‘এবার তুই বল … এখানকার খবর কি, কেমন চলছে সব।’
‘এখনকার খবর? এখানকার ব্যাপারে আমি আর কি বলব তোকে?’
এই আচমকা প্রশ্নটা আনোয়ারের হিসেবের মধ্যে ছিল না। হয়তো তেমন সচেতনভাবে নয়, হতে পারে অবচেতনেই, সে ঠিক করে নিয়েছিল যে, যা হবার হবে। চারপাশের সবকিছু সে খেয়াল করত ঠিকই কিন্তু এখন যখন এখানকার অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হলো, সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ‘কি হয়েছিল এখানে?’ জাভেদ আবার প্রশ্ন করল।
‘এখানে?’ আনমনে কথাটা আবার আওড়াল আনোয়ার, আর তারপর চিন্তার গলি ঘুঁজিতে হারিয়ে গেল। শেষে একসময় সে এইটুকু বলে উঠতে পারল, ‘দোস্ত, কিছুই ঘটেনি এখানে।’
‘কিচ্ছু ঘটেনি?’
‘সত্যি বলছি কিচ্ছু ঘটেনি। ওখানে যা সব ঘটতে দেখেছিস তার তুলনায় এখানে কিছুই ঘটেনি।’
‘সত্যি বলছিস! আমরা তো ওখানে বসে ভাবছিলাম যে এখানেও অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে।’
‘সত্যি বলছি দোস্ত কিছুই ঘটেনি এখানে, আদৌ কিছু না।’
‘কিন্তু এখানেও তো যুদ্ধ হয়েছিল একটা, হয়নি কি?’
‘হ্যাঁ যুদ্ধ একটা হয়েছিল।’ আনোয়ারের গলা শোনা যায় কি যায় না। তারপর আর কোনো কথাবার্তা নেই। দুজনেই একেবারে চুপ। যে উৎসাহ নিয়ে আনোয়ার কথাবার্তা শুরু করেছিল এখন তা মিইয়ে গেছে। জাভেদও আসলে প্রশ্নটা করেছিল কথার কথা হিসেবে; তেমন কিছু কৌতূহল বা আগ্রহ ছিল না তাতে।
আনোয়ার মুখ খুলল আবার, ‘আসলে এখানে বাইরে থেকে কোন আক্রমণ আসেনি। যা কিছু ঘটেছে, এখানেই ভিতর থেকে পচে গিয়েছিল।’
‘বাইরে থেকে কখনোই কিছু ঘটে না,’ জাভেদ খুব আন্তরিকতার সাথে বলল. ‘যা ঘটে ভিতর থেকেই ঘটে।’
‘না, সব সময় তা হয় না।’ বেশ রাগের সঙ্গে বলল আনোয়ার। ‘ঐখানে যা ঘটেছিল, তার বেশিরভাগটাই বাইরে থেকে আক্রমণ। আর এখানে যা ঘটেছে সবটাই ভিতর থেকে। আর এর বেশিটাই ঘটেছে যুদ্ধের পরে।’
‘সত্যি?’
‘ঠিক তাই।’
‘কিন্তু, হয়েছিলটা কি?’
‘স্ট্রাইক, লকআউট, মিছিল, প্রতিবাদ, রাস্তায় রাস্তায় মারামারি, ছাত্র-অশান্তি, গ্রেপ্তার …’
জাভেদ ওদের সামনে পড়ে থাকা একটা ইলাস্ট্রেটেড ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে তার পাতা উল্টাতে লাগলো। ম্যাগাজিনটা সকাল থেকেই টেবিলের উপর পড়ে থাকলেও হয় তার সেটা দেখার সময় হয়নি অথবা পড়ার ইচ্ছে হয় নি। কিন্তু এখন ম্যাগাজিনটা তাকে এমনভাবে টানছিল যে সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলনা। এই ম্যাগাজিনের ছবিগুলো তার অসম্ভব ভালো লাগে।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহযুদ্ধের মতোো কিছু একটা শুরু হয়েছিল। সারি সারি ব্যারিকেড দাঁড় করানো হলো, স্টেনগান চলল আর বুলেটের আওয়াজ শোনা গেল সারা রাতভর।’
‘এইটা মজার হয়েছে,’ হাসলো জাভেদ।
‘মানে?’
‘এই কার্টুনটা। এই যে …’ জাভেদ ম্যাগাজিনটা আনোয়ারের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
থিতিয়ে গিয়ে আনোয়ার কার্টুনটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করল, ‘হ্যাঁ ভালোই।’ তারপর একেবারে চুপ করে গেল।
‘চল, একবার বাইরে থেকে ঘুরে আসি,’ বলল জাভেদ।
‘ঠিক আছে।’
‘বাড়িতে থাকলে আমরা বারবার একই কথা ঘুরে ফিরে বলতে থাকবো। আমায় দেখতে আসা লোকেদের স্রোত লেগেই থাকবে। সবার একই প্রশ্ন, উত্তরও একই। এইটা এখন বন্দিত্বের নতুন সংজ্ঞা। চল দোস্ত, বেরিয়ে পড়ি।’ সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ভিতরের দরজার দিকে হেঁটে গেল, তারপর চিৎকার করে জানিয়ে দিল, ‘আমি আনোয়ারের সাথে বের হচ্ছি।’ এরপর দুজনে রাস্তায় নেমে পড়ল।
‘দোস্ত, সিন্ধের রায়টের ব্যাপারে কিছু শুনেছিলি?’ আনোয়ারের হঠাৎ মনে পড়ে গেল কতটা বিপজ্জনক আর কি মর্মান্তিক ছিল সেই সংকট। জাভেদকে এটা জানানো খুব দরকার।
‘রেডিও বুলেটিন থেকে তুই কিছুই বুঝতে পারবি না। আশ্চর্য সব ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে এখানে। অগুনতি লোক মারা গেছে। কতজনের যে ঘরবাড়ি ছারখার হয়ে গেছে। লিয়াকৎ মার্কেটটা তো দেখেছিস নিশ্চয়ই। কি বিশাল বাজার ছিল ওটা। জ্বালিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। একটা প্রাণীও জীবিত বের হতে পারেনি …।’
‘দোস্ত, পেটে আর উরুতে এই চৌখুপ্পিগুলোর ব্যাপারটা কি বলতো?’ চলা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল জাভেদ।
আনোয়ার মাঝপথে থেমে গিয়ে জাভেদ যেদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সেই দিকে চোখ ফেরাল। সিনেমা হলের সামনে একটা পোস্টার ঝুলছে, সেটায় এক আধা-ন্যাংটো মেয়ের ছবি। তার সুগঠিত উরু আর পেটের উপর একসারি করে চৌখুপ্পি আঁকা রয়েছে। এই ছবিটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকবার আনোয়ার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগ্রহ নিয়েই দেখতো। কিন্তু এখন এটার দিকে তাকিয়ে সে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ‘বাদ দে, দোস্ত,’ বলল সে তারপর দুজনে মিলে এগিয়ে গেল।
‘আইস্ক্রিম খাবি?’ আনোয়ার একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
‘ঠিক আছে।’
আইস্ক্রিম খেতে খেতে জাভেদের নজর পড়ল একটি মেয়ের দিকে, ফ্ল্যাপার পরা, বড় বড় গোল গগলস। যতক্ষণ না মেয়েটি দোকান ছেড়ে চলে গেল ততক্ষণ সে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেল।
‘দোস্ত, আনোয়ার, আমার মনে হয় আমার এখানে না থাকার সাথে সাথে বেল-বটমও হাওয়া হয়ে গেছে।’
‘আর টাইট প্যান্টও।’
‘ঠিক, টাইট প্যান্ট আর টাইট শার্টও … দোস্ত, তুই কিন্তু এখনও আমাকে বলিসনি, এখানে কি ঘটেছিল।’
‘দেখতেই পাচ্ছিস, কি ঘটেছে,’ মিচকি হেসে বলল আনোয়ার, ‘বেল-বটম চলে গেছে আর ফ্ল্যাপার এসেছে।’
‘এটা কিন্তু কোন ছোট ব্যাপার নয়,’ বলল জাভেদ।
‘না, না খুবই বড় ব্যাপার,’ আনোয়ারের গলায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল। একটু থামলো ও, তারপর প্রশ্ন করল, ‘তা এই বড় ব্যাপারটা নিয়ে তোর কি মতামত?’
‘দোস্ত আমি এখনো এই ফ্ল্যাপার ব্যাপারটার সাথে নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে উঠতে পারিনি।’ আইসক্রিম শেষ করে কাপটা একটা ময়লা ফেলার জায়গায় ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ‘এখন যেতে পারি আমরা?’
‘চল যাওয়া যাক।’
এগিয়ে গেল তারা।
এখন আর আনোয়ারের মনটা অত গুরুগম্ভীর হয়ে নেই। কিন্তু ছোটখাট নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে জাভেদের কৌতূহল দেখে সে আর প্রশ্ন না করে পারল না, ‘এখন যখন তুই এখানে এসে পড়েছিস, সব দেখে শুনে তোর প্রতিক্রিয়া কি?’
‘প্রতিক্রিয়া? আমার প্রতিক্রিয়া? কি বলতে চাইছিস তুই?’
‘মানে, বন্ই দশায় এতগুলো বছর কাটিয়ে আসার পর এখন কেমন লাগছে তোর?’
‘কি জানিস, কেমন অদ্ভুত একটা …’ কথার মাঝখানে থেমে গেল জাভেদ।
‘কি হল?’
‘ওই অল্পবয়সী ছেলেটাকে দেখ … একটা গোলাপি সালোয়ার পরে আছে। আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, ওটা সিল্কের।’
‘কি এলো গেল তাতে?’
‘তার মানে এতে কোন গোলমাল নেই, সব ঠিকঠাক? সত্যি?’ জাভেদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, ‘আজকাল অল্প বয়সীদের কি এইসব রং আর এইরকম কাপড়ই পছন্দ? আমি আরো ছেলে-ছোকড়াদের দেখেছি, উজ্জ্বল রং আর সিল্কের সালোয়ার-কুর্তা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, এখন এসব ভালই চলছে। শোন, কড়াই-গোস্ত খাবি?’
‘কড়াই-গোস্ত?’
‘হ্যাঁরে হ্যাঁ, রাতের খাবার সময় তো প্রায় হয়েই গেছে, এখন আর বাড়ি গিয়ে দরকার কি? চল, কড়াই-গোস্ত খেয়ে একটা লম্বা হাঁটা লাগানো যাক।’
ভিড় ছিল ভালো রকম। রাস্তার দু'ধারে গাড়ি দাঁড় করানো। লন এবং ফুটপাথ, দুই জায়গাতেই চেয়ার-টেবিল পাতা রয়েছে। সব টেবিলে লোক বসে আছে। একটা বিশাল ছাগলের ছবির নিচে আগুনে ঝলসানো মাংসের গোটা গোটা ঠ্যাং সারি দিয়ে ঝোলানো রয়েছে। উনুনগুলো গজরাচ্ছে, হিস্ হিস্ শব্দ করছে, আর চারপাশে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে দিচ্ছে।
‘দোস্ত রে, এই জায়গাটা বড্ড ভিড়।’
‘চিন্তা করিস না। টেবিল একটা তাড়াতাড়িই জুটে যাবে।’ বলতে বলতেই আনোয়ারের নজর পড়লো দূরে একটা টেবিল খালি হচ্ছে। সে লাফিয়ে সেই দিকে এগিয়ে গেল। টেবিলটা ছিল ফুটপাথের উপরে। কাছেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা গাড়ির বনেটকে টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটার উপরে মাংস ভরা গোটা দুয়েক কড়াই সাবধানে রাখা হয়েছে আর কয়েকটি তরুণ তরুণী সেগুলোর উপর ঝুঁকে রয়েছে। ‘দোস্ত, এইসবও হয়েছে, আমি নিশ্চিত, আমি চলে যাওয়ার পর।’ জাভেদ মাথা ঘুরিয়ে চারপাশের খাইয়ে লোকজনদের দিকে দেখালো।
‘কোন সব?’
‘এই কড়াই-গোস্তের ব্যবসা।’
‘হ্যাঁ এই খাবারটা একদম হালের আমদানি।’
জাভেদ আরো একবার চারপাশে তাকালো। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সারি, টেবিল, চেয়ার, খাবার খাওয়া লোকজন, সবকিছুর উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল সে, ‘দোস্ত, এই জায়গাটা ছিল এই শহরের সবচেয়ে শান্ত এলাকা।’ একটু থামল সে, তারপর যোগ করল, ‘আর অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো সবাই মিলে ওই একই টিক্কা কাবাব আর কড়াই-গোস্ত খাচ্ছে। আগে কিন্তু টিক্কা কাবাবের এত বেশি দোকান ছিল না, ছিল কি?’
আনোয়ারের কানে আদৌ কোন কথা ঢুকছিল না। তার চোখ আটকে ছিল তন্দুরের দিকে। ‘বড্ড সময় নিচ্ছে, আমাদের খাবার এখনো এলো না।’
জাভেদ সময় নিয়ে চারপাশটা নজর বুলিয়ে দেখতে থাকল। ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, সুসজ্জিতা তরুণীরা, ভুঁড়ি-ওয়ালা পুরুষেরা - সবাই খাওয়ায় মত্ত। কাছাকাছি একটি টেবিলে গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক লোক, ঘেমে-নেয়ে একসা, একাগ্র হিংস্রতায় সে তার খাবারের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এক টেবিলে এক স্যুট-বুট পরা লোক আর সুন্দর কায়দা করে শাড়িটি জড়িয়ে এক আকর্ষণীয় চেহারার যুবতী মাঝখানে একটি ফাঁকা কড়াই নিয়ে বসে আছে। তরুণীর থালায় হাড়ের পাহাড়, আরেকটি হাড় নিয়ে প্রাণপণ চুষছে সে। চারপাশে যেদিকে তাকাও মাংস ভরা কড়াই নিয়ে টেবিলের পর টেবিল, একটার পর একটা প্রকান্ড কামড় অনিঃশেষ গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে, সর্বত্র শুধু চোয়ালের ওঠা-নামা, কড়মড় আওয়াজ, চিবোনো আর চম্প-চম্প করে খাবার ছিঁড়ে নেওয়া। জাভেদ যেন পরিষ্কার দেখতে পেল চোয়ালগুলো ক্রমাগত বড় হয়ে উঠছে। খুব দ্রুত ওর বিস্ময় আতঙ্কে রূপান্তরিত হলো।
‘দোস্ত, আনোয়ার,’ খুব উদ্বেগের সঙ্গে বলল সে, ‘লোকেরা বড্ড বেশি খেতে শুরু করেছে আজকাল।’
আনোয়ার ওর কথা শুনতে পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। ওদের টেবিলে কড়াই এসে গেছে। ‘আয়, এবার ঝাঁপিয়ে পড়া যাক।’
জাভেদ একটা ছোট টুকরো মুখে পুরে ভাবল, ‘আমার চোয়ালগুলো প্রকান্ড বড় হয়ে গেছে।’
দোস্ত তুই কিন্তু কিছুই খাচ্ছিস না।
খাচ্ছি, খাচ্ছি।
উঁহু, খাচ্ছিস না। এখানে বিনয় করে লাভ নেই। এ হচ্ছে কড়াই-গোস্ত। এ জিনিস সাবাড় করে দিতে হবে সেই আদিম গুহা মানবদের মতো।
আনোয়ারকে খুশি করার জন্য সে বেশ কয়েকটা বড় বড় কামড় দিল। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ওর খাওয়ার গতি কমে এলো। ‘দোস্ত, খালিদ কেমন আছে রে? আমি বাকিদের কারো সাথে এখনো দেখা করিনি।’
‘খালিদ?’ আরেকটা বড় গ্রাসের জন্য আনোয়ারের বাড়ানো হাত মাঝপথেই থেমে গেল। ‘খালিদের কথা আমি বলিনি তোকে?’
‘না, বলিসনি তো।’
আনোয়ার মুখের খাবারটা গিলে নিল, তারপর নরম স্বরে বলল, ‘খালিদ আর বেঁচে নেই রে দোস্ত।’
‘কি বলিস … ওকেও?’ চিন্তায় হারিয়ে গেল সে। ‘দোস্ত আমাদের কত জন বন্ধুর চলে যাওয়ার কথা বলছিস রে তুই, কতজন যে মরে গেছে এই দু বছরে!’
‘এই দু বছরে লোকেরা খুব তাড়াতাড়ি মরে গেছে।’
‘আর তারা সবাই মারা গেছে তাদের নিজেদের ঘরে নিজেদের বিছানায়।’ জাভেদের গলায় একটা হালকা বিস্ময়ের সুর।
‘মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?’ ধাক্কা খেয়েছে আনোয়ার।
‘ওখানে লোকেরা অন্য রকমভাবে মারা যায়। ওদের চিরাচরিত মরার পদ্ধতি সমন্ধে আমাদের কোন ধারণা নেই।’ একটু থামল সে, তারপর আবার বলল, ‘সেই জন্যই রাশীদের মৃত্যু আমাদের কাছে এমন অস্বাভাবিক লেগেছিল।’
‘রাশীদ? মরে গেছে ও? রাজশাহীতে থাকত না?’
‘হ্যাঁ, থাকত। কিন্তু শেষের দিকে ও রাজশাহী থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এখানে এসে ও আমার কাছে ওঠে, কয়েকদিন থাকে, তারপর একদিন মরে যায় - বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে আর মরে পড়ে থাকে।’
‘তার মানে, রাশীদও মরে গেছে,’ বিড়বিড় করল আনোয়ার, কিছুটা দু:খে, কিছুটা নিজের মনে।
‘আমরা ঠিক মতোই ওর কাফনের জোগাড় করেছিলাম, দাফনও হয়েছিলো সুন্দর করে।’
কি কথার ছিরি! আনোয়ারের মনটা তেতো হয়ে গেল।
‘রাশীদের মৃত্যুটাই মনে হয় ঐ দেশে শেষ স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল,’ ওর আগের করা মন্তব্যটার ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বলল জাভেদ। তারপর সে চুপ করে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুজনেই চুপচাপ বসে রইল। অল্পই খেল তারা, খাবার নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল, জল খেল তারপর পিঠে হেলান দিয়ে বসে রইল। জাভেদ আরও একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। মুখগুলো পাল্টে গেছে। অনেকগুলো টেবিলে নতুব কড়াই চলে এসেছে, নতুন চোয়াল নিয়ে নতুন খাইয়েরা একইরকম ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে চলেছে। চোয়ালগুলো বড় থেকে আরও বড় হয়ে উঠছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘আমি ফিরে আসার পর থেকে তুই জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছিস আমার কেমন লাগছে, আমার কি প্রতিক্রিয়া, তাই তো?’
‘ঠিক।’
‘দোস্ত, প্রথমটায় আমার মনে হয়েছিল এখানে সবকিছু পাল্টে গেছে, সবকিছু। খুব ধাক্কা লেগেছিল আমার, প্রায় দিশেহারা অবস্থা। আস্তে আস্তে আমি দেখতে পেলাম কোন কিছু বদলায়নি এখানে; আমার আবার দিশেহারা লাগছে।’
‘এই দু'রকম মনে হওয়ার মধ্যে যোগসূত্রটা কি?’ আনোয়ার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।’
‘এই দুইয়ের মধ্যে একেবারেই কোন যোগ-সূত্র নেই। যাকগে, যেতে দে,’ বলল জাভেদ আর চট করে অন্য কথায় চলে গেল। ‘এখানকার পরিস্থিতি কেমন সেইটা বল আমায়।’
‘বলার মতো কিছু নেই।’ এতক্ষণে আনোয়ার এমনই হতাশ হয়ে পড়েছিল যে ওর আর নতুন কোন গল্প করার ইচ্ছে হল না।
‘তা হলে গতকাল কার কথা বলছিলি?’
‘আমি বলছিলাম? আমার মনে পড়ছে না।’
‘সেই, কাকে যেন গুলি করা হয়েছে?’
‘ও, মির্জার কথা বলছিস?’
‘মির্জা গুলিতে মারা গেছে? কে গুলি করলো ওকে?’
‘ও একটা বিক্ষোভ প্রদর্শনী থেকে ফিরে যাচ্ছিল। রাস্তায় খুব ভিড় ছিল।’
‘বিক্ষোভ প্রদর্শনীগুলোর এই মুশকিল। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তা, কি ঘটলো তারপর?’
‘ও রাস্তা পার হল … বড়জোর চার কদম যেতে পেরেছিল যখন কেউ একটা গুলি চালাল আর ও সাথে সাথে মরে পড়ে গেল।’
‘কিন্তু গুলিটা চালালো কে আর কেনই বা?’
‘কেউ একজন তো বটেই - ঐরকমই, চালিয়ে দিয়েছে।’
‘অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত, ভীষণই। তারপর কি হলো?’
‘কিছু না, এইটুকুই।’
‘কি বলছিস তুই, আর কিছুই ঘটেনি তারপর?’ জাভেদের গলায় এখন ভয় ধরে গেছে।
‘না, কিছুই না। কি ঘটতে পারত এর পরে?’
‘একটা লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, আর তারপরে কিছু ঘটল না। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই নয় কি, আনোয়ার?’
‘হয়তো ঠিকই বলেছিস তুই। এই কথাটা আমি ভাবিনি কখনো আগে।’
‘এই কথাটা তুই ভাবিসনি আগে?’ ও আনোয়ারের দিকে খানিকটা বিস্ময় আর খানিকটা ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
‘হ্যাঁ রে দোস্ত,’ খানিকটা লজ্জা পাওয়ার মতন বলল আনোয়ার আর কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে জাভেদের দিকে তাকাতে শুরু করলো।
‘জাভেদ!’
‘হ্যাঁ! কি বলছিস?’
‘দোস্ত,’ একটু ভয়ে ভয়ে শেষবারের মতো একবার বাজিয়ে নিতে চাইল আনোয়ার, ‘নিশ্চয়ই ভয়ংকর সব খারাপ ঘটনা ওখানে দেখেছিস তুই … তাই না?’
একটু দ্বিধা করলো জাভেদ। ‘হ্যাঁ,’ দুঃখের সঙ্গে বলল ও, ‘ঠিকই বলেছিস তুই। কিন্তু, আমরা এইটুকু অন্তত জানতাম যে আমাদের সাথে কেন সেগুলো ঘটছে … অন্তত: আমরা বুঝতাম কী ঘটছে।’
উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ: রক্ষণদা জলিল
****
লেখক পরিচিতি:
‘এখনকার খবর? এখানকার ব্যাপারে আমি আর কি বলব তোকে?’
এই আচমকা প্রশ্নটা আনোয়ারের হিসেবের মধ্যে ছিল না। হয়তো তেমন সচেতনভাবে নয়, হতে পারে অবচেতনেই, সে ঠিক করে নিয়েছিল যে, যা হবার হবে। চারপাশের সবকিছু সে খেয়াল করত ঠিকই কিন্তু এখন যখন এখানকার অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হলো, সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ‘কি হয়েছিল এখানে?’ জাভেদ আবার প্রশ্ন করল।
‘এখানে?’ আনমনে কথাটা আবার আওড়াল আনোয়ার, আর তারপর চিন্তার গলি ঘুঁজিতে হারিয়ে গেল। শেষে একসময় সে এইটুকু বলে উঠতে পারল, ‘দোস্ত, কিছুই ঘটেনি এখানে।’
‘কিচ্ছু ঘটেনি?’
‘সত্যি বলছি কিচ্ছু ঘটেনি। ওখানে যা সব ঘটতে দেখেছিস তার তুলনায় এখানে কিছুই ঘটেনি।’
‘সত্যি বলছিস! আমরা তো ওখানে বসে ভাবছিলাম যে এখানেও অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে।’
‘সত্যি বলছি দোস্ত কিছুই ঘটেনি এখানে, আদৌ কিছু না।’
‘কিন্তু এখানেও তো যুদ্ধ হয়েছিল একটা, হয়নি কি?’
‘হ্যাঁ যুদ্ধ একটা হয়েছিল।’ আনোয়ারের গলা শোনা যায় কি যায় না। তারপর আর কোনো কথাবার্তা নেই। দুজনেই একেবারে চুপ। যে উৎসাহ নিয়ে আনোয়ার কথাবার্তা শুরু করেছিল এখন তা মিইয়ে গেছে। জাভেদও আসলে প্রশ্নটা করেছিল কথার কথা হিসেবে; তেমন কিছু কৌতূহল বা আগ্রহ ছিল না তাতে।
আনোয়ার মুখ খুলল আবার, ‘আসলে এখানে বাইরে থেকে কোন আক্রমণ আসেনি। যা কিছু ঘটেছে, এখানেই ভিতর থেকে পচে গিয়েছিল।’
‘বাইরে থেকে কখনোই কিছু ঘটে না,’ জাভেদ খুব আন্তরিকতার সাথে বলল. ‘যা ঘটে ভিতর থেকেই ঘটে।’
‘না, সব সময় তা হয় না।’ বেশ রাগের সঙ্গে বলল আনোয়ার। ‘ঐখানে যা ঘটেছিল, তার বেশিরভাগটাই বাইরে থেকে আক্রমণ। আর এখানে যা ঘটেছে সবটাই ভিতর থেকে। আর এর বেশিটাই ঘটেছে যুদ্ধের পরে।’
‘সত্যি?’
‘ঠিক তাই।’
‘কিন্তু, হয়েছিলটা কি?’
‘স্ট্রাইক, লকআউট, মিছিল, প্রতিবাদ, রাস্তায় রাস্তায় মারামারি, ছাত্র-অশান্তি, গ্রেপ্তার …’
জাভেদ ওদের সামনে পড়ে থাকা একটা ইলাস্ট্রেটেড ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে তার পাতা উল্টাতে লাগলো। ম্যাগাজিনটা সকাল থেকেই টেবিলের উপর পড়ে থাকলেও হয় তার সেটা দেখার সময় হয়নি অথবা পড়ার ইচ্ছে হয় নি। কিন্তু এখন ম্যাগাজিনটা তাকে এমনভাবে টানছিল যে সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলনা। এই ম্যাগাজিনের ছবিগুলো তার অসম্ভব ভালো লাগে।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহযুদ্ধের মতোো কিছু একটা শুরু হয়েছিল। সারি সারি ব্যারিকেড দাঁড় করানো হলো, স্টেনগান চলল আর বুলেটের আওয়াজ শোনা গেল সারা রাতভর।’
‘এইটা মজার হয়েছে,’ হাসলো জাভেদ।
‘মানে?’
‘এই কার্টুনটা। এই যে …’ জাভেদ ম্যাগাজিনটা আনোয়ারের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
থিতিয়ে গিয়ে আনোয়ার কার্টুনটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করল, ‘হ্যাঁ ভালোই।’ তারপর একেবারে চুপ করে গেল।
‘চল, একবার বাইরে থেকে ঘুরে আসি,’ বলল জাভেদ।
‘ঠিক আছে।’
‘বাড়িতে থাকলে আমরা বারবার একই কথা ঘুরে ফিরে বলতে থাকবো। আমায় দেখতে আসা লোকেদের স্রোত লেগেই থাকবে। সবার একই প্রশ্ন, উত্তরও একই। এইটা এখন বন্দিত্বের নতুন সংজ্ঞা। চল দোস্ত, বেরিয়ে পড়ি।’ সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ভিতরের দরজার দিকে হেঁটে গেল, তারপর চিৎকার করে জানিয়ে দিল, ‘আমি আনোয়ারের সাথে বের হচ্ছি।’ এরপর দুজনে রাস্তায় নেমে পড়ল।
‘দোস্ত, সিন্ধের রায়টের ব্যাপারে কিছু শুনেছিলি?’ আনোয়ারের হঠাৎ মনে পড়ে গেল কতটা বিপজ্জনক আর কি মর্মান্তিক ছিল সেই সংকট। জাভেদকে এটা জানানো খুব দরকার।
‘রেডিও বুলেটিন থেকে তুই কিছুই বুঝতে পারবি না। আশ্চর্য সব ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে এখানে। অগুনতি লোক মারা গেছে। কতজনের যে ঘরবাড়ি ছারখার হয়ে গেছে। লিয়াকৎ মার্কেটটা তো দেখেছিস নিশ্চয়ই। কি বিশাল বাজার ছিল ওটা। জ্বালিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। একটা প্রাণীও জীবিত বের হতে পারেনি …।’
‘দোস্ত, পেটে আর উরুতে এই চৌখুপ্পিগুলোর ব্যাপারটা কি বলতো?’ চলা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল জাভেদ।
আনোয়ার মাঝপথে থেমে গিয়ে জাভেদ যেদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সেই দিকে চোখ ফেরাল। সিনেমা হলের সামনে একটা পোস্টার ঝুলছে, সেটায় এক আধা-ন্যাংটো মেয়ের ছবি। তার সুগঠিত উরু আর পেটের উপর একসারি করে চৌখুপ্পি আঁকা রয়েছে। এই ছবিটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকবার আনোয়ার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগ্রহ নিয়েই দেখতো। কিন্তু এখন এটার দিকে তাকিয়ে সে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ‘বাদ দে, দোস্ত,’ বলল সে তারপর দুজনে মিলে এগিয়ে গেল।
‘আইস্ক্রিম খাবি?’ আনোয়ার একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
‘ঠিক আছে।’
আইস্ক্রিম খেতে খেতে জাভেদের নজর পড়ল একটি মেয়ের দিকে, ফ্ল্যাপার পরা, বড় বড় গোল গগলস। যতক্ষণ না মেয়েটি দোকান ছেড়ে চলে গেল ততক্ষণ সে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেল।
‘দোস্ত, আনোয়ার, আমার মনে হয় আমার এখানে না থাকার সাথে সাথে বেল-বটমও হাওয়া হয়ে গেছে।’
‘আর টাইট প্যান্টও।’
‘ঠিক, টাইট প্যান্ট আর টাইট শার্টও … দোস্ত, তুই কিন্তু এখনও আমাকে বলিসনি, এখানে কি ঘটেছিল।’
‘দেখতেই পাচ্ছিস, কি ঘটেছে,’ মিচকি হেসে বলল আনোয়ার, ‘বেল-বটম চলে গেছে আর ফ্ল্যাপার এসেছে।’
‘এটা কিন্তু কোন ছোট ব্যাপার নয়,’ বলল জাভেদ।
‘না, না খুবই বড় ব্যাপার,’ আনোয়ারের গলায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল। একটু থামলো ও, তারপর প্রশ্ন করল, ‘তা এই বড় ব্যাপারটা নিয়ে তোর কি মতামত?’
‘দোস্ত আমি এখনো এই ফ্ল্যাপার ব্যাপারটার সাথে নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে উঠতে পারিনি।’ আইসক্রিম শেষ করে কাপটা একটা ময়লা ফেলার জায়গায় ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ‘এখন যেতে পারি আমরা?’
‘চল যাওয়া যাক।’
এগিয়ে গেল তারা।
এখন আর আনোয়ারের মনটা অত গুরুগম্ভীর হয়ে নেই। কিন্তু ছোটখাট নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে জাভেদের কৌতূহল দেখে সে আর প্রশ্ন না করে পারল না, ‘এখন যখন তুই এখানে এসে পড়েছিস, সব দেখে শুনে তোর প্রতিক্রিয়া কি?’
‘প্রতিক্রিয়া? আমার প্রতিক্রিয়া? কি বলতে চাইছিস তুই?’
‘মানে, বন্ই দশায় এতগুলো বছর কাটিয়ে আসার পর এখন কেমন লাগছে তোর?’
‘কি জানিস, কেমন অদ্ভুত একটা …’ কথার মাঝখানে থেমে গেল জাভেদ।
‘কি হল?’
‘ওই অল্পবয়সী ছেলেটাকে দেখ … একটা গোলাপি সালোয়ার পরে আছে। আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, ওটা সিল্কের।’
‘কি এলো গেল তাতে?’
‘তার মানে এতে কোন গোলমাল নেই, সব ঠিকঠাক? সত্যি?’ জাভেদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, ‘আজকাল অল্প বয়সীদের কি এইসব রং আর এইরকম কাপড়ই পছন্দ? আমি আরো ছেলে-ছোকড়াদের দেখেছি, উজ্জ্বল রং আর সিল্কের সালোয়ার-কুর্তা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, এখন এসব ভালই চলছে। শোন, কড়াই-গোস্ত খাবি?’
‘কড়াই-গোস্ত?’
‘হ্যাঁরে হ্যাঁ, রাতের খাবার সময় তো প্রায় হয়েই গেছে, এখন আর বাড়ি গিয়ে দরকার কি? চল, কড়াই-গোস্ত খেয়ে একটা লম্বা হাঁটা লাগানো যাক।’
ভিড় ছিল ভালো রকম। রাস্তার দু'ধারে গাড়ি দাঁড় করানো। লন এবং ফুটপাথ, দুই জায়গাতেই চেয়ার-টেবিল পাতা রয়েছে। সব টেবিলে লোক বসে আছে। একটা বিশাল ছাগলের ছবির নিচে আগুনে ঝলসানো মাংসের গোটা গোটা ঠ্যাং সারি দিয়ে ঝোলানো রয়েছে। উনুনগুলো গজরাচ্ছে, হিস্ হিস্ শব্দ করছে, আর চারপাশে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে দিচ্ছে।
‘দোস্ত রে, এই জায়গাটা বড্ড ভিড়।’
‘চিন্তা করিস না। টেবিল একটা তাড়াতাড়িই জুটে যাবে।’ বলতে বলতেই আনোয়ারের নজর পড়লো দূরে একটা টেবিল খালি হচ্ছে। সে লাফিয়ে সেই দিকে এগিয়ে গেল। টেবিলটা ছিল ফুটপাথের উপরে। কাছেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা গাড়ির বনেটকে টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটার উপরে মাংস ভরা গোটা দুয়েক কড়াই সাবধানে রাখা হয়েছে আর কয়েকটি তরুণ তরুণী সেগুলোর উপর ঝুঁকে রয়েছে। ‘দোস্ত, এইসবও হয়েছে, আমি নিশ্চিত, আমি চলে যাওয়ার পর।’ জাভেদ মাথা ঘুরিয়ে চারপাশের খাইয়ে লোকজনদের দিকে দেখালো।
‘কোন সব?’
‘এই কড়াই-গোস্তের ব্যবসা।’
‘হ্যাঁ এই খাবারটা একদম হালের আমদানি।’
জাভেদ আরো একবার চারপাশে তাকালো। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সারি, টেবিল, চেয়ার, খাবার খাওয়া লোকজন, সবকিছুর উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল সে, ‘দোস্ত, এই জায়গাটা ছিল এই শহরের সবচেয়ে শান্ত এলাকা।’ একটু থামল সে, তারপর যোগ করল, ‘আর অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো সবাই মিলে ওই একই টিক্কা কাবাব আর কড়াই-গোস্ত খাচ্ছে। আগে কিন্তু টিক্কা কাবাবের এত বেশি দোকান ছিল না, ছিল কি?’
আনোয়ারের কানে আদৌ কোন কথা ঢুকছিল না। তার চোখ আটকে ছিল তন্দুরের দিকে। ‘বড্ড সময় নিচ্ছে, আমাদের খাবার এখনো এলো না।’
জাভেদ সময় নিয়ে চারপাশটা নজর বুলিয়ে দেখতে থাকল। ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, সুসজ্জিতা তরুণীরা, ভুঁড়ি-ওয়ালা পুরুষেরা - সবাই খাওয়ায় মত্ত। কাছাকাছি একটি টেবিলে গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক লোক, ঘেমে-নেয়ে একসা, একাগ্র হিংস্রতায় সে তার খাবারের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এক টেবিলে এক স্যুট-বুট পরা লোক আর সুন্দর কায়দা করে শাড়িটি জড়িয়ে এক আকর্ষণীয় চেহারার যুবতী মাঝখানে একটি ফাঁকা কড়াই নিয়ে বসে আছে। তরুণীর থালায় হাড়ের পাহাড়, আরেকটি হাড় নিয়ে প্রাণপণ চুষছে সে। চারপাশে যেদিকে তাকাও মাংস ভরা কড়াই নিয়ে টেবিলের পর টেবিল, একটার পর একটা প্রকান্ড কামড় অনিঃশেষ গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে, সর্বত্র শুধু চোয়ালের ওঠা-নামা, কড়মড় আওয়াজ, চিবোনো আর চম্প-চম্প করে খাবার ছিঁড়ে নেওয়া। জাভেদ যেন পরিষ্কার দেখতে পেল চোয়ালগুলো ক্রমাগত বড় হয়ে উঠছে। খুব দ্রুত ওর বিস্ময় আতঙ্কে রূপান্তরিত হলো।
‘দোস্ত, আনোয়ার,’ খুব উদ্বেগের সঙ্গে বলল সে, ‘লোকেরা বড্ড বেশি খেতে শুরু করেছে আজকাল।’
আনোয়ার ওর কথা শুনতে পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। ওদের টেবিলে কড়াই এসে গেছে। ‘আয়, এবার ঝাঁপিয়ে পড়া যাক।’
জাভেদ একটা ছোট টুকরো মুখে পুরে ভাবল, ‘আমার চোয়ালগুলো প্রকান্ড বড় হয়ে গেছে।’
দোস্ত তুই কিন্তু কিছুই খাচ্ছিস না।
খাচ্ছি, খাচ্ছি।
উঁহু, খাচ্ছিস না। এখানে বিনয় করে লাভ নেই। এ হচ্ছে কড়াই-গোস্ত। এ জিনিস সাবাড় করে দিতে হবে সেই আদিম গুহা মানবদের মতো।
আনোয়ারকে খুশি করার জন্য সে বেশ কয়েকটা বড় বড় কামড় দিল। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ওর খাওয়ার গতি কমে এলো। ‘দোস্ত, খালিদ কেমন আছে রে? আমি বাকিদের কারো সাথে এখনো দেখা করিনি।’
‘খালিদ?’ আরেকটা বড় গ্রাসের জন্য আনোয়ারের বাড়ানো হাত মাঝপথেই থেমে গেল। ‘খালিদের কথা আমি বলিনি তোকে?’
‘না, বলিসনি তো।’
আনোয়ার মুখের খাবারটা গিলে নিল, তারপর নরম স্বরে বলল, ‘খালিদ আর বেঁচে নেই রে দোস্ত।’
‘কি বলিস … ওকেও?’ চিন্তায় হারিয়ে গেল সে। ‘দোস্ত আমাদের কত জন বন্ধুর চলে যাওয়ার কথা বলছিস রে তুই, কতজন যে মরে গেছে এই দু বছরে!’
‘এই দু বছরে লোকেরা খুব তাড়াতাড়ি মরে গেছে।’
‘আর তারা সবাই মারা গেছে তাদের নিজেদের ঘরে নিজেদের বিছানায়।’ জাভেদের গলায় একটা হালকা বিস্ময়ের সুর।
‘মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?’ ধাক্কা খেয়েছে আনোয়ার।
‘ওখানে লোকেরা অন্য রকমভাবে মারা যায়। ওদের চিরাচরিত মরার পদ্ধতি সমন্ধে আমাদের কোন ধারণা নেই।’ একটু থামল সে, তারপর আবার বলল, ‘সেই জন্যই রাশীদের মৃত্যু আমাদের কাছে এমন অস্বাভাবিক লেগেছিল।’
‘রাশীদ? মরে গেছে ও? রাজশাহীতে থাকত না?’
‘হ্যাঁ, থাকত। কিন্তু শেষের দিকে ও রাজশাহী থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এখানে এসে ও আমার কাছে ওঠে, কয়েকদিন থাকে, তারপর একদিন মরে যায় - বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে আর মরে পড়ে থাকে।’
‘তার মানে, রাশীদও মরে গেছে,’ বিড়বিড় করল আনোয়ার, কিছুটা দু:খে, কিছুটা নিজের মনে।
‘আমরা ঠিক মতোই ওর কাফনের জোগাড় করেছিলাম, দাফনও হয়েছিলো সুন্দর করে।’
কি কথার ছিরি! আনোয়ারের মনটা তেতো হয়ে গেল।
‘রাশীদের মৃত্যুটাই মনে হয় ঐ দেশে শেষ স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল,’ ওর আগের করা মন্তব্যটার ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বলল জাভেদ। তারপর সে চুপ করে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুজনেই চুপচাপ বসে রইল। অল্পই খেল তারা, খাবার নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল, জল খেল তারপর পিঠে হেলান দিয়ে বসে রইল। জাভেদ আরও একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। মুখগুলো পাল্টে গেছে। অনেকগুলো টেবিলে নতুব কড়াই চলে এসেছে, নতুন চোয়াল নিয়ে নতুন খাইয়েরা একইরকম ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে চলেছে। চোয়ালগুলো বড় থেকে আরও বড় হয়ে উঠছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘আমি ফিরে আসার পর থেকে তুই জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছিস আমার কেমন লাগছে, আমার কি প্রতিক্রিয়া, তাই তো?’
‘ঠিক।’
‘দোস্ত, প্রথমটায় আমার মনে হয়েছিল এখানে সবকিছু পাল্টে গেছে, সবকিছু। খুব ধাক্কা লেগেছিল আমার, প্রায় দিশেহারা অবস্থা। আস্তে আস্তে আমি দেখতে পেলাম কোন কিছু বদলায়নি এখানে; আমার আবার দিশেহারা লাগছে।’
‘এই দু'রকম মনে হওয়ার মধ্যে যোগসূত্রটা কি?’ আনোয়ার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।’
‘এই দুইয়ের মধ্যে একেবারেই কোন যোগ-সূত্র নেই। যাকগে, যেতে দে,’ বলল জাভেদ আর চট করে অন্য কথায় চলে গেল। ‘এখানকার পরিস্থিতি কেমন সেইটা বল আমায়।’
‘বলার মতো কিছু নেই।’ এতক্ষণে আনোয়ার এমনই হতাশ হয়ে পড়েছিল যে ওর আর নতুন কোন গল্প করার ইচ্ছে হল না।
‘তা হলে গতকাল কার কথা বলছিলি?’
‘আমি বলছিলাম? আমার মনে পড়ছে না।’
‘সেই, কাকে যেন গুলি করা হয়েছে?’
‘ও, মির্জার কথা বলছিস?’
‘মির্জা গুলিতে মারা গেছে? কে গুলি করলো ওকে?’
‘ও একটা বিক্ষোভ প্রদর্শনী থেকে ফিরে যাচ্ছিল। রাস্তায় খুব ভিড় ছিল।’
‘বিক্ষোভ প্রদর্শনীগুলোর এই মুশকিল। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তা, কি ঘটলো তারপর?’
‘ও রাস্তা পার হল … বড়জোর চার কদম যেতে পেরেছিল যখন কেউ একটা গুলি চালাল আর ও সাথে সাথে মরে পড়ে গেল।’
‘কিন্তু গুলিটা চালালো কে আর কেনই বা?’
‘কেউ একজন তো বটেই - ঐরকমই, চালিয়ে দিয়েছে।’
‘অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত, ভীষণই। তারপর কি হলো?’
‘কিছু না, এইটুকুই।’
‘কি বলছিস তুই, আর কিছুই ঘটেনি তারপর?’ জাভেদের গলায় এখন ভয় ধরে গেছে।
‘না, কিছুই না। কি ঘটতে পারত এর পরে?’
‘একটা লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, আর তারপরে কিছু ঘটল না। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই নয় কি, আনোয়ার?’
‘হয়তো ঠিকই বলেছিস তুই। এই কথাটা আমি ভাবিনি কখনো আগে।’
‘এই কথাটা তুই ভাবিসনি আগে?’ ও আনোয়ারের দিকে খানিকটা বিস্ময় আর খানিকটা ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
‘হ্যাঁ রে দোস্ত,’ খানিকটা লজ্জা পাওয়ার মতন বলল আনোয়ার আর কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে জাভেদের দিকে তাকাতে শুরু করলো।
‘জাভেদ!’
‘হ্যাঁ! কি বলছিস?’
‘দোস্ত,’ একটু ভয়ে ভয়ে শেষবারের মতো একবার বাজিয়ে নিতে চাইল আনোয়ার, ‘নিশ্চয়ই ভয়ংকর সব খারাপ ঘটনা ওখানে দেখেছিস তুই … তাই না?’
একটু দ্বিধা করলো জাভেদ। ‘হ্যাঁ,’ দুঃখের সঙ্গে বলল ও, ‘ঠিকই বলেছিস তুই। কিন্তু, আমরা এইটুকু অন্তত জানতাম যে আমাদের সাথে কেন সেগুলো ঘটছে … অন্তত: আমরা বুঝতাম কী ঘটছে।’
উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ: রক্ষণদা জলিল
****
লেখক পরিচিতি:
প্রখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক, ছোট গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক ইন্তিজার হুসেইন উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী গল্পকারদের একজন। জন্মে ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের বুলান্দশহরের দিবাইতে। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পাকিস্তানের লাহোর-এ চলে যান। লিখেছেন ‘বস্তি’, ‘নয়া ঘর’ এবং ‘আগে সমুন্দর হ্যায়’ নামের তিনটি উপন্যাস। ‘লীভ্স’, ‘দি সেভেন্থ ডোর’. ‘এ ক্রনিকল অফ দি পীককস’ এবং ‘অ্যান আনরিটন এপিক’ তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্প সংকলন। তাঁর লেখায় দেশভাগ পূর্ব জীবনের স্মৃতি যেমন ঘুরে ফিরে এসেছে তেমনি ধরা রয়েছে তাঁর জীবন-পাঠ যা একই সাথে সমকালীন এবং কালোত্তীর্ণ।
নিজের দেশে নানা সম্মানে ভূষিত ইন্তিজার হুসেইনকে ২০০৭ সালে ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি প্রেমচাঁদ ফেলোশিপে সম্মানিত করে। ২০১৩-তে ‘বস্তি’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর তাঁর নাম ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কারের মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ বিবেচিত নামের তালিকায় সংযুক্ত হয়। ২০১৪-তে পান ফরাসী সরকার-এর ‘অর্ডে ডেস আর্টস এট ডেস লেটার্স ‘-এর সম্মান।
বর্তমান গল্পটি রক্ষণদা জলিল-এর ইংরেজি অনুবাদ সংকলন ‘দি ডেথ অফ শেহরজাদ’-এ সংকলিত Captive-এর অনুবাদ। গল্পটিতে দুই সৈনিক যাদের একজন সদ্য বাংলাদেশে থেকে যুদ্ধবন্দিদশা কাটিয়ে পাকিস্তানে ফিরে এসেছে, তাদের কয়েকটি ঘন্টা একসাথে কাটানো আর গল্প করার মধ্য দিয়ে ইন্তিজার তুলে ধরেন তাদের চারপাশের চলমান জীবনের ছবি আর তাকে নিয়ে কিছু বিমূঢ়তা যা একই সাথে সেই সময়ের এবং চিরকালীন।
অনুবাদক পরিচিতি:
অমিতাভ চক্রবর্ত্তী
কবি, গল্পকার, অনুবাদক
টেনিসিতে থাকেন
0 মন্তব্যসমূহ