বাংলা উপন্যাসের নবাব

হামীম কামরুল হক

মহসীন হাবিব একদিন বললেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে যা করার সব সৈয়দ-রাই করল।’

‘কী রকম?’
‘এই যে সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এই দুই সৈয়দ তো মাস্টার।’
‘আর সৈয়দ শামসুল হক?’
‘তিনিও।’
‘তারপর আবদুল মান্নান সৈয়দ।’

‘ওই আর কী। সৈয়দদের সাহিত্যরথ এখনো অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলিতেছে।’
লক্ষ্যণীয় আমরা কেউই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের নাম করিনি। অথচ অনেক আগেই, মানে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি তাঁর ‘তৃণভূমি’, ‘উত্তর জাহ্নবী’ ও ‘নিশিলতা’র মতো তিনটা উপন্যাস পর পর পড়ে মুগ্ধ-বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘উত্তর জাহ্নবী’-র স্বর্ণ চরিত্রটাতো দিনে পর দিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমাকে। ‘অলীক মানুষ’টা খুঁজছিলাম হন্যে হয়ে। তার আগে পড়া হয়ে গেল ‘গোঘ’-র মতো অবিস্মরণীয় গল্প। এই এক গল্প পড়লেই যে কেউ তাঁর শক্তিটি টের পাবেন বলে বোধ করি। ওই সময় সুযোগ হলে এবং তেমন লোক পেলেই জিজ্ঞাসা করতাম, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা কেমন লাগে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জবাব এসেছে, ‘শুনেছি খুবই বড় লেখক, কিন্তু পড়া হয়ে ওঠেনি। ‘অলীক মানুষ’টা বলে খুবই ভালো লেখা। এটা পড়া নাকি এসেনসিয়াল।’ একদা প্রশান্ত মৃধার সঙ্গে মাহমুদুল হকের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কথা উঠেছিল। কথাটি সম্ভবত মাহমুদুল হক নিজেই তুলেছিলেন। বলেছিলেন, সুনীল (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) বাসায় সাহিত্য নিয়ে যে কটি কথা হয়েছিল, তাতে মুস্তাফা সিরাজের প্রসঙ্গ উঠলে সুনীল নাকি বলেছিলেন, ‘ভালোই লেখেন, কিন্তু ওনার লেখায় সেক্সটা একটু বেশি থাকে।’ আমাদের উদ্দেশে মাহমুদুল হক, বললেন, ‘এই এক কথায় মুস্তাফা সিরাজ শেষ।’ সুনীলের এই কথায় একটু মাহমুদুল হক একটু বিস্মিত হয়েছিলেন। আমরাও ঠিক মেনে নিতে পারিনি। সিরাজের লেখায় যৌনতা থাকে কিন্তু সেটি অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে। আর এটাই তো তাঁর একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। সিরাজের লেখা কতটা বলিষ্ঠ, (এখানে ‘বলিষ্ঠে’র জায়গায় ‘পাওয়ারফুল’ শব্দটি দিলে বর্তমানে, কারণে-অকারণে ইংরেজি ব্যবহার করা বাঙালির কাছে তা জোর পাবে বলে মনে হয়।) সেটি আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেন আরেক জন ঔপন্যাসিক অমলেন্দু চক্রবর্তী (দেখুন পাঠক, অমলেন্দু চক্রবর্তীও অত্যন্ত শক্তিমান একজন ঔপন্যাসিক। মৃণাল সেন তাঁর উপন্যাস ও গল্প থেকে দুটো চলচ্চিত্র করেছেন। তাঁর ‘অবিরত চেনামুখ’ গল্প থেকে ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), উপন্যাস ‘আকালে সন্ধানে’ থেকে ‘আকালে সন্ধানে’ (১৯৮০) সিনেমা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর কি জীবিত থাকার সময়ও কোথাও সেই অর্থে তাঁকে নিয়ে কোনো আওয়াজ শুনিনি)। সেই অমলেন্দু চক্রবর্তী নিজের ‘উপন্যাস ভাবনা’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন,“প্রতিবছর প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থের তালিকায় উপন্যাসের সংখ্যা যত দীর্ঘতর, শালপ্রাংশু ঔপন্যাসিকের ভগ্নাংশ খুবই সংক্ষিপ্ত। নিশ্চিতই সবটা নৈরাশ্যের নয়। অমিয়ভূষণ স্তব্ধ অনেক কাল। দেবেশ রায় আছেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়দের সঙ্গে অতি তরুণ কিছু লেখক তন্নিষ্ঠ আছেন তাঁদের ব্রতপালনে ঋজুবান। আমাদের প্রত্যাশা এই কতিপয়ের কাছেই।” (এবং মুশায়েরা, তৃতীয় বর্ষ, ৩য় ও চতুর্থ সংখ্যা, অক্টো-ডিসেম্বর ১৯৯৬, পৃ.৬৪)
বর্তমানে তো এক দেবেশ রায় ছাড়া অমলেন্দু চক্রবর্তী-উল্লিখিত সবাই প্রয়াত। সিরাজ প্রত্যাশাটি তৈরি করেছেন ‘অলীক মানুষ’, ‘তৃণভূমি’-র মতো উপন্যাস লিখে। বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন। এক কর্ণেলকে চরিত্র করে গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন। কিশোরদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন। মুসলিম স্থাপত্য, চিত্রকলা নিয়ে তাঁর সুগভীর জ্ঞান তাক লাগানোর মতো।

বিমল করের ‘আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা’ বই থেকে মুস্তাফা সিরাজ সম্পর্কে জানা গিয়েছিল আরো কিছু কথা। বিমল কর বইটির শেষে লেখকদের যে পরিচিতি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে আরো কয়েকটি তথ্য জুড়ে দিয়ে সিরাজের একটা তথ্যপঞ্জি তৈরি করা যেতে পারে: জন্ম: ১৪ অক্টোবর ১৯৩০। জন্মস্থান: খোশবাসপুর মুর্শিদাবাদ। পিতার নাম: সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌস। শিক্ষা: কলেজি শিক্ষা সম্পূর্ণ করেননি। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা, নানান জায়গায় কাজ করে থিতু হয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। প্রথম লেখার নাম এবং কবে কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল: আমার বাউল বন্ধুরা, দেশ, ১৯৪৯। ছদ্মনাম: শ্রীকান্ত রায়, মেহের আলী। ইবলিস ছদ্মনামেও লিখেছেন একসময়। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা দেড়শো ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে: উপন্যাস: অলীক মানুষ, তৃণভূমি, উত্তর জাহ্নবী, নিশিলতা, নিষিদ্ধ প্রান্তর, অমর্ত্য প্রেমকথা, মায়ামৃদঙ্গ। গল্প: রাণীঘাটের বৃত্তান্ত, গল্প সমগ্র (একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত)। রহস্যরোমাঞ্চ: কর্নেল সমগ্র।
এর বাইরে যেসব তথ্য যোগ হতে পারে সেগুলো হল: আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৯), ছোটদের সাহিত্যের জন্য রঞ্জিত স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪)। ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’-র জন্য দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার (১৯৯০)। আরো কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। তার ভেতরে এক ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন চারটি পুরস্কার: ভূয়ালকা পুরস্কার (১৯৯০), বঙ্কিম পুরস্কার (৯৯৪), সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৯৪), সুরমা চৌধুরী মেমোরিয়াল আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮)। প্রায় ছয় দশকের লেখক জীবন। তিনি গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে প্রায় ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ছাত্রজীবনে এবং পরে রাজনীতি ও গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লোকনাট্যদল ‘আলকাপে’র সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। আগে পরে অনেকদিন ধরেই বাউল, ফকির, বৈরাগী, সাধু, বাউণ্ডুলে, খুনী, ডাকাত আর ছিঁচকে চোরেরা ছিল তাঁর পরম বান্ধব। সাহিত্যজীবনে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, এর ভেতর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিমল করের মতে, এই দুই জন একসঙ্গে হলে তাদের আলাপের কথাবার্তা যারপরনাই উপভোগ্য হয়ে উঠত।
বিমল কর তাঁকে বলতেন ‘সিরাজ সাহেব’ আর শীর্ষেন্দু বলতেন, ‘এই যে বাংলার শেষ নবাব’। সিরাজের বাড়ি মুর্শিদাবাদ, তারওপর নামে সিরাজ শব্দটি আছে বলেই বোধকরি শীর্ষেন্দু এমনটা বলতেন। পিতা সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌস, অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, ছিলেন গান্ধীবাদী, যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে; মা একসময় কবিতা ও গল্প লিখতেন। সিরাজের একসময় ছন্নছাড়া স্বভাবটি পুরোদমে বাজায় ছিল। তারপর জীবনজীবিকার টানে কলকাতা বসবাস শুরু করেন, কিন্তু তাঁর গল্প-উপন্যাসের বেশিরভাগ গ্রামের পটভূমিতে লেখা।
মুস্তাফা সিরজের লেখা পড়েই কেমন একটা তারাশঙ্করীয় টান টের পেয়েছিলাম। কিন্তু এ তো তারাশঙ্করীয় ব্যাপার নয়, আরো কী যেন আছে, প্রবল সংবেদী গ্রামীণ জীবনের ভেতরকার অন্তর্ঘাতগুলি দেখা ও দেখানোর ভিন্ন এক ভঙ্গি তাকে যেন আলাদা করে দেয়। হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষজনকে এত নিবিড়ভাবে পাঠ ও পর্যবেক্ষণ বোধ করি খুব বেশি লেখকের লেখায় পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে গ্রাম ও নগরের কথাও ততটাই তাল মিলেয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিহাস, মানুষ ও সমাজ বিবর্তনের কথা উপন্যাসে যেভাবে পাওয়া যায় সেই দিক থেকে তাঁর লেখাগুলো বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রায় ষাট বছর ধরে যিনি লিখেছেন, তাঁর রচনার পরিমাণ এমনিতেই বিপুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সিরাজ সেই অর্থে তাঁর সমসমায়িক অন্যান্য লেখক যেমন সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ মজুমদার প্রমুখের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম লিখেছেন। তিনি তাঁদের মতো জনপ্রিয় সাহিত্যিকও ছিলেন না, কিন্তু খ্যাতির দিক থেকেও কোনো অংশে কম ছিলেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ তাঁকে যেমন খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে গেছে, সিরাজকেও ‘অলীক মানুষ’ সেমাত্রায় পৌঁছে যাওয়ার পথ করে দিয়েছে। কিন্তু একজন লেখক তো খ্যাতির জন্য লেখন না। আইজ্যাক বেশেভিস সিঙ্গার বলেছিলেন, তিনটি জিনিস লেখকে ধ্বংস করে দেয়, এক যে, লেখককে অবশ্যই সমাজতাত্ত্বিক এবং রাজনীতিবিদ হতেই হবে, যাতে সে সামাজিক দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পরে-- এই প্রবণতা লালন করা; দুই অর্থ লোভ এবং দ্রুত স্বীকৃতির বাসনা; তিন জোর করে মৌলিক হওয়ার চেষ্টা। নিজের গদ্য, রচনাশৈলী ও বর্ণনাভঙ্গিকে কী করে মৌলিক করে তোলা যায়, তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টায়, অতি-জবরদস্তিতে লেখকসত্তার মৃত্যু ঘটে। মূলত স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই লেখকের প্রকৃত লেখকত্ব । সিরাজের পাঠকেরা জানেন তার লেখা গভীরভাবে ইতিহাস রাজনীতি যেখানে আসার এসেছে, কিন্তু কোথাও মনে হয়নি যে তিনি ঠেঁসে ঠেঁসে সেটি প্রবেশ করিয়েছেন। লিখে তাঁর খ্যাতি ও অর্থবিত্ত বোধ করি ভালো মতোই অর্জিত হয়েছিল। আর তাঁর লিখনভঙ্গিমা তো একেবারেই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। তারপরও বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে তিনি ততটা পরিচিত ছিলেন না। এমনকি নিজে তাঁর একজন মুগ্ধ পাঠক হলেও ‘সৈয়দদের সাহিত্যকীর্তি’র দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁর কথাটি আমি মনে করতে পারিনি। আর এখন বাংলা সাহিত্যের বিংশশতকের প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁকে হিসেবে না রেখে কোনো তালিকা বোধ করি প্রণয়ন করা কঠিন। সেদিক থেকে তাঁকে ‘বাংলা উপন্যাসের নবাব’ বলতে আরামই লেগেছে। এটা কেবল উপাধির জন্য উপাধি দেওয়া নয়। মূলত তাকে দেওয়া শীর্ষেন্দুর নামটি থেকেই আমরা এই আখ্যাটি বেছে নিয়েছি। আবার এও সত্য সিরাজ যেটি করেছেন, হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক গভীর পাঠ, সে-বিচারে বাংলা উপন্যাসের এই দিকটিতে তাঁর রাজত্বটি স্বীকার না করে পারা যায় না। কেবল তাই নয়, তাঁর সাহিত্যে বাউল, ফকির, গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ও তাদের জীবনের যে স্পন্দন অত্যন্ত সংবেদনশীলতা ও মমত্বে ধরা পড়েছে, এর উদাহরণও বাংলাসাহিত্যে গুটি কয়েক লেখকের মধ্যে পাওয়া যায়। তারাশঙ্কর, সমরেশ বসু প্রমুখের লেখার ভেতর ইতিহাস, পটভূমিক সচেতনতা এবং মানুষের দেহমন ও শরীরী সংরাগ যেভাবে এসেছে সিরাজ সেই সিলসিলার পথিক হলেও তিনি নিজস্ব পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেটা বড় লেখকমাত্রই করে নিতে পারেন, আদতে হয়েও যায়। নিজের সীমাবদ্ধতার কথাও সিরাজ স্বীকার করেছেন অকপট ভাবে। গার্সিয়া মার্কেস তাঁর সমবয়সি হয়ে যে ‘সরলা ইরিন্দিয়েরা ও তাঁর নিঠুর দাদিমার কাহিনী’ লিখেছিলেন, সেই একই কাহিনী সিরাজের অভিজ্ঞতায়ও ছিলো, কিন্তু তিনি সেটি লিখতে পারেন নি। সিরাজের মানসকাঠামোর আরো একটি দিক ধরা পড়ে সালমান রুশদীর ‘দ্যা স্যাটনিক ভার্সেস’-এর সমালোচনায়। সিরাজের মতে, ধর্মের তার কাছে ব্যাধির মতো, কিন্তু কোনোভাবেই তিনি কোনো ধর্মকে আঘাত দিতে চান না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের উপর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি (সুনীল নিজে) সবচেয়ে যে বিষয়টি এড়িয়ে চলতে চান সেটি হল ধর্ম, বিশেষ করে তাঁর লেখার সূত্রে যদি ধর্মে বা কোনো সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। তাঁরা সাবধান থাকতে চেয়েছেন, তাঁরা মনে করেছেন আমাদের পাঠকরা আজো তৈরি হতে পারেনি। ফলে জর্জ বানার্ড শ’র মতো কেউ বলতে সাহসী হননি যে, ‘‘অল গ্রেট ট্রুথস বিগিন অ্যাজ ব্ল্যাসফেমিস।’’ বানার্ড শ’, বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো মনীষীরা ব্রিটিশদের এমন সব কথা বলতে পেরেছিলেন, কারণ সেই ধরনের সভ্য সমাজ সেখানে তৈরি ছিল, ছিল গণতন্ত্রের প্রকৃত ও প্রগাঢ় চেতনা। কিন্তু আমাদের লেখকদের অনেকটাই গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। এর ভেতরে লেখা হয় ‘লালসালু’, ‘চাঁদে অমাবস্যা’, ‘অলীক মানুষ’, ‘ফুলবউ’ ও ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র মতো উপন্যাস। এইসব উপন্যাসে বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় জীবনের নানান প্রকাশ্য ও চোরামোহ এবং অন্তঃশীলা পীড়ন যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা আমাদের আগামী দিনে আরো সাহসী হয়ে উঠতে সহায়তা করার কথা ছিল। কিন্তু দিনে দিনে উলটোটাই ঘটেছে। একদিকে ধর্মীয় বেড়ি আগের চেয়ে শক্ত হয়েছে; অন্য দিকে শরীর সম্পর্কে লালিত সংস্কার আমাদের মুক্তির সেই প্রান্তরে নিয়ে যেতে পারেনি যেখান থেকে সাহিত্যের নতুন যুগ শুরু হতে পারত। ফলে যে কন্দর্প দেবতা বা ইরোস শিল্পের শেকড়ে জল ঢালেন তার সেই জলে আমরা সিক্ত হতে পারি নি। ডি.এইচ. লরেন্সের একটি কথা এ প্রসঙ্গে এসেই পড়ে “ My great religion is a belief in the blood, the flesh, as being wiser than the intellect. We can go wrong in our minds. But what the blood feels, and believes, and says, is always true.. ” এই কথার সূত্রে প্রশ্ন জাগে, রক্তমাংসের এই প্রবল দাবীকে যে-লেখকরা অস্বীকার করেন, তারা আমাদের সত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারেন কি? কিন্তু সেই মুক্তির দিকে পথটি তো এদিনে নির্মিত হয় না। আমরা মাহ্বুব-উল-আলম-এর ‘মফিজন’-এর কথাটাইবা ভুলে যাচ্ছি কেন? তিনি যে সাহস দেখিয়েছিলেন, ধর্মের নামে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, এবং আত্মপীড়নের যে সুতীব্র দিকটি তিনি উন্মোচন করেছিলেন, সেদিকে আমরা খুব বেশি নজর দেইনি। দেওয়াটা বোধ করি দিনে দিনে আরো কঠিন করে তুলেছি। সেই দিক থেকে সিরাজের মতো লেখকের লেখা ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আমাদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়। সেখানে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের চলে যাওয়ার অভাবটি আমরা বোধ করি। *

লেখক পরিচিতি
হামীম কামরুল হক
প্রবন্ধকার ও গল্পকার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ