ডোনাল রায়ান
অনুবাদ : শুভ চক্রবর্তী
[চেখভ থেকে কিট দ্য ওয়াল পর্যন্ত লেখকদের নিয়ে ডোনাল রায়ান ছোটো গল্প লেখার শিল্প অন্বেষণ করেছেন তাঁর এই লেখায়]
আমি স্কুলের বাইরে প্রথম যে গল্পটি লিখেছিলাম তা ছিল আইরিশ বক্সার ব্যারি ম্যাকগুইগানকে নিয়ে। তখন আমার বয়স দশ। আমি ব্যারিকে খুবই পছন্দ করতাম। তিনি সেই সময় আমেরিকান স্টিভ ক্রুজের কাছে নেভাদায় গনগনে সূর্যের নিচে তাঁর বিশ্ব ফেদারওয়েট খেতাবটি হারিয়েছিলেন এবং আমার মন ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল। আমার নায়কের সেই বেল্ট পুনরুদ্ধার করা হলেই কেবল আমার সেই ভাঙ্গা মন মেরামত হতে পারতো। দু'এক মাস পেরিয়ে গিয়েছিল ।নতুন করে ম্যাচের কোন কথা হয়নি,তখনও। এবং আমি এই বিষয়ে সেই সময়ে একটা গল্প লিখেছিলাম।
আমার গল্পের সেই লড়াইটি ছিল আয়ারল্যান্ড। এবং আমি ছিলাম রিঙের বাইরে । গল্পে আমিই সমস্ত কিছুর আয়োজন করেছিলাম। এমনকি ব্যারিকে স্টিভের সেই কনুই বাঁকানো ভয়ংকর মুষ্টির মোকাবেলার জন্য কিছু কৌশলও বাৎলে দিয়েছিলাম। তিনি তাতে সফলও হয়েছিলেন । ব্যারি খুব সহজেই পয়েন্ট হাসিল করে জিতেছিলেন। তিনি স্টিভকে জড়িয়ে ধরেছিলেন । তাঁর বাবা "ড্যানি বয়" গানটা গেয়েছিলেন। আমি আমার গল্প শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে গভীর স্বস্তি অনুভব করেছিলাম। সেই মুহূর্তে যেন ধরণী প্রশান্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজের জন্য নতুন এক জগত তৈরি করেছিলাম। এবং কিছু সময়ের জন্য হলেও তাতে বাস করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কাগজের এপার থেকে ওপারে বলপয়েন্টের নিব ঘুরিয়েই আমি সেই অপার আনন্দ তৈরি করেছিলাম । এখন আমি যখনই লিখতে বসি তখনই সেই গল্পটাই ভাবি। সেই প্রশান্তিময় অনুভূতির সীমান্তে পৌঁছানোর জন্যেই আমার চেষ্টা থাকে।
অবশ্য সেই অনুভূতি ফিরে পেতে আমার বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। স্কুলে আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম কেননা আমাকে চারপাশ থেকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এবং দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলা হয়েছিল যে আমি একজন লেখক, কিন্তু আমি ব্যাখ্যাতীত এমন এক কর্মজীবন বেছে নিয়েছিলাম যেটি আমার লেখক সত্ত্বাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, আমার সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ পেতো এবং সেগুলো এতটাই নিম্নমানের ছিলো যে পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া এদের আর কোনো গতি হতো না। যা কিছুই লিখতাম তা সত্য কিংবা পাঠযোগ্য মনে হতো না।
আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই আমার শাশুড়ি মা কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভে একটি ফাইল পেয়েছিলেন, কম্পিউটারটি আমি তাঁকে ধার দিয়েছিলাম (সেখানেই একটি দুর্দান্ত এবং রোমহর্ষক গল্পের প্রণোদনা ছিল)। সেই ফাইলে, একজন তরুণ উকিলকে এক গুণ্ডা মক্কেল কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছিল তা নিয়ে একটি উপহাসমূলক গল্প ছিল। আমি গল্পটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম এবং ভুলেছিলাম জনসি কানলিফ নামের এই গল্পের একজন সাধারণ এবং খাঁটি হৃদয়ের পার্শ্ব চরিত্রকে। আমার স্ত্রী জনসিকে নতুন জীবন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এবং আমি তাকে কেন্দ্র করে নতুন করে লিখতে শুরু করেছিলাম । গল্পটি বেড়েই চলেছিল যতক্ষণ না আমি আমার প্রথম সমাপ্ত উপন্যাস, The Thing About December এর প্রথম খসড়া পেয়ে যাই। এইবার আমি বিব্রত কিংবা লেখাটি পোড়ানোর তাগিদ অনুভব করিনি বরং এক বিরল প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। আমি জানতাম এই প্রশান্তি স্থায়ী হবে না, এবং তখন আমি দ্রুত নতুন কিছু গল্প লিখেছিলাম । এবং সেই প্রশান্তি তখনও নষ্ট হয়নি। অন্তত কিছুসময়ের জন্যে তো নয়।
তো, প্রায় ভুলে যাওয়া একটা ছোটোগল্প, যা আমি কুড়ির দশকের শুরুতে ঘোরের মধ্যে লিখেছিলাম, সেটিই আমার লেখক হওয়ার পথ প্রসারিত করেছিল। হতে পারে এটা এমনই হতো, কিংবা হতোই না।কিন্তু মগজের ভেতরে ধারণাগুলিকে ব্যাকরণে আবদ্ধ করার একটা তাগিদ আমার ছিল । মেরি কস্টেলো, যার লেখা 'দ্য চায়না ফ্যাক্টরি' আমার পড়া সেরা ছোটগল্পের সংগ্রহগুলির মধ্যে একটি, তিনি বলেছেন: “শুধুমাত্র তা-ই লেখা উচিত যা অপরিহার্য… সেই চিত্রকল্প কিংবা গল্প যা আপনার ভেতরে অবিরাম দাঁতে কাটছে, আপনাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়; লিখে ফেলা।“
আমি জানি যে এই সংকীর্ণ, নিয়ম-আবদ্ধ, ভাইরাস-আক্রান্ত চলমান সময়ে, অনেকেই মাথার ভেতরে সেই অস্বস্তিকর অনুভূতিটির সম্মুখীন হচ্ছেন, সেই তাগিদ- যা ভাষার বুননে বাস্তব রূপ নেবে, কিংবা তাঁদের ভেতরের ভাবনাগুলোর একটি নিটোল রূপ, বাইরের জগতের কাছে ধরা দেবে। এই লেখায় আমি আমার প্রিয় লেখকদের নানা লেখা থেকে কিছু ধারণা জড়ো করেছি যা হয়তো সৃষ্টির এই অস্থির তাড়নাকে সেই প্রশান্তিময় স্থিতি দেবে।
চিন্তা করবেন না।
ছোটগল্পে বাক্যগুলিকে বেশ কাজ করতে হয়! চেখভের কিছু গল্প ছাপা অবস্থায় তিন পৃষ্ঠারও কম; কয়েকটি গল্প কেবল একটি সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ নিয়ে গঠিত। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প "দ্য লেডি উইথ দ্য ডগ"-এ, প্রথম পৃষ্ঠায় আমাদের গুরভের প্রকৃতি, ইতিহাস এবং প্রেরণাগুলোর বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তবে কোনও চাপ বা অতিরিক্ত বোঝা নেওয়ার মতো কোনো ব্যাপার নেই। স্টিফেন কিং-এর ২০১০ সালের সংগ্রহ ‘ ফুল ডার্ক, নো স্টারস’ হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত অথচ উদ্বেগে পরিপূর্ণ একটা উচ্চ মানের লেখা। আমার সহকর্মী লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সারাহ মুর ফিটজেরাল্ড, আমার মতোই একজন ঔপন্যাসিক, যিনি মাঝে মাঝে খুব সংক্ষিপ্ত কাঠামোর শৈলীতে ফেরেন। সারাহ ছোটো গল্পকে "গল্প বলার সর্বোত্তম ক্ষমতা" বলে মনে করেন। উত্তম গল্পগুলো হলো সেই গুলো যার মধ্যে কিছুই অতিরিক্ত নয়, যার লক্ষ্য তীক্ষ্ণ এবং প্রাণবন্ত তবে তা আড়ম্বরে উপবৃত্তাকারও হতে পারে, অর্থাৎ প্রতিধ্বনিতে পূর্ণ।" আমি মাইক ম্যাককরম্যাককে বলতে শুনেছি উপন্যাসের রূপটি "লেখকের জন্য সাচ্ছন্দ্যের আবাস" অন্যদিকে ছোটো গল্প হলো খোলা মরুপ্রান্তরের মতো যেখানে লুকোনোর কোনো জায়গা নেই। বাড়াবাড়ি বা বিভ্রান্তির কোনো অবকাশও নেই।
আমার স্ত্রী আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন ব্যাপারটি নিয়ে আমি এতটা উদ্বিগ্ন কেন থাকি। আমি তখন সবেমাত্র আমার প্রথম দু'টি উপন্যাস প্রকাশ করেছি। এবং ছোটোগল্পের একটি সম্পূর্ণ সংকলন, A Slanting of the Sun এর কাজ শুরু করেছি । সে কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে দেখতে পেতো আমি হতাশায় কুঁকড়ে আছি। "প্রতিটি বাক্য আমাকে উদ্বিগ্ন করে," আমি অনুযোগ করতাম। " একটাও ভালো হচ্ছে না”, “কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কতটা কী হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করো না," সে উত্তরে বলেছিল। “গল্পটি লিখে ফেল, তারপরে ফিরে দেখ । সমস্ত উদ্বেগজনক বাক্যগুলি তখন ঠিক করতে পারবে। আর একবার গল্পটি লেখা হয়ে গেলে, সেই বাক্যগুলি নিয়ে মোটেও তোমার দুশ্চিন্তা হবে না। বাক্যগুলো যেমন আছে তেমনই থাকবে ।"
আহা, তাঁর সেই বিচক্ষণ শব্দগুলিতে আমি যে অনাবিল স্বস্তি পেয়েছিলাম তা এখনও অনুভব করতে পারি। জীবন দুর্ভাবনা করার মতো অজস্র বিষয় দিয়ে ভরা। আমাদের বাক্যের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখার প্রচেষ্টাটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া উচিত এবং তার জন্য নিরন্তর অনুসন্ধান এবং পর্যায়ক্রমে তাকে সমৃদ্ধ করার চলমান প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকা উচিত। সৃজনশীলতা অবশ্যই আমাদের ভেতরে আনন্দের সুর তুলবে। এটি আমাদের উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হবে।
বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন
আমার সহকর্মী সারাহ যে ধারণাগুলিকে আলোকিত করেছেন তার মধ্যে একটি হল "শূন্য খসড়া" - যে খসড়া প্রথম খসড়ার আগে আসে। যেখানে আপনার গল্পটি আপনার স্ক্রীন বা পৃষ্ঠায় ছড়ানো থাকে যাতে সমস্ত বা বেশিরভাগ পছন্দসই উপাদানই উপস্থিত থাকে৷ শূন্য খসড়াটি নৈপুণ্য বা সূক্ষ্মতার বিচার-বিশ্লেষণের ভারমুক্ত এবং এতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া যাবে।
কিট দ্য ওয়াল, যিনি সম্প্রতি “সাপোর্টিং কাস্ট” নামে একটি চমৎকার সংকলন প্রকাশ করেছেন, যেখানে তাঁর উপন্যাসগুলির সকল চরিত্র আছে, তিনি গল্পকে লেখকের মগজ থেকে কাগজে কিংবা স্ক্রিনে আনা প্রসঙ্গে অভিমত দেন : “অতিরিক্ত চিন্তা করবেন না বরং বারবার সংশোধন করুন । কখনও কখনও আপনি রাস্তায় একজোড়া গ্লাভস বা একটি ফুল বা কফির কাপে লিপস্টিক দেখতে পান এবং এই বিষয়টি তখন আপনার মনোযোগ একটি বিশেষ দিকে ঘুরিয়ে দেয়। ঠিক ঐখানেই আপনার সংকেতটি রয়েছে। এই অনুভূতিটিকেই লিখে ফেলুন। অথবা একে ঘিরে কিছু লিখুন। এই পর্যায়ে আপনি জানবেন না সামনে কী আছে। নিছক প্রণোদনাটির টানেই চলেছেন আপনি, লেখকসত্ত্বার স্ফুরণ যাকে বলে। একে অনুসরণ করুন। এবং শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করতে থাকুন – হতে পারে একদিন, এক সপ্তাহ,কিংবা এক বছর। এবার বিষয়টি পুনরায় লিখুন এবং তারপরে শান্ত হয়ে বসুন এবং নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, 'জাদু কোথায়? আমি কি বলছি? কে এইসব বলছে?' আপনি যখন প্রশ্নগুলির সমাধান খুঁজে পাবেন তখনই জানবেন গল্পটি আপনি পেয়ে গেছেন এবং এবার এর ওপর আপনার কারুকাজ শুরু করতে পারেন কিংবা সম্পাদনা।"
আপনার ‘শূন্য খসড়া’টি যেন মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর রুক্ষ মার্বেলের একটা পিণ্ড, কিন্তু ডেভিডের মৌলিক আকৃতি-যুক্ত। আপনার মনোজগতের বাইরের সত্যিকারের দুনিয়ার অস্বস্তিজনক অস্তিত্ব, যা আনকোরা, বাস্তব এবং অগোছালো । এই অগোছালো তালটির মধ্যেই রয়েছে এর বিশালতার স্বরূপ। এবং সেটি মনোময় করার সর্বোত্তম উপায় হল তাকে সত্যের সংলগ্ন করা।
সত্যনিষ্ঠ থাকুন
কিন্তু আমি এটা বোঝাতে চাইছি না যে আপনাকে সবসময়ই আপনার নিজের সত্যটিই বলতে হবে বা শুধুমাত্র আপনার নিজের জীবন অভিজ্ঞতার উপরই সে সত্যের নিরূপণ করতে হবে, তবে লেখক হিসাবে আমাদের নিজস্ব তাড়না এবং লক্ষ্যের প্রতি সৎ থাকাও জরুরি। এই সততা সেই গল্পটির জন্যে, যা লেখা প্রয়োজন বলে নয় বরং যা আমরা লিখতে চাই বলেই লিখব। বিষয়টি খানিকটা এমন, মানুষ যা শুনতে চায় তা বলতে গেলে: আপনি নিজেকে অর্ধ-সত্য এবং নির্মিত বিশ্বাসের গেঁড়োতে জড়িয়ে ফেলবেন। আপনি লেখকের চেয়ে বেশি রাজনীতিবিদ হয়ে উঠবেন , যাদের মধ্যে কেউ কেউ ভালো এবং শোভন হলেও, পৃথিবীতে রাজনীতিবিদের সংখ্যা আপাতত যথেষ্ট ।
আপনার নিজের অভিজ্ঞতা, অবশ্যই, আপনার নিজের কাছে সত্য। এবং তা বিস্ময়কর কল্পকাহিনীতেও রূপান্তরিত হতে পারে, এবং বাস্তব-ভিত্তিক হওয়ার কারণে এতে প্রায় তাৎক্ষণিক তীব্রতাও থাকতে পারে। মেলাতু উচে ওকোরির প্রথম সংকলন ছিল, “দিস হোস্টেল লাইফ”। এই সঙ্কলনের গল্পগুলি একজন আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে আইরিশ রসদ ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে শিরোনাম গল্পটিতে আশ্রিতদের অভিজ্ঞতার পরম সত্যতা অনুভব করা যায়, এতে লেখকের স্বদেশী নাইজেরিয়ান গ্রামীননারীদের লোকভাষার অন্তর্ভুক্তি আছে ; অন্যদিকে আরেকটি গল্প, “Under the Awning”,-এ মনে হয় এ যেন লেখকের স্বচক্ষে দেখা বা নিজস্ব অভিজ্ঞতাপ্রসুত ঘটনাগুলির তির্যক বর্ণনা ।
ঝুঁকি নেওয়ার চেষ্টা করুন
আপনি যা করতে চান ঠিক সেটাই করতে পারেন, এমনকি (বা বিশেষত) তা যদি আগে কখনও করা না হয়েও থাকে তারপরেও। ফর্ম, বিষয়বস্তু, শৈলী, গঠন বা আপনার গল্পের অন্য কোনো উপাদানের ওপর ঝুঁকি নিলেও আপনার হারানোর কিছু নেই। রব ডয়েল, একজন পরিপূর্ণ ঝুঁকি-নেওয়া লেখক , তিনি লেখকদের "এমন একটি গল্প” লেখার চেষ্টা করার জন্য প্রণোদিত করেন যা ছোট গল্পগুলির চেনা ছাঁচে না হয়ে- বরং একটা এনসাইক্লোপিডিয়ার লিপিভুক্ত, বা একটা তালিকা, বা একটা প্রবন্ধ কিংবা একটি কাল্পনিক রেস্তোরাঁ পর্যালোচনা, যৌন-খেলনা, বিনোদন পার্ক বা চলচ্চিত্রের কাঠামোতে লেখা হোক। এমনকি লেখাটা কল্পকাহিনী কিনা তা নিয়ে লোকজনকে ভাবতে দিন। সব মিশিয়ে লিখুন।
ছোটগল্প চিন্তনের পাশাপাশি আবেগেরও অন্বেষণ করতে পারে – বিশাল কলেবরের ভাবনাগুলোও ছোটোগল্পে এঁটে যেতে পারে। প্রমাণ চাইলে, হোর্হে লুইস বোর্হেসের লেখা পড়তে পারেন । প্রকৃতপক্ষে, আমি ছোটো গল্প লেখার জন্য রবার্তো বোলানোর পরামর্শ কে সমর্থন করি : “বোর্হেস পড়ুন।"
তাঁর "গেস্ট অফ দ্য নেশন" এখনও পর্যন্ত লেখা শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী গল্পগুলির একটি৷'
লৌহ দণ্ডটি বাঁকিয়ে ফেলুন
""যখন পর্দা নামবে", ফ্র্যাঙ্ক ও’কনার ছোটগল্প প্রসঙ্গে বলেন, “সবকিছু পালটে যেতে হবে। লৌহদণ্ডটি বেঁকে যাবে অথবা বেঁকে যাওয়ার ঘটনাটি দৃশ্যমান হবে।“ যে গল্পটি আমার মনকে সর্বপ্রথম দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল সেটি ছিল ও'কনরের লেখা গল্প "গেস্ট অফ দ্য নেশন" । এই গল্পটিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী গল্প হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এবং ছোট গল্পের এই গুরুর নিজের লেখা গল্পগুলির মধ্যেও এটি অনুপম। গল্পটির শেষ দৃশ্য শেষ হয় বিধ্বস্ত কথকের হাহাকারপূর্ণ বিবৃতিটির সঙ্গে, "এবং এর পরে আমার সঙ্গে যা কিছুই ঘটতো, আমি তা নিয়ে আর কখনই একই রকম অনুভব করিনি।" এই বাক্যটির মধ্যেই রয়েছে অনুনয় যা ছোটগল্পের গল্পকারদের সেই প্রগাঢ় মুহূর্তটির কাছে পৌঁছে দেয়, সেই ঘটনা বা বোধোদয় বা বিপরীতমুখী ধারণা বা সন্ধিক্ষণ; তাঁদের গল্পের সীমাবদ্ধ কাঠামোর মধ্যেই এমন মুহূর্তটিকে ছুঁয়ে ফেলা যায় , যার অনুরণ্ন সেই সঙ্কীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হবে।
এই সময়ের ও’কনরের মতোই আরেকজন ঔপন্যাসিক জোসেফ, তিনি লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক। তিনি বলেছেন যে "আমার কাছে প্রতিটি চমৎকার ছোটো গল্প এমন একটা তাৎক্ষণিক মুহূর্তকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে যেখানে তীব্র পরিবর্তন সম্ভবপর হয় বা অন্ততপক্ষে চরিত্রের জন্য কল্পনা করা যায়। গল্পটি একটু সময় নিয়ে তবে ছাঁটুন,গল্পটি থেকে বেরিয়ে আসুন, এবং মুহূর্তটির সন্ধান করুন।" জোসেফ তার প্রিয় ছোটো গল্পগুলির মধ্যে, রেমন্ড কার্ভারের "ফ্যাট" – গল্পটির শেষদৃশ্যের শব্দগুলি উদ্ধৃত করেছেন: "এটা আগস্ট। আমার জীবন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। আমি উপলব্ধি করছি।"
সংলাপে যা বলা হয়নি তা শুনুন। প্রায়শই বাক্যালাপের ফাঁকে ফাঁকে গল্পটি গোঁজা থাকে।
মুহূর্তটি অবশ্য শেষ মুহূর্তেই থাকবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কিংবা গল্পের শেষেই যে বিস্ফোরক কিছু কিংবা নতুন কিছুর উদ্ঘাটন কিংবা অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন বাঁক ণেবে, এমনও নয়। মেরি গেটস্কিলের "হেভেন"- গল্পে একটি পরিবারের নানা টানাপোড়েন, মানসিক আঘাত এবং হারানোর ঘটনায় ভরপুর। এবং প্রায় প্রতিটি অনুচ্ছেদে লৌহদণ্ড বাঁকানো হয়েছে, কিন্তু এর শেষ অংশের স্বস্তির মুহূর্তটিই গল্পটিকে স্মরণীয় করেছে। গ্রীষ্মের এক বিকেলে সান্ধ্যভোজকে ঘিরে পরিবারের সকলের সমবেত হওয়ার সময়টির শান্ত নিবিড় বর্ণনায় ঈশ্বরের করুণা ধরা পড়েছে।
“তারা সবাই লন-চেয়ারে বসে কোলে গরম প্লেট নিয়ে খাবার খাচ্ছিল। মাংস স্বাদু এবং বিরল ছিল; ভার্জিনিয়া তার হাঁটু সরানোর সময় ঝোল গড়িয়ে সালাদ এবং পাস্তায় চলে গেল। হাল্কা হাওয়ায় ওদের মুখের চারপাশে এলানো চুলগুলি উড়ছিল এবং সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। গাছগুলো মৃদু মর্মরধ্বনি তুলছিল। পোকামাকড়ের চমৎকার আওয়াজ ভাসছিল চারপাশে। জ্যারল্ড থমকাল, কাঁটাচামচে ধরা মাংসখন্ডটি তার বুকের কাছে থেমে গেল। 'যেন স্বর্গ,' সে বলল। “স্বর্গের মতোই মনে হচ্ছে।' সকলে কিছু সময়ের জন্য চুপ হয়ে রইল।
আপনার গল্পটি শুনুন
"বিয়ার-ট্রিপ টু ইয়ান্ডুডনো", কেভিন ব্যারির ২০১২ সনের 'ডার্ক লাইজ দ্য আইল্যান্ড'-এর অন্যতম ছোটগল্প। এটি সেই গল্প যা আমার মনে প্রথম পাঠের মতোই সতেজ আজও। এই গল্পটির কিছু অংশ এবং ব্যারির অন্য সকল গল্পের জাদুই হচ্ছে সংলাপের প্রয়োগ : মেঠো, প্রাণময়, এবং চরিত্রগুলির মধ্যে খাঁটি ভাববিনিময় । নির্ভুল, অর্থাৎ গল্পের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। আমি কেভিনকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেছিলেন: "যদি আপনি মনে করেন যে আপনি একটি গল্পের চূড়ান্ত খসড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তবে তা মুদ্রণ করুন এবং লাল কলম হাতে নিয়ে জোরে এবং ধীরে পড়ুন। কাগজে কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিনে আপনার গল্পের ফাঁকফোকর এবং মিথ্যা সংযোগগুলি আপনার কান চোখের চেয়ে দ্রুত সনাক্ত করতে পারে। সংলাপে যা বলা হয়নি তা শোনার চেষ্টা করুন । প্রায়শই গল্প এবং এর নাটকীয়তা সংলাপের ফাঁকেই খুঁজে পাওয়া যায়।“
ভাষার প্রতিটি একক যে ভার বহন করে তার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিলে এবং প্রতিটি স্তরে যা বলা হলো কিংবা বলা হয়নি তা নিয়ে কাজ করলেই গল্পটি দ্যুতি ছড়াবে। স্বনামধন্য কবি অ্যালিস কিনসেলা উইন্ডো শিরোনামে সম্প্রতি তাঁর মাতৃত্বের প্রথম দিককার আনন্দময় সময়টিকে অনুপম শৈলীতে ছোট পরিসরে রূপ দিয়েছেন। "কবিতা বা গদ্য," অ্যালিস বলেছেন, "লক্ষ্য একই, প্রতিটি শব্দকে পৃষ্ঠায় জায়গা করে দেওয়া।"
সবকিছু উপেক্ষা করুন
এবং এই কথাটা যতটা নিজের কাছেই হেরে যাওয়া বলে মনে হচ্ছে তা কিন্তু নয় বরং এখানে একটা চূড়ান্ত উপদেশ রয়েছে: একবার আপনি আপনার গল্প লিখতে বসলে, এই নিবন্ধটি ভুলে যান। এই পর্যন্ত আপনাকে দেওয়া সমস্ত উপদেশ ভুলে যান। হাত খুলে লিখুন, মনের আগল খুলুন, নিজেকে সম্ভাবনার অসীমতায় আলগা করে দিন । এবং সেই ছাব্বিশটি অক্ষর (ইংরেজি) থেকে আপনি যা চান তা গড়ুন। আমরা নক্ষত্রের হৃদয় থেকেই আমরা এসেছিল আমরাই মহাবিশ্ব, এবং তাকেই তার গল্পটি শোনাচ্ছি।
------------------------------------------------------------------------------------------
ডোনাল রায়ান আইরিশ লেখক। তাঁর ৬ টি উপন্যাস ও ছোট গল্পের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিসি জাতীয় ছোট গল্প পুরস্কারের বিচারক।
বাংলা অনুবাদ-সম্পাদনা : রঞ্জনা ব্যানার্জী
0 মন্তব্যসমূহ