তারপর আমাদের এক নম্বর কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনের বাড়ির সমস্ত শাড়ির রঙ হয়ে গেল নীল। আয়ামাসি আমার ডানা কেটে নিয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের বাড়িতে কোনও খঞ্জনা পাখিও এল না… তুমি তোমার মামাবাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে কবে?
গম্ভীর ও খনখনে গলায় দুটো সোজা কথা এবং একটা প্রশ্ন করে রহমত চক্রবর্তী সেই যে চুপ করলেন, তারপর অনেকক্ষণ তেমন কোনও কথা বললেন না। একবার একটু ছোলা-বাদাম খেয়ে নিলেন শুধু। 'আপনি কি আর কিছু বলবেন না'? গণেশের এই পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে রহমত পাত্তা না দিয়ে উল্টোদিকের বাড়ির পাঁচিলটার দিকে চেয়ে রইলেন। পাঁচিলের গায়ে বহু পুরনো হলুদ দাগ। কেউ যত্ন করে আরও পুরনো একটা শাড়ি মেলে রেখেছে তাতে। সম্ভবত, ন্যাতা ওটা। নইলে এত নোংরা পাঁচিলে কি আর অমনভাবে কোনও সুন্দর শাড়ি মেলে রাখা যায়?
শাড়িটার আঁচলের সামনে দিয়ে একটা সেলাই চলে গেছে। সরোদের স্টিলের তার গোত্রের সেলাই। কোনও একটা নাম লেখা ছিল কখনও। নামটা আর নেই। তবে, নামটা যে ছিল কখনও, সেটা বোঝাতেই যেন শাড়িতে ওই সেলাইয়ের দাগ।
সরু গলির একদিকে টানা পাঁচিল। পাঁচিলের উল্টোদিকে চারটে বাড়ি। একটাতে একজন রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত থাকতেন। ওই গলির টাইমকলে গামছা পরে চান করতেন। আওয়াজ করে থুতু ফেলতেন। একদিন সকাল এগারোটার বালতি মগ নিয়ে চান করতে গেলেন। কিন্তু, ফিরে এলেন না। টাইমকলের ধারে বালতি আর মগ যত্নে পড়ে রইল। গলিতে আরও যে দুটি বাড়ি আছে, তাদের বাসিন্দারা মেশেন কম। আর রয়েছে এই দেড়শো বছরের ঠিকানা, এক নম্বর কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেন। গোটা বাড়িতে দুটো একশো ওয়াটের বালব রয়েছে। তার মধ্যে একটা বাথরুমে। পাতাখোররা বাথরুমের ছ’টা টালি খুলে নিয়ে চলে যাওয়ার ওখানে ত্রিপল টাঙানো। পুরনো ইটের পাঁজার ফাঁকে একটা আলিয়া ভাটের ছবি রাখা। এই গলিটা নিশুত রাতে বেওয়ারিশ কুকুরদের আওতায় চলে যায়। কিছু পাবে না জেনেও ভোরবেলায় এখনও কয়েকটা কাক লেড়ো বিস্কুটের আশায় নেমে আসে।
গত তিনদিন ধরে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে এখানে। ঘন, লালচে বৃষ্টি। দৃষ্টির একদম অন্তিমে চলে যাওয়া মালগাড়ির হুইসলের মতো তার শব্দ। আসলে, শব্দহীন। এই বৃষ্টি যেন আকাশ থেকে পড়ছে না। আকাশের ভিতরের আরও নির্জন আরও শূন্য কোনও অতিপ্রাচীন ঝরনার গা বেয়ে তা এসে পড়ছে পৃথিবীতে। তা এসে পড়ছে পাঁচিলে মেলা শাড়িটায়।
এই শাড়িটাই কি পাঁচালি পরেছিল টিভির ওই অনুষ্ঠানে? প্রশ্নটা গণেশের মনে আসার পর সে রহমতের দিকে একবার গভীরভাবে তাকাল। রহমতও কি এই কথাটাই ভাবল? রহমতের প্রপিতামহ মুসলমান থেকে খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন এরকম এক বৃষ্টির দিনেই। এই গল্পটা রহমত এক সময় বৃষ্টি হলেই বলতেন। এরকম দিনে ওঁর ডানা ঝাপটানি কমে যায়। কথাও কম বলেন। আজ কি তেমনই কোনও দিন? তাই গণেশের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না তিনি? কে জানে!
যে রিয়েলিটি শোয়ের অনুষ্ঠানে মাস্টারমশাইয়ের একমাত্র মেয়ে পাঁচালি চক্রবর্তী গান গাইতে গিয়েছিল, সেখানে মুখ দেখালেও পরের শীত থেকে মাচায় শিল্পীর দর বেড়ে যায়। চালু কথা এমনটাই। পাঁচালি গানটা শুরু করেছিল ভাল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন দূরে থাকো’। খানিকটা গাওয়ার পরেই ওর যে কী হল! অত সুন্দর গলা! অথচ, তারপর আওয়াজটা পুরো রহমতের মতো হয়ে গেল। মনে হল, ওর আর গাওয়ার ইচ্ছে নেই। সকলের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মতো কোনও সুর আর অবশিষ্ট নেই যেন ওর মধ্যে। বিচারকরা সঙ্গত কারণেই আর সুযোগ দিলেন না ওকে। অনেক বছর আগের ওই অডিশনে এই শাড়িটা পরে গান গেয়েছিল পাঁচালি। কে তুমি, কে তুমি, আমায় ডাকো।
গণেশের গায়ে জ্বর গত তিনদিন ধরে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। বহু বছরের রেওয়াজ। সে রোগা মানুষ। দুই ভুরুর মাঝখান দিয়ে একটা সরু কাটা দাগ বেঁকে নাকের হাড় অবধি চলে এসেছে। মানচিত্রে এমন যত্ন করে টানা সরু বক্ররেখা দিয়ে বিখ্যাত নদীকে বোঝানো হয়। বৃষ্টি হলেই গণেশের জ্বর শুরু হয়। সে তখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মেজাজ একটু শান্ত থাকলে স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নের ভিতরে বলা কথাবার্তা মনে করারও চেষ্টা করে। চেষ্টা করতে করতে ঝিম ধরে যায় মাঝেমাঝে। স্বর নিচু হয়ে আসে। নিজেকে বড় কোলাব্যাঙের মতো মনে হয়। ও কোলাব্যাঙ, ও সোনাব্যাঙ, সারারাত হেঁড়ে গলায় ডাকিস গ্যাঙরগ্যাঙ। রসুইপাড়ার মাঠ থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসে। বিসর্জনের ঢাক। মাঝেমাঝে তাল কেটে যায় তার। সেটা হাওয়ার দোষ না ঢাকির দোষ, তা অবশ্য বোঝা যায় না। গণেশের বাবা দিবাকর ছিল রেলের গার্ড। বেশ কয়েকবছর টানা হুইসল দিতে দিতে একবার একটা জগন্নাথ এক্সপ্রেসের পিছু পিছু রেললাইন বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গিয়েছিল সে।
পৃথিবীর একটা কিনারা ধরে ত্রিশ বছর আগে গণেশের বাবা হেঁটে চলে গেল। সেই অন্ধকার থেকে এই অন্ধকার- এতটাই হল গণেশের জীবনবৃত্তান্ত। তার মাঝে রহমত রাগ করে ওঠেন। বিছানায় ভেজা গামছা ফেলে রাখা নিয়ে প্রশ্ন করেন। ছোলাবাদাম সরিয়ে চাউমিন খেতে চান। আয়ামাসি চলে যাওয়ার পরে আর খঞ্জনা পাখির কখনও না আসা নিয়ে শোকপ্রকাশ করেন।
অবশ্য কখনও কখনও আশার কথাও বলেন কয়েকটা। যেমন, দুনিয়ার সমস্ত বাড়ির ছাদ শিশিরে ভরে যাবে একদিন। যেমন, অষ্টাদশ উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী থেকে স্তরীভূত হাসিরা এসে জমা হবে এই বাড়ির সামনে এক সন্ধেবেলায়।
রহমত চক্রবর্তী গণেশের পোষা পাখির নাম। এই পাখিটি জাতে ম্যাকাও। আমাজনের জঙ্গল থেকে উড়ে এসেছে কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনে। দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি এক নম্বর কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনে গণেশ একাই থাকতো বহু বছর। তারপর রহমত আসার পরে ওই বাড়িতে গণেশ আর সে একসঙ্গেই থাকে। বড় বাড়ি। বড় খাঁচা। রহমত আর গণেশ।
২
মেঘ ডেকে উঠলে ঢাকের শব্দ একদম মিলিয়ে যায়। কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেন পেরোলেই রসুইপাড়ার মাঠ। সেখানেই গ্রিন গার্ডেন ক্লাবের পুজো। ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাবে। বিসর্জনের দিনগুলোতে পাঁচালির কথা মনে পড়ে খুব। পাঁচালির সঙ্গে একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল গণেশ। তখনও গণেশের ব্যাঙ্কের চাকরিটা ছিল। মাসে ন’শো সাতান্ন টাকা বেতন। ব্যাঙ্কে চোদ্দমাস চাকরি করেছিল ও। পাঁচালির সঙ্গে শান্তিনিকেতনে অনেকদিন ছিল সে। তারপর একসময় পুরনো পুরনো লাগায় দুজনেই আবার ফিরে আসে কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনে। পাঁচালিদেরটা তিন নম্বর। মাঝের দু’নম্বরটাকে পুলিশ তুলে নিয়ে চলে গেছে। শীতলা পুকুরের জঙ্গলের নির্জন ঝোপের মধ্যে গণেশ আর পাঁচালি দুজনে দুটো গোখরো সাপ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উল্কার আত্মহত্যা দেখার সময় যে কথা-টথাগুলো দেওয়ার তা দিয়েছিল। নাম ‘শীতলা পুকুর’ হলেও কোনও পুকুর আর অবশিষ্ট ছিল না সেখানে। প্রতি বছর শীতলা পুজোর পর ওখানে মূর্তি বিসর্জন দেবে বলে এলাকার বহু পুরনো এক শীতলা-ভক্ত জমিদার পুকুরটা কাটিয়েছিল। সেই পুকুর মজে গিয়েছিল অনেকদিন। সেই জায়গায় ঘন জঙ্গল। ঢোল কলমীর পাতায় নাচতে থাকে দিন ও রাত। পুকুর নেই। তবে, পুকুরের নামটা রয়ে গিয়েছে দিব্যি। শাড়ির আঁচলে যেমন থেকে যায় রঙচটা সেলাই। সন্ধে গভীর হলে রহস্যময়ী চাঁদ অল্প ফুঁপিয়ে পৃথিবীর সব পুরনো প্রেমের গান নিয়ে হাজির হয় প্রাচীন ও মজে যাওয়া শীতলা পুকুরের এক হাঁটু ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে। বসন্ত-ফুরনো পুকুরের দলদলে মাটির ওপর শুয়ে তখন দুটো নিস্পৃহ মানুষ রাজকীয় ভঙ্গিতে একে অপরের চোখের পাতার ওপর হাত বুলোতে বুলোতে কথা দিচ্ছে যে, তারা কখনও আর কেউ কারও সঙ্গে দেখা করবে না। অতি লজ্জিত এক শাঁখামুঠি ওদের ওপর দিয়ে বেয়ে চলে যায়।
৩
এই বৃষ্টির যেন শেষ নেই। এর যেন কোনও শুরুও ছিল না কখনও। শিলে বেটে প্রস্তুত করা হয়েছে এই বৃষ্টিকে। বারবার বৃষ্টির শব্দেই ঘুম ভাঙে এক নম্বর কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনের, ভোরবেলায়। রসুইপাড়ার মাঠ থেকে বিসর্জনের ঢাক একভাবে বেজে চলে। তবে, বিসর্জনের বিষাদ যে শুধু ওই মাঠে রয়েছে, তা তো নয়। তা ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। ফেলে রাখা মগ, স্টিলের পাত্র, বহু শিরা বেরিয়ে আসা হাতের কবজিতে বাধা ডোর, পুরনো জানলার পাশের দেওয়ালটা দিয়ে আকাশের দিকে লক্ষ করে মাকড়সার এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেও রয়েছে সেই বিষাদ। তার মধ্যেই গণেশ ওর একটা ভয়ের কথা জানায় রহমতকে।দু'দিন আগে কাগজে সে একটা ছবি দেখেছিল। নদিয়ার বাইশ বছরের ছেলে আত্মহত্যা করেছে। বাড়ির লোক কাগজে চিঠি ছাপিয়ে শ্রাদ্ধে অতিথিদের আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ছেলেটা চশমা পরা। সেই চশমাটা আবার গণেশের মতো।
- ‘কিছু বুঝতে পারলেন আপনি?’ সেই চিঠির বিবরণ দিয়ে রহমতের কাছ থেকে কিছু একটা শুনতে চায় গণেশ।
- না। তেমন কিছু বুঝলাম না। তোমার কি ভয় হচ্ছে চশমাটা তোমার মতো বলে? কিন্তু, ওই ছেলেটি কীভাবে বিছানায় পাশ ফিরতো, তা তো তুমি জানো না। গভীর ঘুমে বালিশকে লালায় ভিজিয়ে দিতো কি না, সেটা জানো? বারবার তোমার মতো লোককে মামাবাড়ি নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েও নিয়ে যেত না কি না- সেইসবও তো জানো না বোধহয়! এই ছেলেটা তো তুমি নও! তাহলে চশমা নিয়ে এত ভাবছ কেন?
- খিস্তি দেবেন না! ভুলে যাবেন না এই গলিতে রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত থাকতেন!
- তাতে আমার কী করার আছে? ডানা নিয়ে আয়ামাসি চলে গেছে। নইলে হুমকি দিতাম, ভয় দেখালে উড়ে যাব!
- যাক গে, আসলে, ছেলেটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও যখন-তখন হেসে ফেলবে। হাসলে বোধহয় আমার মতোই দেখাবে ওকে।
- ধুর! মৃত মানুষের হাসির কোনও গুরুত্ব নেই! মরে গেলে আবার মানুষ হাসবে কি?
- আমি আজ আপনাকে আপনার প্রিয় মাখা সন্দেশ খাওয়াব, রহমত। আপনি আমায় বাঁচালেন!
কথাটা বলে জ্বর গায়ে গণেশ অনেকটা বাতাস ছেড়ে দেয় শরীরের সমস্ত রন্ধ্র থেকে। শূন্য দৃষ্টি রাখে রহমতের খাঁচার ওপরের আকাশে। পুরোপুরি শূন্যও অবশ্য নয় সেই দৃষ্টি। একটু ভুল হল। কয়েকটা এক, দুই, তিন, চারও লেখা তাতে।
৪
আলো যত কমে, জল তত বাড়ে। তত ঘন হয় বৃষ্টি। সন্ধে ঘন হয়ে গেলে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসেন রহমত চক্রবর্তী। আয়ামাসি তাঁর ডানা কেটে নিয়ে চলে যাওয়ার পর তিনি আর উড়তে পারেন না। তবে, হাঁটাচলায় অসুবিধা হয় না। আয়ামাসির কথা মনে পড়তে মনটা একটু ধরে আসে রহমতের। তাঁর মাথার কয়েকতলা উপর দিয়ে বহু পুরনো কথা একে একে ভেসে যায়। এই বাড়িতে বহু বছর আগে উড়ে আসার পর আয়ামাসির কাছেই থাকতেন তিনি। মানুষের মতোই যে আলো বাতাসেরও নিজস্ব ভাষা রয়েছে, তা রহমত শিখিয়েছিলেন আয়ামাসিকে। এই বাড়ির দেওয়ালে তখন পেরেক দিয়ে পটচিত্র গাঁথা থাকতো। আয়ামাসি কোনও খুনোখুনির মধ্যেই ছিল না। তেমন মানুষও নয় সে। সৃষ্টির মায়াবী ঘোর চোখে নিয়ে রহমতের ডানায় হাত বুলিয়ে দিতো। কিন্তু, রহমতকে না বলেই রহমতের ডানাটা কেটে নিয়ে কেন চলে গেল আয়ামাসি, তা জনাব ম্যাকাও চক্রবর্তী কিছুতেই বুঝতে পারেন না। আয়ামাসি কোথায় চলে গেল তাঁর ডানাগুলো নিয়ে, সেই ব্যাপারেও অন্ধকারেই রয়ে গেলেন রহমত। একবার তো বলে যেতে পারতো? একবার কি জানিয়ে যেতে পারতো না? রহমত তো বাধা দিতেন না। বড়জোর হয়তো বলতেন, শেষবারের মতো শীতলা পুকুরের বেদিটার কাছে একবার যাব দুজনে। যে জায়গাটায় গেলে শরীরে আগুন লেগে যায়, পূর্ণিমা থাকলে আকাশ থেকে সরু আলোর ফিতে এসে একেবারে টুঁটি কামড়ে ধরে। যে শাঁখামুঠিটা ঘুরে বেড়ায় ওই ঝোপঝাড়ে, তাকেও না হয় ডেকে আনব। আমাজনের জঙ্গলের সবটুক গান রেখে দেবো তোমার স্তনবৃন্তে। পৃথিবীর সবথেকে আশ্চর্য ধুলোপ্রিন্ট পরিয়ে দেবো তোমার খোঁপায়। চলে যাবে যখন, সুন্দরভাবে যাও। ডানার পচা রক্ত শাড়িতে লাগিয়ে যাবে কেন! এত জরা নিয়ে যাবে কেন? চলে যাওয়াও তো শেষমেশ একটু জীবনের প্রত্যাশাই করে।
রহমতের তারপর মনে হয়, যাওয়ার আগে অত সুন্দর কোমর পর্যন্ত চুল কি বেঁধে নিয়েছিল আয়ামাসি? রহমত বারবার বলতেন, বেঁধো না।
রহমত চক্রবর্তীর খাঁচায় গুটিশুটি মেরে ঢুকে পড়ে গণেশ। এক নম্বর কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনের প্রাচীন বারান্দা পেরিয়ে গলিটায় নামেন আমাজনের জঙ্গল থেকে উড়ে আসা বৃদ্ধ অধিবাসী। বিসর্জনের ঢাক বাজে। কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনের সমস্ত বাসিন্দা ছুটে চলেছে সেই বাজনার দিকে। তারা কেউ দেখল না, কত ধীরে দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি আর পাঁচিলে মেলে দেওয়া পুরনো শাড়িটির মধ্যে আট ফুটের ব্যবধান পেরিয়ে গেল দেড় হাত সাইজের ম্যাকাও।
রহমত জানেন, গণেশ সবাইকেই একদিন তার মামাবাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, আসলে কোনওদিনই নিয়ে যেতে পারবে না। একশিঙে অহঙ্কারী বুনো মোষের মত এই কথাটা সে স্বীকারও করতে পারবে না যে, মামাবাড়ি বলে তার কখনও কিছু ছিলই না। ‘একদিন মামাবাড়ি নিয়ে যাব’ কথাটা সবাইকে বলে সে কেবল অলৌকিক তৃপ্তি পায় মাত্র।
পাঁচিলটার সামনে দাঁড়ান রহমত। পাঁচিলে মেলা এই শাড়িটা অনেকদিন ধরে দেখেছেন তিনি। শাড়িটার আঁচলের কাছে প্রায় চোখেই পড়ে না, এমন একটু দাগ রয়েছে। ছোপ রয়েছে। আয়ামাসি তাঁর ডানা কেটে নিয়ে যাওয়ার পর রহমত কেবল নীল ছাড়া অন্য রং দেখতে পান না। এই শাড়িটা আয়ামাসির, তা জানেন রহমত। কিন্তু, শাড়ির গায়ে লেগে থাকা দাগটা কি রক্তের? রক্তের দাগটা কি তাঁর? পাঁচিলের গায়ের এই মলিন শাড়িটার গায়ে লেগে থাকা ছোপটির আসল রং কী, তা জানার জন্য মনটা আকুল হয় রহমতের। কিন্তু, জিজ্ঞাসা করার মতো কাউকে পান না।
‘ভাসান হয়ে গেল গো’ বলে জ্বরের ঘোরেই যেন কার উদ্দেশে খাঁচার ভিতর থেকে আচমকা চিল্লে ওঠে রেলের গার্ড দিবাকরের ছেলে গণেশ।
বৃষ্টি, ধূ ধূ মাঠ, ভাঙা ঘরবাড়ি এফোঁড়-ওফোঁড় করে শেষবারের মতো পৃথিবীর কিনারা ধরে মিলিয়ে যাচ্ছে বিসর্জনের ঢাকের শব্দ।
বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে থাকে চরাচর। বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে থাকে কৃষ্ণ চ্যাটার্জি লেনের সব একা হয়ে যাওয়া গলি। পৃথিবী জুড়ে জলে কলসি ডোবানোর গুবগুব শব্দ শুরু হয়। তার মধ্যে দাঁড়িয়েই ‘কে তুমি, কে তুমি, আমায় ডাকো’ সুর করে গাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন রহমত। বেসুরো শোনায়। তবু তাঁর মনে হয়, বিচারকরা তাঁকে কিছুতেই মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেবে না।
0 মন্তব্যসমূহ