প্রতিদিন ভোরে যেমন একটি নতুন দিন জন্ম নেয়, তেমনি একটি দিন কমে যায়।
ওমর খৈয়াম
ওমর খৈয়াম
কারুকার্য করা মেহগনি খাটে উপুড় হয়ে আলতা শুয়ে থাকে কোঁকড়ানো কাগজের মতো। তার আধখোলা শাড়িটা এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকে; কিছুটা শরীরে, কিছুটা সিমেন্টের প্রলেপ মাখানো ফ্লোরে। চুলগুলো ছন্নছাড়া এক উদাস বাউল। মাসের এই বিশেষ সময়ে তার শরীর অসাড় থাকে ব্যথার তীব্রতায়। পুরনো এ যন্ত্রণার শুরুটা সাবালিকা হওয়ার প্রথম দিন থেকে। ব্যথায় ঘুম ভাঙলেও ঘুমের ন্যাতানো পর্দা চোখে লেপ্টেই থাকে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না তার। আধো ঘুম, আধো জাগরণের এই রেশ ধরে রাখতে কারও কথায় সাড়া দিতেও মন চায় না। আলসেমি করে আরও কিছু সময় গড়িয়ে নিতে মন চাইলেও শাশুড়ির হাঁকডাকে শুয়ে থাকার উপায় থাকে না। তার ওপর পাশের ঘরে মাজেদা চাচীর মুরগির কড়কড়ানি ডাক। কানের ভেতর ঝিঁঝি ধরিয়ে দেয়। আলতা শোয়া থেকে উঠে বসে। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে আজ দুপুরে ভাতের থালায় ভাতের সঙ্গে টিটকারি-টিপ্পনীও জুটবে। তখন গুম কান্নায় ভেসে যাবে বুকটা কিন্তু কাউকে বলতে পারবে না সে। একজনকে বলা যায় কিন্তু সে তো থাকে সাতসমুদ্র দূরে। মন চাইলেও যখন তখন কথা বলার উপায় নেই। প্রিয় মুখটা খুব মনে পড়ে। বুকের গভীর থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসতে আসতে আলতা শাড়ি গায়ে পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বিছানায় দিকে ফিরে তাকিয়ে খোঁজে রক্তজবা দাগগুলো। দাগহীন বিছানা ঝাড় দিয়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বের হয় সে।
পশ্চিমমুখী বাড়ি। রোদ পেছন দিক থেকে উঁকি দিতে দিতে বিকালে এসে উঠানে গড়িয়ে পড়ে। বাড়ির পেছনের বাগানে রোদের সঙ্গে পাতার ঝলমলে আলিঙ্গন শুরু হয়ে গেছে আরও কিছু সময় আগে। আলতা তাই পুকুর পাড়ের দিকে রওনা দেয় খালি কলসি আর কয়েকটা এঁটো বাসন নিয়ে। শাড়ির আঁচলে বেঁধে নেয় দুই টুকরো কাঠকয়লা। সকালের প্রয়োজনীয় কাজগুলো পুকুরঘাটে সেরে পানিভরতি কলস নিয়ে ঘরে ফেরে। এটা তার প্রতিদিনকার নামাচার। হাঁটার পথে হঠাৎ করে ঝরে পড়ে পাকা ডেউয়া। আলতা আলতো করে তা তুলে নেয়। দেখে ধনিয়া পাখি ফলটার অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে। ডেউয়া বাগানে ছুড়ে দিয়ে মাথার ঘোমটা আরও একটু টেনে ধীরপায়ে চলে যায় পুকুরঘাটে। ঘাটের প্রাণচঞ্চলতা বেশ দূর থেকেই কানে আসে। পাশের ঘরের মাজেদা চাচি ও আসিয়া ভাবি বাসি হাঁড়ি-পাতিল, এঁটো থালা-বাসন মাজাঘষার ফাঁকে নিজেদের রোজকার রসালো গল্পগুলো সেরে নিচ্ছে। গতকালের রাতদিন মিলিয়ে যত গুহ্য গল্প জমেছে, সেগুলো বলাবলি করছে পুকুরঘাটে। গভীর কালো জল। জলের ওপর ভেসে বেড়ানো কচুরিপানা। কচুরিপানার গাঢ় বেগুনি, হালকা বেগুনির মধ্যে হলদে তিলকযুক্ত ফুলগুলোও হয়তো রোজ সকালে অপেক্ষা করে এই গল্পগুলোর জন্য। শুধু অপেক্ষা করে না আলতা। তাই তার উপস্থিতির কারণে তাদের হাসিটাও হঠাৎ দমে যায়। আলতা জানে এ হাসি দমে যাওয়ার কারণ। কিন্তু ঘরের কথা পরকে জানানো নিষেধ। তাই চুপ করে থাকে। প্রতিবাদ করে না। তার আড়ালে সবাই কে কি বলাবলি করে, সবই তার জানা। এক বিকালে পাশের ঘরে সবুজের মায়ের সঙ্গে ঝগড়ার কারণে তা জানার সুযোগ কিছুটা হয়েছিল। হাসির আলাপ দমে গেলে পাতার মড়মড় শব্দ কানে আসে। তাকিয়ে দেখে, শালিক রোদ থেকে মুখ লুকাতে ছুটছে। শীত এলে শালিকের ঠোঁট, পায়ের হলুদ রঙ তেজি টাটকা হয়ে কমলা রঙ ধরে।
২.
সাত কেজি ওজনের মাংসের দলায় দশ আঙুল ঢোকানোর পর ওসমান চোখ বন্ধ করে আলতার মুখখানি মনে করার চেষ্টা করে। এটা ওর প্রতিদিনকার কারিকা। আঙুলের তীব্র ক্রিয়াকৌশলের মাঝে ভাবনাটা মুখ থেকে একটু একটু নিচে নেমে আসে, চোখে ভেসে ওঠে আড়ঙ্গ সুউচ্চ টিলা, গভীর খাদ। নরম তুলতুলে কিমা দিয়ে কখনো কখনো আকর্ষণীয় সুডৌল স্তন গড়ে তোলে। আবার ভাঙে। আবার গড়ে, আবার ভাঙে। এভাবে প্রতিদিন মাংসের কিমার সঙ্গে নানার পদের মসলা মেশানোর কাজটা বেশ সুনিপুণভাবে মনের আনন্দে সম্পন্ন করে সে।
ওসমান কাজ করে দুবাই শহরের নামকরা একটি কাবাব ফ্যাক্টরিতে। আলো ঝলমল এই শহরে আজ থেকে দশ বছর আগে ওসমান এসেছিল নির্মাণ শ্রমিক হয়ে পেটের তাগিদে। দুবছর নির্মাণ কাজ করার পর হঠাৎ একদিন পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পায়।
পায়ের বড় হাড় ফিমারে একটি বড় আকারের রড বসতি গড়ায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করেন ডাক্তার। ওসমানের ভাগ্য ভালো হওয়ায় সেই কোম্পানির কাবাব ফ্যাক্টরিতে কাজের সুযোগ হয়ে যায়। আর পায়ের জোর কমে যাওয়ায় সব শক্তি এখন যেন এসে ভর করে তার দু’হাতের কব্জিতে। হাতের মাংসের কিমা মাখানোর গ্রথন ভালো হওয়ায় ওসমানের কাজের দক্ষতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। অল্পসময়ের ব্যবধানে দুবাইয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত কাবাব ফ্যাক্টরিতে কাজের সুযোগ পেয়ে যায়।
দুবাইয়ের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ফায়েদিতে এই কাবাব ফ্যাক্টরির অবস্থান। কাবাব রেস্টুরেন্ট যাত্রা শুরু করে গত শতাব্দীর সত্তর দশকে। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় যাত্রা শুরুর পর থেকে এ কাবাবের সুঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাবাবের আসল কারিগর মারা যাওয়ার পর তার চার ছেলে এটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন আজও।
বলিউডের সেলিব্রেটিদের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই দোকান। দোকানের প্রায় সব কর্মী ওসমানকে ওস্তাদের উত্তরসুরী মনে করেন। কেননা ওস্তাদ বেঁচে থাকাকালীন তিনিই কাবাবের কিমাগুলো এভাবে মাখাতেন। এখন সেই কাজটা ওসমান করে। দোকানে আসা পুরনো খাদ্যরসিকরা সেই স্বাদও খুঁজে পান। ওসমান পায় মালিকের বাহবা। তবে কেউ জানেন না, কিমায় মসলা মাখানোর সময় ওসমানের ভেতরকার কাম তাড়না, অভুক্ত যন্ত্রণা। এ ক্ষুধা যৌনতার, এ ক্ষুধা এক নারী আলতার জন্য।
৩.
আলতার বাসন মাজা শেষ হওয়ার আগেই সুরমা রঙের আকাশে বয়ে যায় হিমেল হাওয়া। বাসনগুলো গুছিয়ে আলতা নিজের মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দেয়। কাঠকয়লা দিয়ে দাঁত মেজে কুলকুচি করে। পেছনে তাকিয়ে দেখে পড়শী সবাই পা চালিয়ে চলে যাচ্ছে। আলতা কলস ও বাসনগুলো কাঁখে নিয়ে কোনোমতো উঠে দাঁড়াতেই কোমড়ে টান পড়ে। টনটন করে ওঠে। তাই স্থির হয়ে দাঁড়ায়, আশপাশে পরিচিত মুখ খোঁজে। তখনই গাছের খোঁড়ল থেকে কাঠবিড়ালির মতো মুখটা বের করে আলী চোখ দুটে কচলাতে থাকে। হয়তো মৌজে ঘুমাচ্ছিল।
আলতার ছোট দেবর বলি আর একমাত্র দেবর বলি, সেটা ওই আলী। ওসমান ও আলী দুইভাই। তিনবোন ফাতেমা, হালিমা ও রাবেয়া। তিন ননদ নিজেদের ঘর সংসারে ব্যস্ত। আলতার সংসারে তেমন হানা দেয় না। আম-কাঁঠালের মাসে স্বামী-সন্তান নিয়ে হাজির হয় মুখভর্তি পান চিবুতে চিবুতে। আলতার শ্বশুরবাড়ি অবস্থা একসময় জরাজীর্ণ ছিল। একবেলা দুমুঠো ভাতের সঙ্গে কচুসিদ্ধ খেয়ে পার করত। রাতে ভাতের ফেন জোগাড় করতে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতে হতো শাশুড়িকে। ওসমান কষ্ট-শিষ্টে একটা পাসপোর্ট জোগাড় করেছিল মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার আশায়। তখন ওর দুঃসম্পর্কের এক মামা থাকতেন সৌদি আরব। মামার ঘর পালানো মেয়েকে বিয়ে করে যৌতুক হিসেবে পায় দুবাইয়ের ভালো এজেন্সির মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট ও টিকিটের টাকা। ওসমানের দুবাই যাওয়ার দুবছর পর পা ভাঙার শোকে মামাতো বোন কিংবা প্রাক্তন স্ত্রী পাশের বাড়ির ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায়। গ্রামে ছিঃ! ছিঃ! রব ওঠে। তিন বছর পর ওসমান দেশে আসে তিনমাসের জন্য। সেইসময় ওসমানকে ওর বাবা-মা জোর করে আরেকটা বিয়ে করায়। ওই সময়ে ওসমানের পাসপোর্ট রিনিউ করলেও বৈবাহিক স্থানটি অবিবাহিতই থেকে যায়। আলতা বাপ মরা মেয়ে। চাচাদের আশ্রয়ে পালিত।
হঠাৎ দুবাই প্রবাসী বিবাহিত বয়স্ক লোকটাকে দেখে আলতার চাচা ও ফুফুরা আর না করতে পারেন না। অসহায় মাও মেয়ের ভবিষ্যতটা বেশি প্রাধান্য দেয়। বিগলিত হয়ে দুদিনের মধ্যে বিয়ের সব ব্যবস্থা করে ফেলেন। কেউ জানতে চান না আলতার পছন্দ অপছন্দ। বিয়ের পর আলতা ওসমানের প্রেমে পড়ে। ধীরে ধীরে ওসমানও প্রেমে পড়ে আলতার। তবে যতই প্রেম থাকুক, আলতাকে এখনো শাশুড়ির টিপ্পনী শুনতে হয়। স্বামী থাকা অবস্থায় কেন আলতা গর্ভবতী হতে পারল না, এ নিয়ে শাশুড়ির কথার শেষ নেই। ওদিকে ভাইয়ের মেয়ের প্রতারণায় এ বউকে কড়া শাসনে রাখে ওসমানের মা। হাতে গুনে গুনে টাকা দেয়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে দেয় সীমিত। কথা বলার সময় নিজে পাশে উপস্থিত থাকে।
আলতা সবকিছু নীরবে মেনে নিয়ে দিন পার করে। রাত পার করতেই কেবল বেগ পেতে হয়। একবার রাজসুধা পান করা রানী মৌমাছির কি শুকনো খড়খড়ে জীবন ভালো লাগে?
৪.
ওসমানের কর্মস্থল দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় হলেও বসবাস দুই কামরার ছোট ঘুপচি ঘরে। বাংলায় তাকে দিব্যি বস্তি বলা যায়। দিন-রাত এক করে দিরহাম রোজগারে নেমে পড়া ১৫ জন কর্মক্ষম যুবক থাকে একসঙ্গে। এক-দুই করে দিরহাম জমিয়ে দেশে পাঠায় প্রিয় মানুষের জন্য। কাবাব ফ্যাক্টরিতে ওসমান এখন ভালো টাকা বেতন পায়। দেশে সব বোনকে ঘর তুলে দিয়েছে। নিজের বাড়িও পাকা করেছে। এ বছর ঘরের মধ্যে গোসলখানা, পায়খানা বানিয়েছে দেশে পাকাপোক্তভাবে চলে আসার ইচ্ছায়। ওসমানের বাবা-মা চায়, ছেলে আরও কিছুদিন থাকুক। সোনার ডিম দেওয়া হাঁস সহজে খোঁয়াড়ে ঢোকাতে চায় না তারা। ওদিকে ওসমান চায়, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আলতার সঙ্গে রাতে প্রেমময় সুখ। ঠিক করেছে, ছোটভাই আলীকে দুবাই এনে দেশে চলে যাবে পাকাপোক্তভাবে। মুদি দোকান, মাছ চাষ, মুরগির ফার্মের সঙ্গে কয়েকটা গরু লালনপালন করলেই চলে যাবে সংসার। দিন-রাত এমন হাজারো ভাবনার জাল বুনে নানা রঙিন স্বপ্নের অতলে তলিয়ে যায় সে। মাঝেমধ্যে মাঝরাতে ঘুম ভাঙে ঘুপচি সংসারের কারও না কারও দেশ থেকে আসা দুঃসংবাদ শুনে। বিদেশে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হলো প্রিয়জন হারানোর দুঃসংবাদ। শেষবারের মতো মুখখানি না দেখতে পারার ব্যাকুলতায় ভেতরটা ক্ষয়ে যায় প্রবাসী প্রত্যেক রেমিট্যান্স সৈনিকের। ওসমানেরও ইদানীং এ আশঙ্কায় দিন কাটে। মাঝেমধ্যে খবর পায় বাবার শরীর খারাপ, মায়ের কোমর ব্যথা। ছোট ভাইয়ের টাকা লাগবে, ভাগিনার পরীক্ষার ফিস লাগবে। একমাত্র আলতারই কিছু লাগে না। সবসময় নীরবে অল্পকথায় আলাপ শেষ করে। ওসমান বোঝে আলতার নীরবতার কারণ। বিয়ের পর কতইবা সময় পেয়েছে মেয়েটা। গুনে গুনে মাত্র দেড়মাস। বাকিটা সময় হিসেবে ধরে না ওসমান। কারণ ওই সময়টা সবার সঙ্গে বণ্টন করতে হয়েছে। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে যে মেয়ে মাত্র দেড়মাস স্বামীর সান্নিধ্য পেয়েছে, সেইবা কীভাবে স্বামীর কাছে সহজ হবে? তবু এই কিছুদিন আগে ছোটবোনের বিয়ে উপলক্ষে কিছু টাকা পাঠাতে বলেছে আলতা। ওসমান ঠিক করেছে, এবার বউয়ের নামে টাকা পাঠাবে। আর সেটা আলতার বাড়ির কাছাকাছি কোনো ব্যাংকে। কেননা এ টাকা বাবার নামে পাঠালে আলতা পাবে সিকি ভাগ। ওসমানের মন বউয়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলে ছুটে যায় ইয়াসিনের কাছে। ইয়াসিন ওসমান প্রাণের বন্ধু। অনেকের ধারণা, ওরা শরীয়ত বিরোধী পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। মাঝেমধ্যে ওদের নিয়ে হাস্যরসও সৃষ্টি হয়। কেউ অবশ্য হাতেনাতে এখনো তার প্রমাণ পায়নি। ইয়াসিন কিছুটা মেয়েলি স্বভাবের। কথা বলে বেশ গুছিয়ে। যে কোনো দরকারে ছুটে আসে ওসমানের কাছে। দুজনের বাধভাঙা ভালোবাসার কাছে তখন দেশ তুচ্ছ হয়ে যায়। ওসমান মনেপ্রাণে পাকিস্তান নামক দেশটা ঘৃণা করলেও পাকিস্তানি নাগরিক ইয়াসিনকে ভালোবাসে ওর মহত্ত্বের কারণে। ওসমানের অসুস্থতার সময় ইয়াসিন মনপ্রাণ ঢেলে সেবা করেছে নিজের সাধ্যানুসারে। সেই থেকে এই বন্ধুত্ব।
৫.
আলতা পুকুরঘাট থেকে উঠে এলে আলী গাছের খোঁড়ল থেকে বের হয়। ভাবির বাসনপত্র এগিয়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়। আলতা দিতে না চাইলেও আলী জোর করে নিয়ে নেয়। ভাবির পেছনে পেছন হাঁটে। ইদানীং সবাই আলীর এই পেছন পেছন বাধ্য ছেলের মতো ঘোরাঘুরি নিয়ে দু-চার কথা বলে। আলতার কানেও এসেছে সেদিন ঝগড়ার সময়। ওসমানের আগের বউয়ের নামে অনেক বদনাম ছিল। সেই বদনামের বাতাস মাঝেমধ্যে ওর গায়েও লাগে। আবার চলেও যায়, পাকাপোক্ত হয় না। এখন আলীর সঙ্গে এই সখ্যভাব নিয়ে কানাঘুষা পাকাপাকি হয়ে গেলে মানুষটার সামনে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। আলতার অবশ্য ভালো লাগে আলীর সঙ্গে গল্প করতে, গল্প শুনতে। নানা মানুষের সঙ্গে মেশামেশা আলীর। যাত্রা দেখতে যায়, পালা গান গায়, সিনেমা দেখে। কোনো কিছুই বাদ যায় না আলীর তালিকা থেকে। টাকা-পয়সার এখন অভাব নেই সংসারে। নিজের সব অপ্রাপ্তি ভাইকে দিয়ে উপভোগ করায় ওসমান। আলতার ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে খারাপও লাগে স্বামীর গায়ের রক্ত পানি করা টাকা কীভাবে গড়িয়ে যায় জলের মতো।
গোয়ালঘরের পাশে দিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে আলতার কানে ভেসে আসে শাশুড়ির বাজখাঁই চিৎকার। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে ওর। পেছন ফিরে তাড়াতাড়ি বাসনগুলো নিজের হাতে নিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করে কি নিয়ে ক্ষেপেছেন আজ। হালকা ভেসে আসা শব্দগুলো জোড়া লাগিয়ে বোঝে, ওসমান চলে আসতে চায়। তার আগে আলীকে দুবাই নিয়ে যেতে চায়। মনে মনে খুশি হয়। স্বামীর সঙ্গে এতদিন পর তার আহ্লাদ-সোহাগের সংসার হবে, সন্তান হবে। ছেলে ফিরে আসতে চাওয়ায় শাশুড়ি কেন ক্ষ্যাপা, সেটা ওর মাথায় ঢোকে না। চুলায় এক হাঁড়ি পানি চাপিয়ে আলতা ধীরে ধীরে উঠে আসে রান্নাঘর থেকে। ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে’ মতো ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ি সামনে পড়ে যায়। চোখ কপালে তুলে ওসমানের মা জানান, আলতার নামে টাকা পাঠাবে দুয়েকদিনের মধ্যে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে যেন বাপের বাড়িতে যেতে দেওয়া হয় আলতাকে। সেই কথা মাকে আদেশের সুরে মনে করিয়ে দেওয়ায় ছেলের ওপর কিঞ্চিৎ রাগ। বউয়ের ওপর তার দ্বিগুণ। পরিস্থিতি অশান্ত দেখে দৌড়ে আবারও রান্নাঘরে চলে আসে। কিছুটা হাঁপিয়ে যাওয়ায় পাশে নীরবে পড়ে থাকা বড় জলচৌকিটায় গিয়ে বসে পড়ে, যার একছত্র অধিপতি ওর শাশুড়ি। আলতা আজ মনে মনে বেশ খুশি। অনুভব করে ওসমানের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। নিজেকে এতদিন মনে হতো ঘরের লালিতপালিত গাভি গরুটার মতো। খাবারের সময় খাবার পায়, ঘুমানোর জায়গা পায়, কাজ করে যায় মুখ বুজে। সংসারে নিষ্প্রভা প্রাণীর মতো সেও এক প্রাণী।
‘ও বউ, তুমি কি কাইলক্যাই যাইবা? দুই চাইডা দিন ফরো যাওন যাইতো না?’
পেছন থেকে কথাটা শুনে আলতা লাফিয়ে ওঠে জলচৌকি থেকে। অসচেতনভাবে জলচৌকিতে বসার অপরাধ বোধ মাথায় ছোটাছুটি করতে থাকে। নীরবে মাথা নিচু করে রাখে।
‘কও না ক্যারে? আলী ওহন যাইবার ফারবো? কইতাম ফারতাম না। তোমারার হউরের শরীরডা বালা না।’
২.
সাত কেজি ওজনের মাংসের দলায় দশ আঙুল ঢোকানোর পর ওসমান চোখ বন্ধ করে আলতার মুখখানি মনে করার চেষ্টা করে। এটা ওর প্রতিদিনকার কারিকা। আঙুলের তীব্র ক্রিয়াকৌশলের মাঝে ভাবনাটা মুখ থেকে একটু একটু নিচে নেমে আসে, চোখে ভেসে ওঠে আড়ঙ্গ সুউচ্চ টিলা, গভীর খাদ। নরম তুলতুলে কিমা দিয়ে কখনো কখনো আকর্ষণীয় সুডৌল স্তন গড়ে তোলে। আবার ভাঙে। আবার গড়ে, আবার ভাঙে। এভাবে প্রতিদিন মাংসের কিমার সঙ্গে নানার পদের মসলা মেশানোর কাজটা বেশ সুনিপুণভাবে মনের আনন্দে সম্পন্ন করে সে।
ওসমান কাজ করে দুবাই শহরের নামকরা একটি কাবাব ফ্যাক্টরিতে। আলো ঝলমল এই শহরে আজ থেকে দশ বছর আগে ওসমান এসেছিল নির্মাণ শ্রমিক হয়ে পেটের তাগিদে। দুবছর নির্মাণ কাজ করার পর হঠাৎ একদিন পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পায়।
পায়ের বড় হাড় ফিমারে একটি বড় আকারের রড বসতি গড়ায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করেন ডাক্তার। ওসমানের ভাগ্য ভালো হওয়ায় সেই কোম্পানির কাবাব ফ্যাক্টরিতে কাজের সুযোগ হয়ে যায়। আর পায়ের জোর কমে যাওয়ায় সব শক্তি এখন যেন এসে ভর করে তার দু’হাতের কব্জিতে। হাতের মাংসের কিমা মাখানোর গ্রথন ভালো হওয়ায় ওসমানের কাজের দক্ষতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। অল্পসময়ের ব্যবধানে দুবাইয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত কাবাব ফ্যাক্টরিতে কাজের সুযোগ পেয়ে যায়।
দুবাইয়ের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ফায়েদিতে এই কাবাব ফ্যাক্টরির অবস্থান। কাবাব রেস্টুরেন্ট যাত্রা শুরু করে গত শতাব্দীর সত্তর দশকে। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় যাত্রা শুরুর পর থেকে এ কাবাবের সুঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাবাবের আসল কারিগর মারা যাওয়ার পর তার চার ছেলে এটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন আজও।
বলিউডের সেলিব্রেটিদের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই দোকান। দোকানের প্রায় সব কর্মী ওসমানকে ওস্তাদের উত্তরসুরী মনে করেন। কেননা ওস্তাদ বেঁচে থাকাকালীন তিনিই কাবাবের কিমাগুলো এভাবে মাখাতেন। এখন সেই কাজটা ওসমান করে। দোকানে আসা পুরনো খাদ্যরসিকরা সেই স্বাদও খুঁজে পান। ওসমান পায় মালিকের বাহবা। তবে কেউ জানেন না, কিমায় মসলা মাখানোর সময় ওসমানের ভেতরকার কাম তাড়না, অভুক্ত যন্ত্রণা। এ ক্ষুধা যৌনতার, এ ক্ষুধা এক নারী আলতার জন্য।
৩.
আলতার বাসন মাজা শেষ হওয়ার আগেই সুরমা রঙের আকাশে বয়ে যায় হিমেল হাওয়া। বাসনগুলো গুছিয়ে আলতা নিজের মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দেয়। কাঠকয়লা দিয়ে দাঁত মেজে কুলকুচি করে। পেছনে তাকিয়ে দেখে পড়শী সবাই পা চালিয়ে চলে যাচ্ছে। আলতা কলস ও বাসনগুলো কাঁখে নিয়ে কোনোমতো উঠে দাঁড়াতেই কোমড়ে টান পড়ে। টনটন করে ওঠে। তাই স্থির হয়ে দাঁড়ায়, আশপাশে পরিচিত মুখ খোঁজে। তখনই গাছের খোঁড়ল থেকে কাঠবিড়ালির মতো মুখটা বের করে আলী চোখ দুটে কচলাতে থাকে। হয়তো মৌজে ঘুমাচ্ছিল।
আলতার ছোট দেবর বলি আর একমাত্র দেবর বলি, সেটা ওই আলী। ওসমান ও আলী দুইভাই। তিনবোন ফাতেমা, হালিমা ও রাবেয়া। তিন ননদ নিজেদের ঘর সংসারে ব্যস্ত। আলতার সংসারে তেমন হানা দেয় না। আম-কাঁঠালের মাসে স্বামী-সন্তান নিয়ে হাজির হয় মুখভর্তি পান চিবুতে চিবুতে। আলতার শ্বশুরবাড়ি অবস্থা একসময় জরাজীর্ণ ছিল। একবেলা দুমুঠো ভাতের সঙ্গে কচুসিদ্ধ খেয়ে পার করত। রাতে ভাতের ফেন জোগাড় করতে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতে হতো শাশুড়িকে। ওসমান কষ্ট-শিষ্টে একটা পাসপোর্ট জোগাড় করেছিল মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার আশায়। তখন ওর দুঃসম্পর্কের এক মামা থাকতেন সৌদি আরব। মামার ঘর পালানো মেয়েকে বিয়ে করে যৌতুক হিসেবে পায় দুবাইয়ের ভালো এজেন্সির মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট ও টিকিটের টাকা। ওসমানের দুবাই যাওয়ার দুবছর পর পা ভাঙার শোকে মামাতো বোন কিংবা প্রাক্তন স্ত্রী পাশের বাড়ির ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায়। গ্রামে ছিঃ! ছিঃ! রব ওঠে। তিন বছর পর ওসমান দেশে আসে তিনমাসের জন্য। সেইসময় ওসমানকে ওর বাবা-মা জোর করে আরেকটা বিয়ে করায়। ওই সময়ে ওসমানের পাসপোর্ট রিনিউ করলেও বৈবাহিক স্থানটি অবিবাহিতই থেকে যায়। আলতা বাপ মরা মেয়ে। চাচাদের আশ্রয়ে পালিত।
হঠাৎ দুবাই প্রবাসী বিবাহিত বয়স্ক লোকটাকে দেখে আলতার চাচা ও ফুফুরা আর না করতে পারেন না। অসহায় মাও মেয়ের ভবিষ্যতটা বেশি প্রাধান্য দেয়। বিগলিত হয়ে দুদিনের মধ্যে বিয়ের সব ব্যবস্থা করে ফেলেন। কেউ জানতে চান না আলতার পছন্দ অপছন্দ। বিয়ের পর আলতা ওসমানের প্রেমে পড়ে। ধীরে ধীরে ওসমানও প্রেমে পড়ে আলতার। তবে যতই প্রেম থাকুক, আলতাকে এখনো শাশুড়ির টিপ্পনী শুনতে হয়। স্বামী থাকা অবস্থায় কেন আলতা গর্ভবতী হতে পারল না, এ নিয়ে শাশুড়ির কথার শেষ নেই। ওদিকে ভাইয়ের মেয়ের প্রতারণায় এ বউকে কড়া শাসনে রাখে ওসমানের মা। হাতে গুনে গুনে টাকা দেয়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে দেয় সীমিত। কথা বলার সময় নিজে পাশে উপস্থিত থাকে।
আলতা সবকিছু নীরবে মেনে নিয়ে দিন পার করে। রাত পার করতেই কেবল বেগ পেতে হয়। একবার রাজসুধা পান করা রানী মৌমাছির কি শুকনো খড়খড়ে জীবন ভালো লাগে?
৪.
ওসমানের কর্মস্থল দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় হলেও বসবাস দুই কামরার ছোট ঘুপচি ঘরে। বাংলায় তাকে দিব্যি বস্তি বলা যায়। দিন-রাত এক করে দিরহাম রোজগারে নেমে পড়া ১৫ জন কর্মক্ষম যুবক থাকে একসঙ্গে। এক-দুই করে দিরহাম জমিয়ে দেশে পাঠায় প্রিয় মানুষের জন্য। কাবাব ফ্যাক্টরিতে ওসমান এখন ভালো টাকা বেতন পায়। দেশে সব বোনকে ঘর তুলে দিয়েছে। নিজের বাড়িও পাকা করেছে। এ বছর ঘরের মধ্যে গোসলখানা, পায়খানা বানিয়েছে দেশে পাকাপোক্তভাবে চলে আসার ইচ্ছায়। ওসমানের বাবা-মা চায়, ছেলে আরও কিছুদিন থাকুক। সোনার ডিম দেওয়া হাঁস সহজে খোঁয়াড়ে ঢোকাতে চায় না তারা। ওদিকে ওসমান চায়, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আলতার সঙ্গে রাতে প্রেমময় সুখ। ঠিক করেছে, ছোটভাই আলীকে দুবাই এনে দেশে চলে যাবে পাকাপোক্তভাবে। মুদি দোকান, মাছ চাষ, মুরগির ফার্মের সঙ্গে কয়েকটা গরু লালনপালন করলেই চলে যাবে সংসার। দিন-রাত এমন হাজারো ভাবনার জাল বুনে নানা রঙিন স্বপ্নের অতলে তলিয়ে যায় সে। মাঝেমধ্যে মাঝরাতে ঘুম ভাঙে ঘুপচি সংসারের কারও না কারও দেশ থেকে আসা দুঃসংবাদ শুনে। বিদেশে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হলো প্রিয়জন হারানোর দুঃসংবাদ। শেষবারের মতো মুখখানি না দেখতে পারার ব্যাকুলতায় ভেতরটা ক্ষয়ে যায় প্রবাসী প্রত্যেক রেমিট্যান্স সৈনিকের। ওসমানেরও ইদানীং এ আশঙ্কায় দিন কাটে। মাঝেমধ্যে খবর পায় বাবার শরীর খারাপ, মায়ের কোমর ব্যথা। ছোট ভাইয়ের টাকা লাগবে, ভাগিনার পরীক্ষার ফিস লাগবে। একমাত্র আলতারই কিছু লাগে না। সবসময় নীরবে অল্পকথায় আলাপ শেষ করে। ওসমান বোঝে আলতার নীরবতার কারণ। বিয়ের পর কতইবা সময় পেয়েছে মেয়েটা। গুনে গুনে মাত্র দেড়মাস। বাকিটা সময় হিসেবে ধরে না ওসমান। কারণ ওই সময়টা সবার সঙ্গে বণ্টন করতে হয়েছে। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে যে মেয়ে মাত্র দেড়মাস স্বামীর সান্নিধ্য পেয়েছে, সেইবা কীভাবে স্বামীর কাছে সহজ হবে? তবু এই কিছুদিন আগে ছোটবোনের বিয়ে উপলক্ষে কিছু টাকা পাঠাতে বলেছে আলতা। ওসমান ঠিক করেছে, এবার বউয়ের নামে টাকা পাঠাবে। আর সেটা আলতার বাড়ির কাছাকাছি কোনো ব্যাংকে। কেননা এ টাকা বাবার নামে পাঠালে আলতা পাবে সিকি ভাগ। ওসমানের মন বউয়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলে ছুটে যায় ইয়াসিনের কাছে। ইয়াসিন ওসমান প্রাণের বন্ধু। অনেকের ধারণা, ওরা শরীয়ত বিরোধী পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। মাঝেমধ্যে ওদের নিয়ে হাস্যরসও সৃষ্টি হয়। কেউ অবশ্য হাতেনাতে এখনো তার প্রমাণ পায়নি। ইয়াসিন কিছুটা মেয়েলি স্বভাবের। কথা বলে বেশ গুছিয়ে। যে কোনো দরকারে ছুটে আসে ওসমানের কাছে। দুজনের বাধভাঙা ভালোবাসার কাছে তখন দেশ তুচ্ছ হয়ে যায়। ওসমান মনেপ্রাণে পাকিস্তান নামক দেশটা ঘৃণা করলেও পাকিস্তানি নাগরিক ইয়াসিনকে ভালোবাসে ওর মহত্ত্বের কারণে। ওসমানের অসুস্থতার সময় ইয়াসিন মনপ্রাণ ঢেলে সেবা করেছে নিজের সাধ্যানুসারে। সেই থেকে এই বন্ধুত্ব।
৫.
আলতা পুকুরঘাট থেকে উঠে এলে আলী গাছের খোঁড়ল থেকে বের হয়। ভাবির বাসনপত্র এগিয়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়। আলতা দিতে না চাইলেও আলী জোর করে নিয়ে নেয়। ভাবির পেছনে পেছন হাঁটে। ইদানীং সবাই আলীর এই পেছন পেছন বাধ্য ছেলের মতো ঘোরাঘুরি নিয়ে দু-চার কথা বলে। আলতার কানেও এসেছে সেদিন ঝগড়ার সময়। ওসমানের আগের বউয়ের নামে অনেক বদনাম ছিল। সেই বদনামের বাতাস মাঝেমধ্যে ওর গায়েও লাগে। আবার চলেও যায়, পাকাপোক্ত হয় না। এখন আলীর সঙ্গে এই সখ্যভাব নিয়ে কানাঘুষা পাকাপাকি হয়ে গেলে মানুষটার সামনে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। আলতার অবশ্য ভালো লাগে আলীর সঙ্গে গল্প করতে, গল্প শুনতে। নানা মানুষের সঙ্গে মেশামেশা আলীর। যাত্রা দেখতে যায়, পালা গান গায়, সিনেমা দেখে। কোনো কিছুই বাদ যায় না আলীর তালিকা থেকে। টাকা-পয়সার এখন অভাব নেই সংসারে। নিজের সব অপ্রাপ্তি ভাইকে দিয়ে উপভোগ করায় ওসমান। আলতার ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে খারাপও লাগে স্বামীর গায়ের রক্ত পানি করা টাকা কীভাবে গড়িয়ে যায় জলের মতো।
গোয়ালঘরের পাশে দিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে আলতার কানে ভেসে আসে শাশুড়ির বাজখাঁই চিৎকার। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে ওর। পেছন ফিরে তাড়াতাড়ি বাসনগুলো নিজের হাতে নিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করে কি নিয়ে ক্ষেপেছেন আজ। হালকা ভেসে আসা শব্দগুলো জোড়া লাগিয়ে বোঝে, ওসমান চলে আসতে চায়। তার আগে আলীকে দুবাই নিয়ে যেতে চায়। মনে মনে খুশি হয়। স্বামীর সঙ্গে এতদিন পর তার আহ্লাদ-সোহাগের সংসার হবে, সন্তান হবে। ছেলে ফিরে আসতে চাওয়ায় শাশুড়ি কেন ক্ষ্যাপা, সেটা ওর মাথায় ঢোকে না। চুলায় এক হাঁড়ি পানি চাপিয়ে আলতা ধীরে ধীরে উঠে আসে রান্নাঘর থেকে। ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে’ মতো ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ি সামনে পড়ে যায়। চোখ কপালে তুলে ওসমানের মা জানান, আলতার নামে টাকা পাঠাবে দুয়েকদিনের মধ্যে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে যেন বাপের বাড়িতে যেতে দেওয়া হয় আলতাকে। সেই কথা মাকে আদেশের সুরে মনে করিয়ে দেওয়ায় ছেলের ওপর কিঞ্চিৎ রাগ। বউয়ের ওপর তার দ্বিগুণ। পরিস্থিতি অশান্ত দেখে দৌড়ে আবারও রান্নাঘরে চলে আসে। কিছুটা হাঁপিয়ে যাওয়ায় পাশে নীরবে পড়ে থাকা বড় জলচৌকিটায় গিয়ে বসে পড়ে, যার একছত্র অধিপতি ওর শাশুড়ি। আলতা আজ মনে মনে বেশ খুশি। অনুভব করে ওসমানের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। নিজেকে এতদিন মনে হতো ঘরের লালিতপালিত গাভি গরুটার মতো। খাবারের সময় খাবার পায়, ঘুমানোর জায়গা পায়, কাজ করে যায় মুখ বুজে। সংসারে নিষ্প্রভা প্রাণীর মতো সেও এক প্রাণী।
‘ও বউ, তুমি কি কাইলক্যাই যাইবা? দুই চাইডা দিন ফরো যাওন যাইতো না?’
পেছন থেকে কথাটা শুনে আলতা লাফিয়ে ওঠে জলচৌকি থেকে। অসচেতনভাবে জলচৌকিতে বসার অপরাধ বোধ মাথায় ছোটাছুটি করতে থাকে। নীরবে মাথা নিচু করে রাখে।
‘কও না ক্যারে? আলী ওহন যাইবার ফারবো? কইতাম ফারতাম না। তোমারার হউরের শরীরডা বালা না।’
‘আম্মা, আমারও শরীরডাও বালা না। দুইডা দিন ফরো যাই। আলতা মাসিকের এই সময়টায় ঘর থেকে দূরে কোথাও যেতে চায় না।’
‘রাহো, আলীরে জিগাইয়া লই।’
শাশুড়ি ওর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
৬.
সকালবেলা আলী আধাপেটে আর আলতা বাসিমুখে রওনা দেয়। ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের যাত্রাপথে একবারই বাসে উঠে হয়। বাসের বারবার ব্রেক কষা আলতার পেটের নাড়িভুড়ি তালগোল পাকিয়ে দেয়। আলতা তাই কখনো বাড়িতে যাওয়ার আগে মুখে কিছু দেয় না। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে, যেন এ যাত্রাপথ নির্ঝঞ্ঝাট হয়।
আলতার পরনে রঙিন কাপড়। দামও খারাপ নয়। বাবার বাড়ি অপেক্ষায় থাকা ভাবিদের নিজের সুখ দেখাতে মন চায় ওর। বাবা হারা দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে ওর মা বেশ কষ্টে, চেয়ে-চিন্তে খাবার জোগাড় করে বড় করেছেন। এখন ভাইটা বড় হওয়ায় সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। তবে তাও ওর স্বামীর বাড়ির মতো নয়। বড় চাচার অবস্থা ভালো। শহরের মার্কেটে দোকান আছে। সেখানে চাচাতো ভাই নুরুল আমিনের কসমেটিকস ও রেডিমেড কাপড়ের দোকান। নুরুল আমিনের কথা মনে হতেই বুকে আগুনের হালকা ছ্যাঁত লাগার মতো জ্বলে ওঠে।আলীর চুলগুলো আজ একটু অন্যরকম। অন্যদিন থেকে একটু স্থির, শজারু কাঁটার মতো শক্ত। গায়ে কড়কড়ে হলুদ কালো ডোরাকাটা বাঘের জর্জেট জামা। স্বচ্ছ হওয়ায় শরীরের সব চোখে পড়ে। বাড়ি থেকে বের হয়ে ওরা প্রথমে ভ্যানগাড়িতে ওঠে। নদীর পার ঘেঁষে রাস্তাটা সোজা মিলে গেছে বড় রাস্তার সঙ্গে। এ পথটুকুতে ভ্যানই ভরসা। রিকশা নেওয়া যেত। আলতা দূরত্ব রাখার জন্য ভ্যানই বেছে নেয়। ২১ বছরের কিশোর লেবাস গোটানো দেবরটা এখন মাঝেমধ্যে ওর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে গল্প করার ছলে। মাঝরাতে মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা পড়ে। আলতা সেটা বাতাসের দুষ্টুমি হিসেবে উড়িয়ে দেয়। সেকারণেই ইদানীং আগ-পিছে অনেক কানাঘুষা শোনে। কিন্তু আলতা ঘরের কথা বাইরে নিতে চায় না। ওই প্রসঙ্গে কেউ কথা বললে এড়িয়ে চলে। আলতা ওদের অবসরের গল্পের সারাংশ হতে চায় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদও মায়া লুকিয়ে কর্কশভাবে গায়ে ঢুকে পড়তে চায়। মাঝেমধ্যে বাতাস এসে রোদ শাসায়, আবার চড়াও হয়। এভাবে দুলতে দুলতে আলী আলতাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। কাউন্টারের লোকটা জানায়, একটি বাস দশ মিনিট আগে ছেড়ে গেছে। পরের বাসটি আসবে একঘণ্টা পর। স্ট্যান্ডের পাশে জমিয়ে বসা চায়ের দোকানে নিয়ে যায় আলী ওর ভাবিকে। হঠাৎ পাওয়া দায়িত্বটা ওকে এক ধাক্কায় বড় করে ফেলেছে। সম্পর্কে বড় ভাবি হলেও মাঝেমধ্যে আলতা কাছে আশ্রয় নিতে মন চায় আলীর। তা আরও বেড়ে যায় মেলায় শামিয়ানা টানানো সিনেমা দেখার পর। অভুক্ত পোষা খরগোশকে বশ করতে মন চায় তার। উঠতি বয়সের নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অন্যরকম ভালো লাগা জেঁকে বসে সমবয়সী ভাবির জন্য। কিন্তু ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে এগোতে পারে না সে। তাই সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে।
ওদের চা শেষ হওয়ার আগেই পরের গাড়িটার ভেঁপু এসে কানে লাগে। আলতা হাঁসফাঁস করে আলীর পেছন পেছন দৌড়ে উঠে পড়ে লোকাল বাসটায়। ভয়ে ও গরমে সারা শরীর থেকে দড়দড়িয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। বাসের ভেতরে যাত্রীদের ঠাসাঠাসি ভিড়, বসার জায়গার অভাব, ঘাম-বিড়ির দুর্গন্ধযুক্ত গুমোট গরমে আলতার নাড়িভুড়ি পেটের ভেতরে মোচাড় দিয়ে ওঠে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে আলী আলতাকে সামলে নেয়। একজন নিরীহ লোক ওর অসুস্থতা দেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বসার জায়গা ছেড়ে দেয়। আলতা বসার পরে চোখ বন্ধ করে। সিটে মাথা এলিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। মনে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত কচি ধানখেত। সেখানে কলাপাতা-সবুজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। বৃষ্টির ঝাপটায় আলতার ঘুম ভাঙলে আশপাশে তাকিয়ে দেখে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে।
৭.
ওসমান গতকাল আধাবেলা ছুটি নিয়েছিল মালিকের কাছ থেকে। ইয়াসিনের কাছে যাবে কিছু দিরহাম আনতে। আলতাকে পাঠাবে। এদিকে আলী আজ ভাবিকে নিয়ে যাবে ব্যাংকে, কীভাবে টাকা তুলতে হয়, তা শেখাতে। আলতা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে কথা বলেছিল। ওসমান টের পেয়েছিল আলতার আনন্দ সুরেলা কণ্ঠস্বর।
৮.
টাকাগুলো হাতে নিয়ে আলতার চোখে পানি চলে আসে। সারা জীবনে কখনো এত টাকা হাতে নেওয়ার ভাগ্য হয়নি ওর। আজ মায়ের হাতে টাকাগুলো দেবে। মায়ের পাশে দাঁড়ানোর আনন্দে দিশাহারা আলতা যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, তখনই একটি বাস এসে ওর সামনের অচেনা জলজ্যান্ত মানুষকে চাপা দেয়। মুহূর্তেই মানুষটা চোখের সামনে থেতলানো মাংসের কিমা হয়ে পড়ে থাকে। সেই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারায় আলতা। জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারে মায়ের কোলে শুয়ে আছে সে। কুটুমবাড়িতে আলীর কোনোরকম অযত্ন হয় না। তিনদিন আয়েস করে শুয়ে বসে গ্রাম দেখে, বেয়াইনের সঙ্গে গাল-গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এরই মধ্যে আলতাকে ওর মা ফকির বাড়ি ঘুরিয়ে আনে দুদিন। মেয়ের ভয় কমানো, সন্তান ধারণের আগেভাগের আচার-আচরণ, পানি পড়া নেওয়ার জন্য। ফকির মহাজন হুকুম করেন, ওসমান দেশে আসার সাতদিন আগে একবার এসে চুড়ান্ত তাবিজ ও চিকিৎসা শরীরে ধারণ করতে হবে।
‘রাহো, আলীরে জিগাইয়া লই।’
শাশুড়ি ওর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
৬.
সকালবেলা আলী আধাপেটে আর আলতা বাসিমুখে রওনা দেয়। ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের যাত্রাপথে একবারই বাসে উঠে হয়। বাসের বারবার ব্রেক কষা আলতার পেটের নাড়িভুড়ি তালগোল পাকিয়ে দেয়। আলতা তাই কখনো বাড়িতে যাওয়ার আগে মুখে কিছু দেয় না। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে, যেন এ যাত্রাপথ নির্ঝঞ্ঝাট হয়।
আলতার পরনে রঙিন কাপড়। দামও খারাপ নয়। বাবার বাড়ি অপেক্ষায় থাকা ভাবিদের নিজের সুখ দেখাতে মন চায় ওর। বাবা হারা দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে ওর মা বেশ কষ্টে, চেয়ে-চিন্তে খাবার জোগাড় করে বড় করেছেন। এখন ভাইটা বড় হওয়ায় সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। তবে তাও ওর স্বামীর বাড়ির মতো নয়। বড় চাচার অবস্থা ভালো। শহরের মার্কেটে দোকান আছে। সেখানে চাচাতো ভাই নুরুল আমিনের কসমেটিকস ও রেডিমেড কাপড়ের দোকান। নুরুল আমিনের কথা মনে হতেই বুকে আগুনের হালকা ছ্যাঁত লাগার মতো জ্বলে ওঠে।আলীর চুলগুলো আজ একটু অন্যরকম। অন্যদিন থেকে একটু স্থির, শজারু কাঁটার মতো শক্ত। গায়ে কড়কড়ে হলুদ কালো ডোরাকাটা বাঘের জর্জেট জামা। স্বচ্ছ হওয়ায় শরীরের সব চোখে পড়ে। বাড়ি থেকে বের হয়ে ওরা প্রথমে ভ্যানগাড়িতে ওঠে। নদীর পার ঘেঁষে রাস্তাটা সোজা মিলে গেছে বড় রাস্তার সঙ্গে। এ পথটুকুতে ভ্যানই ভরসা। রিকশা নেওয়া যেত। আলতা দূরত্ব রাখার জন্য ভ্যানই বেছে নেয়। ২১ বছরের কিশোর লেবাস গোটানো দেবরটা এখন মাঝেমধ্যে ওর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে গল্প করার ছলে। মাঝরাতে মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা পড়ে। আলতা সেটা বাতাসের দুষ্টুমি হিসেবে উড়িয়ে দেয়। সেকারণেই ইদানীং আগ-পিছে অনেক কানাঘুষা শোনে। কিন্তু আলতা ঘরের কথা বাইরে নিতে চায় না। ওই প্রসঙ্গে কেউ কথা বললে এড়িয়ে চলে। আলতা ওদের অবসরের গল্পের সারাংশ হতে চায় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদও মায়া লুকিয়ে কর্কশভাবে গায়ে ঢুকে পড়তে চায়। মাঝেমধ্যে বাতাস এসে রোদ শাসায়, আবার চড়াও হয়। এভাবে দুলতে দুলতে আলী আলতাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। কাউন্টারের লোকটা জানায়, একটি বাস দশ মিনিট আগে ছেড়ে গেছে। পরের বাসটি আসবে একঘণ্টা পর। স্ট্যান্ডের পাশে জমিয়ে বসা চায়ের দোকানে নিয়ে যায় আলী ওর ভাবিকে। হঠাৎ পাওয়া দায়িত্বটা ওকে এক ধাক্কায় বড় করে ফেলেছে। সম্পর্কে বড় ভাবি হলেও মাঝেমধ্যে আলতা কাছে আশ্রয় নিতে মন চায় আলীর। তা আরও বেড়ে যায় মেলায় শামিয়ানা টানানো সিনেমা দেখার পর। অভুক্ত পোষা খরগোশকে বশ করতে মন চায় তার। উঠতি বয়সের নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অন্যরকম ভালো লাগা জেঁকে বসে সমবয়সী ভাবির জন্য। কিন্তু ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে এগোতে পারে না সে। তাই সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে।
ওদের চা শেষ হওয়ার আগেই পরের গাড়িটার ভেঁপু এসে কানে লাগে। আলতা হাঁসফাঁস করে আলীর পেছন পেছন দৌড়ে উঠে পড়ে লোকাল বাসটায়। ভয়ে ও গরমে সারা শরীর থেকে দড়দড়িয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। বাসের ভেতরে যাত্রীদের ঠাসাঠাসি ভিড়, বসার জায়গার অভাব, ঘাম-বিড়ির দুর্গন্ধযুক্ত গুমোট গরমে আলতার নাড়িভুড়ি পেটের ভেতরে মোচাড় দিয়ে ওঠে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে আলী আলতাকে সামলে নেয়। একজন নিরীহ লোক ওর অসুস্থতা দেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বসার জায়গা ছেড়ে দেয়। আলতা বসার পরে চোখ বন্ধ করে। সিটে মাথা এলিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। মনে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত কচি ধানখেত। সেখানে কলাপাতা-সবুজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। বৃষ্টির ঝাপটায় আলতার ঘুম ভাঙলে আশপাশে তাকিয়ে দেখে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে।
৭.
ওসমান গতকাল আধাবেলা ছুটি নিয়েছিল মালিকের কাছ থেকে। ইয়াসিনের কাছে যাবে কিছু দিরহাম আনতে। আলতাকে পাঠাবে। এদিকে আলী আজ ভাবিকে নিয়ে যাবে ব্যাংকে, কীভাবে টাকা তুলতে হয়, তা শেখাতে। আলতা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে কথা বলেছিল। ওসমান টের পেয়েছিল আলতার আনন্দ সুরেলা কণ্ঠস্বর।
৮.
টাকাগুলো হাতে নিয়ে আলতার চোখে পানি চলে আসে। সারা জীবনে কখনো এত টাকা হাতে নেওয়ার ভাগ্য হয়নি ওর। আজ মায়ের হাতে টাকাগুলো দেবে। মায়ের পাশে দাঁড়ানোর আনন্দে দিশাহারা আলতা যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, তখনই একটি বাস এসে ওর সামনের অচেনা জলজ্যান্ত মানুষকে চাপা দেয়। মুহূর্তেই মানুষটা চোখের সামনে থেতলানো মাংসের কিমা হয়ে পড়ে থাকে। সেই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারায় আলতা। জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারে মায়ের কোলে শুয়ে আছে সে। কুটুমবাড়িতে আলীর কোনোরকম অযত্ন হয় না। তিনদিন আয়েস করে শুয়ে বসে গ্রাম দেখে, বেয়াইনের সঙ্গে গাল-গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এরই মধ্যে আলতাকে ওর মা ফকির বাড়ি ঘুরিয়ে আনে দুদিন। মেয়ের ভয় কমানো, সন্তান ধারণের আগেভাগের আচার-আচরণ, পানি পড়া নেওয়ার জন্য। ফকির মহাজন হুকুম করেন, ওসমান দেশে আসার সাতদিন আগে একবার এসে চুড়ান্ত তাবিজ ও চিকিৎসা শরীরে ধারণ করতে হবে।
আলতা বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর দৃশ্যপট বদলে যায়। শ্বশুরবাড়ির সবাই হঠাৎ সমীহ করে চলা শুরু করে। শাশুড়ির কাছেই জানতে পারে, ওসমান দেশে আসবে কিছুদিনের মধ্যে পাকাপোক্তভাবে। পরিবারের সবার মধ্যে হতাশা বিরাজ করলেও আলতা খুব খুশি হয়। মায়ের পরামর্শ মনে পড়ে। ঠিক করে, ওসমান আসার একসপ্তাহ আগে একবার গিয়ে তাবিজ ও চিকিৎসা নিয়ে আসবে। ফলহীন বৃক্ষ যে কেউ ভালোবাসে না, এ কথা আলতাও জানে।
৯.
খবরটা প্রথমে হালকা পালকের মতো কানে এসে পৌঁছালেও দিনের শেষটা ভারী পাথরের মতো বুকে চেপে বসে আলতার। সারা বাড়ি, গ্রাম, এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও পৌঁছে যায় খবরটি, ওসমান পরিচিত হয়ে ওঠে সারা দেশে। দুবাইয়ের একটি বহুতল ভবনে আগুন লেগে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। মারা গেছে দশ জন। এদের মধ্যে রয়েছে আলতার প্রাণপ্রিয় ওসমান মৃধা, বয়স ৩৭ নামে এক বাংলাদেশি। রেমিট্যান্স সৈনিকের কথা ব্রেকিং নিউজ, মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। ছুটে আসে টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক, থানার পুলিশ, চেয়ারম্যান। শোকার্ত হয়ে পড়ে চারপাশ। সাংবাদিকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করে ওসমান কেমন মানুষ ছিল? কি পছন্দ করত? কি ভালোবাসতো এসব কিছু। আলতার কথা আড়ালে পড়ে থাকে ওসমানের পাসপোর্টে অবিবাহিত থাকার কারণে। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই আলতাকে জানলেও কাগজ ওকে চেনে না।
আলী আর ওর বাবা ছুটে যায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে। ওসমানের মৃত্যু দুর্ঘটনায় হওয়ায় কোম্পানি থেকে আশ্বাস আসে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের। সোনার ডিম দেওয়া হাঁস মৃত্যুর পরও অনেক সোনার ডিম রেখে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন মনে মনে খুশি হয়। বেশি হয় আলী। ভেতরে আরও একটি খায়েশ জাগে। দশদিন পর ওসমানের লাশ আসে দেশে। এয়ারপোর্টে সবার সঙ্গে আলতাও যায় অনেকটা উপেক্ষিত হয়ে। কেননা এতদিনে সবাই বুঝে গেছে, ওসমানের প্রাপ্য টাকার একমাত্র অংশীদার ওর বাবা-মা। যেহেতু কাগজ-কলম ও পাসপোর্টে ওসমান মৃত্যুকালে অবিবাহিত ছিল।
দাফনের আগে কফিনটা একবারের জন্য খোলা হয়। সেখানে পোড়া মাংসের কাবাবসদৃশ কিছু খণ্ড দেখে সবাই। জ্ঞান হারায় আলতা আর ওর শাশুড়ি।ওসমানকে দাফন করা হয় পুকুরঘাটে, বড় তালগাছের নিচে। গাছটি ওসমানের নিজের হাতে লাগানো ছিল। দেশে থাকাকালীন ওখানে জিরিয়ে নিত মাঝেমধ্যে। জায়গাটি কবরের জন্য অসামঞ্জস্য হওয়ার পরও সবাই ওখানেই দাফন করতে রাজি হয়। আলতা প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে একবার স্বামীর কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এখন প্রতিদিন আলতার দরজায় টোকা পড়ে। ব্যাপারটা এখন সবার জানা। তাই তিনমাস যেতে না যেতে ওসমানের মা মৃত ছেলের বউকে বাড়িছাড়া করার পায়তারা করে। কিন্তু আলতা ছাড়তে চায় না স্বামীর ভিটা। হঠাৎ একদিন আলতার মা এসে হাজির হয় ওর অজান্তে শাশুড়ির পরামর্শে। বিধবা মেয়েকে মায়ের হাতে তুলে দেবেন তিনি।
আলতার কান্নাকাটির কারণে বেয়াইনবাড়ি দুদিন থেকেই ফিরে যান খালি হাতে।গভীর রাত। মেঘকাটা জ্যোৎস্নায় গাছের পাতাগুলো মায়াবতী হয়ে উঠেছে। জানালার গ্রিল গলিয়ে চাঁদের আলো আলতার বিছানায় এসে লুটিয়ে পড়ে। কামনায় উথলে ওঠা আলতার শরীর সেই আলো গায়ে মেখে আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। আজ দরজার খিল খুলে রেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে এ বাড়িতেই স্থায়ী হওয়ার শেষ চেষ্টাটা আজ রাতেই করতে হবে ওকে। সময় গড়িয়ে যায়। আলতা অপেক্ষা করতে থাকে...
--------
৯.
খবরটা প্রথমে হালকা পালকের মতো কানে এসে পৌঁছালেও দিনের শেষটা ভারী পাথরের মতো বুকে চেপে বসে আলতার। সারা বাড়ি, গ্রাম, এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও পৌঁছে যায় খবরটি, ওসমান পরিচিত হয়ে ওঠে সারা দেশে। দুবাইয়ের একটি বহুতল ভবনে আগুন লেগে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। মারা গেছে দশ জন। এদের মধ্যে রয়েছে আলতার প্রাণপ্রিয় ওসমান মৃধা, বয়স ৩৭ নামে এক বাংলাদেশি। রেমিট্যান্স সৈনিকের কথা ব্রেকিং নিউজ, মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। ছুটে আসে টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক, থানার পুলিশ, চেয়ারম্যান। শোকার্ত হয়ে পড়ে চারপাশ। সাংবাদিকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করে ওসমান কেমন মানুষ ছিল? কি পছন্দ করত? কি ভালোবাসতো এসব কিছু। আলতার কথা আড়ালে পড়ে থাকে ওসমানের পাসপোর্টে অবিবাহিত থাকার কারণে। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই আলতাকে জানলেও কাগজ ওকে চেনে না।
আলী আর ওর বাবা ছুটে যায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে। ওসমানের মৃত্যু দুর্ঘটনায় হওয়ায় কোম্পানি থেকে আশ্বাস আসে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের। সোনার ডিম দেওয়া হাঁস মৃত্যুর পরও অনেক সোনার ডিম রেখে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন মনে মনে খুশি হয়। বেশি হয় আলী। ভেতরে আরও একটি খায়েশ জাগে। দশদিন পর ওসমানের লাশ আসে দেশে। এয়ারপোর্টে সবার সঙ্গে আলতাও যায় অনেকটা উপেক্ষিত হয়ে। কেননা এতদিনে সবাই বুঝে গেছে, ওসমানের প্রাপ্য টাকার একমাত্র অংশীদার ওর বাবা-মা। যেহেতু কাগজ-কলম ও পাসপোর্টে ওসমান মৃত্যুকালে অবিবাহিত ছিল।
দাফনের আগে কফিনটা একবারের জন্য খোলা হয়। সেখানে পোড়া মাংসের কাবাবসদৃশ কিছু খণ্ড দেখে সবাই। জ্ঞান হারায় আলতা আর ওর শাশুড়ি।ওসমানকে দাফন করা হয় পুকুরঘাটে, বড় তালগাছের নিচে। গাছটি ওসমানের নিজের হাতে লাগানো ছিল। দেশে থাকাকালীন ওখানে জিরিয়ে নিত মাঝেমধ্যে। জায়গাটি কবরের জন্য অসামঞ্জস্য হওয়ার পরও সবাই ওখানেই দাফন করতে রাজি হয়। আলতা প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে একবার স্বামীর কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এখন প্রতিদিন আলতার দরজায় টোকা পড়ে। ব্যাপারটা এখন সবার জানা। তাই তিনমাস যেতে না যেতে ওসমানের মা মৃত ছেলের বউকে বাড়িছাড়া করার পায়তারা করে। কিন্তু আলতা ছাড়তে চায় না স্বামীর ভিটা। হঠাৎ একদিন আলতার মা এসে হাজির হয় ওর অজান্তে শাশুড়ির পরামর্শে। বিধবা মেয়েকে মায়ের হাতে তুলে দেবেন তিনি।
আলতার কান্নাকাটির কারণে বেয়াইনবাড়ি দুদিন থেকেই ফিরে যান খালি হাতে।গভীর রাত। মেঘকাটা জ্যোৎস্নায় গাছের পাতাগুলো মায়াবতী হয়ে উঠেছে। জানালার গ্রিল গলিয়ে চাঁদের আলো আলতার বিছানায় এসে লুটিয়ে পড়ে। কামনায় উথলে ওঠা আলতার শরীর সেই আলো গায়ে মেখে আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। আজ দরজার খিল খুলে রেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে এ বাড়িতেই স্থায়ী হওয়ার শেষ চেষ্টাটা আজ রাতেই করতে হবে ওকে। সময় গড়িয়ে যায়। আলতা অপেক্ষা করতে থাকে...
--------
লেখক পরিচিতি
ইসরাত জাহান। পেশায় ব্যাংকার। তবে সাহিত্যের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা শৈশব থেকেই। জন্ম পটুয়াখালী, নানাবাড়ি। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম শহরে বাবার চাকরিসূত্রে।
লেখকের এ পর্যন্ত দুটি উপন্যাস ‘মেঘের গায়ে মেঘ’ প্রকাশিত হয় আনন্দম প্রকাশনী থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে। ‘কেন মেঘ আসে’, প্রকাশিত হয় বায়ান্ন প্রকাশনী থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে অমর একুশের বইমেলায়। একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘একটি বেনসন বা জংলিফুলের গন্ধ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে। লেখকের অবসর কাটে দুই মেয়ের সঙ্গে গল্প করে।
ইসরাত জাহান। পেশায় ব্যাংকার। তবে সাহিত্যের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা শৈশব থেকেই। জন্ম পটুয়াখালী, নানাবাড়ি। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম শহরে বাবার চাকরিসূত্রে।
লেখকের এ পর্যন্ত দুটি উপন্যাস ‘মেঘের গায়ে মেঘ’ প্রকাশিত হয় আনন্দম প্রকাশনী থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে। ‘কেন মেঘ আসে’, প্রকাশিত হয় বায়ান্ন প্রকাশনী থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে অমর একুশের বইমেলায়। একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘একটি বেনসন বা জংলিফুলের গন্ধ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে। লেখকের অবসর কাটে দুই মেয়ের সঙ্গে গল্প করে।
2 মন্তব্যসমূহ
ভালো লেগেছে। বিষয়বস্তু আর উপস্থাপনা চমৎকার। দুএক জায়গায় ভাষার জড়তা থাকলেও লেখায় ছন্দ আছে।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ আপা।
উত্তরমুছুন