মূল গল্প: ইন্তিজার হুসেইন
ভাষান্তর: মাজহার জীবন
ভাষান্তর: মাজহার জীবন
মেঘের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে সে অনেক দূর চলে গেল । বেশ ক’টা আঁকাবাঁকা পথ আর অলিগলি পেরিয়ে একটা পুরাতন মাটির বাড়ির সামনে পৌঁছাল সে। সেখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা ধরলো। রাস্তাটা ক্ষেতের দিকে চলে গেছে। উল্টো দিক থেকে একজন লোক ঘাস কেটে সেই ঘাসের বোঝা মাথায় করে বয়ে নিয়ে আসছে। লোকটাকে দাঁড় করিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো, “ এদিকে কি মেঘ এসেছিল?”
“ মেঘ?” লোকটা তাজ্জব বনে গেল যেন তাকে মহা আজগুবি একটা প্রশ্ন করা হয়েছে।
“ হ্যাঁ মেঘ ” কিন্তু লোকটার বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না দেখে তার মন খারাপ হয়ে গেল। সে এবার হাঁটতে হাঁটতে ক্ষেতে লাঙল বইছে এমন এক কিষাণের কাছে হাজির হলো। কিষাণকেও সে একই কথা জিজ্ঞাসা করলো, “ এখানে কি মেঘ এসেছিল?”
কিষাণও এর আগা মাথা কিছু বুঝতে পারল না। সে পরক্ষণেই বলে উঠলো, “মেঘ?”
“ হ্যাঁ মেঘ।”
কারো সন্তান হারিয়ে গেলে যেমন মানুষ পথচারিদের ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করে তেমন করে সে প্রত্যেকের কাছে জানতে চাইলো তাদের কেউ মেঘ দেখেছে কি না। মেঘ যেন তার হারানো সন্তান তাই সে জনে জনে জিজ্ঞাসা করছে কেউ তার সন্ধান জানে কি না। কিন্তু কেউ সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলো না।
সকাল বেলায় সর্বপ্রথম সে তার মায়ের কাছে জানতে চাইলো, “ মা, মেঘ কোথায় চলে গেছে?”
“কে কোথায় গেছে ?” মা এমনভাবে কথাটি বলল যেন সে মস্ত বোকা কিসিমের একটা প্রশ্ন করেছে।
“ মেঘ।”
“ মেঘ---! তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? তাড়াতাড়ি কর। হাত মুখ ধো। নাস্তা সেরে স্কুলে যা। ”
মায়ের এ ধরনের রূঢ় ব্যবহার তার উপর হতাশাজনক প্রভাব ফেলল। মন খারাপ করে সে হাতমুখ ধুয়ে সকালের নাস্তা সারল। বই ভরতি স্কুল ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে।
কিন্তু বের হয়েই তার মাথায় আবার সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়া শুরু করলো: মেঘ কোথায় চলে গেল? গত রাতের সেই সময়ের কথা তার মনে পড়ে গেল: মেঘকে সে উড়তে এবং গর্জন করতে দেখেছিল। যখন সে ঘুমাতে যায় তখন আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। বরং আকাশভরতি তারা জ্বলছিল। বাতাসের লেশমাত্র ছিল না। অতিরিক্ত গরমে তার ঘুম আসছিল না। অনেকক্ষণ পর, কষ্ট করে তার ঘুম আসে। কোনো এক সময় তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। যতটাই বাজুক তার কাছে মধ্য রাতই মনে হয়। দূর আকাশে মেঘ গর্জন করছিল এবং ঘুরপাক খাচ্ছিল। মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল এবং সেই ক্ষণিক মুহূর্তে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছিল। তার মনে হলো খুব জোরে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু সেই বৃষ্টি তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেবে। সেই চিন্তাতে সে চোখ বন্ধ করলো। সে এমন একটা ভান করলো যেন সে কিছুই জানে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়লো।
আকাশ --- আকাশ একেবারে পরিষ্কার এবং মেঘশুন্য। উঠোনে ছিঁটেফোঁটাও বৃষ্টি পড়েনি। প্রথমে সে অবাক হলো তারপর দুঃখিত হলো। সে অবাক হলো এই ভেবে যে, আকাশে মেঘ জমা হলো এবং এক পশলা বৃষ্টি না হয়েই তা কোথায় চলে গেল। কেন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল এ চিন্তা করে তার মন খারাপ হয়ে গেল। যদি সে জেগে থাকতো তাহলে এভাবে মেঘ চোখের আড়ালে হাওয়া হয়ে যেতে পারতো না। সে ঘুমিয়ে না পড়লে মেঘ কয়েক ফোঁটা হলেও বৃষ্টি ঝরিয়ে যেত। আর সেটি হতো মওসুমের প্রথম বৃষ্টিপাত। কিন্তু সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন মেঘ এসেছিল – এক ফোটা বৃষ্টি না ঝরিয়ে সে চলে গেছে। বর্ষা মওসুম দিন দিন পার হয়ে যাচ্ছে। সে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার আকাশের দিকে পরখ করে। দূরে কোথাও মেঘের ছিঁটেফোঁটাও নাই। পরিষ্কার আকাশ থেকে গনগনে সূর্য-কিরণ ঠিক মাথার উপর পড়ছে। স্কুলে যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে ক্ষেতের দিকের রাস্তায় রওনা দিল সে ।
ক্ষেতের মাঝের সরু আল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে অনেক দূরে চলে এলো। সূর্যের অতিরিক্ত তাপ। তার শরীর রোদে ঝলসে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসে তার। অনেক ক্ষেত পেরিয়ে, সে দেখতে পেল প্রকাণ্ড বড় একটা গাছের ছায়ায় একটা পানির কলের চাকা আলতোভাবে ঘুরছে। মরুভ~মির মাঝে চলতে চলতে সে যেন একটা মরুদ্যানে পৌঁছে গেল।
সে গাছটার ছায়ায় পৌঁছে বইয়ের বোঝাটাকে একপাশে রাখলো। পানির কল থেকে ছিটকে পড়া ঠান্ডা পানি দিয়ে সে তার ধুলোমাখা পা ধুয়ে নিল। এরপর সে তার হাত মুখ ধুলো এবং আকণ্ঠ সেই পানি পান করল। হাত মুখ ধোয়া এবং তৃষ্ণা মেটায় তার চোখে আরাম আর জ্যোতি ফিরে এলো। আশপাশে কি আছে তা দেখার জন্য সে চারিদিকে তাকাল। পানির কলের পলেস্তারা পড়া দেয়াল ঘেঁষে বুড়ো এক লোককে বসে থাকতে দেখল। লোকটা হুক্কা টানছে। লোকটা কিছু মনে করে এই দ্বিধা নিয়ে কিছু বলার জন্য সে লোকটার দিকে কয়েকবার তাকালো। অবশেষে সাহস করে বলেই ফেলল, “বাবাজি, এখানে মেঘ এসেছিল?”
বুড়ো লোকটি হুক্কা টানতে টানতে তাকে খুব ভাল করে পরখ করে বলল, “ বাছা, মেঘ এখানে চুপিচুপি আসবে না। যখন সে আসবে ঘিরে আসবে। আকাশ আর পাতাল জেনে যাবে।”
“কাল রাতে মেঘ এসেছিল কিন্তু কেউ তা জানতে পারেনি।”
“কাল রাতে মেঘ এসেছিল?” বুড়ো লোকটি খানিক ভেবে উচ্চস্বরে ডাক দিল, “ আল্লা দীন, কাল রাতে কি মেঘ এসেছিল?”
আল্লা দীন বলদ দিয়ে ক্ষেতে লাঙল বইছিল। সে থেমে উত্তর দিল, “বিছানায় পিঠ ঠেকানোর সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি জানি না।”
তখন বুড়ো লোকটি বলল, “ বাছা, মেঘের আসা কিংবা যাওয়াতে কিছু আসে ষায় না। এক সময় আমি এমন এক এলাকায় ছিলাম সেখানে দশ বছরেও বৃষ্টি হয়নি।”
“ দশ বছর?” সে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে গেল এবং হা করে ফেলল।
“ হ্যাঁ, দশ বছর। তবে মেঘ আসা যাওয়া করতো। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ প্রচণ্ড জোরে গর্জন করত। আমি যখন ওখানে ছিলাম তখন একবার মেঘ ঘিরে এসেছিল কিন্তু এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি।”
“এটা তো আজব কারবার।”
“ না এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। তার হুকুমে বৃষ্টিপাত হয়। তিনি আদেশ দিলে মেঘ বৃষ্টি ঝরায়। তিনি আদেশ না দিলে মেঘ বৃষ্টি ঝরায় না।”
বুড়োর কথায় আগের অনেকগুলো মেঘের কথা মনে পড়ে গেল তার। ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে অন্ধকার রাতে ঘন আর কালো মেঘের কথা তার মনে পড়ল। এমন মেঘ যেন মুসলধারায় বৃষ্টি হবে কিন্তু এক ফোঁটাও পড়ে না - সে মেঘ চলে যায়। তারপর আরেক ধরনের মেঘ যা অল্প পরিমাণ হলেও সেই মেঘে এমনভাবে বৃষ্টি ঝরে যাতে পুকুর আর খাল পানিতে ভরে যায়।
বুড়ো তপ্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ মওসুম চলে যাচ্ছে। কে জানে তার হুকুম কখন হবে?”
সেও উত্তর দেয়ার মতো করে বিড়বিড় করল, “তিনিই জানেন মেঘ এসে কোথায় চলে গেল।”
“বাছা, সহসা বৃষ্টি হয় না, আর যদিও বা হয় তখন বন্যার খবর আসে। আকাশ দিন দিন কৃপণ হয়ে গেছে। মাটির এখন আর কোনো শক্তি নাই।”
‘‘ এমনিতে বৃষ্টি হয় না, আর যদিও বা হয় তখন বন্যা বয়ে যায়”।
বুড়ো লোকটার কিছু কথা সে বুঝতে পারলো আর কিছু কথা বুঝতে পারল না । তবুও সে বসে তার কথা শুনতে থাকলো। হঠাৎ তার মনে হলো সে কত দেরি করে ফেলেছে। তার স্কুলের বই ভরতি ঝোলাটা তুলে নিল সে । সেটা গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ধুলা আর রোদের ভেতর অনেক্ষণ ধরে চলতে লাগল। যে কাঁচারাস্তা ধরে এখানে এসেছিল সেই একই পথ ধরে সে ফিরে যেতে লাগল। সুর্যের তেজ তখনও প্রখর। যখন মাটির কুড়েঘরটির কাছে ফেরত এলো তখন সে বাতাসে ঠান্ডা অনুভূতি টের পেল এবং তার পায়ের নিচের মাটিতে স্যাঁতসেঁতে বোধ করল।
গ্রামের কাছে এসে সে দেখল রাস্তা এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ভেজা। সকালে যখন এদিক দিয়ে যায় তখন গাছ যে ধুলোর আস্তরে ঢাকা ছিল তা এখন সদ্য স্নান করা দেখাচ্ছে। আর গত মওসুম থেকে শুকিয়ে যাওয়া ছোটখাট নালা এখন পানিতে ভরে গেছে। তার শরীরে এক প্রশান্তির স্রোত বয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের উঠোনের জাম গাছটা কেমন পরিষ্কার আর সতেজ হয়েছে তা সে দেখতে চায়।
বাড়ি পৌঁছে সে দেখল বৃষ্টি সবকিছু বদলে দিয়ে গেছে। জামগাছ থেকে অনেক পাতা মাটিতে পড়ে আছে এবং কিছু পাতা ভেজা মাটির সাথে খানিকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। গাছটা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন নতুন স্নান করা। এদিকে মা এক দূর্লভ আত্মতুষ্টি নিয়ে বললেন, “ ভাল বৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহকে অশেষ শুকরিয়া। গরমে মরে যাচ্ছিলাম।”
বৃষ্টির ফোঁটা তখনও জাম গাছের শাখা থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। সে গাছটার নিচে দাঁড়াল যাতে বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখ ও মাথায় পড়ে। তার নজর আকাশের দিকে গেল। আকাশ পরিষ্কার এবং ধোয়া। এখন মেঘের লেশমাত্র নাই আর ।
তার কাছে মনে হলো, যখন সে ধুলা আর রৌদ্রের মাঝে মেঘের খোঁজে দূরে চলে গিয়েছিল সেই সময় তার পেছনে মেঘ এসে বৃষ্টি ঝরিয়ে চলে গেছে। এই ভাবনা তাকে উদাস করে তুলল। বৃষ্টিস্নাত-বাতাস, মাটির সোঁদাগন্ধ হঠাৎ তার কাছে অর্থহীন হয়ে গেল।
-----------
-----------
লেখক পরিচিতি:
প্রখ্যাত
পাকিস্তানি সাংবাদিক, ছোট গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক ইন্তিজার হুসেইন উর্দু
সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী গল্পকারদের একজন। জন্মে ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের
বুলান্দশহরের দিবাইতে। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পাকিস্তানের লাহোর-এ চলে যান।
লিখেছেন ‘বস্তি’, ‘নয়া ঘর’ এবং ‘আগে সমুন্দর হ্যায়’ নামের তিনটি উপন্যাস।
‘লীভ্স’, ‘দি সেভেন্থ ডোর’. ‘এ ক্রনিকল অফ দি পীককস’ এবং ‘অ্যান আনরিটন
এপিক’ তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্প সংকলন। তাঁর লেখায় দেশভাগ পূর্ব জীবনের
স্মৃতি যেমন ঘুরে ফিরে এসেছে তেমনি ধরা রয়েছে তাঁর জীবন-পাঠ যা একই সাথে
সমকালীন এবং কালোত্তীর্ণ।
নিজের
দেশে নানা সম্মানে ভূষিত ইন্তিজার হুসেইনকে ২০০৭ সালে ভারতীয় সাহিত্য
আকাদেমি প্রেমচাঁদ ফেলোশিপে সম্মানিত করে। ২০১৩-তে ‘বস্তি’ উপন্যাসটি
ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর তাঁর নাম ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কারের মনোনয়নের জন্য
সর্বোচ্চ বিবেচিত নামের তালিকায় সংযুক্ত হয়। ২০১৪-তে পান ফরাসী সরকার-এর
‘অর্ডে ডেস আর্টস এট ডেস লেটার্স ‘-এর সম্মান।মূল উর্দু গল্পের সাথে মিলিয়ে দেখতে সাহায্য করেছেন শামীম জামানভী
মাজহার জীবন
কবি। সম্পাদক। অনুবাদক
ঢাকায় থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
মেঘ ভালো লাগলো। অনুবাদ সুন্দর ও সাবলীল হয়েছে। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন