রুমা মোদকের গল্প: গন্ধবাতিক




সুমনের কোনো গন্ধবাতিক নেই। যেখানে সেখানে যে কোনো গন্ধ তার নাকে লাগে না। বিশেষত যে গন্ধ যেখানে লাগার কথা নয়, সে গন্ধ সেখানে তার নাকে লাগেও না। ভালো কিংবা মন্দ সে যে কোনো রকম গন্ধই হোক না কেন। গন্ধ তার প্রাত্যহিকতাকে কোনো ভাবেই প্রভাবিত করে না। গন্ধকে প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার বাতিক সুমনের নাই। এই গন্ধবাতিক ছিল দুলালের। দুনিয়ার তাবত ভালো গন্ধকেই তার লাগতো হাসনাহেনা ফুলের মতো।প্রিয় খাবারের গন্ধকেও, পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাওয়া মেয়েটির গা থেকে রেখে যাওয়া পাউডারের গন্ধও। গন্ধ ভালো লাগলেই বলতো, হাসনাহেনার বাস পাইতাছি সুমন ভাই।
 
পাশের দোতালায় পোলাও রান্না হলে ঘি গরম মশলা ফোড়নের গন্ধই নাকে লাগে তার, মেসে শুঁটকি রান্না হলে শুঁটকির। রোজ রাতে মধুবন রেঁস্তোরার পাশ দিয়ে ফেরার সময় ড্রেনে জমে পচে ওঠা বাসি খাবারের নাড়িভূঁড়ি উল্টে আসা গন্ধ আর বারান্দায় শিককাবাব ভাজার পেটের তীব্র ক্ষুধা জাগিয়ে দেওয়া গন্ধ মিলেমিশে যে খানিক সময়ের জন্য গন্ধময় ঘোর তৈরি করে তার ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শ্রান্ত দেহ ঘিরে, তাও খুব স্বাভাবিকই বোধ হয় সুমনের। মোটেই তা বাতিক গ্রস্ততার পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু আজ ২৫ মাইল সি এন জি চালিত যান আর বর্ষার কাদা প্যাঁচপ্যাঁচে রাস্তায় ১০ মাইল রিক্সায় আদিত্যপুর গ্রামে দুলালের বাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই তার চোখ যায় বাড়ির শেষ মাথায়। যেখানে গোয়াল ঘরটি খড় ভূষির গামলা আর গরুগুলি মৃধাদের হঠাৎ ধনী হওয়ার গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৃধার বাড়িতেই ক্ষেত কামলা খাটে দুলালের বাবা।
 
মূলত সুমন জানে এ গোয়াল ঘরটির জন্মগাথার মধ্যেই দুলালের যাবতীয় বাতিকগ্রস্ততার মূল প্রোথিত। গোবিন্দ বাবুর মেয়ে জবার লাগানো হাসনাহেনার বাগানটিতেই মৃধার গোয়াল ঘর। গোয়াল ঘর থেকে চোখটা ফেরাতে না ফেরাতেই হঠাৎ তার নাকে এসে ধাক্কা দেয় গোবরের তীব্র গন্ধ। মুহূর্ত মাত্র। কিন্তু পরক্ষণেই ঘ্রাণেন্দ্রিয় বার বার টেনে নিশ্চিত হয় সে, না গন্ধটা আর লাগছে না।
 
সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে গোয়াল ঘরটির দুরত্ব কম করে হলেও একশো হাত। এই একশো হাত দূরত্ব আর মাঝখানে দুলালের কফিন ঘিরে জ্বালানো শ'খানেক আগরবাতির গন্ধ ডিঙিয়ে গোবরের গন্ধ তার নাকে লাগার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। সুমন ভাবে, এ তার ভ্রম, নিশ্চিত ভাবে ভ্রম। তবে কি দুলালের বাতিক পেলো তাকে! বেঁচে থাকতে শালা জ্বালিয়েছে আজ মরেও রেহাই দিচ্ছেনা। ‘দূরঅ শালা’ নিজেকেই নিজে গালি দেয় সুমন। যার উৎপাতে একদা তার ‘ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি’ অবস্থা হয়েছিল, তার কফিনবন্দি লাশটা দেখতে এসে আবার কী নতুন উৎপাত! ঘ্রাণেন্দ্রিয় আবার সজোরে টেনে নিশ্চিত হয় সে। না গোবরের গন্ধটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। এ ভ্রমই।

বিশ্বাসে স্থিত হয়ে উঠানভর্তি শ খানেক নারী পুরুষের ভিড়ে জবা নামের মেয়েটিকে সনাক্ত করার চেষ্টা করে সে। দ্যাখতে এক্কেরে নায়িকা মৌসুমীর লাখান, বলতো দুলাল। চিত্রনায়িকা মৌসুমী কিংবা তার মতো কোনো মেয়েই চোখে পড়ে না সুমনের। আশে পাশে মানুষের জটলাবান্ধা বারান্দা কিংবা জানালার শিকে শিকে উঁকি দিয়ে থাকা নারীদের একজন একজন করে দেখার চেষ্টা করে সে। প্রেমিকের মৃত্যুতে তীব্র শোকচিহ্ন বহনকারী অশ্রু ভারাক্রান্ত কোনো চোখই পড়ে না সুমনের কৌতুহলী নজরে। নিজের আচরণে নিজেই বিব্রত বোধ করে ভেতরে ভেতরে, দুলালের মরামুখ দেখতে এসে সে কিনা দুলালের প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

নিজের ভিতরে জেগে ওঠা বিব্রত বোধটা ভিতরেই চাপা দেয় সে, মূলত আজ এই দুলালের মরামুখ দেখতে আসার পিছনে চপলা জবার মুখটা দেখার একটা অনিবার্য তাড়াও যে ছিল তা প্রাণপণে অস্বীকার করতে চায় সুমন। দুনিয়াতে কত জবা আছে। গোদারা ঘাট পাড় হয়ে স্কুলে যাবার পথে এক জবা ঘাটে নেমে তার দোকান থেকে প্রতিদিন বাকিতে চানাচুর নিতো আর চোখের ইশারায় সুমনের রাতের ঘুম হারাম করে দিতো। যদিও তার চেহারা কিছুটা মৌসুমীর মতোই ছিল, তবুও এ জবা নিশ্চয়ই সে জবা নয়। পাশাপাশি গ্রাম হলেই বা কী? পাঁচ গাঁয়ে কী একটাই জবা? না জবাকে আবিষ্কারের জন্য সে আজ এখানে আসে নি। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে জেতার দৃঢ়তায় সে এগোয় দুলালকে এক নজর দেখার প্রচেষ্টায়। জটবাধা চুলের মতো মানুষের জটলা। সব কাটিয়ে কফিন পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন। সুমন বোধ করে দুলালকে দেখার যে সামান্য ইচ্ছেটুকু ছিল তা কেমন যেন মরে গেছে। জলজ্ব্যান্ত ছেলেটাকে সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পারে। একটা নিথর মৃতমুখের পর্দা দিয়ে সেটা ঢেকে দেয়ার কী দরকার, ভাবতে ভাবতে সে ফিরে যাবার উদ্যোগ নেয়।কিন্তু এতোদূর এসে দুলালকে না দেখে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে সে।
 
ঠিক তখন তার নাকে আবার ধাক্কা দেয় গোবরের তীব্র গন্ধ। শুধু তাই নয় এবার একই সাথে একটা উজ্জ্বল নীল আলোর আভা চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় বলে মনে হয় তার। কী বিপদ!! হঠাৎ এমন তীব্র নীল রং দেখলো কেনো সে? নীল রং তো খুব পছন্দ ছিলো দুলালের।কিন্তু সে এখন হঠাৎ নীল রং দেখলো কেন? আশেপাশে আতিপাতি খুঁজে দেখে সে, না কোথাও কোনো নীলের চিহ্ন নেই। কারো ছিন্ন শার্ট, মলিন শাড়ি কিংবা নোংরা লুঙ্গিতে কোথাও নীলের চিহ্নমাত্র নেই। এমনকি মাথার উপরে আকাশের রংটাও আজ নীল নয়। মেঘে সাদা। 'দুরঅ-শালা মইরাও শান্তি দিত না দেখি' বিড়বিড় করতে করতে যে উদ্দেশ্যে সাতসকালে এতো দূর আসা সে উদ্দেশ্যকে অসফল রেখেই ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সুমন।
 
বাড়ির শেষ মাথা যেখানে জটলাহীন মানুষের এলোমেলো ঘোরাফেরা সেদিকে পা বাড়ায় সুমন, বের হবার রাস্তাটা এই দিকেই। যেতে যেতে মনটা টনটন করে দুলালের জন্য। কাতার যাবার জন্য একই দালালের কাছে টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো কার্যকারণই ছিল না দুলালের সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার। একই গন্তব্যের যাত্রী দুজন মিলে শলা-পরামর্শ করবে শুধু এই একটা অভিসন্ধিই তাকে প্ররোচিত করেছে অচেনা দুলালকে মেসের খালি বেডে তুলতে। সি এন জির যাত্রী হিসাবে পরিচয় হয়েছিলো দুলালের সাথে। সেই পরিচয়ে শুধু মেসে তুলেই ক্ষান্ত হয়নি, মিয়ার বাজারে কাপড়ের দোকানে কর্মচারির চাকরিটাও পাইয়ে দিয়েছিলো। কাতারের ভিসা পেতে যে কয়দিন লাগে শহরে থাকার খরচটা তো চলবে। পরবর্তীতে এর মাশুলও কম দিতে হয়নি সুমনকে। রোজ রাতে ঘন্টাজুড়ে বাথরুম দখল করে থাকত দুলাল, এ নিয়ে মেস মেম্বারদের সাথে প্রতিদিন ঝগড়াঝাটি। কিন্তু এ এক বাতিক দুলালের । গভীর রাতে শার্ট নিয়ে ঢুকত বাথরুমে, প্রতিদিন পরনের শার্টটা ধোয়া তার কাজ। পরনের শার্টটা ধুতে ধুতে আসল রংটা যখন আর বুঝার উপায় নেই, তখনো তার কেবলই মনে হতো শার্ট থেকে দুর্গন্ধ যায় না।
 
একটু হাসনাহেনার গন্ধের লোভে রাতের পর রাত বসে থাকতো মেসের সামনে নিমতলায়। শুধু বসে থাকায় হয়তো সমস্যা ছিল না। কিন্তু মোবাইলে উঁচুসুরে বাজানো গান পাশের দোতলা বাড়ির অষ্টাদশী মেয়েটির মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে শুরু করলো। ঐ মাইয়াডার গা থেইক্কাও হাসনাহেনার বাস আয়ে গো সুমন ভাই, বলত দুলাল। এই গন্ধ সে পেতো জবার গায়ে, গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে যখন জবা চুপিচুপি আসতো হাসনাহেনার ঝোপের আড়ালে। জবার শরীলডা এক্কেরে তুলার লাখান নরম, কথাটা বলার সময় গভীর প্রেমে টলটলে দীঘির মতো চকচক করতো দুলালের চোখ। নারী শরীর নিয়ে বিব্রতকর আলোচনাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ধমক দিত সুমন, যা ব্যাডা কিতা কস না কস ঠিক নাই, ঘরের কিনার ঘেইষ্যা হাসনাহেনার ঝোপ আর তুই গন্ধ পাস মাইয়া মাইনষের গতরে। দুলাল তখন দ্বিগুণ উৎসাহে প্রমাণ করতে চাইত তার গন্ধগ্রস্ততা অভ্রান্ত।
 
মৃধা গোবিন্দর বাড়িটা কিনে রেজিস্ট্রি করার পর সবার আগে হাসনাহেনার ঝোপটা কেটে সেখানে গোয়ালঘর বানালো। হাসনাহেনার গন্ধের বাতাস দখল করে নিলো গরুর গোবর-চেনার গন্ধ। বাড়ির উত্তর মাথায় একটা ছাপড়া ঘর বানিয়ে গোবিন্দকে আপাতত থাকতে দেওয়ার দয়া দেখিয়েছে মৃধা। ব্যবসায় লস খেয়ে ভিটেমাটি বেচে ইন্ডিয়া যাওয়ার ধান্ধায় আছে গোবিন্দ। কিন্তু যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিন তিনটা মেয়ে নিয়ে ব্যাটা নইলে থাকতো কই!
 
তখনো গোয়ালঘরের পিছনে জবা দেখা করতে এলে নাকি হাসনাহেনার গন্ধই পেতো দুলাল। আর মৃধার পোলা বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে যতোই বিদেশ থেকে আনা সেন্ট মাখতো ততোই তার গা থেকে বের হতো গোবরের গন্ধ। সুমনকে জ্ঞান দিতো- গন্ধ পাইতে জানন লাগে গো ভাই, এই গন্ধ পাওনের ভাবটা আয়ে ভিত্রের থিক্কা। সুমন সাবধান করেছে বেশ কয়েকদিন, দেখিছ দোতালার মাইয়ার গতরের থিক্কা যে হাসনাহেনার গন্ধ পাইতাছস, বিপদ ডাইক্কা আনিছ না কইলাম।হেরা বড়লোক মানুষ।
 
কিন্তু বিপদ যেদিন ঘটলো সেদিন প্রথমটায় কেউ বুঝতেই পারেনি ঘটনাটা কী। রাত দশটার দিকে মেসের মালিক মেসে ঢুকেই দুলালের গালে গায়ের জোরে লাগায় দুই থাপ্পড়, সাথে মুখে অকথ্য বাক্যবাণ, শালার ঘরের শালা গান তর পাছা দিয়া ঢুকামু । মজনু আইছো এইখানে! সেদিন হাতে পায়ে ধরে কোনরকমে দুলালের আশ্রয়টা টিকিয়েছিল সুমন।

পরে ভেবেছিল অনেক হয়েছে একটা বাহানায় এ আপদরে এবার মেস থেকে বিদায় করে দিতে হবে। কিন্তু পরক্ষণেই পরিবারের দুরবস্থার কথা বলে যখন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে টাকা ধার চাইলো দুলাল, তখন সুমনের কঠোর হওয়ার ইচ্ছাটা মোটামুটি পথ হারিয়ে ফেললো নিজের পরিবারের দুর্বিসহ স্মৃতির ভিড়ে। ভিটা বাড়ি হারিয়ে তার বাপ মাও সরকারের খাস জমির ছাপড়ায় প্রায় নির্ঘুম রাত কাটায় যে কোনো মুহূর্তে উদ্বাস্তু হবার আশঙ্কায়, আর ছেলে বিদেশ গেলে দুঃখ ঘুচবে এই আশায় পাওনাদারদের খোটা সহ্য করে মুখ বুজে। দুলালের এই কান্নায় নিজের অশ্রুর ফোঁটা খুঁজে পেতো সুমন। তাই মেসের সবাই যখন দুলালের যন্ত্রনায় মহাবিরক্ত, তখন সুমন নিজের একবেলা মিল বাঁচিয়ে কিছু টাকা তুলে দিতো দুলালের হাতে।
 
কিন্তু কাহাঁতক ধৈর্য থাকে? একদিন দোকানের ম্যানেজার মেসে আসলো দোকান থেকে দুলালের কাপড় চুরির বিচার নিয়ে। মালিক আর তাকে চাকরিতে রাখবে না। সেদিন সুমন লজ্জায় ক্ষোভে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে অমানুষের মতো মারতে মারতে দুলালকে বাধ্য করেছিলো মাচাঙের উপর পলিথিনে বান্ধা পোটলা থেকে একটা নীল রঙের আনকোরা শার্ট বের করে দিতে। সে দিন রাতে ঘুমানোর সময় সুমনের অভিসন্ধি পরিণত হয়েছিল দুরভিসন্ধিতে। দুয়েকদিনের মধ্যেই মেসে টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে মেস থেকে বিদায় করে দেওয়ার পরিকল্পনাটাকে মোটামুটি প্রতিজ্ঞা বানিয়ে ফেলে সুমন।
 
কিন্তু সেদিনই রাতের আন্ধারে দুলাল আবার তার পায়ে ধরে কান্নাকাটিতে ভেঙে পড়লে শীতের সকালে রোদে রাখা বোতলের নারকেল তেলের মতো গলে যায় সুমন। রাতের প্রতিজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে সে ঠিক পরদিন নিজে দোকানের মালিকের হাতে পায়ে ধরে দুলালকে চাকরিতে বহাল করে দিয়ে আসে। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়, তরে আমি একটা নীল শার্ট কিন্যা দিমুনে যা।
 
আসলে দুলাল জবাকে নিয়ে সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীন আশঙ্কায় থাকতো। দুলালের উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কা অমূলক ছিল না। মৃধার টাকার অভাব নাই, তার পোলা হোন্ডা দৌড়ায়, জবার জন্য নাকি সে জান দিতে পারে। যদি দুলালের কাতার যাওয়া না হয়, জবাকে সে হারাবে। অবশ্য আবার নিজেই সান্ত্বনা খুঁজতো, বলতো জবা পোলাডারে দুই চক্ষে দেখতে পারেনা গো সুমন ভাই। কইছে আরেক দিন হাতের নাগালে পাইলে জুতাইয়া লাম্বা কইরা ফালাইবো। সুমনের চোখে বোধ করি কিছুটা অবিশ্বাসের ছায়া দেখে দুলাল তাই সাথে সাথে বলে, বিশ্বাস যাও সুমন ভাই হাছাই একদিন মৃধার পোলারে এমুন চড় দিছিল ইস্কুলের সামনে।
 
তবে দুলাল গ্রাম ছেড়ে দেওয়াতে ইদানীং আবার নাকি উৎপাত বেড়েছে তার। জবা খবর দিয়েছে, দুলাল যেন বাড়ি যায়। যেতেই হবে। কিন্তু বারবার ধুতে ধুতে পরনের শার্টটার যা চেহারা, কেমনে এটা পরে প্রেমিকার সামনে দাঁড়াবে সে। শার্ট কিনবার টাকাও তো নাই। বাধ্য হয়েই না নীল শার্টটা চুরি করেছিলো সে।
 
দুলাল ভিসা পাওয়ার পর সত্যি সত্যি একটা নীল রঙের শার্ট কিনে দিয়েছিল সুমন দুলাল কে, শার্টটার পিছনে লেখা ‘লাভ ফরএভার’। সেবার শার্টটা পরে জবার সাথে দেখা করে এসে কী খুশি দুলাল, শার্টটা জবার খুব পছন্দ হয়েছে, বিশেষত পিঠের লেখাটা। শার্টটা ফেরত দেয়নি জবা। রেখে দিয়েছে দুলালের স্মৃতিস্বরূপ। পুরানো মলিন শার্ট পরে বিমান বন্দরের দিকে যাবার সময় নীল শার্টটার জন্য সুমনের খারাপ লাগলেও দুলালের ভেতরের স্বস্তিটা সে পড়তে পারছিলো। যে প্রেমিকা প্রেমিকের অবর্তমানে তার স্মৃতিচিহ্ন যত্ন করে রেখে দেয়, সে কী ভীষণ ভালোই না বাসে তাকে।
 
দুলাল চলে যাবার পর মেসের নিমগাছটার নিচে আসলেই বুকটা খচখচ করতো সুমনের। আহারে দুলাল! চোখ যেতো পাশের দোতালা বাসাটার দিকে। জানালায় সেই অষ্টাদশী। চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিতো সুমন, দুলালের শাস্তির স্মৃতিটা দগদগে ঘা হয়ে টনটন করে তখনো । টের পেতো মেয়েটি ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকে জানালার পাশে। প্রায় নিয়মিত।

মাথার উপর শ্রাবণের মেঘ ঘন জমাট বেধে ভারী হতে থাকে, গুড়–গুড়– আওয়াজে সুমন বুঝে নেয় বৃষ্টি নামবে এখনই। যাওয়া দরকার তাড়াতাড়ি। লাশ দেখায় ইচ্ছা যখন বিসর্জনই দিয়েছে তখন আর সময় নষ্ট করার কী দরকার? দুলালদের বাড়ি থেকে নামার পথটা খানিক ঢালু বৃষ্টিতে পিচ্ছিল, সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে সুমন হিসাব করতে চায় শেষ কবে ফোন দিয়েছিলো দুলাল তাকে, দালাল জানিয়েছে মাসখানেক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলো দুলাল। হ্যাঁ মাসখানেকই হবে, ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো- মাইরা সারা শরীলে দাগ ফালাইয়া দিছে গো সুমন ভাই, আমি এই সীমার- এজিদের দেশঅ থাকতাম না। দেশঅ ফিরা আইয়া মাইনষের গু সাফ করমু, তবুও এই দেশঅ থাকতাম না। ইতা সীমারের জাত, দয়া মায়া নাই। তুমিঅ আইয় না সুমন ভাই…। লাইনটা কেটে গিয়েছিল কথা শেষ হবার আগেই।
 
তখন মাত্রই সুদে ঋণ নিয়ে বাকি থাকা পঞ্চাশ হাজার টাকা দালালকে দিয়েছে সুমন। তুমিঅ আইয় না- তখন আর একথা বললে কী চলে? ইচ্ছা ছিলো আরেকদিন ফোন দিয়ে দুলালের কাছে বাস্তব অবস্থাটা জানতে চাইবে। কিন্তু তার আগেই চলে এলো দুলালের লাশ। এখন কী হবে দুলালের নিঃস্ব পরিবারের? চড়া সুদে ঋণ নিয়ে দুলালকে বিদেশ পাঠিয়েছে দুলালের বাবা। কী হবে অপেক্ষায় থাকা জবার? দুলালকে কথা দিয়েছিলো জবা, দুলালকে ছাড়া আর কারো ঘর করবে না সে।

আদিত্যপুর গ্রামের বৃষ্টিতে ভেজা ধানক্ষেত, সুপারি আর তাল গাছের সারির ছবি আড়াল হয়ে সুমনের চোখের সামনে ভাসতে থাকে নিজের অসহায় পরিবারটির ছবি। চড়া সুদে লক্ষাধিক টাকা ঋণ তারও। দুই কান থেকে নির্গত হতে থাকে শোঁ শোঁ গরম বাতাস। কফিনবন্দি লাশটি যেনো দুলালের নয়, তার নিজের।ভয়ার্ত এই বোধ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টায় বাড়ির বাইরে চলে আসে সে। দুর্বহ লাগে দুলালের আদ্যোপান্ত স্মৃতির ভার। ফিসফাস, করুণ কান্নার সুর, কোরান তেলাওয়াতের হৃদয়স্পর্শী উচ্চারণ কিছু আর তাকে স্পর্শ করে না। শোক বেদনা কষ্ট কিছু নয়, কেমন অস্থির বোধ হয়, মাথাটা ঘুরে ওঠে। বমি বমি লাগে, ধপ্ করে সে বসে পড়ে কাদামাখা একটা গাছের গুঁড়িতে। তাকে সাহায্য করতে সিগারেট হাতে এগিয়ে আসে এক যুবক। যুবকটিকে চিনতে পারে না সুমন, চিনবার কথাও নয়। এই গ্রামে আজই তো প্রথম আসা তার। পাশের টিউবওয়েলে নিয়ে সুমনের চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয় যুবকটি। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সুমন মাথা তুলে, চোখ যায় ছেলেটার গায়ের নীল শার্টটার দিকে। এইতো সেই নীল শার্ট যা সে দুলালকে কিনে দিয়েছিল। জবা দুলালের স্মৃতিস্বরূপ রেখে দিয়েছিলো। একটু ফিরে পেছন দিকটা দেখে আরও নিশ্চিত হতে চায় সুমন, হ্যা সেখানে ইংরেজিতে লেখা 'লাভ ফরএভার'। সেই শার্টটাই। শার্টটা মৃধার ছেলের গায়ে!

আমি মৃধার পোলা সেলিম, যুবক হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য ...হাতখানা বাড়ায় সুমনও। বলে,আমি সুমন, দুলালের লগে এক মেসে থাকতাম। যুবক প্রস্তাব দেয়, চলেন হোন্ডা দিয়া বড় রাস্তায় তুইল্যা দিয়া আসি। না, না লাগত না- দ্রুত যুবকের হাত ছাড়িয়ে হেঁটেই বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ায় সুমন, গলার কাছে একদলা কান্না আটকে থাকে। নিজের সি এন জি চালিত যান নিয়ে সদরের দিকে আসতে আসতে হঠাৎ কাকতালীয় ভাবে রাস্তায় হাত দেখায় সেই মেয়েটি, পাশের দোতালা বাড়ির অষ্টাদশী। এ দিকেই নাকি কলেজ তার। সি এন জি তে উঠে কোনো ভণিতা ছাড়াই পূর্ব পরিচিতের মতো মেয়েটি জানতে চায়- আপনাদের মেসে যে গান বাজাতো ছেলেটা, দুলাল, সে চলে গেছে না? সুমন সংক্ষেপে তার চলে যাওয়া আর লাশ হয়ে ফিরে আসার গল্পদুটো শোনায়। মেয়েটা চুপ করে যায়। সুমন একবারও মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটির মুখের ভাষা পড়ে দেখার চেষ্টা করে না। কিন্তু মেয়েটা নেমে ভাড়া দিয়ে চলে যাবার সময় তার নাকে ঝাপটা দেয় হাসনাহেনার তীব্র গন্ধ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ