ওই অপার্থিব বৃষ্টির মধ্যে আমি কখনো কখনো সুতপাকে লক্ষ্য করছিলাম। লক্ষ্য করছিলাম বলা হয়তো ঠিক নয় বরং বলা ভাল আমার অবচেতন আমাকে দিয়ে সুতপাকে লক্ষ্য করিয়ে নিচ্ছিল। বেঁটে, গোলগাল সুতপার পরনে সেদিন সুতির সূক্ষ্ম একটি শাড়ি। সাদা জমির ওপর বড়ো বড়ো শঙ্খের আকারে মেরুন কলকা। শাড়িটা একটি তীব্র সাপের মতো পা থেকে ওকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপরের দিকে উঠেছে যেন। তাতে ওর শরীরের সব ভরাট, স্তনের আঙিনা, পাছার চাতাল দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল।
দেখছিলাম রাশি রাশি শালফুল ওর মাথায় পড়ছে। কখনো কাঁধে। কখনো হাতের নাদুসনুদুস আঙুলে ধাক্কা খেয়ে বা গাঁটের ভাঁছে কয়েক মুহূর্ত আটকে থেকে ঝরে মাটিতে পরছে। কেউ কেউ আবার পাছার চাতালে আটকে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মাটির নাগাল পাচ্ছে। জয়দের আর নার্গিসও ভিজছিল এই বৃষ্টিতে। জয়দের কাঁধে বেশ লম্বা। পেটানো চেহারা। ঠোঁট বেশ পুরু আর প্রস্থে মোটা। এমন ঠোঁট দেখলে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে মানুষটি ন্যাক্কারজনকভাবে আত্মকেন্দ্রিক। যেন একগ্লাস দুধ দিলে তার শেষ বিন্দুটিকেও শুষে নিতে ছাড়বে না। কিন্তু জয়দেব একেবারেই এর বিপরীৎ। ওর গলার স্বর সরু। মেয়েদের মতো আবেগপ্রবণ।
নার্গিস ছিপছিপে। কী কারণে যেন ওর হাতের মাংস ঢিলে। মানে কাঁধের সমান্তরালে যদি কোনো চেয়ারের পিঠ বা গাছের ডাল থাকলে, তা ও যদি হাত বাড়িয়ে ধরে তাহলে ওর হাতের অস্থি থেকে মাংস যেন কিছুটা নীচে ঝুলে পড়বে। নার্গিসও শাড়ি পরে ভিজছিল। মাঝে মাঝেই ও বাচ্ছাদের মতো দু’হাত ওপরে ছড়িয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে দেখছিল। শালফুল ওর একটু চ্যাপ্টা মুখে রাশি রাশি ঝরে পড়ছিল। শালফুল কখনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মুখে চলে গেলে ও থুঃ থুঃ করে সেগুলো ফেলে আবার উদ্বাহু হচ্ছিল।
সুতপার সঙ্গে তখন আমার সম্পর্কের একটা তিক্ততার চরম। কোনো সময়েই, কোনো সুচিন্তিত যুক্তির প্রেক্ষাপটেও আমি ওকে মেনে নিতে পারছি না। ঢালুপথে গড়িয়ে যাওয়া জলের মতোই প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি সেকেন্টে যেন আমাদের সম্পর্কটা আরও আরও কটু তিক্ততার দিকে গড়িয়ে চলেছে। অথচ আমরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করেছিলাম। হৃদয়ের যেটুকু দেওয়া যায়- তা দেওয়া-নেওয়া করেছিলাম। সুতপার ঠোঁটের স্বাদ আমার জানা ছিল। ওর ঘামের নুনও আমার জানা ছিল। ওর লালার উষ্ণতা আমার জানা ছিল। সুতপারও হয়তো তাই। আমার নগ্ন শরীর ও আন্দাজ করতে পারত, যেমন আমি পারতাম। তবুও যে তিক্ততার সূত্রপাত হয়েছিল, তা হয়তো আমাদের দু’জনেরই অতি কঠোর এথিক্যাল পলিসির জন্য হয়েছিল। যা একসময়ে জীবনে এমনভাবে হারিয়ে যায় যে, পরে সেসব ভাবলে নিজেকে বা ঐরকম সবাইকে প্যাটপেটে চোখের একটা গাধার মতো মনে হয়।
ধরা যাক একটি কাপ উল্টে গ্যালো। আমি বললাম ‘আরে ছেড়ে দাও একটা কাপই তো ভেঙেছে শুধু, আর তো কিছু ভাঙেনি। এমন তো কতই হয়।‘ প্রত্যুত্তরে সুতপা বলবে ‘তাই বা হবে কেন? আরেকটু কি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল না আমাদের?’ এইভাবে আমাদের সম্পর্কটা তিক্ত হয়ে উঠে আরও তিক্ততার দিকে সজোরে গড়িয়ে যাচ্ছিল। আমরা যে যার অবস্থান আঁকড়ে ধরে সম্পর্কটাকে ওভাবে গড়িয়ে যেতে দিচ্ছিলাম।
হাওয়াবদল ক্লিশে স্বাস্থ্য ফেরানোর জন্য প্রচলিত কিন্তু সম্পর্কের স্বাস্থ্য ফেরাতে তা কতখানি উপযোগী, তা আমরা জানতাম না। তবু কী এক কারণে সেই সম্ভাবনাতেই আমরা হাওয়াবদল করতে এসেছিলাম এই টাঁড়ের দেশে। তখন মার্চের প্রচণ্ড গরম। তাও এসেছিলাম। আমি সুতপা জয়দের আর নার্গিস।
রুক্ষ একটা টিলার ওপরে ছিল আমাদের লজটা। দোতালা। ওপরে বারান্দায় সারি সারি থাকার ঘর। নীচের ঘরগুলি তালাবন্ধ। হয়তো ওগুলি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার হয়। লজের চত্বরে অনেক শালগাছ। লজ ছাড়ালে যে ঢালু হয়ে নেমে-যাওয়া জমি তাতেও ঘন শালের বন। কোনো কোনো দূরের টিলায় আবার পলাশ গাছের ভীড়। তার মাথায় লাল আগুনের মতো পলাশ ফুটে আছে। বিকেলের রোদে এই বনের মাথা সবুজ দেখায়। আরও দূরে কোনো পাহারের মাথা নীলাভ। বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতো টিলার গায়ে এই লজটা। কাছাকাছি বাজার নেই, লোকবসতি নেই। বাজার আছে ঢালুপথ বেয়ে কিছুটা হাঁটলে তারপর। লোকবসত আছে দূরে যে শাল-পলাশের জংগল- তারই মধ্যে কোথাও। যে রুক্ষ লাল রাস্তা ধরে এখানে আসা যায়, তার শুরুতে একটুকরো বাজার। সেখানেই বাস থামে।
আমরা দুইজোড়া মানুষ-মানুষী দুটো আলাদা ঘর নিয়েছিলাম। সেসময় আমরা ছাড়া ওই লজে তখন আর কেউ নেই। লজের কর্মীরা ছিল অবশ্য। আর ছিল লজের চত্বরে মোটা মোটা চকচকে ঘাস, তাদের গায়ের গন্ধে উড়ে আসা রঙিন ফড়িং আর চারপাশে নিশ্চুপ শালগাছের প্রহরা। আর ছিল বাতির খুঁটি। একটা গেট। সেখান থেকে লজ অবধি যাবার নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তা। আর কতগুলি কালো কালো ফাইবারের খালি ড্রাম। কিছু ফুলগাছ। চত্বরে এককোণে শালগাছের নীচে পাতা দড়ির খাটিয়া। আর অজস্র ঝরা পাতা। তার ফাঁকে কখনো কখনো পিঁপড়ে। আর গরম হলকা পিঠে নিয়ে উড়ন্ত বাতাস।
উপরে বারান্দায় উঠে নার্গিস দেখলাম একবার এ মাথা-ও মাথা হেঁটে বেড়াল। কী যেন দেখল চুনকাম করা ছাদে, দরজার ওপরে কুতকুতে ভেন্টলেটরগুলোয়। তারপর বলল ‘আমরা এই ঘরটা নেব।‘ লজের কর্মী আমাদের জন্য পাশাপাশি দুটো ঘর খুলে দিয়েছিল। দুটো ঘরের চেহারা একইরকম। ক্রিম-রঙা দেওয়াল। ভেতরে ডাবল বেড। দরজায় পাল্লায় ভোঁতা ডাইস, তাতে চকচকে নীল রঙ করা। জয়দেব আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম ‘অবশ্যই।‘
দুপুরে খাবার খেয়ে আমি দেখলাম সুতপা নাইটি পরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। খাটো হাতার নীচ থেকে বেরিয়ে ওর দুটো বাহু একটা বালিশ আঁকড়ে চুপ হয়ে আছে। নাইটির বহরের পর ওর ভীষণ প্রসাধনহীন দুটো পা। তাতে টাইট কালো লোম। ঘরেই বাথরুম। আমি বাথরুম সেরে এসে একটা চেয়ারে বসলাম। বিছানায় গেলাম না। বসে দেখলাম ঘরটায় আলো-বাতাস খেলছে। বেঁটেখাটো গোলাগাল সুতপা বিছানায়। দেওয়ালে শ্রীকৃষ্ণের এক-পা দোমড়ানো বংশীবাদক ছবি। তার গায়ের রঙ নীল। নীচে লেখা মা সারদা টাইলস।
অনেক কথা সুতপাকে বলব বলে মনে মনে একটা মহড়া দিয়ে এখানে এসেছিলাম। দুজন একলা হতেই বুঝলাম মহড়ার প্রভাব এখানে কারও মধ্যেই বুঝি নেই। এখানে এসে আমরা জমাট এক নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ঢুকে পড়েছি, যে নৈঃশব্দ্য আমাদের এখানে আসার আগে ছিল না।
খানিকক্ষণ নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ গোনার পর সুতপা বালিশে থুতনি চেপে যেন আপনমনেই বলল ‘অকারণ চেষ্টা করছ অনীক। আমাদের রিলেশনটা টিকবে না। আমি বুঝতে পারছি টিকবে না।‘
-‘দ্যাখো, রিলেশন টেকা বা না-টেকার অনেকখানিই নির্ভর করে নিজেদের ওপরে। চাইলে এখনো সবকিছু সম্ভব করে ফেলা যায়। যায় না?’
-‘তুমি আমাকে একদিন একটা কাপ ভাঙার উদাহরণ দিয়েছিলে, মনে আছে?
-‘মনে আছে। মনে থাকবে না কেন? সেইজন্যেই তো বলছি কিছুটা সরলে এখনো সবকিছুই পসিবল।‘
-‘ছাড় এসব কথা। তোমার নতুন বন্ধুটির কথা বল। শ্রীরূপা বোধহয় নাম না মেয়েটির?’
-‘হ্যাঁ। বন্ধুত্ব হওয়া কি অপরাধ?’
-‘একদমই না। আমরাও তো বন্ধুই এখনো, নয়?
আমি চট করে খুঁজে পেলাম না এর উত্তরে ঠিক কী বলব। তবে সুতপা শ্রীরূপার প্রসঙ্গ তোলায় আমার মনে তেতো একটা ঘেন্না এল। মেয়েরা কেন যে এমন ঈর্ষাকাতর হয় আমি জানি না। শ্রীরূপা নিছকই আমার বন্ধু। ভাল ছবি আঁকে ও-ও। দেখলাম সুতপা ওর কলির মতো আঙুলগুলি চালাচ্ছে ওর চুলে। মনে হল সুতপা কি এভাবেই আমাকে বিষাক্ত হুল ফোটানোর পরিকল্পনা করেই এসেছে? ঘরে ফুরনো রোদের গন্ধ। সিলিংয়ে যে পাখা ঘুরছে- তার গন্ধ। বললাম ‘তুমি কি মনে কর? আমরা শুধু বন্ধুই?’
-‘তোমার সেই ছবিটা খুব ভাল হয়েছিল। সেই যে একটি মেয়ে মাথা গোঁজ করে ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। একটি চোখ দেখা যাচ্ছে মেয়েটির। শরীরটা দেখে মনে হয় শুকনো বাঁশের বেড়ায় তৈরি। যেন এখুনি ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে। তুমি এখনো ওরম ছবি আঁকো?’
-‘ঠাট্টা কোরো না সুতপা। তুমি জানো এখন আমি ছবি আঁকতে পারছি না। বহু কাজ জমে আছে আমার হাতে।‘
-‘তো কাজগুলি করে ফেল। প্রফেশানটা তো প্রফেশানই। তোমার ব্যক্তিগত তাপ-উত্তাপে প্রফেশান কেন হ্যাম্পার্ড হবে?’
-‘আমি ছবি আঁকতে পারছি না। কেন পারছি না তুমি জান।‘
এর উত্তরে সুতপা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। দরজায় টোকা দিয়ে নার্গিস বলল ‘আসতে পারি?’
আমি উঠে দরজা খুলে দিতেই নার্গিস ঢুকে বলল ‘তোমাদের গুটুর গু-তে ডিসটার্ব করলাম। সরি গো।‘
ময়ূরকণ্ঠী রঙের একটা জামা পরে আছে নার্গিস। ওর স্তনগুলো বোঝাই যাচ্ছে না। সুতপা হুড়মুড় করে উঠে বসে বলল ‘দারুণ তো, আগে দেখিনি। কবে কিনলি?’
-‘এখানে আসার আগে।‘
-‘ও, তলে তলে ভালই গুছিয়ে এসেছিস। জয়দেব কী করল? চুমুটুমু খেল তোকে? জয়দেব তো আবার চুমু খাবার আগে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে দেখবে। বাজেট, সংসদ, বিরোধী জোটের অবস্থান এইসব।‘
হিহি হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল নার্গিস। বলল ‘সত্যি, বিছানায় গিয়ে আমি ওর গলা জড়িয়ে ধরেছি, ও ওর ফাঁকেই হাতে মোবাইল অন করে ইউটিউব চালিয়ে বলল ‘শক্তির একটা স্বকণ্ঠে কবিতাপাঠ শোনো।‘ বলে ইউটিউব চালিয়ে শক্তি চট্টোপ্যাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে ও-ও বলতে শুরু করল ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়’- ভাব তো? আমি ওকে আদর করব ভাবছি আর ও বলছে ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়’ যা-তা কি না বল?’
সুতপা দেখলাম ফুলে ফুলে হাসছে। আহ্, কতদিন পরে আমার সামনে এভাবে ওকে হাসতে দেখলাম। সুতপার দাঁতের সেটিং খুব সুন্দর। কখনো কখনো তা আমার নজরে পড়ল।
নার্গিস বলল ‘অ্যাই অনীকদা, চলো চা খেয়ে একটু বেড়াতে যাই। এমন জংগল, রাতের অন্ধকার, শুড়িপথ কী অ্যাডভেঞ্চারাস বল? চল বেরোই। আমার এভাবে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই কি না বল সুতপাদি?‘
চকিতে দেখলাম সুতপা আমার ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর পায়ের দিকের নাইটি গোছাতে গোছাতে বলল ‘হ্যাঁ, চল। ঘরে খুব আবদ্ধ লাগে। মনে হয় হাতড়ে হাতড়ে কোথাও কিছু পাচ্ছি না।‘
আমি নার্গিসকে একঝলক দেখলাম। নিজের বুকের ওপরে ঝুঁকে আছে। পাতলা ছিপছিপে চেহারার মেয়ে। হাতের মতোই গালেরও মাংস ঢিলে। ও মুসলিম। মুসলিম হলেও জয়দেবের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে। নার্গিসের বাবা রেলে চাকরি করেন। ওর একটা ছোটো ভাই আছে। কোলকাতায় থেকে পড়াশোনা করে। নার্গিসের একটা সুন্দর রুচিশীল মন আছে- যার আলো ওকে ছেয়ে থাকে সবসময়।
লজের বাতিগুলো সব জ্বলে উঠেছে। এখন চারপাশে সব অন্ধকারে ডোবা। এই লজটি ছাড়া আশেপাশে কোথাও হয়তো বিদ্যুত নেই। থাকলে তার জুগজুগে আলো এই দূরব্যাপী অন্ধকারে কোথাও না কোথাও চোখে পড়ত। লজ পেরিয়ে আমি দূরে তাকালাম। অন্ধকারে দূরের টিলা, পলাশ-শালের জংগল কিছুই চোখে পড়ল না। শুধু ফিকে স্লেট রঙের আকাশের ব্যাকড্রপে উঁচু-নীচু, ঢেউতোলা কালো অন্ধকারের স্তুপ। অন্ধকারের প্রকৃতি বোধহয় স্থানভেদে আলাদা হয় না। শহরের অন্ধকার আর এই টাঁড়দেশের অন্ধকার একইরকম।
আমরা গেট পার হলাম। লজের একজন আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল এই বলে যে, জংগলের রাস্তা অন্ধকার। গরমকাল বলে সাপখোপের উপদ্রব থাকতে পারে।
সত্যিই তাই। লজের টিলা বেয়ে রাস্তাটা ঢালু হয়ে গড়িয়ে জংগলের মধ্যে চলে গেছে। আকাশে মেঘের পেছনে একটি মরা চাঁদ। জয়দেব আর আমি মোবাইলের টর্চ জ্বেলেছিলাম। টর্চের আলোয় রাস্তার পাশে ধুলোট ঝোপঝাড় আর বড়ো বড়ো শালগাছের বাকল চোখে পড়ছিল। শুকনো পাতা ভেঙে আমরা হাঁটছিলাম। সেই পাতা ভাঙার শব্দ হচ্ছিল। হঠাৎ নার্গিস বলল ‘অ্যাই, এসব কী? এসব কী পড়ছে গায়ে? পোকামাকড় নাকি? এই জয় দ্যাখো না আলো ফেলে!’
জয়দেব আলোটা ওপরে ঘোরালো। ব্যাপারটা টের পেয়েছিলাম আমরাও। কী যেন অন্ধকারে অবিরাম ঝরে পড়ছে আমাদের গায়ে। আলোর অভিমুখে তাকিয়ে দেখলাম মাথার ওপর গাছের চাদোয়া। সেই চাদোয়া থেকে অসংখ্য ক্ষুদে ক্ষুদে সাদা ফুল ঝরে ঝরে পড়ছে আমাদের গায়ে। শালফুল। টের পেলাম গরম হলেও বেশ শীতল একটা হাওয়া শিরশিরিয়ে চলে যাচ্ছে জংগল দিয়ে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি হবে। গাছের ঘন চাদোয়ার ফাঁক দিয়ে বহুদূরে কোথাও নিঃশব্দে একটা বিদ্যুতের রেখা চকমকিয়ে উঠে নিভে গেল- দেখতে পেলাম। হাওয়ার আঘাতে ফুলগুলি ঝরছে। নার্গিস চিৎকার করে উঠল ‘বিউটিফুল! ফ্লাওয়ার রেইন! সুতপা দেখলাম মাটি থেকে দু-একটা ফুল কুড়িয়ে নিল আনমনে। জয়দেব অস্ফুটে বলল ‘এ জিনিস চোখে না দেখলে ভাবা যায় না। দিনের আলোয় এ আরও কী অপূর্ব হবে ভেবে দ্যাখো। আমাদের দেশ এখনো কী সুন্দর!‘
সে রাতে কেন জানি উদ্ভট একটা স্বপ্ন দেখলাম। সেই মোবাইল টর্চের আলোয় দেখা ক্ষুদে ক্ষুদে সাদা ফুলে ঢাকা রাতের শালগাছে সুতপা, জয়দেব আর নার্গিস চড়ে বসে আছে। ওরা বসে বসে গাছে দোল দিচ্ছে আর বৃষ্টির মতো অসংখ্য সাদা ফুল ঝরে পড়ছে আমার ওপর। আমি কী বলে যেন চিৎকার করছি। চিৎকারের বদলে আমার গলা দিয়ে কীসব কালো কালো পাখি উঠে এসে উড়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এখানে জানিয়ে রাখি আমি আর সুতপা এক বিছানায় শুলেও সুতপার একটি ব্যাগেজ মধ্যেখানে দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের মতো রাখা ছিল।
২.
সত্যি বলতে কী, এখানে এসে সুতপার দিক থেকে এমন শীতল নিস্পৃহ ব্যবহার আশা করিনি আমি। মনে মনে যেকোনো চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্যেও প্রস্তুত ছিলাম। সম্পর্কের পুষ্টিকরণে কখনো দেহ বা রক্তমাংসেরও একটা ভূমিকা থাকে। ভেবেছিলাম, তেমন যদি হয় তো হয়ে যাক। বিশ্বাস বা নির্ভরতারও একটা অবলম্বন দরকার। কখনো সেটা এই ক্ষুধাকাতর দেহও হতে পারে। তবে পাশাপাশি এও জানিয়ে রাখি, এখানে একেবারে নির্জন হয়েও আমার সুতপাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে হয়নি। বরং অজানা একটা ভয় এই প্রসঙ্গে মনে থিকথিক করেছে। আমি জানি না এটাও আমার এথনিক পলিসির একটা চতুর ছদ্মবেশ কি না। প্রথমদিন দুপুরে আমাদের রুমে যখন সুতপাকে দেখছি বিছানায় খোলামেলা হয়ে পড়ে আছে, নাইটির বহর থেকে ও ভীষণ প্রসাধনহীন পা-দুটো বেরিয়ে আছে কিম্বা খাটো হাতার নীচ থেকে বেরোনো কাঁচা বাহু- আমার ভয় হয়েছিল। ছুঁতে গিয়ে কোনো জিনিসকে ভঙ্গুর করে ফেলার এক শিরশিরে ভয়। অথবা তাও হয়তো নয়, আরও অন্য কোনো দুর্ঘটনার ভয়। যে ভয়ের স্বরূপ আমি ধরতে পারছিলাম না।
ঘুম ভাঙল ভোরে। সুতপা দেখি এরমধ্যেই বাথরুম সেরে ঝকঝকে। জানালায় দাঁড়িয়ে চুল এলো করছে।
-‘ আজ কোথাও বেরোচ্ছি নাকি?’
-‘কই, নাতো! এমনিই সকালে স্নান করে নিলাম। যা গরম।‘
-‘সুতপা’ অপ্রত্যাশিত একটা গাঢ় স্বরে আমি ডেকেছিলাম। হয়তো এই গাঢ় স্বর ধাক্কা দিয়েছিল ওকেও। ও চকিতে জানালা থেকে বুকের ওপর একগাছি চুল নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
-‘কী মনস্থির করলে?’
-‘কী ব্যাপারে বলতো?’
-‘আমাদের সম্পর্কটার ব্যাপারে?’
-‘কই, কিছুই ভাবিনি তো। কাল সারারাত শুধু ভেবেছি ওই গাছ থেকে ঝরে ঝরে পড়া শালফুলগুলোর কথা। কী অদ্ভুত ছিল না? কী অদ্ভুত সুন্দর! যেন বৃষ্টি অথচ কেউ ভিজে যাচ্ছি না। আমার স্মৃতিতে খুব স্মরণীয় ঘটনা তেমন নেই। এই ঘটনাটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।‘
আমি চট করে বাসি হাতে ওর কবজি চেপে ধরলাম। ‘তুমি এমন সরে যাচ্ছ কেন সুতপা? এখনো সময় আছে। সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তুমি কেন এ-জায়গাটায় নিজেকে নিয়ে আসতে পারছ না? প্লিজ সুতপা, আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু বোঝো।‘
ওই কবজি চেপে ধরা অবস্থাতেই আমরা কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়েছিলাম। তারপর সুতপা আস্তে আস্তে মুচড়ে আমার হাত থেকে ওর কবজি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল ‘আমি সরে যাচ্ছি না কারণ সরে যেতে আমার কষ্ট হয়, এগোতে পারছি না কারণ এগোতে গেলেই আমার দ্বিধা আসছে।‘
-‘এখানে দ্বিধার কিছুই নেই সোনা। বলছি তো আমাদের সব, স-ব আগের মতো হয়ে যাবে। তুমি আমার পাশে যদি থাক। আমি কাজ করতে পারছি না, পাব্লিশিং হাউস থেকে আমায় চাপ দিচ্ছে। সবমিলিয়ে আমি উদভ্রান্ত হয়ে গেছি সোনা, জাস্ট উদভ্রান্ত! আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না! বিলিভ মি। প্লিজ বিলিভ মি! যা হয়েছে সব ভুলে যাও। চলো নতুন করে সব শুরু করি। এমন একটা রেজোল্যুশন কি নিতে পারি না আমরা? আজ থেকে? ঠিক এখন থেকে? প্লিজ সুতপা, প্লিজ!’
তখন সকাল আটটা/সাড়ে আটটা হয়তো হবে। বাইরে এর মধ্যেই রোদ খর। তবে বাতাসে শীতলতার একটা পরশ আছে যেন। সেই বাতাস ঘুরতে-থাকা সিলিং ফ্যানের পাখায় আটকে যাচ্ছে। দূরে একটা টিলার মাথা নীলাভ হয়ে উঠে আছে। লজ থেকে চা আসেনি তখনো। মানুষ যেভাবে অপ্রত্যাশিত সময়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হয়, তেমনই শিকার হলাম এই সকালে বন্ধ ঘরের মধ্যে আমরা দু’জন।
সুতপা সেই যে আমার একটা ছবির কথা উল্লেখ করেছিল, যেখানে একটি মেয়ে মাথা গোঁজ করে ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যার দেহটা দেখলে মনে হবে শুকনো বাঁশের বেড়ায় তৈরি, যেন এখুনি ঝুরঝুর করে খসে যাবে- আমার সামান্য হাতের টানে সুতপাও যেন তেমনই ঝুরঝুর করে খসে পড়ল বিছানায়। ওর ভেজা চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ, ওর পিঠে শিরদাঁড়ায় তখনো জলের কোমলতা, কোমলতা ওর স্তনের ভাঁজেও এবং নাভির চারপাশে। ও যখন ওর পা-দুটো দিয়ে আমাকে কোমরের কাছে এমন টাঁড়েদেশেরই কোনো প্রাচীন বিছের মতো কামড়ে ধরেছে, যখন আমি জলধির মতো ওর মধ্যে ডুবে যাচ্ছি আবার ভেসে উঠছি, শুনলাম পাশের ঘর জয়দের ইউটিউবে আবার কোনো শিল্পীর অডিও চালিয়েছে।
‘আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;
তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পিছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
আমার বুকে মাথা পেতে সুতপা অনেকক্ষণ শুয়েছিল। কেউই কোনো কথা বলছিলাম না। অন্য ঘর থেকে নার্গিসের গলা পাচ্ছিলাম। নার্গিস বলছে ‘জয়, সবসময় তোমার এসব কিন্তু আমার ভাললাগে না। তুমি কি আমার কিছুই বোঝো না? না, এসব কী বলতো? বেড়াতে এসেছি তো! জয়ের কণ্ঠস্বর পেলাম। দেখি ও বলছে ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়, পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে’ বলতে বলতে গলাটা দূরে সরে গেল। বোধহয় বাথরুমে গেল জয়। নার্গিসের আওয়াজ পেলাম ‘ঈ-ঈ-ঈ-ঈ’ শব্দে।
দুপুরে ঢালুপথ বেয়ে আমরা অন্যদিকের একটা রাস্তায় গেলাম। এই রাস্তাটিও আগের দিনের রাস্তাটিরই মতো। লাল রুক্ষ। মাঝখানে গাছি গাছি তামাদি হয়ে যাওয়া ঘাস। টিলা থেকে নেমে ঘন শালের জংগলে ঢুকে পড়েছে। তেমনই কাতারে কাতারে শুকনো পাতায় ছাওয়া। দু-পাশে ধুলোট ঝোপঝাড় আর আকাশচুম্বী সব প্রাচীন শাল। মাথাগুলো এই দিনের আলোয় দেখলাম একেবারে ফুলে ফুলে সাদা। যেন মুকুট পরে আছে। সেই মুকুট থেকে মণিমাণিক্য ঝরছে ঝুরঝুর। কেমন একটা অন্যমনস্ক হয়ে এলোথেলো হাঁটছিলাম আমরা সবাই। আমার পাশে নার্গিস। কী কারণে যেন চুপচাপ। পিছনে সুতপা। সবশেষে হাতে মোবাইলের ক্যামেরা অন করে জয়দেব। আমি আর নার্গিস একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ নার্গিস আমার হাত ধরে বলল ‘তাহলে তোমাদের ঝামেলাটা মিটে গ্যাছে তাই না?’
আমি বুকের ভেতরে চমকে উঠলাম। নার্গিস কি কিছু আঁচ করতে পারল? পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা কী গাছের মাথায় হাতের মোবাইল তাক করে ধরে রেখেছে জয়দেব। ও একটা হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে। পাঞ্জাবির কাঁধে সাদা সাদা শালফুল। কিছুটা দূর থেকে সুতপা ওকে কিছু একটা বলছে। আমি নার্গিসের দিকে তাকালাম। ওর মুখে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বুড়িয়ে যাবার ছাপ আছে। কোথেকে চুলে একটা পলাশ গুঁজেছে ও। শাড়ি পড়েছে ও-ও। পায়ে বেশ উঁচু সোলের স্যান্ডেল। বুক পেঁচিয়ে আঁচল তুলে দেওয়ায় ওর বুক মনে হচ্ছে ইস্তিরি করে সমান করে দেওয়া। আমি বললাম ‘কেন বল তো?’
-‘এমনিই। আমরা চাই তোমাদের ঝামেলাটা মিটে যাক। সুতপাদি তোমাকে খুব ভালবাসে। তোমাকে হারানোর কষ্ট ও সামলে নিতে পারবে না। মেয়েদের এই ব্যাপারটা মেয়েরা বোঝে। অন্তত এই জায়গাটায় পৃথিবীর সমস্ত মেয়েরা এক।‘
নার্গিসের এই কথার পরে আমি কিছু বললাম না। ফলে হঠাৎই যেন চারপাশের নিস্তব্ধতাটা ভীষণ প্রকট হয়ে উঠল। চারপাশে গাছে গাছে নানারকমের পাখি ডাকছে। পাতাপল্লবের ফাঁক দিয়ে বাতাস বয়ে যাবার শব্দ। মৃদু ঝিঁঝিঁরও শব্দ পেলাম কোথাও। টের পেলাম এই যে অবিরাম তুষারকণার মতো শালফুলগুলি ঝরছে, এরও একটা ভীষণ ধীর শব্দ আছে। আর টের পেলাম প্রচণ্ড গরম। সূর্য যেন গলে গলে পড়ছে । কিছুক্ষণ পর বললাম ‘ঝামেলাটা মেটাতে সত্যিই আমি চাই। সুতপাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারব না।‘
শুকনো পাতা ভাঙার মসমস শব্দ পেতেই দেখলাম সুতপা এগিয়ে আসছে। সাদা সুতির একটা শাড়ি পড়েছে ও। জমিতে শঙ্খের আকারের বড়ো বড়ো মেরুন রঙের কলকা। কেন জানি না এমন একটি সময়, কোনো কার্যকারণ ছাড়াই হঠাৎ সুতপার প্রতি আমি একটা প্রবল, প্রায় দুর্নিবার যৌন আকর্ষণ অনুভব করলাম। লক্ষ্য করলাম ওর স্তন, ওর কোমরের প্রস্থ, শাড়িতে মোড়া পাছা- যা গত কয়েকটি ঘণ্টায় একবারও আমাকে আক্রমণ করেনি। এর একটি কারণ হতে পারে সকালের ঘটনাটার পর আমার অবচেতনে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। কোথাও হয়তো-বা একটা দূরে চলে যাওয়া প্রশান্তি ফিরে এসেছে। নয়তো আরও একবার সুতপার শরীর উপভোগ করার তৃপ্তি- তা আমার অজ্ঞাত কোনো প্রতিহিংসার একটি অংশ পূরণ করেছে।
-‘এই জয়দেবকে সামলাতো! দ্যাখ না কিসব ফুলের ছবি তুলবে দেখে সেই কখন থেকে মোবাইল তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কতবার তুলল, কোনোটাই ওর পছন্দ হচ্ছে না।‘
-‘আমি কী করব বলতো? ও কোনোকিছু কখনো শোনে? দ্যাখো তো?’
-‘অ্যাই, আজ সকালে ওকে আদর করলি?
-‘তুমিও যা সুতপাদি! ও আদরের ইশারা বোঝে? না প্রয়োজন বোঝে? তবে আমাদের হোক বা না হোক, কেউ তো পেয়েছে।‘ বলেই মুচকি হাসল নার্গিস। ওর এই হাসিটাকে কেন জানি না আমার খুব কৃত্রিম মনে হল। কুৎসিত মনে হল ওর ঝুলে পড়া গালের মাংসসহ মুখটাকে। ওর নাকে বা গোঁফের জায়গায় যে ঘামের বিন্দুগুলি ফুটে উঠেছে, সেগুলোকে।
এদিকে দেখলাম চকিতে যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল সুতপার মুখ। একেবারে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলাম না কী ঘটে যাচ্ছে ওর মনের ভেতরে। আবার একটা অজানা ভয়ে আমারই শরীরের কোনো শিরা যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ তখন শুনলাম জয়দেব কী বলতে বলতে যেন এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই শুনতে পেলাম ও বলছে সময় বহিয়া যায় জলের স্রোতের মতো। চল, আরও এগিয়ে চল, আরেকটু এগোলে কালকের মতো ওমন ফ্লাওয়ার রেইনের একটা জায়গা পাব। ওই যে ঐখানটায়, দ্যাখো।
আমি দেখতে পেলাম উদ্দিষ্ট জায়গাটি। সরু রাস্তাটা সেখানে গিয়ে একটু ছড়িয়ে পড়েছে। চারপাশে সেই বৃত্তাকার জায়গাটিকে ঘিরে মোটা বড়ো বড়ো ঘন শাল। রাস্তার লাল রুক্ষ মাটি দেখাই যাচ্ছে না। শালফুল ঝরে ঝরে একবারে একটা গালিচাই যেন তৈরি হয়েছে। ঝোপঝাড়ের গোড়ায় কিছু পুরনো বিস্কুট বা পোটাটো চিপসের প্যাকেট আটকে আছে। দোমড়ানো জলের বোতল। একটি ছেঁড়া বহু পুরোনো কারও হাওয়াই স্যান্ডেল। গরম একটা হাওয়া চলছে। মিহি শব্দে অগণন শালফুল ঝরে ঝরে পড়ছে ওখানে। অপরূপ লাগছিল দৃশ্যটা দেখতে। গতকাল নার্গিস বলেছিল ফ্লাওয়ার রেইন। সত্যিই তাই।
জয়দের ধুচমুচ করে আগে আগে এগিয়ে গেল। ওকে পায়ে পায়ে অনুসরণ করলাম আমরা। এখন আমার আগে নার্গিস। আমার ডাইনে সুতপা কেমন যেন মন্থর। আমি ওর কানে মুখ এগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম ‘কী হল?’
-‘কিছু না, শুধু নিজেকে খুব খাটো মনে হচ্ছে।‘
-‘কেন?’
-‘আমি জানি না, আমি জানি না।‘
পায়ে পায়ে আমরা সেই পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে এসে দাঁড়ালাম। কী অবাঞ্ছিতভাবে এই সুন্দর সময়টা নষ্ট হয়ে গেল তাই ভাবছিলাম। সুতপার সহজ বিষয়ে গোঁয়ারের মতো বাড়াবাড়ি। নার্গিস যা বলেছে, তাতে এমনকিছু মারাত্মক অন্যায় হয়ে যায়নি। এই ওর এক দোষ। কখনো কখনো তা সহ্যের অধিক মনে হয়।
জয়দেব হঠাৎই হাত তুলে অনেকটা ক্লাবে বা রেস্তোরাঁয় যেভাবে কোনো এনগেজমেন্টের ঘোষণা হয়, সেভাবে বলল ‘তোমাদের একটা কথা জানাই। খবরটা আজই সকালে আমি পেয়েছি। আমাদের বন্ধু শৌনককে পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে মানে, ওর ডেডবডি পাওয়া গেছে। একটা পচা ডোবার মধ্যে। জলে-কাদায় পচে গিয়ে ঘুলঘুলে হয়ে গেছে ওর লাশ। পুলিশ লাশটা উঠিয়ে মর্গে পাঠিয়েছে। তবে আমি জানি শৌনকের এই মৃত্যুরও কোনো কিনারা হবে না। এমনিভাবে লাশের পর লাশ মর্গে জমতে থাকবে, কারও মৃত্যুরই কোনো কিনারা হবে না। ধিক্কার রাষ্ট্রযন্ত্র, ধিক্কার বুর্জোয়া বিপ্লব! ‘
জয়দেব থামল। মিহি সিমসিম একটা শব্দে শালফুল ঝরে ঝরে পড়ছিল আমাদের ওপরে। অবিরাম। আমাদের মাথায় কাঁধে চুলে কখনো সেগুলো আটকে যাচ্ছিল। সুতপার স্তনে পাছায় আটকে, ঠোকা খেয়ে মাটিতে পড়ছিল সেগুলো। নার্গিস আকাশের দিকে দুই হাত ছড়িয়ে ভুরু-মুখ কুঁচকে ওপরে কীজানি কেন তাকিয়েছিল। শালফুল ওর একটু চ্যাপ্টা মুখে রাশি রাশি ঝরে পড়ছিল। কখনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মুখে চলে গেলে ও থুঃ থুঃ করে সেগুলো ফেলে আবার উদ্বাহু হচ্ছিল। শৌনক আমাদের বন্ধু। একটা পুলিসি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে অভিযান করতে গিয়ে কয়েকদিন আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। শৌনকের মৃত্যুর খবরটায় আমার কিন্তু খুব, খুবই বিচলিত হয়ে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, সেরকম কোনো তীব্র আবেগ তৈরিই হল না আমার মধ্যে। বরং অন্ত্যন্ত নিস্পৃহভাবে আমি সেই ফুলের বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। কী অপরূপ একটি দৃশ্য! আমার বার বার তাই-ই মনে হল। মনে হল এমন মুহূর্তের সাক্ষী হবার সৌভাগ্য মানুষের জীবনে খুব কমই আসে। এমন অদ্ভুত, অতুলনীয় অনুভূতির আস্বাদ কখনো চকিতে পাওয়া যায়। যেমন প্রথমে বলেছিলাম, তেমনই সব ভাবনা এসে আমাকে ছেঁকে ধরছিল। আমি লোভী একটা জীবের মতো আড়ালে শুধু সুতপাকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম। সুতপার শরীরের সব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম।
-------------------------
অমিতরূপ চক্রবর্তী,
সুভাষ পল্লী, পোঃ হ্যামিল্টনগঞ্জ, জেলাঃ আলিপুরদুয়ার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
0 মন্তব্যসমূহ