১.
সুজন মিয়ার সন্তানভাগ্য খারাপ, কথাটা বাদাঘাটের বয়স্ক কিছু লোক বলেন। জমি জিরাত আছে, বাজারে একটা মনিহারি দোকানও আছে, স্ত্রীর স্বাস্থ্যও ভাল, কিন্তু একটা মাত্র ছেলে। সুজন মিয়া এজন্য বুড়োদের, এমনকি তার বয়সীদের, এড়িয়ে চলেন। বাজারের বিকিকিনি শেষে সন্ধ্যার আলো জ্বললে তিনি হিসাবের খাতা বন্ধ করেন। তারপর আলতাফ মাস্টার আর রাজু কবিরাজের সঙ্গে চা খেতে খেতে গালগল্প করেন। এ দু’জন বয়সে কম, যদিও একজন মাস্টারি করেন, অন্যজন রোগি দেখে দেখে একটা ভারিক্কি ভাব এনেছেন চেহারায়। কিন্তু এখানে এলে তারা প্রচুর হাসেন। দুনিয়ার খবর শোনান, চুটকি বলেন, আষাঢ় এলে আষাঢ়ে-গল্প ফাঁদেন, সুজন মিয়া সেসব গল্প শুনে বলেন, ও মিয়ারা, আজগুবিরও একটা সীমা আছে। তার যা ভাল লাগে, এ দু’জন মানুষ তার সন্তানভাগ্য নিয়ে কোনো কথা বলেন না। রতনকে নিয়ে বরং উদ্বেগ দেখান। সুজন মিয়ার স্ত্রী কমলা বানু রতনকে মাথায় তুলে রেখেছেন, আহ্লাদে আদরে ভাসিয়েছেন। আলতাফের দু:খ, ছেলেটা পড়াশোনা করল না। রাজু বলেন, ছেলেটা গায়ে মাথায় উঁচু , দেখতেও ভাল, পড়াশোনাটা ঠিকমত করলে সে তো অফিসার হতে পারত।
সুজন মিয়া লম্বা শ্বাস ছাড়েন। তার মনে দু:খ। স্ত্রীকে তিনি ভালবাসেন, কোনোদিন তাকে কটু কথা বলেননি। কিন্তু একদিন দু:খ করে বললেন, ছেলেটাকে তুমি শেষ করে দিলে বানু। এখন কি হবে?
কমলা বানু প্রবল প্রতিবাদ জানালেন। কে বলেছে আমার রতন শেষ হয়ে গেছে? ভাল পাশ না দেয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া?
সুজন হাসলেন। ভাল পাশ কেন, ছোটখাটো পাশও তো দিতে পারল না। স্কুলটা শেষ করল?
মায়ের আস্কারা পেলেও বাবা যে তাকে নিয়ে হতাশ, রতন তা বোঝে। পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে সে বাবার সঙ্গে কাজে নেমেছে, কিন্তু দূরত্বটা রেখে। দুপুর পর্যন্ত বাবা খেত খামার তদারকি করেন, সে থাকে দোকানে। সুজন খেয়ে দোকানে গেলে রতন বাড়ি আসে। কোনোদিন জমিতে তদারকিতে যায়, কোনোদিন না।
একদিন সে মাকে বলল, আমি লিবিয়া যাব।
মা জিজ্ঞেস করলেন, লিবিয়া কোথায় বাবা, কোন পরগনায়? বাদাঘাট থেকে কতদূর?
সুজন মিয়া শুনলেন, বালিজুড়ির দরস মিয়ার সঙ্গে রতনকে দেখা গেছে। দরস মিয়ার বাবা হারিছ মিয়া একসময় মানুষকে লন্ডন পাঠাতেন, এখন দরস পাঠায় লেবাননে, লিবিয়ায়। তিনি রতনকে সরাসারি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী মতলব?
লিবিয়া যাব। চার লাখ টাকা দিবেন। দরস ভাই চাকরি ঠিক করে রেখেছেন। এক বছরে ফেরত দিব।
রতন কথা বলে কাটাকাটা, তাও যেটুকু বলতে হয়।
সুজন মিয়া স্ত্রীর কাছে রতনের এই হঠাৎ খেয়ালের কথা জানতে চাইলেন। স্ত্রী তাকে বললেন, পাগল ছেলে, যেতে চাইছে যাক, কিছুদিন পর ফিরে আসবে।
সুজন মিয়া জানতেন না, কমলা বানুকে রতন বুঝিয়েছে লিবিয়া ছাতকের ধারে কাছে, এবং সে কাজ করবে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। সুপারভাইজার হবে। আর বাবা থেকে টাকাটা নিয়ে ব্যবসায় খাটাবে।
সুজন চেষ্টা করলেন ছেলেকে বোঝাতে, কিন্তু দরস মিয়ার কাছে পরাস্ত হলেন। লম্বা শ্বাস ছেড়ে ওপরওয়ালাকে ডাকলেন, বললেন, তুমিই মালিক।
রতন বলল, সে বেনগাজি যাবে। বেনগাজির সিদি হোসেনে ভাতগাঁওয়ের অনন্দ্যি আছে। তার সঙ্গেই থাকবে।
বাবা থেকে যা সে গোপন করল: অনন্দ্যি তাকে বেনগাজি থেকে নৌকায় তুলে দেবে। নৌকায় সে যাবে মাল্টা। মাল্টা থেকে সিসিলির সিরাকুসায়। সেখানে পৌঁছালে তাকে নিয়ে যাবে বালিজুড়ির আইনুদ্দিন।
তারপর তার সুখের দিনের শুরু।
দরস বলল, তুই এখনও বিয়ে শাদী করিসনি। ভাবিস না। ইতালির মেয়েরা ডানাকাটা পরী।
দরস যা গোপন রাখল রতন থেকে, বেনগাজিতে তাকে এক মাছ ধরা নৌকায় তুলে দেয়া হবে। তারপর তার চার লাখ টাকার দায় শোধ।
২.
বেনগাজি থেকে বাবাকে ফোন করল রতন, পনেরো দিন পর, বলল, ভালো আছি। কিন্তু সুজন বুঝলেন, সে ভাল নেই, গলাটা বিপর্যস্ত। ফোনে সে মাকে চাইল, তাকে বলল, মা দোয়া কর। খাজা খিজিরের নামে শিন্নি দিও। তারপর সে কাঁদল।
কমলা বানু ভাবলেন, ছেলে মাকে ছেড়ে কষ্টে আছে। তিনি বললেন, শিন্নি দিব। একটু অবাক অবশ্য হলেন, খাজা খিজিরের দোয়া তো চায় তুফানের মওসুমে নাও ভাসানো মাঝি মাল্লারা।
আরো পনেরো দিন গেল। রতনের কোনো খবর নেই। উদ্বিগ্ন সুজন মিয়া বালিজুড়ি গিয়ে দরসকে খুঁজে বের করলেন। দরস বলল, লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। ভয় পাবেন না, রতন ঠিক আছে।
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ফিরলেন সুজন। কিন্তু সন্ধ্যায় চা খেতে এসে আলতাফ মাস্টার সব শুনে বললেন, ওকে বিশ্বাস করা যায় না।
রাজু কবিরাজ বললেন, ওকে ডেকে পাঠান। ও কথা লুকাচ্ছে।
দু’দিন পর আলতাফ মাস্টার প্রথম আলো হাতে সুজন মিয়ার দোকানে ঢুকলেন। বললেন, খবর ভাল নয়।
সুজন মিয়া জানলেন বেনগাজি থেকে ইতালি যাচ্ছিল এক উদ্বাস্তু ভর্তি নৌকা। প্রায় সবই আফ্রিকার। তবে সঙ্গে তিন বাংলাদেশিও ছিল। সবার বাড়ি সুনামগঞ্জ। সাগরের মাঝখানে নৌকা ডুবেছে। একজনের নাম পাওয়া গেছে। তাহিরপুরের মকিম। বাকি দু’জনের কোনো খোঁজ নেই।
সুজন শুনলেন। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। তিনি ওপরওয়ালাকে বললেন, রতনের মাকে কথাটা কিভাবে জানাই, তুমি বলে দাও।
তার মনে হল রতন নয়, তিনিই ডুবছেন। তার নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকছে। শ্বাস আটকে যাচ্ছে। চেতনা লোপ পাওয়ার আগে তিনি ওপরওয়ালাকে মিনতি জানালনে, আর যেন তিনি না জাগেন।
সুজন মিয়াকে ডাক্তাররে কাছে নিয়ে যাওয়া থেকে রতনের খোঁজ খবর নেয়া, সবই করলেন আলতাফ আর রাজু। কমলা বানুকে তারাই জানালেন দু:সংবাদটা। কমলা বানু জ্ঞান হারালেন।
বাদাঘাটের বয়স্ক লোকরা বললেন, বংশের একটাই বাতি ছিল লোকটার, সেও গেল।
তবে সে যে নিশ্চিতভাবে গেল, তাই বা তারা কিভাবে জানলেন? রতনের তো লাশ পাওয়া যায়নি।
৩.
বাদাঘাটে আষাঢ় নামল, কমলা বানুর চোখের পানিকে সঙ্গ দিতে। জাদুকাটা নদী কুল ছাপিয়ে বইতে শুরু করল। রাস্তাঘাট পানির নিচে। মাঠঘাট, ধানের ক্ষেত সব জলে ডোবা।
রাজু একদিন সান্ত্বনা দিয়ে বললেন সুজন মিয়াকে, রতনের দু:খে আকাশ কাঁদছে।
আলতাফ বললেন, সোনার ছেলে, পশুপাখির জন্য কত ভালবাসা ছিল!
বাদাঘাটে কোড়া পাখি শিকার বন্ধ করেছিল রতন, মনে আছে? রাজু বললেন। জাদুকাটাতে মাঝে মাঝে শুশুক এলে মাঝিরা যে বৈঠা দিয়ে মারত -- কেন, কে জানে -- তাও ঠেকিয়েছে রতন।
সুজন মিয়া কাঁদতে ভুলে গেছেন। পানিতে ডোবা মানুষ কোথায় আর চোখের পানি ফেলে।
৪.
সারা রাত বৃষ্টি ঝরেছে। সকালে একটুখানি যেন দম নিয়েছে আষাঢ়। সুজন মিয়া বেরুলেন, ছাতা হাতে। তিনি হাঁটবেন, উদ্দেশ্যহীন। ঘরে থাকলে তার দম বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি দেখলেন, এক কোড়া পাখি এসে তার হাতে ধরা গুটানো ছাতাটায় বসল, বলল, চাচা, খবর আছে।
সুজন মিয়া চমকে গেলেন। তার মনে হল, বিজলির ফলা যেন গায়ে লাগল।
কোড়াটা বলল, খবরটা রতন ভাইয়ের। তাকে আমাদের সালাম।
সুজন মিয়া এক-পৃথিবী সমান অবিশ্বাস নিয়ে তাকালেন কোড়াটার দিকে। কোড়াটা একটু হাসল, বলল, চাচা, তাজ্জ্বব হবেন না। রতন ভাইয়ের সঙ্গে আমরা কথা বলতাম, তিনিও বলতেন।
রতনের কথা তুলছ কেন? কি মতলব তোমার? সুজন জিজ্ঞেস করলেন। নিজেকে তিনি এখন অবিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।
রতন ভাইয়রে খবর জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারেন চাচা, কোড়াটা বলল।
আচ্ছা? সুজন বললেন, এবং বুঝলনে তার ভেতর একটা তুফানের দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। খবর? কি খবর? অনেক কষ্টে তিনি বলতে পারলেন।
খবর ভাল। তবে খবরের জন্য আপনাকে জাদুকাটাতে যেতে হবে। পানিতে নামতে হবে।
সুজন মিয়া মাঝে মাঝেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেতে অস্থির হয়ে পড়েন, কারণ কমলা বানু শুধু বিড়বিড় করে কথা বলেন আর চুল ছিঁড়েন। এ দৃশ্য তার কাছে নির্মম বেদনার। কিন্তু এখন যে পথে কোড়াটা তাকে নিয়ে যাবে, তার শেষ মাথায় কি ওই চুল ছেঁড়া আর বিড়বিড় করে কথা বলা? তিনি কোড়াকে বললেন, কখন?
এখনই, কোড়া বলল, এবং ছাতাতেই বসে থাকল, যদিও বৃষ্টি আবার নেমেছে, এবং সুজন মিয়া ভিজছেন।
বাদাঘাটের বুড়োরা দেখলে দু:খ পেতেন। বলতেন, লোকটা শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে গেল।
৫.
জাদুকাটা টয়টম্বুর, পাক দিয়ে দিয়ে পানির স্রোত বইছে। বৃষ্টি বেড়েছে, তিনি যেখানটায় গেলেন সেখানে কিছু ইঁট আর নারিকেলের কাটাখন্ড বিছিয়ে তিন সিঁড়ির একটা ঘাট কেউ করে রেখেছে। তিনি ছাতাটা পাড়ে রেখে পানিতে নামলেন। কোড়াটা ছাতাতেই বসে থাকল, বলল, চাচা ডুব দেন।
ডুব দিয়ে তিনি দেখলেন, তিন চার শুশুক মুখ দিয়ে ঠেলে ঠেলে একজন মানুষকে পাড়ে নিয়ে আসছে। শুশুকগুলিকে দেখে মনে হল, তারা হাসছে। সুজন মিয়ার হঠাৎ রতনের জন্মের পরের একটা মুহূর্তের কথা মনে পড়ল। দাইমা সরজুবালা রতনকে সুজন মিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ভাইজান, আজান দেন।
আজও কি কেউ তাকে তার হাতে রতনকে তুলে দিচ্ছে, বাইশ বছর আগের সেই বর্ষা দিনের মতো?
অবাক, পানির ভেতর দিয়ে তিনি ছেলেন গায়ের ঘ্রাণ পেলেন। তিনি জানলেন, এই ঘ্রাণ বিলানো মানুষটা রতন। তিনি আস্তে ডাকলেন, রতন! বাবা!
রতন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল, তারপর ছেলের হাত ধরে তিনি সিঁড়ির ঘাট বেয়ে উঠলেন। মজনু মিয়া দেখলেন, শুশুকগুলি পানির ওপরে লাফাচ্ছে আর হাসছে। একটা বলছে, বাই বাই, রতন ভাই। ভাল থেকো।
রতন বলল, আবার দেখা হবে, এবং বাবার দিকে তাকিয়ে তার গল্প শুরু করল। অবাক, সে আর কাটা কাটা বাক্যে কথা বলছে না, বলছে বেশ গুছিয়ে সময় নিয়ে। সে বলল, আমরা চল্লিশজন যে নৌকায় উঠেছিলাম তাতে বড়জোর কুড়িজনের জায়গা ছিল। ঘন্টা চারেক চলার পর নৌকাটা পড়ল ঢেউয়ের পাল্লায়। আমরা ডুবলাম। মরেই যেতাম, যদি না অনেকগুলি শুশুক এসে আমার নিচে জাজিমের মতো বিছিয়ে যেত। তারা আমাকে আবার বেনগাজির জুলিয়ানা বিচে ফিরিয়ে নিয়ে এল।
মজনু মিয়া বললেন, এখানে এলে কিভাবে?
অনন্দ্যি আমাকে প্লেনে তুলে দিল। ওর কাছে আমার টিকেট আর পাসপোর্ট ছিল।
তারপর? মজনু মিয়ার মনে হল তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধাঁধার সামনে পড়েছেন।
তারপর বাদাঘাট। জুলয়িানা বিচে তাড়াহুড়াতে শুশুকগুলিকে আমি আমার কৃতজ্ঞতাটা জানাতে পারিনি। মনে হল জাদুকাটাতে নেমে বলতে পারি। তুমি কি জানো বাবা, এক নদীর শুশুক আরেক দরিয়ার শুশুকদের সঙ্গে কথা বলতে পারে ? আমার ধারণা ছিল, জাদুকাটাতে তারা আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
ছেলের কাঁধে হাত রেখে হাঁটছিলেন মজনু, ছাতাটা ঘাট থেকে তুলে নিতে ভুলে গেছেন। বৃষ্টিতে দু’জনই ভিজছেন। মজনু মিয়ার মনে হল, রতনের গা থেকে নুনে ভেজা একটা গন্ধ তার নাকে লাগছে।
নাকি তোমাকে ওই শুশুকেরাই জাদুকাটা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে?
কি যে বলেন বাবা, রতন বলল, মাথাটা আপনার নষ্ট হয়ে গেছে।
মজনু হাসলেন। ছেলের ভেজা মাথায় আঙ্গুল বুলালেন। একটা আঙ্গুল কেন জানি একটুখানি জিবে লাগালেন। নোনতা।
মজনু মিয়া আকাশের দিকে তাকালেন। উল্টানো কালি লেপা পাতিলের মতো আকাশ। আষাঢ়ের এখন ভরাযৌবন। সেই আকাশে চোখ মেলে তিনি বললেন, মালিক, আষাঢ়টা তুমি ফিরিয়ে নিও না। কোনোদিনও না।
3 মন্তব্যসমূহ
অপূর্ব
উত্তরমুছুনআবিষ্ট হলাম পড়তে পড়তে।
উত্তরমুছুনজাদুবাস্তবতার প্রয়োগ! চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। তাছাড়া মজনু মিয়াটা কে?
উত্তরমুছুন