বিয়ের পনরে বছর পর আমি একটা খেলার পরীক্ষায় ফেলে দিলাম শোয়বকে।সন্ধ্যার নিয়মিত জগিং এ যাবার সময় টুকিটাকি সওদা আনার সাথে আইসক্রমি আনারও ফরমাশ করি। আইসক্রিমের কথা শুনে শোয়েবের মুখ প্রীত হয়ে ওঠে। এই সুস্বাদু বরফের খণ্ড আনতে বলা মানে;ওর প্রতি জমে থাকা খুচরো মান-অভিমান, রাগ-ঝালের সব মামলা তুলে নেয়া। শোয়েব চলে যাবার পর বলি- তোদরে চাচু যদি আজ আইসক্রিম আনতে ভুলে যায় ; ভালোবাসার পরীক্ষায় তাহলে সে ফেল। প্রমাণ হবে আমার জন্য সেই আগের প্রেম নাই ;বউকে ভালোবাসায় ঘাটতি রয়েছে। এই ভুলে যাবার জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে ওকে! প্রজ্ঞাপন জারি করার আমেজে কথাটা শেষ করি।আমার কথায় তমাল হৈহৈ করে ওঠে এমন হবেই না,চাচু আইসক্রিম ছাড়া আসবে না দেখো! এসব কাণ্ডের মধ্যেই লালন গীতির একটা অন্তরা গুনগুনাচ্ছিলো সেজুঁতি ; বিরতি টেনে বলে- তমাল, পিরিচ বার করো,চাচির আইসক্রিম চলে এলো বলে...। দুই ভাই-বোন নেতি বাচক সম্ভাবনাকে প্রত্যয়ের সাথে নাকচ করে দেয়। যতোটা সরল ভাবে এরা আমার কথাকে টলকাচ্ছে বিষয় তা নয়।এটা আমার কাছে যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের মতো গুরুত্বর্পূণ। বিষয়টা অ্যালিগোরির মতো,আপাততো দৃষ্টিতে যা বোঝানো হচ্ছে তার বাইরে অন্য কিছু। আমাকে হাসি-খুশি দেখালেও,ভেতর ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবাজ মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তেজি অশ্ব লাফাচ্ছে আমার বুকের মধ্যে। সেজুঁতির গুনগুনানো বাণী উদ্ধারে মনোযোগী হয়ে নিজেকে বরং স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করি।
আমরা গেল সপ্তাহে কুষ্টিয়া কুমারখালির লালনের ছেঁউরিয়া আখড়া ঘুরে এলাম।আমরা মানে আমি-তমাল আর সেঁজুতি। শোয়েব অবশ্য যায়নি,উল্টো টিজ করেছে ;ওসব আখরায় যাওয়া কিন্তু বেদাতি...। বেচারার ছুটি জোটেনি। ওকে ছাড়াই যাই।জন্মদিন উপলক্ষে লালন মেলা চলছিলো তখন। ফেরার পর সাঁইজিতে আচ্ছন্ন সবাই। সেজুঁতি গুনগুনাচ্ছিলো। ও খুব ভালো গায়। এবার গলা ছেড়েই গাওয়া শুরু করে। দরদ আর যত্নের আদরে সে সুর শিখায়িত হয়ে ক্রমশ খাবার ঘরের শূন্যতা দখল করে সমস্ত নীরবতাকেও কোণঠাসা করে ফেলে। আন্তরিক অর্থেই তুমুলভাবে গানের মীরে সংক্রমিত হয়ে পড়ি, সেঁজুতির সাথে যোগ না দেয়ার উপায় থাকে না-
আগে জান না রে মন
বাজি হারলে তখন, লজ্জায় মরণ
শেষে আর কাঁদলে কী হয় ।
খেল রে মন-খেলারু, ভাবিয়ে শ্রীগুরু
সামাল সামাল বাজি সামাল সর্বদায় ।।
শোয়েবের জন্য কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করি। দীর্ঘ বছরের সংসারটাকে ভালোবাসা-প্রেমে কোন ভাবেই বাড়াতে পারিনি আমরা। সেজুঁতি,তমাল আমার ভাশুরের ছেলে-মেয়ে । স্কুল, কলেজ শেষ করে আমাদের কাছে থেকে অর্নাস,মাস্টার্স করেছে ; দুজনই কর্মজীবী এখন। এরা থাকাতে বাসাটা বাড়ি বাড়ি লাগে। সারাদিন বাইরে থাকি আমরা। কারো বিশেষ কাজ না থাকলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘন্টাখানেক একসাথে চা পান এর সাথে খুচরা গাল-গল্প চলে। চা-টা খেয়ে শোয়েব চলে যায় জগিংএ। খুব মেনটেইন করে। চায়ে সুগার নেয় না, রেড মিট অ্যাভয়েড করে। আমি, তমাল, সেজুঁতি মন ভরে দুধচা খাই। এই একবেলাই তো! ওরা আমার ভাশুরের ছেলে-মেয়ে হলেও আমরা বন্ধুর মতো।
বাজি হারলে তখন, লজ্জায় মরণ
শেষে আর কাঁদলে কী হয় ।
খেল রে মন-খেলারু, ভাবিয়ে শ্রীগুরু
সামাল সামাল বাজি সামাল সর্বদায় ।।
শোয়েবের জন্য কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করি। দীর্ঘ বছরের সংসারটাকে ভালোবাসা-প্রেমে কোন ভাবেই বাড়াতে পারিনি আমরা। সেজুঁতি,তমাল আমার ভাশুরের ছেলে-মেয়ে । স্কুল, কলেজ শেষ করে আমাদের কাছে থেকে অর্নাস,মাস্টার্স করেছে ; দুজনই কর্মজীবী এখন। এরা থাকাতে বাসাটা বাড়ি বাড়ি লাগে। সারাদিন বাইরে থাকি আমরা। কারো বিশেষ কাজ না থাকলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘন্টাখানেক একসাথে চা পান এর সাথে খুচরা গাল-গল্প চলে। চা-টা খেয়ে শোয়েব চলে যায় জগিংএ। খুব মেনটেইন করে। চায়ে সুগার নেয় না, রেড মিট অ্যাভয়েড করে। আমি, তমাল, সেজুঁতি মন ভরে দুধচা খাই। এই একবেলাই তো! ওরা আমার ভাশুরের ছেলে-মেয়ে হলেও আমরা বন্ধুর মতো।
সেজুঁতির আকদ্ হয়েছে, বর অস্ট্রেলিয়া থাকে, কাগজ-পত্র তৈরি হলে সেজুঁতিও চলে যাবে। তমাল একটা ফোন কোম্পানিতে আছে। গপ্পবাজির ভেতরেও তমালের আঙ্গুল নেটা-নেটিতে ব্যস্ত। নেট থেকে চোখ সরিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে-প্রবাদ আছে না মশা মারতে কামান দাগা; এবার কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ভিমরুল মারতে কামান দাগার চেয়েও হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটেছে চাচি...।
কেমন হুলুস্থুল? ওর কথায় কৌতূহল অক্ষত রাখতে পারি না।
--কামান দাগা না হলেও ভিমরুল তাড়ানোর জন্য‘বি প্রটেকশন অর্গানাইজেশন’ নামের একটা এনজিও শ্রীলঙ্কার ভিমরুল বিতরণ কমিটিকে সহায়তা করেছে। বিবরণ এই-ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী শ্রীলঙ্কার পূর্বদিককার একটা চা বাগান পরির্দশনে যাবে বলে এতো সর্তকতা অবলম্বন। সেখানে নাকি ভিমরুল আক্রমনের সম্ভাবনা আছে। ভিমরুল তাড়ানো কমিটির প্রধান তিসা বান্দারা থামাবাভিতা মিডিয়াকে এ তথ্য জানিয়েছে। তমালের ফাটাফাটি সংবাদ পরিশেনের মাঝখানে অস্ট্রেলিয়ার ফোন আসায় সেজুঁতি ফোন রিসিভ করে জমাটি আড্ডা থেকে অক্লেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণের বারান্দায় চলে যায়। সেখানে বসন্তের আর্দশ বাতাস বহিতেছে!
--কামান দাগা না হলেও ভিমরুল তাড়ানোর জন্য‘বি প্রটেকশন অর্গানাইজেশন’ নামের একটা এনজিও শ্রীলঙ্কার ভিমরুল বিতরণ কমিটিকে সহায়তা করেছে। বিবরণ এই-ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী শ্রীলঙ্কার পূর্বদিককার একটা চা বাগান পরির্দশনে যাবে বলে এতো সর্তকতা অবলম্বন। সেখানে নাকি ভিমরুল আক্রমনের সম্ভাবনা আছে। ভিমরুল তাড়ানো কমিটির প্রধান তিসা বান্দারা থামাবাভিতা মিডিয়াকে এ তথ্য জানিয়েছে। তমালের ফাটাফাটি সংবাদ পরিশেনের মাঝখানে অস্ট্রেলিয়ার ফোন আসায় সেজুঁতি ফোন রিসিভ করে জমাটি আড্ডা থেকে অক্লেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণের বারান্দায় চলে যায়। সেখানে বসন্তের আর্দশ বাতাস বহিতেছে!
ঘন্টাখানেক পর শোয়েব ফিরে আসে।তার দুই হাতে ডিম আর দুধের প্যাকেট।এসেই জিহ্বায় কামড়ায় সিট্, আইসক্রিম আনতেই ভুলে গেছি! আবার অ্যালোগোরি সাজাই-দূর,বাদ দাও তো এসব ছেলেমানুষি! ওর হাতে কাতার থেকে আসা একটা চিঠি ধরিয়ে বলি- আবার ভুল করেছে ডাক বিভাগ! দিয়ে আসো না প্লিজ! উপর তলার এফ-থ্রী‘র চিঠি গত মাস ছয়েক ধরে ভুলে আমাদের এফ-টুএ দিয়ে যাচ্ছে! বাসায় থাকি না। দরজার তলায় গলিয়ে দিয়ে যায়। বেচারার ঘামের ফোটাকে তোয়াক্কা করি না। বেদরদি আদেশ মাথা পেতে নেয় শোয়েব।আইসক্রিম না আনার অপরাধ হিসাব করলে এটা কোন দণ্ডই না; অবয়বে বিরক্তি দেখি না বরং ওকে প্রসন্ন দেখায়। তমালের জরুরী ফোন আসায় বাসার বাইরে গেছে,সেজুঁতির ফোনালাপ চলছে এখনও...। আকদের পর পর চলে যাওয়া বরকে সময় না দিলে চলে! শূন্য ঘরটায় অপ্রাসঙ্গিক মা এসে দাঁড়ায়। দূর,এখন আমি কাঁদতে চাই না। বরং বার্গম্যানের ‘সেভেনথ সিল’এর নাইটকে পেতে চাই পাশে। জীবন বাজি রেখে যে স্বয়ং মৃত্যুর সাথে শতরঞ্জ খেলে আমি তার কাছ থেকে মনোশক্তি ধার করতে চাই। মা তবু যায় না। মা’র সাথে দক্ষিণের জানালার কাছে দাঁড়াই। মা তো! তাই অ্যালিগোরিটা বুঝে ফেলেছে। আমার কানে ফিসফিস করে অদৃশ্য মা বলে- এবার একটু কাঁদো, কষ্টটা হালকা হবে!
পড়শির চিঠি দিয়ে ফিরতে দেরি করে শোয়েব। হাতে আইসক্রিম। বাক্সটা নিরানন্দ হাতে ফ্রিজে রাখি।আইসক্রিমের ঠান্ডা আমার মধ্যেও কনর্ভাটেট হয়ে পড়েছে যেন। রাতের খাবার মেনুতে কোরাল মাছ,ঢেরস ভাজা,মুগের ডাল। খাবার টেবিলে শ্রীলঙ্কার ভিমরুল তাড়ানোর ঘটনাটা শোয়েবের সাথে শেয়ার করি, এ নিয়ে যতোটা না শোয়েব তার চেয়ে আমরা তিনজন হাসাহাসি করি। শোয়েবকে বরং খানিকটা বিরক্ত দেখায়। এরমধ্যে ওর পকেটের মোবাইলে ক্লিং ক্লিং,ক্লিং ক্লিং করে ডজন খানেক(আমার অনুমান) ম্যাসেজ উড়াল মেরে ঢুকে পড়ে। ও অসহিষ্ণু গলায় বলে- –অফিস রাতেও একগাদা কাজের নোট দিয়ে রাখবে! মুখটা কিন্তু প্রীত দেখায় ওর। ড্রয়িং কাম ডাইনিং টেবিল থেকেই দেখি দেয়ালের ভিনসেন্ট ভ্যান গগ বিরক্তি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে আমাকে।ভিনসেন্ট এর আত্মপ্রকৃতিটা বিয়ের যুগর্পূতিতে আমাদের চিত্রশিল্পী বন্ধু খৈয়াম উপহার দিয়েছিলো। আমি কোরাল মাছ থেকে ‘ভি’‘ওয়াই’ অক্ষর বের করতে করতে হাসি-গ্যঁগাকে ডেকেছিলো তাহিতির মেয়ে! তোমাকে কোন দেশের মেয়ে ডাকে গো! আমার কথা শোনে শোয়েব এতো টসকে যায় যে ওর বিহ্বল দৃষ্টির সাথে(এমনিতে ওর ঠোঁট মোটা ধাঁচের, তা আমি পছন্দই করি। শরিরী আদরে চুমু আর চকলেটের মধ্যে ফারাক এই, চুমুটা উত্তেজক আর তখন চকলেটের স্বাদ লবন ছাড়া ভাতের মাড়ের মতো ম্যাড়ম্যাড়ে) ঠোঁটটাও ঝুলে পড়ে। এতে ওকে কিন্তু ইনোসেন্ট দেখায় না; ফাঁদে পরা শেয়ালের মতো ইনটোলারেবল লাগে। ওর এই মূর্তিতে তিনজন হেসে উঠলে শোয়েবের মধ্যে একটা তাজা রাগ চাগিয়ে ওঠে- আসলে ঘরে মানুষের প্রতিকৃতি রাখা ঠিক না...। ফেরেস্তা আসে না । তমাল ও সেজুঁতি দৃষ্টি বিনিময় করলে চোখের ঈঙ্গিতে কিছু বলতে মানা করি ওদের;বরং ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম পর্বের র্পূব প্রস্তুতি স্বরূপ বুয়াকে টেবিলে আইসগ্লাস দিতে বলি।প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করি, উপরের ওরা বাসায় ছিলো? মাঝে মাঝে যেন কোথায় উধাও হয়ে যায়। চিঠিটা দিতে পেরেছো? তুকতাকে কাজ হয়; শোয়েবের দানাদার রাগ কমতে থাকে।
প্রথম আসা চিঠি উপরে দিতে আমি নিজে গেছলাম। সিড়ি টপকাতে টপকাতে ‘চিঠি দিও প্রতিদিন’ গুনগুন না করে পারছিলাম কেন জানি। গানটা যে প্রিয় তাও না ; প্রাসঙ্গিকতার জোরে ঠিক ঐ সময় ওটা ডমিনেট করছিলো আমাকে। গুনগুনানোর ভেতর এ ভাবনাও সক্রিয় থাকে; এই ডিজিটাল যুগে খামে ভরা এতো ওজনদার চিঠি আসে কারো! দরজা খুলে দেয় নেকাব ঢাকা একটা মুখ। ভদ্রমহিলা আমাকে বসতে বলে। গৃহকর্ত্রী আমার সামনেও মুখের নেকাব সরায় না। ওর উঁকি মারা ফর্সা কপালের দিকে তাকিয়ে বলি - আমার সামনে পর্দা করার দরকার আছে? সে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওর তিন বছরের মেয়েকে নিচু গলায় কি নিয়ে যেন ধমক দিলো। গলাটা ভারি রিনরিনে আর মিষ্টি। পরে আমার প্রশ্নের উত্তরে যা বললো তার শানে-নজুল করলে দাঁড়ায়, বেপর্দা জেনানাদের সামনেও নেকাব খোলা হারাম। কেবল নিজের সহর আর ভাই-বোনদের সামনে তিনি নেকাব রাখেন না। মেজাজটা তেতে উঠলেও ঠান্ডা গলায় বলি-আমার হাজবেন্ড চিঠিগুলো কার হাতে দেয় ? আপনার কাছে না বাচ্চাদের কাছে? বাসায় তো নাকি কাজের লোকও নেই ,বাজার-টাজারে কে যায়? মহিলা স্পষ্ট বুঝে যায় আমি চটেছি। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খুব নম্র করে বলে- ভাবি, আমি একটু ব্যস্ত, আপনি কি আরো কিছুক্ষণ বসবেন? নূরে হান্না তাকরিয়ার( খামের উপর ‘বরাবর’এর জায়গায়এ নামটাই লেখা) সান্নিধ্য আর বরদাস্ত হয় না। বিরক্ত পায়ে দরোজার দিকে হাঁটি। কোন মানে হয় না এ সমস্ত অভদ্র জনের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার। একবার ইচ্ছে করে ফিরে গিয়ে বলি,আপনার চিঠি-ফিটি পৌঁছে দেয়ার দায়-দায়িত্ব আমাদের না। পরক্ষণে মনে পড়ে, বেচারি চার-চারটা বাচ্চা নিয়ে একা থাকে। তিন কী চার বছরের মেয়েটাও দেখলাম হিজাব পরা। মহিলার স্বামী কাতারে থাকে, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।কাছের আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় তেমন কেউ নাই। এসমস্ত তথ্যাদি অবশ্য শোয়েবের কাছ থেকে জানা।
একটা র্উদূ শায়েরের গম্ভীর অত্যাচারে ঘুম ভাঙ্গে। শোয়েবের মোবাইলে পাকিস্তানি মাতৃভাষার উদ্ধত আওয়াজে ভোরের নীরবতা হরণ মেনে নিতে অপারগ হলেও চুপ থাকি। মনে পড়ে শোয়েব ট্যুরে যাবে আজ। ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে চাকরির সুবাদে বিদেশ ছাড়া দেশেও মাঝে মাঝে ফিল্ড ভিজিটে যেতে হয় ওকে।সকালে অফিসের গাড়ি আসে। পনের বছরের চুক্তিনামার প্রতিদিনের সংসার যাপনে এটা মন্দের ভালো। স্থানিক দূরত্ব আমাদের ভেতর পরষ্পরের জন্য নতুন প্রেম উপযোগিতা তৈরি করে। পুরনো আমরা তাই নতুন ভালোবাসায় ঘর-দোর আর বিছানা উষ্ণ রাখি। ওর জন্য প্রতি ট্যুরের বিদায় পর্বে বরাদ্দকৃত চুমু থাকে। আসন্ন ( এবার পনের দিনের বিচ্ছেদকাল!)বিরহ আমেজ তৈরি করে আমি উঁকি দিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে গিয়েও পিছু হটি। পায়ের আঙ্গুলে তেলাপোকার অস্তিত্ব রসময় মুহূর্তে বাগড়া দেয়। জুতার ডগা দিয়ে নোংরা জীবটার মাথা চেপ্টে দিয়ে শোয়েবের দিকে তাকিয়ে অপারগ হাসি; পুনরায় চুমু তৈরিতে আলস্য টের পাই। চৌদ্দ বছরের যৌথ জীবন যাপনে পরষ্পরের কাছে আমরা মোটামুটি ভালো ট্রান্সপারেন্ট।
এমন কী আমরা একে অন্যের আইডি পাসওর্য়াডও জানি। তবে বছর দশেকের মধ্যে কখনও ওর আইডি খুলিনি। দিন কুড়ি আগে আমাদের বিয়ের কিছু ছবির জন্য শোয়েবের ফেইসবুকে ঢুকতে গেলে পুরনো পাসওর্য়াডে ঢুকতে পারলাম না। এ নিয়ে অবশ্য শোয়েবকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। মাস-দুই ধরে ওর মধ্যে কিছু চেঞ্জ লক্ষ করছি। ছবি,কবিতা,গান পাগল মানুষটা ঘর থেকে ভ্যানগঁগকে বিদায় করতে চায়, লালনের আখরায় যাওয়া বে-দাতি বলে...! এই বিষয়গুলো আমার মধ্যে একটা ঘোলাটে সংশয় তৈরি করে। আমার উর্বর মস্তিস্কের পরিচালনায় শোয়েবের আইডি ‘নূরে হান্না তাকরিয়া’ পাসওর্য়াডে খুলে গেলে ঈর্ষার চেয়েও শংকিত হয়েছিলাম ; তখন সেখানে নিছক পরকীয়া নয় আরও বেশি কিছু আশঙ্কা করি।‘চিঠি দিও প্রতিদিন’ গানটার মতো ডমিনেটেট হই সন্দেহ দ্বারা ! সন্দেহটা স্রেফ সন্দেহ থাকলে খুশি হতাম। নাহ্! ভাবনা ভুল নয় আমার। শোয়েব জঙ্গি এক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে সেও মাস ছয়েক। নূরে হান্না আসার পরপর।জঙ্গি তৎপরতায় নূরে হান্না আর তার স্বামী ওর ব্রেন ওয়াশ করেছে ধীরে ধীরে। প্রতিটি ই-মেইল খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখি; হান্না’র এখানে আসাও পূর্ব পরিকল্পিত। ম্যাসেঞ্জারে তাকরিয়া হান্না আর শোয়েবের কথোপকথন পড়ি: আসসালামু আলাইকুম,হাই জানেমন! :ওয়ালাইকুম আসসালামু, বলো সোনা! (এ সম্বোধনটা আমার জন্য বরাদ্দ ছিলো), জেহাদের পথে নেমেছি, সে জন্য তোমার নিকট শুকরিয়া!
ফেসবুকের সংলাপ থেকে মন পিছলে যায় আমার।চোখের কনীনিকায় সেইসব স্মৃতি সদ্যোজাত হয়ে ফিরে আসে। সন্তান না হলেও আমাদের সংসারে সুখের অভাব ছিলো না। সব সময় অফুরান ফূর্তি আর আনন্দ রচনা করতাম আমরা। উইকএন্ডে কখনও বাইরে না গেলেও ঘরে একটা মুভি দেখা বরাদ্দ ছিলো আমাদের।আর কী ভীষণ রোমান্টিক ও! শোয়েবের আলিঙ্গনে আমার ফিনিক্স পাখির উড়াল আনন্দ!ওর কামুক চুম্বনে বিবশ আমার শরীরি প্রস্তুতি...। আর সেই মানুষটার এই পতন! দুঃখে,জেদে ঠোঁট কামড়ে রক্তপাতেও ভ্রুক্ষেপ করি না কিন্তু ফের ঠোঁটেরই আর্তচিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পাই। বুকের বেবুঝ কষ্ট আমাকে স্ত্রী কনভিক্ট সিকলিড করে তোলে। সঙ্গীর বিচ্ছেদে মেয়ে সিকলিড মাছের জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়। খানিকটা থিতু হয়ে মনকে ঝাড়া দিই। যুবক রাগ বুকের পরতে গড়ান দেয়। নাহ্! কনভিক্ট সিকলিড হলে চলবে না। দরদি আলিঙ্গন ছাড়াই ফিনিক্স পাখির গতি চাই। ঠান্ডা মাথায় সব করতে হবে। এই ভোরেই সেজুঁতির ঘর থেকে লালনের ধীমান পঙক্তি কানে ঢেলে দেয় সুরের নির্দোষ মীর- ভাবিয়া খেলা কর খেলারু...। শোয়েবকে নিয়ে একটু আগে চলে যাওয়া গাড়ির পেছনে সে সুরকে ধাবিত করি আমি। কোথায় পালাবে ও!
লেখক পরিচিতি:
পারভীন সুলতানা
ছড়াকার। গল্পকার
ঢাকায় থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ গল্প! গভীর ভালোবাসার তরঙ্গ বেয়ে বেয়ে পারভীন সুলতানার নিজস্ব মুক্তোর মতো
উত্তরমুছুনভাষার জাদুটানে একেবারে বিস্ময়করভাবে
পার্টনার শোয়েবের ভয়াবহ ভীতিজনক পতন
পাঠক হিসেবে আমাকে বিমূঢ় করে দিয়েছে।
আর এ ঘটেছে লেখকের উপস্থাপনের
সৌকর্যের কারণে।