কয়েক দশক আগে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা এনহেদুয়ান্নার কাজ আবিষ্কার করেছিলেন, একজন প্রাচীন পুরোহিত যিনি সাহিত্যের গল্পকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কেন তার দাবি নিশ্চিত করা হয়নি?
এলিজাবেথ উইঙ্কলার
অনুবাদ : শুভ চক্রবর্তী
প্রায় তেতাল্লিশশো বছর আগে এই অঞ্চলের নাম ছিল ইরাক । এখানে একজন ভাস্কর একটি শাদা-চুনাপাথরের চাকতির মধ্যে মন্দিরের আচার অনুষ্ঠানের তদারককারী একজন মহিলার ছবি তৈরি করেছিলেন। তিনি সম্মান সূচক মুকুট এবং পৌরহিত্যের পোশাক পরে আছেন। মহিলাটির সামনে একজন ও পিছনে দু'জন পুরুষ পরিচারক রয়েছেন।তাঁরা একটি বেদীতে পবিত্র সূরা ঢালছেন । চাকতির পিছনে লেখা আছে এনহেদুয়ান্না। তিনি মহাযাজক, এবং রাজা সারগনের কন্যা। কিছু কিছু পণ্ডিত বিশ্বাস করেন-- পুরোহিতই ছিলেন বিশ্বের প্রথম নথিভুক্ত লেখক। যেমন একটি মাটির স্লেটে একটি দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা সংরক্ষিত আছে: "আমি অভয়ারণ্যের কাছে বাসস্থানের জন্য আমার জায়গা সুনিশ্চিত করেছিলাম,/ আমি ছিলাম মহাযাজক, আমি, এনহেদুয়ান্না।" সুমেরে, দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতা । সেখানেই লেখার প্রথম উদ্ভব হয়েছিল । আর এই লেখাটি ছিল নামহীন কোনো লেখকের। যদি এনহেদুয়ান্নাই এই শব্দগুলি লিখে থাকেন তবে তিনিই প্রথম লেখক। তাঁরই হাত ধরে লেখকত্বের সূচনা। অলঙ্কারশাস্ত্রের সূচনা, এমনকি আত্মজীবনীর লেখার সূচনাও বিস্তারিত হয়েছে । তিনি হোমারের পনেরোশো বছর আগে, স্যাফোর সতেরোশো বছর এবং অ্যারিস্টটলের দু'হাজার বছর আগে বেঁচে ছিলেন। আর তাই তাঁকে ঐতিহ্যগতভাবে অলঙ্কার শাস্ত্রের ঐতিহ্যের জনক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
কিউনিফর্মের (প্রিজম-আকৃতির) ছাপগুলিতে লেখা কবিতাটি পুরোহিতের জীবনের একটি সংকটের সময় বর্ণনা করে। এনহেদুয়ান্নার পিতা ছিলেন সারগন। তিনি মেসোপটেমিয়ার শহর-রাজ্যগুলিকে একত্রিত করেছিলেন। আর সেই রাজ্যগুলোকে কখনও কখনও ইতিহাসের প্রথম সাম্রাজ্যও বলা হয়।
সারগনের সাম্রাজ্য পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল।আধুনিক যুগের কুয়েত, ইরাক, জর্ডান এবং সিরিয়াকে জুড়ে রয়েছে সেই সাম্রাজ্যের বিস্তার। যার মধ্যে পঁয়ষট্টিরও বেশি শহর রয়েছে । প্রত্যেকটির শহরের নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্য, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং স্থানীয় পরিচয় রয়েছে। যদিও সারগন আক্কাদ উত্তরে থেকে তাঁর শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।আর অন্যদিকে, তিনি তাঁর কন্যাকে দক্ষিণের উর শহরের চাঁদ দেবতার মন্দিরে মহাযাজক নিযুক্ত করেছিলেন। আর এই অবস্থান ছিল বাহ্যিকভাবে ধর্মীয় ব্যবস্থা ।বাস্তবে কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। কেননা এই ব্যবস্থা সাম্রাজ্যের ভিন্ন অংশকে একত্রিত করতে সাহায্য করেছিল সারগনকে । সারগনের মৃত্যুর পর রাজ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়। তার ফলে রাজ্য সমগ্র নিয়ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এবং সিংহাসনটি সাময়িকভাবে এনহেদুয়ান্নার ভাইদের কাছে চলে যায়।এবং পরে তার ভাইপোর কাছে । কবিতায়, লুগালেন নামে একজন দখলদারের কথা জানা যায়--- যিনি একজন সামরিক জেনারেল ছিলেন।তিনিই সম্ভবত উরের মধ্যে একটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর এই কারণে-এনহেদুয়ান্নানাকে মন্দিরে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেন।
তিনি মন্দিরটিকে একটি বদনামের আখড়ায় পরিণত করেছেন। তিনি গায়ের জোরে এই কাজ করেছেন। আর লালসায় আমার সমকক্ষ হওয়ার সাহস করেছেন!" এনহেদুয়ান্না বলেছেন। তাকে শহর থেকে বের করে দাও, সে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায়। “তিনি আমাকে কাঁটাভরা পথে হাঁটতে বাধ্য করেছেন। / তিনি আমার পবিত্র মন্দিরের মহৎ পদমর্যাদা কেড়ে নিয়েছিলেন। আমাকে একটি ছুরি দিয়ে বলেছেন : 'এটাই আপনার জন্য ঠিক,' যদিও আত্মসাৎকারীর অপরাধের সম্পূর্ণ তাৎপর্য আক্ষরিক অনুবাদে হারিয়ে যায়। কিন্তু ভাষাটি যৌন লঙ্ঘনের পরামর্শ দেয়।
(একজন অনুবাদক উল্লেখ করেছেন যে ক্রিয়াপদগুলি যৌন প্রবাহ বোঝাতে অন্যত্র ব্যবহৃত হয়।) এমনকি আত্মহত্যার প্ররোচনাকেও নির্দেশ করে ।
কেননা তাঁকে একটি ছুরি দিয়ে লুগালেন তাঁকে আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত করেন। "এটাই আপনার জন্য ঠিক।"
এনহেদুয়ান্নার পরিত্রাণ তাঁর অলঙ্কার শাস্ত্রের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু তিনি মনে করেন যে তাঁর আর সে ক্ষমতা নেই ,শুকিয়ে গেছে।
"আমার একসময়ের মধু মুখ এখন ফেনায় ভরে গেছে , / হৃদয়কে খুশি করার মতো ক্ষমতা আমার ধুলোয় পরিণত হয়েছে," তিনি বলেছেন ।
এই সংকটমুহূর্ত অতিক্রম করার জন্য তিনি প্রথমে চাঁদের দেবতার কাছে প্রার্থণা করেন। কিন্তু চাঁদের দেবতা তাঁকে উপেক্ষা করেন:
" হে আমার জোছনা আমার জন্য কোন আদর নেই!কোনো ভালোবাসা নেই! / সে আমাকে প্রতারিত করে এই আশায়, যেন আমি ধ্বংস হয়ে যায়।"
তারপরে তিনি প্রেম, যৌনতা এবং যুদ্ধের দেবী ইন্নার কাছে ফিরে যান। এবং তাঁর গৌরবের জন্য একটি গৌরবগাথা পরিবেশন করেন: " হে আমার প্রিয় ! এই দেশ আবার মাথা নত করবে তোমার যুদ্ধের কান্নায়!এনহেদুয়ান্নার সংকটের উত্তরণ ঘটে তাঁর গৌরব গাথার প্রশংসায়। এবং তাঁর কবিতার সৃষ্টির মাধ্যমে। যাকে বলা হয় "ইনান্নার গৌরবগগাথা"।
আর এই গৌরবগাথাই হ'য়ে ওঠে তাঁর আত্মসচেতন আমির আধার। যেখানে তিনি লেখার কাজটিকে প্রসব বেদনার সঙ্গে তুলনা করেছেন ।
কেননা "এই লেখাই আমাকে পূর্ণ করে। কেননা এই আভা আমার থেকে উপচে পড়ে। হে মহিমান্বিত প্রিয়, যেমন আমি তোমার জন্য জন্ম দিয়েছি।/ আমি তোমাকে রাতের অন্ধকারে নিশ্চিত করেছি।
একদিন দিনের উজ্জ্বলতায় একজন গায়ক তোমার জন্য গাথা পরিবেশন করবেন!"
এনহেদুয়ান্নার ভাইপো অবশেষে বিদ্রোহ প্রত্যাহার করে নেন। ফলে এনহেদুয়ান্না তাঁর মন্দিরের পদমর্যাদা ফিরে পান । তিনি ইনান্নাকে তার উত্তরণ হিসেবে মনে করেন---" তবুও জেনে রাখো তুমিই বিদ্রোহী দেশ ধ্বংস করেছ!"-কিন্তু কবিতাটি ইঙ্গিত করে এনহেদুয়ান্না ইনান্নার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন।কারণ উরের পরিত্রাণের ভূমিকা রেখেছিল ইনান্নার প্রসঙ্গই।
কেননা দেবী এবং পুরোহিত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।পুরোহিত হচ্ছেন ঐশ্বরিক পার্থিব প্রতিনিধিত্বের অংশ। কবিতাটি রাজনৈতিক। কিন্তু তারপরেও ক্ষমতা এবং ভাষার মধ্যে সম্পর্ককে যুক্ত করে। তবে কবিতাটির মধ্যে ব্যক্তিগত বিষয়েরও আঘাত আছে।
"দ্য এক্সাল্টেশন" ছাড়াও আরও দু'টি পাঠ্য প্রসঙ্গে বলা হয় এনহেদুয়ান্নাই এই পাঠ্যের জনক :
"A Hymn to Inanna", এই নাম অনুসারে এনহেদুয়ান্নাইর নাম উল্লেখ করা হয়।এবং "Inanna and Ebih", যা তাঁর শৈলীগত ভিত্তিতে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর দাবি বিয়াল্লিশটি ধর্মীয় কবিতার সংকলনের সঙ্গে এই প্রসঙ্গ সংযুক্ত রয়েছে।তাঁর ধারণা---এমনকি বিভিন্ন শহর-রাজ্যের মন্দিরেও সম্বোধন করা স্তোত্র কবিতার মধ্যে তার নিদর্শন রয়েছে।
সমস্ত স্তোত্র কবিতাগুলোকে ইয়েল পণ্ডিত উইলিয়াম হ্যালো এবং জে.জে.এ. ভ্যান ডাইক অভিহিত করেছেন "মেসোপটেমিয়ার ধর্মতত্ত্বের প্রধান অংশ" বলে । কারণ এই অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও দেবতাকে একত্রিত করে।এবং তাঁরা এ-ও মনে করেন-- এনহেদুয়ান্না একজন "ধর্মতত্ত্ববিদ" । চাকতিটি একটি পুনশ্চ লেখা দিয়ে শেষ হয়: " আর স্লেটটির মধ্যে বিষয়ই হলো এনহেদুয়ান্না।/ হে আমার রাজা, এখানে এমন কিছু তৈরি করা হয়েছে যা আগে কেউ তৈরি করেননি!" আর প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় এনহেদুয়ান্নার কাজগুলিকে নিয়েই চর্চা হতো।এমনকি এদুব্বাস বা স্ক্রাইবাল স্কুলের পাঠ্যক্রমের অংশও ছিল তাঁর লেখা। যেগুলো ভবিষ্যতের পুরোহিত এবং সরকারি কর্মচারীদের কিউনিফর্ম লেখা এবং সুমেরীয় ব্যাকরণে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। শত শত বছর ধরে শিক্ষার্থীরা মাটির স্লেটে এনহেদুয়ান্নার কথাগুলো খোদাই করেই শিখেছেন।এবং "দ্য এক্সাল্টেশন অফ ইনন্না"-এর এই কপিগুলির মধ্যে প্রায় একশোটি এখনও টিকে আছে এই কারণেই।
কিন্তু তাদের আবিষ্কারের পর থেকে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পণ্ডিতরা এনহেদুয়ান্নার লেখকত্ব নিয়ে তীব্র বিতর্ক করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর লেখা নিয়ে।পুরোহিত এনহেদুয়ান্না কি সত্যিই এই লেখাগুলো লিখেছিলেন? গ্রিসের স্বর্ণযুগের দু'হাজার বছর আগে লিখিত ঐতিহ্যের সূচনাপর্বে একজন নারীর ধারণাটি কি সত্য হওয়া খুব যুক্তিযুক্ত ?
এই শীতে, নিউ ইয়র্কের মরগান লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামে একটি প্রদর্শনী চলছে।তিনি লিখেছেন: "এনহেদুয়ান্না এবং মেসোপটেমিয়ার নারী" পুরোহিতকে তার প্রাপ্য দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। "আপনি আপনার পরিচিত কাউকে জিজ্ঞাসা করুন এবং তারা বলবেন প্রথম লেখক হেরোডোটাস বা অন্য কেউ।" কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন প্রদর্শনীর অধ্যক্ষ সিডনি ব্যাবকক । "এটা সবসময় আমাকে বিস্মিত করে । কেউ কখনও তাঁর সঙ্গে একমত হবেন না।" উর শহরটি প্রথম খনন করা হয়েছিল আঠারোশো-পঞ্চাশের দশকে। কিন্তু ১৯২২ সাল পর্যন্ত এর বেশিরভাগই অনাবিষ্কৃতই ছিল।আর সেইসময় একজন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক লিওনার্দো উলি ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থানুকূল্যে একটি যৌথ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। উলি আব্রাহাম প্রাচীন পৌত্তলিক রাজাদের বাইবেলের বাড়ি দেখে উরে কাজ করার জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন। (তাঁর খননের বিবরণ, "উর অফ দি ক্যালদিস: এ রেকর্ড অফ সেভেন ইয়ারস অফ এক্সকাভেশন " জেনেসিসকে ইঙ্গিত করে:
"এবং তেরাহ আব্রামকে নিয়ে গেলেন . . আর তাঁর পুত্রবধূ (আব্রামের স্ত্রী) সারাইকে । এবং তারা চ্যালদিদের উর থেকে তাদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন।”) উলির দুর্দান্ত সন্ধান ছিল রাজকীয় কবরস্থানগুলো। যেখানে তাঁর গবেষক দল গয়না, অস্ত্র, মাটির পাত্র, বাদ্যযন্ত্র এবং অন্যান্য ধন-সম্পদ সহ রাজা ও রাণীদের সমাধি খুঁজে বের করেছিল। উর অবশ্য এনহেদুয়ান্নার নিজের বাড়ি ছিল না । ১৯২৭ সালে খননের পাঁচ বছর পরে, খননকারীরা একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন । সেখানে তাঁরা একটি পাথরের চাকতির বিকৃত অবশেষ খুঁজে পেয়েছিলেন - চাকতিটিতে এনহেদুয়ান্নাকে চিত্রিত করা হয়েছে - এবং পাশাপাশি পুরোহিতের নামকরণ করা আরও তিনটি বস্তু তাঁরা পেয়েছিলেন : তাঁর চাকরদের সিলমোহর । এবং মন্দিরের অন্য কোথাও কিউনিফর্ম লিপিতে আবৃত মাটির স্লেটও ছিল। "এখানে নিশ্চিত প্রমাণ ছিল যে পুরোহিতরা তাদের প্রাঙ্গনে একটি স্কুল রেখেছিলেন।" কথাটি উলি লিখেছেন তাঁর গবেষণায় । কিন্তু তিনি মন্দিরটিকে "নানারী" এবং "হারেম" বলে অভিহিত করেন । কিন্তু তিনি আবিষ্কারের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
উরেতে পাওয়া কিছু স্লেটও ছিল। যেগুলো এনহেদুয়ান্নার লেখার অনুলিপি। কিন্তু উলি, ইতিহাস-রাজনৈতিক রাজবংশ ও বাইবেলের পিতৃপুরুষের টানে - মনে হয় পুরোহিত এনহেদুয়ান্নার প্রতি কোন আগ্রহই দেখাননি।কেননা সেখানে এনহেদুয়ান্নাকে তাঁর বিখ্যাত পিতার একটি অসংগত অনুষঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয় । এমনকি উলি তাঁর বইটিতে এনহেদুয়ান্নার নাম পর্যন্তও নেই।তাঁকে কেবল সারগনের কন্যা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী বছরগুলিতে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং লুটেরারা নিপপুর এবং লারসার মতো শহরে এনহেদুযান্নার লেখা ছাড়াও অন্যান্য স্লেটগুলি আবিষ্কার করেছিল ।
কিন্তু পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত তাঁর কাজের অংশটি প্রতিলিপি করা। কিন্তু তা প্রকাশিত এবং তাঁরই কিনা এমন কোনো দাবী তোলা হয়নি । ১৯৬৮ সালে সুমেরিয়ান থেকে ইংরেজিতে তাঁর লেখার প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
হ্যালো এবং ভ্যান ডাইক তাঁদের অনুবাদের ভূমিকায় লিখেছেন "আমরা এখন এক প্রথমসারির কবিতার একটি সংগ্রহ দেখতে পাচ্ছি যা কেবল তার লেখকের নামই প্রকাশ করে না, সেই সঙ্গে লেখককের সত্যিকারের আত্মজীবনীমূলক শৈলী ভিন্ন এক সূচনাপর্বকে বর্ণনা করে।"
"এনহেদুয়ান্নার ব্যক্তিত্বে আমরা এমন একজন মহিলার মুখোমুখি হয়েছি যিনি একই সময়ে রাজকন্যা পুরোহিত এবং কবি ছিলেন।" এই দুই অনুবাদক স্বীকার করেছেন যে পণ্ডিতদের ভিন্ন ভিন্ন ধারণার আভা অসম্পূর্ণও হতে পারে। অর্থাৎ সেই ধারণা স্পষ্ট নয়।
"আমরা এখনও এনহেদুয়ান্নার সাহিত্য রচনার সম্পূর্ণ বিস্তৃতিও জানি না।" তাঁরা লিখেছিলেন "কিন্তু তাঁর শৈলীর চিহ্ন এবং কবিতাগুলিতে তার প্রত্যয় এতটাই শক্তিশালী যে তাঁকে অবশ্যই লেখক হিসেবে মেনে নেওয়া যায়। হয়তো এটা একদিন সম্ভবও হবে । অন্যান্য সংরক্ষিত টুকরোগুলিতেও তাঁর লেখকত্ব সনাক্ত করা যায়।"
যখন হ্যালো এবং ভ্যান ডাইক লক্ষ্য করছিলেন যে এনহেদুয়ান্না হয়তো উন্মোচিত হওয়ার চেয়ে আরও বেশি করে কিছু লেখার চেষ্টা করেছেন— সারগনের সাম্রাজ্যের রাজধানী আক্কাদ এখনও খনন করা হয়নি — আর এ বিষয়ে অন্যরা তাঁর দাবিকে অস্বীকার করছিল।
ব্রিটিশ পণ্ডিত ডব্লিউ জি ল্যামবার্ট একজন ভূত লেখকের সম্ভাবনা উত্থাপন করেছিলেন। এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন এনহেদুয়ান্নার পাঠ্যগুলির মধ্যে অন্তত একটি একজন লেখক দ্বারাই রচিত হতে পারে।
সুমেরীয় রাজাদের জন্য প্রায়শই লেখকরা তাঁদের নিজেদের রচনা রাজাদেরকে উৎসর্গ করতেন।) "প্রাচীন গ্রন্থের প্রতি আমাদের আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই বিচারের সর্বোত্তম মাপকাঠি নয়।"
তিনি পরে লিখেছিলেন, ২০০১ সালে।
অন্যান্য পণ্ডিতরা এনহেদুয়ান্নার প্রতি প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর কাজের সংরক্ষিত সংস্করণগুলি নিয়ে। যেগুলো এদুব্বাসের ছাত্রদের দ্বারা অনুলিপি করা হয়েছিল।তাঁর মৃত্যুর পাঁচশো বছর পরে। এনহেদুয়ান্নার নিজের সময়ের কোন কপি আজ আর নেই। এবং, কিছু ক্ষেত্রে, পাঠ্যগুলিতে স্থানের নাম এবং শব্দ রয়েছে যে-শব্দগুলো তাঁর যুগের অনেক পরের শব্দ। অর্থাৎ অনুলিপি করার সময় সেই শব্দ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আর এমনটা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লেখকের অনুলিপি করার প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের ফলে ।পরিবর্তনগুলি সাধারণত পুরানো আখ্যানগুলির পুনরুৎপাদনের অংশ হতে পারে-কিন্তু কেউ কেউ এই প্রক্রিয়াকেই সন্দেহের কারণ হিসাবে দেখেন।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাসিরিওলজির অধ্যাপক পল ডেলনেরো আমাকে বলেছিলেন। "এনহেদুয়ান্না প্রথম পুরুষে কথা বলেন, কিন্তু এটা লেখক হওয়ার মতো গুন নয় ।" এনহেদুয়ান্না একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হতে পারেন যা পরবর্তী লেখকদের দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। আর, হয়তো তাঁদের কর্তৃত্ব ধার দেওয়ার কাজে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছিল।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে কারও কারও কাছে এই দাবিগুলি বেশ বিস্তারিত । "কেন লেখকরা পিছনে ফিরে তাকাবেন এবং একজন মহাযাজককে খুঁজে পাবেন এবং বলবেন যে তিনি গ্রন্থগুলি লিখেছেন?"
ইয়েলের অ্যাসিরিওলজির অধ্যাপক বেঞ্জামিন ফস্টার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। “প্রচুর মহাযাজক ছিলেন। কেন তাঁকেই বেছে নিতে হলো?" ফস্টার অবশ্য সন্দেহবাদীদের মতোই অস্থির প্রকৃতির।
"আমাদের একটা প্রবণতা রয়েছে যে এই বিষয়টিকে তাদের কথায় প্রাচীন গ্রন্থগুলি না নেওয়াকে প্রজ্ঞার লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা।" তিনি বলেছিলেন। "উত্তেজিত এবং আবেগপ্রবণ হওয়া মোটেই ভালো নয়। আপনার একটি বিচ্ছিন্ন সংশয় অন্তত থাকা উচিত।কিন্তু প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অন্য কোনো লেখকের কাছে আমাদের কাছে তার চেয়ে বেশি প্রমাণ রয়েছে।
কিন্তু ফস্টারের, এনহেদুয়ান্নার লেখকত্ব নিয়ে "কোন সন্দেহ নেই"। কবিতাগুলির আত্মজীবনীমূলক বিষয়বস্তু। বর্ণনামূলক স্বরের গভীর অন্তরঙ্গ গুণের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এবং তারপরেও "দ্য এক্সাল্টেশন"-এর অদ্ভুতভাবে মহিলার চিহ্ন রয়েছে—যেমন যৌন লঙ্ঘনের ভাষা, সন্তানের জন্ম হিসাবে লেখার রূপক, এমনকি দেবতার পরিবর্তে দেবীর জন্য কথা বলার মতো বিষয় ।
যদিও বিভিন্ন উপায়ে, বিতর্কিত তাত্ত্বিক দৃষ্টান্তগুলির প্রতিযোগিতার জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্র পরিণত হয়েছে। সত্তরের দশকে যখন দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদ প্রবাহ বিকশিত হচ্ছিল।তখন এনহেদুয়ান্নার লেখকত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি চাপ তৈরি হয়েছিল । নব্বইয়ের দশকে একই ধরনের আন্দোলন হয়েছিল ।
(মরগান প্রদর্শনীর একজন সহ-অধ্যক্ষ এরহান তামুর আমাকে বলেছিলেন যে এনহেদুয়ান্নার কৃতিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ "আধুনিক বৃত্তির পিতৃতান্ত্রিক প্রকৃতি" থেকে প্রবাহিত হয়েছিল।) এদিকে, উত্তর-আধুনিক চিন্তাভাবনা সন্দেহ, অনিশ্চয়তা এবং লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতাকে উৎসাহিত করেছিল। কখনও একমতে পৌঁছানো যায়নি।
আজকে অনেকেই পুরোহিত এনহেদুয়ান্নাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ মহিলা কবি হিসেবে দেখেন না ।কিন্তু, ব্রিটিশ অ্যাসিরিওলজিস্ট এলেনর রবসন তাকে "ইচ্ছা পূরণকারী ব্যক্তিত্ব" বলে অভিহিত করেছেন।
চাকতিটিতে নারীদের গবাদি পশু পালনের ছবি আছে। মৃৎপাত্র তৈরি করার মতো ছবি দৃশ্য রয়েছে। এবং একটি তাঁতে কাজ করছেন মহিলা। তাদের চুল তাদের পিছনে উড়ছে। মন্দিরে নারীদের দৃশ্য রয়েছে। পুরুষ পরিচারকদের নির্দেশ দিচ্ছেন মহিলা । একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তি তার মেয়ের কাছে জমি হস্তান্তর করছেন। পরবর্তী অন্যান্য সমাজের বিপরীতে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মহিলারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারতেন।) এখানে রানী পুয়াবির বিস্তৃত মুকুটও রয়েছে। উনিশ-কুড়ি দশকে উলি উন্মোচিত করেছিলেন এবং তার সঙ্গে থাকা সীলমোহরগুলি যা এনহেদুয়ান্নাকে তাঁর পিতা বা ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের অধিকারে একা শাসন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশেষ লক্ষণীয় হলো যে একটি মহিলার মূর্তি যাঁর কোলে একটি স্লেট রয়েছে - নারীর সাক্ষরতা এবং লেখার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ এই মূর্তি । (যখন এটা প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, জার্মান পণ্ডিত অটো ওয়েবার এই উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, "আমাদের নমুনায় তাঁর হাঁটুতে একটি স্লেট রয়েছে । এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়।")
মূর্তি এবং এটার মতো অন্যান্য জিনিসকেও একাডেমিক সাহিত্যে উপেক্ষা করা হয়েছে, ব্যাবকক আমাকে বলেছিলেন। "এটা যদি কোলে স্লেট নিয়ে একজন লোক হয় তবে এর সম্পর্কে অন্তত কুড়িটি নিবন্ধ থাকবে।" এই ধরনের নিদর্শনগুলি দীর্ঘকাল ধরে রাখা অনুমানগুলিকে উত্থাপন করে - অভিজাত পুরুষ লেখকদের সংরক্ষণ হিসাবে সাক্ষরতা সম্পর্কে এবং মধ্যপ্রাচ্যের মহিলাদের গার্হস্থ্য জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়ে।
প্রদর্শনীতে Enheduanna -এর চাকতিটিও রয়েছে। তার চাকরদের সিলমোহর এবং একটি স্লেট যেখানে "ইন্নার উৎকর্ষ" থেকে লাইন লেখা। আর দেখা যাচ্ছে স্লেটটি জটিল খোদাইয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে । সেটা এনহেদুয়ান্নার পাঠ্যের চিত্রও হতে পারে । তাদের পৌরাণিক আঙ্গিকে দেবতাদের যেমন দেখায়।
"সমস্ত প্রমাণই এখানে আছে। " কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন নিয়ার ইস্টার্ন শিল্প ও প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক জয়নাব বাহরানি আমাকে বলেছেন, এনহেদুয়ান্নার লেখকত্বকে সমর্থন করে এমন বিভিন্ন লিপিবদ্ধ টিক চিহ্ন দেওয়া আছে।
“আপনি যদি এর সম্পর্কে চিন্তা করেন, তাহলে সেটা সঠিকভাবে বোঝা যায় যে একজন অভিজাত মহিলাই প্রথম কবি হতে পারেন। তার একটি আরামদায়ক জীবন, পড়ার এবং চিন্তা করার জায়গা, লেখার জায়গা ছিল। তাকে মাঠে কাজ করতে হয়নি বা যুদ্ধ করতে হয়নি। কেন তিনি লিখতে পারতেন না?"
বাহরানি এনহেদুয়ান্নার কবিতাকে সেই সময়ের ভক্তিমূলক অর্ঘের সঙ্গে তুলনা করেছেন - মূর্তি, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম যা মহিলারা মন্দিরে দিয়েছিলেন। তাদের নামের সাথে খোদাই করা। এই ধরনের ঐতিহ্যই হয়তো এনহেদুয়ান্নাকে নিজের পরিচয় দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি "দ্যা এক্সাল্টেশন"-এর মতো একটি রচনা তৈরি করেছিলেন যা এক ধরনের প্রার্থনা-কবিতা এবং দেবীর উদ্দেশ্যে একটি নৈবেদ্য।
১৯২৯ সালে, যে বছর উলি এনহেদুয়ান্নার নাম বাদ দিয়ে "উর অফ দ্য চ্যালদিস" প্রকাশ করেছিলেন । সেই বছরই তার দেশে একজন মহিলা ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর প্রবন্ধ "একজনের নিজের ঘর" প্রকাশ করেছিলেন। মহিলাদের দ্বারা এবং তাদের সম্পর্কে বইগুলির জন্য তাঁর বইয়ের তাকগুলো অনুসন্ধান করেন - যে বইগুলি সেখানে ছিল না - তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ইতিহাস "অবাস্তব একমুখী বলে মনে হয়। কিছুটা অদ্ভুতও... ইতিহাস যুদ্ধ সম্পর্কে খুব বেশিকথা বলে । মহান পুরুষদের সম্পর্কে জীবনী খুব বেশি থাকে ।" তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে মহিলারা যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা স্বাক্ষর ছাড়াই তাদের কাজ ছেড়ে চলে গেছেন। উলফ এনহেদুয়ান্নাকে জানার জন্যই অস্থির হয়ে পড়েছিলেন তা নয় । কিন্তু তিনি একটি হারিয়ে যাওয়া সাহিত্য ঐতিহ্যের আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করেছিলেন আজকের লেখকদের জন্য। এনহেদুয়ান্না একাডেমিক বিতর্ক নির্বিশেষে সৃজনশীল শক্তির রূপকার হয়ে উঠেছে। পশ্চিমে, তিনি অ্যালিস নটলির "দ্য ডিসেন্ট অফ অ্যালেট" (১৯৯২) এবং অ্যানি ফিঞ্চের "এমোঙ্গ দ্য গডেসেস" (২০১০)-এর মতো কাব্যময় গাঢ় কাজগুলিকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
তিনি ইরাকি শিল্পীদের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব - একজন মহিলা যিনি তাদের শোক, নির্বাসন এবং স্থানচ্যুতির আধুনিক অভিজ্ঞতার কথা বলেন। (কবি আমাল আল-জুবরি ইরাক থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর, ১৯৯৮ সালে তিনি "এনহেদুয়ান্না, প্রিস্টেস অফ এক্সাইল" নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন) । এনহেদুয়ান্না এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একটি চিহ্ন রেখে গেছেন । প্রথম দিকের মহিলা হিসাবে আকাশ নিয়ে পর্যবেক্ষকের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনিই । তাঁর মন্দিরের স্তোত্রগুলি স্বর্গীয় গতিবিধির পরিমাপ বর্ণনা করে: "ভিতরে... পুরোহিতদের ঘর/ মহাজাগতিক আদেশের সেই রাজকীয় মন্দির/ তারা চাঁদের উত্তরণ খোঁজার চেষ্টা করে।" এই পর্যবেক্ষণগুলি সম্ভবত ক্যালেন্ডার পালনের ভিত্তিও তৈরি করেছে, তার মন্দিরের দায়িত্বগুলির মধ্যে একটি:
সত্যিকারের মহিলা যিনি অত্যধিক জ্ঞানের অধিকারী,তিনি ল্যাপিস লাজুলির স্লেটের পরামর্শ নেয়,তিনি সমস্ত জমি নিয়ে উপদেশ দেন...তিনি স্বর্গ নিয়ে পরিমাপ করেন,তিনি পৃথিবীতে মাপার জন্য দড়ি রাখেন।
সেই মন্দিরের ঘরগুলিতে কোথাও, কল্পনা করা সম্ভব যে বুদ্ধিমতী মহিলা তার ল্যাপিস-লাজুলি স্লেট একপাশে রেখে, দিনের পরিমাপ শেষ করে এবং তার নিজের অন্য প্রকল্পে ফিরে যাচ্ছেন।
তিনি তাঁর আঙুলে লেখার জন্য অনুসন্ধান করেন। তারপরে তিনি তাঁর যন্ত্রটি তুললেন, নিজের সাথে বিড়বিড় করে থামলেন এবং কাদামাটিতে তার শব্দগুলি লিখতে শুরু করলেন।
0 মন্তব্যসমূহ