জহিরুদ্দিন যখন করাচির চাটগাঁ কলোনির চিপাগলি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে আসে, সূর্য মাটি ছেড়ে বুকের পাঁজর বরাবর উঠে গেছে। আজকের দিনও গনগনে তাপ সবকিছু জ্বালিয়ে দেবে বোঝা যায়। সে নিজে বুকের আগুনে ধিকি ধিকি জ্বালায় একা পোড়ে, কেউ তা দেখে না; দেখার কথাও নয়। একবার মনেপ্রাণে শীতল হয়েছিল। দু হাজার পাঁচ, শেষবার দেখে আসে, সেও তো দিন কয়েক, আর সেই চার-পাঁচ কিংবা সাতদিনের জন্য তিরিশ হাজার টাকা গুনতে হয়; তখন তার পাসপোর্ট ছিল। ভিসা লাগাতে ঘুষ। এখন কোনোকিছু নেই, আশা-ভরসা-আনন্দ, এমনকি এই জীবন আর অস্তিত্ব; সামনে শুধু সীমাহীন আরব সাগর। লবণাক্ত ঢেউ বাতাস। করাচি বড় নির্দয় শহর। কারও বুকে দয়ামায়া নেই। জহিরুদ্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে পড়ে কপালে যে নিশান জ্বলজ্বল করে তুলেছে, তারচয়েও বড় হয়ে জানান দেয় না-পাকি তকমা ‘গাদ্দার’। তার কী দোষ? উনিশ শ তেষষ্টিতে চলে আসে মা-বাবা। মাস গেলে সাড়ে তিন শ রুপি বেতন। এসব তার বুঝ-অবুঝ বয়সবেলার শোনা কথা। জহিরুদ্দিন করাচি বোর্ড থেকে আটষট্টিতে সায়েন্স বিভাগে এসএসসি পাস করেছে। এর তিন বছর পর কী যে যুদ্ধ হলো, সে তো ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর দোষ নাকি ইন্ডিয়ার ষড়যন্ত্র; মাসরেকি পাকিস্তান মাগরেবি থেকে আলাদা হয়ে গেল। এসব কথা এখানের মানুষজনের মুখে মুখে। জহিরুদ্দিন জানে সঠিক ইতিহাস, ব্যাখ্যাও করতে পারে, কিন্তু সব কথা বলে না, বলা যায় না; একদিন ঠিক ঠিক কথা বলবে। এ হলো মনের গোপন বাসনা, যদি কোনোদিন সুযোগ আসে; নিজের দেশ আর পরিচয়-স্বাধীকারের ব্যাখ্যা মাথা উঁচু স্বরে বলবে। এখন তার দেশ নেই। পরিচয়হীন ঠিকানার অদ্ভুত প্রবঞ্চক জীবন।
সেদিন তার মন ফুরফুরে পাগল হাওয়ায় ভেসে যায়। ডিসেম্বর মাসের ষোলো তারিখ, বৃহস্পতিবার, বিকেল সাড়ে চারটায় স্বাক্ষরিত হলো আত্মসমর্পনের ঐতিহাসিক দলিল। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান নাম: সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) উন্মুক্ত আকাশের নিচে হাতিয়ার নামিয়ে দিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. কে. নিয়াজি। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতের সমন্বিত বাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে নতজানু পিস্তল থেকে কার্তুজ বের করে সারেন্ডার। কেন এই যুদ্ধ? কেন নিহত হলো লক্ষ লক্ষ বাঙালি? রেপ করা হলো হাজার হাজার নারীকে? বাঙালি সব কি গাদ্দার হয়ে গিয়েছিল? সেই প্রশ্নের জবাব জানা আছে। আজকাল পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণও করতে পারে। জহিরুদ্দিন সে-সব করে না। এখানে এসব কথায় লাভ কী? উল্টো দোষ। সে তো এখন মোহাজের, শরণার্থী, দু হাজার চোদ্দো সালে নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে গেল, কেন...কী তার দোষ জানা নেই। অন্য একটি কার্ড পেয়েছে, কিছু গম-আটা-তেল কখনো সাদা চাল পাওয়া যায়; আজকাল এর বেশি কিছু আশা করা অসম্ভব কল্পনা। তবে মনের মধ্যে খুশি হিল্লোল তোলে, দেশ স্বাধীন হয়েছে; মুক্তি পেয়েছে বাংলার জনগণ। সতেরো বছর আগে বৃদ্ধ বাবাকে রেখে এলো। নিজ দেশের মাটিতে মরার সাধ। জহিরুদ্দিনকেও থেকে যাওয়ার ইশারা করে সেই প্রাচীন চোখের দৃষ্টি। জহিরুদ্দিন তখন শোনেনি। তার দোকান জমজমাট ব্যবসা করছে। তহবিল বা কিছু সঞ্চয় করে ফিরে আসার পরিকল্পনা। আদতে সেটি পারবে কিনা জানা নেই। এখন চাটগাঁ-মাচান আর মুশা কলোনির ঘিঞ্জি অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে কখনো সেই দৃষ্টি বিষাদ আকুতিতে আছড়ে পড়ে, গোপন স্বপ্নের কথা মনে এসে সবকিছু পোড়ায়; তারপরও স্বপ্ন দেখে একদিন ঠিক নিজ বাসভূমে ফিরে যাবার। অপেক্ষা শুধু কখন ফিরে পাবে সেই দিনক্ষণ। মনে আশা রাখা ভালো।
রাতে ঘুম হয়নি, এপাশ-ওপাশ করতে করতে হাজারও ব্যাকুলতা বুক চেপে বসে; কেন ফিরে এলো? গতকাল দোকানে এটা-ওটা বিক্রির একফাঁকে, শেষদুপুরের সময় কেউ একজন এলো, আরও দু-একজন, তাদের হাতে ক্যামেরা-অ্যালুমোনিয়াম রিফ্লেক্টার আরও কত কি! খান রেহান সাদিক, তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের উদ্যমী তরুণ, কত কথা জানার আর জানাবার ইচ্ছে তার। জহিরুদ্দিনের মনের তন্ত্রীতে সবকিছু উসকে ওঠে আর বুকের গহিন খেদ মিটিয়ে কথা বলে। অনেক কথা গোপনও করে যায়। উপায় নেই।
‘আপ কিত্নে বরছ সে পাকিস্তান মে রেহতে হ্যাঁয়?’
‘বহুত বরছ সে, উয়ো জব পাকিস্তান-ইন্ডিয়া জং হুয়া থা, জম্মু-কাশ্মির কে লিয়ে, উসকে ভি কোয়ি সাল পেহ্লে।’
‘নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান?’
‘নেহি নেহি সিক্সটি ফাইভ, মেরা ওয়ালেদ এঁহা জব করতে থে।’
‘উয়ো যো সেভেনটি ওয়ান মে মাসরেকি পাকিস্তান আলাগ হো গেয়ে, উস টাইম মেঁ আপলোগ কাঁহা থে?’
‘হাম পাকিস্তানি হ্যাঁয় ভাই, জরুর এঁহা থা।’
‘আপকা রিস্তেদার কোয়ি বাংলাদেশ মেঁ হ্যাঁয়?’
‘মেরে আওলাদ, উসকা বিবি আউর এক পোতি ভি।’
‘আপ ওঁহা গেয়ে থে? উস লোগো কা ইয়াদ আতা নেহি?’
‘বহুত ইয়াদ আতা হ্যাঁয়। দো হাজার পাঁচ মেঁ গিয়া থা।’
‘আব জানে কা এরাদা হ্যাঁয়?’
‘জানে কো দিল বহুত বেচায়েন হ্যাঁয়, মাগার মেরা কোয়ি শেনায়ক্তি কার্ড নেহি হ্যাঁয়; কেয়সে যা পায়েগা?’
রেহান সাদিক কখনো কখনো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথার ফাঁকে কমেন্ট করে যায়। রিফ্লেক্টারের পরদায় ঝলসে ওঠে সূর্যের আলো। চোখে-মুখে এসে উষ্ণ করে তোলে সবকিছু। এই যে পাকিস্তানে আটকে থাকা বাঙালি আর তাদের জীবনযাপন-সুবিধা-অসুবিধা-স্বপ্নসাধ নিয়েও দু-চার কথা চলতে থাকে। জহিরুদ্দিনের শ্রুতি সেদিকে মনোযোগ ধরে রাখতে রাখতে কোনো তেপান্তরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। সতেরো বছর পেরিয়ে যায় যায়, তার আর কতদিন আয়ু আছে জানা নেই, কত লাখ টাকা সঞ্চয় করা হলো কে জানে; একবার শেষবার ছেলে-ছেলেবউ আর নাতনিকে দেখতে বড় সাধ জাগে। কীভাবে সম্ভব? আদৌ কি দেখা হবে?
সেই সাক্ষাতকার শেষে যখন বিকেলের বাতাসে উষ্ণ তাপদাহ হালকা হতে শুরু করে, জহিরুদ্দিনের মনমেজাজে জ্বলজ্বল তাপ, বাংলাদেশে ছেড়ে আসা ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনির কথা উঁকি মেরে হাজারও ভাবনায় ধীরে ধীরে কাহিল করে দেয়। এই জীবনে কি আর দেখা হবে? তার বয়স আটষট্টি পেরিয়ে যায় যায়। বাবা মরেছিল দু হাজার ছয় সালে, ছিয়াত্তর বছর বয়স, স্বাস্থ্য ভালো ছিল না, ডায়াবেটিস; জহিরুদ্দিন ওষুধ কিনে দিতে পারে না। আ রে বাড়িতে দু-বেলা ঠিকমতো দানাপানি নাই, সেই বাপের জন্য আবার ইনসুলিন কী? একসময় কত ভালো ভালো খেয়েছে। সকালে মাটন নেহারি নাহয় বুটের ডাল দিয়ে ডালডা কি বাদাম তেলে ভাজা গরম গরম পরোটা, দুপুরে বিফের ঘনীভূত ঝোল নয় ভুণা, আর রাতে সেই ঝোলে রুটি ডুবিয়ে খাওয়া। একদিন প্রায় অচল বাবাকে নিয়ে গেল দেশে। কয়েকটি দিন...আর দেখা হলো না। মৃত্যুর আগে আগে একবিন্দু পানি পর্যন্ত দেওয়ার সুযোগ নেই। আফশোস! একদিন মোবাইলে খবর এলো। আইনুদ্দিন সন্ধের সময় কল দেয়।
‘বাজান দাদা বইকালের পরে পরে আছর নামাজ শেষ হওনের লগে চইলা গেল। মাগরিববাদ মাটি। তুমি তো আইতে পারবা না। মাফসাফ কইরা দাও, আল্লা তোমারেও মাফ করুক।’
‘ইন্নালিল্লাহি-ওয়া-ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাজান তোর দাদা রে কদম গাছের তলায় রাখিছ। আল্লাহ তার বেহেস্ত নসিব করুক। আমিন।’
‘আমি একফোঁটা পানি খাওয়াইতে পারি নাই বাজান...অফিসে ছিলাম। মুনার মায়ের কোলে জান ছাইড়া দিছে গো বাজান।’
‘আল্লাহ রহম করো মাবুদ। দোয়া করিছ বাজান। খোদা যেন তার সকল ছগিরা-কবিরা গুনাহ মাফ করি দেন।’
‘আমিন।’
জহিরুদ্দিনের চোখে ভেসে ওঠে বাবার ধসে যাওয়া মলিন চেহারা, সেই কাতর চাহনি, সেখানের প্রতিচ্ছবি বলে ওঠে; ‘জহিরুদ্দিন ভিনদেশে আর যাইয়া কাম কী? দোকান-ঘরবাড়ি সব মায়া ছাড়ি দিয়া নিজের দেশে থাকি যা বাপ।’ জহিরুদ্দিন শোনেনি। আফশোস! বাবার কবরে তিন মুঠো মাটি তুলে দেওয়ার ক্ষমতা হলো না তার। এই তো কয়েক বছর, স্মৃতিতে জেগে ওঠে, চিকন রাস্তার বাঁ-ধারে ডোবা, তার দক্ষিণে প্রাচীন কদমগাছ, পশ্চিম আকাশের সূর্য আড়াল করে শুয়ে আছে বাঁশবাগান আর শুকনো পাতার মর্মরে আচ্ছাদিত কবরস্থান। তারই কোনো কোণায় নিশ্চয়ই ঠাঁই হয়েছে বাবার। নিজের দেশ...মাতৃভূমি। মায়ের ভাষার মধুর মতো মায়ের কোল হলো নিজের দেশ। জহিরুদ্দিনের কোনো দেশ নেই। ঠিকানা নেই। নিজের দেশ থেকে অনেক অনেক দূর, যেনবা পৃথিবীর শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে রাতের খোলা আকাশের বুকে ছড়িয়ে থাকা তারাগুলো ধরে রাখে অবলম্বনহীন অসহায় দীর্ঘশ্বাস। তার কপালে কি দেশের মাটি আছে নাকি আরব সাগরের লোনা জলে শরীর ডুবিয়ে দেয় কে জানে? জহিরুদ্দিন পাশের দোকানদার আজিম বেগের হাতে মোবাইল ফেরত দিয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। চোখে-মুখে বিষাদের ছায়া সন্ধের চেয়েও অন্ধকার আর রহস্যময় বেদনা ছড়িয়ে দেয়। আজিম বেগ শুকনো চোখে জিজ্ঞেস করে, -
‘ক্যায়া বাত মিয়া জহিরুদ্দিন কুছো খারাপ খবর?’
‘মেরা ওয়ালেদ ইন্তেকাল কর বসা ভাই।’
‘ইন্নালিল্লাহি-ওয়া-ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বড়ি আফশোস কি বাত্!’
‘হাঁ ভাই আফশোস। আল্লাহ উসে জান্নাত নসিব কঁরে।’
‘আমিন।’
জহিরুদ্দিন দোকান বন্ধ করতে করতে ভেবে নেয়, তার কোনো মোবাইলও নাই, এই পাঠান মানুষটির সঙ্গে পাশাপাশি দোকান বা একই পেশাদারিত্বের কোনফাঁকে সখ্যতা গড়ে উঠেছে, মনে নেই; তারই মোবাইলে কথা হয়। কখনো বিশ-তিরিশ রুপি খরচের মাধ্যমে আনন্দ কেনে, দেশের খবর পায়, ছেলে-ছেলেবউ আর নাতনির সঙ্গে কথা হয়, মনে স্বস্তি আর শান্তি। আজ নিখরচায় বুকে বেদনা পেয়ে গেল। সুখ কিনতে টাকা লাগে, কষ্ট কেনায় কোনো খরচ নেই; মানুষ কি সাধ করে বুকে কষ্ট টেনে নেয়? নেয় না। তারপর ফেরার পথ, যেতে যেতে সন্ধে থেকে রাত, সারারাত আর দিনের পিঠে গড়িয়ে আসা কয়েকটি দিন বিমর্ষ-বিষাদের সঙ্গে সঙ্গে কোনো অলীক ভাবনা-দুর্ভাবনায় ডুবে ডুবে ঘোর লাগা মায়ায় কাটিয়ে দেয়।
আজকের সকালে আকস্মিক সেই ভাবনায় চোখের শুষ্ক দৃষ্টি আদ্র হয় জহিরুদ্দিনের। তারপর জীবন যেমন, সকালে কাজ, সারাদিন দোকানে বেচাবিক্রি আর গভীর রাতে মোটর গ্যারেজের মতো টিনচালের ঘরে ফিরে সালমা বেগমের সঙ্গে দু-একটি কথা বলতে বলতে ঘুমঘোরে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন জেগে ওঠে। এশার নামাজ শেষে কোরআন পড়তে পড়তে কখনো দোয়া বকশে দেয়। বাবা-মায়ের বেহেস্ত নসিব হোক পরওয়ারদিগার। ছেলে-ছেলেবউ আর নাতনি যেন দুধেভাতে সুখে সহিসালামতে থাকে। এইটুকু প্রার্থনা দু-হাতের কম্পমান অঞ্জলিতে অনেক অনেক প্রাপ্তি জেনে-বুঝে নিয়ে সেজদা। তারপর ঘুমোতে যায়। ঘুম আসে...ঘুম আসে না। এই তো জীবন! এ ছাড়া আর কী করতে পারে? সালমা বেগম বলে, -
‘মিয়া জানতে হো রুকাইয়াকা শাদি টুট গেয়ি...হলো না। আকমল ভাই এত্তো রুপেয়া খরচ করল, লাড়কি পছন্দ্ ভি হলো, মাগার...।’
‘শেনায়ক্তি কার্ড নেহি হ্যাঁয়।’
‘আপ কো ক্যায়সে মালুম?’
‘তুমি কি মাতৃভাষা ভুইলা গেছ নাকি কইতে শরম করে?’
‘অভ্যাস মিয়া। ও আইনুদ্দির বাপ, আমরা এইহানে কুত্তা-বিলাইয়ের লাহান পইড়া আছি ক্যান্? তুমি কি রাজাকার আছিলা নাকি পেয়ারে পাকিস্তানের খেদমতের মায়া?’
‘এইডা আমার দেশ না। একদিন নিজ দেশে ঠিকই যামু। তুমি জানো, মঈনের ব্যাডাটা ট্রাক চালাইত, কুড়ি হাজার রুপি বেতন, কার্ড নাই লাইসেন্সও পায়নি, কাজ চইলা গেছে। মঈন আইজ খুব কাঁদতে আছিল।’
‘আমাগো জীবন, ঝোলা হাতে লইয়া রিলিফ পাব, সেইডাও কপালে নাই। আমার বুক পোড়ে, পোলাডারে দ্যাখপার মন চায়, মুনাডা কত বড় হইল কিচ্ছু জানি না। ক্যান যে পোড়ার দ্যাশে ফিইরা আলাম! এ্যাহন কি যাওয়ার পথ আছে? তুমি কোনো উপায় করতে পারবা?’
‘জানি না।’
জহিরুদ্দিন এছাড়া আর কী জবাব দেয়? রাতের ফ্যাকাশে অন্ধকারে একটি দীর্ঘশ্বাসের অমোঘ প্রত্যুত্তর উঁচুতে থাকা ঘুলঘুলি দিয়ে বেরোবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। আচ্ছা বাংলাদেশে বিহারিরা তাদের মতো এরকম সমস্যায় আছে? তাদের তো ভোটার আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। আইনুদ্দিন মোবাইলে একদিন কথায় কথায় এই খবর বলছিল। সেখানে নাকি রাজনৈতিক নেতারা ভোটার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিহারিদের আইডি দিয়েছে। দুই হাজার আট সালে হাইকোর্ট থেকে তেমন ফয়সালা ঘোষিত হয়। বিহারিরা নাগরিক। আজ তারা রাজনীতি করে। জনসাধারণের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। কি আজব কাহিনি! অথচ তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা খানসেনার দোসর হয়ে বাঙালি হত্যা-লুটপাট আর ধর্ষণে মত্ত হয়েছিল উনিশ শ একাত্তরে। মানুষ সব ভুলে যায়। নেতারা ক্ষমতার মত্ত লোভে কী কী যে করে! কিসের জন্য এমন হয়? বাতাসে কত কথার গুঞ্জন, কত গুজব ভেসে ভেসে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে কানে আসে। এই বিহারিরা তো পাকিস্তানের লাহোর-করাচি বা পিন্ডির মানুষজন নয়। উনিশ শ সাতচল্লিশের দেশভাগে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বে উত্তর প্রদেশ-বিহার-পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত উর্দুভাষী রিফিউজি। রাজনৈতিক কারণে তাদের উদ্বাস্তু না বলে অভিহিত করা হয় মোহাজের নামে। তাদের কেউ কেউ ছেড়ে আসা বাপদাদার ভিটের জন্য মাতম করে, হালকা হারমোনিয়াম-তবলা-বাঁয়া বা ঢোলক আর বেঞ্জু সহকারে কাওয়ালি গায়, কাওয়াল পাশে রাখা চিলমচিতে পানের পিক ছুঁড়ে কণ্ঠস্বর আরও উঁচুতে তোলে, বেজে ওঠে দাফলি; কেউ কেউ আবার শায়েরির আসর বসিয়ে রাত কাবার দেয়। পাকিস্তানের প্রত্যেক সরকার তাদের জন্য অবারিতভাবে দিয়েছে হাজারও সুযোগ-সুবিধা, জমিজমা, হাউজিং প্লট, বাড়িঘর, এমনকি রেলওয়ে-পুলিশ-জুডিশিয়াল আর বিবিধ বেসরকারি দফতরে ছোটবড় সকল পদে চাকরি। ঢাকা থেকে দুই শত মাইল উত্তর-পশ্চিমে সৈয়দপুর শহর, সেখানে রেলওয়ের বৃহৎ ওয়ার্কশপ, সেখানে আগে থেকে ছিল কিছু বিহারি, দেশভাগে সেই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বাঙালি যে গরিব তেমনই থেকে গেল, কতিপয় সুবিধেবাদী ছাড়া। সেই গরিব মানুষেরা বুঝি মালিকবিহীন দেশের নাগরিক। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিম পাকিস্তান। কে জানে সত্য কী? অথচ পাকিস্তানে আজ আড়াই মিলিয়ন বাঙালি পরিচয়বিহীন...রাস্ট্রহীন। তাদের কোনো এনআইডি নাই। উনিশ শ আঠারো সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী বাঙালিরা শেনায়ক্তি বা এনআইডি কার্ড পাবে। কলোনির কোনো কোনো বাঙালি ঘোষণা শুনে উৎফুল্ল হয়, ইমরান খানের জন্য প্রাণভরে দোয়া করে, ভালবাসা জানায়; কিন্তু ওয়াদা বাস্তবায়িত হলো না। আদৌ কি হবে?
জহিরুদ্দিনের জন্ম কবে? উনিশ শ বায়ান্ন সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলাদেশের কোনো এক মফস্বল শহরে। সেখানে একদা চোদ্দোই আগস্ট এলে সাদা-সবুজ রঙের পতাকায় বাঁকা চাঁদ আর তারা বাতাসে পতপত উড়ত। স্কুলে স্কুলে আনন্দ খেলা আর লাড্ডু বিতরণ। স্কুল থেকে ফিরে তড়িঘড়ি সিনেমা হলে ফ্রি-চলচ্চিত্র দেখার উৎসব। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান প্লেন থেকে নেমে পূর্ব পাকিস্তান সফর করে বেড়াচ্ছেন। এখানে-ওখানে উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন আর তার ধারাবিবরণী কত কি! যার সবই ছিল ভেলকিবাজি। পূর্ব পাকিস্তান নামক বাঙালির প্রাণের বাংলাদেশকে ছলে-বলে-কৌশলে আখের মতো নিঙড়ে রসটুকু নিয়ে গিয়ে পশ্চিমের শহর সাজানো-গোছানো চলতে থাকে। শিল্প-কলকারখানা সব গড়ে ওঠে সেখানে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি থেকে যায় অভুক্ত-অনাহারি। লাহোর-করাচি-রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদের সড়কে সন্ধেয় জ্বলে উঠে বাহারি আলো, আলোয় আলোয় আলোকিত চারিদিক; আর ঢাকার রাজপথ ঘুপচি অলিগলি থেকে যায় ছায়া-অন্ধকার। কে বলে সেই শোষণ-বঞ্চনার কথা?
ফেব্রুয়ারি মাস...শিমুল-পলাশের আগুনে আগুনে ফাল্গুনের ঐতিহাসিক দিনকাল। সেই সময়ের ইতিহাস জেনেছে জহিরুদ্দিন, যে কাহিনির শুরু পাকিস্তান-ভারত জন্মের আগে থেকেই। উনিশ শ সাতচল্লিশে দেশভাগ হলো। পাকিস্তান নামক রাস্ট্রর দুটো অংশ পূর্ব আর পশ্চিম, মধ্যখানে হাজার মাইল জুড়ে শুয়ে আছে ভারত, এত দূরত্বের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে মেলবন্ধনের কারণ কী? কেননা তারা মুসলমান। সব মুসলমান ভাই ভাই। অথচ এদের ভাষা আলাদা...জীবনযাপন সংস্কৃতি পৃথক। পূর্বের মানুষজনের মুখের ভাষা বাংলা, যেখানে পশ্চিমের অধিবাসীরা পাঞ্জাবি-বেলুচ-পশতু আর বিবিধ উপভাষায় কথা বললেও মূলত উর্দু। পূর্বাংশের জনগণ সংখ্যায় বেশি হলেও রাস্ট্রভাষা সেই উর্দু রাখার চক্রান্ত শুরু হয়। তারই আঁচ পেয়ে উনিশ শ সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় ‘তমুদ্দিন মজলিশ’ যার একটিমাত্র দাবি, পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা হতে হবে ‘বাংলা’। পরের বছর জানুয়ারি মাসে বাংলাকে রাস্ট্রভাষা করার দাবিতে গঠিত হলো ‘রাস্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ওই বছরের পরের মাসে পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনের কাজে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু শুরু হলে পূর্ব-বাংলার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের কণ্ঠে জেগে ওঠে প্রতিবাদ। বাংলার জনসাধারণও একই দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে।
উনিশ শ আটচল্লিশের একুশে মার্চ, রবিবার, কায়েদে আজম মো. আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত জনসভায় ঘোষণা দিলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা’। তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি হলো। জনসাধারণ ‘না-না’ ধ্বনিতে প্রতিবাদ জানালেও চক্রান্তকারীরা বাংলা বর্ণকে উর্দু বা আরবির মতো সাজানোর কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। উনিশ শ পঞ্চাশে প্রধানমন্ত্রী মো. লিয়াকত আলী, এবং প্রায় দু-বছর পর উনিশ শ বাহান্ন সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও ঢাকার এক জনসভায় উর্দুকে রাস্ট্রভাষা করার জোর ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ‘সর্বদলীয় রাস্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ‘রাস্ট্রভাষা দিবস’ ও হরতালের ডাক দেয়। এই কর্মসূচীকে প্রতিহত করতে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হলো। সকল প্রকার জনসমাবেশ-মিটিং নিষিদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুতোভয় ছাত্রছাত্রি আর ভাষাপ্রেমিক জনগণ একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। আকাশ প্রকম্পিত ‘রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ব্যানার-ফেস্টুন-শ্লোগানে জেগে ওঠে বাঙালির প্রাণের দাবি। পুলিশ ছাত্র-জনতার মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। বাতাসে ছড়িয়ে দেয় কাঁদুনে গ্যাস। পরিশেষে গুলিবর্ষণ। ঢাকার পিচকালো রাজপথ সালাম-রফিক-জব্বারের রক্তে রঞ্জিত হলো। পরদিন এই শহিদদের রক্তের শপথ নিয়ে পুলিশি গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে এক শোক শোভাযাত্রার আয়োজন হয়। পুলিশ পুনরায় গুলি ছোঁড়ে। সেখানে শফিউর রহমান নামে আরও একজন মরে গেল। অবশেষে উনিশ শ ছাপ্পান্ন সালের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাস্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে জেগে রইল একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা দিবস, আমি কি ভুলিতে পারি?
জহিরুদ্দিন থমকে দাঁড়ায়। এত যে ত্যাগ, আজ কেন সে মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারে না? এখানে পরিচয়হীন জীবনযাপনে বিজাতীয় কথাবার্তার সঙ্গে থেকে থেকে সবকিছু ভুলে যেতে বসেছে? প্রাণ খুলে মায়ের ভাষায় কথা বলার পরিসর কোথায়? কলোনির ছোট ছোট শিশুরা উর্দুতে কথা বলে। তাদের কোনো শিক্ষা নেই। স্কুল নেই। কেউ কোথাও আধা-মাগনা কাজ করে বেঁচে আছে। মালিকেরা কথায় কথায় গালিগালাজ আর নির্যাতন চালায়। ফেরেশতার মতো নিষ্পাপ ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নেই। উধাও হয়ে গেছে। কেউ কেউ সাগরের মাছ নিয়ে বাজারের কোণায় বসে হাঁক পাড়ে। তাদের শরীরে সারাদিন-সারারাত মাছের আঁশটে গন্ধ। এভাবেই দিন পেরিয়ে রাত, রাত হারিয়ে দিন, আসলে কোনো ভোর নেই; সকাল হয় না। তাদের কোনো আগামি নেই...নেই কোনো ভবিষ্যৎ। আজ এইসব মানুষের অস্তিত্বের সবটুকু ক্যামলিয়নের মতো বর্ণচোরা, গন্তব্যহীন বেঁচে থাকা আর বারে বারে রং বদলানো প্রহর। তার নিজেরও কোনো রং নেই, যেমনভাবে পরিচয়-ঠিকানা আর অস্তিত্ব। সালমা বেগম কি সবকিছুতে অনায়াসে অভ্যস্ত হয়ে গেল? সূর্য প্রায় মধ্য আকাশে উঠে যেতে শুরু করে। জহিরুদ্দিনের বুকে কাউকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাকুলতা আরও ঘনীভূত হতে থাকে। প্রাণভরে একবার মায়ের ভাষায় কথা বলতে সাধ হয়। পৃথিবীতে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার দাবিতে কি এত সংগ্রাম আর প্রাণ বিসর্জনের কাহিনি আছে? তার জানা নেই।
জহিরুদ্দিন দোকানের ঝাপ উঠিয়ে আশপাশ দেখে নেয়। আজিম বেগ গ্রাহক নিয়ে বেশ ব্যস্ত। সালামের জবাব দেওয়ার ফুরসত নেই। জহিরুদ্দিন দোকানের মালামাল বিক্রি করে দেবে প্রস্তাব দিয়েছে। তার আইডি নেই। দোকান ঘরের মালিক অন্য কেউ। মাস শেষে ভাড়া দিতে হয়। ইলেকট্রিক বিল বিবিধ খাজনা-ট্যাক্স জোগায় জহিরুদ্দিন। এমনই চলে আসছে। তারপর সেই সন্ধেয় মন কেমন কেমন, স্মৃতির পরিসীমায় ভেসে ওঠে নির্বাক মানুষের ভাসা ভাসা কথা বলা দৃষ্টি। ওই দেশে যাওয়ার দরকার কী? জহিরুদ্দিন কি এখানে নিজের দেশে নতুনভাবে শুরু করতে পারে না? সে জবাব দেয়নি, দিতে পারত; কিন্তু অচেনা লোভ অদূরদর্শী করে রেখে দিল। কে জানে একদিন তার পরিচয় কোনো ঠিকানা থাকবে না। আজকাল অবশেষে উপলব্ধি আসে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে; তার পদতলে মাটি নেই। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপন বড় বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা এনে দেয়। চোখে ভাসে নিরিবিলি শহরের রাস্তা-বাড়িঘর, তার শৈশবের খেলার মাঠ, স্কুলের গেট, অলিগলি আর বন্ধুদের চেহারা। সেবার দেখে এসেছে, শুনেছে বন্ধুদের কয়েকজন বেঁচে নেই, কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা; সরকার অনেক আদর আর সম্মান দেয়। কফিনের সম্মুখে ফুলের ডালা আর গার্ড অব অনার। কি ভাগ্য! জহিরুদ্দিন উনিশ শ একাত্তরে কোথায় ছিল? কী করছিল? করাচির রাস্তায় এখানে-ওখানে মুখ লুকিয়ে চলাফেরা নাকি প্রাণ বাঁচাতে ‘পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি? তার মনে আছে, মনে নেই; আসলে মনে করতে চায় না। পলাতক মন হাজারও ওজর বের করে আনে, পালিয়ে বেড়ায় আর বার বার হোঁচট খেয়ে ফিরে ফিরে আসে; বিমর্ষ হয়ে যায় মনের আকাশ। তখন কলেজে ভর্তি হয়েছিল। ইংলিশ মিডিয়াম। কেমিস্ট্রি-বায়োলজি আর ফিজিক্সের জগতে ডুবে যাওয়া, কিংবা কে জানে সালমা বেগমের মনের গহিনে হাজারও খেলায় ব্যস্ত সময়। জহিরুদ্দিন মুহূর্তখানেক স্থির ভেবে নেয়, এই তো সেদিনের দিনকাল; আজ কত বুড়ো হয়ে গেল সে! মানুষ এত দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে যায় কেন? এখন তো বয়সের উপলব্ধির সময় অথচ শরীর-মন বলে দেয় দিনান্তের কাল। কবে চলে যাওয়ার ডাক আসে কে জানে, তবে কি বুকের মধ্যে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন অসাড় দেহটির সঙ্গে সঙ্গে সমাহিত হয়ে যাবে? তার দু-চোখ দূরের ধু-ধু তপ্ত বাতাসের কম্পনে হারিয়ে যেতে থাকে। ইতিহাসের পাতাগুলো ধুলো বাতাসে ভেসে যায়।
পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয় উনিশ শ ছাপ্পান্ন সালে। পাকিস্তান হয়ে গেল ইসলামি প্রজাতন্ত্র। প্রথম প্রেসডিন্ট ইস্কান্দার মির্জা। তিনি ক্ষমতায় বসার দু-বছর পর অক্টোবর মাসে এক আদেশে সামরিক শাসন জারি হলো। সামরিক শাসনকর্তা সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান। আয়রন ম্যান। কুড়ি দিন পর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। সামরিক শাসন চলল উনিশ শ ষাট সালের তেইশ মার্চ পর্যন্ত। বছর দুয়েক পর পুনরায় নতুন সংবিধান যাতে সরকার প্রকৃতিও বদলে যায়। উনিশ শ পয়ষট্টি। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। সতেরো দিনের যুদ্ধ শেষে রাশিয়ার তাসখন্দে বৈঠক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শ্রী শাস্ত্রি হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলেন; পাকিস্তানের চারিদিকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের জয় জয়কার। জহিরুদ্দিন এ গল্প শুনেছে। যুদ্ধ দিনের আকস্মিক ব্লাকআউটের অন্ধকার হাতড়ে দেখা, যেমনভাবে শুনেছে হুসিয়ারির তীক্ষ্ণ সাইরেন। মানুষজন বাড়ির আঙিনায় ট্রেঞ্চ খনন করে রেখেছে। সে তখন স্কুলের সিনিয়র ছাত্র। কখনো ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন পড়ে। পাবলিক লাইব্রেরিতে বিবিধ বইয়ের মধ্যে আল্লামা ইকবালের কবিতা, রবি ঠাকুর আর নজরুল, নভেল-থ্রিলার আর রাজনৈতিক ইতিহাসও পড়া হয়। ‘বল বীর- বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমার, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ জহিরুদ্দিনের শরীরের ভেতরে রক্ত টগবগ করে। ইচ্ছে হয় ছুটে যায় মানুষের জন্য। মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্বের কেতন ওড়াতে ওড়াতে যদি প্রাণ যায় যাক। তখন কিশোরবেলা, আর এখন বৃদ্ধ চোখের নেতিয়ে পড়া দৃষ্টিতে ফেলে আসা দিনকালের ব্যাকুল বিষাদ, কত ভুল, কত প্রবঞ্চনার নতজানু জীবনযাপন, তারই পেছনে পেছনে ছুটে কিনা আফশোস। সেদিন কেন ফিরে এলো সে? এ যে তার দেশ নয়। সে আর তার মতো অনেক বাঙালি হলো উদ্বাস্তু। ঠিকানাবিহীন পরিচয়হীন মানুষ।
উনিশ শ একাত্তর। পাকিস্তানের পূর্বাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের উপর শাসন আর শোষণের চুড়ান্ত পর্যায়ে সেজে উঠেছে পশ্চিম। বাঙালির এইটুকু বুঝতে বুঝতে উনিশ শ সাতচল্লিশ থেকে পেরিয়ে গেছে ছাব্বিশ বছর। অথচ যার সূচনা হয়েছিল বৃটিশ উপনিবেশ শাসনের সূর্য ডোবার আগে থেকেই। তাই বাঙালির হাতে ক্ষমতা আসে না। প্রভু আর ভৃত্যের খেলা চলতে থাকে। উনিশ শ চুয়ান্ন সালের প্রাদেশিক নির্বাচন আর চার দলের যুক্তফ্রন্ট, উনিশ শ সাতান্ন সালের টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর অমোঘ ঘোষণা, স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য নানান কর্মসূচী, আর এরই মধ্যে অভিযোগ বাংলার অকুতোভয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান নাকি ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। ইতিহাসে এরই নাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। উনিশ শ আটষট্টি সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি রেখে মোট পঁয়ত্রিশ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়। দেশে শুরু হয় ব্যাপক গণ-আন্দোলন। আইয়ুব খান নিজের দুর্বল অবস্থান বুঝতে পেরে অবশেষে মামলা প্রত্যাহার করে সকল বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন। উনসত্তরের তেইশে ফ্রেব্রুয়ারি, রবিবার, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিপ্রাপ্ত নেতাদের গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখনকার ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলার মানুষের মুক্তি আন্দোলন তখন চরমে। আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আট দফা; প্রথমত আইয়ুব শাহীর পতন এবং গণতন্ত্রের পথে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। অবশেষে আইয়ুব খান পঁচিশে মার্চ, মঙ্গলবার, সেনা প্রধান আগা মুহম্মদ ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে সরে গেলেন। ওইদিন রাতে পুনরায় সামরিক শাসন জারি হলো। ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেন। উনিশ শ সত্তর সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্পন্ন হলে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের তিনশত আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দুই শত অষ্টাশি আসনে বিজয়ী হয়, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রধান বিজয়ী দল জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপল্স পার্টি। এখন নিয়মানুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ, কিন্তু ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে শুরু হয় নানান তালবাহানা আর নাটক-প্রহসন। আলোচনা বৈঠক ব্যর্থ হতে থাকে। যার প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে উনিশ শ একাত্তর, পহেলা মার্চ, সোমবার গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ঢাকার পল্টন সমাবেশে তিন মার্চ, বুধবার, বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়। এরপর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। সাতই মার্চ, রবিবার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান সরকারের প্রতি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে চারটি দাবি তুলে ধরলেন। এক. সামরিক আইন প্রত্যাহার, দুই. সকল সৈন্যকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, তিন. গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং চার. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। বঙ্গবন্ধু মূলত ওইদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করেন। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব; এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্।
সেই কালরাতের কাহিনিও জানা আছে। পঁচিশে মার্চ, বৃহস্পতিবার, যখন মানুষ শান্তির ঘুমে আশ্রয় নিয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে গণহত্যা। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে মানুষ টের পেল না মৃত্যু কী আর কেনইবা তাদের হত্যা। বাঙালি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে ভারতে শরণার্থী হলো। সাড়ে ছয় কোটি মানুষ দেশের মধ্যে পাকসেনার নারকীয় হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটে দিগ্বিদিক দিশেহারা, এই বুঝি প্রাণ যায়, তারাও যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াতে শুরু করে। সেই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অংশ নিল অধিকাংশ নন-বেঙলি বা বিহারি। তারা চিনিয়ে দিল মানুষের ঘরদোর, চালাল লুটপাট, মশালের আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মনের সাধ মিটাল। অগ্রগামি বাঙালিদের ধরে ধরে জান্তব নির্যাতন-হত্যা-ধর্ষণ কিছুই বাদ রাখল না। বিহারিদের কপালে কাফনপট্টি, হাতে উন্মুখ ছোরা-বল্লম-লাঠি আর মারণাস্ত্র। তারা হাজারও অশ্রাব্য গালির মুখে মুহুর্মুহু ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার’ আর ‘পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে থাকে। যতদিন বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত না করেছে, অত্যাচর-নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যা আর বিবিধ বীভৎস পৈশাচিকতা চলেছিল। তারপর ষোলোই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনার আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন। বাংলার প্রত্যেক বাড়ির শিখরে বিজয় নিশান, সবুজের বুকে রক্তিম সূর্য আঁকা বাংলাদেশ আকাশের প্রান্তসীমায় বাতাসের ঢেউয়ে উড়তে শুরু করেছে। মানুষের বুকে স্বস্তি আর শান্তির সুবিমল পরশ। উনিশ শ বাহাত্তরের জানুয়ারি মাসের দশ তারিখ, সোমবার, পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে এলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। একটি ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত দেশে শুরু হলো পুনর্বাসনের কাজ।
জাহিরুদ্দিনের চোখে দূরের তাপবাতাস মথিত দৃশ্য কম্পমান হতে থাকে। চোখের পলকহীন অচেনা মায়ায় জমে ওঠে আদ্র স্পর্শ। হায় সেদিনের দিনকাল ছিল মনের গহিনে জেগে ওঠা আনন্দ আর বিষাদের লুকোচুরি। নিজের কাছেই আত্মগোপনে থাকা কোনো স্বপ্নকাল! আর এর সকলই তার গর্ব-অহংকার...সে বাঙালি। সেই দুঃসহ দিনগুলোয় তখন কী করছিল সে? করাচির ঘিঞ্জি কলোনির রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বেশ কিছু পথ পেরিয়ে স্কুলের সম্মুখে দোকান খুলে বুঝে নিতে চায়, আসলে তার দেশ কোথায় আর পরিচয় কী? এই নতজানু মাথা আর নিশ্চুপ বধির জীবনযাপন? আর দশজনের তির্যক দৃষ্টি ও অশ্রাব্য গালিগালাজ যেমন মেখে নিতে নিতে অসহায় ক্ষোভে বেঁচে থাকা, বুঝি এর সকলই তার অপরাধ, সে হয়ে গেল গাদ্দার। তারপরও দিন, দিন পেরোতে পেরোতে সবকিছু কীভাবে মুছে গেল নাকি আবছা হয়ে পড়ে বুকে তার, আর কেনইবা কোন্ আশা নাকি মরীচিকার স্বপ্নদোলায় পুনরায় ফিরে আসা?
জহিরুদ্দিন সেই স্বপ্নের মধ্যে ফিরে আসে। দু হাজার পাঁচ আর আজ দু হাজার বাইশ, সতেরো বছর পর মন বড় উতলা হয়ে উঠেছে। কেমন আছে আইনুদ্দিন, তার বউ আর নাতনি মুনা? এখনো স্পর্শ করে দেখতে পারেনি সেই ছোট্ট শিশু, এখন বড় হয়ে গেছে; জহিরুদ্দিন পরম আদরে বুলিয়ে দিতে পারেনি বুকে জমে থাকা আদর মায়া। কোনোদিন রাতে মোবাইলে কথা হয়। অন্যের মোবাইল। নিজের মোবাইল কী করে হবে? তার তো এনআইডি নাই। একসময় ছিল। করাচি বোর্ড থেকে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করা সার্টিফিকেট খুব গর্ব করে একে-ওকে দেখিয়ে শান্তি পেয়েছিল। এখন ওসব বাতিল কাগজ। তার জীবন আর বেঁচে থাকা সব খেরোখাতায় লেখা পরিত্যক্ত হিসাবনিকাশ। একদা দেশ ছিল, এখন কোনোকিছু নেই।
কী এমন ঘোরের মধ্যে হেঁটে যায় জহিরুদ্দিন, দুই পা বুঝি চেনা পথ দেখে দেখে এগিয়ে যায়; তার কোনো বোধ নেই। কোনো থমথম নিশ্চুপ নীরবতার মধ্যে আকাশে শেষ-দুপুর রোদের ছায়ায় কী দেখে সে? কফিন নিয়ে একদল মানুষ কোথায় চলেছে? আতর-কর্পূর আর গোলাপজলের বিষাদ গন্ধ বাতাস ভারী করে রাখে। জহিরুদ্দিন পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কাকে জিজ্ঞেস করে? ডুমুরের ডালে দুটো কাক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যায়। কাকে দেখে তারা? জহিরুদ্দিনের সবকিছু ফ্যাকাশে রোদের মতো আউলা। আশ্চর্য, সে যে করাচির মাচান কলোনির এক টিনছাপরার নিচে মেঝেতে শুয়ে থাকে, সে জায়গা তেমন নয়, সেটা যেন তার ছোটবেলায় চেনা জানাশোনা ঘর, সে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, একাডেমি স্কুলের পুকুরপাড়ে কয়েকটি হাঁস তির্যক রোদে গা শুকোয়, জহিরুদ্দিন আবার জিজ্ঞেস করে, -
‘কে যায়? কে মারা গেছে ভাই? নারী না পুরুষ? আশ্চর্য কেউ খবর দিল না!’
এইসব প্রশ্নের মধ্যে বাঁশবাগানে বাতাসের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, বৃন্তচ্যুত শুকনো খয়েরি পাতাগুলো আচমকা তীব্র ঢেউয়ে চোখে-মুখে আছড়ে পড়ে, ঢেকে দিতে চায় সকল দৃশ্যপট, তার দম বন্ধ হয়ে আসে কিংবা আসতে চায়, তারপরও সে মরিয়া যেন বুকের সবটুকুতে চাপ চাপ ব্যথা আর বিষাদের কান্না বেজে ওঠে, নিশ্চয়ই খুব আপন কেউ বিচ্ছেদে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে যায়, চলে যেতে থাকে; কে সেই মানুষ? তখন অনেক উঁচু বাঁশের আগা অদ্ভুত বাঁকা হয়ে সড়সড় নিনাদে নিচে নেমে আসে আর খুব চেনা চেনা অথচ কিছুতেই মনে পড়ে না কিংবা মনে পড়ে ছায়া ছায়া আবছায়া অথবা ধূসর কারও চেহারা বুঝি চোখের সামনে এসে ঝুলে থাকে, হ্যাঁ সে মুখছবি তার বাবার।
‘বাবা জহির, তোর পোলা মারা গেছে বাপ। তুই তারে চিনতে পারছস না? আইনুদ্দিন...হায় আইনুদ্দিন!’
‘সে তো দেশে ভালো আছে বাবা, সহিসালামতে আছে, গত শনিবার কথা কইছি, আজিম বেগ মোবাইল দিল, হাজার মাইল দূরের দেশ, কিন' কথা কত স্পষ্ট।’
‘হাজার মাইলের দূরত্ব নিয়া কেমনে একটা দেশ হয় রে পাগলা? কবে দেখছস আইনুদ্দিনকে? তুই মনভোলা রে...মনভোলা।’
‘বাবা তুমি ক্যান এই দেশে নিজের বাড়িঘর ছাইড়া চইলা আসছিলা? কেউ কি ভিন ভাষার দেশে যায়?’
‘বাঁচার জন্য আসছিলাম রে বাপ। বড় ভুল হইছিল...হায়!’
‘বাবা!’
‘তোরে যাইতে না কইছিলাম। ক্যান শুনোস নাই রে জহির?’
জহিরুদ্দিন আচমকা ঘেমেনেয়ে উঠে বসে। তখন অচেনা গাছের উঁচুতে সেই মুখছবি খুব দ্রুত উঠে গেছে, বুঝিবা উড়ে যেতে যেতে বাতাসে কর্পূর-আতরের গন্ধ মাখিয়ে যায়। জহিরুদ্দিনের শরীর জুড়ে ঘাম। টিনছাপরা ঘরের পশ্চিমে উঁচু ফোকর গলে ঢেউ হয়ে আসা বাতাস অদ্ভুত হিম হিম। সেখানেও জড়িয়ে আছে অপর্থিব কোনো গন্ধ। জহিরুদ্দিনের সকল লোমকূপ ভয় ভয় শুষ্ক শিহরনে তখনো বুঝে নিতে চায়, এটা কি স্বপ্ন নাকি কোনো বাস্তব ঘটনা, সেলুলয়েড ফিলমের মতো কোনো দৃশ্যছবি, তখনো বোধহীন জিজ্ঞসায় অস্তিত্বের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকে; হায় আইনুদ্দিন! কেমন আছে তার আদরের পুত্র? ঘরের আলো-আঁধার ছায়া ছায়া গা ছম ছম ভৌতিক আবহ ধরে রাখে, তারপর মধ্যরাত বসে থাকা; ভোরের অপেক্ষা। সালমা বেগম একপাশ থেকে অন্যপাশে নড়ে উঠে হাতে কিছু খুঁজে নিতে নিতে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে, -
‘ক্যায়া বাত মিয়া...কুচ্ছো খাব-ওয়াব দেখা হো?’
‘হয় হয়...দেশের জন্য মন কান্দে গো বউ, আমার ব্যাটা, ব্যাটার বউ আর নাতনি।’
‘আসতাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিন কুল্লে জাম্বিউ আতুবু ইলাইহে...স্বপন দেখিছ আইনুদ্দির বাপ। বুকের মধ্যে থুতু দাও। অযু কইরা দুই রাকাত নামাজ আদায় করো। খাঁড়ো আমিও নামাজ পড়ুম। আমি সেখনই কইছিলাম, আর ফেরত আসনের দরকার নাই। নিজ দেশে আইছি, আর কি? কিন্তু তোমার ব্যবসা। ভারি তো চা-বিস্কুট-সিগারেটের দোকান। আ রে এমন দেশত্ কেউ থাকে...নিজের ভাষায় কথা কইতে পারি না। তারা কেমন চোখে তাকায়। কুকুরের লাহান জীবন।’
‘সব আমার গুনাহ বিবি।’
‘সরো বিবি কইবা না। আল্লাহ আমার ব্যাটা আর সবাকে সহিসালামতে রাইখো...আমিন।
‘সুম্মা আমিন।’
জহিরুদ্দিন আজ বুঝি হেঁটে আসতে পারে না। সেই স্বপ্নের পুনরায় জাগরণ মাথা আর শরীর গুলিয়ে ফেলে। তবু শরীরের যতটুকু শক্তি আর ক্ষমতা একটু একটু ধীরে ধীরে পা ফেলে এগোয়। আজ যদি দোকানের মালামাল বিক্রির কোনো ফয়সালা হয়ে যায়, যেভাবে হোক, সে বুঝি আরব সাগরে ডিঙি নৌকোয় ভেসে যাবে, কোথায় তার সবুজ-শ্যামল দেশ; ঠিক পৌঁছে যাবে। গত পরশু সেই যুবক ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে কলোনিতে হাজির। মাচানের একেবারে গোড়ার দিকে ছোট্ট দোকান জহিরুদ্দিনের। সেদিন বেচাবিক্রি ভালো। স্কুল ছুটির সময়। দোকানের এখানে-ওখানে ঝোলানো চিপস্-কুকিজ-চাটনি আর নানখাতাই বিস্কুট বেচতে হিমশিম অবস্থা। জহিরুদ্দিনের ক্যাশবাক্স হাঁ হয়ে খুচরো রুপি আর কয়েন গিলতে থাকে। মনের মধ্যে সতেরো বছরের গোপন খায়েশ ক্ষণে ক্ষণে উঁকি মেরে অস্বস্তি জাগায়। এবার তিরিশ-চল্লিশ কিংবা ষাট-সত্তর হাজার রুপি ফেলে যেভাবেই হোক পানি কিংবা আকাশ পথে চলে যাবে। এই দোকান ছেড়ে দেবে। আরও অনেককিছু, যা তার নয়, একসময় ছিল অথবা কোনোকালে ছিল না; সেখানে কীসের মায়া আর আবেগ? আজিম বেগ একটু অবসর পেলে শেষ ফয়সালা হয়ে যায়। তারপর এক সন্ধেয় আরব সাগরের বুকে ডিঙি নৌকোয় ভেসে যাবে। যদি লক্ষ্য থাকে স্থির, গন্তব্য অবশ্যই পাওয়া যাবে। জহিরুদ্দিনের চোখে ঘোরলাগা দৃশ্যছবি, আরব সাগরের বুকে এক ডিঙি নৌকো ভাসছে, অনেক মানুষ, সকলের দৃষ্টিতে বিষাদ কালোছায়া, কখনো-বা উঁকি দেয় দৃঢ় স্বপ্নসাধ, তাদের একেকজনের গন্তব্য আলাদা আলাদা; এরই মধ্যে জহিরুদ্দিন আর সালমা বেগম এতটুকু হয়ে বসে আছে। একবার মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। নিজের নাম-পরিচয় আর ঠিকানা।
তখন একজন মানুষের চোখে-মুখে আরব সাগরের লোনাজল ঢেউ ছড়িয়ে যেতে থাকে।
লেখক:
মাহবুব আলী
প্রভাষক (ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট)
দিনাজপুর, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত বই:
১. ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা), ২. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প), ৩. পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় (গল্প), ৪. অযোগ্যতার সংজ্ঞা (গল্প), ৫. ভয় (গল্প), ৬. রাত পাহারা চোখ (গল্প), ৭. গোপনীয়তার অলিগলি (গল্প)
0 মন্তব্যসমূহ