শাহনাজ মুন্নীর গল্প : কাঁঠাল



পোয়াতি নারীর জিভ যেন চঞ্চলা বানের পানি; সময় অসময়ে কত কিছু যে খাইতে মন চায়! পোড়ামাটি, কয়লা, তেঁতুল, গম ভাজা আরো কত হাবিজাবি, সোয়ামী যার উজান দেশে কামলা খাটতে গেছে, সে একলা ঘরে মাটিতে বিছানো হোগলা চাটাইয়ে গড়াগড়ি যায় আর লকলকে জিভের জল টেনে ভাবে--

--আহারে কেউ যদি এখন আমারে একটা কাঁঠাল খাওয়াইতো, তাইলে... ’

সে তার ঈষৎ ফুলে উঠা পেটে হাত রেখে অনাগত শিশুর অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে--‘তাইলে আমার পেটের বাচ্চার সাথে তার বিয়া দিতাম, আর বাচ্চাটা যদি পোলা হয় তাইলে তার সাথে দোস্তী পাতায়া দিতাম।’

পোয়াতি নারীর এই অধীর ইচ্ছাখানি বিহ্বল বাতাস গুপ্তচরের মতো গোপন দ্রুততায় ছড়িয়ে দেয় সবুজ গাছের বাড়ন্ত পাতায় পাতায়, দীর্ঘ জঙ্গলের তীব্র রহস্যে, বুনো ফুল আর নিবিড় ঘাসদের শেকড়ে, ছড়িয়ে দেয় ভোরের কাছে, রাতের কাছে, দুপুরের কাছে।

নিজের প্রাচীন স্যাঁতসেঁতে মাটির গুহায় লোমশ শরীরে গড়াগড়ি খেতে খেতে বাতাসের এই বার্তা আরো অনেকের মতো শুনে ফেলে এক পুরুষ শেয়াল, তার ঘাড়ের কাছে পাঁশুটে বাদামী রোয়া খাড়া হয়ে ওঠে, রক্তে মাংসে বেজে ওঠে হাজার মৃদঙ্গ, ফলে শিয়ালটি আর দেরি করে না, গুহা তোলপাড় করে বেরিয়ে যায় একটা পাকা হলুদ কাঁঠালের খোঁজে।

‘আকাশ থেকে একটা গোলগাল রূপালী চাঁদ ঝুপ করে এসে তার কোলে পড়ল, আর আলোকিত হয়ে গেল চারপাশ’- এমন দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখে ভোর বেলাকার মসৃণ আলোতে ঘরের দুয়ার খুলে খুব অবাক হলো স্বপ্নতাড়িত পোয়াতি নারীটি। একটি সোনালি হলুদ কাঁঠাল মদির আলস্যে শুয়ে আছে তার খোলা দাওয়ার শান্ত ছায়াতলে। পোয়াতি বধূটির জিভের সীমান্ত সুতীব্র লালায় ভরে উঠতে থাকলে সে স্বপ্নময় চোখ তুলে মেঘ স্তিমিত চারপাশে তাকায়, খোঁজে কাঁঠালের বাহককে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। তার লোভাতুর চোখ শুধু দেখতে পায় কাঁঠালের রসালো সৌন্দর্য, কাঁঠালের মুগ্ধ আহ্বান, মাঝ সমুদ্রে ডুবতে থাকা একাকী জাহাজের মতো রসনার সাগরে ডুবতে ডুবতে সে কাঁঠালটাকে দুই হাতের মধ্যে ধরে তুলে আনে ঘরের একান্ত অঙ্গনে। দুইহাতে চাপ দিয়ে ভাঙ্গে এবং কাঁঠালের কাঁটাময় খোলস সরিয়ে উঁকি দেয় কোমল সুস্বাদু হলুদ আর মিষ্টি মধুর মিষ্টতা।

পোয়াতি বধূর কনুই গড়িয়ে নামে কাঁঠালের আঠালো রস, রস জবজবে ঠোঁট হয় প্রফুল্ল, প্রফুল্লতা বাড়তেই থাকে এবং কাঁঠালের সর্বশেষ কোষটি নিঃশেষিত না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আর কোনোদিকেই তার খেয়াল থাকে না।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিনম্র চতুরতায় পুরুষ শেয়ালটি এই গোগ্রাস আহার দেখে, বধূটিকে কিছুক্ষণ সময় দেয় তৃপ্তির ঢেকুর তোলার। হাতমুখ মুছে থিতু হয়ে বসার তারপর খোলা দরজায় নিজের চারপেয়ে ছায়াটাকে মূর্ত করে তোলে সে।

বধূটি তাকে কাঁঠালের গন্ধে আকুল লোভী শেয়াল ভেবে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে বলে,

--দেরি করে আসছো গো শেয়াল পন্ডিত, কাঁঠাল তো শেষ।

শেয়ালটি দরজায় থাবা পেতে বসে, লেজ নাড়ায়, হাসে,

--তোমার কন্যাকে আমার কাছে বিয়ে দেবে তো?

--কেন? তোমার কাছে বিয়া দিবো কেন? যে আমাকে কাঁঠাল দিবে কন্যা হবে তার...

--কাঁঠাল তো আমিই দিয়েছি গো গেরস্থ বৌ, তুমি সেটা বোঝো নাই?’

বধূটি প্রথমে হতবাক্ বাক্যহীনা, পরে বৃথাই তর্কের জাল বোনে

--কাঁঠাল তো দিছে বৃক্ষ, কাঁঠাল দিছে আমার কপাল, তোর কাঁঠাল আমি খাই নাইরে বনের পশু... খাইতে চাইও না। তাছাড়া তাছাড়া...’ বধূটি তোতলায় ‘মানুষের সাথে কি পশুর বিয়া হয়?...’

--‘ও, তাই বলো, ওয়াদা রক্ষার কোনো ইচ্ছাই আসলে তোমার নাই, সবই ছিল কথার কথা ! বেশ তবে দাও, আমার কাঁঠাল ফেরত দাও, বনের পশু বনে ফিরে যাই...’

বধূটির চোখে মুখে এবার পরাজয়ের গ্লানি, সে প্রবল বাতাসের দাপটে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো হার মানে। ওয়াদা রক্ষা না করলে যে জাহান্নামের অনন্ত আগুনে কয়লার মতো জ্বলতে হবে তাকে। অভিশপ্ত হবে সে। আসমানি শাস্তি নেমে আসবে তার বংশের উপর। বধুটিকে বিমর্ষ আর হতাশ দেখায়। নিজের ক্রন্দনসম্ভবা ঝুলন্ত পেট চেপে ধরে ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে সে বলে,

‘বারো বছর পর আসিস ধুরন্ধর শেয়াল, বারো বছর পর দেখা যাবে’--

শেয়ালটি সরব আনন্দে বনে ফিরে গেলে আতঙ্ক ও হতাশায় বধূটি শীতল পান্ডুর ও ধূসর জীর্ণতায় আক্রান্ত হয়। সে কামনা করে এক্ষুনি ঝরে যাক এই শিশু, তরল রক্ত হয়ে ঝরে যাক, ঝরে যাক্ অভীষ্ট গোলাপ, এই গাঢ় হিমে, এই সর্বনাশে তুই আসিস না বাছা, বরং নিঃশব্দে জলের মতো ঝরে যা, কিন্তু শিশুটি ঠিকই পূর্ণতা পায় এবং একদিন গর্ভের কালো অন্ধকার গম্বুজ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। জ্ঞান হারাবার আগ মুহূর্তে বধূটি আধখোলা চোখে বুড়ি দাইকে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘ছেলে না মেয়ে, খালা?’

বয়স্ক পরিশ্রান্ত দাই রক্তমাখা শিশুটির দিকে তাকিয়ে আরো একবার হাসে--‘মাইয়া হইছে তোর, দেখ, ফুটফুইট্যা পুর্ণিমার চান্দের মতো একটা মাইয়া জন্মাইছে তোর ঘরে।’

বধূটি এবার বিবর্ণ হয়ে বাতাসের সামনে জ্বলন্ত কূপির শিখার মতো দপ করে নিভে যায়। সেই পশু অস্তিত্ব, কাঁঠালের সুমিষ্ট আস্বাদ, সেই প্রলয় প্রহর এবং পতনের প্রাকৃতিক চক্রান্ত তার হৃদপিণ্ড দীর্ণ করে। তার উথাল পাতাল জিভের পানি আর অলিখিত অতীত প্রতিশ্রুতি তাকে হিম বরফের মতো শিশুটির কাছ থেকে আলাদা করে রাখে। কিন্তু কতদিন আর? শিশুটির কান্নার দাবি ঘুমন্ত মাতাকে পেখম মেলে জাগিয়ে তোলে, সকল অপ্রত্যাশিত স্মৃতি ভুলে অবসন্ন কপোতীর মতো মা কন্যাকে গভীর সোহাগে টেনে নেয় নিজের ডানার উষ্ণতায়। মায়ের অর্থহীন কথা সুর হয়ে বাজে, কন্যার নাম রাখা হয় ময়না। ময়না সত্যিই যেন এক উজ্জ্বল পাখি, হাত পা ছুঁড়ে কখনো প্রজাপতি, কখনো পাকা খেলোয়াড়, ঘুমের মধ্যে হাসে, মায়ের কোলে যেন একফোঁটা জোসনা। উঠান জুড়ে কোমল পায়ে হেঁটে হেঁটে কন্যা বড় হয়, যেন এক নিটোল পদ্ম, এলোচুলে তেল মেখে সাপের লেজের মতো বেণী বাঁধে যখন তখন রিনিঝিন আওয়াজ তুলে ময়নার হাতের চুড়ি মুখর হয়। অধীর হয়ে সময়ের নদী বয়ে যায়, ময়নার পালকে ফোটে রক্তপুষ্পের কলি। এখন যেন সে এক স্নিগ্ধ মায়াবী গোলাপ। মা সস্নেহে হাসেন...‘ময়না আমার, বড় হইছে।’

ময়নার নীলাম্বরীতে এখন অবাধ্য স্রোতের জোয়ার, হাঁটায় সজাগ সলাজ অবসাদ, চোখ আকস্মিক বৃষ্টিমুখর, মা এসব দেখে আর ক্রমেই ভুলে যায় দূর অতীতের সেই সর্বনেশে প্রতিশ্রুতি। হাসিমুখে গ্রামবাসীকে জানান দেয়- ‘হারানের ছোট ছেলে পরানের সাথে আগামী ফাল্গুনে ময়নার বিয়া।’

যেন মায়ের মনেই থাকে না বার বছর আগে দেয়া তার প্রতিশ্রুতির কথা। মায়ের মনে ধূলির আস্তরণ পড়ে আর ঝাপসা হয়ে আসে সেই সর্বনাশা অঙ্গীকারের স্মৃতি। কিন্তু যে চতুষ্পদ এক এক করে বারো বসন্ত প্রতীক্ষা গুনেছে, সে তো ভুলে নাই। সে অরণ্যে মাতালের মতো ঘুরেছে, পাতা ঝরা, ফুলফোটা, গাছেদের মেজাজ-মর্জি আর আকাশের রং দেখে সময়ের হিসেব রেখেছে। সময় পূর্ণ হলে ভেতরের উত্তেজনা চেপে একদিন পরিচিত ঘরটির দরজা জুড়ে দাঁড়ায় সে, তার দুচোখ উত্তেজনায় কাঁপে।

সন্ধ্যার অন্ধকারে এই চতুষ্পদ সূচালো মূর্তি দেখে কিশোরী ময়না ভয় পায়। সে ঝাড়ু– হাতে ধমকায়,‘ যা ভাগ, ভাগ, দূর হ বনের পশু...’

শেয়ালটির অপেক্ষমান ঠোঁট থেকে প্রশংসা ঝরে পড়ে। সে বলে, ‘ওগো সুলক্ষণা, লাবণ্য প্রতিমা, তোমার মাকে ডাকো, চুক্তি আমার তার সাথে, কথা যা কবো তার সাথেই কবো, সে আমারে চেনে, ডাকো তারে’।

মায়ের চেহারায় এবার কালিমার আচ্ছাদন, তার চোখে ভয়, আতংক আর নিরুপায় অবিশ্বাস, ‘হ্যাঁরে পশু, এই কি তবে সত্য? সত্যিই কি কন্যা আমার এতই অভিশপ্ত? মায়ের দোষে, মায়ের পাপে, পশুর সাথে বাঁধা পড়বে তার নারী জীবন? হায়, আমার আদরিণী বুকের মানিক তবে কি তোর ঘরেই বিষাদে লজ্জায় নিঃশেষ হবে?

--‘তবে কি তুমি প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে দিতে চাও, মানুষের ঘরের বৌ ? অঙ্গীকার বিনষ্ট করতে চাও? করলে করো। বনের পশু মানুষের প্রতারণার কাহিনি বন জুড়ে বলে বেড়াই--’

মায়ের কণ্ঠে তখন সর্বহারার আকুল বিলাপ, শ্রান্তি, সংকট, বিভ্রান্তি। মায়ের চোখে ব্যর্থ ডুবন্ত সূর্য, চারপাশে অনুজ্জ্বল বিধ্বস্ত পৃথিবী। মা যেন সেই পৃথিবীতে পথ হারানো কোনো গুলিবিদ্ধ হরিণী, দিশাহীন। তার বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, তবু কণ্ঠ থাকে অকম্পিত,

--‘প্রতারণা নারে বনের পশু...জবানের দায়...বড় কঠিন, জবান যখন দিছি তখন তা রাখবোই, বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। ময়নার সাথেই বিয়া হবে তোর’।

সব শুনে ময়না প্রথমে প্রতিবাদী, ‘না, আমি রাজি না, এই বিয়া হবে না, হইতে পারে না’।

সে দৌড়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে চায় তারপর পাগলের মতো মা’কে গালাগালি করে,

‘রাক্ষুসী, পাপিষ্ঠা, আমি তোর মেয়ে না, তোর ভুল জবানের দায় আমি নিবো না, তুই জ্বলে পুড়ে মর, তুই ধ্বংস হ, আমার এই নবীন জীবন তুই নষ্ট করিস না।’

ময়না কেঁদে আকুল হয় তারপর ধীরে ধীরে হয়ে যায় একখণ্ড পাথরের মতো শান্ত। মূক ও বধির মাটির প্রতীক। যেন সে হাসি অথবা ক্রন্দন জানে না। যেন সে নিথর নিশ্চুপ পলকহীন এক কাঠের পুতুল।

অবশেষে আশ্বিনের দুপরে পড়শীরা ময়নার মায়ের বাড়ির উঠানে সমবেত হয় আর মায়ের ভুলের মাশুল দিতে, তার ওয়াদার দায় রাখতে. মায়ের দুধের ঋণ শোধ করতে, চারপেয়ে স্বামীর সাথে গহীন বনে সংসার করতে যায় অভাগী ময়না। তার প্রেমিক পুরুষ, মনের মানুষ, হবু স্বামী পরান তখন দূর প্রবাসে, উজান দেশে।

শেয়ালের খুশি যেন সহস্র ঝর্ণার জলধ্বনির মতো বাজে। তার স্যাঁতসেঁতে গুহায় সে খুঁজে পায় কামিনীর ঘ্রাণ, যেন গুহা নয় এটি কোনো পুষ্পিত উদ্যান। বনকে মনে হয় শ্যামলিম সুন্দর, নিজেকে সে ভাবে ভাগ্যবান অরণ্যের সন্তান, দূর দূরান্ত ঘুরে নিয়ে আসে সুস্বাদু শিকার, বউয়ের পায়ের কাছে সেসব ঢেলে দিয়ে বলে--

‘মানুষের মেয়ে গো, রাধো, বাড়ো, খাও আর পতিরে খাওয়াও।’

ময়নার ম্লান কচি মুখ, ভেজা চোখের আর্তি, হতাশ নিঃশ্বাস, তার কষ্ট, তার আকুল আঁধার, তার ঘৃণাপূর্ণ ভয়ার্ত দৃষ্টি বোঝে না বনের শেয়াল। শেয়ালের চোখ ধূর্ত, শেয়াল শুধু বোঝে আদিম বন্য বাসনা। শেয়ালের লেজ লম্বা, শেয়াল চেনে শুধু বনের সীমানা। কত বিচিত্র কষ্টের জমাট বেদনা লেপ্টে আছে ময়নার ঠোঁটে শেয়াল জানে না। জীবনের সব রং, সব স্বপ্ন, সব গন্ধ, সব শব্দ ভুলে গিয়ে ময়না ক্রমে ক্রমে বহুদূরে, যেন বোধহীন খটখটে এক স্বপ্নশূন্য শেয়ালিনিতে রূপান্তরিত হয়, যে একাকী জঙ্গলের কোটরে নিঃশব্দ নিয়মে পশুর মতো স্বাভাবিকতায় জন্ম দেয় দুইখানা সন্তান, দুইখানা প্রাণবন্ত শেয়ালশিশু। শিশুদের আকার ও আকৃতি দেখে বেচারী ময়না নীরব আক্ষেপে কাঁদে, হায়, একটা শিশুও আমার মতো হইলো না, আমি এত কষ্টে কি আমার পেটে ধরলাম? আহা, একটা বাচ্চাও যদি আমার মতো হইতো...

ওদিকে ময়না যে যুবকের বাগদত্তা ছিল, সেই, পরান, দীর্ঘপ্রবাস শেষে কামাই রোজগার করে যখন ফিরে এলো, তখন তার সম্মুখে অচেনা শূন্য বাগান, যোজনব্যাপী রুক্ষ মরুভূমি। ময়নার মা ভাষাহীন যেন হাহাকার করা ছাই। গাঁয়ের লোকের কাছে সমস্তটা জেনে যুবকের বুক জ্বলে যায়, বুকে প্রচণ্ড কালোচিহ্ন নিয়ে একরাতে সে ঘর ছেড়ে--গাঁয়ের আলপথ-নদী তীরের জনপদ, পরিচিত মাটি তরঙ্গ পেরিয়ে মুখে গাঢ় বিষাদের ছায়া, অন্তরে শোকের হাহাকার নিয়ে অন্ধ পথিকের মতো ময়নার গন্ধ শুঁকে শুঁকে কুয়াশাচ্ছন্ন পথে নির্বান্ধব হেঁটে চলে। বিশাল গাছের কাণ্ড, শ্যামল কোমল গুল্ম, তীক্ষ্ণ কাঁটা গাছ তার পথরোধ করে, তবু সে দুর্বার ধৈর্য্যবান, লক্ষ্যে স্থির একাকী মানব। অনেক বন্ধুর পথ, অনেক হিংস্র চোখ পেরিয়ে, গাছে ঠাসা এক বনে লজ্জা, অপমান, অভিমানে বরফ কিংবা শেয়ালিনিসদৃশ মেয়েটির দেখা পায় সে। মেয়েটি তাকে দেখে অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ হয়, যেন মানুষই তার শত্রু, যেন সে সত্যিই এক শানিত দন্ত উন্মাদ শেয়ালিনি। তার চোখে ঘৃণা, তাচ্ছিল্য আর তিক্ততার ইতিহাস। ছেলেটি সমস্ত শরীর দিয়ে একবুক বাতাস টেনে তখন তারে ডাকে, ডাকে সহজ ভালোবাসায়, মেয়েটিকে, তার প্রিয় নামে--‘ময়না, আমার ময়না পাখি...’

মেয়েটির বুকে হঠাৎ আলোড়ন, দৃষ্টিতে সহসা বিভ্রম, আত্মায় উথালপাতাল তুমুল তুফান বয়ে যায়। তবু সে দাঁত খিচিয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকারে পরানকে কামড়াতে ছোটে। এরকম দৃশ্য প্রেমিককে দ্রবীভূত করে, সে গভীর সমবেদনায় বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে বুকের দুয়ার খুলে অসভ্য বুনো মেয়েটিকে ভেতরে টেনে নেয় আর মেয়েটি বৃষ্টির মিহি ফোঁটার মতো ঝরঝর শব্দে ভেঙ্গে পড়ে, চূর্ণ বিচূর্ণ হতে থাকে, তার শরীর থেকে ধীরে ধীরে পশু গন্ধ উড়ে যায়, সে অসহায় বিস্ময়ে জেগে উঠলে তাকে কেমন উদাস অচিন দেখায়। এইবার প্রেমিকের হাত ধরে সে তার গুহায় পৌঁছায় যা মাটি, খড় ও পাঁশুটে গন্ধের সমবায় এবং যেখানে দুইখানা ফুটফুটে শেয়াল শিশু জ্বলজ্বলে কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করে--‘এ কে মা? এ কে?’

শিশুদের মা কিছুক্ষণ চুপচাপ, তার বুকে চৈত্রের দহন, ঠোঁটে বিষবিন্দু,

‘এ হচ্ছে তোদের মামা--আমার ভাই, খবরদার, বাবাকে কিন্তু এর কথা ঘুণাক্ষরেও বলবি না’

শিশুরা ঘাড় নাড়ায়--বলবে না। তারা লেজ নাড়িয়ে পরানের চারপাশ ঘিরে ঘুরতে থাকে, আমাদের মামা, মায়ের ভাই, তাই-তাই।

পরান এইসব ধূসর করুণ দৃশ দেখে ব্যথিত হয়, এ ব্যথা ব্যাপ্ত হয়ে অরণ্যময় ঘুরে ফেরে, ময়না হঠাৎ বিমর্ষ যেন বাজপড়া গাছের উপমা। পরান ফিসফিস করে,

--আমি বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে তোমাকে নিতে এসেছি, চলো পালাই, এ আত্মনাশ অর্থহীন, চলো কন্যা, পালাই।

ময়না যেন একাকী বিনম্র মৃত্যুতে মগ্ন যেন চৈত্রের রোদ দগ্ধ খাঁ খাঁ দুপুর। সে খড়খড়ে শুকনো কণ্ঠে কান্নার মতো হাসে,

--তুমি লোকালয়ে ফিরা যাও মানবপুত্র ..’

--আর তুমি?

--আমি অভাগিনি, কপাল আমার এইখানে বাঁধা, যেদিন এই বন্ধন ছিঁড়বে সেদিন হয়তো ফিরবো।

পরান এত সহজে নিস্ফল প্রত্যাবর্তন চায় না, কেননা সে তাদের মধ্যকার সমুদ্র সমান ব্যবধান ঘুচাতে চায় কেননা তার স্মরণে সমুজ্জ্বল দিনের স্মৃতি, সে বন্য নারীটিকে মানুষের আশ্রয়ে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু ময়না তার সঙ্কল্পে অটল, সে ফেরে না, অন্তহীন অভিশাপ আর জননীর দুর্বিষহ প্রতিশ্রুতির বোঝা কাঁধে সে স্বেচ্ছায় ফিরে যায় নিরানন্দ গুহার জীবনে।

সন্ধ্যায় সারা বন ঘুরে গুহায় আসে শিকারী শেয়াল। বাপকে দেখে শেয়াল শিশুরা আনন্দে চিৎকার করে--‘আমাদের মামা, মায়ের ভাই, তই-তাই-তাই’। পিতা এ হুল্লোড়ের অর্থ বুঝতে সন্তানদের মায়ের দিকে তাকায়,

--কি বলে এরা, মানুষের মেয়ে?

--কি জানি কি?’-- মা তাচ্ছিল্য দেখায়, ‘আমি কেমনে বলি?’

ফলে ব্যাপারটি আপাতত চাপা পড়ে কিন্তু তা হয়তো কিছুদিনের জন্য মাত্র কেননা যতই দিন যায় ময়নার মনে লুকিয়ে থাকা মানুষের মেয়েটি ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে এবং অবিরাম পাঠাতে থাকে জীবনের মন্ত্রমুগ্ধ সংকেত, যা ক্ষণে ক্ষণে তাকে সম্মোহিত, স্বপ্নকাতর ও লোলুপ করে তোলে। ময়নার মধ্যে কেঁদে উঠে আরেক ময়না, যে ভয়ংকর নিষ্ঠুর, শব্দহীন কিন্তু অবিচলিত। যে তাকে অবিরাম ফুসলায় অন্য যাত্রাপথে, দুই ময়নাতে দ্বন্ধ বাঁধে, যুদ্ধ চলে। আর যুদ্ধ শেষে শিশুদের মা ময়না নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না বরং ভেসে যায় ঘন বর্ষায় প্রান্ত থেকে প্রান্তরে আর একটি কুটিল ইচ্ছা তাকে থেকে থেকে বৃশ্চিকের মতো দংশন করে, সেই দংশন বিপদসংকুল, দুঃসাহসী ও উৎকণ্ঠাময়। ময়না এখন অন্য কেউ। সুযোগের সন্ধানে তক্কে তক্কে থাকা এক ঘাতক। কয়েকদিন পর এক ভোরে যখন শেয়াল বউকে ডেকে বলে-- ‘মানুষের মেয়ে শোন, আমি যাচ্ছি দূরের বনে, তুমি তোমার দেশের পিঠা বানিয়ে রেখো, এসে খাবো।’

ময়না তখন অন্তরে ঘুমন্ত ভয়াল বিদ্রোহ চেপে রেখে নিপুন হাসে, তারপর জেগে উঠে তীব্র আক্রোশে যেন সে এক হিংস্র ডাইনী কলঙ্কিনী কাল নাগিনী, তার মদির বুকের নিচে শুধু সর্বনাশ, শুধু উদ্যত ফণা, ক্রূর বৃশ্চিক, নরকের ঢেউ। সে তার আশ্চর্য সুন্দর মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রেখে সমস্ত সংসার ঠান্ডা মাথায় নিজের হাতে লন্ডভন্ড করে বেরিয়ে পড়ে পুরনো শৈশবের পথে, নিজের চিরচেনা গ্রামের দিকে, অতীতের দিকে অথবা পেছনের দিকে।

ময়নার অকস্মাৎ ফিরে আসা তার মাকে যুগপৎ বিস্মিত, ভয়ার্ত ও আনন্দিত করে। ফিরে আসা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আবেগে, নিজস্ব দুঃখে ও অপরাধবোধে মা কাঁদে, এই কান্না লোকালয়ে বিস্তৃত হলে পড়শীরা ভীড় করে ময়নাকে দেখতে আসে আর ময়নার হঠাৎ নিজেকে মনে হতে থাকে ফাঁদে পড়া শেয়াল, প্রতিটি মানুষের চোখে যেন ক্ষুরধার বর্শাা যা তাকে অনবরত বিদ্ধ করে। সে ঘরের অন্ধকার কোণে লুকায় তারপর আকাশে চাঁদ উঠার শব্দ শুনে সর্ন্তপণে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে খোলামাঠে, পশুদের মতো থাবা পেতে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে কাঁদে, বিড়বিড় করে, গোঙ্গায়, আর্তনাদ করে। দূর থেকে এসব দেখে মা’র বুক কেমন কেঁপে উঠে, ধীরে ধীরে মা মেয়ের পাশে এসে বসলে ময়না আর্তকণ্ঠে জানায়, ‘বাচ্চাগুলির জন্য মন খারাপ লাগতেছে, মা, আমাকে না পেয়ে ওরা বোধ হয় কাঁদতেছে..’।

মেয়ের দুঃখ বুঝে মা জিজ্ঞেস করে, ‘ওদের নিয়ে এলি না কেন?’

উদাস ভঙ্গিতে জোনাকীর পেছনে হামাগুড়ি দিতে দিতে ময়না উত্তর দেয়--‘ওরা আসবে কেন? ওরা যে শিয়াল, মা,ওরা মানুষের কাছে আসবে কেন?’

ওদিকে অরণ্যে তখন অন্য দৃশ্য। সন্ধ্যায় গুহার দরজায় পা দিয়েই সর্বনাশ ও মৃত্যুর গন্ধ পায় শেয়ালটি, কেননা সে দেখতে পায় জমাট রক্তের রেখা, শুনতে পায় থমথমে নীরবতা এবং সবশেষে গুহার ভেতরে পায় তার দুই সন্তানের মুন্ডুহীন, শক্ত, শীতল ছোট শরীর। প্রথমেই তার সন্দেহ হয় বনের কোনো হিংস্র মাংসাশী প্রাণীর কাণ্ড কিন্তু অচিরেই সে বোঝে এই প্রলয় এক মানুষের মেয়ের প্রেমহীন সন্ত্রাস, বিধ্বংসী রক্ত রক্ত খেলা, নিহত প্রতিশ্রুতির নীল যন্ত্রণাময় প্রতিশোধ।

... ... ... ... ... ...

ময়নার প্রত্যাবর্তনের খবরে স্বপ্ন প্রপাত চোখে ছুটে আসে পরান, বুকে তার সবুজ আকাঙ্ক্ষা যেন এইবার জানা যাবে কোন মহিমায় বালিকা জ্বলে উঠে হীরের দ্যুতিতে। কিন্তু সেই প্রফুল্ল সুকন্যা ময়না কোথায়? ঘরের অন্ধকারে থাবা মেলে বসে আছে এক পাংশুমুখো লাবণ্যহীন শেয়ালিনি। পরান আবার সেই পুরনো সহজ সুরে ডেকে তার রূপ বদলাতে চায় গভীর ভালোবাসা গলায় ঢেলে সে ডাকে,

--ময়না, আমার ময়না পাখি...

উত্তর আসে না। পরান তাকে স্পর্শ করতে সামনে এগুলে তার নাকে এসে ধাক্কা দেয় পাশব গন্ধ। শেয়ালিনিটি বিকট বিশ্রী কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে--

--চোপ্, কাছে এলে খুন হয়ে যাবি

পরান দেখে ময়নার অনাবৃত হাতে মসৃণ বাদামী লোম। আঙুলে ময়লা লম্বা ধারালো নখ, মুখে সাদা তীক্ষ্ণ সূচালো মাংসাশী দাঁত, জিভ বেরিয়ে নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। ময়না বসে আছে ঠিক পশুদের মতো, চার হাত পায়ে ভর দিয়ে। চোখ দুটো জলন্ত কয়লার মতো ধিকিধিকি জ্বলছে,

পরানের প্রচণ্ড ভয় হয়।
সে ক্রমশ পিছুতে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ