শতাব্দী দাশের গল্প : ভোজ


১.

বেগনি নোট হাতে বেরিয়ে আসে জগন্নাথ। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝে ধরা নোটের একখানি কানা। বেগনি বিজয়কেতন পতপত উড়ছে হাওয়ায়। বেরিয়েই ধাঁ করে আলোর মুখোমুখি হয় সে। যে আলোর কালো তেরপলের ঘরে ঢোকার অধিকার নেই, সে আলো এখানে বেপরোয়া। জড়োসড়ো জগন্নাথকে নিজের সীমানায় পেয়ে আলো মস্করা করে। 'দ্যাখ্ শালা, কেমন লাগে!' খালের ধার ঘেঁষে সন্তর্পণে হাঁটে জগন্নাথ, অনধিকারীর মতো।

সিধে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলে বাজার। আলো জগন্নাথের পিছু পিছু যায়, রাইশাক আর টমেটোর গালে চুমো দেয়৷ নধর পটল, বেগুনের শরীরে ঝরে পড়ে। জগন্নাথ সবজি বাজার ছেড়ে মেছো গলিতে ঢোকে। এখানেও আলো ঢোকে; নাড়িভুড়ি চাটা কুত্তার ঘায়ে আদর দেয়। খসখস আঁশ ছাড়ানোর শব্দ আসে৷ আলো গা বাঁচিয়ে চলে। মেছো গলি ফেলে তস্য গলিতে মাংসের দোকানের সার— পরপর তিনখান। আলো সিঁটিয়ে যায়, তবু পিছু ছাড়ে না।

অন্ধ গলির ভিতরে ঘোলা বাল্ব। জগন্নাথকে ছেড়ে আলো খানিক ক্ষণ তার চারপাশে মাছির মতো ভনভনায়। পল্টু আর হারুর চিকেন স্টোরের মাঝে গদাইয়ের পাঁঠারা ঝুলছে৷ পাঁঠাদের চিকন গায়ে আলো সন্তর্পণে গোলাপি ছড়ায়। ও দোকান মাড়ায়নি জগন্নাথ, বহু বছর হল। মুরগিই ঢের। ছাড়ানো পাঁঠাদের চোখ এড়িয়ে, জিভের সুড়সুড়ি চেপে, জগন্নাথ প্রথম চিকেন স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।

আজ ভোজ হবে। যবে থেকে তেরপলে এল ওরা, তবে থেকে এই প্রথম। জগন্নাথের খুব নোলা। ছোটভাইও কম যায় না। বাপেদের ধারা পেয়েছে দু'ভাইয়ের ছেলেমেয়েগুলোও। এমনকী মেয়েগুলো ভায়েদের সঙ্গে মারপিট লাগাত মেটে বা নলির জন্য। তাদের মায়েরা বলত, মেয়েমানুষের নোলা ভাল নয়। সেসব বহুকালের কথা। আজকাল ইচ্ছা করে না। মন কালো হয়ে থাকে, তেরপলের মতো।

এক ভারিক্কি মহিলা দেড় না দুই কিলো নেবে, তা নিয়ে হেব্বি দোটানায়। দেড়ে মনস্থির হল। পল্টু খাঁচা খুলে ভীত ঘাড় ধরে৷ এইবার টানটান যাত্রাপালা শুরু হবে। অ্যাকসান আর ইমোসানে ভরপুর। জগন্নাথ মহিলার এক পাশে খোঁচা খাওয়া কেন্নোর মতো গুটিয়ে থাকে। পল্টু তাকে আড়চোখে দেখেও দ্যাখে না। একই ব্রিজতলা থেকে একই খালপাড় — পল্টুরা জগন্নাথদের চিরকেলে প্রতিবেশী। দাঁড় করিয়ে রাখাই যায় অতএব৷ তাছাড়া বেগনি নোট পল্টুর নজর এড়ায়নি। শয় টাকায় যতটুকু হয়, ততটুকু কেনার মুরোদ। আসলি খদ্দেরকে দিয়ে থুয়ে যা বাকি থাকে, তাতেই খুশ হয়ে যাবে।

'রোঁয়া-ওঠা যে! ফ্লুয়ের মুরগী নাকি?' মহিলা নাকচ করে। অন্য একটা দেখায়।

'ফাগল! রোঁয়া ওঠা কোথায় দেখলেন? জল দিলে সব পাখির পালক ভিজে চুপ্পুস হয়ে যায় গো দিদি!'

'জল মেরে ওজন বাড়িয়েছ?'

'গরমে জল মারতে হবে না? পাখি হাঁকপাঁক করে। গাদাগাদি বড়! তা আপনে অন্যটাই ন্যান।'

গাদাগাদি জগন্নাথের ঘরেও কম ছিল না। তবু ঘর ছিল। এক কোণে তক্তপোষে মা শুত নাতি-নাতনি নিয়ে। সব মিলে চার পিস। তক্তপোষের তলায় ডাঁই ছিল সংসার। ট্রাঙ্কে জামাকাপড়৷ হাঁড়ির ভিতর ছোট হাঁড়ি, তার ভিতর জামবাটি, তারও ভিতর ছোট বাটি। কড়ার ভিতর কড়া, তার উপর হাতা খুন্তিদের ঠ্যাং জেগে থাকত। আর কী কী ছিল, অত জগন্নাথও জানে না৷ মেয়েমানুষের খুঁটিনাটি কারবার যত। তার মধ্যে কী করে যেন লুকোচুরির জায়গা খুঁজে নিত বাচ্চারা।

তক্তপোষ বাদ দিয়ে যেটুকু মেঝে বাকি থাকে, সেটা ছিল ইংরাজি এল অক্ষরের মতো। এল-এর লম্বালম্বি দিকে জগন্নাথের বউ বিছানা পেতে নিত মেঝেতে, আর আড়াআড়ি দিকটায় বিছানা পাতত ভাইবউ। এভাবেই ঘুম আর রতি৷ ওদিকে শীৎকার শুনে এদিকে শরীর জেগে ওঠা। এভাবেই দু দুবার করে পোয়াতি হল বউরা। তবু ঘর ছিল। আলো ছিল।

২.

এখন তেরপল পাওয়া গেছে। দুই ভাই লাইনে দাঁড়িয়ে দুইখান পেয়েছিল। কালো রঙা। ওটুকু ফাঁকি ধরতে পারেনি সতর্ক চোখ। নইলে পরিবার পিছু একটাই পাওয়ার কথা। কালো তেরপল আলো শুষে নেয়। আলো তাই তেরপল ঘরের ধার ঘেঁষে না। গোঁসা করে ছেলেমেয়েগুলো। সকাল ছাড়া পড়া হয় না মোটে। মায়েরা প্রবোধ দেয়, সন্ধে ছয়টা থেকে দশটা কারেন্ট পাওয়া যাবে। এমনই হলদেটে বাল্ব, যেমনটা এখন কষাই গলিতে। তার চারপাশটুকুতে শুধু আলো ভনভনাবে। তবু চার ঘণ্টা ইলেক্ট্রিক বাতি। তার মধ্যে পড়া করে নিতে হবে কোনো মতে। না হলে ইস্কুল কামাই।

তারপর অন্ধকারে গুটি কয় মানুষ। জাগে। ঘুমায়। পাব্লিক ইউরিনালে যায়। দুই বউ রান্না চাপায় বাইরের উনোনে। খাওয়া দাওয়া। আবার ঘুমায়। আজকাল রতি ইচ্ছা করে না। আজকাল ভোজেও মন নাই। ঘুমানোর আগে মায়েরা শিশুদের ভোলায়, কটা দিন বৈ নয়! পাকা বাড়ি দেবে সরকার। ইঁট-বালি-সুরকি…

ঘ্রাণের স্মৃতি ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে, বাচ্চারা ঘুমায়ে পড়ে। বড়রা দম চেপে ভাবে, রাত পার করে দিতে পারলেই সকাল। সকালে তেরপলের পর্দা সরালে খালের বুকে আলো। আলো ফুটলে ছেলেমেয়ে ইস্কুলে যায়। ব্যাটাছেলেরা কাজে। বিকেল হলে আলো মরে আসে ক্লাসরুমে বা বিল্ডিং তৈরির সাইটে। ফেরবার সময় নিভন্ত আলো আঁজলা ভরে মা-বউদের জন্য তেরপলে নিয়ে যাওয়া যায়? ভাবে তারা। কিন্তু তেরপলের দোড়গোড়ায় এলেই আলো পাঁকাল মাছের মতো পিছলে যায়।

৩.

ব্রিজতলার বস্তিতে বাচ্চারা ইস্কুলে যেত রোজ। চাঁছড়ার ঘর ছিল আড়াইশ মতো। পাকা খান পঞ্চাশ। চাঁছড়া দিয়েও আলো ঢোকে। যে আলো এখন আলগোছে এলিয়েছে মুরগী-কাটা বঁটিতে। খান দশ বাড়ি পিছু ছিল একটা বাথরুম কলতলা। ব্যবস্থা মন্দ নয়। বাপ নদী পার করে এসেছিল। ঠ্যালাওয়ালা। ঠ্যালা ঠেলত রাজপথে হুঙ্কার দিতে দিতে। পথচারী পথ ছেড়ে দিত। বাপ কেন্নো-সম সিঁটিয়ে রইত না, জগন্নাথের মতো।

বাপের দেশ কখনও দেখেনি জগন্নাথ। সেখানে নাকি অনেক আলো খ্যালে। সেখানে নদীরা নাকি হাত ধরাধরি করে। এক নদী অন্য নদীতে চালান করে দেয় মানুষ ও যান। অথচ যেদিন বুলডোজার এল, সেদিন হাত ধরেনি কেউ কারও।

বুলডোজারকে মা দোখ্নো ভাষায় ডাকে — হ্যাঁকাতে গাড়ি। 'হ্যাঁকাতে' মানে নাকি বেপরোয়া, মাথাগরম। বাপের সঙ্গে শহরে এসে, মা-ও কাজে লেগেছিল চার বাড়ি। বিন্দাস চলছিল। জগন্নাথ আর ভাই বড় হয়ে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে হল। ব্রিজতলাতে গাঁথল ইঁট। সিমেন্টের প্রলেপ নাই, তবু পাকা বাড়ি৷ টিনের ছাদ। চাঁছড়া বাড়িরা চোখ টাটালো। নজর লাগল কি?

হতশ্রী জীবন টানতে টানতে, হঠাৎ সিলিং থেকে ঝুলে পড়ে কেউ কেউ। ওটাই প্রতিবাদ। তেমনই একদিন, শহরের আরেক পারে, আরেক ব্রিজ বোঝা টানতে অস্বীকার করে, ধ্বসে পড়ল স্রেফ। সেই বার ভয় পেল ওরা। গিরিধারী গোবর্দ্ধন পাহাড় ধরেছিল বৃন্দাবনবাসীর মাথায়। ব্রিজখানা বস্তির মাথায় কে ধরে আছে, কে জানে! তিন প্রজন্মের দীনতার মাথায় ছাতা ধরেছিল যে বৃদ্ধ সেতু, তার কি বয়স গড়াল?

গোবর্দ্ধন পাহাড়ের গল্পখানা মা বলেছিল। তার তলে আশ্রয় পেয়েছিল বৃষ্টি-তাড়িত লোকজন৷ ব্রিজকে গোবর্ধন আর কৃষ্ণ, দুই-ই মনে হত। অথচ দ্যাখো, কৃষ্ণ তো আসলে তেরপল — কৃষ্ণকালো। মা বলে, কৃষ্ণর লীলা বোঝা ভার। কখন যে কী অবতারে!

মা এত গল্প পেত কোত্থেকে? কীর্তনের আসর থেকে? ব্রিজের উপর দিয়ে হুশহাশ গাড়ি যেত দিনমান, রাতভর। নিচের কানগুলোয় তাহাই সুরেলা ভোরাই। বস্তিতে কীর্তন বসত যখন, 'রাই জাগো রাই জাগো' দিয়ে শেষ হত। জগন্নাথের হাই উঠত। মায়ের চোখে জল। ফাস্ সকালের গাড়িগুলোও তখনই বেরোত হুশ করে, ব্রিজের উপর দিয়ে। জগন্নাথ তাদের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত ঠিক। ততক্ষণে জলের লাইন পড়েছে সর্পিল। গামলা, জ্যারিকেন, প্লাস্টিক বালতির নানা রঙে আলো খেলে যেত। বাথরুমেরও লাইন ছিল। তবু পাবলিক ইউরিনালের চেয়ে তার ঝাঁঝ কম।

খালপাড়ে সরকারি মোতাখানা ভরসা। তা বন্ধ হয়ে যায় এগারোটায়। তারপর আলোর চোখ এড়িয়ে রাস্তার কোনো অন্ধকার ধার খুঁজে নেয় ছেলেরা । মেয়েগুলো প্রেতিনীর মতো সার বেঁধে আড়াই কিলোমিটার হেঁটে ব্রিজের তলায় ফেরে প্রতি রাতে। বাড়ি ভাঙা পড়লেও বাথরুম আস্ত রেখে গেছে। হুজুরের দয়ার শরীর। তেরপল দিয়ে খালপাড়ে পাঠানো গেলেও, রাতারাতি অত বাথরুম তৈরি করে দেওয়া সহজ নয়। তাই হিসি করে যাওয়ার অধিকার বরকরার থাকে। প্রেতিনীরা পরিত্যক্ত মোতাখানায় হিযি করার ফাঁকে লুকিয়ে ফেলে যাওয়া মাটির ঘ্রাণ নেয়।

ভেঙে পড়ার ভয় যখন ধীরে ধীরে কেটে গিয়েছিল, তখনই ভাঙার তোড়জোড় শুরু হল। ঢ্যাঁড়া পেটানো হল, ব্রিজ সারাই হবে, তাই ছেড়ে দিতে হবে ঘর। ব্রিজ ভেঙে পড়লে হাজার মানুষ চাপা পড়বে। দায় কে নেবে? মানবহিতার্থে তাই বুলডোজার আসে। বাথরুম রেখে বাকি সব গুঁড়িয়ে দেয়, বুলডোজার এমনই নিখুঁত দরদী৷

অথচ সয়ে গেল। সয়ে যায়। ও বাড়িতে গ্যাস ছিল। থাকলই বা! এখানে বউরা উনুন তুলে নিল পথের মাটি কেটে। খালপাড়ে আগে থেকে ছিল যারা, তারা শিখিয়ে পড়িয়ে নিল। ওদের মাথায় চুল ঝাঁকড়া ও বাদামী। চোখে খরা। আশা মরে গেলে চোখ শুকিয়ে যায়। এখন চার ভাইবোন খাটিয়ায় হুটোপুটি যায়। ওদের চুলও রুক্ষ হয়ে ওঠে ধীরে। ওদের চোখেও কি একদিন খরা দেখা দেবে?

৪.

অন্য একটা ভীত ঘাড়ে হাত পড়েছে এবার পল্টুর। রোঁয়া ওঠা মুরগিটা বেঁচে যায়। এক কোণে সরে যায়, আপাতত। বাকিরাও ছিটকে যায়৷ ঠুকরে দেয় না কেউ পল্টুর হাতে। ফালা ফালা করে দেয় না আঙুল বা কবজি৷ বিকট আর্তনাদে সরে যায় শুধু৷ আর ডানা ঝাপটায়।

ডানা ঝাপটাচ্ছে পল্টুর হাতে যার টুঁটি ধরা এখন, সেই পাখিটাও। পা, ডানা সবই ঝাপটাচ্ছে। শালির ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে, চোখ উলটে গেছে। পরিত্রাহি চিৎকার তবুও থামে না৷ পল্টুর হাতখানা জগন্নাথ মন দিয়ে দেখে। চার আঙুল আর বুড়ো-আঙুলের মধ্যের ফাঁক বুলডোজারের হাঁয়ের মতো বড় ছোট হয়। শিকারের টুঁটি পেঁচিয়ে ধরে৷ পল্টুর মুখে বুলডোজারের নির্লিপ্তি।

এইবার পল্টু এক পায়ের চেটোর তলায় চেপে ধরল বুক। এক হাতে তখনও টুঁটি ধরা। আরেক হাত তার পা দুটো মুচড়ে ধরল। এবার ঝাপট মারছে শুধু ডানা৷ ফৎ ফৎ, প্রাণপণ। দক্ষ হাত মুচড়ে রাখে পায়েদের ততক্ষণ, যতক্ষণ না পা দুটো পুরোপুরি শক্তি হারায়। তারপর ডানাদেরও উলটে পেঁচিয়ে ধরে৷ দক্ষ কেরামতি। একই হাতে দুই ডানা, দুই পা একসাথে ধরেছে এবার। মুচড়ে ধরে আছে, যেন ছিবড়ে করে দিচ্ছে, টেনে নিচ্ছে হিম্মত। সকল গমনাঙ্গ নিস্তেজ হয়ে এলে, অন্য হাত গলাটিকে নিয়ে যায় বৃহৎ বঁটির দিকে৷ যে বঁটির ফলায় লেপ্টে আছে আলো। পাখির চোখে ভয় দেখে জগ্ননাথ। আলো আর জগন্নাথ একসঙ্গে চোখ বন্ধ করে। তারপর কুচ্ শব্দ হয়।

জগ্ননাথের বন্ধ চোখে তেরপল ঘরের অন্ধকার ঘনায়। মুহূর্তেই। এমনই অন্ধকার ছেয়েছিল, রুলের প্রথম বাড়িখানা খেয়ে। মাথায় পড়েছিল সেটা। ভাইয়ের বুকের উপর বুট তুলেছিল তখন আরেক পুলিস।

ভাই বলেছিল, 'জবরদখল যদি, বস্তিতে কারেন্ট কেন দিলে? কেন বিল দাও সে কারেন্টের? এ ঠিকানায় ভোটার কার্ড আধার কার্ড হল কেমন করে? জন্ম এখানে। এটাই বাড়িঘর৷'

বোলচাল না দিলে, চুপচাপ উঠে গেলে, লাথি খেত না৷ ওকে বাঁচাতে গিয়ে রুলের বাড়ি খেত না জগন্নাথও৷ দ্বিতীয় বাড়িটা মাথায় পড়ার আগে ধরে ফেলেছিল ডান হাতে। সেও বড় ভুল হয়েছিল।

অন্য পুলিস ভাইয়ের বুক থেকে উঠিয়ে নিয়েছিল বুট। এগিয়েছিল জগন্নাথের দিকে৷ ডান হাত মুচড়ে পিছনে ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাকে এক হ্যাঁচকায়। তারপর বাম হাতও। অন্যজন লাঠি ফেলে দিয়েছিল৷ বদলে প্রবল ঘুষি নেমে এসেছিল।

জগন্নাথ উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, অথচ ওরা তক্ষুনি পড়তে দেয়নি। যেহেতু তার দুটো হাত মুচড়ে ধরা ছিল পিছে, সেই হেতু জগন্নাথ তার নিজেরই দুই বাহু থেকে ঝুলেছিল কিছুক্ষণ, যেমন ভাবে পাশের দোকানে ঝুলছে ছাল ছাড়ানো পাঁঠা। তারপর ধুড়ুম।

পড়ে যাওয়ার পর, জগন্নাথের দুই পা উলটো ভাঁজ করে, তার উপর চেপে বসেছিল উর্দি৷ আবার মুড়িয়ে ধরেছিল হাতদুটো। ধনুষ্টংকারে বেঁকে যাওয়া বালকের মতো অসহায় হয়েছিল জগন্নাথের দেহপট। তার চতুষ্পদই তখন উর্দির দখলে। জগন্নাথের এই প্রথম নিজেকে জগন্নাথ মনে হয়েছিল। নুলো শরীরটার কানের কাছে মুখ এনে উর্দি বলেছিল, 'খুব তড়পাচ্ছিস দুই ভাই। কেটে ফেলব, জানিস?'

শালা আলো সেদিনও থম মেরে আটকেছিল বুলডোজারের দাঁতে৷ জবাই চাক্ষুষ করেছিল, নাকি বুজে ফেলেছিল চোখ?

৫.

এক্ষণে ঘোলা আলোর নীচে দাঁড়িয়ে, কষাই গলিতে মুরগি ছিন্ন হয় আর ঘামে ভেজে জগন্নাথ। কুচ্ শব্দে মুণ্ডের থেকে আলাদা হওয়ার পরও, ধড় পা ছোঁড়ে। কি আশ্চর্য, পায়ু হেগে ফেলে তারও পরে! জগন্নাথের হাত দুটো টনটন করে ওঠে। পা দুটো অবশ লাগে। পায়খানা পায় নাকি হিসি, নাকি দুটোই, ঠিক বুঝতে পারে না।

সাড় আসে পল্টুর ডাকে। ভারিক্কি মহিলাকে দেড় কিলো মেপে দেওয়া গেছে। বাকিটুকু পাল্লায় চাপিয়ে হারু বলছে, 'একশ ছ টাকা লাগবে। দিয়ে দিই?'

মাথা নাড়ে জগন্নাথ, 'না না, একশো টাকারই।'

হারু করুণার চোখে দেখে। চপার হাতে নেয়।

কাঠের উপর চপার পড়ছে অতি দ্রুত। ভারিক্কি মহিলার মাঝারি পিস কাটা হয়ে গেল। এইবার জগন্নাথের পালা। জগন্নাথ বলে, 'ছোট, খুব ছোট।'

আজ ভোজ হবে। বহুদিন পর। দুইপিস করে দিতে গেলে সকলের পাতে, ছোট, খুব ছোট করে কাটতে হবে। রাতের বেলার জন্য রইবে ঝোল আর আলু। বউয়েরা তারই মাঝে নিজের ভাগের দু টুকরো থেকে এক টুকরো তুলে রাখবে বাছাদের তরে। তাছাড়া ঝোলে পাশাপাশি থাকতে থাকতে আলুও মাংস হয়ে যায়।

চপার পড়ছে ঝুপঝুপ। চপারে নির্লজ্জ আলো ঠিকরায়। ছোট, খুব ছোট ছোট টুকরো হচ্ছে জগন্নাথ। আজ ভোজ হবে।



লেখক পরিচিতি
শতাব্দী দাশ 
জন্ম ও বসবাস কলকাতায়।
 ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
পেশায় শিক্ষক৷
প্রকাশিত ছোটগল্পের বই: অ-নান্দনিক গল্পসংকলন। প্রকাশক: ঐহিক (কলকাতা)
সাল: ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ