কাজী রহমানের গল্প : টয়লেট পেপার



পরিদর্শনের এক পর্যায়ে ভেবেছিলাম জিজ্ঞাসা করব না যে তিনি আসলে কী করছেন, কিন্তু কৌতূহলের জয় হলো। সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে বসলাম, এত যত্ন করে তুমি কী করছ মিজ হান্টিংটন? সে বললো, এই তো, এগুলো জোড়া লাগাচ্ছি ই.আর.। দেখলাম তাঁর ডাইনিং টেবিলের অর্ধেকটাই ভরে আছে প্রায় শেষ হয়ে পড়া অনেকগুলো টয়লেট পেপারের রোলে।

লোকে আমাকে ই.আর. বলে ডাকে। ডাকা উচিৎ আই.আর. মানে ইরেশ রানা, আই. আর. এর বদলে কীভাবে যে ই.আর. চালু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম বিরক্ত হয়ে পরে আর এ নিয়ে সময় নষ্ট করিনি।

আমার কাজ হল কোম্পানির হয়ে ফ্রিজ সারানোর খবরদারি করা। আজ আসতে হয়েছে মিজ রেবা হান্টিংটনের বাসায়। বয়স্ক মানুষ। আমাদের টেকনিশিয়ান ছেলেটি ঊনিশ বছরের পুরনো ফ্রিজ সারাতে গিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে। সহজে সারানো যাচ্ছে না। সারাতে গেলে সব মিলিয়ে যা খরচ হবে তার চেয়ে নতুন ফ্রিজ কিনে দেওয়াই ভালো। ছেলেটি ফ্রিজ সারাতে গিয়ে রান্নাঘরের মেঝের দুটো টালিও ভেঙেছে।

ফোন পেয়ে আসার পথেই সমাধান ভেবে নিয়েছি। মিজ রেবাকে একটা নতুন ফ্রিজ পাইয়ে দেব কোম্পানি থেকে আর রান্নাঘরের মেঝে সারাবার জন্য দু'দিনের মধ্যে লোক পাঠিয়ে দেব। সব খরচ আমাদের কোম্পানির, আমাকে শুধু সরেজমিন দেখে ঘটনা প্রত্যায়ন করতে হবে। ভোক্তার জন্য এটা চমৎকার সমাধান, চুক্তিও সেই রকমই বলে। সহজ কাজ।

রেবা হান্টিংটনকে সমাধান ব্যবস্থাটা বুঝিয়ে বলতেই সে খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। পাঁচ মিনিটেই ঝামেলা শেষ। ফ্রিজ ও মেঝের অবস্থা দেখে সার্ভিস অর্ডারে অনুমোদনের জন্য লিখে দিলাম। স্বয়ংক্রিয় ভাবেই সমস্ত ব্যবস্থার নির্দেশগুলো যায়গা মত চলে গেল কম্পিউটার মাধ্যমে। এই কাজটার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের অবশিষ্ট হিসেবে আমার হাতে রয়ে গেল আরো কুড়ি মিনিট প্রায়। ইতোমধ্যে রেবা তার শোবার ঘর থেকে জলের বোতল এনে দিল। তেষ্টা পেয়েছিল বেজায়, ক্লান্তিও লাগছিল। আজকাল অল্পেই ক্লান্ত হয়ে যাই। রেবা হান্টিংটন চেয়ার টেনে আমাকে বসিয়ে দিল জলপান করাতে। আমি তার বিচিত্র টেবিলের দিকে চোখ বুলাচ্ছি আর সেও গল্প জুড়ে বসলো আমার অবশিষ্ট সময়টা উড়িয়ে দিতে। সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম এক ধরণের উম্মনা ভাব নিয়ে।


ডাক্তারদের নির্দেশে হেপারিন মানে ব্লাড থিনার শুরু করেছে নার্স একটু আগে। হাতের শিরাগুলোতে ফুটো করে গোটা কয়েক সুঁই ঢুকিয়ে রেখেছে। ঘুমের ওষুধ, ব্যথার ওষুধ আরো অন্য কী সব ওষুধ চলছে। ট্যাঁটট্যাঁট করা মনিটরের নল আর তারগুলো নিয়ে শুয়ে চিৎপটাং পড়ে থাকতে হচ্ছে। নড়াচড়া বন্ধ। হার্ট এটাকের চিকিৎসা চলছে আমার। ত্রাহি মধুসদন অবস্থা। তদ্রাচ্ছন্ন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেও এক্স রে, স্ক্যান, রক্ত দেওয়া, বোতলে মুত্রদান ইত্যাদি কিছুই থেমে নেই। আমার ইচ্ছের কোন ধার ধারছে না কেউ। খেতে দিচ্ছে না। ডাক্তারদের নির্দেশই সব। অফিসে তিন দিন পর আমার একটা পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করবার কথা, প্রমোশনের জন্য খুব কাজে লাগত। গেল মনে হয়, সব অনিশ্চিত হয়ে গেল। অতিরিক্ত উৎপাত হিসেবে মাথার ভেতরটায় চিঁচিঁ করে কেউ যেন কিছু বলছে। স্নানঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি টয়লেট পেপারটা। চিঁ চিঁ টয়লেট পেপার, টয়লেট পেপার, ঐ যে ঐ যে। হেপারিনই হবে। বন্ধুর মত কেউ থাকলে বলতাম দু চারটা সরিয়ে রাখতে। ভাবছি একটা কিছু করতে হবে। ভাল যন্ত্রণা। দশমুখী যন্ত্রণা থেকে দু'একটা কমাতে হবে ভাবলাম।

একটু আঁধার হতেই চক্কর দিতে এলেন আলাভোলা কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত চোখের এক ডাক্তার। নামের ট্যাগ নেই। ঘরে ঢুকেই বলে সে বলে উঠল, আমি ডঃ বোদলেয়ার। মিঃ রানা, আপনি আজ আমার শেষ পেশেন্ট । বলুন তো আপনার কোথায় কী কষ্ট হচ্ছে এখন?

বোদলেয়ার? আহা, বোদলয়ার! এই নামের কেউ ডাক্তার হতে পারে ভাবিনি।

বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কষ্ট হৃদয়ে, কিন্তু বললাম, তেমন কোন কষ্ট অনুভব করছি না, তবে বিরক্ত লাগছে সবকিছুতেই, ঘুমুতে পারছি না।

বোদলেয়ার বললেন, এগুলো তেমন কোন সমস্যা নয়। আপনাকে সবচেয়ে ভাল ওষুধগুলো দেওয়া হয়েছে। এখন আর এর চেয়ে বেশি কিছু দেওয়া যাবে না।

ডাক্তার কিছুক্ষণ রোগীর অবস্থা বর্ণনা করা মনিটর ও দেয়ালের বোর্ড দেখে এগিয়ে গেল কামরার অন্য প্রান্তে যেখানটায় বিশাল কাচের জানালা। রাতের চেয়ে বেশি কালো হয়ে থাকা পাহাড়-গড়ানো কটনউড, সিকামোর আর রেডউড গাছগুলো দেখা যাচ্ছিল জানালা ছাড়িয়ে বেশ অনেকদূর পর্যন্ত। সে খুব নিচুস্বরে আপন মনে কিছু আওড়াচ্ছিল যার শেষটা শুনতে পেলাম ... চলিষ্ণু মেঘ, ঐ উঁচুতে, ঐ উঁচুতে, আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।

আমি, ‘ডাক্তার ডাক্তার’ বলে ডেকে উঠলাম। তারপর অস্ফুটে বলে উঠলাম, নিজের কবিতাটাও ঠিক করে বলতে পারছেন না? আমাদের বুদ্ধদেব বসু আপনার কবিতা সংকলন ‘শয়তানের ফুল’ কে অনুবাদ করে লিখেছিলেন ‘ক্লেদজ কুসুম’, এটা নিয়ে প্রায়ই ভাবি আমি।

ডাক্তার ধীর পায়ে আমার বিছানার পাশে এসে কোমল কণ্ঠে বললেল, আপনার শরীরটা দুর্বল, আপনি ক্লান্ত। ঘুমের ওষুধের কথা আবার বলে দিচ্ছি। চটপট বলুন আর কী করতে পারি আপনার জন্য। ডাক্তারকে ঘাবড়ে দেবার ইচ্ছে থেকে বিরত হলাম। ভাবলাম বলি, ডাক্তার, স্নানঘর থেকে সামান্য অব্যবহৃত কয়েকটা টয়লেট পেপার রোল এনে দেবেন? তার বদলে বললাম, শুভরাত! চোখ বন্ধ হয়ে এলো।

কত রাত হল বুঝতে পারছি না। খচমচ শব্দে তন্দ্রা বা ঘুম কেটে গেল। নার্স এলেনাকে একটা ভারী কণ্ঠ বলছিল, ‘সকালে পেশেন্ট আরো বেশ কিছুটা ঠিকঠাক হয়ে উঠবে। আপাতত এখানে কিছু করবার নেই আর। কাল সকাল সকাল রিলিজ করে দিতে বলেছি।’ কোন রকমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সাদা কোটের ডাক্তারকে, তার বুকে লেখা বি. বসু। তিনি বললেন, ডঃ বোদলেয়ারের সাথে কথা হয়েছে আমার। কাল ছেড়ে দেব আপনাকে। আপনার স্পেশিয়ালিস্ট দেখবে আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি। তারপর ঠিক করা হবে আপনাকে নিয়ে ঠিক কোন পথে এগুনো যায়। এই বলে বি. বসু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, দরজা পর্যন্ত পৌঁছে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, ওহ্‌ আর একটা কথা, অনুবাদের ‘শয়তানের ফুল’ আর কাব্যানুবাদের ‘ক্লেদজ কুসুম’ কি এক ব্যপার? বুঝতে হবে যে, অনুবাদ আর কব্যানুবাদ এক নয়। যা হোক, নার্সকে বলে দিয়েছি আপনার এই সব নলটল খুলে দিতে। ঘোর কাটবে, আরাম হবে।

ঘুমিয়ে পড়বার আগে দেখলাম আমার বন্ধুর মত ছোটখাটো ভালো নার্স এলেনা, অবশিষ্ট আছে এমন কয়েকটা টয়লেট পেপার একটা পলিথিন ব্যাগে ভরছে, মনে হল সেটা আমারই জন্য ।


মাস তিনেক পেরিয়ে গেছে এর মধ্যেই। ভাল আছি, শরীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত শনিবারে গ্যারেজে তিনটে বড় কাগজের বাক্স ভর্তি জমানো সামান্য অব্যবহৃত টয়লেট পেপার রোল দেখতে পেয়ে বিব্রত হলাম। রেবাকে দেবার জন্য ধীরেসুস্থে জমিয়েছিলাম ওগুলো অথচ সেই সব যে দিয়ে আসব বলেছিলাম সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আজ তিরিশ মিনিট আগেই অফিসে এসেছি। গাড়ির ট্রাঙ্কে রেখেছি কাগজের বাক্সগুলো। এগারো মাস পুরনো রেবা হান্টিংটনের সার্ভিস অর্ডার খুঁজে তাঁর ঠিকানা বের করে নিলাম। আবার দেখা হবে বলেছিলাম রেবাকে। সেই কথা এতদিনেও রাখতে না পেরে কেমন যেন ছোট ছোট লাগছে নিজেকে। সোমবার, তবু অফিস শেষ করে রেবা হান্টিংটনের মোবাইল পার্কের ঠিকানায় চলে গেলাম। ঘন্টাখানিকের ধাক্কা মনে রেখেই গিয়েছিলাম কিন্তু কাজ হল না । দেখলাম রেবার জায়গায় নতুন এক খিটমিটে বুড়ো। রেবা সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না। হতাশ হলেও হাল ছাড়তে ইচ্ছে হলো না।

বুধবার রেবার মোবাইল পার্কের খুব কাছে থেকে একটা কল শেষ করে আর দুপুরের খাবার বিরতিটা জলাঞ্জলি দিয়ে চলে গেলাম রেবার মোবাইল পার্ক লিজ অফিসে। রেবার নতুন ঠিকানাটা পাওয়া গেল, সেটা ছিল একটা সমাধিস্থলের ঠিকানা। ছ'মাস আগেই মারা গিয়েছে রেবা হান্টিংটন। লিজ অফিস বলল যে, রেবার মেয়েটি শেষ মাসের ভাড়া মেটাতে এসেছিল, সে রেবার সম্পত্তি বলতে গেলে কিছুই নেয়নি, তবে নিয়েছিল শুধু কটা প্লাস্টিকের পুতুল, আঠার ব্রাশ, পুতুলের জামা আর কিছু পুরনো টয়লেট পেপার রোল। বাকি সব দান করে দিয়েছিল স্যালভেশন আর্মি ও গুডউইল নামের দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। ব্যবস্থাটা রেবার মেয়ে মেরী সম্ভবত তাঁর মায়ের নির্দেশেই করেছিল। আমার নিজের উপর বেশ রাগ হল।


শনিবার সকালে মেরীর সাথে আমার দেখা হয়ে গেল রেবার কবরস্থানে। ওর হাতে চারটে টয়লেট পেপারের রোল রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা, তার ওপর ছোট্ট নতুন জামা পরা পুরনো বারবি ডল বসানো আর সেই বারবির হাতে একগুচ্ছ ডেইজি। মেরী রেবাকে এগুলো নিবেদন করে মুখ ফেরাতেই আমাকে দেখতে পেয়ে ম্লান অথচ স্নিগ্ধ করে হাসল। অপূর্ব গভীর নীল চোখ তাঁর, ভারি মায়াময় ছোটখাটো মানুষ সে। আমার জ্যাকেটে কোম্পানি লোগো দেখে বলে উঠল, তুমি নিশ্চয় এ. আর.? মা বলেছিল তুমি আসবে। তুমি নাকি তাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে, তুমি এক হাজারটা সামান্য ব্যবহৃত টয়লেট পেপার এনে দেবে। এ নিয়ে আমি মা'র সাথে হাসাহাসি করেছিলাম। সম্ভবত সেটা উচিৎ হয়নি আমার। এই বলে আবার একটু হাসল মেরী। তার নীল চোখের দ্যুতি কি তার মায়েরই মতন? বললাম, আমি অবশেষে এনেছি প্রতিজ্ঞার পেপার রোলগুলো, গাড়িতে আছে। মিজ হান্টিংটনকে তো দিতে পারলাম না, তুমি কি অনুগ্রহ করে সেগুলো নেবে?’

মেরী ডান হাতটা দিয়ে সূর্যটাকে আড়াল করে যেন আকাশের দিকে চাইল, হয়তো আকাশের নীলকে গ্রহণ করেই ওর চোখ এমন নীল হয়েছে। তারপর চাইল মা’র কবরের দিকে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, তুমি নিজেই জানো কী করতে হবে। দেখা হবে। এই বলে মেরী হাঁটতে শুরু করল, যতক্ষণ না সে কবরস্থানের গেটটা পার হয়ে ততক্ষণ আমি তাকে দেখলাম।

একা হতেই নীল আকাশের দিকে তাকালাম। কেন যেন মনে হল মেরী’ও মৃদুকণ্ঠে বোদলেয়ার আওড়াচ্ছে, বলছে, I love the clouds the clouds that pass yonder the marvelous clouds। হয়তো উপলব্ধি করলাম তখন, “আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল” কাব্যানুবাদের মর্ম।

৫.

রবিবারগুলো স্পোর্টস বারে আর যাওয়া হয় না আমার। রেবার সেই চার্চের সুবিশাল উঠোনে দুপুরটা খুব প্রশান্তিময় মনে হয়। পুরনো জোড়া-দেয়া টয়লেট পেপার রোলগুলো অনেক মানুষই নিয়ে যায়। তাঁদের সবাই যে বাস্তুহীন মানুষ এমন মনে হয় না আমার। অনেক সময় নিয়ে আসি ডোনাট। আর কোনো কোনো শনিবার সকালে যাই রেবার সমাধিতে, নীল-চোখ কোনো একজনের সঙ্গে আবার যদি দেখা হয় তাকে বলব, আমাকে কিছু পুতুল জোগাড় করে দিতে, টয়লেট পেপার আর ডোনাট ছাড়াও মানুষ আরো তো কিছু চাইতে পারে।



লেখক পরিচিতি
কাজী রহমান
ঢাকায় জন্ম। 
বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোরনিয়ায় থাকেন। 
কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার। ব্লগার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ