আজ কলেজ শেষ করে তালবাগানের মাঝের লাল সুরকির রাস্তাটা দিয়ে যখন পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম, তখন মনে মনে আবেদকে বেশ ক’বার ধন্যবাদ দিলাম। আবেদ যদি গত দু’বছর ওভাবে বারবার বুঝিয়ে না দিতো ওর জীবনে আমি বাড়তি কেউ হয়ে গেছি, তাহলে বড় শহরের নামকরা কলেজের চাকরিটা ছেড়ে এই শান্ত-নিরিবিলি মফস্বল শহরটাতে আসা হতো না আমার।
সরকারি চাকুরিজীবী বাবার কল্যাণে আমার ছোটোবেলা কেটেছে মফস্বলে। এজন্যই হয়তো মফস্বলী নির্ভেজাল জীবনের প্রতি একটা আলাদা লোভ সব সময়ই ছিল। কিন্তু সে লোভের রাশে টান পড়ে আবেদের সাথে পরিচয় হবার পরে। বিজনেস ম্যানেজম্যান্ট থেকে এম.বি.এ করা আবেদের শুরু থেকেই একমাত্র নিশানা মাল্টিন্যাশনাল কোনো কোম্প্যানির ঊর্ধ্বতন পদ কবজা করা। আর সে নিশানা লক্ষ্যভেদ করতে আমাকেও থেকে থেকে যেতে হয়েছিলো শহরে আবেদের সঙ্গে।আসলে আবেদের যে কোনো প্রাপ্তিতে ওকে সঙ্গ দিতে আমার ভালই লাগতো। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, ক্যারিয়ারিষ্ট আর ঝকঝকে ব্যক্তিত্বের আবেদ আমাকে বিশ্বাস করিয়েছিলো,আবেদবিহীন মীরা আসলে এই ছুটে চলা পৃথিবীর জন্য খুব একটা যুৎসই নয়।
‘ আহ্, মীরা আজকের পার্টিতেও তুমি ম্যাড়ম্যাড়ে এই সুতি শাড়িটা পড়ে যাবে? কোন পার্টিতে কী পড়তে হবে তাও বুদ্ধি খাটিয়ে বের করতে পারো না?আসলে এইসব পার্টি ঠিক তোমার জন্য না।’
এ ধরণের মন্তব্যে ভেতরে মিইয়ে যেতে যেতে আমি যেই না বলতাম,
‘ আজ আমি বরং না যাই, সব পার্টিতে তোমার সাথে যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া কলেজের কিছু কাজও আছে আমার।’
এরপর তো শুরু হতো আরেক বিড়ম্বনা। অচল আমাকে ঘঁষেমেজে আবেদ কতটা এই পৃথিবীর উপযুক্ত করে তুলছে প্রতিনিয়ত তার ফিরিস্তি শুরু হয়ে যেতো,
‘ দেখো, তোমার ভালোর জন্যই এসব পার্টিতে তোমাকে নিয়ে যাই মীরা। হাই কোয়ালিফাইড মানুষজনের সাথে তুমি যত মিশবে তত তোমার জড়তা কাটবে। আজ না হোক কাল আমরা তো দেশ ছাড়বোই। ওসব দেশের জন্য তোমাকে তৈরী হতে হবে তো।’
এরপর নিজের পছন্দ অনুযায়ী সার্টিনের একটা এ্যামব্রোডারিয়েড শাড়ি এনে আমার সামনে ধরতো,
‘ এই পিচ আর লাইট লেমন কন্ট্রাস্টে তোমাকে পরীর মতো লাগবে।’
আবেদের এই আহ্লাদটুকুতে কী থাকতো তা আমার আজও জানা নেই। আমি আগের সব তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভুলে হাইহিলে ঠকঠক শব্দ তুলে হাঁটতে শুরু করতাম ঝকঝকে আবেদের পাশে। পার্টিতে যতটুকু সময় আবেদ পাশে থাকতো অদ্ভুত এক অহংকারে আমার গ্রীবা দৃঢ় হয়ে থাকতো। সে সব পার্টিতে সবচেয়ে ঝকঝকে আর চৌকষ ব্যক্তিকে সঙ্গ দিচ্ছি যে আমি!
তবে দৃঢ় সে গ্রীবায় হঠাৎ নখের আচড় বসতেই আমার সব অহংকার দুমড়েমুচড়ে গেলো।
হ্যাঁ, আনাড়ি আমি যতই হাইহিলে আবেদের উচ্চতার সাথে তাল মেলাতে চাই না কেনো, পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চির আমি হাইটের মতো চিন্তাভাবনাতেও আবেদের থেকে অনেক নীচু। এজন্যই তো অন্য মেয়েদের সাথে আবেদের খুব সাধারণ রসিকতাতেও আমি অন্য ইঙ্গিত খুঁজে পেতে শুরু করলাম। অফিসের পরেও নির্দিষ্ট কারো সাথে প্রতিদিন জরুরী মিটিং-কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে লাগলাম।
ব্যস্, ঝকঝকে আবেদ এক নিমেষে কেমন নর্দমার মতো নোংরা হয়ে উঠলো আমার কাছে,
‘ তোর মতো আনস্মার্ট একটা মেয়েকে যে আমি জাতে তুলছি তার জন্য শুকর কর। কোন সাহসে তুই সুমনারে ফোন দিসিস? ওর সাথে কথা বলার যোগ্যতা আছে তোর? নিজের লিমিট বুইঝ্যা আসিস আমার আর সুমনার সাথে লাগতে।’
এরপর যে ক’দিন ছিলাম আবেদের সাথে ওকে দেখলেই আমার গা গুলিয়ে বমি আসতো, ও আশেপাশে থাকলেই আমি মরা ইঁদুরের গন্ধ পেতাম। আর যখন অফিসের পর দীর্ঘ সময় কারো সাথে জরুরী মিটিং শেষে ও বাসায় ফিরতো তখন প্লেবয় আর ইটার্নিটির ঘ্রাণ মিলেমিশে শ্রাবণ মাসের পাট জাগ দেওয়া গন্ধ পেতাম।
সেসব সময় আমি দৌড়ে বাথরুমে চলে যেতাম। বেসিনের উপর উপুর হয়ে তেতো পানি গলা বেয়ে না ওঠা অব্দি পেট থেকে সবকিছু উগড়ে দিতাম।
কিন্তু এত দূর্গন্ধের ভেতর কতদিন আর থাকা যায়।
হ্যাঁ, পাক্কা সতেরো দিন পর কতগুলো সুতির ম্যাড়ম্যাড়ে শাড়ি আর কিছু বই নিয়ে আমি গিয়ে উঠলাম আমার ব্যাচেলর মেয়ে কলিগের বাসায়। আর সেখানেই আবিষ্কার করলাম শুধু আবেদই নয় সেই শহরের প্রতিও বিতৃষ্ণা এসেছে আমার।
ছয়মাস পর এই কাঞ্চনপুর থেকে এমপিওভূক্ত কলেজটির এ্যাপয়েন্টম্যান্ট লেটার আসতেই আবেদকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে চলে এলাম এখানে। আর এখানে আসার ঠিক চারদিন পরেই ডাকে এলো আবেদের সই করা ডিভোর্সের ফিরতি চিঠি।
ঝামেলাহীন এই মফস্বলে ম্যাড়ম্যাড়ে সুতির শাড়িতে পারফেক্ট মীরা একটি পারফেক্ট থাকার ঠিকানাও খুঁজে নিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে তালবাগান পেরিয়ে মসজিদের বড় মাঠটাই চলে এসেছি বেশ কিছুক্ষণ। ভাঙা একটি পরিত্যক্ত বাড়ি আর দশ-বারোটা মাঝারি মেহগনী গাছের বাগান পেরোলেই যে হাল্কা হলুদরঙের তিনরুমের ছোট বাড়িটা দেখা যায়, ওটাই এখন আমার ঠিকানা।
‘ঠিকানা’ শব্দটির জন্যই কীনা জানি না, আমার এখন হুট করে জমা হওয়া হলুদ খামগুলোর কথা মনে হলো। নয় নয় করেও পাঁচটি চিঠি এরমধ্যে এসেছে। ঠিকানাটা একদম ঠিক।তবে তা নিয়ে কারোরই দ্বিধা থাকার কথা নয়। কারণ প্রেরক এই ঠিকানাতেই চিঠিগুলো পাঠাতে চাইছে এবং পাঠাচ্ছে। তবে ঝামেলা পাকাচ্ছে প্রাপকের নামটি। বড় বড় আর স্পস্ট অক্ষরে লেখা——-
‘ শারমীন সুলতানা’
কাগজে পত্রে আমার ভালো নামটি হচ্ছে শারমীন শাহানা। নামের প্রথম অংশ মিলে যাওয়াই প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ আমার নাম ভুল করেছে। কিন্তু হলুদ খামের প্রেরকের ঠিকানা দেখে নিশ্চিত হয়ে যাই চিঠিগুলো আসলে আমার জন্য নয়,
রেবেকা খাতুন
জেলা কারাগার
মানিকগঞ্জ
ঢাকা
কারাগার থেকে আমার কাছে চিঠি আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে চিঠিগুলোর প্রাপক আসলে কে? এই প্রশ্নটির সহজবোধ্য উত্তরটি মনে করতে আমার একটুও বেগ পেতে হলো না।
হ্যাঁ, এই বাসার আগের ভাড়াটিয়াদের হবে চিঠিগুলো। হয়তো তাদের পরিচিত কেউ হবে এই চিঠির প্রেরক। আমি সময় নষ্ট না করে হুমায়ূন চাচার কাছে চিঠিগুলো নিয়ে গেলাম। হূমায়ূন চাচা মাঠের মসজিদে ইমামতি করেন। মসজিদটি আশেপাশের এলাকার মানুষ এজমালি মনে করে ব্যবহার করলেও, হুমায়ূন চাচা জানেন
মসজিদটি আমার বাসার মালিক সেই কুয়েত থেকে টাকা পাঠিয়ে করে দিয়েছেন। ওনারা দু’জন আসলে বন্ধু মানুষ। তাই মসজিদের মতো আমার ভাড়া করা বাড়িটিও হুমায়ূন চাচা দেখাশোনা করেন। ভাড়া তোলা থেকে শুরু করে পানির পাম্প মিস্ত্রি ডেকে রিপেয়ার করে দেওয়া সব দায়িত্ব হুমায়ূন চাচা বিনাবাক্যে করে দেন। তাই এই বাড়ির প্রতিটি ভাড়াটিয়ার আদ্যপান্ত হুমায়ূন চাচার থেকে আর কেউ ভালো জানবে না।
আমি নির্দ্ধিধায় চিঠিগুলো গুছিয়ে গতকাল কলেজ থেকে ফেরার পথে মসজিদে রাস্তা ধরেছিলাম,
‘ চাচা, এই চিঠিগুলো আগের ভাড়াটিয়ার। আপনি ওনাদের পৌঁছে দিতে পারবেন?’
আমার হাতে ধরা চিঠিগুলোর উপরে প্রাপকের নাম দেখে সৌম্য চেহারার হুমায়ূন চাচার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি নিশ্চিত হয়ে চিঠিগুলো ওনার দিকে এগিয়ে দিতেই উত্তর এলো,
‘ বুনডি, এই নামের কারো চেহারা তো স্মৃতি তে জোর দিয়েও মনে করতে পারতাছি না। আগের ভাড়াটিয়া ক্যান তার আগের দুই ভাড়াটিয়ার নামও এই নামের সাথে মিলতাছে না।’
আমি হতাশা চেপে রেখে বলি,
‘ হয়তো সেসব ভাড়াটিয়ার কোনো আত্মীয়ের নাম এটা।’
হুমায়ূন চাচা হাসিটুকু মুখে ঝুলিয়েই আমাকে নিদান দেন,
‘ বেওয়ারিশ চিঠি এগুলান। জমাইয়্যা রাইখ্যা লাভ নাই।’
হ্যাঁ, তাই তো যে চিঠিগুলোর প্রাপক নিরুদ্দেশ সে চিঠিগুলো বেওয়ারিশ হবে, এটাই স্বাভাবিক।
আর তাই স্বাভাবিক নিয়মেই আমি গতকাল হুমায়ূন চাচার কাছ থেকে ফিরে চিঠিগুলো ময়লার বালতিতে রেখে দিয়েছি। এতক্ষণে হয়তো চিঠিগুলো পৌরসভার ময়লার গাড়িতে করে পৌঁছে গেছে সুইপার কলোনির ভাগাড়ে।
মেহগনি গাছের বাগানটা পেরোলেই আমার ভাড়া বাড়ির ফটক পরিস্কার দেখা যায়। জং ধরা লোহার গ্রিলগুলোতে অবশ্য ভালো করে তাকালেই বোঝা এর আদি রং ছিলো নীল। বিকেলের রাঙা আলো আড়ম্বরহীন পড়ে রয়েছে সেই গ্রিলে।
আমি পা চালিয়ে বাড়িটাতে পৌঁছে যাই। ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে চারপাশের নিরবতা ভেঙে গেইট ঠেলে ভেতরে ঢুকি। আজ কেন যেন সামনের মাঠও খুব ফাঁকা। অন্যদিন এ সময় সেখানে দু’চারটা বাচ্চাকে খেলতে দেখা যায়।
আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে ফাঁকা মাঠ আরেকবার দেখি।
এরপর এগোই বেশ বড়সড় তালা লাগানো দরজার দিকে। চাবি ঘুড়িয়ে তালা খুলতে খুলতেই নিজের মনে একচোট হেসে নিই। নিরাপত্তার এত বাড়াবাড়ি দেখে যে কেউ ভেবে নিবে এ বাড়ির অন্দরে না জানি কত মূল্যবান জিনিষ আছে!
না, তালা খুলে গেলেও সাথে সাথেই বাড়ির অন্দরে ঢোকা হলো না আমার। তার আগেই আমার চোখ চলে গেলে সিঁড়ির বামপাশে রাখা ময়লার বালতিতে।
আজও পৌরসভার ময়লার গাড়িটা আসেনি দেখছি। দু’দিনের জমা ময়লা এরইমধ্যে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। অন্যদিন হলে ময়লার বালতিটা ওভাবেই রেখে দিতাম। কিন্তু আজ পারলাম না।
হলুদ খামগুলো আমাকে তা করতে দিলো না।
আমি পায়ে পায়ে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম সেই ময়লার বালতির সামনে। এক ঝটকায় তুলে নিলাম বেওয়ারিশ চিঠিগুলো।
হোক না এর প্রাপক নিরুদ্দেশ কিন্তু প্রেরক নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজনেই বারবার চিঠি পাঠাচ্ছে।
কী প্রয়োজন? কেনো প্রতিমাসে একই ঠিকানায় চিঠিগুলো আসছে? আর কেনইবা এই বাড়ি হলো চিঠিগুলোর ভুল ঠিকানা?——— প্রশ্নগুলো আমাকে সমস্ত সহবত ভুলিয়ে দিলো।
এই প্রথম অন্য কারো চিঠি খুলে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।
সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যত ঝটপট হয়ে গেলো, কাজটি করতে কিন্তু সময়ক্ষেপন হলো ভালোই।
প্রথমেই আমি ছাদের আমগাছের ছায়ায় শ্যাওলা পড়া পানির ট্যাংকির বরফ ঠান্ডা পানিতে আয়েশ করে গোছল করলাম।এরপর একগাদা কাঁচামরিচ দিয়ে ডিম ভেজে ভাত খেলাম। তারপর এককাপ লেবু চা বানিয়ে বসার ঘরে এলাম চিঠিগুলোর কাছে। মাস হিসেবে সিরিয়াল করলাম পাঁচমাসের পাঁচটি চিঠি।
না, এরপরও চিঠিগুলো খুলতে পারলাম না।
মনে হলো বারান্দায় গিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে চিঠিগুলো পড়া যাক। আশ্বিন মাস যাওয়া যাওয়া করছে। শেষ বিকেলে একটা ঠান্ডা হাওয়া ছাড়ে এখন।
বারান্দায় বেতের পাটিতে বসে আমি চিঠিগুলো খুলছি। প্রথম চিঠি এসেছে মে মাসে।
আপা,
সালাম নিয়েন। আশা করি আপনারা ভালো আছেন। বেশ অনেকদিন হয়ে গেলো আপনাদের কোনো খবর পাই না। অপেক্ষায় ছিলাম আপনি হয়তো কাউরে দিয়া খবর পাঠাবেন। সে জন্যই মাস তিনেক অপেক্ষা করলাম। কিন্তু না, কেউ আসলো না আপনার খবর নিয়ে।
আমি প্রায়ই মুন্নি রে স্বপ্নে দেখি। এতদিনে নিশ্চয়ই খানিক বড় হইছে মুন্নি। কেমন দেখায় ওরে এখন? কাউরে দিয়া একখান ছবি পাঠায়েন।
আপনাদের জন্য সবসময় দোয়া করি।
ইতি
রেবেকা খাতুন
চিঠিটা পড়া শেষ করেই মনে হলো নেহাত পারিবারিক চিঠি এগুলো, বাকীগুলো আর খুলবো না। তবে আসল প্রাপকের কাছে এ চিঠির মূল্য যে অপরিসীম তা বুঝতে আমার অবশ্য খুব বেশী আবেগী হতে হলো না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম চিঠিগুলো যত্ন করে রেখে দেবো। কখনো যদি কেউ এই চিঠিগুলোর খোঁজ করতে এখানে আসে!
চিঠিগুলো গুছিয়ে রেখে দিলাম। আর কালের নিয়মে নৈমিত্তিক কাজের সাথে সাথে ভুলে যেতে থাকলাম চিঠির অস্তিত্বগুলো। এরমধ্যে আশ্বিন ফুরিয়ে, কার্তিক গড়িয়ে অগ্রহায়ণে পড়লো।
মসজিদের মাঠটাই এখন প্রতি সন্ধ্যায় কুয়াশা জমে। আর সকালে যখন কলেজের জন্য বের হই তখন পাতলা শালটা মনে করে গায়ে জড়িয়ে নিই।
আজও তেমন শাল জড়িয়ে কলেজ থেকে বিশাল তালা লাগানো দরজায় সামনে দাঁড়াতেই চোখ চলে গেলো দরজার তলায় রাখা হলুদ খামের দিকে। পোস্টমাস্টার হয়তো দরজার নীচ দিয়ে চিঠিটা ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমি চিঠিটা হাতে নিতেই প্রেরকের ঠিকানাটা জ্বলজ্বল করে উঠলো।
আবার সেই জেলখানা থেকে চিঠি এলো!
মাঝের দু’মাস চিঠি না আসায় ভেবেছিলাম চিঠি এবার ঠিক প্রাপককে খুঁজে পেয়েছে।
নিজের আন্দাজ ভুল হওয়ার জন্যই কীনা জানি না, আমার এবার চিঠির প্রেরকের প্রতি মেজাজ খারাপ হলো। উত্তর না পেয়েও কেউ এভাবে নিয়ম করে চিঠি পাঠিয়ে যেতে পারে?
তবে শুধু এটুকুই নয়, আমার মনে আরোও কতগুলো প্রশ্ন এলো।
কেমন আছে রেবেকা খাতুন এখন? তার কাছে মুন্নির ছবি নিয়ে কেউ গেলো কী?
প্রশ্নগুলোর সাথে সাথেই চিঠিগুলো নতুন উদ্যোমে আমার সামনে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠলো। আর তার সাথে রেবেকা খাতুনও।
হ্যাঁ, রেবেকা খাতুন আমার জীবনে জুটে গেলো বেশ আড়ম্বর করেই।
সে গল্প শুরু করার আগে চিঠিগুলো আরেকবার পড়ে নেওয়া যাক।
জুন মাসের চিঠিটি ছিল দ্বিতীয়।
আপা,
সালাম নিয়েন। ভালো আছেন নিশ্চয়ই।
পর সমাচার এই যে, আগের কোনো চিঠির উত্তর পাই নাই। এজন্য চিন্তা হইতেছে খুব। বাড়ির সব খবর ভালো তো?
মুন্নি ভালো আছে তো? ওরে নিয়া প্রায়ই দু:স্বপ্ন দেখি। পরাণের ভিতর খুব কু ডাকে। মুন্নির খবর আর একখান ছবি পাঠাবেন আপা খুব তাড়াতাড়ি।
আল্লাহর কাছে সারাক্ষণ আপনার আর মুন্নির জন্য দোয়া করি।
ইতি
রেবেকা খাতুন
এরপর তৃতীয় আর চতুর্থ চিঠির ভাষা হুবহু এই চিঠির মতোই। যা পড়ে আমার খুব একটা রেবেকা খাতুন, তার আপা মানে শারমীন সুলতানা আর মুন্নিকে নিয়ে আগ্রহ জন্মালো না। কিন্তু পঞ্চম চিঠিটা আমাকে এক অদ্ভুত ধন্দে ফেলে দিলো।
আপা,
আজ আটমাস হইয়্যা গেলো আপনার আর মুন্নির কোনো খবর পাই না। আপনে কি আমার চিঠিগুলান পাইতেছেন? চিঠি পাইলে উত্তর দেন না ক্যান আপা? মুন্নির কিছু হয় নাই তো?
আমার কলিজা পোড়ায় আপা মুন্নির জন্য।
মুন্নির জন্য আমি মিথ্যা রে সত্য বানাইছি। কিন্তুক, ওর খবর না পাইলে আমি সত্য লুকাইয়া রাইখ্যা কি করমু?
আপনার বিবেচনা ভালো। মুন্নির খবর পাঠাইয়েন আপা। মিনতি করত্যাছি।
ইতি
রেবেকা খাতুন
চিঠির প্রেরক জেলখানায় না থাকলে হয়তো এতটা ধন্দে পড়তাম না।
আমি শেষ চিঠিখানা খুলি। আজই সেটা এসেছে।
আপা,
আমি কাল রাইতে স্বপ্ন দেখছি মুন্নিরে একখান ট্রাক চাপা দিছে। আমি সেই ভোর থিইক্যা জায়নামাজে বইস্যা আল ফাতিমা পড়তাছি আপা। আমার বুকের ভিতর তুফান উঠছে আপা। হাত-পা কাঁপতাছে আমার।
মনে হইতেছে, সত্যখান কইয়্যা দিই সবাইরে। সত্যই মনে হয় এখন আমারে মুন্নির কাছে নিতে পারবো।
আল্লাহর পর আপনারে বিশ্বাস করছিলাম আমি।
আপনার কাছে আঁচল পাততাছি আপা, মুন্নির খবর পাঠান।
ইতি
রেবেকা খাতুন
কে মুন্নি, কে রেবেকা আর কেইবা শারমীন সুলতানা? প্রশ্নগুলোর থেকেও রেবেকা খাতুনের মিথ্যাকে সত্য বানানোর পাজলটা আমাকে বেশী গোলকধাঁধায় ফেলে দিলো।
আমি রেবেকা খাতুনের সাথে দেখা করবো—-সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
তবে সিদ্ধান্ত যতটা ঝট্ করে নিয়ে নিলাম, তার বাস্তবায়ন হতে কিন্তু বেশ লম্বা সময় লেগে গেলো। জেল সুপারের কাছে কাগজে কলমে আবেদন জানানোর প্রায় মাস তিনেক পর তারিখ পড়লো রেবেকা খাতুনের সাথে দেখা করার।
নির্ধারিত দিনে রেবেকা খাতুনের সবগুলো চিঠি সাথে নিয়ে আমি পৌছে গেলাম মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারের ফটকে। মানুষটিকে অন্তত জানানো দরকার তার চিঠিগুলো ভুল ঠিকানায় গিয়ে পড়ছে।
তবে চিঠিগুলোর মতো আমি যে ভুল জায়গাতে আসিনি তা নিজেকে বোঝাতে বেশ বেগ পোহাতে হলো আমাকে।
‘ আপনি রেবেকা’
‘ হ, আপনেরে চিনতে পারতাছি না, আপা পাঠাইছে?’
আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবার প্রশ্ন করি,
‘ আপনি রেবেকা খাতুনই তো?’
রেবেকা খাতুনের চেহারার উৎকন্ঠা ছাপিয়ে আমি দেখতে থাকি একহারা গড়ন, টিকালো নাক, কোঁকড়া চুল আর বাদামী চোখের এক অপরূপ রাজকন্যাকে। জেলের আবছা আলোতেও যার মায়াভরা মুখ একটুও ম্লান নয়।
চিঠিগুলো আর তার ভাষাতে যে রেবেকা খাতুনকে আমি মনে মনে এঁকেছিলাম তার সাথে কোনভাবেই মেলানো যায় না।
‘ আমি শারমীন শাহানা, আপনার লেখা সবগুলো চিঠি আমার কাছে গিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর আসল প্রাপক আমি নই।’
আমার কথাগুলো রেবেকা খাতুন ঠিকঠাক ঠাওরে উঠতে পারলো না,
‘ হ, আমি তো শারমীন আপারেই চিঠি পাছাইছি। তার কাছেই তো মুন্নি আছে। কেমন আছে মুন্নি?’
রেবেকা খাতুনের একমাত্র প্রশ্ন এটি। দশ মিনিটের মধ্যে প্রশ্নটা প্রায় আটবার করে ফেলেছে সে।
আমি বুঝতে পারি, মুন্নির কথা ছাড়া আর কিছুই শুনতে বা বুঝতে অন্তত এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয় রেবেকা। কিন্তু মুন্নিটা কে? সেটাই তো জানা নেই আমার। তবুও পরিস্হিতি সামাল দিতে আমি বলি,
‘ মুন্নির খবর জানাবো, তার আগে আমার কথাগুলো একটু শান্ত হয়ে শুনুন।’
মুন্নির খবরের আশায় রেবেকা এই প্রথম আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো,
‘ আপনি প্রতিমাসে যে ঠিকানায় চিঠিগুলো পাঠিয়েছেন তা ভুল।’
আমি ততক্ষণে ব্যাগ থেকে চিঠিগুলো বের করে ফেলেছি।
‘ সে ঠিকানায় শারমীন সুলতানা নামে কেউ থাকে না।’
ভুল মানুষের হাতে চিঠিগুলো দেখে এবার রেবেকার চেহারাটা শক্ত হয়ে যায়,
‘ আপা তাইলে আমারে ঠকাইলো? আপার মতো ভালো মানুষ আমারে ঠকাইলো?’
আসলে এখানকার তিনটি চরিত্রই আমার কাছে এতটাই অপরিচিত যে, রেবেকা ঠকছে না জিতছে তার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। তবুও এই মেয়েটির চেহারার আপাত মায়াটুকু আমাকে কেমন যেনো মোহগ্রস্ত করে তুললো। খাবারে বিষ মিশিয়ে গৃহকর্তাকে খুনের আসামী মেয়েটিকে মুন্নির খবর জানাবার এক অদ্ভুত ইচ্ছা জাগ্রত হলো।
প্রথমবারের মতো জিজ্ঞাসা করলাম মুন্নির পরিচয়।
খুব অনভিপ্রেত সেটা বুঝেও প্রশ্নটি করলাম। নিজের সন্তানের খবরের জন্যই কেউ এরকম আকুতি করতে পারে। তবে আঠারো-উনিশ বছরের রেবেকা খাতুন কোনো সন্তানের মা এটা কেন যেনো বিশ্বাস হতে মন চায় না।
‘ মুন্নি আমার কলিজার টুকরা আপা। ওর লাইগ্যাই আমি এই জীবন বাইছ্যা নিছি। আমার মানিক ভালো থাকবো— তার লাইগ্যা আমি সব করতে পারি।’
অসহায় এই মাকে তার সন্তানের খবর জানানোর ইচ্ছাটা এরমধ্যেই আমার পণ হয়ে উঠল।
কথা না বাড়িয়ে চাইলাম সেই ঠিকানা যে ঠিকানায় রেবেকা খাতুন কাজ করতো।
১৫/২৬,
নোওয়া পাড়া,
মির্জাপুর
মানিকগঞ্জ
জানার সাথে সাথেই রেবেকাকে প্রশ্ন করলাম,এই ঠিকানায় চিঠি পাঠাননি কেন?
উত্তরে যা জানতে পারলাম তা হলো, শারমীন সুলতানা মির্জাপুর কলেজের শিক্ষক। রেবেকা জেলে আসার পরপরই কাঞ্চনপুর কলেজে বদলী হয়েছেন।শারমীন সুলতানা নিজে জেলখানায় এসে এই নতুন ঠিকানা দিয়ে গেছেন রেবেকাকে। তবুও মাঝে দু’খান চিঠি রেবেকা খাতুন ওই পুরাতন ঠিকানায় পাঠিয়েছে,যা নিরুত্তরই থেকে গেছে।
না, কাঞ্চনপুর কলেজে আমি ছাড়া কোনো শারমীন নেই। রেবেকা খাতুন এক অদ্ভুত চক্রে গেছে পড়ে আমি বুঝে যাই ।
আধাঘন্টার এই সাক্ষাৎ শেষে যখন আমি জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসছি তখন পেছন থেকে রেবেকার স্বগোক্তি,
‘ মুন্নির খবর না পাইলে আমি সত্যখান কইয়্যা দিমু সবাই রে!’
আমি হাঁটার গতি একটু কমে আসে কিন্তু আমি থামি না। আমি জানি রেবেকা খাতুনের এই সত্যটা জানতে আমাকে তার আস্হা অর্জন করতে হবে। আর এই আস্হার নাম ‘মুন্নি’।
আমি আর দেরী করি না। আগামীকাল সকালেই মির্জাপুর যাবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম মনে মনে।
প্রস্তুতি বলতে ওই তো কলেজে জানিয়ে দেওয়া অনুপস্হিতির কথা। আর সেটা জানাতেই যখন সকালে তাড়াহুড়ো করে কলেজের রাস্তা ধরলাম, তখনই হুমায়ূন চাচার সাথে দেখা।
‘ আইজ এত্ত সকালে কলেজের দিকে রওনা করছেন, কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকী?’
আমি ঘাড় নাড়িয়ে ‘না’ বলেই সামনে পা বাড়াই,
‘ আজ একটা কাজে মির্জাপুর যাবো।’
কথাটা বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম। তবে এ কথা শুনে হুমায়ূন চাচা কোনো প্রতিক্রিয়া চেহারাতে ভাসিয়েছিলেন কীনা তা আমার খেয়াল করা হলো না।
আমি তখন ভাবছি ১৫/২৬, নোওয়া পাড়ায় কত তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায়।
এরমধ্যেই মনের ভেতর ছক কষে নিয়েছি কীভাবে রেবেকা খাতুনের কথা গোপন রেখে মুন্নির খবর পাওয়া যায়। ভুল ঠিকানা দিয়ে কাউকে প্রতারণা করা মানুষগুলো যে রেবেকা খাতুনের কাছ থেকে লুকাতে চাইছে, তা আমি গতকালই নিশ্চিত হয়ে গেছি।
পৌঁছে গেলাম মির্জাপুর। বাসস্ট্যান্ড থেকে খুব একটা সময় লাগলো না কাঙ্খিত ঠিকানায় পৌঁছাতে। দোতলা বাড়িটির সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। পাশেই একটি বাচ্চাদের স্কুল। মায়েদের হাত ধরে কোনো কোনো বাচ্চা স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে।
বাচ্চাদের কোলাহলে জায়গাটা সরগরম।
আমি স্কুল থেকে মনোযোগ সরিয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে যাবো তখনই নীল-সাদা স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে বছর তিনেকের একটি বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে আসলো বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারার এক মহিলার হাত ধরে।
কে এই বাচ্চাটা? শারমীন সুলতানা কী আবার এই ঠিকানায় ফিরে এসেছেন?
প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে আমি কথা জুড়ি,
‘ শারমীন সুলতানার বাসা এটা?’
উত্তরের বদলে ছুটে এলো প্রশ্ন,
‘আপনার পরিচয়?’
কী পরিচয় দেবো তা আগেই ভেবে রেখেছিলাম।
‘ মির্জাপুর কলেজে নতুন বদলী হয়ে এসেছি। শারমীন সুলতানার কাছে এক কলিগ পাঠিয়েছেন আমাকে।’
এবার মহিলাটি সামনের স্কুলখানার দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললেন,
‘ স্কুল শুরু হয়ে যাবে।’
আমি মহিলার তাড়া বুঝে বললাম,
‘ শারমীন সুলতানা বাড়িতে আছেন?’
‘না, নেই। এই বাড়িতে শারমীন সুলতানা নামের কেউ নেই।’
মহিলার নির্লিপ্ত উত্তর।
‘ শারমীন সুলতানার বাসার ঠিকানা কলেজে এটাই দেওয়া আছে। হয়তো উনি ঠিকানা বদলেছেন। কোথায় থাকেন এখন শারমীন সুলতানা?’
প্রশ্নটা আমি যেন হাওয়াকে করলাম।
‘ কে কোথায় থাকে, তার খবর আমি কীভাবে জানবো?’
মহিলাটি গজগজ করতে করতে বাচ্চা মেয়েটির হাত টেনে নিয়ে চলে গেলেন স্কুলের দিকে।
শারমীন সুলতানা নামের অচেনা মানুষটির প্রতি খুব বিরক্তি এলো আমার। অন্যের সন্তানকে নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন উনি?
এই ঠিকানা আর মির্জাপুর কলেজ ছাড়া আমার কাছে অন্যকোনো সূত্র নেই শারমীন সুলতানার। তাই এই ঠিকানায় সময় নষ্ট না করে মির্জাপুর কলেজে চলে যাওয়াটাই এখন সমীচীন মনে হলো।
কিন্তু সেখান থেকেও আশাপ্রদ কিছু পাওয়া গেলো না।
বছর দেড়েক আগে শারমীন সুলতানা চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন।তিনি এখন কোথায় থাকেন, তা কেউ জানেন না।
দমে গেলাম আমি। কত সহজে মানুষ হারিয়ে যায়!
প্রায় দিন বিশেক পর হেরে যাওয়া চেহারা নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম রেবেকা খাতুনের সামনে।
‘ সেই ঠিকানাতে গিয়েও মুন্নির কোনো খবর আনতে পারলাম না…..’
আমার কথা শেষ করতে দিলো না রেবেকা খাতুন।সজ্ঞা হারালো।
গত ছ’মাসে চারবার এরকম হলো। আগেও এমন হতো, তবে এখন খুব খুব ঘনঘন সজ্ঞা হারান রেবেকা খাতুন।
আজই জানতে পারলাম হার্টের জটিল অসুখে ভুগছে রেবেকা খাতুন। আর এই জানাটা আমাকে কয়েক পা এগিয়ে দিলো রেবেকা খাতুনের দিকে।
নি:স্ব, অসুস্হ মেয়েটি আস্তে আস্তে আমার খুব আপন হয়ে উঠলো।
আর তা হবার একমাত্র কারণ হলো ‘প্রতারণা’।হ্যাঁ, সেই শব্দটি অদ্ভুতভাবে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেবেকা খাতুনের পাশে। আমরা দু’জন হয়ে গেলাম সমকক্ষ।
‘ কিছু না জেনেই মানুষকে এত বিশ্বাস করা যায়?’
রেবেকা খাতুনের চোখের পাতাগুলো তিরতির করে কেঁপে ওঠে,
‘ জানছিলাম তো, আমারে ভালোবাসে খুব বারবার জানাইছিলো।’
বোকা মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়,
‘ শুধু সেটুকু জেনেই অজানা গ্রামের এক ফেরিওয়ালাকে বিয়ে করা যায়?’
‘ হ্যাঁ যায়, সৎ মায়ের অত্যাচার থেইক্যা মুক্তি পাওয়ার জইন্য কয়েকজন মানুষের সামনে কবুল কওয়া যায়। আর মানুষখানরে তো আমি আপনই ভাবছিলাম।’
‘ আর সে?’
নিজের কন্ঠ কেমন কঠিন শোনায় আমার কাছে।
‘ শুরুতে তো সেও খুব মায়া করতো। সপ্তাহে দুই বার কইরা আমারে দেখতে আইতো চুড়ি-ফিতা লইয়্যা।’
এরপর……
অভিজ্ঞ আমি যেন গল্পের শেষটুকু মেলানোর অপেক্ষায়।
‘ এরপর আর কি? মুন্নি প্যাটে আসার খবর শুইনাই পলাইয়্যা গ্যালো?’
আমি সবজান্তার মতো মাথা নাড়ি,
‘ তোমার মতো বোকা মেয়েদের এমনই হয়।’
আমি আসলে নিজেকেই কটাক্ষ করলাম যেনো।
এরপর যেদিন রেবেকা খাতুন তাঁর স্বামীকে খুঁজে পেলো, সেদিন নিজের নতুন একটি পরিচয়ও খুঁজে পেলো,
‘ গ্রামে বউ রাইখ্যা সেই ব্যাডা আমারে মিথ্যা মিথ্যা নিকাহ্ করছিলো। আর তার লাইগ্যা আমার সন্তান অবৈধ। আমার মুন্নি অবৈধ সন্তান। আর আমি নষ্ট মাইয়্যা।’
নষ্ট রেবেকা খাতুনকে তার আপনজন ত্যাজ্য করলেও আপন করে নেয় শারমীন সুলতানা। তবে দু’মাসের সন্তানসহ রেবেকা খাতুনকে রাস্তা থেকে বাসায় এনে তোলে কিন্তু শারমীন সুলতানার স্বামী ওবায়েদ ইসলাম।
কারণ আর কিছুই নয় সন্তানহীন শারমীন সুলতানা শিশুটিকে পেলে খুশী হবেন আর রেবেকা খাতুন বাড়ির কাজে সাহায্যও করতে পারবে।
হলোও তাই। শারমীন সুলতানা যতটা না খুশী হলেন রেবেকা খাতুনকে দেখে তারচেয়ে অনেক বেশী আনন্দিত হয়ে উঠলেন মুন্নিকে দেখে। আর মুন্নির প্রতি শারমীন সুলতানার এই অপাত্য স্নেহ আদতে রেবেকা খাতুনের সে বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকার জায়গা করে দিলো।
প্রথম প্রথম শারমীন সুলতানা একটু আধটু বিরক্তি দেখিয়ে ফেললেও মাস দু’তিনের মধ্যেই রেবেকা খাতুনকে আপন আত্মীয়ের মতো জায়গা করে দিয়েছিলো। এতে অবশ্য রেবেকা খাতুনের ভূমিকাও ছোট করে দেখার উপায় নেই। নিজের মাতৃস্নেহকে যে অনেকটাই বিসর্জন দিয়েছিলো সে বাড়িতে। দু’মাসের মুন্নিকে বলতে গেলে শারমীন সুলতানা অদ্ভুতভাবে অধিকার করে নিয়েছিলো।মুন্নির খেলনা থেকে খাবার সব হতে শুরু করল তার ইচ্ছাতেই,
‘ মুন্নির খিচুড়িতে আজ থেকে চিকেন মিশিয়ে দিস, ও ভালো খায়।’
কিংবা
‘ পুরাতন প্লাস্টিকের শক্ত পুতুলগুলো সব সরিয়ে ফেল রেবেকা, মুন্নির জন্য আজ তুলোর পুতুল এনে দেবো।’
রেবেকা খাতুন সেসব দেখে আর মনে মনে আশ্বস্ত হয়, অন্তত তার মৃত্যূর পর মুন্নি এতিম হয়ে যাবে না।
হ্যাঁ, সে সময়ে রেবেকা খাতুন জেনে গেছে তার হৃদযন্ত্র আস্তে আস্তে বিকল হয়ে আসছে।
শারমীন সুলতানার স্বামীর তদারকিতেই প্রথমবারের মতো ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো রেবেকা খাতুন।যদিও এটাতে শারমীন সুলতানা খুব একটা খুশি হয়েছিলো না। আর যখন ওষুধ পথ্য নিয়ে মানুষটি রেবেকা খাতুনকে মানুষটি আলাদা মনোযোগ দিতো তখন তো শারমীন সুলতানা তার বিরক্তিটুকু প্রকাশ করেই ফেলতো,
‘ অসুস্হ মানুষকে হাসপাতালে রাখতে হয়, বাড়িতে নয়।’
শারমীন সুলতানা যেন রেবেকা খাতুনকে বাড়ি থেকে চিকিৎসার নামে বের করে দিতে চাইছেন। শুধু মুন্নির জন্য পারছেন না।’
রেবেকা খাতুনের খুব কষ্ট হতো, শারমীন সুলতানা কেন এমন করেন?
প্রশ্নটির উত্তর পেতে খুব একটা সময় লাগলো না।
ওষুধ বুঝিয়ে দেবার নাম করে যেদিন শারমীন সুলতানার স্বামী মধ্যরাতে রেবেকা খাতুনের দরজায় টোকা দিলো, সেদিনই প্রশ্নটির উত্তর নির্লজ্জের মতো সামনে হাজির হলো।
‘ তোমাকে আমি কেনো যে বারবার ক্ষমা করে দেই?’
শারমীন সুলতানার এই প্রশ্নে তাঁর স্বামী উত্তরহীন ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়েছিলে। তবে মুখখানায় অনুশোচনা ছিলো নাকী ধরা পড়ে যাবার বিরক্তি, তা কিন্তু রেবেকা খাতুন উদ্ধার করতে পারেনি।
তবে লজ্জাজনক সেই পরিস্হিতি থেকে রেবেকা খাতুনকে কিন্তু উদ্ধার করেছিলো শারমীন সুলতানাই,
‘ তুই ভয় পাস না, এরপর আর কোনোদিন তোর ঘরে এই মানুষটা আসবে না।’
ঘরে না আসলে কী হবে, এক বাড়িতে তো নোংরা মানুষটি থাকবে। রেবেকা খাতুন সিদ্ধান্ত নেয় মুন্নিকে নিয়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।
‘ তুই কেনো যাবি? আর মুন্নিকে নিয়ে কোথায়বা যাবি? এই বাড়ির থেকে নিরাপদ ঠিকানা মুন্নির জন্য পাবি না।’
হ্যাঁ, মুন্নির জন্য একটা নিরাপদ ঠিকানার লোভই রেবেকা খাতুনকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
কিন্তু যে মুন্নির নিরাপত্তার জন্য রেবেকা খাতুন এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো সেই মুন্নিকেই কী হারিয়ে ফেললো?
‘ আচ্ছা, শারমীন সুলতানাকে তুমি কীভাবে বিশ্বাস করলে? যে মানুষটি এতবড় অন্যায় করতে পারে তাকে বিশ্বাস করা যায়?’
‘ ন্যায় অন্যায় বুঝি না, ব্যাডা খুব খারাপ মানুষ আছিলো, এর আগেও আপা গুইন্যা গুইন্যা চারবার হ্যারে মাফ কইর্যা দিছিলো। এইবার আর মাফ পায় নাই।’
আমার প্রশ্নের উত্তরে যতই রেবেকা খাতুন পক্ষ নিক শারমীন সুলতানার কিন্তু আমি আশ্বস্ত হই না। আর এখন যখন মুন্নিকে নিয়ে মানুষটি উধাও হয়ে গেছে তখন তো আরও অবিশ্বাস বাড়ছে।
‘ ওরকম একটি মানুষকে নিজের সন্তানের দায়িত্ব দিয়ে দিলে…..’
কথা শেষ হয় না আমার। রেবেকা খাতুন যেন নিজেকে আশ্বস্ত করতেই বলে ওঠে,
‘ না, না, মুন্নি তার কইলজ্যার টুকরা, মুন্নিরে আপা নিজের সন্তানই মানে। কিন্তু আমার কাছ থেইক্যা মুন্নিরে এমন কইর্যা লুকাইয়া ক্যান ফেললো?’
এই প্রশ্নটাই যেন রেবেকা খাতুনকে বারবার ক্ষেপিয়ে তোলে,
‘ আমি সত্যিখান কোর্টে কইয়্যা দিমু।’
না, সত্যি বলার সাহস বা সুযোগ কোনোটাই হয় না রেবেকা খাতুনের। জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যাটাকে সঙ্গী করেই রেবেকা খাতুনকে পৃথিবী ছাড়তে হয়। ত্রুটিযুক্ত হৃদযন্ত্র রেবেকা খাতুনকে নিয়ম অনুযায়ী হুট করে একদিন থামিয়ে দেয়।
স্বজনহীন বেওয়ারিশ লাশটা আন্জুমান মফিদুল ইসলামের লোকজন যখন কবর দিচ্ছিলো তখন মনে মনে আমি খুশীই হই, মেয়েটা বিনাদোষে কেন শাস্তি ভোগ করবে? কেন শারমীন সুলতানার অপরাধে রেবেকা খাতুন ফাঁসিতে ঝুলবে?
এরপর আমার জীবনও নিয়মে ফিরলো। মাসে মাসে মানিকগঞ্জ কারাগারে যাওয়া বন্ধ হলো। কলেজ আর নিরিবিলি মফস্বলী জীবনে আবার ধাতস্থ হলাম আমি।
নিয়ম করে সময়ও এগোতে লাগলো। মসজিদের মাঠে নিয়ম করে আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝড়লো, অগ্রহায়ণের কুয়াশা জমলো, বৈশাখের নাছোরবান্দা রোদ বসলো। আর এরসাথে জমতে থাকলো আমার অগণিত পদচিহ্ন।
হ্যাঁ, কলেজ থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে কলেজে সীমাবদ্ধ আমার জীবনে পথ বলতে তো ওটুকুই।
সেই পথেই আমি ম্যাড়ম্যাড়ে সুতির শাড়ি পড়ে নির্ভার সামনে এগোই।
আজও তেমনই এগোচ্ছিলাম আমি কলেজের দিকে। মসজিদের মাঠে সবসময়ই দু’চারটে বাচ্চাকে খেলতে দেখা যায়। আমি সবসময়ের মতো ওদেরকে পাশ কাটিয়ে সামনে পা বাড়াতেই চোখ পড়ে যায় হুমায়ূন চাচার দিকে। অভ্যাস মতো সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। হুমায়ূন চাচার সাথে সুশ্রী একজন মহিলা। আমাকে দেখে খুব একটা খুশী হলেন না তিনি। না হবারই কথা। আমার বাড়ির শ্যাওলা পড়া পানির ট্যাংকিতে কিছু একটা পঁচেছে। দূর্গন্ধযুক্ত পানি দিয়ে আমি কোনো কাজ করতে পারছি না। আজ প্রায় তিনদিন হুমায়ূন চাচা ট্যাংকি পরিস্কার করার লোক নেই বলে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
এই অপ্রিয় প্রসঙ্গটি এড়াতেই হুমায়ূন চাচা পাশের মহিলার দিকে ইশারা করেন,
‘ আমার বোনের মেয়ে। কয়েকমাস পর দেশে ফিরলো।’
আমি ভদ্রতাবশত হাসি বিনিময় করলাম। হাতে সময় নেই। জরুরী কথা সেরে নেওয়া দরকার আমার। কিন্তু সুযোগ হয় না আমার।
‘ আপনি ওই হলুদ বাড়িটাতে থাকেন?’
সুশ্রী মহিলাটির চোখেমুখে অদ্ভুত কৌতুহল। কিন্তু হুমায়ূন চাচার চেহারাতে বিরক্তি আরোও জেঁকে বসে। এসব অভিব্যক্তি এড়িয়ে আমি মহিলার প্রশ্নের উত্তর দিতেই যাবো, তার আগেই উড়ে এলো একটি আদুরে ডাক,
‘ মা……..’
কোকরানো চুল আর বাদামী চোখের পুতুলের মতো একটি বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো মহিলাটিকে।
‘ এত দৌড়াদৌড়ি কেন করছো? সার্জারী পর ডাক্তার কী বলেছে ভুলে গেছো?’
মায়ের আহ্লাদি শাসনে বাচ্চা মেয়েটি হাত তুলে জানিয়ে দেয় এবার তাকে কোলে নিতে হবে। আদর আহ্লাদের সকল শব্দ থেকে ‘ সার্জারি’ শব্দটিই কেন যেন আমাকে কৌতুহলী করে তুললো,
‘ সার্জারি?’
প্রশ্নটি মহিলাটির জন্য থাকলেও হুমায়ূন চাচা উত্তর দিলেন সপ্রতিভ হয়ে,
‘ হার্টের অসুখ ছিল জন্ম থেকে, জানা গেছে অনেক পরে। বাচ্চার চিকিৎসার জন্যই তো আমার ভাগ্নি তাড়াহুড়া করে বিদেশ গেলো তখন।’
কথাগুলোয় কি পেলো পুতুলের মতো মেয়েটি কে জানে? ‘মা’ বলে গলা জড়িয়ে ধরলো মায়ের। আর তার মা তাকেও আরেকটু আঁকড়ে ধরলো।
নির্মল এই সময়ে আমি যতই আটকে যায় সময় তো আর থেমে নেই। কলেজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বলে আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তালবাগানের লাল সুরকির পথ ধরি। বরাবরের প্রিয় এই রাস্তাটা আমাকে অদ্ভুতভাবে সামনে এগোনোর শক্তি দেয়। আমি শান্তভাবে এগিয়েই চলছিলাম। কিন্তু পেছোন থেকে আসা একটি শব্দ আমাকে থামিয়ে দেয়,
‘ মুন্নি……’
আমি চট করে পেছোন ফিরি।
মাঠের ভেতর দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুতুলের মতো মেয়েটি, আর তাকে থামাতে ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে মা।
প্রজাপতির মতো উড়ছে মসজিদের মাঠজুড়ে বাদামী চোখের মেয়েটি।
আমার ভালো লাগে মা-মেয়ের এই খুনসুটি। আর ঠিক তখনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি রেবেকা খাতুনের জমিয়ে রাখা চিঠিগুলো আজই ফেলে দেবো।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পের বিষয়বস্তু চমৎকার! কিন্তু গ্রামে থাকতে শুরু করার আগের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং পৃথক হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বাহুল্য বলে মনে হলো। গল্পের মূল বক্তব্যের সাথে এটির সংযোগ বোধগম্য হলো না। তবে সব মিলিয়ে বেশ ভাল লেগেছে। শুভ কামনা রইল।
উত্তরমুছুন