চিনুয়া আচেবে
মাইকেল অবির আশা পূরণ হলো তাঁর
প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি নডিউম সেন্ট্রাল স্কুলের
হেডমাস্টার হিসেবে নিয়োগ লাভ করলেন। এটা সব সময় একটি অনুন্নত বিদ্যাপীঠ বিধায় মিশন
কর্তৃপক্ষ একজন তরুণ ও উদ্যমী মানুষকে তা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে সেখানে পাঠানোর
সিদ্ধান্ত নিল। অবি সানন্দচিত্তে এই দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। তাঁর মাথায় খুব
চমৎকার কিছু ধারণা ছিল এবং সেগুলো বাস্তবায়নের সেটা ছিল মোক্ষম এক সুযোগ।
মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষা বিষয়ে তাঁর ভালো জ্ঞান ছিল, যা অফিশিয়াল রেকর্ডে তাঁকে ‘গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, আর এ কারণে অন্য প্রধান শিক্ষকদের থেকে তাঁকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছিল। বয়সী ও স্বল্পশিক্ষিতদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনায় তাঁর কোনো ধরনের রাখঢাক ছিল না।
মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষা বিষয়ে তাঁর ভালো জ্ঞান ছিল, যা অফিশিয়াল রেকর্ডে তাঁকে ‘গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, আর এ কারণে অন্য প্রধান শিক্ষকদের থেকে তাঁকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছিল। বয়সী ও স্বল্পশিক্ষিতদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনায় তাঁর কোনো ধরনের রাখঢাক ছিল না।
‘আমরা খুব ভালো কিছু একটা করতে পারব, তাই না?’ পদোন্নতির সুসংবাদ শুনে তিনি
তাঁর স্ত্রীকে বললেন।
‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’ তাঁর স্ত্রী উত্তর দিল। ‘এখানে চমৎকার সব বাগান রয়েছে, মনে হয় সব কিছু আধুনিক ও
আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে। দুই বছরের বিবাহিত জীবনে তার স্বামীর এই ‘আধুনিক পদ্ধতি’র প্রতি অনুরাগ এবং ‘শিক্ষাক্ষেত্রে এই সব বুড়োহাবড়া, যাদের ওনিশা মার্কেটে দোকান
খুলে বসলে ভালো হতো’ জাতীয় অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য দ্বারা সেও আক্রান্ত হয়েছে। সে নিজেকে একজন
তরুণ প্রধান শিক্ষকের গুণমুগ্ধ স্ত্রী হিসেবে ভাবতে শুরু করে দিল।
অন্য শিক্ষকদের স্ত্রীরা তাকে হিংসা
করতে শুরু করেছে, সব কিছুতেই সে ওই রকম একটা হাবভাব দেখাতে লাগল। তারপর হঠাৎ করেই তার
মনে হলো, আর কারো স্ত্রী তো এখানে থাকবে না। আশা আর
আতঙ্কের দোলাচলে দুলতে দুলতে উদ্বিগ্নচিত্তে সে তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে এ
ব্যাপারে জানতে চাইল।
‘আমার সব সহকর্মীই তরুণ আর অবিবাহিত, এটা একটা ভালো দিক।’ অবি খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল।
কিন্তু তাঁর স্ত্রী বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে জানতে চাইল, ‘কেন?’
‘কেন! তাহলে তারা তাদের পুরো সময় ও
শ্রম স্কুলের পেছনে ব্যয় করবে।’
ন্যান্সি ভীষণ দমে গেল। কয়েক মিনিট
সে নতুন স্কুলের ব্যাপারে খানিকটা সন্ধিহান হয়ে পড়ল। তবে তার ব্যক্তিগত হতাশা তার
স্বামীর ভবিষ্যৎ প্রত্যাশাকে যেন নস্যাৎ করে না দেয়, তাই সে তার স্বামীর দিকে তাকাল। অবি একটা চেয়ারে
গুটিসুটি মেরে বসে ছিলেন। দেখতে খানিকটা ঘাড় কুঁজো ও রোগাপটকা। কিন্তু মাঝে মাঝে
হঠাৎ করেই শারীরিক সামর্থ্যের বিস্ফোরণ দেখিয়ে সবাইকে তিনি অবাক করে দিতেন। এই
মুহূর্তে তাঁর বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, শরীরের সব
শক্তি তাঁর কোটরাগত চোখ দুটোর পেছনে গিয়ে অবস্থান নিয়ে তীব্র এক অন্তর্ভেদী শক্তি
লাভ করেছে। এখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ বছর, কিন্তু তাঁকে ৩০
বা এর বেশি মনে হয়। তবে সব মিলিয়ে তিনি খুব কুদর্শন নন।
‘তুমি
কী ভাবছ, মাইক?’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে
ন্যান্সি জানতে চাইল।
‘ভাবছি স্কুল কিভাবে চালাতে হয় তা
সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার একটা মওকা শেষমেশ পাওয়া গেল।’
নডিউম স্কুলটা সব দিক দিয়েই
পশ্চাৎপদ। মি. অবি এর পেছনে একেবারে প্রাণাতিপাত করতে লাগলেন, তাঁর স্ত্রীও। তাঁর দুটো
লক্ষ্য ছিল উন্নতমানের শিক্ষা দেওয়া এবং স্কুল চত্বরটাকে একটি সুন্দর ক্ষেত্র
হিসেবে গড়ে তোলা। ন্যান্সির স্বপ্নের বাগান প্রাণ পেল বৃষ্টি নামাতে, গাছগুলোতে ফুল ধরল। চমৎকার লাল ও হলুদ হিবিস্কাস ও আলামান্দা গুল্ম
দিয়ে সযত্নে অন্যের সীমানা বাদ দিয়ে স্কুলের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এক সন্ধ্যায় অবি যখন মুগ্ধদৃষ্টিতে
নিজের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন হঠাৎ করেই স্কুল চত্বরের ভেতর আড়াআড়ি মেরিগোল্ডের বীজতলা আর ঝোঁপের
ভেতর দিয়ে গাঁয়ের এক বৃদ্ধাকে লেংচে লেংচে হেঁটে আসতে দেখে তাঁর মেজাজাটা বিগড়ে
গেল। দ্রুত সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন অব্যবহৃত অস্পষ্ট একটি পথের রেখা,
যা গ্রামের দিক থেকে স্কুল চত্বরের ভেতর দিয়ে পাশের জঙ্গলে গিয়ে
মিশেছে।
‘আমি
ভেবে অবাক হচ্ছি যে আপনারা গ্রামের লোকদের এই পথটা ব্যবহারের অনুমতি দিলেন কী করে?’
তিন বছর ধরে এই স্কুলে শিক্ষকতা করা একজনকে ডেকে তিনি বললেন,
‘ভারি অদ্ভুত তো।’ অসন্তুষ্টিতে বারবার মাথা
নাড়তে লাগলেন অবি।
ওই শিক্ষক খানিকটা আত্মপক্ষ সমর্থনের
ঢঙে বললেন, ‘রাস্তাটা ওদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তা কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়,
আর তা গ্রামের উপাসনালয়ের সঙ্গে গোরস্তানকে যুক্ত করেছে।’
‘তাহলে তা স্কুলের কী কাজে আসছে?’
প্রধান শিক্ষক জানতে চাইলেন।
‘আমি ঠিক জানি না, তবে একবার আমরা রাস্তাটা
বন্ধের উদ্যোগ নিলে বেশ ঝামেলা হয়েছিল।’ তিনি বললেন।
‘আগের কথা থাক, এখন থেকে রাস্তাটা আর
ব্যবহৃত হবে না।’ অবি পায়চারি করতে করতে বললেন। ‘আগামী সপ্তাহে সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তা স্কুল
পরিদর্শনে এসে কী ভাববেন? পরিদর্শনের সময় ওরা হয়তো পূজা অর্চনার আনুষ্ঠানিকতার জন্য একটি
শ্রেণীকক্ষ ব্যবহারের দাবি জানাবে।’
ঘন করে মোটা মোটা খুঁটি পুঁতে
রাস্তাটার প্রবেশ ও বাহিরমুখ বন্ধ করে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হলো।
দিন তিনেক বাদে গ্রামের পাদ্রি
প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি বয়সী মানুষ এবং খানিকটা ঝুঁকে হাঁটেন।
চলার জন্য মোটা ও শক্ত একটা লাঠি ব্যবহার করেন এবং প্রতিবার নতুন যুক্তি দেখানোর
সময় জোর দিতে মেঝেতে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি বললেন, ‘শুনলাম, আমাদের পূর্বপুরুষদের পায়ে চলার পথটি নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, আমরা স্কুল চত্বরের ভেতর দিয়ে গ্রামের লোকদের
চলাচলের রাস্তা বানাতে দিতে পারি না।’
‘দেখুন, এই রাস্তাটা আপনার এমনকি আপনার পিতার জন্মের আগে
থেকে এখানে ছিল। এই গ্রামের প্রাণটা নির্ভর করছে এর ওপর। আমাদের মৃত স্বজনরা এ পথ
দিয়েই চিরবিদায় নেন এবং পূর্বপুরুষরা আমাদের দেখতে আসেন। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হলো, এ পথ দিয়েই নবজাতকরা জন্ম নেয়।’
মুখে মৃদু পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে মি.
অবি সব কথা শুনলেন।
‘আমাদের স্কুলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো
এসব বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করা। মৃত মানুষের পথঘাট লাগে না। এসব ধারণা গাঁজাখুরি।
আমাদের কর্তব্য হলো, ছেলেমেয়েরা যেন এসব শুনে হাসে, তাদের সেই
শিক্ষা দেওয়া।’ অবি বললেন।
‘আপনি যা বলছেন তা হয়তো সত্য, কিন্তু আমরা পূর্বপুরুষের
রীতি অনুসরণ করে চলি।’ তিনি বললেন। ‘আপনি
যদি রাস্তাটা খুলে দেন তাহলে আমাদের ঝগড়াঝাঁটি করার প্রয়োজন পড়বে না। যে কথা আমি
সব সময় বলে থাকি বাজকেও বসতে দাও, ঈগলকেও।’ তিনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমি দুঃখিত।’ তরুণ প্রধান শিক্ষক বললেন। ‘স্কুলের চত্বরটা সর্বসাধারণের
চলাচলের পথ হতে পারে না। এটা নিয়ম-বিরুদ্ধ। আমি স্কুলের সীমানা ঘেঁষে অন্য একটি পথ
তৈরি করে নিতে পরামর্শ দেব। আমাদের ছেলেরাও তাতে সহায়তা করবে। আমার মনে হয় না
পূর্বপুরুষরা সামান্য ঘুরপথে চলাটাকে সমস্যা মনে করবেন।’
‘আমার
আর কিছু বলার নেই,’ পাদ্রি বললেন। ততক্ষণে তিনি
প্রায় বাইরে চলে গেছেন।
দুই দিন বাদে গ্রামের এক সন্তানসম্ভবা
মহিলা প্রসবের সময় মারা গেল। তাৎক্ষণিক একজন গণক ডেকে আনা হলো এবং রাস্তা বন্ধ করে
দেওয়ায় পূর্বপুরুষরা ক্ষুব্ধ হওয়ায় তাঁদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য বিশাল যজ্ঞের আয়োজন
করতে হবে বলে সে জানাল।
পরদনি সকালে অবির ঘুম ভাঙল
ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে। চমৎকার গুল্মের সারিগুলো ছিঁড়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে, শুধু পথের পাশের নয়, সারা স্কুল চত্বরের; ফুলগুলো পায়ে পিষে নষ্ট
করা হয়েছে আর স্কুলের একটা ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিনই শ্বেতাঙ্গ সুপারভাইজার
স্কুল পরিদর্শনে এসে স্কুল চত্বর সম্পর্কে খারাপ একটা প্রতিবেদন লিখলেন। তবে এর
চেয়ে মারাত্মক যা লিখলেন তা হলো : ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে দলাদলি
ও সাংঘর্ষিক যে অবস্থা বিরাজ করছে তা কিছুটা হলেও নতুন প্রধান শিক্ষকের ভ্রান্তপথে
চালিত আকাঙ্ক্ষার ফল।’
অনুবাদ : শরীফ আতিক-উজ-জামান
অনুবাদ : শরীফ আতিক-উজ-জামান
কালের
কণ্ঠ
0 মন্তব্যসমূহ