সন্তোষ করের বই নিয়ে আলোচনা : মুক্তামাছ, ঐক্য -- যেন এক দরিদ্রের মালা

পুরুষোত্তম সিংহ

বঙ্গীয় প্রকাশকদের হাডুডু খেলা

বাংলা বাজারে প্রতি বছর হাজার হাজার উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে। সমান তালে থ্রিলার বাঙালি পাঠক গোগ্রাসে গিলছে। প্রকাশক মুনাফার তাগিদে ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে। পাঠক যা চায় তাই সে ছাপতে রাজি। হে পাঠক তুমিই নির্ধারণ করে দাও প্রকাশক কোন পথে যাবে। প্রকাশক যেন উচ্চস্বরে বলছে—আমি ছাপতে রাজি আছি গো, আমি ছাপতে রাজি আছি/ আমি যে মুনাফার কাজি। বেনিয়া সভ্যতায় কে না চায় মুনাফা? লোকসান দিয়ে আর কতদিনই বা বাণিজ্য চালানো যায়? ওইরকম মেধাবী প্রতিষ্ঠান ‘প্রতিক্ষণ’ কেন স্তব্ধ হয়ে গেল কোন জাবাব আছে পাঠক মহাশয়? আমরাই কি দায়ী নই? কী বলেন মাননীয়া স্বপ্না দেব? ঋত্বিকের সেই স্মরণীয় সংলাপ—‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’। ভাবাটাই কি ভুলে গেল বাঙালি পাঠক? নইলে কেন এতো মেকির কদর? জাতি হিসেবে আমরা কি ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণুর পথে? কে দেবে উত্তর? কী বলে বাংলা বাজারের ঘোষিত-অঘোষিত প্রতিষ্ঠানের সিলমোহর-মোহরহীন সংস্কৃতিবিদরা? প্রচার, বিজ্ঞাপন, লাইভ এর দৌলতে কোথাও কি হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত সত্য? সন্তোষ করের ‘মুক্তামাছ’ উপন্যাসের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল দুইদশক আগে ‘দিঘলপত্র’ প্রকাশনকে। যদিও সেদিন উপন্যাসের নাম ছিল ‘দাঁড়-জাল-মুক্তামাছ’। উপন্যাসটি সাড়া জাগানোর পরও বৃহত্তর বঙ্গের কাছে পৌঁছে যায়নি। দুই দশক পরে আবার সেই প্রকাশকই গ্রন্থটি প্রকাশ করেলন। বলা ভালো এক দায়িত্ব পালন করলেন। যদিও দ্বিতীয় সংস্করণে উপন্যাসের নাম ‘মুক্তামাছ’।

কেন্দ্র বারবার প্রান্তকে অস্বীকার করে। সেটা মুখে বলে না, কাজে করে। কেন্দ্র নিজের স্বরকেই জাতির স্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। ‘আমি কী গান গাব’কেও নিজস্ব ছকের মধ্যে আনতে চায়। ছকের বাইরে গেলেই তা বাতিল বলে ঘোষণা করে দেয়। আজ তথ্য প্রযুক্তি, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের সৌজন্যে কেন্দ্র-প্রান্তের ব্যবধান অনেকটাই ঘুঁচেছে। প্রান্তের সত্য পৌঁছে যাচ্ছে কেন্দ্রের কাছে। ওই প্রান্ত থেকে এই প্রান্তে বইটি (মুক্তামাছ) হাতে এল এও তো ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের সৌজন্যেই। একটা উপন্যাস কখন পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে? এই পাঠযোগ্যতা বিচারের নানা মাপকাঠি রয়েছে। বলা ভালো কখন ক্লাসিক হয়ে ওঠে? জীবনবোধ, পরিসরের মুন্সিয়ানা উপন্যাসকে কীভাবে পৃথক করে দেয়। জীবনকে দেখা, শুধু দেখাই নয় গভীরভাবে উপলব্ধি করা, জীবনের সমস্ত সত্যের এপিঠ-ওপিঠে ময়নাতদন্ত চালানো, রক্ত মাংসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গোত্র-বর্ণ নির্ণয়, জেরক্স নয় অরিজিনালের অরিজিনালিটি আবিষ্কার একজন লেখককে স্বতন্ত্র করে দেয়। সন্তোষ কর স্বতন্ত্র হয়ে উঠলেন শুধুমাত্র এই একটি মাত্র টেক্সট পাঠেই। হ্যাঁ ‘মুক্তামাছ’ উপন্যাসের কথাই বলতে চাইছি। এমন মুন্সিয়ানায়, জীবনবোধে, পরিসরে, চরিত্রের আঞ্চলিক সংলাপে, জল-জেলের সাতকাহনে, মাঝি-জেলের জীবন সংগ্রামের নিষ্ঠুর পরিহাসে, শ্রেণির রূপান্তরে, প্রকৃতির রুক্ষতায়, মহাজনের দখলদারিতে যে টেক্সট লেখক নির্মাণ করে তা বাংলা উপন্যাসের ভিন্ন পরিসর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিন ‘জ’এর ক্রমাগত লড়াই

জল-জেলে-জীবন। তিন এরই ক্রমাগত সংঘাত। সংঘর্ষও কি নয়? মায়াময় আখ্যান। জেলে জীবনের কথা যেন স্রোতের মতো ভেসে যায়। তাদের জীবনে জোয়ার-ভাঁটা আছে। উত্থান-পতন ক্রমাগত আঘাত করে জীবনকে। প্রত্যাঘাত যে নেই তা নয়। তবে কেউ জীবন পালাতক নয়। ভদ্র জীবনের প্রচলিত সভ্যতা-সংস্কৃতির বাইরে এই জীবন। এখানে শারদীয়ার আগমনি-বিসর্জনের বাজনা বাজে না। এখানে উৎসবের কোনো আনন্দ প্রবেশ করে না। অথচ আনন্দমুখর উৎসব কল্লোল থেকে কিছুটা দূরে এদের অবস্থান। এখানে আছে কেবল ভাতের জন্য কাকুতি। ভাতের জন্য প্রবল কান্না। উৎসব না এলেও সময় পর্ব সম্পর্কে প্রবল জ্ঞান মানুষগুলির। পূজার পরেই শুরু হয়ে মাছের মরশুম। প্রস্তুত হতে হবে জেলে সুবলকে। দাঁড়টাই যার সম্বল। একমাত্র হাতিয়ার বা চাবিকাঠি। সারানি জাল ছেড়ে সুবল সাবড়ে জালে ভাগ নিয়েছে। মহাজনের হাতে বন্দি হয়েছে। অমোঘ নিয়তি। নিম্নবিত্তের অবধারিত পরিণাম যা হয়। শরীর যে সায় দিয়েছিল তা নয়। শরীরের দিকে নজর দেবার সময় কই? সমুদ্রই যাদের ভবিষ্যৎ, অর্থের সংস্থান, তাদের শরীরের কথা চিন্তা করলে চলে না। সুবল জানে পুরুষ মানেই অর্থ। অর্থ আছে বলেই লখা পাল লক্ষণ বাবু। আর সে বোকা সুবল। লেখক প্রথম থেকেই আখ্যানকে একটা স্পষ্ট প্রবাহে নিয়ে যান। জেলে জীবনের ভয়ংকর জীবনচিত্রের বিন্দু বিসর্গ স্পষ্ট হতে শুরু করে।

কত বছর সুবলের? আটাশ। এই বয়সেই সে জীবন থেকে মুক্তি পেতে চায়। কেন চায়? উত্তর আসে দারিদ্র্যের চরমতম কারাঘাত। জীবন পলাতক হতে চায়। কী আছে জীবনে? সে জানে না জীবনের তত্ত্ব। তবে বাস্তবতা জনে। বঙ্কিম কথিত সেই বচন ‘এ জীবন লইয়া কী করিব’ এখানে কোনো বার্তা দেয় না। সে জানে কিছুই করার নেই। শুধুই বয়ে চলা। শুধুই স্রোতে ভাসা। এই জীবনের কোনো মূল্য নেই। এই বেদনার মধ্যেও কেতু বউকে দেখে মুক্তির ইচ্ছা উড়ে যায়। স্বাধীন জীবন চেতনা সুবলের ব্যর্থ জীবনের পালে বাতাস লাগায়। উষ্ণতাও কি নয়? প্রেরণাও হয়ত! নারী শরীর যে প্রেরণা, উৎসাহ চাহিদার জন্ম দেয়। পূর্বপুরুষদের স্মৃতি মনে উঁকি দেয়। বংশ পরম্পরায় জল আর জালের বৃত্তান্ত নিয়েই এদের জীবন। কেউ মহাভারতের কাহিনি শোনায়। মৃদু স্রোতের মতো কাহিনি বয়ে যায়। জীবনের দোলাচলতা আছে, তা কখনো আঘাত করে কিন্তু প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দেয় না। অমোঘ নিয়তি বলে মেনে নেয়।

জঙ্গল আর সমুদ্রের বিস্তৃর্ণ চর। লোনা বালিতে ভরা। চাষের সুযোগ নেই। একদিন বন জঙ্গলে মা মঙ্গলার প্রতিষ্ঠা হয়। দেবীর উৎপত্তি হল। এ দেবী জেলেদের পক্ষে শুভ। পুরোহিত গজপতি পাণ্ডা। সে বৃদ্ধ হলে পুত্র রঘুপতি পাণ্ডা দেবীর সেবায় নিয়োজিত। লোকাচার, কুসংস্কার আঁকড়ে আছে এই জনপদ জীবনকে। কেন ই বা থাকবে না? বন জঙ্গলের দেশ। অবিশ্বাসের জায়গা কোথায়? শক্তিই বা কতটুকু! ব্যক্তির বিদ্রোহের স্থান কোথায়? ব্যক্তি অপেক্ষা গোষ্ঠী বড় হয়ে ওঠে। গোষ্ঠীর বক্তব্য দ্বারাই ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। কেউ কেউ নিজ গুণে প্রধান হয়ে ওঠে, যেমন সুবল। মা মঙ্গলার দেখা পায়নি সুবল। অবিশ্বাসের সুর বড় হয়ে ওঠে। লখা পালের মনে হয় দেবতা বুজরুকি। ঠাকুমা জানায় দেবীর সাক্ষাতের মতো সুবলের ভাগ্য নয়। সবাই সাক্ষাৎ পায় না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব বড় হয়ে ওঠে। আবার কেয়া জঙ্গল কাটাও যায় না। কেননা বালি ঝড়। প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই জনপদকে প্রকৃতির হাত থাকে নানা কৌশলে বাঁচতে হয়। প্রতিপদে জীবনযুদ্ধ। হ্যাঁ যুদ্ধই বটে। অন্ন বস্ত্রের সংস্থানের জন্য ক্রমাগত লড়াই। মনে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে লড়াই। সুবলের স্ত্রী ফুলির অভিমান আছে। স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর বর্ষণ আছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অভিমান অভিযোগ। সুবল শুনেও কোনো উত্তর দেয়নি। উত্তর দেওয়ার পরিসর কোথায়? যেখানে নিয়মিত নিয়মমাফিক দারিদ্র্য জীবনকে তছনছ করে। আবার এই ব্যর্থতার অভিশাপ ক্রমাগত তো শোনাও যায় না। সুবল ভিন্ন আশ্রয় খোঁজে। কেতু বউ সেই আশ্রয় স্থল হয়ে ওঠে। এখানেও ভাগ আছে। লখা পাল। লখা পাল থাকলে সুবলের দাবি কোথায়? তাই অনুপস্থিতই বড় আশ্রয় হয়ে ওঠে।

তরণী বুড়া মহাভারত পড়ে। মহাভারতের ঐশ্বর্যের কথা শোনাতে চায়। সুবলের পিতা হারাধন মাঝি পুঁথি পড়ত। তরণী সে নির্দেশ দেয় সুবলকেও। সুবলের চিন্তা অন্য দিকে। ভাতের চিন্তা। ভাতের চিন্তা ফুরালে যৌনতা পেয়ে বসে। দুইয়েরই সংস্থান আছে কেতু বউয়ের কাছে। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে অমনযোগী হয়ে বসে থাকে সুবল। এ আখ্যান জনপদ জীবনের। যে জীবন জেলে মাঝি সংঘাত সংশয় অতিক্রম করতে চেয়েও পারে না। লেখক জানে পারা সম্ভব নয়। কেনন-ই বা পারবে? যেখানে বংশ পরম্পরায় দরিদ্র অথই পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। যে পাহাড়ের ভাঙন নেই। কেবলই উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। সুবলের জীবনে দুই নারী—ফুলি, কেতু বউ। ফুলির কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কেতু বউ এর কাছে আশ্রয় নেয়। সে জানে এ আশ্রয় ক্ষণিক। তবুও তো আশ্রয়। মনের আনন্দ। অবসরে ফুলি ও কেতু বউ এর তুলনা করে। মিল খুঁজে পায় না। হতাশ হয়। ভাবে এ বুঝি প্রকৃতির নিয়ম। মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়নে ক্ষতবিক্ষত হয়। কেবল অর্থের অনটনই পিছনে ফেলে দেয়। কোনো আত্মজিজ্ঞাসা নেই। কেন লখা পাল? উত্তর জানে সুবল। জেলে মাঝিদের জীবন এখানে দুর্নিবার। ক্লান্তির এখানে ক্ষমা নেই। রবিবাবু কথিত ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ এখানে বাজে না। পথে পিছিয়ে পড়ার তো কোনো প্রশ্নই নেই। পথ যেখানে দ্বিধাভক্ত। নৃপতির স্ত্রী রাধাকে ধাইজাল টানতে হয়। যদি কিছু ভাতের সংস্থান হয়।

প্রতিনিয়ত বেজে চলে অভাবের সংগীত

কণ্ঠসংগীত বা যন্ত্রসংগীত নয় এখানে বাজে অভাব সংগীত। জেলে পাড়ার অনাবশ্যক ভবিষ্যৎ সাত আট বছর হলেই কোন না কোন কাজে নিযুক্ত হওয়া। অবধারিত ভাবে ছুটে আসে সামাজিক ব্যঙ্গ। শিক্ষা অপেক্ষা জেলে জীবনের জাল টানাই যেন বড় শিক্ষা। যে শিক্ষা ভাত কাপড়ের সংস্থান করে তাই তো বড়। নিরঞ্জনদের একদিন জালে যেতে হয়। কিন্তু অনাভ্যাসের ফলে বিশেষ সুবিধা হল না। জেলেরা ব্যঙ্গ দৃষ্টিতে দেখলেও কেউ মুখে কিছু বলল না। কেননা জীবন তো চালাতে হবে। যেখানে অন্ন চিন্তাই বড় চিন্তা সেখানে চুরির লজ্জা কতটুকু? না কোনো দ্বিধা দেখা দেয়নি। ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে’। একদিন সত্যি সে নিখোঁজ হল। বলা ভালো জীবনের পরিণাম তাঁকে নিখোঁজ করে দিল। সুবলের আত্মচিন্তায় অন্নচিন্তা বারবার হানা দেয়। সাড়া পাড়া ঘুরেও সামান্য চাল সংস্থান করতে পারেনি। কী জবাব দেবে স্ত্রীর কাছে? আছে কোনো উত্তর? স্ত্রী তো অথর্ব হয়ে সময় অতিবাহিত করছে। কোন মুখে তাকাবে? প্রতিপদে জীবনযুদ্ধ। জল ও জীবন যেন একাকার হয়ে যায়। মরা মাছের মতো যেন এদের জীবন। নেই কোনো গ্লানি, অহংকার বোধ বা উদ্দীপনা। কেবলই দিন অতিক্রমের উদ্‌যাপন। অসহনীয় দরিদ্র। সেই দরিদ্রকে লেখক এমন মায়াবী গদ্যে বুনেছেন যা অনবদ্য। বাক্যের এমন মায়াময়, মধুময় বিন্যাস আখ্যানকে স্বাদু করে তোলে। জীবন এখানে সমুদ্রের মতো নোনো, চোখের জল ফেলবার অবকাশ নেই। সেই নোনা জীবনকে লেখক মিষ্টি ভাষায় বুনেছেন। সুবল বাড়িতে ফিরে এসে দেখে ভাতের গন্ধ। কোথা থেকে এল চালের সংস্থান? স্ত্রী তো গহনাও বিক্রি করেনি। সমস্ত গ্লানিবোধ মুছে যায় ক্ষুধার অন্নের কাছে—“হ্যাঁ, ভাত। চালের সঙ্গে ডাল কি কুমড়া-কুচি মেশানো জাবনা নয়। ভাত। নির্ভেজাল ভাত। তরতরে সাদা ভাত। গরম ভাত। মাছের টকের সঙ্গে এরকম ভাত কতদিন খায়নি সুবল, কষ্ট করে মনে করতে হয়। চোখ চকচক করে উঠলো সুবলের।” (মুক্তামাছ, দিঘলপত্র, পূর্ব মেদিনীপুর-০১, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৮, পৃ. ৫৪)

সন্তানহীন সরমা। সে জেলে পাড়ার অনেককে দুধ দিয়েছে। আজ অভিমানও কম নেই। জেলে পাড়ায় মহিলাদের জীবন দুর্বিসহ। জালে সবাই না গেলেও অন্নচিন্তা যেন জ্বালিয়ে খায়। কত সব বিচিত্র মহিলা। কেতু বউ, রানি, ফুলি, সরমা। জীবনের কত সত্য থাকে তা না দেখলে বোঝা তো দূর অস্ত, জানাও যায় না। লেখক দেখেছিলেন সেইসব সত্যগুলিকে। জীবন এখানে মেঘলা আকাশে ভরা। কেবলই অন্ধকার ডুবিয়ে দেয়। অর্থ সংকটই জীবন জিজ্ঞাসা ও সমস্যার জন্ম দেয়। সেই চিন্তা থেকে নারী পুরুষ কেউই রেহাই পায়নি। নারীরা পরস্পর কোন্দোল করে না। নারী ঈর্ষা আছে তবে প্রকাশ্যে আনে না। গোষ্ঠী জীবনে তা কোনো লাভ সুরাহা করে না তা জানে। কেউ কেউ বৃত্তের বাইরে চলে যায়। মনে সংশয় সন্দেহের জন্ম দেয়।

গোষ্ঠী জীবনের আখ্যান। হারাধন মাঝিকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক জীবন পরিসর ও চরিত্রগুলির বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে পুত্র সুবলকে কেন্দ্র করে মাঝি পাড়ার চাল চুলোহীন জীবনের বারমাস্যা বইতে থাকে ফাল্গুনের তপ্ত বেলা থেকে আশ্বিনের মৃদু বাতাসে। সামান্য মুগের ডাল খাবার সাধ্য নেই এই মানুষগুলির। হায় রে জীবন! সিদ্ধেশ্বরী বোট মাঝিদের কাছে দেবতা সমান। হারাধন মাঝির ছেলে সুবল মনের মধ্যে মাঝি হবার বাসনা লালন করে চলে। নোনা মানুষদের নিয়ে এ মিষ্টি স্বাদের মিহি আখ্যান। আখ্যানের এমনই গতি ও মাঝিদের জীবনের কোলাহল সমস্ত বিষাদ বন্যার মধ্যেও বাঁচার আনন্দে আনন্দমুখর করে তোলে। সূর্যের উদয়-অস্তের সঙ্গে মাঝিদের সময় নির্ণয় হয় না। মাঝিদের সময় নির্ণয় হয় জোয়ার ভাঁটা দ্বারা। তবে মহিলাদের সময় পরিসরের একক ভিন্ন। জোয়ার এলেই ঘর ছাড়ার ইঙ্গিত। জাল নিয়ে জলে নামা। জলের মীন সংগ্রহ করে রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করা। সুবলের ঠাকুমা নানা গল্প বলে। নানা লৌকিক-অলৌকিক গল্প। সেসব রাতের অন্ধকারে সুবল-কেতু গোগ্রাসে গিলে খায়। ঠাকুমা জানায় স্বাতী নক্ষত্রের বৃষ্টি মাছের ওপর পড়লে সে মাছ মুক্তামাছ হয়। সুবলের মনে মুক্তামাছের ধারণা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে। যা সুবলকে মাঝিগিরি অপেক্ষা জেলে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করে। যদি ভাগ্য ফেরে। যদি ঈশ্বর দয়া করে। এই অনাগত ভবিষ্যৎ চিন্তা নিয়েই সুবল ঝাঁপ দেয় জেলে জীবনে।

এইখানে জল আছে, জীবন আছে, আখ্যানের স্রোত আছে...

জেলে পাড়ায় শিক্ষা দীক্ষার কোনো বালাই নেই। পাঠশালা কোথায়? অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম। জেলের ছেলে জেলে মাঝি হবে এটাই যেন ঘোষিত প্রন্থা। নবীন শিশুর প্রথম জালে যাওয়ার দিন মা মঙ্গলার প্রসাদ নেওয়া অবধারিত নিয়ম। এটাই যেন শিক্ষানবিশের মঙ্গলবার্তা। আখ্যানে রয়েছে অন্ধকার জীবনের সেই ভয়বিহ্বল ইঙ্গিত—“ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো প্রকার মাথা ঘামানো বেড়াখানার এই জেলেপাড়ার রীতি বিরুদ্ধ। জেলের লক্ষ্মী জালে। জেলের ছেলে বড় হয়ে জালে যাবে—এটাই এখানকার সকলের ছক-কাটা হিসেব। এর বাইরে কেউ কখনো ভাবতে পারে না। ভাবতে চায় না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছেলেকে লেখাপড়া শেখানোর চিন্তা তো অনেক দূর।” (তদেব, পৃ. ৮৩) কিন্তু অনাগত ভবিষ্যৎ চিন্তা একটি ঠুনকো আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় হারাধনের। নিরক্ষরতা পাপ বুঝতে শেখে সে। মহাজনের কাছে ভর্ৎসনা শোনে। ভাঁড়ারে সামান্য বিদ্যা থাকলে এমন হোত না। কোনোদিন ভদ্র সমাজের সমপক্ষ হতে পারবে না ভেবে চোরা গ্লানিবোধের জন্ম হয়। যা তাঁকে এক দর্শনে নিয়ে যায়। নিরক্ষরতার অভিশাপ বেড়াখানা জেলেপাড়ার কাউকে স্পর্শ করে না। বরং তাদের কাছে শিক্ষিত হওয়াটাই যেন ভয়ানক পাপ। রীতি বিরুদ্ধ। শিক্ষার কথা বললে অবিনাশ ব্যঙ্গ ছুড়ে দেয়। শিক্ষা যেন এখানে এক শৌখিন ব্যাপার। আহ্লাদের ব্যাপার। জেলেরা আর শখ করেছে কবে?

অবশেষে এল সেই প্রতিক্ষিত দিন, সুবলের সমুদ্র যাত্রা। সমুদ্রের এতো রহস্য সে আজ উপলব্ধি করল। তেমনি সিদ্ধেশ্বরী বোট সম্পর্কে মনের মধ্যে যে ধারণাগুলি লালন করে চলেছিল সেগুলি ভেঙে যাচ্ছে। পিতার মাঝিগিরি সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা মনের মধ্যে সযত্নে লালন করেছিল সেগুলি তছনছ হচ্ছে। সমুদ্র নিয়ে বালক সুবলের মনে ফ্যান্টাসি আছে। কেনই বা থাকবে না? জীবনের রুক্ষ্মতা যে স্পর্শ করেনি তার লাগি কি রোমান্স মধুর নয়? সুবলের মুক্তামাছের ধারণা ভেঙে যায় মামাবাড়ি গিয়ে। পাঁচ বছর জেলে জীবন থেকে একটু তফাতে ছিল সে। আর কিছুদিন থাকলে হয়ত শিক্ষা পরিণত হত। এই সুবলকেই নিয়েই জেলে পাড়ায় সংশয় সন্দেহ। শিক্ষিত হলে কেউ কি জালে যাবে? তরণী তো সুবলের পাঠ পরীক্ষা নেয়। অসম্ভব মায়াবী আখ্যান। জীবনকে জেলে জীবনের ফ্রেমে রেখে আখ্যান প্রবাহিত হয়। আখ্যানকার কখনও নিজেই কথক, কখনও চরিত্রের সংলাপে জলময়, গন্ধময় জেলে জীবনের বৃত্তান্ত বলে যান। জটিল কোনো তত্ত্ববলয় নয়। লেখকও প্রতিষ্ঠানের সীলমোহর পাওয়া কোনো পরিচিত মুখ নয়। তবে আখ্যানে একটা মায়াময় স্নিগ্ধ ভাব আছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় জীবনের যে আভা বিকশিত হয় তার বিচ্ছুরণ আছে। চালুনে জল দিলে সমস্ত জল ঝরে যাওয়ার পরও বিন্দু বিন্দু জল যেমন ক্ষণিক সময় ব্যবধানে ঝরে সেই ঝরে পড়ার শব্দ আছে আখ্যানে। তা গম্ভীর নয়, জীবনসুরে বাঁধা।

সমুদ্র ও পার্শ্ববর্তী চর। তীরবর্তী মানুষকে বাঁধ বেয়ে জলে নামতেই হয়। জীবিকা ও জীবনের সংস্থান করে আবার উঠতে হয়। উঁচু তীর থেকে জল পর্যন্ত যে ঢেউ খেলানো ভূমি জেলে মাঝিদের জীবন যেন তেমন। জীবন কেবলই নীচে নেমে আসে। সুবল শৈশব থেকে পরিণত বয়সে গেলেও মনের মধ্যে বেঁচে আছে মুক্তামাছ। যা ভাগ্য বিবর্তনের একক। কোন দরিদ্র ভাগ্যের পরিবর্তন চায় না? জানে তা অলীক, তবুও নৌক নিয়ে আপাত সুখের সন্ধানে যাত্রা। স্পষ্ট কথায় ভাতের সন্ধান। এই মুক্তামাছের গল্পই যেন দরিদ্র মাঝির জীবনে একটু আশার আলো। আশা ছাড়া একটি দরিদ্র মানুষ আর কি নিয়ে বাঁচতে পারে? শুধুই অলীক স্বপ্ন রচনা করে যাওয়া। কে চায় আশার বিসর্জন দিতে? স্নিগ্ধ আটপ্রৌঢ় ভাষায় জেলে জীবনের যে বাস্তবতা তিনি অঙ্কন করেছেন তা বাংলা উপন্যাসের স্থায়ী সম্পদ। দরিদ্রের মধ্যেও যে অপরিসীম সৌন্দর্যের নানা রশ্মির রংমশাল ছড়িয়ে আছে তা আবিষ্কার করেছেন। সামান্য তুলে ধরা যাক—

“অনেক কিছু হব, বড় হয়ে অনেক কিছু করব, তেমনতর স্বপ্নের ডালপালাগুলো সেই কবে ভেঙে গেছে। আমড়া গাছের মটকা ডালের মতন বাস্তবের ছোট খাটো আঘাতেই। মেদ-মাংস কি সবুজ পাতার চাহিদা মাফিক রসের যোগান দিতে না পেরে, সব খুইয়ে সুবল মাঝি এখন তার হাড়ের মৌল কাঠামোটাকেই কেবল দাঁড় করিয়ে রেখেছে দু’টো পায়ের উপর। শীতকালের পাতাঝরা গাছের মতনই শীর্ণ খরখরে বিপর্যস্ত চেহারা। কোমরে জড়ানো তেলচিটে ময়লা চারহাতি একখানা গামছা।” (তদেব, পৃ. ১১২)

এ আখ্যান যেন দুঃখের সাতকাহন। অভাবী জীবনে যেন দুঃখের সাতপাকে খেলা। দুঃখই যেন জীবনের অতল রহস্য চিনতে শেখায়। দুঃখ ছাড়া সব যে চলে যায়। দুঃখের ছন্দমালা তিনি এমনভাবে বুনন করেছেন যা অনবদ্য। জেলে যেমন জাল বুনন করে ছন্দবদ্ধভাবে লেখক তেমন দুঃখ বুনন করেছেন। এ জীবন ছাইভস্ম মাখা নয় দুঃখ মাখা। দুঃখের সেতু যেন জীবনের সমস্ত প্রান্তকে নিবিড় করে টেনে রেখেছে। সুবলের জীবনে আশার বার্তা নিয়ে আসে কেতু বউ। সেই লখা পালের জালে কাজের খোঁজ করে দেয়। সুবল তো এটাই চাইছিল। ভীরু সুবল মুখে বলতে পারেনি। সম্পর্কের একটা বাতাবরণ তৈরি করেন লেখক। ছোটবেলায় খেলার সঙ্গীর প্রতি এ যেন অনাবশ্যক মায়া। সুবল শেষ পর্যন্ত বাঁধা পড়ে লখা পালের কাছে। মাছ না উঠলে ভোগান্তি বাড়বে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হবে সমুদ্রে। ঘন মেঘে বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো আখ্যানে রোমান্টিকতা উঁকি দেয়। জীবনের নগ্ন বাস্তবতা থেকে বাঁচাতেই বুঝি লেখক চরিত্রগুলিকে আপাত আড়ালে নিয়ে যান। কাঁহাতক আর লড়াই করা যায়? জীবনও যে অবসন্ন হয়ে আসে।

আছে প্রগাঢ় যৌন চেতনা। নৌকাকে দেবী মনে করে জেলে মাঝিরা। তাই নৌকায় শোয়া যায় না। ফুলির সমস্ত অজানাকে ভেঙে দেয় সুবল। যেখানে লুকিয়ে থাকে নিগূঢ় যৌনতা। লেখকের কপটহীন শব্দচয়ন ও উপমা বোধ। নিজেকে ভিতর থেকে নিঙড়ে না নিলে এমন আখ্যান লেখা সম্ভব নয়। ভাষার সাবলিল প্রবাহ আখ্যানে গতি সঞ্চার করে। সমুদ্রের কুলুকুলু শব্দের মতো আখ্যানের ঝর্ণাধারা ক্রমেই পরিণতির পথে পর্যবসিত হয়। জোয়ার-ভাটার গতিময় ছন্দে জেলে মাঝিদের জীবনলীলা একটা সুর পায়, হোক না তা দুঃখের সুর, তবু তা উপভোগ করে। উপভোগের বসন্তে কখন বর্ষার কালো ছাড়া ঘনিয়ে আসে কেউ জানে না। জানা সম্ভব নয়। এ যেন জীবনের সাবলীল গতি। অপ্রস্তুহীনের প্রস্তুতপর্ব শেষ হয় না। দুঃখ বিদায় হয় না। কেতু ও সুবলের আপাত রোমান্স সম্পর্ক। সমস্ত দুঃখের মধ্যেও যেন একটু আশার আলো। আনন্দ আশ্রয়। জীবনধারণের লসাগু পূর্ণ করতে গেলে যে রোমান্স চাই, আপাত ভালোবাসা চাই। ভালোবাসা যেন জীবনেরই নির্যাস। সুযোগ পেলেই সে শুধু প্রতিপক্ষে ধায়। সুখ শান্তি খোঁজে।

এই প্রথম জেলে পাড়ার মাঝিরা সাবাড় জাল নিয়ে সমুদ্রে নামবে। জালের আয়তন নিয়ে সংশয়। মূর্খ মাঝি জালের আয়তন সম্পর্কে অজ্ঞাত। যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের অতীত জীবনের কথা স্মৃতিচারণ করছে। লেখক একটা বড় সময়কে ধরতে চান। সমুদ্রে অভিযানরত জেলে মাঝিদের অতীত-বর্তমান যেন এক অভিজ্ঞ সমাজতাত্ত্বিক চোখে পর্যবেক্ষণ। প্রখরভাবে যিনি জীবনকে জেনেছেন তার তত্ত্ব না জানলেও চলে। জীবনের অপার সাগর থেকে যে অভিজ্ঞতাগুলি উঠে আসে সেগুলিই তিনি বিনিসুতোয় বুনে চলেন। এ যেন দরিদ্রের মালা। ক্রমাগত জীবনযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি। জাতির অলিখিত ইতিহাস। স্বামী সমুদ্রে গেলে নানা লোকাচার পালন করতে হয় স্ত্রীদের। স্বামী সমুদ্রে, কেবলই কুচিন্তা গ্রাস করে নারীকে। ঘরে বাইরে কেবলই সংশয় বিপর্যয়ের সংকেত। যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে মৃত্যু সংবাদ। কান্নার কোলাহল এখানে তেমন নেই। তবে বেদনা আছে। ব্যক্তির যন্ত্রণা ব্যক্তিকেই কুড়েকুড়ে খায়। নৌকা যাত্রার দিনই একটি নৌকা প্রায় ডুবে যেতে বসে। সবার বক্তব্য কেউ পাপ করেছে। অতুল তাকায় সুবলের দিকে। কেননা সেই যৌন স্পর্শ পেতে চেয়েছিল কেতু বউয়ের। লখা পাল বাঘের মতো আক্রমণ করে সুবলকে। আচার-অনাচার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পল্লির মানুষের জীবনচেতনাকে আঁকড়ে থাকে পাপ বোধ। আধুনিক বিচার বিশ্লেষণ ও আজন্ম বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব বড় হয়ে ওঠে। যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের কাছে আজন্ম বিশ্বাস-সংস্কার যখন টাল খায় তখন মন ভেঙে যায়। থাকে মৃদু বিদ্রোহ। কিন্তু গোষ্ঠীপতির প্রতি সে বিদ্রোহ ঘোষিত হয় না। লখা পাল যেন হোসেন মিঞা। অর্থের দিকে যার ক্রমাগত নজর। তেমনি লখা পালের সন্তান চন্দন জেলেদের আজন্ম বিশ্বাসে যেন আঘাত হানে—

“জেলেপাড়ার হুড় জেলেরা চন্দনের ওপর মনে মনে বেদম চটেছে। যেহেতু তাদের আজন্ম সংস্কারের ভিতে হাতুড়ির ঘা পিটেছে চন্দন। মা মঙ্গলার সম্মানকে চার-কড়া করে দিতে চায় সে। এবং যেহেতু চন্দনের বিচারে সুবল তো বে-কসুর খালাস, উপরন্তু বাদবাকিদের অনেকেই দোষী বলে সাব্যস্ত, যারা নৌকা বইতে গেছিল।” (তদেব, পৃ. ১৬৪)

লখা পাল দ্বারা নানাভাবে অপমানিত হয় সুবল। মহাজন যেভাবে পাওনাদারকে অপমান করে। অগ্রিম টাকা পরিশোধের কোনো পথ নেই। তাই সুবলকে সমুদ্রে যেতেই হয়। সমুদ্র মাছের দিশা নেই। বেনিয়া লখা পালের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। রাগ বর্ষিত হয় সুবলের ওপর। প্রতিমুহূর্তে অপমানিত হতে হয় সুবলকে। নেই কোনো প্রতিবাদ। জেলে মাঝির সাধ্য কতটুকু প্রতিবাদের? সংশয়ের তীর সুবলের দিকে। কেউ কেউ অবিশ্বাস করে। কিন্তু বলার সাধ্য নেই। সমুদ্র থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবী মঙ্গলার ওপর অবিশ্বাসের পারদ চরতে থাকে সুবলের। একসময় শোনে কেয়া বন উঠিয়ে সেখানে দিঘি হবে। দেবীর নিধনে সে ততটা কাতর নয়। অবিশ্বাসের যে সুর মনের অন্দরমহলে গোপনে প্রবেশ করেছে তার নিরাসন হয় না। হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনার মাঝেও সুবল এগিয়ে যায়। সুবলকে সামনে রেখে লেখক জেলে জীবনের বিস্তৃর্ণ সময়ের কথা বলেন। মহাজন দ্বারা বর্জিত বিচ্যুত সুবল তবুও যেন জেলে পাড়ার মধ্যমণি। সুবলকে সামনে রেখেই জেলে জীবনের কথাপালা বিকশিত হয়। জেলা পাড়ার মানুষগুলি রংচঙে নয়। জীবনের ক্রম লড়াইয়ে বড় বাস্তব। প্রেম, রোমান্স, কোলাহল আছে তবে তা মলিনভাবে। কেউ নরকগামী নয়, কারও সত্তা দ্বিখণ্ডিত তবে জেলে জীবনের ঊর্ধ্বে নয়। মহাভারতের পাঠ তাদের পুঁথি জ্ঞান, দেবী মঙ্গলায় বিশ্বাস তাদের ভরসা স্থল আর সমুদ্রের অভিজ্ঞতা তাদের জীবন চালক।

শেষ পর্যন্ত সমুদ্র তাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় না। মাছের সন্ধান পায়। অর্থলাভ ঘটে। দুঃখভোগের নিরাসন হয়। মন সাহসী হয়ে ওঠে। তবে বিদ্রোহের সুযোগ পায় না। এখনও যে বন্দি লখা পালের কাছে। মরমীয়া ভাষায় লেখক জেলে জীবনের আকাঙ্ক্ষাহীণ ভ্রাম্যমান জীবনের গতি টানতে চেয়েছেন। অর্থগত দিকে থেকে পঙ্গুত্ব জীবন চেয়ে থাকে সমুদ্রের মীনের আশায়। সে প্রত্যাশা পূরণ হলে মাঝির মনে খুশির জোয়ার আসে। বিজয়া দশমীর পরের দিন যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা সমাপ্ত হল মদন ভঞ্জন পূর্ণিমায়। বলা ভালো আখ্যানের বিস্তার এই দুই উৎসবের মধ্যবর্তী সময়। মাঝির জীবনে অর্থ এসেছে, সংশয়ও কি নয়? তরণী দলুই জানিয়েছে জলের টাকা সইবে না। নৃপতি ভিন্ন যুক্তি দেখায়। আর্থিক স্বচ্ছন্দ সুবলকে অন্য চেতনায় নিয়ে যায়। মা মঙ্গলার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। হ্যাঁ-না এর দ্বন্দ্ব ক্রমাগত জেলে মাঝির জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বিশ্বসৃষ্টির এই চরাচর সম্পর্কে সমস্ত ধারণাকে অবিশ্বাস করতে পারে না। সহজ সরল জীবন বিশ্বাস নিয়েই বাঁচতে চায়। তেমন কোনো চেতনা নেই। জেলে মাঝির আর কত চেতনা, বোধ থাকা সম্ভব? যেখানে জীবনই ছিন্নভিন্ন ছোটলোক তাকমায় সাড়া জীবনের গ্লানি সইতে হয় সেখানে যেন কোনো চেতনার জন্ম হতে পারে না!

মুরগি লড়াইয়ের প্রতিযোগিতায় কেন এই আখ্যান?

বাংলা বাজারের লেখকমণ্ডলী (যিনি দুই/চারটি কবিতা লিখেছেন, হাফডজন গল্প আর সুয়াখানা উপন্যাস) ক্রমাগত ছুটছেন প্রকাশকের দরবারে। দরবেশ সংস্কৃতি প্রচারে নয় নিজের লিখন কর্মকে বাংলা বাজারের তামাম মানুষের কাছে উপযোগী করতে। প্রকাশকও বয়লার মুরগি ভেবে চেপে ধরেছেন। আরে বাবু আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন? আপনাকেই তো আমাদের প্রয়োজন। টাকা দাও বই ছাপো। মার্কেটিং এর দায়িত্ব আমাদের। এই কুমড়ো সংস্কৃতিতে তো প্রকৃত লেখক ভিড়বে না। কোথায় যাবে প্রকৃত লেখক? ওই জীবনানন্দের মতো পাণ্ডুলিপি বাক্স বন্দি হবে(আজ বাক্স নয় কম্পিউটার বা ল্যাপটপ)। কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করবেন। সন্তোষ করের মতো কিছু লেখকের দুই একটা বই ছড়িয়ে যাবে। সারা বাংলার প্রত্যেক জেলায় সবই হল কিন্তু কলেজ স্ট্রিটের বিকল্প গড়ে উঠলো না? সরকারি উদ্যোগ তো দূর, বেসরকারি লগ্নিও হোল না। কিছু ছোটো আউটলেট ভিন্ন। যদিও বইবৃত্তান্ত ব্যাপারটা সমস্কৃতি মন্তির আওতার বাইরে! উৎসব মোচ্ছব নিয়েই তো তাদের বেশ ভালো চলছে।

মুক্তামাছের সন্ধানই সুবলকে জীবনের সব ক্লেদ, গ্লানি, বিষণ্ণতা ভুলিয়েছে। পরাজয়ের বেদনা ভুলে ক্রমেই নতুন স্বপ্ন বুনতে গেছে। জেলে জীবনকে এক উচ্চসুরে বেঁধে বাজিয়েছেন লেখক। আখ্যানের কাহিনিধর্মীতা ও জীবনবোধ এক জ্যামিতিক ও ভৌগোলিক পরিসরে নিয়ে গেছে যা বাংলা উপন্যাসের ভুবনে বিশেষ সংযোজন। একদিকে আধিপাত্যবাদ অন্যদিকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা, কায়েত মহাজন ও জেলে মাঝির দ্বন্দ্ব স্রোতে প্রবাহিত যে সময়ের জীবনদীপ জ্বেলে ওঠে তা বিশিষ্টতার দাবি করে। প্রকৃতি এদের সঙ্গে বেইমানী করেনি, মানুষও প্রকৃতির ওপর ভরসা হারায়নি, প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জেলে জীবনের বিলাসবিহীন ক্যানভাসকে লেখক যে মাত্রায় নিয়ে এসেছেন তা ক্লাসিক হয়ে ওঠে। আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ, উপমার বর্ণালি, মিহিদানার মতো ছোটো অথচ মিষ্টি বাক্যে নোনা মানুষের যে জীবন তিনি নির্মাণ করেন তা এক আশ্চর্য জীবনচেতনায় পাঠককে উপনীত করে—এখানেই আখ্যানের ধ্বনিসৌন্দর্য। নগরকেন্দ্রিক জীবন থেকে বহুদূরে জেলে পাড়াগাঁর কথা লৌকিক পুরাণ, লোকাচার সমস্ত মিলিয়ে এমন গদ্যশৈলীতে মৃদুমধুর স্বরে প্রবাহিত করেন যা বহু উপন্যাসের মধ্যেও পৃথক গোত্রের চিহ্নিত করে দিতে অসুবিধা হয় না।

** সমস্কৃতি মন্তি এই বানান ই লিখেছি। ইচ্ছাকৃত।



পুরুষোত্তম সিংহ
সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর
৬২৯৭৪৫৮৫৯১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ