অনুবাদ: মোস্তফা তারিকুল আহসান
গল্প বলার সবচেয়ে মোক্ষম পদ্ধতি কি? যেহেতু একটি ভালো বা মানসম্পনড়ব গল্পের দিকেই পাঠকের আগ্রহ বেশি কাজেই একটা পদ্ধতির চেয়ে কয়েকটি ভালো পদ্ধতিই বেছে নেওয়া বরং উত্তম। এর কারণ হলো বিভিন্নবভাবে উপস্থাপিত বা নানা বিপরীত ভঙ্গিতে বর্ণনা করা কোন জীবন কাহিনীতে পাঠকের উৎসাহ বেশি। সাধারণত বেশিরভাগ সময় আমাদের প্রম আকর্ষণ থাকে কোন মানুষের অতীত বা ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে একটি চিত্রভাষ্য পাওয়া; লোকটি হয়তো অপরিচিত, অসাধারণ, যন্ত্রণাদীর্ণ বা সে হয়তো হাস্যময় চরিত্র অথবা এমন চরিত্র যা একথায় উল্লেখযোগ্যক বৈশিষ্ট্যের।
আমরা ঘটনাণমে অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়ি অথবা আমরা পর্যবেক্ষক হয়ে পড়ি এবং আমরা আগ্রহী হতে থাকি নতুন ঘটনা জানার জন্য। আর অবশ্যই অনুসন্ধানের কাজটি লেখক করেন। (পাঠকের সে কাজ করার দরকার পড়ে না)। তুমি দেখতে পারো একজন বিশুদ্ধ লোকের মুখ যে অনেক কয়েদীর মধ্যে জেলের ভেতরে নিচু হয়ে শিকল তুলছে; পরে তুমি দেখলে একই মুখ গির্জার বেদীতে যা কখনো ভোলা যায় না; সে অবশ্যই ভোঁতা ধরনের মানুষ আর সে জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে চাও না মোটেও যে জীবন বৈপরীত্যে ভরা। যদিও সে তার মতো জ্ঞান অর্জন করে অগোছালোভাবে আর থেমে থেমে। আবার হয়তো আমরা একজন মানুষ সম্পর্কে অনেক শুনি অথবা এমন কিছু শুনি যা সচারচর শোনা যায় না, যাকে আমার কখনো দেখিনি এবং আমরা চারদিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকি কখন আমাদেরকে তার সম্পর্কে বলা হবে যে, সে আমাদের সামনে বর্তমান। যা সে বলে বা করে আমাদের কাছে তার একটা আলাদা অর্থ থাকে। কারণ তার সম্পর্কে আমাদের পূর্ব থেকে কিছু জ্ঞান থাকে যা আসে মূলত শ্র“তি থেকে আর এগুলো আমাদের মধ্যে গেঁথে যায় -- হয়তার সম্পর্কে জোরালোভাবে প্রকাশিত বা উচ্চারিত সংলাপ থেকে অথবা ঘটনাকেন্দ্রিক মন্তব্য থেকে অথবা তার সম্পর্কে ছাপা বা না-ছাপা প্রতিবেদন থেকে জ্ঞান বা তথ্য চলে আসার এই পরোক্ষ উপায় সব সময় আমাদের উত্তেজিত করে এমনকি নৈর্ব্যক্তিক বিষয়েও তা সমান কার্যকর। রাসায়নিক একটি পরীক্ষা দেখার সময়
আমরা এক গভীর আকর্ষণ বোধ করি এর সংগা জানার জন্য এবং আর গভীর তাপর্যসহ অনুভব করি যা বাস্তবে কোন একটি ঘটনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলে বোঝা যায় না। যেমন, সলিড বস্তু থেকে গ্যাসে রূপান্তর বিপরীতভাবে গ্যাস থেকে সলিড বস্তুতে রূপান্তর । প্রথম কোনো একটি শব্দের মুখোমুখি হওয়ার সময়, হোক তার স্বতন্ত্র বা গুণগত তাৎপর্য অর্থ আমরা তার সম্পূর্ণ অর্থ জানার জন্য যতড়ববান হই, তার পরিপূর্ণ অর্থ আমাদের স্মৃতিতে রাখতে চাই। প্রম তথ্য যদি অসম্পূর্ণ হয় তবে আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তাছাড়া, এভাবেই ঘটনা বা সময়য়ের পুনরাবৃত্তি করে স্মৃতি তার কাজ করে। তাছাড়া এভাবে স্মৃতি ছোট ঘটনাকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে আনে ঘটনার ধারাবাহিকতায়; পাঠকের নিজের ভেতরে কিছু মৌলিক অভিজ্ঞতা দৃশ্যমান হয়। আর ঘটনার পরম্পরায় পুরনো তথ্য বের হয়ে আসে—এক্ষেত্রে কাহিনীর প্রম ঘটনা সূত্র হিসেবে কাজ করে যা আসলে অভিজ্ঞতাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় ও স্মৃতিময় করে তোলে -- ‘‘আহ! আমি স্মরণ করতে পারছি যে আমি ওয়েস্টমিনিস্টারের নির্বাচনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছি -- তুমি ভাবতেই পারবে না যে আমি পূর্বে কখনো এই অবস্থায় এসেছি; ঠিক আছে, বলছি, আমি কিভাবে এখানে এসেছিলাম।’’
এখন শুরু হয় পুরনো স্মৃতির বর্ণনা। এভাবে গল্প বর্ণনার এই পদ্ধতি জীবনের ভেতরে ও বাইরের নানা বিষয় তুলে আনে—পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার মতো চূড়ান্ত কল্পনাময় ছবি তৈরি হয়ে যায় অথবা একজন লেখক আরো মৌলিকভাবেও বর্ণনা করতে পারেন—যেখানে আসতে পারে আমাদের অতীত বিষয় বা শক্তিশালী আবেগময় বিষয় অথবা আমাদের গভীর স্বীকারোক্তি; অথবা সাধারণ কিছু চিত্রকলা যোগ হতে পারে সাধারণ অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য। এগুলো হলো চিন্তার আদিম যন্ত্রপাতি। তবে আশ্চর্য হবার কিছু নয় যে, প্রাচীন কবিতা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল—আগে কিভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই দুর্ময় মুহূর্ত বা কোন কাজ বা গৌরবময় অর্জনকে বর্ণনা করেছিল। পদ্ধতিগতভাবে বর্ণনার বিষয়টি আরো পরে এসেছে: এটা আরো গভীর প্রতিক্রিয়ার ফল। যেমন একটি বক্সের ভেতর জ্যাকের উপস্থিতি সব শিশুকে উৎসাহী করে তুলবে।এই বালক আরো বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়, সে ক্ষুদে দার্শনিক—সে আসলে জানতে চায় লোকটা এখানে কিভাবে এলো?
আত্মজীবনীতে কেবল আমাদের জীবনের গল্প ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা যায় অথবা শৈশব থেকে আমাদের সঙ্গী সাথীদের গল্প অথবা সম্ভবত আমাদের সন্ধ্যা নদের নিয়ে গল্পে এ রকম সুযোগ থাকে। তবে যারা গল্প বাহক তাদের সংশ্লিষ্ট করা বা গভীরভাবে বর্ণনার সাথে যুক্ত করা অবশ্যই মহৎ শিল্প। আর এভাবে আমরা শুরু থেকে সব সবিস্তারে মনে করতে পারি। এসমস্ত ক্ষেত্রে সহযোগীদের অংশগ্রহণ ও এর অনুপাত গল্পের চূড়ান্ত অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে। এই সব বর্ণনা গ্রীষ্মকালীন গল্প হিসেবে শ্রোতাদের খোরাক মেটায়—আত্মভোলা বা ব্যস্ত শ্রোতা যাদের একঘণ্টাও বিনোদনের জন্য বরাদ্দ নেই তাদের জন্য এই গল্প উপযুক্ত নয়। তবে প্রয়োজনীয় তথ্য-সময়-তারিখ-স্থান-উপাদানসহ চূড়ান্ত সফল বর্ণনার দিকে ধাবিত হয়ে খুব সাধারণভাবে গল্পের শুরু হলে আলাদা কথা। সেখানে নাটকীয় ব্যাপার থাকবে তবে কোন পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাবার ব্যাপার থাকবে না। এসব হলো এজাতীয় গল্পের সফল দিক। তবে এ সবই নির্ভর করবে গল্পের প্রকৃতির ওপর। এখানে খুব গভীর বর্ণনা থাকে যেখানে দু-একটা মাত্র সংলাপ থাকতে পারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অথবা এসব গল্প খুব মজার হতে পারে এবং এটা নভেলের জন্য খুব উপযুক্ত। এর মজার বা আনন্দের উদাহরণ আমরা ফরাসি গল্পে পাবো। ফরাসিরা অসম্ভব সফলতা পেয়েছিল যেখানে ইংরেজরা কখনো পৌঁছতেই পারেনি। ইংরেজরা মোটা দাগে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন। আর আনন্দময় সফল বর্ণনা আমরা পাই লা ফন্টেইনের কাছে। তাঁর লেখা হাস্য উৎপাদন করে ঠিকই তবে তা নির্দিষ্ট গল্পের ক্ষেত্রে; তিনি অসম্ভব দক্ষতার সাথে গল্প বর্ণনা করেন। আর সেটা যেকোন বিষয়ে হতে পারে এমনকি সবচেয়ে সিরিয়াস বিষয় পর্যন্ত। আর এই জাতীয় আনন্দময় গল্প বর্ণনা ফরাসিদের উৎকৃষ্ট নভেল রচনায় বড় ভূমিকা রেখেছে। ভিকার অব ওয়েকফিল্ড-এর প্রম অধ্যায়টি খুবই অতুলনীয় একটি বর্ণনা; এটা কেবল এভাবেই বর্ণনা করা যেতে পারে। কেন একটা গল্প সবচেয়ে অপ্রচলিত ভঙ্গিতে বলা হয় না? এটা একজন লেখকের ব্যক্তিগত আদর্শকে বাড়িয়ে দেয় অথবা তিনি যা আমদের সরবরাহ করেন আমরা উপভোগ করতে পারি। ত্রিস্তান শ্যান্ডির বর্ণনায় স্টার্ন যে বুনো বা জটিল পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে আমরা পাই বাধাদান পদ্ধতির গুণগত বৈশিষ্ট্য। সরলতার অভাবে প্রায়শ নিজের মনে বিরক্ত হতে পারে প্রিয় সাধারণ পাঠক এবং তারা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে; তারা যেন মদের বোতলের ছিপি।
0 মন্তব্যসমূহ