এমন প্রবল বাদল ভোর, আলস্য বিছানা টানে, পায়ের অঙ্গুলি, এমন কি কেশের শীর্ষাগ্র পর্যন্ত প্রার্থনা করে আয় সুখ, নিষ্পেষণ, আয় কষ্ট, উষ্ণতা, আনন্দ; নারীটি কাঁদে, ঘুমের ভেতর, অস্পষ্ট কাতর কান্না, চৌকিতে আহত সপির্ণী দেহ মোচড়ায়, ডানপাশ থেকে বাঁ পাশ, বাঁ পাশ থেকে ডান পাশ, বিব্রত সূর্য খড়ের চালার ফাঁকে ম্লান চোখ রাখে, যেন ডাক দেয়, ‘ উঠোগো নূরজাহান, দিবসের প্রারম্ভ, হেমনগরের সোহরাবের বউ ঘুম ভেঙে উঠো এবার।’
আহা দিবসের এমন মধুর স্নেহময় ডাক, অথচ নিঃসঙ্গ যাপিত নিশি! নূরজাহান আগামী অন্ধকারের কৌশলী কল্পনায় দুয়ারের খিল খোলে, কি হয় তার কিছুদিন বাদ দিলে তাসের আড্ডা, ইয়ার দোস্তদের সঙ্গ, যাত্রার গান, গাঁজা ভাং, ছাইপাশ, আমি কি কিছুই না? আমি কি একটি নিষ্প্রাণ কলাগাছ মাত্র? নূরজাহান আড়মোড়া ভেঙে প্রাত্যহিকতায় জড়ায়, মুরগীর ঘর খোলে, উঠানে খুঁদ কুড়া ছিটায়, বৃষ্টির গানে গানে গুন গুন গলা মেলায়, চুলায় পাটকাঠি দিয়ে আগুন জ্বালে এবং হঠাৎ সচকিত হয় শাশুড়ীর ব্যতিক্রমি অনুপস্থিতিতে, বৃদ্ধার থেমে থেমে কাশি, পিত্তথলির তেতো উগরানো আক্ষেপ, অবিশ্রান্ত গালাগাল,
‘ফকিরণীর ঝিলো ফকিরণীর ঝি, কি আনছিলি বাপের বাড়ির থে? কবিরের ঘরে বউ আইলো, বউয়ের লগে ঘর ভরা জিনিশ-পত্র, আমার ফাডা কপাল, আমার ভাইগ্যে ছাই।’
বুড়ি আজ কোন ঘুমে মগ্ন, এতো বেলাতক? পশ্চিমের একচালা ঘরের দরজায় ভীত চকিত নূরজাহান সাবধানে উঁকি দেয়, যারপরনাই হিংসুটে বুড়ি তার আদরের একমাত্র পুত্রের কম বয়সী বধূটির প্রতি; বুড়িকে নূরজাহান ডাকতে যায় অনিচ্ছায়, কেননা অহেতুক সব সন্দেহ তার, আর সব সময় তার পানি পড়তে থাকা ঘোলা চোখ ব্যস্ত থাকে পুত্রবধূর ত্রুটি খোঁজায়,
- আম্মা ও আম্মা উঠবেন না? অনেক বেলা হইছে ..
নূরজাহান আবেগহীন কণ্ঠে ডাক দেয়। বৃদ্ধার লালা গড়ানো হা করা মুখ থেকে উড়ে যায় কালো ডাঁশা মাছি।
মৃত্যু তবে এই প্রকার? নূরজাহান পড়শীদের বাড়ি বাড়ি খবর দেয়। গভীর নিদ্রায় বুড়ি মরিয়াছে। মায়ের মৃত্যু সংবাদে তাড়া তাড়া তাস ফেলে লাল চোখে ঘরে ফেরে সোহরাব। ননদেরা আসে চারজন। দীঘল বিলাপ হয়, সুরে সুরে ধর্মগ্রন্থ পঠিত হয়, আগরবাতি জ্বলে, মৃতার স্মৃতিচারণ করা হয় এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে ফিসফাস হয়
- ভাবীর চক্ষু দুইটায় দেখো একফুটা পানি নাই, কান্দেও না, পাষাণী ডাইনী রাক্ষুসী একটা..
- দেখো গা, ওই পারলে বিষ খাাওয়াইছে শাশুড়ীরে, নাইলে অসুখ-বিসুখ নাই, ভালা মানুষ রাইতে ঘুমাইলো হেই মানুষ সকালে কেমনে মরে?
- ও মা .... আ ... আ .. মরার সময় তুমার মুখে পানি দিতে পারলাম না .. আ .. আ ..আ
তাদের বুড়ি মায়ের মৃত্যুর কারণ যে নূরজাহান এই বিষয়ে সোহরাবের বোনদের কোন সন্দেহ নাই। নূরজাহানের দিকে তারা বিষ চোখে চায়, তারা সাথে কোন কথাই নাই। সে খুনি। সে পাপিষ্ঠা।
- ও ভাইজান ... ভাইজানগো ...
মাটি খুঁড়িয়া বৃদ্ধাকে শোয়ানো হইলো। পারিবারিক আয়োজনে মিলাদ হইলো, তাহার মৃত আত্মা শান্তি পাক। বেহেস্তের বাগানে অনন্ত সুখে ডুবুক। চারদিন পর ননদেরা মরা বাড়ি ছাড়ে, যার যার সংসারে ফেরে।
বাস্তবিকই নূরজাহানের অন্তরে কোন প্রকার শোক চিহ্ন নাই। তার নিজেকে নির্ভার লাগে। সে রাতের স্বপ্ন দেখে, নিশ্চিত সোহাগ উল্লাস। সোহরাব আজ রাতে নিশ্চয়ই বাড়ি রবে, হায় এতোকাল পরে তবে। বর্ষণ হোক, অদ্য রাত্রিতে প্রবল বর্ষণ। নূরজাহান সোহরাবের সমগ্র কটু গন্ধ ঢাকিবে নিজের সুবাসে। আজ কাহারো অতৃপ্ত চক্ষু দরজা বা বেড়ার ফাঁকে নাই। কবরের মাটি শক্ত, বুড়ি তা কিছুতেই ভাঙ্গতে পারে না, পারে না। মধ্যরাতে সোহরাব অকস্মাৎ টের পায় একটি কোমল হাত, নরম স্পর্শ এবং সে ছিটকায় ক্রোধ ও ঘৃণায়-
‘হারামজাদী, দুইদিন গেলো না মা মরছে ... ছি ছি তুই কি মানুষ? ...’
নূরজাহানের দুই পা কাষ্ঠ হয় এমত অপমানে, চক্ষে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এমত প্রত্যাখ্যানে, সমগ্র শরীর জমাট বরফ, অভিমান, লজ্জা ক্রমশ কঠিন পাথর, তার ভেতরে কিছু একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, সে চিৎকার করে ওঠে,
- না আমি মানুষ না, জ্বিনের কইন্যা, নূরজাহান আমি জিনের কন্যা।
কেমন এক প্রচন্ড ভয় আঁকড়ে ধরে সোহরাব আলীকে, আচম্বিতে মনে পড়ে নূরীর মাতামহ জ্বিন পালতেন, বিছানার কোণে বিদ্যুৎ চমকের মতো নীল আগুনে ঝলকায় নূরজাহানের দেহ, সমগ্র ঘরে ক্ষণে ক্ষণে অগ্নি ও বাতাস ঝাপটা দেয়। সোহরাব যেন নিজ স্ত্রীকে চিনতে পারে না। আতংকে পালায়। থমথমে প্রত্যুষ আসে। দিবস আজ যেন বাকশক্তি রহিত, গোঙ্গায়। পশ্চিমের খালি ঘর নূরজাহান নিজ হাতে কালো মাটি দিয়ে লেপে পুছে যতনে, আপন গোপন অঙ্গের মতো দোর আগলায়,-
‘এই ঘরে আপনের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ নিষেধ, নাপাক নারী, নাপাক পুরুষ, নাপাক সব প্রাণীর, এই ঘর যে জন অপবিত্র করে তার উপর আমার শাপ-শাপান্ত তিন কুড়ি। ’
গোলাপ ফুল আঁকা টিনের বাক্স খুলে পাটভাঙ্গা কাপড় পিন্ধে নারী, গোসলের পর, চোখে সুলেমানী সুরমা টানে। সোহরাব এখন বেকায়দায় আপোষকামী। শাদা পতাকা উড়িয়ে সন্ধির প্রস্তাবে সবলে অবলায় আঁকড়ায়,
‘তুই কি পাগল হইলি নূরী? নূরজাহান ... নূরী ... আইচ্ছা ... আইচ্ছা না হয় ভুল হইছে আমার, শুন ... আরে শুন না ... আইজকা আর এমন হইবো না ... কথা দিলাম।
‘আমি জ্বিনের কন্যা নূরজাহান, সোরাব আলী সাবধান, ধারে কাছে আসবি না, খবরদার, আমারে একটুও জ্বালাবি না, ছুঁবি না আমারে, নাইলে আমার শাপ-শাপান্ত তিন কুড়ি, চল্লিশদিন মানুষের সাথে আমার কথা বন্ধ, আমার পিতামাতারা আসবেন, মেঘ ভেদ কইরা আসবেন বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজনেরা, ভালো চাইলে যন্ত্রণা করিস না। যা ভাগ এইখান থেইক্যা ...’
আহত কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে কুঁই কুঁই করে সোহরাব আলী পালায় আর নূরজাহান সম্রাজ্ঞীর মতো পশ্চিমের ঘরের দরজা লাগায়। চল্লিশ, আশি, নব্বই অথবা আরো বেশি দিবস ও রজনী ঘুরে ফেরে। নূরজাহান পূর্ববৎ স্থির, মৌন, অচঞ্চল যেন সাধ্বী সন্ন্যাসিনী, যেন পিশাচী যেন সত্যিই জ্বিনের কন্যা এক।
নূরজাহানের এক ডাকে আকাশ থেকে নেমে আসে জ্বিনের দঙ্গল, তারা হাসি আনন্দ রং তামাশা করে, পবিত্র রাতে দমে দমে আল্লাহরে ডাকে, নূরজাহানের কথা শুনে অনুগত চাকরের মতো। শুনবে না কেনো? জ্বিনের রাজার কন্যা তো সে, এক গ্লাস জলে সে ফুঁ দিয়া দিলে তাবৎ রোগী ভালো হয়ে যায়, নূরজাহানের কেরামতিতে ঘাটের মরা উইঠা বসে, হাঁটে-চলে, কথা কয়। এক লহমায় নূরজাহান দিয়া দেয় হারানো জিনিসের দিশা, চিরবন্ধ্যার গর্ভে সে দেয় সবল সন্তান, আইবুড়ো মেয়ের কপালে জুটায় ধনবান স্বামী। নূরজাহান বড়ই ক্ষমতা ধরে, গ্রামের এক প্রান্তে একেলা বাস করে, খায় শুধু ফলমূল আর মিষ্টি, পান করে কালো ছাগলের শাদা দুধ, নূরজাহান, জ্বিনের কন্যা নূরজাহান।
বাপের শেষ জমির দলিল বেচে বাজারের মেয়ে বিউটির স্বাদ চাখে সোহরাব আলী। বিউটি তার মাংসহীন গালে ঠোনা দেয়, রং মাখা চক্ষু ঘুরায়-
‘এইবার কি বেচবা নাগর? পথের ফকিররে আমরা তো ঘরে জাগা দেই না সোনা’
ইহাদের রং ঢং সোহরারেব বড়ই পছন্দ, সে পছন্দ মেটায়। ইয়ারদের সহিত সুখটান দেয় গাঁজার কল্কে’য় হেমনগরের জ্বিন-কন্যার কেরামতির কিস্যা শোনে, জ্বিনদের সকল সম্পত্তি নাকি এখন নূরজাহানের জিম্মায়, সোনা-রূপা, মণি মানিক্য, ধন রতন, সারা দেশ জোড়া নাম ডাক তার। ওই জি¦নের বেটি কি কোনদিন সোহরাব আলীর বউ ছিলো? কোন পৌষের রাত্তিরে ছিলো অধীনা কিংবা কোন শ্রাবণের সকালে? সোহরাব আলী যেন মনে করতে পারে না।
নিজের ঘরবাড়ি সোহরাব আলী নিজেই চেনে না, ওই জটাধারী কৃষকায়, শুভ্র নারী, ওই দূরবর্তী চোখ। একদা সে এক সরল বালিকাকে চিনিত, বালিকা স্বামীর পা টিপিতে টিপিতে পায়ের উপর ঘুমাইয়া পড়িত, শাশুড়ী ও ননদের খোটায় আকুল কাঁদিত, চৈত্রের দ্বিপ্রহরে উঠানে ধানশীষ শুকাইতো, বিশ্বস্ত কুকুরীর ন্যায় পায়ে পায়ে হাঁটিত, জিহ্বায় চাটিয়া নিতো রক্ত ও পুঁজ, আদেশক্রমে। অথচ, এই স্ত্রীলোক যেন অস্পষ্ট ধুম্রজাল, সোহরাব আলীর পদযুগল পলাইতে চাহে যুগপৎ স্থানু ও ভারি হয়, ধুসর আতঙ্ক গ্রাস করে দৃশ্যপট- এই স্ত্রী লোককে কোন কালে আমি চিনি নাই, শব্দহীন প্রচন্ড চিৎকারে তার গলা শুষ্ক হয়। নূরজাহানের অধরা ওষ্ঠে তখন অলৌকিক সেতার বাজে।
‘সহায় সম্বল সবই ফুরাইছে, ঠিক না সোহরাব আলী? পথের ফকির হইছো তুমি’
সোহরাব আলী যেনবা কাঠগড়ায় অপরাধি এবং যেন একটি দিশাহারা ক্ষুদ্র ইঁদুর গর্তের মুখ খোঁজে, কিন্তু পায় না, কোথাও যেন তার জন্য খানিকটা আড়াল নাই।
‘আগামী অমাবস্যায় আইসো, একটা সোনার কলস দিবো, পাক সাফ হইয়া আইসো সোরাব, পরশু অমাবস্যা।’
হায় , হায়, পাকপবিত্র হইবার কি উপায়, কি উপকরণ? প্রকৃতই সোহরাব গভীর ভাবনায় রত হয়, চক্ষু কর্ণ খুলিয়া খোঁজ করে পাক সাফ হইবার নিয়মাবলী, পুকুরের অনাবিলে অসংখ্যবার নিজেকে ডুবায়, সুগন্ধী সাবানের ফেনা তোলে, ধবধবে সাদা বস্ত্রে আবৃত হয় এবং উপস্থিত হয় অমাবস্যার রাতের সেইক্ষণ।
পাতিলের তলার মতো নিকষ চর্তুপার্শ্বের কালি কিংবা ঘোর কৃষ্ণ নিগ্রোর রং, সম্মুখে জ্বিন রমণী হেঁটে যায় অথবা উড়ে যায় পশ্চাতে কুঁজো হয়ে তারে অনুসরণ করে সোরাব আলী, সমগ্র রক্ত মাংস আর অন্তর জুড়ে থির থির ভয়ের কাঁপন, তারা পৌঁছায় উত্তরের পতিত ভিটায়। ভিটায় ইতস্তত লম্বা ঘাস, বিছুটি জঙ্গল, ভেঙ্গে পড়া বাঁশের খুঁটি চাল ও বেড়া, দূরে কোথায়ও ম্লান প্রদীপ জ্বলে বা জগৎ আলো করে দাঁড়ায়, নূরজাহান, আলো ও আঁধার রাতের শরীরে ছবি আঁকে, অশরীরী কারা যেন চারপাশে নি:শব্দে দৌড়ায়। যেন দৈব আদেশ হয়-
‘দক্ষিণের মাটি পরিস্কার করো সোরাব।’
সোহরাব আলী উবু হয়ে বসে কম্পিত দুই হাতে মাটি খামচায়। কাঁটাময় আগাছা, পক্ষীদের মল, ইটা ও পাথর কুচি সরিয়ে মুখ দেখায় বাস্তব মাটি।
‘এইবার সইরা আসো।’
নূরজাহান এইবার হাঁটু গেড়ে বসে, দুই হাত মোনাজাতের ভঙ্গীতে উপরে তোলে। অপার্থিব কোন মায়াময় অচীন সুরে এক মা যেন ডাকে তার লুকানো আদুরে ছেলেকে,
‘ওরে পুঞ্জীকৃত স্বর্ণ-চান্দি স্তুপ, ওরে অজস্র ঐশ্বর্য, ওরে মানব আকর্ষণীয় সম্পদ ভান্ডার, বিন্দুমাত্র অনাবৃত হ’ বাপ, উন্মোচিত হ’, দ্বারপ্রান্তে আমি নূরজাহান, আমি ডাকি তোরে’ ...
এই সব কুহেলিকা, নিশ্চয়ই যাদুকরী ভেলকি মাত্র, সোহরাব অবিশ্বাসে চক্ষের পাতা ফেলে এবং সহসা দেখে মাটিকে দ্বিধাবিভক্ত, মধ্যাংশে চক্ চক্ করে কিছু, নূরজাহান তার দীঘল সরু আঙ্গুল বাড়ায় একটি কলসের কারুকাজ খচিত স্বর্ণালী গলা অতঃপর সমগ্র অবয়ব দৃশ্যমান হয়, মৃদু মুগ্ধ আলোক ছড়ায়।
নূরজাহানের রক্তহীন ঠোঁটে লকেটের মতো ঝোলে বিজয়ীর হাসি,
‘এই কলসভর্তি সম্পদ তোমারে দিলাম সোরাব আলী, তবে নিয়ম আছে, তিনদিন তিনরাত কলস এই ঘরে এই স্থানে একলা থাকবে। ছুঁইতে পারবা না, চতুর্থ রাতে পবিত্র শরীর ও মনে মধ্যরাতে এই কলস তোমার হবে, তখন যেথা ইচ্ছা নিয়া যাবা, এর যদি অন্যথা হয়, তাইলে মনে রাইখো আমার শাপ-শাপান্ত তিনকুড়ি..’
আশে পাশে রাতজাগা পেঁচকের ডানা ঝাপটানি, একটি ঘেয়ো কুকুর গ্রামের রাস্তায় ব্যাকুল হয়ে কাঁদে। তাহারা প্রত্যাবর্তন করে।
সকালের আলোয় সোহরাব আলীর রাতের ঘটনা সমস্ত কিরূপ স্বপ্নবৎ মনে হয়, মনে হয় দৃষ্টি বিভ্রম, সমস্তই যাদু, মায়া, ছলনা, ডাকিনীর লীলা ইত্যাদি।
কৌতুহলের তীব্র সুচ জর্জরে সমুদয় শর্ত বিস্মৃত হয় সে এবং পায়ে পায়ে অগ্রসর হয় গাঁয়ের শেষ প্রান্তে গা ছমছম করা নিঝঝুম উত্তরের ভিটায়, এমন শান্ত স্বাভাবিক বিজন সবুজে বড়ই মুগ্ধতা, ভাঙা ঘরবাড়ি হাল্কা বেমানান। পাখিরা গান গায়, ছায়ারা মমতা বিলায়, সোহরাব দৃষ্টি প্রসারিত করে উত্তরের ভিটায়, রহস্যমন্ডিত দক্ষিণ কোণে। তার সমগ্র শরীর হঠাৎ পুলকে শিহরিত হয়, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ভুমিকম্পের ন্যায় দেহ কম্পিত ও লোমরাজি খাড়া হয়। সে দেখে মোহময় ভঙ্গিতে সোনালী কলস বাস্তবিকই রূপসী নারীর মতো চোখ বুজে শায়িতা, অর্থাৎ যা ঘটেছিলো তা মিথ্যা না বরং আনন্দময় রোমাঞ্চিত সত্য নতুবা বাস্তব সত্য অপেক্ষা বিষ্ময়কর। সোহরাব আলীর নিঃশ্বাস দ্রুত হয়, দেহ ও আত্মা হয় লৌহ সদৃশ, কলসটি যেনবা এক চুম্বকপিন্ড, গভীর আকর্ষণে তাকে কাছে ডাকে, তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয় কলসের উজ্জ্বল স্বর্ণত্বকে। সে জ্বিনের কন্যার সতর্কবাণী ভুলে মন্ত্রমুগ্ধ অগ্রসর হয়, একটা সাদা রঙের দুধরাজ সাপ শুকনো পাতায় খসখস শব্দ তুলে হারিয়ে যায়।
সোহরাব আলীর ভাঙা নখসহ স্থূল আঙ্গুলসমূহ স্পর্শ করে স্বর্ণকলসের আপাত পেলব মৃণাল শরীর, প্রথমত, বোধহয় কোন জোরালো আঠায় সেঁটে গেছে তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ও চামড়া, পরক্ষণে অনুভূত হয় অসহ্য তীব্র যন্ত্রণাদায়ক জ্বলুনি, উহু, স্বর্ণে একি জ্বলন্ত অগ্নি ! সে ভাবে, আর তার প্রসারিত অঙ্গুলিগুলো কুঁকড়ায়, হাতের আকৃতি বীভৎস বিকৃত হয়, গোলাপী মাংস গলিত, নিশ্চিহ্ন নখ।
সোহরাব আলী বুঝিবা জ্ঞান হারায়, গলা ও চক্ষু হয় জলশূন্য, সে ভয় বিস্ময় ও যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াগড়ি খায় এবং সোনালী কলস কেমন অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাসে, দ্বিধাবিভক্ত মাটির বুকে অদৃশ্য হয়।
0 মন্তব্যসমূহ