আমাদের গ্রামে পাকা রাস্তাটি ঘেঁষে একটি ভাঙাঘরের টিনের বেড়ায় সাঁটানো পল্লীবিদ্যুতের মিটার, দিনেরাতে জ্বলে আর নেভে। বাড়ি নাই, মানুষ নাই, রাতে বাতি জ্বলে না একটাও, কিন্তু কালো তারে বাঁধা জিনিসটা আছে আগের মতোই জীবন্ত, যা পিটপিট করে জ্বলে আর নানারকম গল্প বলে।
একদিন কালিসাঁঝে মিটারের লাল আলোটাকে ভূতের চোখ সনাক্ত করে গ্রামের ছোট চ্যাংড়া অন্তু, ভূত ভূত বলে ভয়ে চিৎকার করে দৌড় দিয়েছে। আমরা যারা গ্রামেও স্মার্টফোনে ইউটিউব, ফেসবুক, ক্যামেরা ইত্যাদি ব্যবহার করি, তারা ডিজিটাল যুগের চেনা মিটারে ভূত আবিষ্কারের গল্প শুনে হেসেছি। কিন্তু অন্তুর বুড়া দাদা কয়, ‘ঠিকই দেখছে নাতি। ভাঙা বাড়ির মানুষরা মরিয়া ভূত হইছে! আর ওই জায়গাখান ছিল ভূতের বড় আখড়া, গন্ডোগোলের টাইমেও আছিল বাঁশের থোপের জঙ্গল। সেই জঙ্গলে ওই ভাঙা ঘরের মাটিতেই ছিল একটা শ্যাওড়া গাছ। সেই গাছের ভূত দেখিয়া চ্যাংড়াকালে বড়বাড়ির সরকার সাহেবও ভয়ে প্যান্টে মুতি দিছিল! অনেক তাবিজ-কবজ আর ঝাড়ফুক লাগছে তাকে ভালো করতে। বিশ্বাস না করলে এলায় ঢাকায় ফোন দাও তাকে। পুছ করিয়া দেখ কথা সাচা না মিছা?’
শৈশবে ভূতের ভয়ে ঢাকার নামিদামী মানুষ সরকার সাহেবের মুতে প্যান্ট ভেজানোর গল্পের চেয়ে ভাঙাবাড়ির বাসিন্দাদের নিরুদ্দেশ হওয়াটা আমাদের কাছে তাজা খবর। জন্ম থেকেই অতি চেনা চারটি মানুষ বেশি বেশি টাকা কামাতে ঢাকা গেল। তিন জনের তিনটা ফোন স্বজন-গ্রামবাসীর ফোনে কতো স্বপ্ন ও আশার সুখবর শোনাল। তারপর হঠাৎ করে একদিন সবার ফোন বন্ধ। চেনাজানা কারো কাছে কোনো স্থানেই হদিশ মিলছে না তাদের। ঢাকা যাওয়ার পরই জ্বলজ্যন্ত মানুষগুলির নিখোঁজ-রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা গাঁয়ের ছোটো-বড় অনেকেই গোয়েন্দার ভূমিকা নিয়েছি। নিরুদ্দেশ মানুষগুলির মরে ভূত হওয়ার ভয় মিথ্যে প্রমাণ করতে এবং গোয়েন্দা অনুসন্ধানের ক্লু খুঁজে পেতেও, আমাদের গল্পে স্মৃতি-সত্তা তোলপাড় করে নিখোঁজরা নানারূপে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
মাত্র কিছু দিন আগেও ভাঙাঘরের উপর টিনের ছাদ ছিল। ঘরের ভিতরের উজ্জ্বল লাইট, ছোট্ট উঠানের চুলায় আগুন, স্বামী-স্ত্রী দুজনের দুটি মোবইল ফোনের ঠিকড়ানো আলো, বাড়িঘেঁষা সরকারের দীঘির পাহারাদার লাইট এবং রাস্তায় ছুটে চলা যানবাহনের আলোয় রাতের বেলাতেও বাড়িটা ছিল গাঁয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল বাড়ি। পাকা রাস্তাটা ছিল যেন বাড়ির বারান্দা। আর রাস্তাটা দুদিক থেকে উঁচু হয়ে যে কালভার্ট বা ছোট্ট পুলটায় উঠেছে, সেই উঁচু শক্তপোক্ত পুলটা ছিল এ বাড়িরই বৈঠকখানা, ভাড়ারঘর এবং ছেলেমেয়ে দুটির খেলার ঘরও। পুলের দুপাশে দশইঞ্চি ওয়ালের শানবাঁধানো দুটি রেলিং। পথচারি ও গ্রামবাসীদের পাছা রেখে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উপযুক্ত বেঞ্চি। এই সরকারি বেঞ্চিতে বসে আমরা কদিন আগেও বাড়ির গৃহকর্তী উড়নি ওরফে চুরনি ওরফে ডাকিনীকে এবং তার রূপসী কন্যা উপালিকে কতো রূপে যে দেখেছি! এক সময় ইসুফ চোরের মেয়ে উড়নি যেমন গাঁয়ে তোলপাড় করা নানা রসালো গল্পের নায়িকা হিসেবে চুরনি এবং চুরনি স্বঘোষিত ডাকিনী উপাধি পেয়েছিল, নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে তার কিশারী কন্যা উপালিও তেমনি আমাদের চোখে গাঁয়ের সেরা সুন্দরী নায়িকা হয়ে উঠছিল। কেউ নাম দিয়েছিল পরীমণি, কেউবা তাকে ডাকতাম মুম্বাইয়ের দীপিকা পাড়কৌনি। অন্যদিকে বাড়ির পুরুষকর্তা উজাল ও বালকপুত্র চপলের নামের সঙ্গেও চেহারা ও স্বভাবের ষোল আনা মিল। চোখে ধরার মতো উজ্জ্বল, টকটকে ফর্সা রং ছিল বাপ-বেটা ও মেয়েরও । চাষী-মজুরদের পরিবারে এমনটা দেখা যায় না সচরাচর। ১০/১১ বছর বয়সী চপল বয়সের কারণে ও ডাকিনী মায়ের স্বভাব পেয়েও হয়তো-বা, ভারী দুষ্টু টাইপের ছিল। তবে উজাল ছিল স্ত্রীর বিপরীত, অলস এবং ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ। বাড়ি ছাড়ার কিছুদিন আগেও সে পুলের ওপর বসে তার পুরোনো গানটা বেসুরো গলায় গেয়েছে ‘পরের জায়গা পরের জমি/ ঘর বানাইয়া আমি রই/ আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।’
উজাল অবসরে তার ড্রয়িংরুমে বসে হরহামেশা মনের দুঃখে, খুশিতে, নাকি উদাসীন মনের আধ্যাত্মিকতা প্রকাশে ঘুরেফিরে এ গানটা গাইত? আমরা ঠিক জানি না। তবে, গানের কথায় ও সুরে বাড়ি ও তার স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের কিছু সত্য প্রকাশ পেত অবশ্যই। প্রথমত বাড়িটার ভিত পরের জমিতেই। সরকার সাহেবের লিচু বাগান, পুকুরপাড় এবং খানিকটা সরকারি রাস্তা দখল করে এক শতাংশ জমির উপর শহুরে বস্তির মতো গড়ে উঠেছিল একটি টিনের চালা ঘর। সরকারি রাস্তা ও পুলের পাড় ব্যবহারের জন্য সরকারি অনুমতির তোয়াক্কা করে না কেউ। ধানের মৌসুমে রাস্তার উপরেই চাষীরা পোয়াল খড় শুকায়। চ্যাংড়ারা মাঠ বানিয়ে খেলে। আর রাস্তার সঙ্গে বাড়ি হওয়ায় সরকারি রাস্তাকে উজাল-উড়নি পরিবারের নিজস্ব বারান্দা ভাবার অধিকার ছিল ষোল আনা। তবে ঘর তোলার সময় সরকার সাহেবের লিচুবাগান ও পুকুরপাড় ব্যবহারের জন্য অনুমতি নিতে হয়েছিল অবশ্যই। আর গরিব পবিারটিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সরকার সাহেবের অন্তরে দয়ামায়া যাই থাক, আসল কারণটাও আমাদের জানা। পরিবারটির নিরুদ্দেশ-ঘটনার সঙ্গেও সরকার সাহেবের সঙ্গে উড়নি ও তার বাপ ইসুফ চোরের সম্পর্কের গল্প আমরা স্মরণ করি, বিশ্লেষণ করি নানাভাবে।
পুলখানার পশ্চিমে দুশ গজ দূরে ইসুফ চোরের বাড়ি। ইসুফ ক্ষেতের কাজকর্ম করার পাশাপশি যৌবনে একবার খোদ সরকার-বাড়িতে সিঁধ কেটে ধরা খেয়ে প্রচুর মারধরসহ চোর উপাধি পেয়েছিল। সরকার সাহেবের বুড়ো বাপের পায়ে পড়ে এবং কোরান ছুয়ে চৌর্যবৃত্তি বিসর্জনের শপথ করায় জেলে যাওয়াটা ঠেকাতে পেরেছে। কিন্তু সারা জীবন প্রকাশ্যে পরের ক্ষেতে কামকাজ করেও নামের শেষের চোর উপাধিটা সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেনি। বয়স হওয়ায় ইসুফ এখন সারাদিনেই প্রায় মাথায় টুপি রাখে এবং মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ে। তারপরও আড়ালে আমরা তাকে ইসুফ চোরই ডাকি এখনও। ইসুফ বকলম গরিব কামলা হলেও সন্তান-সন্ততির দিক দিয়ে তাকে গাঁয়ের সেরা ধনী বলাই সঙ্গত। মৃত ২/১টি বাদ দিয়ে জীবিত আট ছেলেমেয়ের জনক সে। সংসারে স্ত্রীর ফোলা পেট কিংবা ঘন ঘন টোঁয়া শব্দ শুনে ঘনিষ্ঠজনরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিলে গর্বের সঙ্গে জবাব দিত, ‘আল্লার মাল আল্লাই চালাবে।’ কিন্তু সপ্তম সন্তান উড়নির ব্যাপারে আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে না পেরে, বছর তের/চৌদ্দ আগে সরকার সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘বড়ভাই, আল্লাহর ওয়াস্তে এইটাকে আপনার হাতে তুলি দিলাম। ঢাকা নিয়া যান, কামকাজ করি খাইবে। বড় হইলে দেখিশুনিয়া একটা বিয়া দেমেন। এ ছাড়া মোর আর কোনো দাবি নাই।’
পরিবারের কাজে লাগবে বলেই হয়তো সরকার সাহেব বালিকা উড়নিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন ঢাকায়। তারপর টানা প্রায় পাঁচ বছর ছিল সে ঢাকায়। কী হালে ছিল, সরকার সাহেব বা তার পরিবারের কাছে সন্তানসম আদর-যতœ পেয়েছে, নাকি ঠিকমতো কাজ না করায় লাঠিঝাঁটা খেয়েছে বেশি? এ বিষয়েও আমরা নানাজনে নানারকম গল্প শুনতাম। সেসব গল্পের তথ্য-প্রমাণ জোরালো ছিল না। কিন্তু শেষবার গ্রামে ফিরে এলে উড়নির শহুরে সুগন্ধী ছড়ানো ডগমগে যুবতী চেহারা দেখে ঢাকায় তার ভালো খাওয়া-পরা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ জাগেনি। ইসুফ চোরের বেটি নয়, খোদ সরকার সাহেবের কন্যা হলেই যেন তাকে মানায়। কিন্তু উড়নি সেবার গাঁয়ে ফিরে শপথবাণী ঘোষণা করেছিল, ঢাকায় আর কোনোদিন ফিরে যাবে না। টাউনের ভদ্রলোক-বড়লোক কাউকেই আর বিশ্বাস করে না সে। তদের কারো বাড়িতে গিয়ে বাঁদী-দাসীর কাজও করবে না। বাপ-ভাইয়েরা যদি দুবেলা খাওয়াতে না পারে, গ্রামের কচুঘেচু ও ডোবার মাছ ধরে, বড় গেরস্তবাড়িতে কামকাজ করে খাবে।
উড়নির এরূপ ঘোষণায় মনিব হিসেবে সরকার সাহেবের বদনাম যেটুকু প্রচ্ছন্ন ছিল এবং একান্তে নিকটজনদের কাছে সে যা প্রকাশ করেছে, তা কানকথা হিসেবে আমাদের কানে এলে পিতৃসম সরকার সাহেবের চরিত্র নিয়েও সন্দেহ জেগেছিল অনেক যুবকের, বিশেষ করে যুবতী উড়নিকে দেখে সম্ভোগ বাসনা যাদের মনে এবং বিশেষ অঙ্গেও ভর করেছিল বেজায়। কিন্তু গাঁয়ের মেয়েরা উড়নির ঢাকায় না ফেরার প্রতিজ্ঞার পেছনে ভিন্ন কারণ আবিষ্কার করেছে। তার ব্যাগ থেকে শুধু দামি শ্যাম্পু-ক্রীম বেরয়নি, টুকিটাকি দামি জিনিস আরো অনেক কিছু লুকানো আছে, যার মধ্যে সোনার জিনিস এবং টাকার বান্ডিল থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এদেরই কেউ-বা সরকার সাহেবের হিতৈষী সাজতে তাকে ফোন করেও নিশ্চিত হয়েছে, উড়নি আসার পর বাসায় অনেক টুকিটাকি জিনিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর উড়নির ঢাকা না ফেরার গুমোড় ফাঁক হওয়ায় চোরের মেয়ে চুরনি উপাধিটা পেয়েছে সে আমাদের কাছে। আর বাড়িতে বছরখানেক থাকার সময়ে পরের ক্ষেতের বেগুন-মূলা-আলু চুরি করে নিজের উপাধির সার্থকতাও প্রমাণ করেছিল সে। তখন উড়নি নয়, প্রকাশ্যে ও আড়ালে তাকে ‘চুরনি’ নামে ডাকতাম আমরা সবাই।
বাপ-ভাইদের বিয়ে দেওয়ার গরজ নাই দেখে, রাগ করে চুরনি একদিন সুন্দরগঞ্জে খালার বাড়িতে গিয়েছিল। গরিব খালার সংসারে মাস চারেক বোঝা হয়ে ছিল। সেই সময়ের মধ্যেই বড় অঘটন ঘটিয়েছে। তার খালা ও খালার গাঁয়ের মানুষজন টের পাওয়ার আগেই, পাপের ভাগী উজালকে পাকড়াও করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। উজালের সঙ্গে চুরনির অবৈধ প্রেম-প্রীতির গোপন সম্পর্ক নিয়ে নানা রসালো গল্প শোনার আগেই, ছেলেটার চেহারা দেখে আমরা চমকে উঠেছি। টকটকে ফর্সা রং, বেঁটেখাটো চেহারা। নাকের নিচের কালো গোঁফ না থাকলে তাকে রূপবান বালক বলা যেত এবং মেয়ের বদলে এরকম বালকের সঙ্গেও অপকর্ম করার মতো খচ্চর ছেলে আমাদের গ্রামেও কম নেই। খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পারি, উড়নির খালার বাড়ির কাছেই ছেলেটা তার ফকিরনী মায়ের সঙ্গে ছিল। অবুঝ বয়সে জন্মদাতা বিদেশি বাপ তার মাকে ছেড়ে দিয়ে সেই যে উধাও হয়েছে, আর ফিরে আসেনি। ফকিরনী মায়ের সঙ্গে পরের বাড়ির আশ্রয়ে থেকে ভিক্ষে ও নানারকম কামকাজ করে চলত মায়ে-পুতে। যতই রূপবান হোক, তার সঙ্গে আত্মীয়তা করার কথা ভাবেনি উজালের জন্মভূমি গাঁয়ের কোনো মানুষ। কিন্তু চুরনি তাকে বাড়িতে এনেই ঘোষণা করেছিল, ‘মৌলবি হুজুরকে ডাকায় আনিয়া এই চ্যংড়ার সাথে মোর বিয়া দাও আইজকেই। না হইলে তোমার মান-ইজ্জত কিছু থাকপে না। জারুয়া নাতির মুখ দেখতে হবে।’
উড়নি তথা চুরনির এই ঘোষণা শুধু তার বাড়িতে নয়, পুরো গ্রামেই নিষিদ্ধ রস উথলে আনন্দ-উত্তেজনা সঞ্চার করেছিল। চুরনি কী করে জাতকূলহীন অচেনা এক সুদর্শন বালককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজেও গর্ভ ফাঁদাল এবং গর্ভবর্তী চুরনি লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বাপভাইয়ের কাছে বিয়ের দাবি জানাল, এসব বিষয় নিয়ে আমারা গ্রামে নানারকম সরস গল্প বলা ও শোনার আনন্দ উপভোগ করেছি। আমাদের কারো কারো মনে এমনও সন্দেহ জাগে যে, চুরনিকে গর্ভবর্তী করার আসল নায়ক যে, তাকে না পেয়ে কিংবা আড়াল করতেই গোবেচারা টাইপ কমবয়সী উজালকে টেনে এনেছে সে। চুরনির ভাগ্য ভালো, ওই সময়ে তার প্রাক্তন মনিব সরকার সাহেব গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। দিশেহারা রাগে-অপমানে উত্তেজিত ইসুফ ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। উড়নি ঢাকা থেকে নায়িকা হয়ে ফেরার পর আমরা, গাঁয়ের যে-চ্যাংড়া সকল নানা অছিলায় ইসুফের বাড়ি ঘুরঘুর করেও চুরনির সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত হতে ব্যর্থ হয়েছি, এমনকি বুক টেপারও সুযোগ পাইনি যারা, তারা ইসুফের চেয়েও বেশি উত্তেজিত হয়ে ভিড় জমিয়েছিলাম সরকার সাহেবের বাড়িতে।
‘পাত্তর দেখতে যত রূপবানই হউক, জানিশুনিয়া এমন জারুয়া চ্যাংড়ার সাথে কি বিয়শাদি দেবে কোনো বাপ? ছোট বেলায় ভিনদেশি বাপ তার মাকে ফেলায় থুইয়া নিরুদ্দেশ হইছে। এই জাড়–য়া জামাইও যে মোর বেটির পেট ফাঁদায় দিয়া পালায় যাইবে না তার গ্রান্টি হামাকে কাঁয় দেবে?’
ইসুফ চোরের অপমান-উত্তেজনা সমর্থন করে আমাদের মধ্যে অনেকেই দুই পাপিষ্ট যুবক-যুবতীকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিলাম। মসজিদের ইমাম শরিয়তের ব্যাখায় উভয়কে দোররা মেরে শাস্তি দেয়ার কথাও বলেছে। দুজনের মাথার চুল কেটে দিয়ে জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছি কেউ-বা। আর চুরনির বাপ-ভাইয়েরা বাড়িতে যদি তাকে আশ্রয় দেয়, তাদের একঘরে করার পক্ষেও একজোট ছিলাম গ্রামবাসী। কিন্তু সরকার সাহেব গ্রামে না থাকলেও গাঁয়ের বড়বাড়ির বড় ছেলে এবং দেশেরও নামীদামি মানুষ। গ্রামে বিস্তর সম্পত্তি, রাজধানী শহরে নিজের বাড়িগাড়ি নিয়ে থাকেন। আমরা তাকেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারকের সম্মান দিয়ে, তার রায় মেনে নেয়ার জন্য একমত হয়েছিলাম সবাই।
বিচারসভায় আসামী চুরনিও তার পাপের দোসর উজালকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। ভয়ে-লজ্জায় মুখ লুকানো দূরে থাক, ক্ষমা চাওয়ার বদলে উকিলের মতো জোর গলায় প্রাক্তন মনিবকে যুক্তি দিয়েছিল সে, ‘ও জ্যাঠোআব্বা, মোর বাপে কয় হামরা হইলাম সউগ আল্লার মাল, এই চ্যাংড়া কি আল্লার মাল না হয়? আল্লাহর হুকুম ছাড়া এ দুনিয়ায় আসছে কোনো মানুষ? তেমনি আল্লার হুকুমে মোর পেটে যে আসছে, তাকে জারুয়া গাইল দেন কেন? মৌলভী ডাকায় ওকে কলেমা পড়ায় ফের মুসলমান বানান, তারপাছে কোরান হাদিস সাক্ষী রাখিয়া এই চ্যাংড়ার সাথে মোর বিয়া দেন। বিয়ার পর বাপে-ভাইয়ে যদি বাড়িতে জায়গা না দেয়, তা হইলে তোমার দিঘির পাড়ে লিচুর বাগানে ছাপরা তুলি থাকপো আমরা। মাগ-ভাতারে গ্রামে কামকাজ করি খাবো, আর মাগনা তোমার পুকুরের মাছ আর বাগানের ফলমূল পাহারা দেব। ঢাকা থাকি মোবাইলে যখন যে হুকুম দেবেন, সেই মতো চলবো। তোমার হুকুমের অবাধ্য হই যদি, গ্রামবাসী কারো কিছু চুরি করি যদি, লাথিগুড়ি দিয়া হামাকে যা খুশি শাস্তি দেন, মাথা পাতি নেব।’
আমরা গ্রামবাসী ভেবেছিলাম, সরকার সাহেব এবার সুযোগ পেয়ে তার কাজের মেয়ের অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি দেবে। যেখানে চুরনির বাবা-ভাইসহ আমরা অধিকাংশ গ্রামবাসী তার শাস্তি দেখার জন্য উদগ্রীব, সেখানে প্রধান বিচারক হিসেবে সরকার সাহেব শান্ত। হাসিমুখে উড়নির রহস্যময় বরের সঙ্গে তার ছওয়াল-জবাব ছিল একরম:
‘এই ছেলে, তুমি কি আমদের উড়নিকে সত্যই ভালোবাস?’
উজাল মাথা নিচু করে গোঁফ চুলকে জবাব দেয়, ‘ভালবাসিয়া তো তার সাথে ঘর করার জন্য এ গ্রামে আসিনো স্যার।’
‘বিয়ের পর ছেড়ে পালাবে না তো?’
‘বাপ তো শুনছি বিহারী মুসলমান ছিল, আমি তো একটা উর্দু কথাও কইতে পারি না। মুসলমান মতে বিয়া দিয়াও যদি অবিশ্বাস করেন, তা হইলে উড়নির পায়ের সাথে আমার একখান ঠ্যাং শিকল-তালা দিয়া বাঁধি রাখেন।’
অতঃপর সরকার সাহেব হাসিমুখে রায় দিয়েছেন, ‘ছেলেমেয়ে দুজনই যখন দুজনকে ভালোবাসে, তার ওপর আর কথা কী? ঠিক আছে, পুলের কাছে আমার দিঘির ওপর একটা ছাপরা তুলে থাকুক আপাতত। তোমরা মুন্সীকে ডেকে ধর্মমতে ওদের বিবাহের ব্যবস্থা করো।’
রায় কার্যকর করার জন সরকার সাহেব মেয়ের বাপের হাতে পাঁচশ টাকার নোটও দান করেছেন।
উজাল-উড়নির বিয়ে ও বাসরঘরের ব্যবস্থা করে দিয়ে মনিব তো ঢাকা ফিরে গেলেন, এদিকে আমরা গ্রামবাসী টেলিভিশনে খুব মজার একটা সিরিয়াল দেখার মতো বাস্তব নাটক দেখার জন্য পুলের ওপর ভিড় জমাই। পুলের নিচে প্রথমে কোনোমতে একটি টিনের চালা তুলে বসবাস শুরু করেছিল তারা। কারেন্টের বাতির বদলে রাতে ঘরে কেরাসিনের কুপি জ্বলত। প্রথমদিকে রান্না ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা বাপের বাড়িতেই রেখেছিল চুরনি। কিন্তু জামাইকে নিয়ে নিজের ঘরেই রাত কাটাত। আমরা চুরনির দাম্পত্য সুখ উপভোগের জন্য চোখকান মেলে দিনে রাতে যারা পুলের ওপর বসে থাকতাম, তাদের মধ্যে কেউবা রাতে ঘরের বেড়ায় কান পেতেও সম্পর্কের আসল স্বরূপটা দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করেছি। যারা সন্দেহ করতাম, চুরনির গর্ভের বীজদাতা পুরুষ অন্য কেউ, সময়ের হিসাব মেলাতে পারলে বয়োজ্যেষ্ঠ সরকার সাহেবকেও সন্দেহের ঊর্ধে রাখতাম না হয়তো-বা; চুরনিকে বেশ্যা প্রমাণ করতে তাদের একজন পকেটে নগদ পাঁচটাকা নিয়ে এক সন্ধ্যায় ঢুকেছিল তার ঘরে। উজাল তখন হাটে ছিল। চুরনিকে ঘরে একা পেয়েও টাকাটাসহ তার পেটে হাত দেওয়ার আগে দা হাতে চিৎকার করেছে সে, ‘ফের যদি এই ঘরে কোনো জানোয়ার ঢোকে, এই দাও দিয়া এক চোটে ধড় থাকি কল্লা নামাইম। উড়নি কি বেশ্যা মাগী রে? টাকার লোভ দেখাইস তাকে! উড়নি চুরনি নয়, ডাকিনী, গ্রামের এক শয়তানকে খুন করিয়া সেটা প্রমাণ করিম এবার। সরকার জ্যাঠো মোকে সরকারি রাস্তার বগলে ঘর তোলার জাযগা দিছে বলিয়া কি মোকে সরকারি মাল পাইছেন হারামজাদারা?’
রাস্তার হাটুরে পথচারি এবং পুলের উপর বিশ্রামরত আমরা যারা উড়নির এরকম ঝগড়ু চিৎকার শুনেছি, নানাভাবে খাতির জমানার চেষ্টা করলেও তার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পাইনি আর। মাস কয়েক পর উপালির জন্ম এ ঘরেই হয়েছে। পুলে বসে আমরা সেদিন তার টোঁয়া টোঁয়া কান্না শুনেছি যারা, এক যুগ পরের ঘটনা কল্পনাও করতে পারিনি কেউ। উপালি একটু বড় হয়ে শুধু নামে নয়, চেহারাতেও বাপের রং ও আদল পেয়ে আমাদের অনেকের সন্দেহ-কল্পনা থেকে চুরনির গর্ভজ শিশুর আসল পিতার অনুসন্ধান থেমে গিয়েছিল।
উপালির জন্মের পরই উজাল-উড়নির ঘর-সংসারেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। মেয়েকে মায়ের কাছে দিয়ে স্বামীর সঙ্গে ধুমসে কামকাজ করত উড়নি, ক্ষেতের কামেও পিছুপা হতো না। মেম্বারকে ধরে দুস্থ মহিলা হিসেবে সরকারি রাস্তায় মাটিকাটার কাজও পেয়েছে। মেয়ে উপালির দুবছর বয়স হতে না হতেই আবারও গর্ভবর্তী হয়েছে। খালাস হওয়ার আগের দিনেও ঘর-সংসারের কাজ নিয়েই যেমন ব্যস্ত ছিল, তেমনি খালাস হওয়ার পর বাচ্চাদের মায়ের জিম্মায় কি পুলের উপর রেখে দিনেরাতে ব্যস্ত থেকেছে রুজিরোজগার বাড়ানো এবং ঘর-সংসার সামলানোর শতেক কাজে। ওইটুকু বাড়িঘর, তাতেও পেসাবের ঘেরা, হাঁসমুরগির খোয়াড় এবং ছাগলও কিনেছিল একটা। কাজের মাধ্যমেই উড়নি তার চুরনি অপবাদ ঘুচিয়ে স্বঘোষিত ‘ডাকিনী’ নামটাও পোক্ত করেছিল।
সরকারি উন্নয়নযজ্ঞে গাঁয়ের শতভাগ বাড়িঘর বিদ্যুতায়িত করার ঘোষণা সফল করতে ডাকিনী উড়নির বাড়িতেও মিটার বসেছে। মিটারটি বাড়ির পুরুষকর্তা উজালের নামে বরাদ্দ হলেও বিদ্যুতবিলে উড়নির ফোন নাম্বার ছিল। কারণ কারেন্ট বিল থেকে শুরু করে ঘর-সংসারের সবকিছুর আসল মালিক, এবং খোদ স্বামীরও চালক ছিল ডাকিনী উড়নিই আসলে। বাড়িটাকে আমরা কেউ উজালের বাড়ি বলতাম না, বলতাম উড়নি-চুরনি বা ডাকিনীর বাড়ি। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা অবশ্য বাড়িটাকে উড়নির মেয়ে উপালি-চপলদের বাড়ি হিসেবেও চিনত। উপালি-চপলও বহুবচনে বলত ‘হামার বাড়ি’। এমনকি সরকার সাহেবের বাগান ও দিঘিকেও নিজেদের সম্পদ জ্ঞানেই ছোটাছুটি করত তারা। আর উড়নি কেবল দা-বটি হাতে রাতের অবাঞ্ছিত অতিথিদের তাড়ায় না, কথায় কথায় গরবের সঙ্গে চেঁচিয়ে ঘোষণা করত ‘মোর বাড়ি মোর সংসারে মুই হাঁসছাগল পালিম, তাতে হিংসাচোদা মানুষের গাও জ্বলে ক্যানে?’
বাড়িঘেঁষা রাস্তা ও পুলটিতে সবাই ব্যবহার করলেও তাতে ডাকিনীর পরিবারের অগ্রাধিকার কেউই অগ্রাহ্য করতে পারত না। পুলের উপরে জ্বালানি লতাপাতার গাদা কি গোবরের ঘুঁটে এমনভাবে দিত, দুর্গন্ধে লোকজন পুলের ওপর বসতেও পারত না অনেক সময়। উপালি ও চপলও পুলের রেলিঙের কালো দেয়াল ও কংক্রিটের মেঝে স্লেটের মতো ব্যবহার করে ইটের টুকরা কি কয়লা দিয়ে হাবিজাবি কতো কি এঁকেছে। কে একজন পুলের দেয়ালে ডাকিনী ও উপালিকে দুই অক্ষরের শব্দ দিয়ে অপকর্ম করেছিল। ক্লাস ফাইভে পড়া উড়নি মাকে তা দেখিয়ে দিলে, উড়নি গোবর দিয়ে তৎক্ষণাত তা ঢেকে দিয়েছে। লেখার জবাব অচেনা লেখককে মুখে দিয়েছে, ‘আসিস হারামজাদা করতে, দাও দিয়া এক চোটে তোর চ্যাট-বিচি কাটিয়া মোর হাঁসকে খাইতে দিম।’
সরকার সাহেব চালাক মানুষ। নিজের জমিতে আশ্রয় দিলেও পুকুর, লিচুবাগান কিংবা কৃষিজমি দেখাশোনার অধিকারটাও তাদের দেয়নি। এসব কন্ট্রাক্ট দিয়ে প্রতিবছর নগদ টাকা নিয়ে যেত লিজগ্রহীতার কাছ থেকে। পুকুরে যারা মাছচাষ করে, ফলের মৌসুমে আম-লিচুর মালিকানা পায় -- আশ্রিত পরিবারটির সঙ্গে প্রায়ই মাছচুরি বা ফলচুরি নিয়ে ঝগড়াঝাটি হতো তাদের। চুরনির হাঁসগুলিও পুকুরের মাছ সাবাড় করত। পোষা ছাগাল বাগানের গাছপালার ক্ষতি করত। লিজগ্রহীতারা ঝগড়ায় পরাস্ত হয়ে, উজাল-উড়নির নামে ঢাকায় ফোনে অভিযোগ জানালে সরকার সাহেব তাদের উচ্ছেদ করার আশ্বাস দিতেন। কিন্তু গ্রামে এলে যে কয়দিন থাকতেন তিনি, উড়নি তার রান্নাবাড়ি থেকে শুরু করে সবরকম সেবা দিয়ে উচ্ছেদ ঠেকিয়েছে।
প্রাক্তন মনিবের নিদের্শে ছেলেমেয়ে দুটিকে স্কুলেও দিয়েছিল উড়নি। কিন্তু মেয়ে উপালি কোনোমতে ক্লাস ফাইভে উঠেইে রূপের যাদুতে গ্রামে মায়ের চেয়েও বড় ধরনের অঘটন ঘটানোর আলামত দেখাতে থাকে। স্কুলের এক শিক্ষক তাকে শাস্তি দেয়ার নামে গাল ও বুক ডলে দিয়েছে। পাছায় চিমটিও দিয়েছে একজন। ঘটনা মাকে জানিয়েছে উপালি। আর উড়নি মেয়েকে স্কুল ছাড়ানোর কারণ জানাতে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগটি ফোনে ঢাকায় মনিবকেও জানিয়েছিল। সেই বছর গ্রামে এলে সরকার সাহেব কিশোরী উপালিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডাকিনী রাজি হয়নি। রাজি না হওয়ার কারণটিও গ্রামবাসী সবাইকে চড়া গলায় শুনিয়েছে সে। পরের মাটিতে ঘর তুলেছে বলে পরের বাড়িতে মেয়েকে সে দাসীবাঁদী করে পাঠাবে না। টাউনের কোনো বড়লোক-ভদ্রলোকের দয়াও নেবে না। বরং দেখেশুনে বিয়ে দেবে মেয়ের। কারণ বাগানে ফল পাকলে যেমন পাখি আর দুষ্টু চ্যাংড়ারা ভিড় জমায়, তেমনি মেয়ে তার সেয়ানা হতে না হতেই পুলের উপর কাক-শেয়ালের উৎপাত বাড়ছে। বুড়ো সরকার নানাও ঠাট্টা করে নাতনি সম্পর্কের উপালিকে গাঁয়ের বদমায়েশ-বানরদের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য মস্করা করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। বুড়ো ভাতারকে ঠোঁট উল্টেই খারিজ করেছে উপালি। সরকার সাহেব তখন বলেছে, ঠিক আছে ঢাকা থেকে উপযুক্ত চ্যাংড়া পাত্তর পাঠাব তোর জন্য।
একদা উড়নির সঙ্গ পাওয়ার জন্য যেমন, এখন তার কিশোরী কন্যার রূপ-সৌন্দর্যের টানেও তেমনি পুলের ওপর ভিড় জমায় যারা, ডাকিনী তাদের প্রতিরোধ ও সতর্ক করতেই সরকার সাহেবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সন্দেহ নেই। এই ঢাল অগ্রাহ্য করে উপালি পুকুরে গোসলের সময় এক চ্যাংড়া সাপের মতো এগিয়ে গিয়ে তার পা পেঁচিয়ে ধরেছিল। চিৎকার শুনে ডাকিনী মা ছুটে গিয়েছিল বলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে রক্ষা পেয়েছিল উপালি। বয়স্ক একজন মাঝারি গেরস্ত বউ মারা যাওয়ার পর কিশোরী উপালিকেও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মেয়েকে গাঁয়ের শয়তানদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সে যে ভিন জায়গার অচেনা রহস্যময় পাত্র জোগাড় করবে, আমরা ভাবতে পারিনি কেউ।
কীভাবে এবং কী কৌশলে ডাকিনী উপালির বর খুঁজে পায়, আমরা কেউই সে গল্প সঠিক ও বিস্তারিত জানি না। তবে সবকিছু ঠিক হওয়ার পর জানতে পারি, পাত্র ঢাকায় থাকে ও বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। পাশের ইউনিয়নে তাম্বুলপুরে মামাতো বোনের বাসায় বেড়াতে এসে পুলের উপর বসে উপালিকে দেখে পছন্দ হয়েছিল তার। খোঁজখবর নিয়ে ছেলেই প্রস্তাব দিয়েছিল। ছেলে ঢাকায় সরকার সাহেব এবং তার গ্রামের বাড়ি চেনে শুনে আমরা অনেকেই ভেবেছি, সরকার সাহেবই আসলে নাতনি সম্পর্কের উপালির বর ঠিক করে গ্রামে পাঠিয়েছিল। ছেলের বিস্তারিত খোঁজখবর জানতে ছেলের সঙ্গে ও ছেলের খরচেই ঢাকা গিয়েছিল উজাল।
একটাও চুল পাকেনি যার, এমন বোকচোদ হবু শ্বশুরকে ঢাকা শহরে কী দেখিয়ে কিংবা কী খাইয়ে এমন যাদু করেছিল যে, বিয়ের আগেই তাকে জামাই বাবাজি ডাকতে শুরু করেছিল জোয়ান শ্বশুর। জামাইকে নিয়ে গ্রামে ফিরে জামাইয়ের খরচেই দশজনকে ডেকে মেয়ের বিয়ে পরিয়ে দিয়েছিল। গ্রামবাসী কারো মতামতের তোয়াক্কা করেনি আর। আমরা তার জামাইকে দেখেছি, তার পোশাক-আশাক, হাতের ঘড়ি ও দামি স্মার্টফোন, দামি সিগারেটের ব্রান্ড দেখে ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠা ও সচ্ছলতা আন্দাজ করেছি মাত্র।
বিয়ের পর মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে উজালও যায় ঢাকা। কারণ শ্বশুরের জন্য জামাই গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকরি ঠিক করে রেখেছে। মাস দুয়েক পর গ্রামে ফিরে উজাল স্ত্রী-পুত্রকেও ঢাকা নিয়ে যায়। কারণ শাশুড়ি ও শালার জন্যও ঢাকায় চাকরি ঠিক করে রেখেছে তার যোগ্য জামাই। প্রথম দিকে তালাবদ্ধ পরিত্যক্ত বাড়িটি থাকে ইসুফ চোরের জিম্মায়। রহস্যময় বিদেশি নতুন নাতিন-জামাই তাকেও মোবাইল কিনে দিয়ে ফোনে সবার নাম্বার সেভ করে দিয়ে মোবাইল চালানোও শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
অতঃপর আমরা উজাল-উড়নি নাটকের পুরোনো ও নতুন দর্শকবৃন্দ, পুলে বসে তাদের অন্ধকার পরিত্যক্ত বাড়িটির দিকে তাকিয়ে ইসুফের মোবাইলে আসা খবরের ভিত্তিতে ঢাকায় তাদের আয়-উন্নতি ও সুখ-সাচ্ছন্দের মাপজোক করে নানা গল্প বানাই। ডাকিনীর জামাই বড় কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে, বেতন পায় ত্রিশ হাজার টাকা। আর স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে ডাকিনীর মাসে রোজগার এখন পঁচিশ হাজার টাকা। অতি সুন্দরী হওয়ার কারণেই হয়তো নতুন বউকে জামাই এখনো চাকরিতে ঢোকায়নি। আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। আর উজাল-উড়নি গ্রামের নড়বড়ে রাস্তাঘেঁষা ঘরের তুলনায় শহরের বস্তিতে এখন পাকা ঘর ভাড়া নিয়েছে। ইসুফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব সুখবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হই আমরা। মেয়ে-জামই ও নাতি জামাই তাদের সুখের ভাগ দিতে ইসুফকে শুধু মোবাইল ফোনে সুখবর পাঠায় না, মাঝে মাঝে তাকে বিকাশে টাকাও পাঠায়। শেষ বয়সে দিনেরাতে ইবাদত-বন্দেগি করলেও বুড়ো বাপকে ছেলেরা ভালো-মন্দ খাওয়ানো দূরে থাক, জরুরি অষুধপথ্যের টাকাটাও দেয় না। সেখানে মেয়ে ও নাতিন-জামাই তার দায়িত্ব নিয়েছে। এ জন্য প্রকাশ্যে সে উপরে আল্লাহ আর নিচে সরকার সাহেবকে শোকরিয়া জানাত প্রায়ই।
এর মধ্যে একদিন ঝড়ে উজাল-উড়নির ঘরের ছাদ উড়ে যায়, খুঁটিও ভাঙে। এই সংবাদ শুনেও উজাল-উড়নি একটুও দুঃখ করেনি। বরং বাপকে জানিয়েছিল, রাস্তার ধারের ঐ সরকারি বাড়িতে উঠবে না আর। জামাইয়ের সঙ্গে সরকারি দলের নেতাদের খাতির। তাদেরকে ধরে সে শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য ভূমিহীন গরিবদের জন্য সরকারি আশ্রম প্রকল্পের একটি বাড়ি বরাদ্দ করে দেবে। ইসুফ নিজের জন্য বিকাশে এবার কিছু বেশি টাকা দাবি করলে উড়নি গোপনে বাপকে বলেছিল, আরো বেশি টাকা রোজগারের জন্য জামাই বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। উপালি ও নিজের পাসপের্টও করে ফেলেছে। পারলে শ্বশুর-জামাই ও শালাকেও নিয়ে যাবে। আর বিদেশে যদি একবার যেতে পারে, দু’তিন বছর পর গ্রামে ফিরে জমি কিনে পাকা বাড়ি করবে। কিন্তু এই খবরটা এখনই গ্রামের মানুষের কাছে ভাঙতে নিষেধ করে দিয়েছে উড়নি। কারণ গ্রামের মানুষের মনগুলি যে আল্লা হিংসার বিষ দিয়ে গড়েছে, সেটা রাস্তার ধারে বাস করে তার মতো ভালো আর কে জেনেছে?
মেয়ে-জামাই কি নাতিজামাইয়ের বিদেশে যাওয়ার খবরটা ইসুফ প্রথমে আমাদেরও জানায়নি। কিন্তু সকল সুখবরের উৎস উজাল, উড়নি ও নাতি জামাইয়ের তিনটি ফোন একদিনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে লোকটা যেদিন হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে পাগলের মতো ঘুরতে থাকে, সেদিন থেকেই নিখোঁজ পরিবারের সন্ধানে আমরা, গাঁয়ের নানা বয়সী গোয়েন্দারা তৎপর হই। মোবাইল বিশেষজ্ঞরা ইসুফকে সাহায্য করতে নির্দিষ্ট নাম্বারে কল দিয়ে বারংবার একই জবাব পেয়েছি: দুঃখিত, এই নাম্বারটিতে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। গ্রামে উজাল-উড়নির ঘনিষ্ঠ দু’চারজনের মোবাইলে তাদের নাম্বারও সেভ করা ছিল। তারাও চেষ্টা করে একই জবাব পেয়েছে। যেহেতু মোবাইল ফোন ছাড়া তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সহজ ও বিকল্প পন্থা আর কিছু ছিল না, তাই ঘুরেফিরে মাসখানেক ধরে আমরা একইভাবে চেষ্টা চালাতে থাকি। মোবাইল বন্ধের কারণ আবিষ্কারে গোয়েন্দাদের একজন মত দেয়, ‘যেহেতু ইসুফ চোর ঘনঘন টাকা চেয়ে ফোন দিত, সেকারণে তার এবং গ্রামের পরিচিত সবার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে তারা।’ কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা নাম্বার থেকে কল দিয়েও একই জবাব পেয়েও তার মতটি খারজি করে দিই আমরা। আমাদের আরেক শিক্ষিত গোয়েন্দা মত দেয়, ‘সিম পাল্টে নতুন ফোন নিয়েছে তারা। গ্রামের সঙ্গে কোনো সংযোগ রাখতে চায় না, কারণ কম জ্বালাতন করেছে তাদের গ্রামবাসী?’ অপর একজন গোয়েন্দা মত দেয়, ‘ইসুফকে গোপনে যেহেতু বিদেশে যাওয়ার কথা বলেছে, বিদেশেই গেছে মনে হয়। সে জন্য দেশি ফোন কোম্পানির সিম অচল হয়ে গেছে।’ আমাদের এসব অনুমানে সবার আস্থা পাওয়ার আগে মনে পড়ে সরকার সাহেবের কথা। উজাল-উড়নির আসল খবর একমাত্র তার কাছেই পাওয়া সম্ভব।
ইসুফের অপেক্ষায় না থেকে আমাদের একজন সরকার সাহেবেকে ফোন করে তার আশ্রিতা পরিবারটির ফোন বন্ধ ও কোনোরকম হদিশ না পাওয়ার খবরটি জানাই। কিন্তু তিনি হদিশ দেওয়ার বদলে যেন আকাশ থেকে পড়েন । উজাল-উড়নি মেয়ের বিয়ের কথা তাকে কিছুই জানায় নি। তাদের ঢাকায় যাওয়ার খবরও জানেন না। ইসুফকে নিজেই ফোন করে জরুরি নির্দেশ দেন, শিগগির থানায় গিয়ে একটা কেস দিতে হবে। এলাকার অনেক ছেলেমেয়েই এখন সাভার-গাজীপুরে গার্মেন্টস-এ চাকরি করে, তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
ইসুফ সরকার সাহেবের জরুরি আদেশ অগ্রাহ্য করতে পারে না। আমাদের মত জানতে চায়। আমরা, গাঁয়ের অলস ও ব্যর্থ গোয়েন্দরা সরকার সাহেবের নিরেট অজ্ঞতাকে সহজে মানতে পারি না। কারণ উজাল-উড়নির মুখে আমরা অনেকেই শুনেছি, উপালির বিয়েতে আসল মনিবের মত নিয়েছে তারা। উপালির বরও সরকার সাহেবকে ভালো চেনে বলেই এ বিয়ে তার ইচ্ছেতেই হয়েছে বলে ধারণা করেছিল অধিকাংশ গ্রামবাসী। উপালিকে ঠাট্টা করে বিয়ের কথাও বলেছিলেন তার মনিব-নানা। নাতনি ও নাতিন জামাই হয়তো তার বাসাতেই আছে, এমন সন্দেহও করেছিলাম কেউবা। সন্দেহের কুলকিনারা করতে না পেরে ইসুফকে সরকার সাহেবের নির্দেশ মতো কাজ করতে বলি আমরা।
ইসুফ সরকার সাহেবের কথা বলে তার অনুগত গাঁয়ের হারেস মেম্বারকে নিয়ে থানায় যায়। প্রমাণ হিসেবে সরকারি মিটারের চলতি মাসের বিলটাও সঙ্গে নেয় ইসুফ। বাড়ি ভাঙার পরও মিটার ভাড়ার বিল মাসে মাসে আসে, এবং সে বিলে তার মেয়ের ফোন নাম্বারও লেখা আছে। কিন্তু ঘুষ খাওয়ার জন্য থানায় হা-মেলে বসে থাকে যে পুলিশ, উপযুক্ত ঘুষ ছাড়া তাদের কী দায় পড়েছে নিজের খেয়ে ইসুফ চোরের মেয়ে-জামাই-কিংবা নাতিন-জামাইয়েরও হদিশ খুঁজে বের করে দেবে। সরকার সাহেবের নাম বলার পরও কেস নেওয়া দূরে থাক, ডায়রি পর্যন্ত নেয়নি। তবে পরামর্শ দিয়েছে, যে কোম্পানিতে চাকরি করে বা যেখানকার বাসা থেকে হারিয়ে গেছে, নিয়ম অনুযায়ী সেই এলাকার থানায় গিয়ে জানাতে হবে। এরপর ইসুফ ধারকর্জ করে হাজার দুয়েক টাকা জোগাড় করে ছেলে আবুলকে ঢাকা পাঠিয়েছিল। আবুল ঢাকার গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ইত্যাদি জায়গায় ঘুরে গ্রামের পরিচিত বেশ কিছু গার্মেন্টস কর্মীর খোঁজ পেয়েছে, তাদের কোম্পানি-কারখানা ও বস্তিও দেখেছে, কিন্তু চেনা-অচেনা হাজার জনের কাছে জিজ্ঞেস করেও উজাল-উড়নি কি উপালির কোনো হদিশ বের করতে পারেনি।
আবুল ঢাকা থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসার পর, মিটারের লাল আলোয় অন্তুর ভূত আবিষ্কার এবং বাড়ির বাসিন্দাদের মরে ভূত হওয়ার আশঙ্কাটি অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা গাঁয়ের অপেশাদার ও সৌখিন গোয়েন্দা দল, যারা পুলের ওপর বসে পরিবারটির বেঁচেবর্তে থাকার হাজারকম অন্তরঙ্গ রূপ প্রত্যক্ষ করেছি, তারা মরে ভূত হওয়ার আশঙ্কা পাত্তা দেই না। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর গোয়েন্দাটি আবারও পরিবারটির বিদেশে যাওয়ার উপর জোর দিয়ে বলে, ‘ডাকিনীর জামাইয়ের চেহারা দেখিয়া বুঝছি আমি, মহা চালু মাল। পাসপোর্ট ভিসা করিয়া হউক, আর অবৈধ পথে ইন্ডিয়ার বর্ডার পার হউক, অথবা সমুদ্রপথে ট্রলারে চেপে দেশান্তরী হইছে সবাই। বিদেশ থাকি কয় বছর বাদে অনেক টাকা নিয়ে ফিরে গ্রামে যখন পাকা বাড়ি করবে, তখন টের পাইবেন কথাটা আমি ঠিক কইছিলাম কিনা।’
আমাদের মধ্যে যে ছেলেটি উপালির সঙ্গে প্রেম করতে চেয়েছিল, গোপনে তার ছবিও তুলেছে, সে পরিবারের বিদেশযাত্রাকে সমর্থন করে বলে, ‘আমার মনে হয় উপালিকে মুম্বাই নিয়া গিয়ে বেচে দেবে। ট্রেনিং দিয়া তাকে নায়িকা কি মডেল বানাইলে কোটি কোটি টাকা রোজগার করবে দালালটা।’
অন্য একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতো জোরালো কণ্ঠে বলে, ‘ইন্ডিয়া নয়, সে স্বপ্নে দেখেছে ইন্টারন্যাশনাল চিটার জামাই শ্বশুরকে গুম করে দিয়ে বউ উপালি এবং গায়েগতরে ও মোজাজে এখনও যুবতী শাশুড়ি, এমনকি সুদর্শন বালক শালাকেও কোটি টাকায় বেচে দিয়েছে দুবাইতে নিয়ে গিয়ে। দেশের সুন্দরী নারী পাচার আর কোটি কোটি টাকা পাচার ব্যবসায়ের সাথে উজালের চিটার জামইয়ের সাথে ঢাকায় সরকার সাহেবের মতো ক্ষমতাবান মানুষও জড়িত। আরবের ধনীরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে উজালের বউ-বাচ্চাদের শরীরের তেল নিঙড়ে নেবে। আমারা গ্রামে থেকে তাদের কোনো খবরই আর জানতে পারব না।’
আমরা যারা যুবতী উড়নি ও কিশোরী উপালির রূপ-যৌবন উপভোগে পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে নানা ফন্দিফিকির করেছি, কেউবা গোপনে কিছুটা সফলও হয়েছি, বাস্তবে সুযোগ না পেয়ে যারা কল্পনাতেও উড়নি কি উপালিকে সম্ভোগের আনন্দ-শিহরণ খুঁজেছি, উপালিকে কব্জায় না পাওয়ার খেদ মেটাতে তার ভাই চপলকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি যে ধর্ষক, তাদের সবার কাছে এ গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ঠিক ঠিক বলে তারা সমর্থন জানায়।
অন্যদিকে গাঁয়ের খেটে খাওয়া চাষীদের একজন পুলের ওপর গাঁয়ের বেকার যুবক গোয়েন্দাদের এসব সত্যসন্ধানী গল্প শুনে ধমক দিয়ে বলে, ‘গরিব মানুষ বিদেশে গিয়া কামকাজ করিয়া কোনোমতে টিকে আছে। মোবাইল ফোন হারায় ফেলছে নিশ্চয়। নতুন মোবাইল কিনতে পারেনি এখনো। আল্লাহ যদি হায়াত দারাজ করি থাকে, অবশ্যই বাঁচি আছে তারা। আর তাদের নিয়ে কী অকামের ফাতরা গালগল্প শুরু করছেন তোমরা?’
গাঁয়ের মুরব্বিদের আল্লাহনির্ভর এরকম যুক্তি শুনেও মাথা নাড়ে সবাই। কিন্তু তাতে নিখোঁজ পরিবারটির প্রকৃত অবস্থান জানার কৌতূহল ও দায়িত্ববোধ আমাদের মুছে যায় না। এ কারণে সরকার সাহেব এবার গ্রামে এলে, ইসুফের সঙ্গে আমরা সৌখন গোয়ন্দারা সবাই ভিড় জমাই তার বাড়িতে। নিখোঁজরহস্য উদ্ঘাটনে আমাদের ব্যর্থতার কথা জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত শুনতে চাই তার। কিন্তু সরকার সাহেব উত্তেজিত কন্ঠে চাঁচাছোলা জবাব দেন।
‘দেশে ১৮ কোটি মানুষের অন্তত ২৫ কোটি মোবাইল ফোন, তার মধ্যে কোনটা কী কারণে বন্ধ হয় -- সেটা তদন্ত করার দায়িত্ব কি আমার? আমি ঢাকায় থাকি বলে কি সরকারের ডাক-তার মন্ত্রী হইছি? ঢাকা নগরীর আশেপাশে হাজার হাজার গার্মেন্টস কোম্পানিতে গ্রামের প্রায় এক কোটি নারী-পুরুষ কাজ করে। হাজার হাজার বস্তিতে থাকে, তাদের কে কী হালে আছে সে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব কি আমার?’
সরকার সাহেবের যুক্তি সমর্থন করেও আমরা বলি, ‘উজাল-উড়নির ঢাকাইয়া জামাই তো বলেছিল, ঢাকায় আপনাকে চেনে ও আপনার গ্রামের বাড়িও চেনে। উড়নিও বলেছিল, তার মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছেন। সে জন্য আমরা ভেবেছিলাম বর আপনার পরিচিত।’
সরকার সাহেব পাল্টা যুক্তি দেখায়, ‘শহরের নামীদামি মানুষকে দেশের অনেক মানুষই চেনে। প্রধানমন্ত্রীকে দেশের কোটি কোটি গরিব মানুষ চেনে। তাই বলে কি গ্রামের গরিবদের কেউ প্রধানমন্ত্রীর চেনা আপনজন হয় কেউ? দেশ বিরোধী দলের নামকরা শত শত নেতাকর্মীও গুম হয়েছে, পুলিশ আজ পর্যন্ত তাদের হদিশ বের করতে পারেনি। ঢাকার থানাপুলিশকে আমি কেস দিলেও লাভ হবে না কোনো। আমার ভিটার আশ্রয়ে যখন ছিল, তখন তাদের প্রতি দায়িত্ব ছিল আমার। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে উড়নি যদি তার মেয়েটাকে আমার সঙ্গে দিত, তাহলে তোমরা আমার কাছে খোঁজ চাইতে পারতে। কিন্তু আমার কাছে এখন খোঁজ চাইতে এসেছো কেন? ঢাকায় খেয়েদেয়ে আমার কাজ নেই যে, ইসুফ চোরের মেয়ে-জামাইর তালাশ করব?’
গত প্রায় চার মাস ধরে নিরুদ্দেশ মেয়ের পরিবারের চিন্তায়, তারচেয়েও বড় কথা বৃদ্ধবয়সে ছেলেমেয়ে কারো কাছেই কোনো কোনো অর্থসাহায্য না পেয়ে চেহারা বেশ ভেঙে গেছে ইসুফের। আশায় ছিল, সরকার সাহেব বাড়িতে এলে একটা না একটা পথ বেরুবে। কিন্তু তার কথা শুনে ষোলো আনা হতাশাকে প্রশ্রয় দেওয়ার আগে বলে, ‘বড় ভাই, মোকে একটা শেষ চেষ্টা করতে দেন।’
ইসুফের শেষ চেষ্টা আসলে তার নিজের উদ্ভাবিত কোনো পন্থা নয়। আমাদের অঞ্চলের বিখ্যাত জ্বীন-মওলানার গল্প দূরদূরান্তরের মানুষও জানে। আমরা তাকে অনেকেই দেখেছি এবং তার ইমামতিতে নামাজও পড়েছি। জ্বীন-মওলানার বাবাও ছিল বিখ্যাত পীর। তাঁর বাড়িতে একটি পোষা জ্বীন ছিল। পীর মরে যাওয়ার পর পোষা জ্বীনকে নিজের ছেলের হাওলা করে দিয়েছে। পীরের ছেলে মাদ্রাসা লাইনে পড়াশুনো করে বড় মওলানা হয়েছে, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে এবং পাশের থানার বড় মসজিদের ইমামও সে। মানুষ বড় ধরনের বিপদে পড়লে মওলানা তার জ্বীনের সাহায্য নিয়ে মুসকিল আসান করে। নিজ গ্রামের এক ব্যবসায়ী জ্বীন-মওলানাকে জব্দ করার জন্য বলেছিল, কালকে এক পাওনাদারের কাছে বিশ লক্ষ টাকা পেয়েছিল সে। সাক্ষীপ্রমাণও দিয়েছিল তার। কিন্তু মুখোশ পরা ডাকাতরা বাড়িতে এসে সেই টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এখন জ্বীন-মওলানা যদি জ্বীনের সাহায্যে সেই টাকা উদ্ধার করে দিতে পারে, অর্ধেক টাকা সে তাকে দেবে। জ্বীন-মওলানা তার বাড়িতে গিয়ে অন্ধকার ঘরে পোষা জ্বীনকে তলব করে টাকা উদ্ধারে তার সাহায্য চেয়েছিল। জ্বীন বলেছিল, টাকা ডাকাতে নেয়নি, বেপারি সাহেব ব্যাংকে রেখেছে। তারপর তার ব্যাংক তদন্ত করে দেখা গেছে, এবং ভয়ে কবুল করেছে বেপারিও, জ্বীনের ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য টাকাটা নিজেই ব্যাংকে জমা রেখেছিল সে। বাজিতে হেরে গিয়ে দশ লাখ টাকা জ্বীন-মওলানাকে দিতে চেয়েছিল বেপারি। কিন্তু মওলানা জ্বীনের মাধ্যমে মানুষের উপকার করার জন্য এক টাকাও নেয় না। ব্যাপারীকে সামর্থ্যমতো মসজিদে দান করতে বলেছে। আর একজন ক্যানসারাক্রান্ত রোগীকে বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে পোষা জ্বীনের সাহায্য নিয়েছিল জ্বীন-মওলানা। জ্বীন মক্কা থেকে থেকে আরবী লেখা বোতলে যমযমের পানি এনে দিয়েছে। সেই পানি খেয়ে ক্যানসার ভাল হয়েও বছরখানেক বেঁচে ছিল মানুষটা। আবার যে মসজিদে জ্বীন-মওলানা ইমামতি করে, সেই মসজিদে জ্বীনও তার ইমামোতিতে নামাজ পড়ে। কথাটা বিশ্বাস না করে এক নামাজী জ্বীন দেখার জন্য নামাজে দাঁড়িয়ে সুরা বলার বদলে ঘাড় ফিরিয়ে এদিকওদিক দেখছিল, তখন আজগুবি ঘাড়ে অদৃশ্য হাতের চড় খেয়ে মসজিদে পড়ে গিয়ে মরার অবস্থা হয়েছিল তার। ইমাম হুজুর তার জ্বীনের দোয়া নিয়ে ভালো করেছে তাকে।
আমরা সরকার সাহেবকে জ্বীন-মওলানার এসব কুদরতের গল্প শোনাই। গ্রামে থাকেন না বলে তিনি এসব জানেন না। তাছাড়া আমরা জানি মানুষটার ধর্মকর্মেও মনোযোগ কম, গ্রামের মসজিদে তেমন দান করেননি, জামাতের নামাজেও শরিক হন না নিয়মিত।
জ্বীন মওলানার অলৌকিক ক্ষমতার গল্প শুনে সরকার সাহেব অবিশ্বাসের হাসি দিয়ে বলেন, ‘ধর্মের নামে ধর্মব্যবসায়ীদের ভন্ডামি-প্রতারণা এ দেশে নতুন কিছু নয়। এক ভ- জ্বীনের বাদশার গল্প পেপারে বেরিয়েছিল, পড়োনি তোমরা?’
শৈশবে ভূতের ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়েছিল যে, ঢাকা শহরে থেকে নামীদামি শিক্ষিত মানুষ হয়ে তার কোরান সমর্থিত জ্বীনকেও অবিশ্বাস করাটা আমাদের অনেকেরই পছন্দ হয় না। ইসুফ কান্নার গলায় বলে, ‘একবার শেষ চেষ্টা করিয়া দেখি বড় ভাই। মোর মতো গরিবের কথায় জ্বীন-মওলানা তো আসবে না, আপনার কথা কইলে মওলানা আসতে রাজি হইতেও পারে। আমি তার মোবাইল নাম্বার আনি দেব, মোবাইলে কথা বলেন আপনি।’
ধর্মভীরু গ্রামবাসী সবাই ইসুফের প্রস্তাবকে সমর্থন করে। আমরা সরকার সাহেবের মতো বেনামাজী ও সন্দেহবাদী গোয়েন্দারা তাকে আশ্বস্ত করি, ‘জ্বীন-মওলানা যদি সত্য উদঘাটনের নামে ভণ্ডামি করে, তবে আমরাও তাকে রেহাই দেব না।’ এরপর ইসুফ বিশ কিলো পথ ভেঙে সেদিনই ছুটে যায় জ্বীন-মওলানার বাড়িতে।
আমরা, গ্রামের ব্যর্থ তদন্তকারী ও কৌতূহলী মানুষ ভাঙাবাড়ির রহস্য উদ্ঘাটনে জ্বীনের কুদরত দেখার জন্য পুলের উপর অপেক্ষ করি। অবশেষে সরকার সাহেবকে টেলিফোনে দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী, দুদিন পর সন্ধ্যাবেলায় জ্বীন-মওলানার মোটরসাইকেলের তীব্র আলো পুলের উপর এসে থামে। পুলে অপেক্ষারত আমরা যারা তাকে চিনি, উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেই। মোটরবাইক নিজের হলেও নিজে সাধাণত চালান না তিনি। তারচেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ এক মওলানা তার চালক হিসেবে সঙ্গে এসেছেন। জ্বীন-মওলানা বড় জোর বছর চল্লিশ বয়সের আধুনিক মওলানা, রাতের বেলাতেও চোখে কালো চশমা, হাতে ধরা স্মার্টফোন। যারা তাঁকে আগে দেখেনি, তাঁরা মোটরবাইকের চালক মওলানাকেই আসল জ্বীন-মওলানা সন্দেহ করতে পারে। মোটরবাইক থেকে নেমে উভয়ে ভাঙা বাড়িটি দেখে এবং মিটারটি দেখতে জ্বীন-মওলানা তার মোবাইলের তীক্ষè আলো ফেলে জানতে চায়, এটা কী?
ইসুফ জবাব দেয়, ‘সরকারি জিনিস তো হুজুর, লাইন কাটি দেয় নাই এলাও। সরকার বিলও পাঠায়।’
জ্বীন-মওলানা আমাদের সরকার সাহেবকে নামে জানলেও এবং তার বাড়ি চিনলেও সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় হয়নি কখনো। আমরা তাকে নিয়ে সরকারবাড়িতে যাই।
পরিচয় পর্বে জ্বীন-মওলানা ও তার চালকও বয়োজ্যেষ্ঠ সরকার সাহবেকে সালাম দিয়ে মোসাহাবা করে এবং জানায়, ‘আংকেল, আপনার নাম এত শুনেছি, কিন্তু ঢাকা গিয়েও আলাপ-পচিয়ের সুযোগ হয়নি। আপনি গ্রামে এসেছেন এবং এই গুম হয়ে যাওয়া পরিবারটির সঙ্গে জড়িত শুনেই ছুটে এসেছি।’
সরকার সাহেব যেন চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে কথা বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা তো কেউই আজ পর্যন্ত পরিবারটির গুম রহস্যের কুলকিনারা করতে পারলাম না! গ্রামবাসী সবার বিশ্বাস, আপনার পোষা জ্বীনই আসল সত্য বলে দিতে পারবে। সেটা দেখার জন্যই আপনাকে ডাকা। দেখি আপনার জ্বীন আজ কী সত্য প্রমাণ করে।’
‘জ্বীন ইসনান সবই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। পবিত্র কোরানেও উল্লেখ আছে, মানুষ যেহেতু আশরাফুল মকলুকাত, মানুষের চেয়ে তো জ্বীনের ক্ষমতাও বেশি হতে পারে না আংকেল। তারা অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা, আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি নিয়ে মশগুল থাকে। মানুষের দুনিয়ার কোথায় কখন কোন ঘটনা ঘটছে, কেন ঘটছে, তার সুলক সন্ধান মানুষেরই ভালো জানার কথা। না কী বলেন আংকেল?’
সরকার সাহেব আমাদের সকলের হয়ে জবাব দেয়, ‘ইসুফ এবং গ্রামবাসী সবাই তো নানাভাবে সবখানে সন্ধান করেছে। খবরটা জেনে ঢাকায় আমার পক্ষে যতটা সম্ভব, খোঁজখবর করেছি। ইসুফকে থানায় কেস দিতে বলেছিলাম, কিন্তু গরিব ফেমিলিকে খুঁজে দিতে থানাপুলিশ কেস তো দূরের কথা, সাধারণ ডায়রি পর্যন্ত নেয়নি।’
‘আমি আমার জ্বীনহুজুরকে দিয়ে শেষ চেষ্টা করাব অবশ্যই, তার আগে নিজে একটু চেষ্টা করে দেখতে চাই।’
জ্বীন-মওলানার বাহক হুজুরও এবার উপস্থিত ভিড়ের উদ্দেশে ধমক দেয়, ‘আগে হুজুরকে বসতে দেন, উনি তো একা আসেননি, বসার জন্য দুটি চেয়ার দেন।’
জ্বীন-মওলানাকে বসতে দেওয়ার মতো উপযুক্ত ঘর কিংবা চেয়ার ইসুফ চোর তো তুচ্ছ, গ্রামের অনেক গেরস্তবাড়িতেও নেই। অগত্যা সরকার সাহেবই তার পাকা বৈঠকঘর ও বারান্দায় সকলের বসার ব্যবস্থা করেন। জ্বীন-মওলানার পাশে একটি চেয়ার খালি রাখা হয়। তাতে মওলানার সঙ্গে পোষা জ্বীন আসীন হয়েছে অনুমান করে আমরা সবাই ফাঁকা চেয়ারটার দিকে ঘন ঘন তাকাই, এমনকি সরকার সাহেবেও চশমা তাক করে দেখেন।
কথা বলেন জ্বী মওলানা, ‘ভাঙা বাড়িতে কারেন্টের মিটার এখনো জ্বলছে দেখলাম। তার মানে ওই বাড়িতে ফ্যান না থাউক, লাইট ছিল আর মোবাইল ফোন ও ফোনচার্জারও তো ছিল। নিখোঁজ যারা হয়েছে তাদের সবার ফোন নাম্বারগুলি দেন তো দেখি আমাকে।’
ইসুফ বলে, ‘আমাকে নাতি জামাই যে মোবাইল কিনে দিছে, তাতে সবার নাম্বার আছে। কিন্তু হাজার টিপলেও কোনো নাম্বারই কাম করে না। সে জন্য চটকে ফেলায় দিছি অচল জিনিসটাকে। আমার ছেলের কাছে ওটা।’
ইসুফের ছেলে আকবরও উপস্থিতি ছিল ভিড়ে। সে জলদি পকেট থেকে ফোন বের করে দেয় এবং সবার নাম্বারও চিনিয়ে দেয়। জ্বীন-মওলানা ফোনটা হাতে নিয়ে কললিস্ট পরীক্ষা করে, তারপর নিখোঁজদের তিনটি আলাদা নাম্বার নিজের দামী স্মার্টফোনে তুলে কল দিতে থাকে। আমরা যারা শতবার চেষ্টা করে ওসব নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয় গান শুনেছি, জ্বীন মওলানার কাছে ভিন্ন ফল পাওয়ার আশায় চেয়ে থাকি। কিন্তু তিনি আমাদের মতো হতাশ হয়ে ওঠেন। একটি নাম্বারে চেষ্টা করতেই সরকার সাহেবের ফোন বাজে। সরকার সাহেব জানান, ‘উড়নি ও উজালের ফোন নাম্বার আমার ফোনেও আছে, কিন্তু তাদের মেয়ে-জামাইয়ের ফোন নেই। জামাইকে দেখিওনি কোনোদিন।’
জ্বীন-মওলানা সরকার সাহেবের ফোন পরীক্ষা করে তার কথার সত্যতা যাচাই করার বদলে আমাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, ‘শুনলাম, ওনার মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। ওদের কোনো ছবি আছে আপনাদের কারো মোবাইলে? ওরা কি ফেসবুক করত? ফেসবুক আইডি ছিল কারো?’
উপস্থিত কৌতূহলী ভিড়ে যুবকদের মধ্যে আমরা যারা স্মার্টফোন ও ফেসবুক ব্যবহার করি, তাদের মধ্যে উপালির প্রেমিক ছিল একজন। সে গোপনে উপালির ছবি তুলেছিল একাধিক। নিখোঁজ হওয়ার পর ফেসবুকে উপালির ছবিসহ একবার পোস্টও দিয়েছিল। লিখেছিল, ‘আমাদের গ্রামের মেয়ে উপালি। ঢাকায় গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তার কোনো খোঁজ পেলে ইনবক্সে জানাবেন।’ সেই পোস্টে ৮৮ লাইক পেয়েছে, মন্তব্য পেয়েছে ২৯টি। উপালির রূপের প্রশংসা করে রূপই তার নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ বলেছে অন্তত দশজন। কিন্তু ইসুফ যেদিন থানাপুলিশের কাছে যায়, সেদিনই পোস্টটা ডিলিট করে দিয়েছে উপালির ভীরু প্রেমিক। সে ভয়ে ভয়ে জানায়, ‘আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে ওদের খোঁজ করেছি হুজুর, কিন্তু খোঁজ না পেয়ে উপালির সব ছবিও ডিলিট করে দিয়েছি।’
জ্বীন-মওলানা তার ফোনটাও হাতে নিয়ে আঙুল চটকে কী যেন পরীক্ষা করে।
সরকার সাহেব এবার বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করে, ‘সবার ফোন পরীক্ষা করে কে কবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কার সাথে কী সম্পর্ক ছিল, সেটা আবিষ্কারের চেয়ে ওরা এখন কোথায় আছে, দেশে না বিদেশে, বেঁচে আছে না মরে গেছে, সেটা জানা আমাদের জন্য জরুরি। কিন্তু আপনি ফোন পরীক্ষা করে যে সত্য উদ্ধার করবেন, সেটা তো সবাই বলে দিতে পারবে।’
জ্বীন-মওলানা হেসে বলে, ‘বুঝলাম আংকেল, থানা-পুলিশ কেস নিলে তারাও আধুনিক টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে ওদের গুম কেসের রহস্য উদ্ঘাটনের যেমন চেষ্টা করত, আপনারা অনেকেই সে চেষ্টা করেছেন। এখন জ্বীন হুজুরের সাহায্য নেব অবশ্যই। এশার নামাজের সময় তো হলো। চলেন, মসজিদে গিয়ে এশার নামাজটা পড়ে আসি। হুজুরও নামাজ পড়বেন আমাদের সঙ্গে। তারপর আপনার ঘরে বসেই তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে দেখি, কী জবাব দেন তিনি।’
জ্বীন-মওলানা পাশের খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে যে হুজুরের নামাজ পড়ার কথা বলেন, তাকে আমরা খালি চোখে কেউই দেখতে পাই না। তবু ভয়ঙ্কর কিছু দেখার মতো অনেকের বুক কাঁপে। মসজিদে নামাজে গিয়েও নামাজে মনোযোগী হওয়ার বদলে জ্বীনহুজুরকে দেখার চেষ্টা করায় একজনের ঘাড় মটকানোর গল্পটা স্মরণ করে ভয় পাই অনেকে। চেয়ারের দিকে না তাকিয়ে জ্বীনহুজুরের সঙ্গে আমরাও মসজিদে নামাজে যাই। সরকার সাহেবও আজ টুপি মাথায় জামাতে শরিক হন। অন্যদিনের চেয়ে আজ জাামতে বেশ ভিড় হয়। আমাদের মসজিদের ইমামের বদলে এশার নামাজে আজ ইমামতি করেন জ্বীন-মওলানা।
নামাজে আজ আমরা সাবই আল্লার প্রতি একাগ্র ছিলাম বলেই হয়তো মসজিদে কোনো অঘটন ঘটে না। নামাজ শেষে সবাই আবার সরকারবাড়ির বৈঠকখানা ও বারান্দায় ভিড় জমাই। আগের মতো জ্বীন-মওলানা তার পাশে একটি শূন্য চেয়ার রেখে নির্দেশ দেন, ‘ঘরের সব লাইট-ফ্যান বন্ধ করে দিতে হবে। আপনাদের হাতের মোবাইল ফোনগুলোও বন্ধ করতে হবে। হুজুর দুনিয়ায় মানুষের জ্বালানো কোনো আলোই পছন্দ করেন না। নিজস্ব রুহানি আলো দিয়েই সব দেখেন।’
আলো নিভানোর পর অন্ধকারে পিনপতন স্তব্ধতার মধ্যে জ্বীন-মওলানা আদেশ দেয়, ‘আপনারা আমার সাথে তিনবার সুরা ফাতেহা ও সুরা এখলাস পড়েন।’ আমরা মাথা নিচু করে সুরা আওড়াই, যারা পুরোটা মুখস্থ জানি না, তারাও চুপচাপ আল্লাহকে স্মরণ করি। সরকার সাহেব পাশে ছিলেন বলে আগের মতো সন্দেহভরা দৃষ্টিতে অন্ধকারে শূন্য চেয়ার বা হুজুরের দিকে তাকান কিনা, তাকিয়ে কিছু দেখতে পান কি না, আমরা বুঝতে পারি না। ঘরে থমথমে আতঙ্কময় পরিবেশে শূন্য চেয়ারটা কেউ যেন সরিয়ে সশব্দে বসে। মিহি কন্ঠে সালাম উচ্চারিত হয়, ‘আসলামো আলায় কুম রাহমুতুল্লাহে আলায় হে।’
মওলানা স্বকণ্ঠে সালামের জবাব দেয়, ‘হুজুর আপনাকে স্মরণ করেছি যে জন্য, আপনি তা জানেন এবং শুনেছেন। আমরা মাস চারেক ধরে নানা ভাবে খোঁজাখোঁজি করেও যাদের হদিশ বের করতে পারিনি, আপনি তাদের বর্তমান অবস্থানটা আমাদের বলে দেন।’
কিছুক্ষণ পর জবাব আসে, ‘দেখলাম। ভাঙাবাড়ির দুই আওরাত, মা ও মেয়ে, বাপ ও ছেলে, এবং তাদের নতুন জামাই -- নাই, তারা এ দেশের কোথাও নাই।’
‘তা হলে কি তারা সবাই বিদেশে চলে গেছে হুজুর? কীভাবে কোনো দেশে চলে গেছে তারা?’
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মিহি কন্ঠে জবাব আসে, ‘দেখলাম। নাই। এ দুনিয়ায় তারা কোথাও নাই। একটা বিশাল অন্ধকার গর্ত। সেই গর্তের তল নাই, গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেউ নাই। দুনিয়ার আলো দিয়ে তাদের আর খুঁজে পাওয়া পাবে না। অন্ধকার গর্তে ডুবে যাবে সবাই, ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে....।’
এরপর মিহিকণ্ঠে আরবী সুরা আবৃত্তির আওয়াজ, তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বিদায়ী সালাম উচ্চারিত হয় এবং শূন্য চেয়ারটি সশব্দে কাঁপতে থাকে।
জ্বীন-মওলানা একটা সুরা আবৃত্তি করে অদৃশ্য অশরীরী জ্বীন ও আমাদের সকলের উদ্দেশে যেন সালামের জবাব দিয়ে বলেন, ‘ হুজুর বিদায় নিয়েছেন। লাইট জ্বালেন এখন।’
ঘরের লাইট জ্বলে উঠলে আমরা টের পাই শূন্য চেয়ারটা উল্টে পড়ে আছে। আমরা জ্বীন-মওলানার দিকে তাকিয়ে থাকি, মওলানার বাহক সঙ্গীর দিকেও তাকাই। সরকার সাহেব জানতে চান, ‘কী বলল আপনার জ্বীন হুজুর, কিছুই তো বুঝলাম না! অন্ধকার গর্তে নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা কী বলল?’
‘বাংলাতেই তো কথা বলল জ্বীন হুজুর। এ দুনিয়ায় আর তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশাল অতল এক অন্ধকার গুহা, সেই গুহার মধ্যে পড়ে সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এর আগেও এরকম এক নিখোঁজ রহস্য ভেদের জন্য হুজুরকে স্মরণ করেছিলাম। সেদিনও তিনি একই কথা বলেছেন। দেশে এত উন্নতির আলো, কিন্তু আমার জ্বীন হুজুর কেন অতল অন্ধকারে সবার নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা বলেন -- এর ব্যাখা আমিও সঠিক দিতে পারব না আংকেল। তার চেয়ে আসেন, সবাই হাত তুলে অতল অন্ধকার গুহার যাত্রীদের জন্য আমরা দোয়া করি।’
জ্বীন-মওলানা মুনাজাত করে সরকার সাহেব ও আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে অদৃশ্য হয়ে যান। ইসুফ চোরই প্রথম কেঁদে সরকার সাহেবকে বলে, ‘বুঝিছোঁ মুই বড়ভাই, মোর বেটি-জামাই ও নাতনি- জামাই কাঁয়ও আর এ দুনিয়ায় বাঁচি নাই। অন্ধকার গর্তের মানে বুঝিঁছো মুই। এই গর্তে এবার হামারও পড়তে দেরি নাই।’
কান্নায় ভেঙেপড়া ইসুফকে আমরা সান্ত¡নাও দিতে পারি না। কাঁদতে কাঁদতে সে বাড়ি চলে যায়। সরকার সাহেবের মধ্যে জ্বীন-ভূতে যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের ছায়া আমরা দেখেছিলাম, এখন তিনিও আর উচ্চবাচ্য করছেন না। আমরা সন্দেহবাদী তদন্তকারীরা যারা নিখোঁজ রহস্যের সঙ্গে সরকার সাহেবের সংশ্লিষ্টতা সন্দেহ করেছি, এমনকি উড়নি ও উপালির সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক নিয়েও সন্দেহ জেগেছিল কারো কারো, জ্বীনহুজুর তেমন সন্দেহ উস্কে দিতে তার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। আর জ্বীন-মওলানা আমাদের ফোন নিয়ে তদন্ত করলেও তার ফোনের কললিস্ট খতিয়ে দেখেনি। এ কারণে জ্বীন-মওলানা ও তার পোষা জ্বীনের প্রতি তার নতুন আস্থা জাগল কি?
সরকার সাহেবকে গম্ভীর ও চুপচাপ দেখে সন্দেহবাদী যুবকদের মধ্যে একজন বলে, ‘আংকেল, আমার কিন্তু জ্বীন-মওলানার সঙ্গীটাকেও সন্দেহ হয়। ঘর অন্ধকার করে সেই জ্বীন সাজিয়া ভয় দেখায়নি তো?’ আরেকজন বলে, ‘জ্বীন-মওলানার ফোনে রেকর্ডারও থাকতে পারে, সেই রেকর্ড বাজিয়ে আমাদের অন্ধকার গর্তের ভয় দেখাল নাকি?’
আমরা বেনামাজী যুবকরা যখন এরকম সন্দেহ-সংশয়ের কথা বলে সরকার সাহেবকে দলে টানার চেষ্টা করছি, তখন তিনিও জ্বীন-মওলানার পক্ষ নিতেই যেন, গম্ভীর হতাশ হয়ে বলেন, ‘উড়নি-উজালের পরিবার আমার ভিটা থেকে বিদায় নিয়ে যেখানেই যাক, ওরা ভালো আছে, এখনো বেঁচেবর্তে আছে-- এটা প্রমাণ করতে না পারলে জ্বীন-মওলানাকে ভ- বা প্রতারক বলি কী করে? সে তো এসব করার জন্য আমাদের কাছে একটা টাকাও নিল না!’
অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা আগে থকেই গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী, জ্বীনের অস্তিত্ব ও দৈববাণী নিয়ে তাদের মনে তিলমাত্র সন্দেহ জাগেনি। বরং সবার উপরে টুপির মতো কবরযাত্রার ভয়টা কমবেশি ভর করেছে যেন। এদেরই একজন ছুটে এসে খবর দেয়, ‘ইসুফ বাড়িতে যাওয়ার পর অজু করার সময় উল্টে পড়ে গেছে। তাকে ধরাধরি করে বিছনায় তুলতেই আজগুবি মরে গেল মানুষটা! হায় আল্লাহ!’
সরকার সাহেবসহ আমরা সবাই ইসুফের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। তার বাড়িতে যাওয়ার পথে পরিত্যক্ত বাড়িটার কাছে এসে দেখতে পাই, টিনের বেড়ায় সাঁটানো মিটারটি আগের মতো জ্বলছে না আর। কে বা কারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে নাকি লাইন থেকেই বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে, আমরা জানি না। মিটারটিসহ নির্জন ও পরিত্যক্তবাড়িটিও যেন বিশাল এক অন্ধকার গুহায় লীন হয়ে গেছে। কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করে, অতল অন্ধকার গুহায় হারিয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে আমরা মৃতের বাড়ির দিকে এগুতে থাকি।
লেখক পরিচিতি
মঞ্জু সরকার
জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে রংপুরে। একজন বাংলাদেশী লেখক।
তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) পেয়েছেন।
তিনি কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় এবং কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রকাশনা কর্মকর্তা পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন তিনি। তারপরে তিনি দৈনিক আমার দেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
মঞ্জু সরকার
জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে রংপুরে। একজন বাংলাদেশী লেখক।
তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) পেয়েছেন।
তিনি কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় এবং কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রকাশনা কর্মকর্তা পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন তিনি। তারপরে তিনি দৈনিক আমার দেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
প্রকাশিত বই :
- আমস (১৯৮৪)
- নগ্ন আগন্তুক (১৯৮৬)
- প্রতিমা উপাখ্যান (১৯৯২)
- দাড়াবার জায়গা (১৯৯৪)
- আবাসভূমি (১৯৯৪)
- ভাঙ্গনের সময় ভালোবাসা (১৯৯৫)
- মৃতা (১৯৯৫)
- স্বপ্নচোর (১৯৯৭)
- শিন্দুকের চবি (২০০৯)
- 'লেখক'(২০১৯)।
0 মন্তব্যসমূহ