দিলারা মেসবাহ-এর গল্প: এক জোড়া পয়মন্ত ইলিশ



চশমাটা বিগড়েছে। মানে চোখজোড়ার পাওয়ার বিগড়েছে। নাকি কোন যমব্যাধি আছর করল! বাইফোকাল চশমার কাচ মিহি কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ধুত্তোরি ছাই, বলে জানালার কাচ দুহাতে ঠেলে সরাল মাহফুজা।আষাঢ়ের মেঘ। আকাশ জুড়ে মেলা বসিয়েছো। মচ্ছব আর কি। মেঘে মেঘে ঠাঁসবুনুনি। বিপুল সূর্য ঢেকে রইল পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের দৌরাত্ম্যে। অন্ধকার– বাপরে কী নিকষ আন্ধকার! আজও আকাশের মেজাজশরীফ সপ্তমে চড়ে থাকল? কুচকুচে পাথর-আকাশ।
 
তিনটি সন্তান নিয়ে সংসারের হাল ধরেছিল একা মাহফুজা। একাই! তবু বিনীত সাহস আর অবুঝ স্বপ্নগুলো একেবারে বিসর্জন দিতে পারে নাই। বছর পনের তো কেটেই গেল। অকাল বৈধব্য! … স্মৃতির মিছির পথ ছাড়ে না!...
 
ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি। পলাশ কৃষ্ণচূড়ার দিন মাহফুজার ছোট্ট ব্যালকনিতে ফুটেছে নয়নতারা, সন্ধ্যামণি। শুক্রুবারের ভর দুপুরবেলা। আউসের লাল চালের লাসা লাসা খিচুড়ি, ইলিশ সরষে। মোতাহের তরফদার কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছিলেন। স্ত্রীর রান্নার গালভরা প্রশংসা করার অভ্যেস নেই তাঁর। এক একেক জনের আজব স্বভাব! তবে মাহফুজা স্বামীর গোলগাল মুখখানা দেখে বুঝে গিয়েছিল পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করলেন তিনি। হয়তো খানিক বাদে একটা ঢেঁকুর উঠবে।…
 
পল্লী বিদ্যৎএর মাঝারি মানের কর্মকর্তাটি ইলিশের পাঁড় ভক্ত। মওকা পেলেই কাওরান বাজার মোহাম্মদপুর কৃষি বাজার, হাতিরপুল কাঁচা বাজার, কচুক্ষেত বাজার ইত্যাদি পরিভ্রমণ করে সুলক্ষণ, সুদর্শন, রূপালী ইলিশ ক্রয় করতেন তরফদার।
 
জিগাতলার ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িটার রসুই রান্নার ঘ্রাণে ম’ ম’ করত। একান্ত উৎসবের আয়োজনে প্রাণময় মাহফুজার ভুবন। তখন তার শ্যামলা তিরতিরে শরীর ছটফটে বর্ণিল প্রজাপতি। তখন অপু, নিপু, দীপু, কৈশোরের দ্বারপ্রাপ্তে।…
 
ঘনমেঘের বালাপোষ জড়ানো কালচে আকাশটার দিকে অসহায় দুচোখ মেলে চেয়ে থাকে মাহফুজা। বিষণ্ন মুখটা স্মৃতিময় ছাপচিত্রে ভরে ওঠে। আহা সেইসব দিনগুলো। সোনার খাঁচা, মণিমুক্তার খাঁচা কিছুতেই বাঁধা পড়ে না। পড়ে না।
 
‘ইলশা জব্বর মাছ দুইডা! মাখখন। শনপাপড়ি। পাইচি মাহফুজা। যেমন ওজন, তেমন সুরতখান। মনপছন্দ। মাছুয়া ব্যাডা দাম হাঁকলাটশ টাকা। কুচ পরোয়া নেহি। মন চাইল - মন কান্দাইতে পারি, বলো? জীবন তো একটাই। আর মনডা মহামূল্য ধন। টাক্কু মাছুয়া ব্যাডা ডালায় ইলশা সাজায়া রাখছে– না জানি মণি মুক্তার জড়োয়া গয়না খান। কী দেমাগ। টেরা চোউখে কাস্টমার দেহে। কথা একখান। এক দর। নিলে লইয়া যান, বিবি খুশি হইব। না নিলে ফোটেন।’ মানসম্মান নিয়া টানাটানি। নিয়া নিলাম চক্ষু মুইদা। কচু কাশও নিলাম। বটল গিরিন কালার। মাথা, ল্যানজা দিয়া বনবো ভালো। আজকা করবা পাতুরি। লাউ পাতায় জড়ায়া, সরষা, কাঁচা মরিচ বাটা মাখায়া। তোমার হাতে এই জিনিস ভালোই হয়।’
 
সদাইয়ের ঢাউস ব্যাগ ঢেলে দেয় মাহফুজা।
 
‘এত্ত মুখি কচু আনছো, ক্যারে?’ তরফদার ধুলোময়লা মাখা বাটার স্যান্ডেল যথাস্হানে খুলে রাখতে রাখতে এগিয়ে আসে। ‘ আরে মুখি কচু দিয়া ইলশার পেটি রানবা একদিন। উমদা চিজ।’ মাহফুজা ততক্ষণে তৎপর ইলিশ বরণে।
 
রূপা চকচকা ইলিশ চেয়ে আছে। কালচে পুঁতির মতো জোড়া চোখ। চারপাশে লালচে রঙের ছিটা। ওগুলো কী ওর অশ্রুজল? ইলিশের আঁশটে গন্ধ্যের মধ্যে কেমন একরকম মাদকতা।
 
লতুর মা রূপবান ঠিকে কাজ করে। লতু থাকে বাঁধা। সবে ডাগর হয়ে উঠেছে। ছোটমেয়ে দীপুর সমবয়সী। কাসার পদ্মপাতা খোদাই করা মায়ের হাতের থালা বের করে মাহফুজা। সুদর্শন মৎসের যথোপযুক্ত আসন। এমন রূপবান মৎস অসম্মান করা যায় না।
 
লাতুর মা কাপড় ধুইয়ো খানিক বাদে। অহন ইলশার ভাও করো। বটিটা পুতার লগে ধার দিয়া লও। পেটি আর গাদা এক লগে ফালি করবা। ত্যাড়াব্যাকা হওন যাবো না। বহুত মজার মাচ গো।’ মাহফুজা মাছ দুইডার শরীর স্পর্শ করে আনমনু ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু খায়। ততক্ষণে রূপবান উপুড় হয়ে পুতার সাথে বটি ধার দিতে শুরু করেছে। তার মনে খুশির বুড়বুড়ি। আজ লাতুর পাতে, নিজের পাতে ইলশার টুকরা কচুর ঘন্ট পড়বেই পড়বে। গরিবের রেজেকের মালিক মাবুদ আল্লা।
 
খানা টেবিল জুড়ে মেঘনার ঢেউ, ছলাৎ ছলাৎ। বাটি ভরা ইলিশের অকৃপণ ব্যঞ্জন। তরফদার আজ জমিদারের জমিদার। খানেওয়ালারা জানে জীবনের অমূল্য স্বাদ রসনার সাধনায়।
 
অপু, নিপু, দীপু। পিঠাপিঠি ভাইবোন। কোল মোছা সন্তান দীপু খানিক ভীতু, নরম স্বভাবের। চড়ুই পাখির মতো ইলিশের কাঁটা বাছে। খুটে খুটে লোকমা বানায়। অপু, নিপু ইলিশের কাঁটা বাছতে বেশ চৌকস হয়ে উঠেছে। মাহফুজার নজর দীপুর দিকে, ‘এই যে মা হরিণের মাংস, কালা কালা মাখন। খা, আমি কাঁটা বাইছা দেই।
 
অপু, নিপু আড়চোখে তাকায়। দীপুর জন্যে মায়ের যত দরদ। অথচ ও অংকে তেত্রিশের বেশি পায় না। স্যারেরা দয়া করে দুই তিন নম্বর যোগ করে পাস করায়ে দেন। আর ওরা দুইজন প্রতিবছর লেটার মার্কস। নিপুও ঈর্ষাকাতর। মায়ের এরকম পারসিয়ালটি সহ্য হয় না। মুখে তুলে দিলে খেতে তো পারে ঘাউরা মাছের মতো, কৎ কৎ করে।
 
অপু অনাবশ্যক ঘ্যান ঘ্যান করে, ‘আমাকে হরিণের মাংস দাও মা।’
 
ইতোমধ্যে ভোজনরসিক তরফদার তার একধাপ উপরের কর্মকর্তা নিজামউদ্দিনের ফ্যামিলিকে নিমন্ত্রণ করে রেখেছে। টাটকা খাওয়াবে। রাতে আসবে ওরা। সরষে ইলিশ, কালাজিরা চাল, মুগ ডালে মাখামাখা খিচুড়ি। শেষ পাতে দই মন্ডা তো থাকবেই। আর অতিথি যদি হাতে করে মিষ্টান্ন নিয়ে আসে, তাও।
 
গতবছর নিজাম ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত করেছিল তার গিন্নী। স্মোকড ইলশা, রোস্ট ইত্যাদি। কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার দিয়ে আনা। চেহারা আর ঘ্রাণে তরফদার বোঝে কোনটা বাবুর্চির হাতের, আর কোনটা ঘরের রাঁধুনীর ঘামের দামে সুপক্ক। ইলিশের আইটেম খানিক পাতে নিয়েছিল তরফদার। জিভে ঠেকাতেই রসভঙ্গ। ছাতানাতা কী সব রাঁধে নিশিভাবী। সংসারে আছিও, নেইও জাতের মহিলা। মাহফুজার মতো নয়। যেদিন বাড়িতে গেস্ট ডাকেন, সেদিন পয়লা পরথম পারলারে যায়, তারপর রান্না-বান্নার খবরদারি। সারাক্ষণ ব্যস্ত শাড়ির আঁচল সামলাতে, আর বয়কাট চুলগুলোকে অকারণ শাসন করতে।
 
ইলিশ বড় অমূল্য মৎস্য। মমতাভরা কৌশলী হাতে এই মাছ কড়াইয়ে দিতে হয়। এমনই মৎস্য অন্য মাছের মতো লবণ, লেবু কচলে ধোয়াও চলে না। খুব বেশি কারিশমায়ও ইলিশ ব্যাজার। ড্রইংরুম বিহারিণীরা এসব কানুন জানেই না। এক চামচ ভালোবাসা ইলিশ রন্ধনে অত্যাবশ্যক।
 
এই তো যেন সেদিনের কথা। কত দুপুর, রাত। ইলিশের আতর সুগন্ধে ২/১ জলসিঁড়ির ফ্ল্যাট ভেসে গেছে। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে জানালার ফোকর গলিয়ে।… তখনও পুরনো এই চারতলার ফ্ল্যাটের আশপাশে আকাশ ছোঁয়া এত হাইরাইজ দালানকোঠা ওঠেনি। দক্ষিণে একটা জারুল গাছ ছিল। মৌসুমে ফুলে ফুলে ছেয়ে যেত। এমনকি পূবের কোণায় একটা কদম গাছও ছিল। শঙ্কিত শহরের দূষিত বাতাসে মলিন হয়ে যেতবটো। কিন্তু বর্ষা এলে পত্রপল্লবে, ফুলে নবযৌবনা। কোন রাতে ইলিশের ঘ্রাণের সঙ্গে হাস্নাহেনার চকিত সুবাস মিলেমিশে একাকার। কী দিন ছিল রে মাবুদ!... মাহফুজা এখন দুহাতে ঠেলে দিতে চায় যাবতীয় স্মৃতি- সেই মানুষটাকে। স্মৃতিজলে আর কাঁহাতক ডুবে থাকা যায়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম।…
 
চশমার কাচ আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বসার ঘরে এসে বসে মাহফুজা। লতুর বিয়ে দিয়েছে। লতুর মা বুড়ি হয়ে গেছে। প্রাণশক্তি প্রায় তলানিতে। তবুও পেটের দায়ে কাজ ছাড়েনি।
 
দীপু আছে মায়ের সঙ্গে। জীবিকার তাড়নায় দৌড়াচ্ছে শান্ত মেয়েটা। অপু, নিপু কবেই বিদেশের মাটিতে সংসার পেতেছে। স্কাইপে মায়ের সঙ্গে বায়বীয় সাক্ষাৎ হয়।
 
বছর পনেরো কেটে গেল। অদ্ভুত, এখনও স্বচ্ছ জলছবি। নুন হলুদে মরিচের গুঁড়ায় রাঙানো ইলিশ ভাজা হচ্ছে। চনমনে ঘ্রাণ বাতাসে। ফ্রাইপ্যান থেকে তুলেই চালান হচ্ছে টেবিলে। চুচড়া মাছের চচ্চড়ি। কলিগ জাফর এমন মধুর আপ্যায়নে আপ্লুত।
 
‘তরফদার ভাই আপনি ইলিশ চেনেন বটে। জহুরী চোখ যাকে বলে। মায়ানমার থেকে ইইশের মতো দেখতে এক পদের মাছ আসে। মাছুয়ারা চিল্লায়, লইয়া যান, পদ্মা ইলিশ। বরফের বাসি ইলিশেরও স্বাদ নাই। ঘাস ঘাস, স্পঞ্জের টুকরা যেন। ডিম ভরা ইলিশ কিনলেও ঠকা। পোয়াতি ইলিশের স্বাদ কম। নোনা পানির মা-ইলিশ ডিম ছাড়তে আসে মিঠা পানির আঁতুরঘরে। যেমন নাইওরে আসে মেয়েরা বাপের বাড়ি। মা-ইলিশ ধরে বজ্জাতরা, জাইল্লা আর দাদনখোরের দল। শত পাহারা, কড়াকড়ির চোখে ধূলা দিয়ে।

আফসোস।’
 
‘আফসোস আমার বহুদিনের। তবে ইলিশ কিনে কখনও ফুলিশ হইনি। দাদার বাড়ি চাঁদপুর, মঠবাড়ি। সেই শিশুকাল বাপের কেনি আঙুল ধইরা মেঘনা ঘাটে যাইতাম। কত যে বায়াস্কোপ দেখতাম ভাই। ডালা ভরা শয়ে শয়ে ইলশা। লাফান্ন্যা ইলশাও দেখছি। রোইদ পইড়্যা চিক চিক করত। খুব ডেলিকেট চিজ। ডাঙ্গায় তোলার কয়েক মিনিটের মইধ্যে পরলোক গমন করে। পদ্মার ইলিশ চিনি। ঐ মাছের স্বাদের তুলনা হয়না। খাটো চকচকা। গর্দান মোটা গোলগাল। নানিমা পদ্মাপাড়ের মানুষ। ইলিশের পাঁচ ছয় কিসিমের পদ করত। কী স্বাদ রে ভাই। ইলশার তৈল হাতে জড়ায়া থাকত। আঙুল শুঁকলে বোঝা যাইত ইলশা দিয়া ভাত খাইছে। নোনা ইলশাও খাইছি। তবে ঐডা আমার ফেভারিট না। আহারে জাটকা, মা-ইলিশ যদি কয়টা দিন অভয়াশ্রমে দিন কাটাইত তাইলে বাঙালির পাকঘরগুলায় উৎসব হইত, উৎসব। নাপিত জাইল্যা কামার কুমার সগ্গলে- ইলশা দিয়া ভাত খাইত। মাঘ, ফাল্গুন, বৈশাখে ইলিশের ছানাপোনারা চাঁদপুরের মোহনপুর,, হাজিমারায় শিশুকাল কাটাই। এদিকে পটুয়াখালির আন্ধারমানিক,

সোনাতলি এসব জলসীমানায় কড়া পাহারা থাকে। বিশেষ সময়গুলায় আন্ধারমানিক, লতা-চাপলি নদীর পানি আর ইলশা সমান সমান হয়্যা যায়। জালে আটকা পড়া ইলশা ওজনে জাইল্যারাও কুপোকাত। এক একখান মাছ ধরা ট্রলার দশ থেইকা পনেরো মণ ইলশা ধরে। আহা মা-ইলশার কান্দন হেরা শোনে না। জাউল্যাগুলা বজ্জাত দাদনখোরগো মদদ পাইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে। ধরা খাইলে জেল হাজত। তাও সই! মা-নু-ষ।’...
 
কোন কোনদিন মাহফুজা বিড়বিড় করে, ‘খাইতে বইয়া লেকচার ছাড়তাছেন।’ জলসিঁড়ি ফ্ল্যাটবাড়িটার ২/১ নম্বর ফ্ল্যাট আজকাল ইলিশ রান্নার সুঘ্রাণে চনমন করে না। দীপু আর মাহফুজা, দুটি প্রাণী। দীপু ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটছে। সোজা সরল মেয়েটি যেন থই পাচ্ছে না। ওর জন্য দুশ্চিন্তা মায়ের। বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই।
 
দিনকয় আগে মাহফুজা জানল শিহাব নামের দীপুর এক কলিগ ওকে পছন্দ করে। দীপুর শ্যামলা করুণ মুখটি আজকাল প্রাণময় মনে হয়। এরই মধ্যে একদিন চায়ের নিমন্ত্রণে এসেছিল ছেলেটি। লম্বা, ছিপছিপে সরল্যমাখা মুখখানি। ওদের বাড়িও চাঁদপুর। কথায় কথায় ইলিশ প্রসঙ্গ এসেই পড়ল। শিহাবের সবচেয়ে পছন্দের মাছ ইলিশ। দীপু বেফাঁস বলে ফেলেছে তার মায়ের হাতের ইলিশ রান্না চমৎকার। বাবাও ছিলেন ইলিশ পাগল।
 
আজ আষাঢ়ের ঘোর অন্ধকার। আজ রাতেই ওরা অর্থাৎ শিহাব, ওর বাবা-মা, বোন আসবে। আংটি পরাতে। পাকা কথা হবে। চাপা স্বভাবের দীপু লাজুক হেসে বলেছিল, ‘ওরা ইলিশ ভালোবাসে। ওটা রেখো কিন্তু মা।’
 
ইলিশ, ইলিশ। মাথার জবুথবু মগজগুলো আর ভার নিতে পারছে না। কতদিন। ক ত দিন এ রসুইঘরে ইলিশ নিয়ে মেতে ওঠে না মাহফুজা। মাসকাবারি খরচার বহর লম্বা হচ্ছে দিনকে দিন। ওষুধ, ডাক্তার, আনাজপাতি, মাছ, মুরগি, যাবতীয় বিল, সার্ভিস চার্জ সামলানো দায়। তরফদারের সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই ছিল না। মাথার উপর ছাদটুকু আছে এইটুকুই শুকরিয়া। দীপু মাইনের মোটা অংশ মাকে দেয়। মাইনেই বা মেয়েটার কত!
 
গতরাতে শিহাবের মা ফোনে জানালেন আজ রাতে তারা আসবে। পাকা কথা বলতে। শুনে মাহফুজার বুকে ধড়ফড় শুরু হয়েছিল। স্বামীর বন্ধু স্বজন কেউতো আর ধারে কাছে ভেড়ে না। মাহফুজারই বা কে আছে বন্ধু, স্বজন?
 
ইলিশ মাছ নিয়ে যত ফ্যাকড়া। সকাল থেকে মুখ কালো আকাশটার।
 
মাঠপাড়ের ‘মোল্লা স্টোর’ এর মধূ মিয়া বেশ মানুষ। মুদি দোকানি মনু মিয়া কত বছর ধরে নগদে, ধারে কত সদাইপাতি জোগান দিয়েছে জলসিঁড়িতে। শুকনা মরিচ থেকে সোডা সাবান মুড়ি, এনার্জি বিস্কুট। লাতুর মা কত শত বার পা ফেলেছে মোল্লা স্টোরের রাস্তা ধরে। ঈমানদার দোকানি। মাপে পাক্কা। আজ মনু মিয়ার মোবাইলে ফোন দিল নিরুপায় মাহফুজা, ‘মনু মিয়া আমারে একজোড়া ইলিশ আইন্যা দিতে হইবো। বুজলা মিয়া তুমিই ভরসা। সব বিষয় পরে জানাবো। জরুরি।’ মনু মিয়া অবাকের অবাক, ‘কি কন খালাম্মা কেবলই দোকানের ঝাঁপ খুলছি। দুইডা কাস্টমার ছাতি মুড়ি দিয়া খাড়া। এ বেলা তো বাইর হওনই যাইব না। আসমানের অবস্হাডা দেখছেন তো। রাইত নয়ডা দশডায় দোকান বন করবো। খালাম্মা মনে কোনু কষ্ট নিয়েন না।’ মাহফুজা থম মেরে যান। মনু মিয়া আজ এমন উত্তর দিল। দিবই হাত্তি গত্তে পড়ছে যে। ব্যবসা ছাইড়া কাঁচাবাজারে ইলশা খুঁজবই বা কেমনে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অস্হিরতা বাড়ে মাহফুজার। চশমার কাচ আবারও ঝাপসা হয়ে গেছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে কাচ মুছতে মুছতে বসে পড়ে বিছানায়। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।
 
মোবাইলের লাল বোতামে টিপ দিয়ে মনু মিয়া হা হা করে হাসে খানিক। ‘ খালার কী হইছে! পাগলের কতাই না কইলেন।’ কাস্টমারকে মসুর ডাল বনরুটি দিতে দিতে স্বগতোক্তি করে মনু মিয়া। জামালউদ্দিন গলা বাড়িয়ে বলে, ‘ঘটনা কি মনু ভাই?’ দোকানি যবনিকা টানে, ‘আরে কিছু না। আবোল তাবোল।’ আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে জামালউদ্দিন জলদি হাঁটা দেয়।
 
দীপুর বিয়ের পাকা পয়গাম নিয়ে আসছে সম্মানী পাত্রপক্ষ। রুই মাছ, গলদা চিংড়ি, চিনিগুঁড়া চাল মজুদ আছে। লতুর মাকে দিয়ে আড়াইশ গ্রাম বাঘাবাড়ির ঘি আনিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু ইলিশ! মেয়েটার কপালই ফাটা! মনটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। শিহাব বাবাজীর পছন্দের মাছ বলে কথা। মাহফুজা জানে নাজু খালার মেয়ে নুসরাতের পানচিনিতে পায়েসে নুন দেয়া হয়েছিল বলে বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। খানদান মরুব্বিদের জোর আপত্তির মুখে। নূরী ফুপুর বড় জামাই পোলাওয়ের উপর বেরেস্তা বিছানো ছিল না বলে

বৌয়ের চৌদ্দগুষ্টির ইজ্জত ধুয়ে দিয়েছিল। জামাই আদর জানে না, কালচার তো নাইই। এরপর জামাতা তিনবছর শ্বশুর বাড়িতে পদধূলি দেয় নাই।
 
গতকাল সারাটা দিন ছিল ধুম বৃষ্টি। আজও সকাল থেকেই আকাশের মুখ নিকষ কালো। মাহফুজার মাথাটা টনটন করছে। অস্বস্তিকর চাপা ব্যথা।
 
রবোটের মতো দরজা খুলে পাশের ফ্ল্যাটের পুরনো প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটের কলিংবেলে তর্জনী ঠেকিয়ে মৃদু চাপ দিলো মাহফুজা। মাথাটা আবার ঘুরে উঠল। দেওয়াল ধরে নিজেকে সামাল দিলো ও। দরজা খুলল মিঠুর মা তনু ভাবী। তার চোখ মুখে তেমন ভাবান্তর নেই যেন। নাকি তার মুখছবি এরকমই হবার কথা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা সারল মাহফুজা। মিন মিন করে বলল, ভাবী আপনার ড্রাইভার আসবে না? মুহূর্তে কেমন কলকলিয়ে উঠল মহিলা, ‘আর বলবেন না তার কানে নাকি ফোঁড়া উঠেছে। কোকাচ্ছে। ছুটি দিয়ে দেব।’
 
মাহফুজা আর এক দফা বোকা বনে যায়। প্রতিবেশীর স্বভাব তার কিছুটা জানা আছে। ব্যথা আদতে তেমন তীব্র নয়, আর মিঠুর মা দুটো নাপা খাইয়ে দিনভর ডিউটি করাতে পারবে। ভেবেছিল ড্রাইভারকে দিয়ে যদি ইলিশ আনাতে পারা যায়। সে গুড়ে বালি। অথচ এদের বিপদে আপদে আনন্দে মাহফুজা সাধ্যমত শরিক হয়েছে।অপমানে মনটা একদম চুপসে গেল।
 
এবার দীপুর অফিসে ফোন করে মাহফুজা। দীপু ব্যস্ত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ মা বলো।’ এপার থেকে মা কোন ভনিতা না করেই বলে, ‘ না বলছিলাম কি ইলশার জোগাড় তো হইল না রে মা। কোন পিয়ন টিয়ন দিয়া কি একজোড়া ইলশা–’ দীপু বেশ টনটন গলায় বলে ওঠে, ‘আহ্ মা কি যে বলো না। এটা অফিস মা। যা ইচ্ছা তাই করা যায় না। রাখছি এখন। পরে কথা বলবো।’
 
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। আজ যদি সেই মানুষটা বেঁচে থাকত। তাইলে পদ্মা মেঘনা ছেঁচে ইলিশ আনতো টাটকা জোড়ায় জোড়ায়। আদুরে কন্যার সুখের জন্যে। বার বার ইলিশের শোক তাকে অস্হির করে তুলছে। পায়েসে লবণ দেয়ার দুর্নামে নাজু খালার অমন সুন্দর লেখাপড়া জানা মেয়েটার বিয়ে ভেঙ্গে গেছিল। শিউরে শিউরে ওঠে মাহফুজা।
 
আচমকা লাগাতার কলিংবেল। ক্যার-ক্যার-ক্যার আওয়াজটা এত বিশ্রী। কানে খুব লাগে। দীপুকে কতদিন বলেছে মাহফুজা, ‘একটা টুং টাং আওয়াজের বেল আনিস তো মা। পুরোনটা ক্যার ক্যার করে।’ মেয়েটা সময় পায় না।
 
মাহফুজা দরজা খোলে। বিপদের উপর বিপদ। কসিরউদ্দিন পাটোয়ারী। আজই তার আসা লাগবে! লোকটা দূর সম্পর্কের দেওর। লোকটা বেহুদা প্যাচাল পারে। কথা বলার সময় মুখ দিয়ে থুতু ছিটায়। হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে সুরুৎ সুরুৎ আওয়াজ করে চা খায়। আগে প্রায় আসত, হাঁপানি চিকিৎসা করাতে। এই ফ্ল্যাটেই থেকে যেত হপ্তাখানেক। তরফদারের বাল্যবন্ধুও সে। মানুষটা মাহফুজার অপছন্দের।
 
‘ভাবীসাব ভাইজানরে হপনে দেখছি। দুই রাইত। হেয় যেন কি কইতাছে। মোনে হইলো ইলশার কতা কইতাছে। ম্যাগনা গাট থেইক্যা কিন্যা লঞ্চে উঠছি। এই সদরগাট নামছি।’ বলতে বলতে দুটো চকচকে সুদর্শন ইলিশ তুলে ধরে। কানকো ফুটা করে সুতলিতে গাঁথা। লেজজোড়া ওসমানীর সফেদ গোঁফের মতো জ্বলজ্বল করছে। মাহফুজা অপলক চেয়ে থাকে।
 
আচমকা খানিক উবু হয়ে যায় মাহফুজা। মনে হয় কসিরউদ্দিনকে কদমবুসি করার নিয়তে উদ্যত তার দুটি শ্যামলা করুণ হাত।





লেখক পরিচিতি:
দিলারা মেসবাহ
কথাসাহিত্যিক
ঢাকায় থাকেন



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ