শামসুজ্জামান হীরার গল্প : একজন রজব আলী

শালা শুয়ারকা বাচ্চা, কিছু ঠাওর করবার আগেই বাজখাঁই আওয়াজ আর ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড আঘাতে ভ্যানরিকশার সিট থেকে টলে পড়তে পড়তে কোনোমতে নিজেকে সামলে নেয় রজব আলী। চোখে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার দেখে। চিপা রাস্তা থেকে অসতর্কভাবে মেন রোডে উঠতে গিয়ে ভ্যানের গুঁতো লাগিয়ে দিয়েছে থানার বড়বাবুর মোটর সাইকেলে। ভ্যানরিকশা অহরহই একে অন্যে গুঁতোগুঁতি ঠেলাঠেলি করে -- চাকায় চাকায় জড়াজড়ি বাঁধিয়ে স্পোক ভাঙে কটকট -- একে অন্যেতে অশ্লীল ভাষায় বাক্য বিনিময় হয়, কিন্তু থানার বড়বাবুর ঝকঝকে একশ পঁচিশ সিসি মোটর সাইকেলের গায়ে গুঁতো -- কল্পনারও বাইরে। অথচ এমনই একটা ঘটনা ঘটে গেল পবিত্র জুমার দিন দুপুর বেলা এবং ঘটনার হোতা কিনা রজব আলীর মত হাড়জিরজিরে একজন লোক। বড়বাবুর চিৎকারে আশপাশের লোকজন, যাদের অধিকাংশই পথচারী থমকে দাঁড়াল -- টিস্টল-হোটেল মুদিখানা আর পানবিড়ির দোকান থেকেও উৎসুক লোকেরা এসে ভিড় জমাল রাস্তার তেমাথায়।

-- রাস্তা দেইখ্যা ভ্যান চালাইতে পারিসনা ব্যাটা ? দেখি তোর কাগজপত্র। বড়বাবু খেঁকিয়েই চলেছেন।

লোকজন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এক যুবক, দেখে মনে হয় ছাত্র, চাপা স্বরে বলে, রিকশাভ্যানের আবার কাগজপত্র থাকে নাকি ?

-- চোপ্ রাও! তুমি আবার কোন চুদিরভাই; দালালি করতে আসছো নাকি? দুইটারেই থানায় নিয়া চল, এই রহিম মিয়া, (পাশে দাঁড়ানো সিপাইকে লক্ষ করে বলেন ওসি সাহেব) লকআপে ঢুকাইয়া পোন্দের উপর হান্টারের বাড়ি দিলে তেজ বাইর হইয়া যাইবো...

ভিড়ের আড়াল থেকে কে একজন বলে ওঠে, খুবই বেয়াদব ছোকরা, উঠতি মাস্তান, পাছায় বাড়ি পড়লি সাইজ হয়া যাবিনি...।

হঠাৎই দুম্ করে থেমে যায় শোরগোল। রাস্তার ওপাশে ইটের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে নিতাই পাগলা -- মাঝবয়সী, সারা মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, লিকলিকে নোংরা শরীর -- সম্পূর্ণ দিগম্বর; ঘন কালো ঝোপের মধ্য থেকে কাছিমের মাথার মত বেরিয়ে-আসা অঙ্গটা ডান হাতের মুঠোয় নাড়ছে আর হেঁড়ে গলায় গাইছে, ‘আমার সোনার বাংলা ...’

সবার দৃষ্টি এখন নিতাই পাগলার দিকে। ওসি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। পরক্ষণেই কোমরে ঝোলানো রিভলবার হাতে নিয়ে নিতাইয়ের দিকে তাক্ করে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ধর শালারে, ওর পাগলামি ছুটাইয়া দেই। আনো তো দেখি কেউ একটা চাক্কু, সোনাডা কাইট্যা ওর হাতে ধরাইয়া দেই। ওসির দেশের বাড়ি নোয়াখালী।

বড়বাবুর হুঙ্কারে ভড়কে যায় নিতাই, ইটের পাঁজা থেকে লাফিয়ে পড়ে ‘ঠোলায় গুলি করল রে, আমারে মাইরা ফালাইল রে’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ভোঁ-দৌড়! জড়ো-হওয়া লোকগুলো হাঃ হাঃ, হিঃ হিঃ, হেঃ হেঃ, হোঃ হোঃ শব্দ তুলে হাসতে থাকে। খুব মজার একটা নাটক উপভোগ করছে যেন সবাই!

রজব আলীর মাথা ঝিমঝিম করছে। লোকজনের কোলাহল কানের ভেতর অদ্ভুতভাবে বাজছে । ভ্যানরিকশার হ্যান্ডেল আকড়ে ধরে মাথাটা বুকের ওপর ঝুলিয়ে কোনোমতে বসে আছে সে।

মাথায় গোল টুপি, জানুর নিচে ঝোলানো পাঞ্জাবি আর গিঁঠের ওপর ওঠানো চুড়িদার পাজামা-পরা সফেদ শ্মশ্র্রুম-িত নুরানি চেহারার এক মাওলানা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মসজিদের দিকে -- জুমার নামাজ আদায় করতে। ভিড় ঠেলে এসে ওসি সাহেবের গা ঘেঁষে দাঁড়ান। আদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত শুনে মোলায়েম সুরে বলেন, মাফ কইরা দ্যান স্যার, ক্ষমাকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন। লোকটা একসময় মুক্তি আছিল। আমারেও কম জ্বালায় নাই, মাফ কইরা দিছি ...

মাওলানার অনুরোধে শান্ত হন ওসি। মোটর বাইকের পিঠে বিশাল বপুটি চাপিয়ে ভটভট শব্দ তুলে স্থান ত্যাগ করেন।

রজবের ঘনিষ্ঠ কজন এগিয়ে আসে ওর কাছে। কেউ একজন দরদ-ভেজা স্বরে বলে, আহা-হা শরীলডার কী হাল! এই বয়সে এত খাটাখাটনি সয় ? ভ্যান চালান সাজে ?

-- না চালালি খাবি কী ? পেটের ভাত জুটাতি আর তো কোনো পথ নাই রজব মিয়ার, ওরে দেখপার আছেডা কে? অন্য একজন বলে।


দুই

রজব আলী, একাত্তরের টগবগে যুবক, বেপরোয়া মুক্তিযোদ্ধা এখন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। রোগা বৌ, বৃদ্ধা মা আর সে -- সংসারে থাকার মধ্যে এখন এই তিনজনই। দুই সন্তান -- এক ছেলে ও এক মেয়ে বিয়েথা’ করে আলাদা সংসার পেতেছে । ছেলেটাকে অনেক চেষ্টা করেও লেখাপড়া করাতে পারেনি। মহল্ল¬ার বখাটে ছোকরাদের সঙ্গে মিশে একেবারে উচ্ছন্নে যাচ্ছিল, বাধ্য হয়ে এক বন্ধুকে বলে-কয়ে সাভারের এক গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিয়ে করে ওখানেই থাকে। ভিটেবাড়ির যে ক-ডেসিমেল জায়গা ছিল বিক্রি করে মেয়েটাকে পার করেছে -- বেশি দূরে নয়, নিশিন্দাপুর গ্রামের এক কৃষকপরিবারে। আল্লার রহমতে ভালোই আছে ।

রজব আলীকে এখন একাই টানতে হয় সংসারের বোঝা। ভিটেমাটিহীন রজব আলী পানিউন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর ছাপরা তুলে মাথা গুঁজে আছে কোনোমতে। শোনা যাচ্ছে বাঁধের ওপর দিয়ে চওড়া রাস্তা তৈরি হবে খুব শিগগিরই। বাঁধের ঢালে গজিয়ে-ওঠা সব ঘর-ছাপরা ভেঙে দেয়া হবে। তখন কী হবে? কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজবে রজব? দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় ওর শরীর আরও ভেঙে পড়ছে।

ভূমিহীনদের নাকি সরকার খাস জমি বরাদ্দ দেবে। রজবকে অনেকে বুদ্ধি দিয়েছে এ-ব্যাপারে চেষ্টা-তদবির করতে। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো উৎসাহ থাকলে তো! ধর্না দিতে দিতে ঘেন্না ধরে গেছে ওর। বায়াত্তর থেকেই তো ধর্না দিচ্ছে -- ফল কী হয়েছে! পাকিস্তানিদের খেদাতে পারলে সোনার বাংলা কায়েম হবে -- কত স্বপ্নœ ছিল রজবের চোখে! বায়াত্তর থেকে দুহাজার পাঁচ -- কত বছর? হিসেব করতেও হিমশিম খায় সে। সোনার বাংলা দেখতে কেমন? ওর বুড়ি মা আর ব্যারামি বউয়ের মলিন মুখে সোনার বাংলা দেখবার চেষ্টা করে! বুড়ি মা ছাপরার পাশে ঢোলকলমি আর ডুমুর গাছের ছায়ায় পা ছড়িয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে বসে সারাদিন পচা-পাটের-আঁশের মত চুলে আপন মনে ঘন ঘন হাত ছোঁয়ায় আর দুহাতের বুড়ো আঙ্গুলে টিপে টিপে উকুন মারার ভান করে -- এটা ওর বাতিক। আর বৌ? সন্নিপাতিক জ্বরে ভুগে ভুগে এখন কঙ্কালসার । বয়স যে খুব বেশি, তা নয়। বায়াত্তরে রজবের সঙ্গে বিয়ের সময় বেশি হলে এগারো কি বারো । বুকে ঝুলে-থাকা লাউ দুটো তখন অবাত্তি কদবেলের মত। গেরস্তঘরে অমন চেহারাসুরত নজরে পড়ে না খুব একটা। বেপরোয়া রজব গোঁ না ধরলে বিয়েটা কি হয়! প্রতিবেশী এবং মুক্তি -- রজবের প্রতি কিশোরী সকিনার মুগ্ধতা যে ছিল না, তা বলা যাবে না। কিন্তু রজবের মত ছন্নছাড়া লোকের হাতে মেয়ে তুলে দিতে কোন বাপের মন সায় দেয়! সকিনার বাপ ইচ্ছা না থাকলেও শেষ অব্দি বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল।

জোয়ান বয়সে রজব আলীই বা দেখতে শুনতে কম ছিল কিসে! উঁচা-লম্বা তাগড়া -- গায়ের রংটাই যা একটু ময়লা। বাপ-দাদার পেশা ছিল নাও বাওয়া, ওরও তাই। বড়াল নদীতে নৌকোয় পাইট দিত, খেপ মারত বিনোদবাড়ি ঘাট আর সাত মাইল দূরের রেল ইস্টিশনের মধ্যে। আয়রোজগার একেবারে মন্দ ছিল না। যুদ্ধশেষে ওই একই কাজে লেগে পড়ল। ওর সঙ্গে যারা যুদ্ধ করেছিল, বিশেষ করে দেশ স্বাধীন হবার পর যারা যুদ্ধ করেছিল, তাদের অনেকেরই দেখতে দেখতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। মোটামাথা রজব ওর বন্ধু অনেকের শনৈঃশনৈঃ উন্নতি দেখত আর তাজ্জব মেরে যেত! নিজেকে বোঝাত, ওরা নেকাপড়া জানে, আমি তো মুরুখ্খু ... পয়সা বানাতি হলি প্যাঁচগোছ জানা নাগে গো...।

কী জানি কী কারণে দেখতে দেখতে বড়াল শুকিয়ে এল। বর্ষা-মৌসুম ছাড়া নৌকো চলে না। অন্যদিকে রাস্তাঘাটেরও তরতর উন্নতি। মাঝির কাজ করে পেট চালানো দায় হয়ে পড়ল এক সময়। বাধ্য হয়ে এটা-ওটা কাজ। কখনও টঙ দিয়ে পানবিড়ির ব্যবসা, কখনও ডিম সেদ্ধ করে পথের ধারে বসে বিক্রি করা। বোকাসোকা রজব আলী -- সব ব্যবসায়ই ফেল। অবশেষে কী আর করা, ভ্যানরিকশায় প্যাডেল মারো।


তিন

আজকের ঘটনায় খুবই মুষড়ে পড়েছে রজব। যত যা-ই হোক এলাকার লোকজন কিছুটা হলেও এখনও ওকে অন্য চোখে দেখে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর অত্যাচারে যখন গ্রামকে গ্রাম উজাড়, পুরুষরা জান আর মেয়েরা ইজ্জত বাঁচাতে পালিয়ে বেড়ায় ভীতসন্ত্রস্ত হরিণের মত, তখন এই রজব যে-হিম্মত দেখিয়েছিল, প্রবীণদের কেউ কেউ এখনও ভোলেনি সে-কথা। তাছাড়া এখনও যে-কজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচেবর্তে আছে তাদের অনেকেই রজব আলীকে ভালোবাসে -- শ্রদ্ধা করে; ওর নির্লোভ স্বভাব আর অন্যের সুখে-দুঃখে সাড়া দেবার জন্যই বোধহয়।

বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের জরুরি সভা বসল। আজকের ঘটনা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার -- ইউয়েনও সাহেবের সঙ্গে কথা বলা দরকার; এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। ইউয়েনও সাহেব সজ্জন-সৎ এবং জনদরদি হিসেবে এরই মধ্যে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন।

আবদুুর রাজ্জাক, রগচটা স্বভাবের মুক্তিযোদ্ধা, স্বাভাবিক স্বরে কথা বলা যার ধাতে সয় না, চিল্লিয়ে ওঠে, রজবের গালে চড় মানে আমাগের সক্কলের গালে চড়, রজব শুয়োরের বাচ্চা -- বাপ তুইলে গাইল -- আমরা সক্কলে শুয়োরের বাচ্চা ; বিচার না করলি আমরা দেখায়া দেব, হু... কমান্ডার নরম হলি চলবি লয়, কলাম কিন্তু ...

কমান্ডারের ভুসিমাল আরও কী যেন সব ব্যবসা আছে -- অনেকে বলে দুনম্বরি কারবার। অবস্থা ভাল, উপজেলা সদরে আড়ত এবং দোতলা বসতবাড়ি -- বিল্ডিং। একটু আমতা আমতা করে বলে, ঘটনাডা খুবই দুঃখজনক... এর একডা বিহিত করতিই হবি... বীর মুক্তিযোদ্ধা রজব ভাইয়ের উপর টরচার বরদাস্ত করা হবি না। কী এমন আনলিগাল কাম করছিল যে ঐ রকম দুব্ব্যবহার করতি হবি? সামান্যি এট্টু গুতা...! তো কথা হইলে, খুব ভাইবা চিন্তা কাম করতি হবি, মাথা গরম করলি উল্টা ফল হতি পারে...

উপস্থিত একজন গজ গজ করে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, শালা দুই নম্বরি, বেলাইনে লিয়ে যাতি চায় বিষয়ডারে ... উল্টা ফল আবার কী?

অনেক উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা আলাপ-আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয়, আগামীকালই ইউয়েনও সাহেবের কাছে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এবং সেই সঙ্গে রজব আলীর বসবাসের জন্য এক টুকরো খাস জমি বরাদ্দের দাবি জানানো হবে।

পরদিন সকালে যথারীতি জনাদশেক মুক্তিযোদ্ধা দল বেঁধে রওনা হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে দেখা করতে। পায়ে-হাঁটা পাঁচ-সাত মিনিটের পথ। রজব আলী আসেনি। গত রাত থেকে জ্বর আর পেটে ব্যথা। পেটে ব্যথাটা অবশ্য অনেক দিন থেকেই। হেলথ্ কমপ্লেক্সের ডাক্তার ব্যথার ওষুধ আর অ্যান্টাসিড খেতে বলেছিলেন। না সারলে মাস খানেক পর আবার দেখা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এক মাস পেরিয়ে গেছে সেই কবে।

মুক্তিযোদ্ধার দল মেন রোড ধরে এগোচ্ছে। পথের ধারে এক পুরনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উলঙ্গ নিতাই পাগলা ঠিক একইভাবে নাড়ছে তার শিশ্নটি আর মুখে সেই একই গান। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওর দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে খিস্তি করে ওঠে, শালার জ্বালায় আর বাঁচা গেল না, ভাগ শালা ... গেলি...! নিতাইয়ের কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না, ভাঙা রেকর্ডের মত গানের ওই একটি কলি কখনও ঠিকভাবে কখনও বা উল্টাপাল্টাভাবে গাইতেই থাকে। নিতাইয়ের জীবনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। একাত্তরে পাকবাহিনীর ব্রাশফায়ারে পরিবারের সবাই নিহত হলেও ও বেঁচে গিয়েছিল বাড়িতে না থাকায়।

নির্বাহী অফিসারের চেম্বারে পৌঁছেছে ওরা। ছিমছাম পরিপাটি চেম্বার। পুরু গদি-আঁটা রিভলবিং চেয়ারে বসে ইউয়েনও সাহেব । বয়স দেখে চল্লিশের নিচেই মনে হয়। চকচকে চেহারা, ক্লিন শেভড্, নাকের ডগায় ছোট্ট দু-ফালি কাঁচের চশমা। পেছনের দেয়ালে ঝোলানো সরকারপ্রধানের সুদৃশ্য ছবি। কে কবছর এই উপজেলাটিকে শাসন করে গেছেন তাঁদের নামের তালিকা। হাট-বাজার মাদ্রাসা-মসজিদ ইস্কুল-কলেজ মায় স্যানিটারি পায়খানা সংক্রান্ত তথ্যে ঠাসা ‘একনজরে উপজেলা’।

মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই সমাদর করেন ইউয়েনও সাহেব, এখনও করছেন। পিয়নটাকে চা-বিস্কুট আনার হুকুম দিয়েছেন। খুব আন্তরিকভাবে খোঁজখবর নেন দেশের সূর্যসন্তানদের হালহকিকত সম্পর্কে। ওঁরা দেশটা স্বাধীন করেছিলেন বলেই তো আজ এত সহজে তিনি এ চেয়ারে। মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি কী যে চিন্তা-ভাবনা করেন তা হাত নেড়ে, মাথা বাঁকিয়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে, চোখ ও ভুরুর নানা রকম ভঙ্গি করে বোঝানোর চেষ্টা করেন। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আধঘণ্টা অনর্গল কথা বলে শেষে জানান, একটু পরে, মানে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাঁকে বেরোতে হবে। মতলবপুর মাদ্রাসায় বার্ষিক কেরাত প্রতিযোগিতার বিরাট মাহফিল। বিএনপি ও জামায়াত নেতারা উপস্থিত থাকবেন এবং মাননীয় এমপি মহোদয়ও মাহফিলে উপস্থিত থাকার সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন, বুঝতেই তো পারছেন, ছোট চাকরি করি ... আমার শ্যালকের মরহুম চাচাশ্বশুরও অবশ্য আপনাদের মত একজন সূর্যসন্তান ছিলেন, কিন্তু...

-- স্যার, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে গতকাল বড়বাবু, মানে ওসি সাহেব...

-- ব্যাপারটা আপনারা বলার আগেই আমি জেনে গেছি। মুক্তিযোদ্ধা আর অমুক্তিযোদ্ধা সবাইকেই তো নিয়ম মেনে চলতে হবে...। বুঝতেই তো পারছেন, আইন সবার জন্য সমান; আর গণতন্ত্র মানে হল আইনের শাসন। তাছাড়া থানার লোকদের উপর আমার তো কোনো এক্তিয়ার নাই...

-- কিন্তু স্যার...

-- ওকে। আপনারা যদি ঘটনাটাকে খুবই সিরিয়াস মনে করেন তাহলে ওনার ডিপার্টমেন্টের কোনো সুপিরিয়র অফিসারকে জানাতে পারেন। দিস্ মাচ আই ক্যান সে...

-- আরেকটা ব্যাপারে আপনার কাছে আরজি ছিল স্যার; রজব ভাইয়ের মাথা গোঁজার ...

-- রজব ভাইটা কে?

-- যে মুক্তিযোদ্ধাকে কাল ওসি সাহেব ...

-- ওহ, হ্যাঁ, তা মাথা গোঁজার কী সমস্যা আবার?

-- উনাকে যদি একটুকরা খাস জমি, মানে একটা ঘর তুলবার সামান্য একটু জমি বরাদ্দ দেওয়ার...

-- এই যে দেখেন, আপনারা সূর্যসন্তান অথচ দেশের নিয়মকানুন সম্পর্কে খোঁজখবর, ডোন্ট মাইন্ড, খুব একটা রাখেন বলে মনে হচ্ছে না; খাস জমি বণ্টন করার জন্য একটা কমিটি আছে, কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে; জমি দেওয়ার মালিক আমি এই ধারণা আপনাদের দিল কে? স্ট্রেঞ্জ!

-- আপনি, আপনি স্যার যদি একটু...

-- আমার দেরি হয়ে গেল, ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললেন ইউয়েনও সাহেব, আপনারা যখন খুশি চলে আসবেন আমার কাছে, একটুও হেজিটেট করবেন না। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস। আজ তা হলে উঠি...

-- মুক্তিযোদ্ধারা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে, তারপর লাইন ধরে বেরিয়ে আসে নির্বাহী অফিসারের কক্ষ থেকে । ডায়বেটিস রোগী রমজানের তলপেট ফাটি ফাটি ভাব -- পড়িমরি ছোটে সে পেচ্ছাবের জায়গার খোঁজে।


চার

রজব আলীর পেটে ব্যথা বেড়েই চলেছে -- সাথে জ্বর এবং বমি। কিছু পেটে দিলে উগড়ে আসে। হেলথ্ কমপ্লেক্সের ডাক্তার ভুরু কুঁচকে বললেন, জানেনই তো এখানে চিকিৎসার সুযোগ কতটুকু, রুগিকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান.... বেশ কিছু টেস্ট করাতে হবে -- এখানে সে সুযোগ নাই...।

জেলা হাসপাতালের ডাক্তার আল্ট্রাসনো, এন্ডোস্কোপি আর কী যেন বলে সেগুলো করতে বললেন, কিন্তু হাসপাতালের যন্ত্রপাতি অনেকদিন ধরেই অকেজো হয়ে পড়ে আছে তাই ওগুলো বাইরের কোনো ক্লিনিক থেকে করাতে হবে। ডাক্তার সাহেবের অবশ্য খুবই আস্থা ‘ফ্লোরিডা ডায়গনষ্টিক সেন্টার’-এর ওপর। ওই ক্লিনিকের একটা কার্ডও ধরিয়ে দিলেন রজব আলীর সঙ্গীদের হাতে। বললেন, টেস্টগুলো করায়ে রিপোর্ট দেখাবেন, রুগিকে আনার দরকার নাই...।

বিভিন্নজনের কাছ থেকে সংগ্রহ-করা সাহায্যের টাকায় কোনোমতে পরীক্ষাগুলো করা গেল। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন, সাস্পেক্ট এডিনো কারসিনোমা, তবে বায়োপ্সি না করলে কনফার্ম হওয়া যাবে না। বায়োপ্সি করা দরকার। রুগির অপারেশন লাগবে মনে হয়।

রোগীর সঙ্গীদের একজন জিজ্ঞেস করল, স্যার, ওই যে কী যেন বললেন এডিনো... ওইটা কী রোগ, স্যার?

ডাক্তার চোখ তুলে তাকালেন, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, স্টমাক ক্যানসার; সিওর না, অনুমান করতেছি ...

রোগের নাম শুনে সঙ্গীদের চেহারায় বিষাদের ছায়া নেমে এল। রজবের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু আফজাল তো প্রায় কেঁদেই ফেলে।

আবার পয়সা সংগ্রহের চেষ্টাতদবির। বাজারের দোকানে-দোকানে সাহায্য প্রার্থনা; কিন্তু তেমন সাড়া মেলে না কোথাও। নির্বাহী অফিসার সাহেব অবশ্য খুবই মূল্যবান পরামর্শ দিলেন, আপনারা সময় নষ্ট না করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে চলে যান। ওখানে গেলে চিকিৎসার পুরা খরচ ওরা দিবে। সূর্যসন্তানদের কল্যাণের জন্যই তো ওই ট্রাস্ট। বুঝলেন তো অইটার উপর আপনাদের ট্রাস্ট থাকা উচিত। নির্বাহী অফিসার সাহেব যখন ‘সূর্যসন্তান’ কথাটা বলেন, তখন তাঁর কণ্ঠ আবেগে ভারী হয়ে আসে। শ্যালকের চাচাশ্বশুর সেই সূর্যসন্তান, যিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ হয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়!

যে কটা পয়সা ছিল তা-ই নিয়ে আফজাল রওনা হল ঢাকা। কল্যাণ ট্রাস্টের সংশ্লিষ্ট অফিসারকে ইনিয়েবিনিয়ে রজবের অসুস্থতার কথা জানাল। অফিসার টেলিফোন ধরা আর করায় খুবই ব্যস্ত; কখনও ফিক্সড ফোন, কখনও মোবাইল। এক ফাঁকে পান চিবোতে চিবোতে বলল, অত কথা শুনিয়া তো আমার লাভ নাই, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সুপারিশ না থাকলে আমরা কোনো স্টেপ নিতাম পারি না...।

কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে গিয়ে জানা গেল, কাউন্সিলের চেয়ারম্যান দেশের বাইরে, দিন পনেরো পর ফিরবেন। তাছাড়া আরও একটা সমস্যা তো আছেই --মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ইস্যু-করা সর্বশেষ সার্টিফিকেট না থাকলে কাজ হবে না। রজবের নেই। আফজালের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। পনেরো দিন দেরি -- আবার সার্টিফিকেট তোলা -- কী করবে ভেবে পায় না। ভাগ্যিস দূরসম্পর্কীয় এক আত্মীয়র বাসায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছিল, থাকা-খাওয়ার খরচাটা ওর বেঁচেছে। সময় পেলে মোবাইলে রজবের খোঁজ-খবর নেয়, ঢাকার অবস্থা জানায়।

সার্টিফিকেট তোলার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে যেতে হল। গোব্দাগাব্দা চেহারা, গিরগিটির মত চোখঅলা এক কেরানি দ্রুত অঙ্গুলি সঞ্চালনে কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখল, তারপর দাঁত কেলিয়ে বলল, ফাইলটায় নোট দিয়া পাঠাইয়া দেই; মাস খানেক পরে আইসা সার্টিফিকেট নিয়া যাইয়েন।

-- এতো দেরি! হতাশা মেশানো গলায় বলে আফজাল।

-- তাড়াতাড়ি করারও ব্যবস্থা আছে, তার জন্য অবশ্য অফ্খ ...

বিস্মিত আফজাল বলে, অফ্খ মানে? এটার মানে তো ...!

-- বুঝলেন না, তাই না ? অফিস খরচ, সংক্ষেপে অফ্খ, এব্রিভিয়েশন ..., দাঁত কেলিয়েই বলে লোকটা, অফ্খটা হইল গিয়া ফুয়েল। ফাইলেরও তো চলন লাগে, ফুয়েল ছাড়া কি কিছু চলে? তয় বিভিন্ন কিসিম আছে এর, সিয়েনজি, ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন; কাজের ধরন অনুযায়ী। আপনেরটা তো সিয়েনজি, মাত্র এক হাজার। অকটেনে হয় না এমন কোনো কাম নাই, হেঃ হেঃ...

বারো দিন লেগে যায় অফ্খর ব্যবস্থা করে সার্টিফিকেট তুলতে। আঠারো দিনের দিন কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সুপারিশপত্র। সব কাজ সমাধা করে কল্যাণ ট্রাস্টে যাওয়ার পর খুব গুরুত্ব সহকারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু ঘেঁটে জানানো হল, হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক, একদম ঝকঝকে কাগজপত্র; সামনের মিটিঙেই প্লেস করা যায় -- পনেরো বিশ দিন পরেই মিটিং। তাড়াহুড়া থাকলে নিজ খরচে পেশেন্টের চিকিৎসা করায়ে খরচের পাকা ভাউচার দাখিল করতে পারেন, পয়সা পাইয়া যাবেন। তবে হ্যাঁ, পাঁচ হাজার টাকার বেশি কিন্তু দেওয়া যাইব না, সিলিং, ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে পারছি তো ?

আফজালের মনে হল, মাথার ঘিলুর মধ্যে মাছি জাতীয় কিছু একটা ঢুকে অনবরত পিনপিন শব্দ করে চলেছে। বাকরুদ্ধ, ধ্বস্ত আফজাল কোনোমতে নিজেকে টেনে বার করে নিয়ে আসে দম-আটকানো কক্ষটি থেকে। কেন জানি ওর মনে হচ্ছিল, কোথাও -- ঘরের ভেতর কোথাও একটা ধেড়ে ইঁদুর মরে পচে আছে।



পাঁচ

রজবের অবস্থা সংকটজনক। মুখে খাওয়া বন্ধ সে প্রায় দুসপ্তাহ তো হল। এখন শুধু শিরা-স্যালাইনের ওপর। বুকের ধুকপুকুনিটা না থাকলে ওকে জীবিত ভাববার কোনো জো ছিল না । ঢাকা থেকে আফজাল যেদিন ফিরল -- রজব ‘কোমা’তে।

২০০৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ১২ তারিখ রাত ৯ টা ৩৩ মিনিটে বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোহাম্মদ রজব আলী উপজেলা হেলথ্ কমপ্লেক্সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন (ইন্না লিল্লাহে... ... রাজেউন)। শেষনিশ্বাস ত্যাগের সময় তাঁর পাশে, একেবারে নাক ঘেঁষে বসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, হাতের ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। ঘড়িতে তখন ৯:৩৩ ভেসে উঠেছিল। কমান্ডার অশ্রুতপূর্ব শব্দ করে কেঁদে উঠেছিলেন। উপস্থিত লোকেরা ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল মৃত জনাব রজব আলীর বেডের চারিদিকে, কেউ কাঁদছিল, কেউ ফোঁপাচ্ছিল, কেউ আবার বিড়বিড় করে পবিত্র কিতাবের কালাম আওড়াচ্ছিল। এত লোকের ভিড় আর আহাজারির তোড়ে মরহুমের স্ত্রী, শেষ দেখা দেখতে-আসা পুত্রকন্যা আর আত্মীয়স্বজনদের শোক প্রকাশের কোনো সুযোগই ছিল না বলা যায়।

দেখতে দেখতে হাসপাতাল লোকে ভরে উঠল। মোবাইলে খবর পেয়ে খোদ ইউয়েনও সাহেব ছুটে এসেছেন। তাঁর পরপরই থানার ওসি সাহেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ -- সাংবাদিক -- গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ -- জামে মসজিদের ইমাম -- সবাই হাজির। বিকেলে ডাক্তার শেষনিশ্বাস ত্যাগের সম্ভাব্য একটা সময় ঘোষণা করেছিলেন -- খুব একটা হেরফের হয়নি তাতে।

নির্বাহী অফিসার সাহেব থানার ওসি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও মসজিদের ইমাম সাহেবকে নিয়ে বসলেন জরুরি মিটিঙে। অতি জরুরি মিটিং। এলাকায় বেশ কবছর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলেন। বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্র্ণ এবং সেজন্য অতীব জরুরি মিটিং। মিটিঙের এজেন্ডা একটাই, মরহুম জনাব মোহাম্মদ রজব আলীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান। দাফন। দাফন সারার আগে অনেক আনুষ্ঠানিকতা। এটা তো সাধারণ কোনো মৃত্যু নয়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু -- অনেক আনুষ্ঠানিকতা। সরকার এ-ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস এবং স্ট্রিক্ট -- পান থেকে চুন খসলে খবর আছে!

নির্বাহী অফিসার সাহেব বয়সে তরুণ -- এই পদে প্রথম পোস্টিং । এবং সেকারণেই জীবনে এই প্রথম একজন মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্যানুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবার সৌভাগ্য অর্জনে ভেতরে ভেতরে পুলক ও রোমাঞ্চ বোধ করছিলেন -- কিছুটা দুশ্চিন্তাও। এ-ধরনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে ওঁর খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই তো। দুশ্চিন্তার কী আছে! বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাডারের সদস্য; বুদ্ধিতে, জ্ঞানগম্যিতে তাঁর ধারে কাছে ঘেঁষে এমন কে আছে! ওসি সাহেবকে লক্ষ করে বললেন, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আপনার ভূমিকাই প্রধান...। আর আপনি তো ঝানু অফিসার, বহু থানায় ওসিগিরি করে আসছেন, এ ধরনের কত অনুষ্ঠান করতে হয়েছে, কি বলেন?

-- তা ঠিক স্যার, কিন্তু আপনে হইলেন গিয়া স্যার, থানার মানে উপজেলার রাজা....

-- ছি ছি কী যে বলেন; আমরা সবাই মিলে একটা টিম, টিম স্পিরিট নিয়ে সব কাজ করতে হবে; তবে মূল দায়িত্ব তো কাউকে না কাউকে নিতে হয়, আপনাকে আমি এ কাজটার মূল দায়িত্ব দিতে চাই, (অন্যদের দিকে তাকিয়ে) কী বলেন আপনারা?

সবাই মাথা নেড়ে ইউয়েনও সাহেবের ইচ্ছার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। ওসি ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, জানাজাটা কখন হইলে ভাল হয়?

-- বাদ জোহর হলিই বেহ্তের, মুর্দারে বেশিক্ষণ রাখা ঠিক না...

-- কিন্তু এত কম সময়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা কি সম্ভব? আমার মনে হয়, বাদ আসর হইলেই ভাল হয়; প্রস্তুতির ব্যাপার আছে তো!

নির্বাহী অফিসার ওসির কথায় সায় দেন। প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। এ-ধরনের মুত্যু তো আর হরহামেশাই হয় না; ভবিষ্যতে অবশ্য ঘন ঘন হবে -- আমার উপজেলায় মোট ঊনাশিজন সূর্যসস্তান এখনও বেঁেচ আছেন -- তবে তাঁদের বেশির ভাগই বৃদ্ধ, অভাবগ্রস্ত ... হ্যাঁ ওসি সাহেব প্রস্তুতির ব্যাপারটা আপনার মুখ থেকেই শুনি, কী বলেন কমান্ডার?

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাথা নাড়েন। ইউয়েনও সাহেবের কথায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। উনি যা বললেন তাতে বড় জোর বছর দশেক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আয়ু!

-- প্রস্তুতি মানে স্যার, প্রস্তুতি মানে... আমার থানার তো এখন স্ট্রেংথ সাকুল্যে একুশজন -- অফিসার কন্সটেবল সব ধইরা। পাশের থানা থেইকা আরও কিছু স্টাফ আনতে পারলে অনুষ্ঠানটা জমতো।

-- আই উইল ট্রাই, পাশের থানার ইউয়েনও আমার ব্যাচমেট ... ঘনিষ্ঠ বন্ধু..., নির্বাহী অফিসার বলেন।

-- রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের কায়দাকানুন সকাল থেইকাই ওদের প্রাকটিস করান দরকার, কোনো খুঁত রাখা যাইব না ...

-- বেশ করান, আর?

-- থানায় নাই, জেলা থাইকা একটা বিগুলের ব্যবস্থা করলে খুব ভাল হইত, স্যার...

-- বিউগল, বিউগলে লাস্ট পোস্ট, করুণ সুর! আহ্, বিইউটিফুল! আপনার চিন্তাশক্তির প্রশংসা না করে পারি না। ভোর বেলাতেই কাউকে জেলাসদরে পাঠিয়ে দেন; আমি না হয় ডিসি স্যারকে দিয়া এসপি সাহেবকে বিশেষভাবে রিকোয়েস্ট করাবো এ ব্যাপারে.....

-- সকাল থাইকা মাইকিং করা দরকার স্যার, কমান্ডার মুখ খোলেন।

-- দ্যাটস্ রাইট, কমান্ডার সাহেব আপনেই লিখে ফেলেন মাইকিঙের ভাষা। লিখে ফাইনালটা আমাকে দেখায়ে নিবেন। ভাষায় বিশেষত্ব থাকতে হবে, সাদামাটা মৃত্যুসংবাদের মত না, শ্রদ্ধা আবেগ এই আরকি। আপনাকে আর কী বলব, ভাষায় তো আপনে প-িত, (ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা ইমাম সাহেব জানাজা কোথায় পড়ানো যায়? খেলার মাঠে না ঈদগায়?

-- এক জায়গায় পড়ালিই হয় স্যার, আপনে যেখানে ভাল মনে করেন...

-- খেলার মাঠে লোক ধরবে বেশি, তাছাড়া উপজেলা কমপ্লেক্সেরও কাছে, আমার মনে হয় ওখানে হলেই ভালো...। আরে আরে দেখেন, একটা কথা তো কারও মনেই আসে নাই, ইম্পোরট্যান্ট ম্যাটার, ডেডবডির উপর একটা বড়মাপের জাতীয় পতাকা থাকতে হবে তো; ফুলের রিং এসব ব্যবস্থাও করতে হবে। কত কাজ....। এগুলোর দায়িত্ব কমান্ডারের, কী বলেন? ইউয়েনও একটানা কথাগুলো বলে যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এক বীর মুক্তিযোদ্ধার দাফনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে সবাই উঠে পড়লেন।

সকাল থেকেই দুটো মাইকে প্রচার শুরু হল, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ রজব আলীর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সংবাদ। থানায় চলছে পুলিশদের মহড়া -- সামরিক কায়দায় সম্মান দেখানোর বিরতিহীন মহড়া। জেলাশহর থেকে বিউগল এসে পৌঁছুল দুপুর বারোটা নাগাদ। চকচকে পিতলের নাকি তামার শিঙা -- বিউগল; এ যন্ত্রটিকে সুর তোলার কাজে মিলিটারি আর পুলিশরাই শুধু ব্যবহার করে থাকে। সুর তোলা যে-সে কাজ নয়। দমের জোর লাগে, কৌশলের ব্যাপার তো আছেই। ফুঁ দিলেই বেজে ওঠে না দশটাকার বাঁশির মত। থানার পুলিশদের মধ্যে কে বিউগল বাজাতে পারে তা নিয়ে খোঁজ শুরু হল। পুলিশ লাইনে বিউগল বাজাতো একসময় এক হাবিলদার -- ডাক পড়ল তার। বহুবছর যন্ত্রটিতে হাত দেয়নি, তবু চেষ্টা করতে দোষ কী! বিউগলের নলে ঠোঁট ঠেকিয়ে গলা ফোলালো সে, অদ্ভুত আওয়াজ বেরোলো, র্ভে ভে র..র..র! নাহ্, হচ্ছে না, আগের মত দমও নেই, অনভ্যাসে বিদ্যাও লোপ পেয়েছে। তবু হাল ছাড়ে না হাবিলদার। অনেক চেষ্টার পর সুর বেরোলো, তবে তা করুণ সুর বলতে যা বোঝায় তার ধারে কাছেও না। ওসি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন -- প্রেস্টিজের ব্যাপার! ওর উৎসাহেই তো ইউয়েনও সাহেব এসপি স্যারকে বলে বিউগলের ব্যবস্থা করেছেন। থাক্, অনুষ্ঠানের সময় দেখা যাবে। হাবিলদারের পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিলেন, চেষ্টা চালাইয়া যাও... তুমি পুরানা লোক, ট্রাই করতে থাক, হইয়া যাইবো ইনশাল্লাহ,,,।

খেলার মাঠে লোকে গিজগিজ। জানাজা প্রায়ই হয়, কখনও ঈদগাহে কখনও খেলার মাঠে কিন্তু এরকম শানশওকতের সাথে জানাজা বহুবছর দেখেনি কেউ। আর জানাজায় এত পুলিশ, উপজেলার এত অফিসারের সমাবেশ -- লোকজনের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। মাইকে শুনল, রজব আলী মরেছে, এ কোন রজব আলী! রিকশাঅলা রজব আলীর মৃত্যুর কথাই তো জানে সবাই। লোলচর্ম এক বৃদ্ধ কোমরে দুহাত চেপে হেঁটে যাচ্ছিল ভিড়ের পাশ দিয়ে, দন্তহীন তোবড়ানো মুখ থেকে দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে আসে তার, আমাগের রজব, মুক্তি রজব তো রিস্কা চালায়া না খায়া না দায়া বিনা চিকিচ্ছায় মারা গেল, তার মরা লাশ লিয়ে অ্যাতো ধুমধাম করতিছে ক্যা! চোদ্দ-পনের বছরের দুজন চ্যাংড়া কোত্থেকে ছুটে এসে দাঁড়ায় মাঠের কিনারে, চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। একজন বলে ওঠে, আইজ মনে হয় কোনো গানটান হবি, মনে হয় কী জানি কয়, সাদিনতা দিবস! অন্যজন বলে, আরে ধুৎ, মনে হয় কোনো ডাকাইত ধরা পড়িছে, না হলি অ্যাতো পুলিশ ক্যা?

মাইকে ঘোষণা ভেসে আসে, এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ রজব আলীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখবেন জনাব... রাখবেন বক্তব্য জনাব ...জনাব বক্তব্য রাখবেন... বক্তব্য জনাব রাখবেন ... বক্তব্য জনাব... জনাব ... বক্তব্য ....

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাঁর বক্তব্যে কোন অ্যামবুশে তিনি মরহুমকে সঙ্গে নিয়ে কতজন পাকসেনা মেরেছিলেন, কোন রেইডে তিনি নিজের জান বাজি রেখে রজবকে রক্ষা করেছিলেন, কোন কোন সেক্টর কমান্ডার, বীর-উত্তম, বীর-প্রতীকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, এসব কথা সংক্ষেপে বললেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন একনিষ্ঠ সৈনিকের মৃত্যুতে বাঙালি জাতি কী হারাল তার বর্ণনা দিলেন এবং বিএনপি নেতা স্বাধীনতার ঘোষক মহান মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একজন আপসহীন ভাবশিষ্যের অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে কী পরিমাণ হোঁচট খেল তা তুলে ধরলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতা বাংলাদেশের আজাদির পেছনে তাঁর দলের যে সূক্ষ্ম কিন্তু বিশাল অবদান ছিল তা বয়ান করলেন ও মরহুম তাঁর মৃত্যুর আগে এটা বুঝতে পেরে যে জামায়াতে ইসলামীর একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন সে কথা বুলন্দ কণ্ঠে বয়ান করলেন এবং ওসি সাহেব আবেগমথিত গলায় মরহুমের সঙ্গে তাঁর অতীতের অনেক সুখস্মৃতি, অজানা কাহিনি শোনালেন এবং সর্বশেষে নির্বাহী অফিসার মহোদয় এদেশের সূর্যসস্তানদের প্রতি বর্তমান সরকারের কী গভীর মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধ তা নিখুঁতভাবে তুলে ধরলেন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাসে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার, (ফিসফিসিয়ে কমান্ডারের কাছ থেকে কী যেন জেনে নিয়ে) মানে জনাব রজব আলীর মহাপ্রয়াণ কী অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ ও গৌরবের ব্যাপার তাও বুঝিয়ে বললেন এবং সবাই মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করলেন ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করলেন ও মরহুম যে ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন সবাই যেন তা থেকে শিক্ষা নেন সেই আহ্বান রাখলেন এবং শোকে একসময় সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন! জাতীয় পতাকায়-ঢাকা রজব আলীর কফিনটা শহীদ মিনারের বেদিতে রাখা। কফিনের ওপর অমুক তমুকের শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখা পুষ্পস্তবক।

আলোচনা শেষে জামে মসজিদের ইমাম জানাজার নামাজ পড়াবার আগে সুললিত কণ্ঠে (ওয়াজ মাহফিলে কোকিলকণ্ঠী বক্তা হিসেবে ওঁর খুবই সুনাম) অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশে শরিয়তি সমাজ কায়েম করার যে খওয়াব দেখেছিলেন মরহুম মোহাম্মদ রজব আলী তাঁর ইন্তিকালের আগমুহূর্ত পর্যন্ত সেই খওয়াব কায়েমের কোশেশ করে গেছেন। আল্লাপাক যেন মাইয়েদের সেই এরাদা পূরণের তৌফিক আমাদের দান করেন। আমিন -- সুম্মা আমিন!

এবার মূল কাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর অন্তিম শয্যায় শোওয়ানো এবং তার প্রাক্কালে সামরিক কায়দায় সম্মান দেখানো। পুলিশের সুসজ্জিত দল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল কফিনকে সম্মুখে রেখে। থানার এক দারোগা চিৎকার করে কমান্ড দিলেন, পুলিশের দল রাইফেল তুলে ঠাস ঠাস শব্দ করে গার্ড অফ অনার দিল -- প্রেজেন্ট আর্ম। বিউগলে ঠোঁট চেপে গলা ফোলাতে থাকল হাবিলদার, বর্ষাকালে কোলাব্যাঙ যেমনটি ফোলায়, করুণ সুর তুলবার আপ্রাণ চেষ্টায় গলা ফোলাতেই থাকল; ওর চেহারা করুণ দেখাল, ক্ষোভে-দুঃখে নাকি শারীরিক ক্লেশে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল। আর ঠিক তখনই, বেসুরো গানের বিকট শব্দে সবার সচকিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মাঠ-ঘেঁষে দাঁড়ানো একতলা দালানের ছাতে। ছাতের ওপর নৃত্যরত উলঙ্গ নিতাই, ক্ষিপ্র হাতে নেড়ে চলেছে উত্থিত লিঙ্গটি এবং ফুসফুসের সর্বশক্তি জড়ো করে গলা ছেড়ে গেয়েই চলেছে, আমার সোনার বাংলা...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ