—— ইন্ডিয়ান কফি হাউস। সেন্ট্রাল এভিনিউতেও আছে আর আছে যাদবপুরে।
—— দাদুর সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলে?
—— কলেজ স্ট্রিটে।
—— এই সব দাদু লিখেছে?
—— কোথায় ?
—— পড়ে কখনও কখনও, তবে এতো নয়। এবার রীতিমত তুষার ঝড়- ব্লিজার্ড।
—— সেকি!
—— পাওয়ার গ্রিড ফেল করেছে। লোকে বাড়ির ভেতর ঠাণ্ডায় জমে মরেছে।
—— ঠাণ্ডায়।
—— রুম হিটিং ফেল করেছে। বাইরের ঠাণ্ডা ভেতরে চলে এসেছে।
—— ভেতরের গরম?
—— আর নেই।
—— কী নেই?
—— কেউ গরম থাকছে না। তবে আমি ঠিক আছি।
—— ঠিক আছিস তো?
——হ্যাঁ, চিন্তা কর না আমাদের কোম্পানি দেখভাল করছে।
—— করছে?
—— হ্যাঁ , খুবই। আর এখানে পাওয়ার সাপ্লাই আছে। কোম্পানি থেকে একটা টিম তৈরি করেছে— খোঁজ নিচ্ছে সব।
—— যাক।
—— দাদুর ব্যাপারে কী বলছ?
—— হ্যাঁ - বলছিলাম একটা মেমোয়ার্স জাতীয় কিছু লিখেছিল।
—— তাই?
—— শেষ করেনি। পরিবার টরিবার নিয়ে লিখেছিল অনেকটা।
—— পরিবার?
—— নিজেকে নিয়ে লিখেছিল কিনা জানি না। পরিবার নিয়ে লিখেছিল।
—— পাঠিও।
মৌ বলেছিল টেক্সাসে তুষার ঝড়ের কথা, আমি শুনেছিলাম আর বাবার জীবনস্মৃতি বা মেমোয়ার্স নিয়ে বলেছিলাম।লিখতে গেলে সব ডায়েরির মতো হয়ে যাচ্ছে- সব। সুকান্ত শুনে বলেছিল,“ এটা তো ডায়েরি।” বাবার মেমোয়ার্সের কথা লিখলে সেটাও ডায়েরির মতো হয়ে যাবে? এই ভাবে শুধু কথোপকথন লিখতে চাইছি। পাতার পর পাতা জুড়ে শুধু কথোপকথন হবে। সব কথাবার্তা নিয়ে নিয়ে সাজিয়ে রেখে দেখব। সাজাবো আর দেখব। এ ভাবে হলে নিশ্চয়ই ডায়েরির মতো মনে হবে না। চিন্তার নদীরা চিন্তার পুকুরের সঙ্গে কথা বলবে না। চিন্তার পুকুররা থাকবে না শুধু পাড় বাঁধানো হবে। ঝকঝকে পাড় যেখানে বসে থাকলেই হাওয়া দেবে। সে হাওয়ায় দোল খেতে খেতে দেখব লেখাটা কোথায় দাঁড়ায়। লেখা দাঁড়াবে না। লেখা শুয়ে থাকবে। সে ঘুমতে চাইবে। সে মরতে চাইবে না অথচ তাকে মরে যেতেই হবে। নির্জন বারান্দায় বসে বসে মরবে। মরার সময় তার হাতের কাছে থাকবে এক বাটি মুড়ি। সে মুড়ি খাচ্ছিল । তারপর মরে যায়। সেখানে একটা পাঞ্চিং ব্যাগ ঝোলান ছিল। সে যখন মরে গেল পাঞ্চিং ব্যাগটা জুড়ে শুধু আওয়াজ হয় “মার মার মার মার মার মার .......।”
বাবার বাবার একটা ফোর্ড গাড়ি ছিল। আর ছিল ঘোড়ার গাড়ি। সে নিয়ে কোথায় কোথায় যেত সব লেখা আছে। বাবা সব লিখে রেখেছিল। ফোর্ড গাড়িটার খুঁটিনাটি বর্ণনা ছিল। এমন বর্ণনা যার থেকে গাড়ির সব কিছু বোঝা যাচ্ছিল। সে গাড় কেমন করে চলে আর চললে কী কী আওয়াজ হয় সব বোঝা যাচ্ছিল। গাড়িটা এঁকে বেঁকে যাচ্ছিল যখন যাচ্ছিল গাড়িটার ভেতর থেকে শব্দ হচ্ছিল। সে শব্দ ছাপিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে অজস্র কথাবার্তা বাইরে আসছিল। সে কথাবার্তারা গাড়ির কথা ছিল, তারা বাইরের কথাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল যাতে বোঝা যায় কিছু একটা চলছে তো চলছেই ধূলোমাখা বা পরিষ্কার রাস্তাঘাট দিয়ে আর আওয়াজ হচ্ছে প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক....... এ সব ফোর্ড গাড়ির আওয়াজ। গাড়িটা যখন প্রথম আসে তখন বাবার বাবার ঘোড়ার গাড়ি ছিল দুটো। সেই ঘোড়ার আস্তাবলের পাশেই গাড়িটা রাখা হল। তখন ঘোড়ারা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল। গাড়িটা গড়িয়ে এসে থামল। তখনও তারা তাকিয়েছিল।
তাদের খেতে দেওয়া হয়েছিল। মাটি জুড়ে ঘাসের পাহাড় এসেছিল। আস্তাবলের ভেতর ঝাঁঝালো পেচ্ছাবের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল আর ঘোড়ার গা দিয়ে তার নাদি দিয়ে গন্ধ বেরচ্ছিল। সেই সব গন্ধের ভেতর দিয়ে দৃশ্যেরা ছিল আর কোথা থেকে আলো এসে পড়েছিল। সে আলো সব জায়গায় একরকম না থেকে তীরের মতো আলোর কণা হয়ে এসে পড়ে সারা আস্তাবল আর সামনে রাখা গাড়িটায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। ঘোড়া দুটো ঘাস খেতে খেতে মাঝে মধ্যেই গাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিল। তারা গাড়িটার গা থেকে গন্ধ শুঁকেছিল কিন্তু কোন গন্ধ গাড়িটা থেকে আসছিল না দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। ঘোড়ারা কি বুঝতে পেরেছিল গাড়ির কোন নিজস্ব গন্ধ নেই। তার গন্ধ সব তেলের গন্ধ, মোবিলের গন্ধ আর হয়ত বা ধূলোর গন্ধ। ওরা কি তফাৎ করতে পেরেছিল আর না করতে পেরে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সেই আলোর মধ্যে দিয়ে যা আস্তাবলের ভেতর পড়ে তারপর তেরছা হয়ে গাড়িটার ওপর গিয়ে পড়ল এইমাত্র। তারা কি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল গাড়ির হেডলাইটের দিকে। তারপর সেই হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠলে বুঝতে পেরেছিল এ এমন একটা কিছু যার নিজস্ব আলো আছে আর সেটা নিভে গেলেও আবার জ্বলে উঠবে যে কোন সময়।
মৌ বলেছিল,“ আমি একটা কিছু লিখতে চাইছি।”
—— কী?
—— সে জন্য দাদুর ওই মেমোয়ার্সটা পাঠাও।
—— ওটা তো তৈরি লেখা নয়।
—— মানে?
—— তুই যে রকম চাইছিস সে রকম কমপ্লিট লেখা নয়।
—— সে আমি জানি না বাবা।
—— দাদুর লেখাটা চাইছি।
—— আর কিছু?
—— আর কিছু চাইতে যাব কেন?
—— তা জানি না।
—— তুমি পুরো লেখাটা পড়েছ?
—— না।
—— তবে?
—— পড়তে শুরু করেছি।
—— আর আমাকে পাঠাও।
—— স্ক্যান করে?
—— হ্যাঁ , স্ক্যান করেই পাঠাও।
—— তুই কী জানতে চাইছিস।
—— দাদুর সব জানতে চাইছি।
—— সব কি আছে?
—— মেমোয়ার্সটা আছে তো?
—— হ্যাঁ , তা আছে।
—— তবে তাই পাঠাও।
—— হ্যাঁ, সেটাই পাঠাচ্ছি।
মৌ বাবার মেমোয়ার্সের ব্যাপারে কথা বলছিল। সে নিজের লেখা লিখতে চাইছে আর বাবার লেখা পড়তে চাইছে। নিজের লেখা লেখার জন্য নিজের লেখা পড়লেই হবে কিনা এটা ওকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বলেছিঃ
—— টেক্সাসে ঝড় থেমে গেছে?
—— হয়েছিল।
—— আর এখন?
—— এখনও তুষার পড়ছে।
—— আর ঝড়?
—— ব্লিজার্ডের কথা বলছ তো?
—— হ্যাঁ।
—— হয়েছিল।
—— ক দিন ?
—— কয়েক দিন। তাতেই সব বন্ধ। সব অচল।
—— সেকি আমেরিকাতেও?
—— আমেরিকাতেও হয়।
—— হয়েছিল?
—— সব ফেল করেছিল টেক্সাসে।
ওর কথার মধ্যে দিয়ে ঝড় আসছিল। শীত লাগছিল খুব। ভাবলাম জানলাটা বন্ধ করে দিই। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম গরম আসছে খুব। গরমরা হাওয়াকে হাল্কা করেছে সেই জন্য হাওয়ারা হল্কা দিয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছিল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। দূর দিকে তাকালাম , কাছ দিকে তাকালাম। দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে তুষারের মধ্যিখানে। বাবা তুষার ঠেলে ঠেলে আমার দিকে আসছে। মাঝমধ্যে দু হাত উঁচু করে করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বাবার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বাবার মোটা মোটা ঠোঁট শীতে ফেটে গেছে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে দু হাত তুলে নাড়ছে আর খুব তুষার ঝড় হচ্ছে- ব্লিজার্ড। কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না, কোন কিছু দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা বাচ্চা প্রায় গলা অবধি বরফের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। ওর জন্ম কি ১৯৭৮ সালে? ওর চারপাশে বরফ আর ঝড়। ওই বাচ্চাটা আর হাঁটতে পারছে না এবার পড়ে যাবে। এবার বাবা আমাকে ডাকছে। দুষহাত তুলে নাড়ছে। আওয়াজ করছে,“ এই হো হো হো, এই হো হো হো, এই হো হো হো — শিগ্গির যা। বাচ্চাটাকে বাঁচা। ডুবে যাবে যে ব্লিজার্ড ব্লিজার্ড এই হো হো হো এই হো হো হো এই হো হো হো ।” আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,“ ওর কি ১৯৭৮ সালে জন্ম? ও কি মৌ?” বাবা হাত নাড়তে নাড়তে আমার দিকে এগোয়। আমি তুষার ঝড়ের ভেতর পড়ে যেতে যেতে বাচ্চাটাকে তুলে ধরেছি। গরমের হল্কা এসে নাকে চোখে লাগছে জানলার ধারে আর বাবা কফি হাউসের মধ্যিখানের কোন একটা টেবিলে বসে আছে। আমায় বলল,“ দুধ ছাড়া কফিকে বলে ইনফিউশন।”
—— কিন্তু তাতে কি চিনি দেওয়া চলে?
—— চলবে না কেন।
—— সব চলে?
—— হ্যাঁ যার যেমন পছন্দ। কেউ নেয় , কেউ নেয় না।
—— কী?
—— চিনির কথাই তো বলছিলি। আর এটা হল পাকোড়া।
—— ইনফিউশন আর পাকোড়া?
—— ইনফিউশন আর পাকোড়া।
বাবা পাকোড়া খাচ্ছিল। তারপর কফি খাবে। সেই প্রথম কফি হাউসে। এ কথা মৌকে বলাতে ও বলল,“ কফি হাউস।”
—— হ্যাঁ, কলেজ স্ট্রিটে।
—— কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস।
—— ইন্ডিয়ান কফি হাউস। সেন্ট্রাল এভিনিউতেও আছে আর আছে যাদবপুরে।
—— দাদুর সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলে?
—— কলেজ স্ট্রিটে।
—— এই সব দাদু লিখেছে?
—— কোথায় ?
——--- মেমোয়ার্সে।
—— কী জানি। মনে হয় না।
—— কেন?
—— বাবা কি নিজেকে নিয়ে লিখেছে?
—— তবে কী নিয়ে লিখেছে?
—— পরিবার নিয়ে লিখেছে দেখছি।
—— দেখছ মানে? পড়ছ না?
—— পড়ছি আর দেখতেও পাচ্ছি।
—— তা হলে তো খুবই ভালো লেখা।
—— না । ভালো লেখা নয়।
—— এই যে বললে দেখছ— ভালো লেখা দেখায়।
—— কী জানি। মনে হয় না।
—— কেন?
—— বাবা কি নিজেকে নিয়ে লিখেছে?
—— তবে কী নিয়ে লিখেছে?
—— পরিবার নিয়ে লিখেছে দেখছি।
—— দেখছ মানে? পড়ছ না?
—— পড়ছি আর দেখতেও পাচ্ছি।
—— তা হলে তো খুবই ভালো লেখা।
—— না । ভালো লেখা নয়।
—— এই যে বললে দেখছ— ভালো লেখা দেখায়।
আমি মৌকে বলতে পারি না আজকাল যাই লিখি সব ডায়েরির মতো হয়ে যায়। সুকান্ত বলেছে,“ এটা তো ডায়েরি।” লকডাউনে সুকান্তর কোন রোজগার ছিল না কারণ ও রেল আর বিমানের টিকিট বুক করে। টেক্সাসের তুষার ঝড়ের সময় বিমান পরিষেবা বন্ধ ছিল। পাওয়ার গ্রিড ফেল করেছিল। অনেক লোক মারা গেল। ঘরের ভেতর বসে বসে তারা মরে যায়। যখন মরে বারান্দা খোলা ছিল কি? আর ছিল হাতের পাশেই এক বাটি মুড়ি, সেটা খেতে খেতেই মরে গেল। সে মুড়ি খাচ্ছিল তারপর মারা যায় নাকি আগেই মারা গিয়েছিল? মুড়ির বাটিতে হাত পড়ার আগেই, মুড়ি দেওয়ার আগেই। তখন তুষার ঝড়ের মধ্যে জানলা খোলার কথা নয় তখন গরমের মধ্যে জানলা খোলার কথা। বারান্দায় মরে যাবার সময় সে সব নিশ্চত ভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে জানলা খোলা বা বন্ধ - তার পাশেই একটা পাঞ্চিং ব্যাগ ঝুলছিল। সে যখন মরে গেল পাঞ্চিং ব্যাগটা জুড়ে শুধু আওয়াজ হয়,“ মার মার মার মার মার .......।”
লেখক পরিচিতি:
উপল মুখোপাধ্যায়
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
বর্তমান আবাস: মুখার্জিগেট মহেশতলা। দ: চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: চারটি।
4 মন্তব্যসমূহ
অপূর্ব। অন্য একটা ডাইমেমনশনে লেখা, অথচ মন ছুঁয়ে যায়
উত্তরমুছুনঅনবদ্য এক সাতকাহন
উত্তরমুছুনভালো লাগলো গল্প
উত্তরমুছুনঅসাধারণ একটা গল্প পড়লাম
উত্তরমুছুন