হ্যারলড পিন্টার -
অনুবাদ : লুনা রুশদী
১৯৫৪ সালে আমি লিখেছিলাম:
নাটকের সত্য সবসময় পালিয়ে বেড়ায় । কখনোই তাকে পুরোপুরি পাওয়া যায় না অথচ তার খোঁজ করতে আমরা বাধ্য। এই খোঁজই উদ্যম যোগায়। এটাই কাজ। বেশীর ভাগ সময় অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে হোঁচট খেয়ে পড়ি সত্যের উপর, কখনো তার সাথে ধাক্কা লাগে আবার কখনো একনজর দেখি কোন প্রতিচ্ছবি বা আকার যা হয়তো সত্যের বার্তাবাহী, প্রায়ই বুঝে ওঠার আগেই। তবে সার কথা হলো নাট্যশিল্পে একমাত্র সত্য বলে কোন বস্তু নাই। সত্য অনেক। এরা কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো একে অপরকে এড়িয়ে চলে, প্রতিবিম্বিত করে, ভয় পায়, ঠাট্টা করে অথবা অস্বীকার করে। মাঝে মাঝে মনে হয় কোন একটা মুহূর্তের সত্যকে হয়তো হাতের মুঠোয় ধরতে পেরেছি, পরক্ষণেই আঙুলের ফাঁক গলে সে হারিয়ে যায়।
আমায় অনেকেই প্রশ্ন করেন আমার নাটকগুলি কিভাবে মাথায় আসে আমার। আমি বলতে পারি না। আমার নাটকের সারাংশও দিতে পারি না আমি, শুধু বলতে পারি কি হয়েছিল । কে কি বলেছিল। কে কি করেছিল। বেশীর ভাগ নাটকই জন্মায় কোন একটা শব্দ, একটা অবয়ব অথবা একটা বাক্য থেকে। এক একটা শব্দের সাথেসাথেই এক একটা ছবিও মনে আসে। এরকম দুটি বাক্যের উদাহরণ আমি দেব যা একদম হঠাৎ করেই মনে এসেছে, যাকে অনুসরণ করেছে একটা অবয়ব এবং তাকে অনুসরণ করেছি আমি।
নাটকগুলির একটি হলো দ্যা হোমকামিং (ঘরে ফেরা) আরেকটি ওল্ড টাইম্স (ফেলে আসা দিন) । হোমকামিং এর প্রথম বাক্য ছিল 'হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান উয়িথ দ্যা সিজরস্?' (কাঁচিটা কি করেছ তুমি?)। আর ওল্ড টাইমস এর প্রথম বাক্য 'ডার্ক' (গাঢ়/অন্ধকার)।কোন ক্ষেত্রেই আর কোন তথ্য আমি জানতাম না। প্রথম ক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে কেউ একজন একটা কাঁচি খুঁজছিল এবং অপর একজনের কাছ থেকে তা ফেরত চাইছিল যাকে সে দায়ী করছিল কাঁচিটার স্থানচ্যুত হওয়ার পেছনে। কিন্তু আমি কোনভাবে জেনে গেছিলাম যে দ্বিতীয় ব্যক্তির কোন মাথাব্যথাই নাই কাঁচি বিষয়ে, এমনকি প্রশ্নকর্তা বিষয়েও।
'ডার্ক' আমি নিলাম কারো চুলের বর্ণনা হিসাবে, কোন নারীর, আর কোন একটা প্রশ্নের উত্তরও রয়েছে এর মধ্যে। সব ক্ষেত্রেই আমি চালিত হয়েছি বিষয়টাকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে। মানশ্চক্ষে দেখছিলাম ঘটনাটা, খুব ধীরে ধীরে পরতে পরতে ছায়া রূপান্তরিত হচ্ছিল আলোয়।
আমার নাটক লেখার শুরুতে চরিত্রদের নাম আমি দেই 'এ', 'বি', 'সি' এরকম করে। দ্যা হোমকামিং লেখার সময়ে আমি দেখলাম একজন লোক একটা প্রায়শূন্য ঘরে ঢুকে তার প্রশ্নটি ছুঁড়লো কদাকার এক সোফায় বসে থাকা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী আরেক ব্যক্তিকে যে সেইসময় রেস্ এর পত্রিকা পড়ছিল। আমি ধারণা করলাম যে 'এ' হোল বাবা আর 'বি' তার ছেলে, তবে কোন প্রমান ছিলনা আমার কাছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার ধারণাটি সত্য প্রমাণিত হল যখন 'বি' (পরে যার নাম হয়েছিল 'লেনি') 'এ' কে বলে (পরে নাম হয়েছিল 'ম্যাক্স'),
শিল্পের ভাষা তাই এক ঝাপসা দ্ব্যর্থক বস্তু, চোরাবালি, ট্র্যমপোলিন অথবা বরফজমা পুকুর, যা যে কোন সময় লেখকের পায়ের তলা থেকে সরে যেতে পারে। তবে আগেও বলেছি, সত্যের সন্ধান কখনোই থামেনা। তাকে মুলতুবি রাখা যায়না, স্থগিত করা যায় না। তার মোকাবিলা করতে হয়, তৎক্ষণাৎ।
রাজনৈতিক নাটকের সমস্যা আবার ভিন্ন ধরণের। উপদেশ দেয়া থেকে সবরকমভাবে বিরত থাকতে হয়। নিরপেক্ষতা আবশ্যিক। চরিত্রদের নিজের মত নিঃশ্বাস নিতে দিতে হবে। লেখক তাদের সীমাবদ্ধ বা সংকুচিত করতে পারেন না নিজের রুচি, মতামত অথবা কুসংস্কারকে চরিতার্থ করতে। লেখক বিভিন্ন দিক থেকে এদের কাছে আসার জন্য প্রস্তুত থাকেন , একটি সম্পূর্ণ এবং নির্বাধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, হঠাৎ হঠাৎ তাদের বিস্মিত করে দেয়া যায় নিশ্চয়ই, তবে অবশ্যই তাদের নিজের পথে চলার স্বাধীনতা দিতে হয়। সবসময় যে এর পরিণাম ভালো হয়, তাও না। আর রাজনৈতিক ব্যঙ্গ নাটক অবশ্য এইসব নীতির কোনটাই মানেনা, বরং উল্টাটাই সে করে, যা তার ক্ষেত্রে উপযুক্ত।
আমার নাটক দ্যা বার্থডে পার্টি (জন্মদিনের উৎসব) তে আমার মনে হয় আমি হরেক রকম পন্থাকেই ঘোরাফেরা করতে দেই সম্ভাবনার ঘন বনে শেষমেষ যেকোন একটিকে বশীভূত করায় মন দেবার আগে।
মাউন্টেন ল্যাংগুয়েজ (পাহাড়ের ভাষা) এ এরকম কোন ভান নাই। এই নাটক পাশবিক, ছোট আর কুৎসিত। কিন্তু নাটকের সৈনিকরা এর থেকেও মজা পায় ঠিকই। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে অত্যাচারীদের অল্পতেই একঘেয়ে লাগে। তাই তাদের মন ভালো রাখার জন্য মাঝে মাঝে হাসিঠাট্টার প্রয়োজন আছে। এর সত্যতা প্রমান করে বাগদাদের আবু গারিবে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ। মাউন্টেন ল্যাংগুয়েজ বিশ মিনিটের নাটক, অথচ এটা চলতেই থাকতে পারতো, ঘন্টার পর ঘন্টার পর ঘন্টা, একইভাবে, বারে বারে, ঘন্টার পর ঘন্টা।
আবার অন্যদিকে, অ্যাশেস টু অ্যাশেস (ছাই থেকে ছাই), আমার মনে হয়েছে পানির নীচে ঘটছে। এক ডুবন্ত নারী, ঢেউএর উপরে হাত বাড়িয়ে আছে, দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, অন্য কাউকে ধরার চেষ্টা করছে, অথচ কাউকে পাচ্ছেনা, পানির উপরে বা নীচে, শুধু দেখছে, ছায়া, প্রতিবিম্ব, ভাসমান। এক নারী, একটা হারানো আদল ডুবন্ত জমিতে, যে পরিত্রান পায়না মৃত্যুদন্ড থেকে যা মনে হয়েছিল শুধু অন্যদের প্রাপ্য । কিন্তু যেভাবে তারা মরেছে, তাকেও মরতে হবেই।
অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের দখলে যে রাজনীতির ভাষা, তার মধ্যে এসবের বালাই নাই। কারণ এ যাবত যা দেখেছি তাতে এরকমই প্রমাণিত হয় যে তাঁরা সত্যে আগ্রহী না, ক্ষমতায় আগ্রহী আর আগ্রহী এই ক্ষমতার লালনে। আর ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য মানুষকে অজ্ঞতায় রাখা জরুরী, যাতে তারা সত্য জানতে না পারে, এমনকি তাদের নিজের জীবন বিষয়েও। তাই আমাদেরকে ঘিরে থাকে মিথ্যার পর্দা, তার মধ্যেই বসবাস আমাদের।
এখানকার প্রতিটা মানুষ জানেন যে, ইরাক আক্রমনের বৈধতা স্বরূপ বলা হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনের দখলে রয়েছে বিপজ্জনক গণবিধ্বংসী অস্ত্রসস্ত্র, যার কোনো কোনোটা প্রয়োগ করার ৪৫ মিনিটের মধ্যে শুরু হবে ধ্বংসযজ্ঞ। আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছিল যে এটাই সত্য। সত্য ছিল না। আমাদের বলা হয়েছিল ইরাক আল কায়দার সাথে যুক্ত আর ২০০১ এ নিউ ইয়র্কএ ঘটে যাওয়া সেপ্টেম্বার ১১ এর নৃশংসতায় তারাও সামিল ছিল। আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছিল যে এটাও সত্য। এটাও সত্য ছিল না। আমাদের বলা হয়েছিল ইরাক সারা পৃথিবীর নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ এবং নিশ্চিত করা হয়েছিল এর সত্যতা সম্পর্কে। সত্য ছিলনা এটাও। সত্য পুরোপুরিই অন্য বিষয়। সত্য হল যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে তার ভূমিকা বলতে কি বোঝে আর কি রূপে তার প্রয়োগ করে। তবে বর্তমানে ফেরার আগে আমি অদূর অতীতের দিকে একবার তাকাতে চাই, অর্থাৎ দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির দিকে দৃষ্টি ফেলতে চাই। এসময়টার সতর্ক অনুসন্ধান আমাদের অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
সবাই জানেন যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সারা পূর্ব ইউরোপ জুড়ে কি ঘটছিল। পদ্ধতিগত নির্দয়তা, নৃশংসতা আর একক সত্তার দমন। এ সবকিছুই যাচাই এবং দলিলকৃত। কিন্তু আমার আপত্তি হলো একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধগুলির রেকর্ড হয়েছে খুব ভাসাভাসাভাবে, দলিল, সত্যতা স্বীকার এমনকি অপরাধ হিসাবে এগুলিকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা। আমি মনে করি এটা বলতেই হবে যে পৃথিবী এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তার সাথে সত্যের গাঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের কারণে যদিও খানিকটা রাশটানা, পৃথিবীজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকলাপে এটা পরিষ্কার যে যা খুশী তাই করার মত ক্ষমতা তার আছে। একটা স্বাধীন দেশে সরাসরি আক্রমন কখনোই আমেরিকার পছন্দের উপায় ছিলনা। যুক্তরাষ্ট্রের নিজের ভাষায় সে পছন্দ করে 'স্বল্পমাত্রার সংঘর্ষ'। এর মানে হলো হাজার হাজার মানুষ মরবে ঠিকই, তবে কোন দেশে বোমা হামলার চেয়ে অনেক ধীরগতিতে। একটা দেশকে ভেতর থেকে সংক্রামিত করা, বিজানু ছড়িয়ে ঘা বাড়তে দেখা। অধিবাসীরা যখন ম্রিয়মান অথবা মৃত আর বন্ধুবেশে মিলিটারি এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলি যখন আরামে ক্ষমতায় আসীন, সেইসময় আপনি যাবেন ক্যামেরার সামনে আর বলবেন - গণতন্ত্র জয়ী হলো।
যে সময়ের কথা আমি বলছি তখন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে এরকম অবস্থা ছিল স্বাভাবিক। নিকারাগুয়ার ট্র্যজেডি এ বিষয়ে একটি মূল্যবান সবুদ। এ ঘটনাটি আমি একটি যুৎসই উদাহরণ হিসাবে হাজির করতে চাই তৎকালীন এবং বর্তমান পৃথিবীতে নিজের ভূমিকা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা সম্পর্কে।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মার্কিন দূতাবাসের এক বৈঠকে আমিও ছিলাম। মার্কিন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল নিকারাগুয়ার বিদ্রোহী দল কন্ট্রাকে আরো আর্থিক সাহায্য করার ব্যাপারে। আমি গিয়েছিলাম নিকারাগুয়ার প্রতিনিধি হিসাবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি সেদিন ছিলেন ফাদার জন মেটক্যাফ। মার্কিন পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রেমন্ড সিট্জ (সেই সময় দূতাবাসের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা তবে পরবর্তীতে তিনি নিজেই রাষ্ট্রদূতের পদ গ্রহণ করেন)। ফাদার মেটক্যাফ বললেন -
শেষপর্যন্ত একজন বললেন -
আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে এই সময়েই প্রেসিডেন্ট রিগ্যান বলেছিলেন
১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়ার জনগন সান্দিনিস্তার নেতিৃত্বে গণবিপ্ললবের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটায়। যদিও সান্দিনিস্তারাও নিখুঁত ছিলনা। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে কিছু পরষ্পরবিরোধী ব্যাপার ছিল আর অনেক বিষয়ে সহসশীলতারও অভাব ছিল। তবুও তারা ছিল বুদ্ধিমান, যুক্তিসংগত আর সভ্য। একটি স্থিতিশীল ও সুন্দর সমাজ গঠনের উদ্যগ নিয়েছিল তারা। হাজার হাজার দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকেরা জীবন ফিরে পেয়েছিল সান্দিনিস্তা শাসন আমলে। সে সময় ১ লাখেরও বেশী পরিবার পেয়েছিল চাষের জমি। দুইহাজার স্কুল গঠিত হয়েছিল। বেশ ব্যাপক আর জোরদার সংগঠনের কারণে দেশের নিরক্ষরতা কমে দঁড়িয়েছিল সাত ভাগের এক ভাগে। অবৈতনিক শিক্ষা আর বিনা পয়সার চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শিশু মৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছিল এক তৃতীয়াংশে। আর পোলিও উচ্ছেদ হয়েছিল সমূলে।
এই সফলতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা করেছে লেনিন/মার্কসবাদী নাশকতা বলে। মার্কিন সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এক বিপজ্জনক উদাহরণের পত্তন হচ্ছিল। যদি নিকারাগুয়াকে অনুমতি দেয়া হয় সামাজিক স্থিতি ও ন্যায়শীলতা স্থাপন করার, শিক্ষা ও চিকিৎসার মান বাড়ানোর, সামাজিক ঐক্য আর জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধির, তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলিও তো একই দাবী তুলবে, একই কাজ করবে।
আল সালভাদোরে সে সময় জোর প্রতিরোধ উঠেছিল তাদের তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থার বিরূদ্ধে। আমি আগেও 'মিথ্যার পর্দা'র কথা বলেছি, যা আমাদের ঘিরে আছে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান নিকারাগুয়াকে বলতেন 'সমগ্রতাবাদী জেলখানা'। মিডিয়া ও বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকার এই উক্তিকে সঠিক ও ন্যায়সংগত বলেই গ্রহণ করেছে। অথচ সান্দিনিস্তা সরকার আমলে কোন ডেথ স্কোয়াডের রেকর্ড নাই। কোন অত্যাচারের রেকর্ড নাই। পদ্ধতিগত অথবা সরকারীভাবে সামরিক নির্মমতারও রেকর্ড নাই কোন। সরকারে তিনজন ধর্মযাজক ছিলেন, দুইজন ঈসায়ী আর একজন ম্যারিকনোল মিশনারী। 'সমগ্রতাবাদী জেলখানা' ছিল পাশের রাজ্যে - আল সালভাদোর আর গুয়াতেমালায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র গুয়াতেমালার গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়েছিল আর পরবর্তী একের পর এক সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের বলি হয় প্রায় ২ লাখ মানুষ। পৃথিবীর ছয়জন প্রসিদ্ধ ঈসায়ীকে ১৯৮৯ সালে সান সালভাদোরে সেন্ট্রাল আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে নৃশংসভাবে খুন করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার ফোর্ট বেনিংএ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আলকাটল সেনাবাহিনী। প্রচন্ড সাহসী আর্চবিশপ রোমেরো খুন হন একটি ধর্মীয় বক্তৃতার সময়। প্রায় ৭৫০০০ মানুষ নিহত হয়েছে এসময়ে। কেন তাদের মারা হলো? তারা খুন হয়েছে কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল আরেকটু ভালো ভাবে জীবন যাপন করা যায় এবং তা অর্জন করা সম্ভব। এই বিশ্বাস তৎক্ষণাৎ তাদের পরিণত করলো কমুনিষ্টএ। তারা খুন হয়েছে কারণ জন্মসূত্রে পাওয়া গরিবী, উৎপীড়ন ও লাঞ্ছনার বিরূদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সাহস করেছিল তারা। যুক্তরাষ্ট্র শেষপর্যন্ত সান্দিনিস্তা সরকারেরও পতন ঘটাতে পেরেছিল। যদিও তাতে সময় লেগেছে বেশ কয়েক বছর। তবে অবিরাম অর্থনৈতিক নীপিড়ন আর ৩০ হাজার মৃত্যুতে শেষ পর্যন্ত নিকারাগুয়ার মানুষের মনোবল ফুরিয়ে যায়। আবার তারা দারিদ্র্যপীড়িত আর সর্বশান্ত হলো। ক্যাসিনোগুলো ফিরে এলো দেশে। বিদায় নিলো অবৈতনিক স্কুল আর নিখরচার চিকিৎসা। বড় ব্যবসাকেন্দ্রগুলি ফিরে এলো নতুন উদ্যমে। 'গণতন্ত্রের' প্রতিষ্ঠা হলো।
তবে এই 'নীতি' শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সারা পৃথিবীতেই চালু হয়েছে। দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীর সমস্ত ডানপন্থী সামরিক একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছে অথবা গঠন করেছে। আমি ইন্দোনেশিয়া, গ্রীস, উড়োগুয়ে, ব্রাজিল, পারাগুয়ে, হাইতি, তুর্কি, ফিলিপিন্স, গুয়াতেমালা, আল সালভাদোর আর অবশ্যই চিলির কথা বলছি। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে বিবমিষায় আক্রান্ত করেছে চিলিকে তা কোনদিন মুছে ফেলা যাবে না, ক্ষমারও অযোগ্য। এসব দেশে হাজার হাজার হত্যাকান্ড ঘটেছে। সত্যি? সব ক্ষেত্রেই কি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই দায়ী? উত্তর হলো হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের কখনো তা জানতে দেয়া হয় না।
এরকম কখনো হয় নাই। কোন কিছুই কখনো হয় নাই। এমন কি যখন এসব হচ্ছিল তখনো তা হচ্ছিল না। এসব কোন ব্যাপার না। কোন আগ্রহের বিষয় না। যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ সবসময়েই পদ্ধতিগত, দৃঢ়, নির্মম, অনুশোচনাহীন অথচ খুব কম লোকই এ নিয়ে কথা বলেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে বাহ্বা দিতেই হয়। খুব নিপুনভাবে সারা পৃথিবীর উপরে তারা কতৃত্ব করেছে সার্বজনীন মাঙ্গলিক বাহিনীর ভেক ধরে। চরম সফল মগজধোলাইএর এক বিচক্ষণ এবং উজ্জ্বল উদাহরন।
আমি আপনাদের বলছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রোড শো। নির্মম, উদাসীন, অবজ্ঞাশীল, নির্দয় সে বটে তবে মানতেই হয় তার চাতুর্য। বিক্রেতা হিসাবে সে একা এবং তার সবচেয়ে বেশী বিক্রয়যোগ্য পণ্য হলো আত্মপ্রেম। যুক্তরাষ্ট্র জয়ী। এদেশের যে কোন রাষ্ট্রপতি টেলিভিশনে বলেন 'আমেরিকার মানুষ', সম্পূর্ণ বাক্যটা এরকম
আমাদের নৈতিক সংবেদনশীলতার কি হলো? কোনদিন কি ছিল এরকম কিছূ? এ শব্দগুলির অর্থ কি? এরা কি সেই অপসৃয়মান শব্দের কথা মনে করায় যার নাম বিবেক? যে বিবেক শুধু আমাদের কাজেরই না, অন্যান্যদের কর্মকান্ডের জন্যও দায়বোধ করে? এইসব বোধ কি মৃত এখন? গুয়ানতানামো বে'র দিকে তাকান, গত তিন বছর ধরে শ'য়ে শ'য়ে মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে কোন রকম দোষ সাব্যস্ত হওয়ার আগেই, কোন আইনি প্রতিনিধি বা কোন পদ্ধতি অবলম্বন ছাড়াই, বলতে গেলে এ আটক ব্যবস্থা চীরস্থায়ী। জেনেভা কনভেনশানকে পাত্তা না দিয়েই এই পুরোপুরি অবৈধ সংগঠন বজায় আছে। এটা যে সহ্য করা হচ্ছে তাই শুধু নয় বরং আন্তর্জাতিক সমাজ এ নিয়ে তেমন কিছু ভাবছেও না। এই চরম নিষ্ঠুর অপরাধের দায় একটি দেশের, যে দেশ নিজেকে 'স্বাধীন পৃথিবী'র নেতৃত্ব প্রদানকারী বলে ঘোষণা করে।
আমরা কি গুয়ানতানামো বে'র বাসিন্দাদের কথা চিন্তা করি? মিডিয়া তাদের সম্পর্কে কি বলে? মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় ছোট করে কোন খবর উঠে আসে। তাদেরকে এমন এক নো-ম্যানস্-ল্যান্ড এ পাঠানো হয়েছে যেখান থেকে হয়তো কোনদিনই তারা ফিরতে পারবে না। বর্তমানে অনেকেই অনশন ধর্মঘট করছে। তাদেরকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। এমনকি ব্রিটিশ নাগরিকদেরও। এবং এ ব্যাপারেও কোন কোমলতা নাই। কোন সিডেটিভ বা এনেসথেটিকেরও বালাই নাই। শুধু একটা নল ঢুকিয়ে দেয়া হয় জোর করে কন্ঠনালী বা নাক দিয়ে। রক্তবমি তারপর। এটাতো অত্যাচার।
বৃটেনএর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি বলেছে এ নিয়ে? কিছু না। বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী কি বলেছে? কিছু না। কেন নয়? কারণ যুক্তরাষ্ট্র বলেছে: গুয়ানতানামো বেতে আমাদের আচরণের সমালোচনা কে আমাদের প্রতি বৈরিতা বলে ধরে নেয়া হবে। হয় আপনারা আমাদের সঙ্গী, নয়তো বিরোধী। তাই ব্লেয়ার চুপ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমন একটি বর্বরতা, রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস, যা আন্তর্জাতিক আইন ব্যবস্থার শর্তহানি করেছে সম্পূর্ণভাবে। এই বেআইনী সামরিক কর্মকান্ড সম্ভব হয়েছে মিথ্যার পরে মিথ্যা সাজিয়ে চুড়ান্তরূপে মিডিয়া এবং সেইসাথে জনগণকে অপব্যবহারের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রন সুদৃঢ় করা। অন্য সব যুক্তি বিফলে যাবার পর এ পদক্ষেপের বৈধতা প্রমানের শেষ অবলম্বন হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশ - ইরাকের মুক্তি। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আর অঙ্গহানির জন্য দায়ী সামরিক বাহিনীর ভয়ঙ্কর উক্তি। আমরা ইরাকী মানুষের জন্য এনেছি অত্যাচার, বোমা, তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম, অগুনতি হত্যাকান্ড, দুর্দশা, লাঞ্ছনা এবং মৃত্যু আর এর নাম দিয়েছি 'মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা'।
ঠিক কি পরিমাণ মানুষ খুন করলে যুদ্ধোপরাধী ও গণ হন্তারকের যোগ্যতা অর্জন করা যায়? একশো হাজার? যথেষ্ট, আমি মনে করি। তাই আন্তর্জাতির ক্রিমিনাল কোর্টে বুশ ও ব্লেয়ারের বিচার চাওয়া একটা ন্যায্য দাবী। তবে বুশ এব্যাপারে চতুর। সে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টকে অনুমোদনই করে নাই। কাজেই কোন মার্কিন সৈন্য বা রাজনৈতিক নেতাকে যদি ডকে দাঁড়াতে হয়, বুশ আগে থেকেই নৌবাহিনী পাঠানোর হুমকি দিয়ে রেখেছে। তবে টনি ব্লেয়ার এই কোর্টকে অনুমোদন করেছে আর তাই বিচারের জন্য তাকে পাওয়া যাবে। আদালত আগ্রহী হলে আমরা তার ঠিকানাও জানাতে পারি । ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট, লন্ডন।
এই প্রসঙ্গে মৃত্যু অবান্তর। বুশ ও ব্লেয়ারের কেউই মৃত্যু বিষয়ে খুব চিন্তিত না। ইরাকের বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে মার্কিন বোমা ও মিসাইলে অন্তত একলাখ ইরাকী খুন হয়েছিল। এই মানুষগুলি কেউ না, তাদের মৃত্যুর কোন অস্তিত্বই নাই। তারা ফাঁকা। তারা যে মৃত সে রকম কোন রেকর্ডও নাই।
আক্রমনের শুরুতে বৃটিশ এক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ইরাকী শিশুর গালে চুম্বনরত টনি ব্লেয়ারের ছবি ছাপা হয়েছিল - 'এক কৃতজ্ঞ শিশু'। কিছুদিন পরে আরেকটা গল্প আর ছবি ছিল সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায়, একটি চার বছরের ইরাকী ছেলে, দুই বাহু বিচ্ছিন্ন। তার পুরো পরিবার উড়ে গেছে মিসাইলে । শিশুটিই কেবল বেঁচে আছে। 'আমি আমার হাত দুটি কবে ফেরত পাবো?' ছেলেটা জানতে চেয়েছিল। এ নিয়ে আর কিছু লেখা হয় নাই। টনি ব্লেয়ার তো আর এই শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছিল না, অন্য কোন বিকলাঙ্গ শিশুকেও না। রক্ত নোংরা, রক্ত শার্ট আর টাই নোংরা করে টেলিভিশানে অকৃত্রিম বক্তৃতা দেয়ার সময়।
দুইহাজার মার্কিনীর মৃত্যু একটা লজ্জার ব্যাপার। তাদেরকে রাতের অন্ধকারে কবর দেয়া হয়। জানাজাও হয় চুপিসারে, কাউকে বিরক্ত না করে। বিকলাঙ্গরা বিছানায় পচে, কেউ সারাজীবন, তাই মৃত আর বিকলাঙ্গ সবাই পচে, তফাৎ শুধু কবরের ভিন্নতা। পাবলো নেরুদার একটি কবিতার অংশ 'আই এ্যা্ম এক্সপ্লেইনিং এ ফিউ থিংগস্ ' (আমি কিছু কৈফিয়ৎ দিচ্ছি) নীচে বলছি.
'সর্বাঙ্গীন আধিপত্য' মানে ভূমি, সমুদ্র, বাতাস, মহাশূন্য এবং আর সব সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রন। ১৩২ টি দেশে ৭০২ টি সামরিক স্থাপনা আমেরিকার অধিকৃত (একমাত্র সম্মানজনক ব্যতিক্রম সুইডেন)। আমেরিকার কাছে আছে ৮০০০ সক্রিয় এবং ক্ষেপনযোগ্য পারমানবিক অস্ত্র। এর মধ্যে ২০০০ টি আছে 'হেয়ার ট্রিগার এলার্ট'এ। বিপদসংকেতের ১৫ মিনিটের মধ্যেই নিক্ষেপ করা যাবে এদের । আরো উন্নত পারমানবিক ব্যবস্থা তৈরী করছে তারা যা বাঙ্কার বাস্টার হিসাবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের চিরসহযোগী বৃটিশরাও মনস্থ করেছে তাদের নিজেদের পারমানবিক মিসাইল ট্রাইডেন্ট কে বদলাবে। কার দিকে তাক করা আছে এসব? ওসামা বিন লাদেন? আপনার? আমার? জো ডোক্স? চীন? প্যারিস? কে জানে।
আমরা জানি যে এই শিশুসুলভ পাগলামী - পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং সংরক্ষণ অবস্থান করছে মার্কিন রাজনৈতির দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক প্রশাসন বজায় রাখছে স্থায়ীভাবেই এবং এতে শৈথিল্যের কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ মানুষ সরকারের এ সকল কর্মকান্ডে রাগান্বিত, লজ্জিত, কান্ত কিন্তু হায়, রাজনৈতির বাহিনীর অংশ তারা এখনো নয়। যে বাড়তে থাকা ভয়, উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে মার্কিনিদের মধ্যে তা লাঘব হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
একজন লেখকের জীবন খুব অরক্ষিত, তার সব কর্মকান্ড প্রায় নগ্নতার মত প্রকাশ্য। এ নিয়ে কান্নাকাটির কিছু নাই। লেখক বেছে নেয় তার জীবন আর তা নিয়েই বাঁচতে হয় তাকে। লেখক জীবনের নিশ্চিত কোন পরিণাম নাই, কারো পরিণাম হতে পারে রক্তহিম করা ভয়ঙ্কর। লেখক একা, তার কোথাও কোন আশ্রয় নাই, রক্ষাকারী নাই। যদি না সে মিথ্যা বলে - সে ক্ষেত্রে তার নিজের আশ্রয় তৈরী করে সে নিজেই, এ পর্যায়ে সে হয়তো রাজনীতিবীদ হয়ে যায়।
আমি আজ বেশ কয়েকবার মৃত্যুর কথা বলেছি। এখন আমার নিজের একটা কবিতার উদ্ধৃতি দিব। কবিতার নাম মৃত্যু ।
আমার বিশ্বাস ব্যাপক এই বিরুদ্ধচারণ সত্ত্বেও নাগরিক হিসাবে অনঢ় অবিচলতায় দৃঢ়তার সাথে সত্যের অনুসন্ধান এবং আমাদের জীবন ও সমাজে তাকে সংজ্ঞায়িত করা আমাদের দায়িত্ব। অবশ্য কর্তব্য। এই দৃঢ়তা আমাদের রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত না হলে আর কোনদিনই আমরা ফিরে পাবনা যা প্রায় হারিয়েছি - মানুষের সম্মান।
অনুবাদ : লুনা রুশদী
১৯৫৪ সালে আমি লিখেছিলাম:
কল্পনা ও বাস্তবের ভেতর বাঁধাধরা কোন ব্যবধান নাই, যেমন নাই সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে । যে কোন কিছুকেই সত্য বা মিথ্যার দলে ফেলতেই হবে এরকম নয়, অনেককিছুই একই সাথে সত্য এবং মিথ্যা।আমার বিশ্বাস কথাগুলি এখনো অর্থবহ এবং বাস্তবের শৈল্পিক অভিযাত্রায় আজও মানানসই। তাই একজন লেখক হিসাবে এর সমর্থন আমি করি তবে একজন নাগরিক হিসাবে পারি না । নাগরিক হিসাবে আমাকে প্রশ্ন করতেই হবে - সত্য কি? মিথ্যা কি?
নাটকের সত্য সবসময় পালিয়ে বেড়ায় । কখনোই তাকে পুরোপুরি পাওয়া যায় না অথচ তার খোঁজ করতে আমরা বাধ্য। এই খোঁজই উদ্যম যোগায়। এটাই কাজ। বেশীর ভাগ সময় অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে হোঁচট খেয়ে পড়ি সত্যের উপর, কখনো তার সাথে ধাক্কা লাগে আবার কখনো একনজর দেখি কোন প্রতিচ্ছবি বা আকার যা হয়তো সত্যের বার্তাবাহী, প্রায়ই বুঝে ওঠার আগেই। তবে সার কথা হলো নাট্যশিল্পে একমাত্র সত্য বলে কোন বস্তু নাই। সত্য অনেক। এরা কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো একে অপরকে এড়িয়ে চলে, প্রতিবিম্বিত করে, ভয় পায়, ঠাট্টা করে অথবা অস্বীকার করে। মাঝে মাঝে মনে হয় কোন একটা মুহূর্তের সত্যকে হয়তো হাতের মুঠোয় ধরতে পেরেছি, পরক্ষণেই আঙুলের ফাঁক গলে সে হারিয়ে যায়।
আমায় অনেকেই প্রশ্ন করেন আমার নাটকগুলি কিভাবে মাথায় আসে আমার। আমি বলতে পারি না। আমার নাটকের সারাংশও দিতে পারি না আমি, শুধু বলতে পারি কি হয়েছিল । কে কি বলেছিল। কে কি করেছিল। বেশীর ভাগ নাটকই জন্মায় কোন একটা শব্দ, একটা অবয়ব অথবা একটা বাক্য থেকে। এক একটা শব্দের সাথেসাথেই এক একটা ছবিও মনে আসে। এরকম দুটি বাক্যের উদাহরণ আমি দেব যা একদম হঠাৎ করেই মনে এসেছে, যাকে অনুসরণ করেছে একটা অবয়ব এবং তাকে অনুসরণ করেছি আমি।
নাটকগুলির একটি হলো দ্যা হোমকামিং (ঘরে ফেরা) আরেকটি ওল্ড টাইম্স (ফেলে আসা দিন) । হোমকামিং এর প্রথম বাক্য ছিল 'হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান উয়িথ দ্যা সিজরস্?' (কাঁচিটা কি করেছ তুমি?)। আর ওল্ড টাইমস এর প্রথম বাক্য 'ডার্ক' (গাঢ়/অন্ধকার)।কোন ক্ষেত্রেই আর কোন তথ্য আমি জানতাম না। প্রথম ক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে কেউ একজন একটা কাঁচি খুঁজছিল এবং অপর একজনের কাছ থেকে তা ফেরত চাইছিল যাকে সে দায়ী করছিল কাঁচিটার স্থানচ্যুত হওয়ার পেছনে। কিন্তু আমি কোনভাবে জেনে গেছিলাম যে দ্বিতীয় ব্যক্তির কোন মাথাব্যথাই নাই কাঁচি বিষয়ে, এমনকি প্রশ্নকর্তা বিষয়েও।
'ডার্ক' আমি নিলাম কারো চুলের বর্ণনা হিসাবে, কোন নারীর, আর কোন একটা প্রশ্নের উত্তরও রয়েছে এর মধ্যে। সব ক্ষেত্রেই আমি চালিত হয়েছি বিষয়টাকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে। মানশ্চক্ষে দেখছিলাম ঘটনাটা, খুব ধীরে ধীরে পরতে পরতে ছায়া রূপান্তরিত হচ্ছিল আলোয়।
আমার নাটক লেখার শুরুতে চরিত্রদের নাম আমি দেই 'এ', 'বি', 'সি' এরকম করে। দ্যা হোমকামিং লেখার সময়ে আমি দেখলাম একজন লোক একটা প্রায়শূন্য ঘরে ঢুকে তার প্রশ্নটি ছুঁড়লো কদাকার এক সোফায় বসে থাকা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী আরেক ব্যক্তিকে যে সেইসময় রেস্ এর পত্রিকা পড়ছিল। আমি ধারণা করলাম যে 'এ' হোল বাবা আর 'বি' তার ছেলে, তবে কোন প্রমান ছিলনা আমার কাছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার ধারণাটি সত্য প্রমাণিত হল যখন 'বি' (পরে যার নাম হয়েছিল 'লেনি') 'এ' কে বলে (পরে নাম হয়েছিল 'ম্যাক্স'),
'বাবা, আমি অন্য কোন বিষয়ে কথা বললে কি তুমি রাগ করবে? তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। একটু আগে যে আমরা রাতের খাবার খেলাম, কি নাম ছিল তার? তুমি কি বলো একে? একটা কুকুর কেনোনা কেন তুমি? তুমি তো কুকুরের বাবুর্চি । আসলেই। তোমার ধারণা তুমি একপাল কুকুরের জন্য রান্না করছো।'যেহেতু 'বি' 'বাবা' সম্বোধন করলো 'এ' কে, আমার পক্ষে এই ধারণাটা যুক্তিযুক্ত যে তারা বাপ-ছেলে। এ বিষয়ও স্পষ্ট যে 'এ' রান্না করে এবং তার রান্নার হাত খুব সুবিধার না। তার মানে কি এখানে মায়ের চরিত্র নেই? আমি জানতাম না। কিন্তু তখনো আমি নিজেকে বলেছিলাম, আমাদের শুরুগুলি কখনোই আমাদের শেষ জানেনা।
'ডার্ক'একটা বড় জানালা। বিকালের আকাশ। একজন লোক, 'এ' (পরে হয়েছিল 'ডিলি'), এক মহিলা 'বি' (পরে হয়েছিল 'কেইট'), পানীয় হাতে বসে ছিল । 'মোটা না চিকন?' জিজ্ঞেস করে লোকটা। কার কথা বলছে ওরা? পরে আমি দেখি, জানালায় দাঁড়িয়ে, এক নারী, 'সি' (পরে হয়েছিল 'এ্যানা'), তার ওপর আলো পরছে অন্যভাবে, অন্যান্যদের থেকে পিছন ফিরে সে আছে, তার চুল - গাঢ়/অন্ধকার (ডার্ক)। বড় অদ্ভুত মূহুর্ত সেটা, যখন কোন চরিত্র রচনা করি যার কোন অস্তিত্বই ছিলনা এক মুহুর্ত আগেও। এর পরের অংশ অনিয়মিত, অনিশ্চিত এমনকি ঘোরলাগা, যদিও কখনো কখনো রূপ নিতে পারে এক অপ্রতিরোধ্য ধারায়। লেখকের অবস্থান এখানে বেকায়দার। এক অর্থে চরিত্ররা তার উপস্থিতি অপছন্দ করে। এরা তাকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে, এদের সাথে বসবাস মোটেই সুখের নয়, তাদের সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। তাদের ওপর আধিপত্য ফলানো যাবে না কিছুতেই। একটা পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপারটা অনেকটা এক বিরতিহীন ইঁদুর-বেড়াল, কানামাছি অথবা লুকোচুরি খেলার মতন। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় রক্ত-মাংসের মানুষ নিয়েই কাজ করছি, যাদের রয়েছে নিজস্ব সত্তা, নিজস্ব ইন্দ্রীয়, আর এমন কিছু উপাদান, যা একজন লেখক বদলাতে, প্রভাবিত করতে অথবা বিকৃত করতে পারেন না।
শিল্পের ভাষা তাই এক ঝাপসা দ্ব্যর্থক বস্তু, চোরাবালি, ট্র্যমপোলিন অথবা বরফজমা পুকুর, যা যে কোন সময় লেখকের পায়ের তলা থেকে সরে যেতে পারে। তবে আগেও বলেছি, সত্যের সন্ধান কখনোই থামেনা। তাকে মুলতুবি রাখা যায়না, স্থগিত করা যায় না। তার মোকাবিলা করতে হয়, তৎক্ষণাৎ।
রাজনৈতিক নাটকের সমস্যা আবার ভিন্ন ধরণের। উপদেশ দেয়া থেকে সবরকমভাবে বিরত থাকতে হয়। নিরপেক্ষতা আবশ্যিক। চরিত্রদের নিজের মত নিঃশ্বাস নিতে দিতে হবে। লেখক তাদের সীমাবদ্ধ বা সংকুচিত করতে পারেন না নিজের রুচি, মতামত অথবা কুসংস্কারকে চরিতার্থ করতে। লেখক বিভিন্ন দিক থেকে এদের কাছে আসার জন্য প্রস্তুত থাকেন , একটি সম্পূর্ণ এবং নির্বাধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, হঠাৎ হঠাৎ তাদের বিস্মিত করে দেয়া যায় নিশ্চয়ই, তবে অবশ্যই তাদের নিজের পথে চলার স্বাধীনতা দিতে হয়। সবসময় যে এর পরিণাম ভালো হয়, তাও না। আর রাজনৈতিক ব্যঙ্গ নাটক অবশ্য এইসব নীতির কোনটাই মানেনা, বরং উল্টাটাই সে করে, যা তার ক্ষেত্রে উপযুক্ত।
আমার নাটক দ্যা বার্থডে পার্টি (জন্মদিনের উৎসব) তে আমার মনে হয় আমি হরেক রকম পন্থাকেই ঘোরাফেরা করতে দেই সম্ভাবনার ঘন বনে শেষমেষ যেকোন একটিকে বশীভূত করায় মন দেবার আগে।
মাউন্টেন ল্যাংগুয়েজ (পাহাড়ের ভাষা) এ এরকম কোন ভান নাই। এই নাটক পাশবিক, ছোট আর কুৎসিত। কিন্তু নাটকের সৈনিকরা এর থেকেও মজা পায় ঠিকই। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে অত্যাচারীদের অল্পতেই একঘেয়ে লাগে। তাই তাদের মন ভালো রাখার জন্য মাঝে মাঝে হাসিঠাট্টার প্রয়োজন আছে। এর সত্যতা প্রমান করে বাগদাদের আবু গারিবে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ। মাউন্টেন ল্যাংগুয়েজ বিশ মিনিটের নাটক, অথচ এটা চলতেই থাকতে পারতো, ঘন্টার পর ঘন্টার পর ঘন্টা, একইভাবে, বারে বারে, ঘন্টার পর ঘন্টা।
আবার অন্যদিকে, অ্যাশেস টু অ্যাশেস (ছাই থেকে ছাই), আমার মনে হয়েছে পানির নীচে ঘটছে। এক ডুবন্ত নারী, ঢেউএর উপরে হাত বাড়িয়ে আছে, দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, অন্য কাউকে ধরার চেষ্টা করছে, অথচ কাউকে পাচ্ছেনা, পানির উপরে বা নীচে, শুধু দেখছে, ছায়া, প্রতিবিম্ব, ভাসমান। এক নারী, একটা হারানো আদল ডুবন্ত জমিতে, যে পরিত্রান পায়না মৃত্যুদন্ড থেকে যা মনে হয়েছিল শুধু অন্যদের প্রাপ্য । কিন্তু যেভাবে তারা মরেছে, তাকেও মরতে হবেই।
অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের দখলে যে রাজনীতির ভাষা, তার মধ্যে এসবের বালাই নাই। কারণ এ যাবত যা দেখেছি তাতে এরকমই প্রমাণিত হয় যে তাঁরা সত্যে আগ্রহী না, ক্ষমতায় আগ্রহী আর আগ্রহী এই ক্ষমতার লালনে। আর ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য মানুষকে অজ্ঞতায় রাখা জরুরী, যাতে তারা সত্য জানতে না পারে, এমনকি তাদের নিজের জীবন বিষয়েও। তাই আমাদেরকে ঘিরে থাকে মিথ্যার পর্দা, তার মধ্যেই বসবাস আমাদের।
এখানকার প্রতিটা মানুষ জানেন যে, ইরাক আক্রমনের বৈধতা স্বরূপ বলা হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনের দখলে রয়েছে বিপজ্জনক গণবিধ্বংসী অস্ত্রসস্ত্র, যার কোনো কোনোটা প্রয়োগ করার ৪৫ মিনিটের মধ্যে শুরু হবে ধ্বংসযজ্ঞ। আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছিল যে এটাই সত্য। সত্য ছিল না। আমাদের বলা হয়েছিল ইরাক আল কায়দার সাথে যুক্ত আর ২০০১ এ নিউ ইয়র্কএ ঘটে যাওয়া সেপ্টেম্বার ১১ এর নৃশংসতায় তারাও সামিল ছিল। আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছিল যে এটাও সত্য। এটাও সত্য ছিল না। আমাদের বলা হয়েছিল ইরাক সারা পৃথিবীর নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ এবং নিশ্চিত করা হয়েছিল এর সত্যতা সম্পর্কে। সত্য ছিলনা এটাও। সত্য পুরোপুরিই অন্য বিষয়। সত্য হল যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে তার ভূমিকা বলতে কি বোঝে আর কি রূপে তার প্রয়োগ করে। তবে বর্তমানে ফেরার আগে আমি অদূর অতীতের দিকে একবার তাকাতে চাই, অর্থাৎ দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির দিকে দৃষ্টি ফেলতে চাই। এসময়টার সতর্ক অনুসন্ধান আমাদের অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
সবাই জানেন যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সারা পূর্ব ইউরোপ জুড়ে কি ঘটছিল। পদ্ধতিগত নির্দয়তা, নৃশংসতা আর একক সত্তার দমন। এ সবকিছুই যাচাই এবং দলিলকৃত। কিন্তু আমার আপত্তি হলো একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধগুলির রেকর্ড হয়েছে খুব ভাসাভাসাভাবে, দলিল, সত্যতা স্বীকার এমনকি অপরাধ হিসাবে এগুলিকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা। আমি মনে করি এটা বলতেই হবে যে পৃথিবী এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তার সাথে সত্যের গাঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের কারণে যদিও খানিকটা রাশটানা, পৃথিবীজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকলাপে এটা পরিষ্কার যে যা খুশী তাই করার মত ক্ষমতা তার আছে। একটা স্বাধীন দেশে সরাসরি আক্রমন কখনোই আমেরিকার পছন্দের উপায় ছিলনা। যুক্তরাষ্ট্রের নিজের ভাষায় সে পছন্দ করে 'স্বল্পমাত্রার সংঘর্ষ'। এর মানে হলো হাজার হাজার মানুষ মরবে ঠিকই, তবে কোন দেশে বোমা হামলার চেয়ে অনেক ধীরগতিতে। একটা দেশকে ভেতর থেকে সংক্রামিত করা, বিজানু ছড়িয়ে ঘা বাড়তে দেখা। অধিবাসীরা যখন ম্রিয়মান অথবা মৃত আর বন্ধুবেশে মিলিটারি এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলি যখন আরামে ক্ষমতায় আসীন, সেইসময় আপনি যাবেন ক্যামেরার সামনে আর বলবেন - গণতন্ত্র জয়ী হলো।
যে সময়ের কথা আমি বলছি তখন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে এরকম অবস্থা ছিল স্বাভাবিক। নিকারাগুয়ার ট্র্যজেডি এ বিষয়ে একটি মূল্যবান সবুদ। এ ঘটনাটি আমি একটি যুৎসই উদাহরণ হিসাবে হাজির করতে চাই তৎকালীন এবং বর্তমান পৃথিবীতে নিজের ভূমিকা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা সম্পর্কে।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মার্কিন দূতাবাসের এক বৈঠকে আমিও ছিলাম। মার্কিন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল নিকারাগুয়ার বিদ্রোহী দল কন্ট্রাকে আরো আর্থিক সাহায্য করার ব্যাপারে। আমি গিয়েছিলাম নিকারাগুয়ার প্রতিনিধি হিসাবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি সেদিন ছিলেন ফাদার জন মেটক্যাফ। মার্কিন পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রেমন্ড সিট্জ (সেই সময় দূতাবাসের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা তবে পরবর্তীতে তিনি নিজেই রাষ্ট্রদূতের পদ গ্রহণ করেন)। ফাদার মেটক্যাফ বললেন -
'স্যার, আমি উত্তর নিকারাগুয়ায় এক ধর্মীয় এলাকার তত্ত্বাবধায়ক। এ এলাকার লোকেরা একটি স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর সংস্কৃতিকেন্দ্র গঠন করেছিল। আমরা শান্তিতেই ছিলাম। কয়েকমাস আগে কন্ট্রাদের একটা দল আমাদের এলাকায় চড়াও হলো। স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সংস্কৃতি কেন্দ্র সবকিছু ধ্বংস করেছে তারা চুড়ান্ত বর্বরতায়। নৃশংসভাবে ধর্ষণ করেছে নার্স আর শিক্ষিকাদের, ডাক্তারদের জবাই করেছে। আপনি দয়া করে মার্কিন সরকারের কাছে দাবী জানান, সরকার যেন এরকম ঘৃণ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে তার সমর্থন তুলে নেয়।'রেমন্ড সিট্জ একজন দায়িত্বশীল, যুক্তিবাদী আর অভিজাত ব্যক্তি হিসাবে প্রশংসিত। কূটনৈতিক মহলেও তিনি বেশ শ্রদ্ধেয়। তিনি শুনলেন, খানিকটা বিরতি নিলেন, তারপর গম্ভীর গলায় কথা বললেন -
'ফাদার', তিনি বললেন, 'আমি একটা কথা বলি। যুদ্ধে নিরপরাধ মানুষ সবসময় ক্ষতিগ্রস্থ হয়।'এরপর একটা হিম নৈঃশব্দ নেমেছিল ঘরে। আমরা নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তার কোন ভাবান্তরই হয় নাই। নিরপরাধ মানুষ, অবশ্যই, সব সময় ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
শেষপর্যন্ত একজন বললেন -
'কিন্তু এই ক্ষেত্রে "নিরপরাধ মানুষ" এমন এক নৃশংস দলের নিষ্ঠুরতার শিকার যার সমর্থন করছে আপনার সরকার। যদি কংগ্রেস কন্ট্রাদের আরো অর্থ সাহায্য করে এই রকম পাশবিক কর্মকান্ড আরো ঘটবে। নয় কি? আপনার সরকার কি তবে একটি স্বাধীন আর সার্বভৌম দেশে হত্যা এবং বিধ্বংসের সর্মথন অপরাধে অপরাধী না?'সিট্জ নির্বিকার -
'উপস্থাপিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আপনার উক্তির সাথে আমি দ্বিমত প্রকাশ করছি।'আমরা দূতাবাস ছেড়ে আসার সময় এক মার্কিন সদস্য আমাকে বলেছিল সে আমার নাটক পছন্দ করে। আমি তার সাথে কথা বলি নাই।
আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে এই সময়েই প্রেসিডেন্ট রিগ্যান বলেছিলেন
'নৈতিকভাবে কন্ট্রারা আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষদের সমতূল্য।'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪০ বছরেরও বেশী সময় ধরে নিকারাগুয়ার নিষ্ঠুর সামাথা একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছে।
১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়ার জনগন সান্দিনিস্তার নেতিৃত্বে গণবিপ্ললবের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটায়। যদিও সান্দিনিস্তারাও নিখুঁত ছিলনা। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে কিছু পরষ্পরবিরোধী ব্যাপার ছিল আর অনেক বিষয়ে সহসশীলতারও অভাব ছিল। তবুও তারা ছিল বুদ্ধিমান, যুক্তিসংগত আর সভ্য। একটি স্থিতিশীল ও সুন্দর সমাজ গঠনের উদ্যগ নিয়েছিল তারা। হাজার হাজার দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকেরা জীবন ফিরে পেয়েছিল সান্দিনিস্তা শাসন আমলে। সে সময় ১ লাখেরও বেশী পরিবার পেয়েছিল চাষের জমি। দুইহাজার স্কুল গঠিত হয়েছিল। বেশ ব্যাপক আর জোরদার সংগঠনের কারণে দেশের নিরক্ষরতা কমে দঁড়িয়েছিল সাত ভাগের এক ভাগে। অবৈতনিক শিক্ষা আর বিনা পয়সার চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শিশু মৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছিল এক তৃতীয়াংশে। আর পোলিও উচ্ছেদ হয়েছিল সমূলে।
এই সফলতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা করেছে লেনিন/মার্কসবাদী নাশকতা বলে। মার্কিন সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এক বিপজ্জনক উদাহরণের পত্তন হচ্ছিল। যদি নিকারাগুয়াকে অনুমতি দেয়া হয় সামাজিক স্থিতি ও ন্যায়শীলতা স্থাপন করার, শিক্ষা ও চিকিৎসার মান বাড়ানোর, সামাজিক ঐক্য আর জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধির, তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলিও তো একই দাবী তুলবে, একই কাজ করবে।
আল সালভাদোরে সে সময় জোর প্রতিরোধ উঠেছিল তাদের তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থার বিরূদ্ধে। আমি আগেও 'মিথ্যার পর্দা'র কথা বলেছি, যা আমাদের ঘিরে আছে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান নিকারাগুয়াকে বলতেন 'সমগ্রতাবাদী জেলখানা'। মিডিয়া ও বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকার এই উক্তিকে সঠিক ও ন্যায়সংগত বলেই গ্রহণ করেছে। অথচ সান্দিনিস্তা সরকার আমলে কোন ডেথ স্কোয়াডের রেকর্ড নাই। কোন অত্যাচারের রেকর্ড নাই। পদ্ধতিগত অথবা সরকারীভাবে সামরিক নির্মমতারও রেকর্ড নাই কোন। সরকারে তিনজন ধর্মযাজক ছিলেন, দুইজন ঈসায়ী আর একজন ম্যারিকনোল মিশনারী। 'সমগ্রতাবাদী জেলখানা' ছিল পাশের রাজ্যে - আল সালভাদোর আর গুয়াতেমালায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র গুয়াতেমালার গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়েছিল আর পরবর্তী একের পর এক সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের বলি হয় প্রায় ২ লাখ মানুষ। পৃথিবীর ছয়জন প্রসিদ্ধ ঈসায়ীকে ১৯৮৯ সালে সান সালভাদোরে সেন্ট্রাল আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে নৃশংসভাবে খুন করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার ফোর্ট বেনিংএ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আলকাটল সেনাবাহিনী। প্রচন্ড সাহসী আর্চবিশপ রোমেরো খুন হন একটি ধর্মীয় বক্তৃতার সময়। প্রায় ৭৫০০০ মানুষ নিহত হয়েছে এসময়ে। কেন তাদের মারা হলো? তারা খুন হয়েছে কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল আরেকটু ভালো ভাবে জীবন যাপন করা যায় এবং তা অর্জন করা সম্ভব। এই বিশ্বাস তৎক্ষণাৎ তাদের পরিণত করলো কমুনিষ্টএ। তারা খুন হয়েছে কারণ জন্মসূত্রে পাওয়া গরিবী, উৎপীড়ন ও লাঞ্ছনার বিরূদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সাহস করেছিল তারা। যুক্তরাষ্ট্র শেষপর্যন্ত সান্দিনিস্তা সরকারেরও পতন ঘটাতে পেরেছিল। যদিও তাতে সময় লেগেছে বেশ কয়েক বছর। তবে অবিরাম অর্থনৈতিক নীপিড়ন আর ৩০ হাজার মৃত্যুতে শেষ পর্যন্ত নিকারাগুয়ার মানুষের মনোবল ফুরিয়ে যায়। আবার তারা দারিদ্র্যপীড়িত আর সর্বশান্ত হলো। ক্যাসিনোগুলো ফিরে এলো দেশে। বিদায় নিলো অবৈতনিক স্কুল আর নিখরচার চিকিৎসা। বড় ব্যবসাকেন্দ্রগুলি ফিরে এলো নতুন উদ্যমে। 'গণতন্ত্রের' প্রতিষ্ঠা হলো।
তবে এই 'নীতি' শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সারা পৃথিবীতেই চালু হয়েছে। দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীর সমস্ত ডানপন্থী সামরিক একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছে অথবা গঠন করেছে। আমি ইন্দোনেশিয়া, গ্রীস, উড়োগুয়ে, ব্রাজিল, পারাগুয়ে, হাইতি, তুর্কি, ফিলিপিন্স, গুয়াতেমালা, আল সালভাদোর আর অবশ্যই চিলির কথা বলছি। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে বিবমিষায় আক্রান্ত করেছে চিলিকে তা কোনদিন মুছে ফেলা যাবে না, ক্ষমারও অযোগ্য। এসব দেশে হাজার হাজার হত্যাকান্ড ঘটেছে। সত্যি? সব ক্ষেত্রেই কি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই দায়ী? উত্তর হলো হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের কখনো তা জানতে দেয়া হয় না।
এরকম কখনো হয় নাই। কোন কিছুই কখনো হয় নাই। এমন কি যখন এসব হচ্ছিল তখনো তা হচ্ছিল না। এসব কোন ব্যাপার না। কোন আগ্রহের বিষয় না। যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ সবসময়েই পদ্ধতিগত, দৃঢ়, নির্মম, অনুশোচনাহীন অথচ খুব কম লোকই এ নিয়ে কথা বলেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে বাহ্বা দিতেই হয়। খুব নিপুনভাবে সারা পৃথিবীর উপরে তারা কতৃত্ব করেছে সার্বজনীন মাঙ্গলিক বাহিনীর ভেক ধরে। চরম সফল মগজধোলাইএর এক বিচক্ষণ এবং উজ্জ্বল উদাহরন।
আমি আপনাদের বলছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রোড শো। নির্মম, উদাসীন, অবজ্ঞাশীল, নির্দয় সে বটে তবে মানতেই হয় তার চাতুর্য। বিক্রেতা হিসাবে সে একা এবং তার সবচেয়ে বেশী বিক্রয়যোগ্য পণ্য হলো আত্মপ্রেম। যুক্তরাষ্ট্র জয়ী। এদেশের যে কোন রাষ্ট্রপতি টেলিভিশনে বলেন 'আমেরিকার মানুষ', সম্পূর্ণ বাক্যটা এরকম
' আমি আমেরিকার জনগনকে বলছি, এখন প্রার্থণার সময়, আমেরিকার মানুষের অধিকার আদায়ের সময় আর আমেরিকার জনগনের পক্ষ থেকে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণে আমি আমেরিকার মানুষের কাছে আবেদন জানাই তারা যেন তাদের প্রেসিডেন্টএর প্রতি আস্থা রাখেন.'দারুণ জ্বলজ্বলে পরিকল্পনা। চিন্তা কে দমিয়ে রাখতেই ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। 'আমেরিকা জনগণ' শব্দগুলি একটা তুলতুলে কুশনের মত আরামদায়ক নিশ্চিন্তি নিয়ে আসে। চিন্তার আর দরকার পরে না তখন। কুশনে হেলান দিয়ে আরাম করলেই হয়। কুশনটি হয়তো আপনার বোধবুদ্ধি, বিবেচনাকে শ্বাসরূদ্ধ করছে তবে বড় আরামদায়ক এ শ্বাসরোধ। এ আরাম অবশ্য দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসরত চারকোটি মানুষের ক্ষেত্রে অথবা সারা আমেরিকা জুড়ে ২০ লাখ কারাবন্দী নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে খাটেনা। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর স্বল্পমাত্রার সংঘর্ষ নিয়ে ভাবিত না। মৌনতা অবলম্বণ বা অন্য কোন ছলচাতুরীর কারণ সে খুঁজে পায় না আর। যুক্তরাষ্ট্র এখন নির্ভয়ে এবং অন্যকারো আনুকুল্যের পরোয়া না করেই তার সমস্ত তাস দেখাতে পিছপা হচ্ছেনা। সোজা কথায়, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন বা বিরোধী মতামতকে তোয়াক্কা করে না যুক্তরাষ্ট্র, বরং মনে করে এরা শক্তিহীন ও অবান্তর। আর তার পিছন পিছন গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় ব্যা ব্যা করতে করতে তার নিজস্ব মেষশাবক, করুণ ও অবলা গ্রেট ব্রিটেন।
আমাদের নৈতিক সংবেদনশীলতার কি হলো? কোনদিন কি ছিল এরকম কিছূ? এ শব্দগুলির অর্থ কি? এরা কি সেই অপসৃয়মান শব্দের কথা মনে করায় যার নাম বিবেক? যে বিবেক শুধু আমাদের কাজেরই না, অন্যান্যদের কর্মকান্ডের জন্যও দায়বোধ করে? এইসব বোধ কি মৃত এখন? গুয়ানতানামো বে'র দিকে তাকান, গত তিন বছর ধরে শ'য়ে শ'য়ে মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে কোন রকম দোষ সাব্যস্ত হওয়ার আগেই, কোন আইনি প্রতিনিধি বা কোন পদ্ধতি অবলম্বন ছাড়াই, বলতে গেলে এ আটক ব্যবস্থা চীরস্থায়ী। জেনেভা কনভেনশানকে পাত্তা না দিয়েই এই পুরোপুরি অবৈধ সংগঠন বজায় আছে। এটা যে সহ্য করা হচ্ছে তাই শুধু নয় বরং আন্তর্জাতিক সমাজ এ নিয়ে তেমন কিছু ভাবছেও না। এই চরম নিষ্ঠুর অপরাধের দায় একটি দেশের, যে দেশ নিজেকে 'স্বাধীন পৃথিবী'র নেতৃত্ব প্রদানকারী বলে ঘোষণা করে।
আমরা কি গুয়ানতানামো বে'র বাসিন্দাদের কথা চিন্তা করি? মিডিয়া তাদের সম্পর্কে কি বলে? মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় ছোট করে কোন খবর উঠে আসে। তাদেরকে এমন এক নো-ম্যানস্-ল্যান্ড এ পাঠানো হয়েছে যেখান থেকে হয়তো কোনদিনই তারা ফিরতে পারবে না। বর্তমানে অনেকেই অনশন ধর্মঘট করছে। তাদেরকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। এমনকি ব্রিটিশ নাগরিকদেরও। এবং এ ব্যাপারেও কোন কোমলতা নাই। কোন সিডেটিভ বা এনেসথেটিকেরও বালাই নাই। শুধু একটা নল ঢুকিয়ে দেয়া হয় জোর করে কন্ঠনালী বা নাক দিয়ে। রক্তবমি তারপর। এটাতো অত্যাচার।
বৃটেনএর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি বলেছে এ নিয়ে? কিছু না। বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী কি বলেছে? কিছু না। কেন নয়? কারণ যুক্তরাষ্ট্র বলেছে: গুয়ানতানামো বেতে আমাদের আচরণের সমালোচনা কে আমাদের প্রতি বৈরিতা বলে ধরে নেয়া হবে। হয় আপনারা আমাদের সঙ্গী, নয়তো বিরোধী। তাই ব্লেয়ার চুপ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমন একটি বর্বরতা, রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস, যা আন্তর্জাতিক আইন ব্যবস্থার শর্তহানি করেছে সম্পূর্ণভাবে। এই বেআইনী সামরিক কর্মকান্ড সম্ভব হয়েছে মিথ্যার পরে মিথ্যা সাজিয়ে চুড়ান্তরূপে মিডিয়া এবং সেইসাথে জনগণকে অপব্যবহারের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রন সুদৃঢ় করা। অন্য সব যুক্তি বিফলে যাবার পর এ পদক্ষেপের বৈধতা প্রমানের শেষ অবলম্বন হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশ - ইরাকের মুক্তি। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আর অঙ্গহানির জন্য দায়ী সামরিক বাহিনীর ভয়ঙ্কর উক্তি। আমরা ইরাকী মানুষের জন্য এনেছি অত্যাচার, বোমা, তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম, অগুনতি হত্যাকান্ড, দুর্দশা, লাঞ্ছনা এবং মৃত্যু আর এর নাম দিয়েছি 'মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা'।
ঠিক কি পরিমাণ মানুষ খুন করলে যুদ্ধোপরাধী ও গণ হন্তারকের যোগ্যতা অর্জন করা যায়? একশো হাজার? যথেষ্ট, আমি মনে করি। তাই আন্তর্জাতির ক্রিমিনাল কোর্টে বুশ ও ব্লেয়ারের বিচার চাওয়া একটা ন্যায্য দাবী। তবে বুশ এব্যাপারে চতুর। সে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টকে অনুমোদনই করে নাই। কাজেই কোন মার্কিন সৈন্য বা রাজনৈতিক নেতাকে যদি ডকে দাঁড়াতে হয়, বুশ আগে থেকেই নৌবাহিনী পাঠানোর হুমকি দিয়ে রেখেছে। তবে টনি ব্লেয়ার এই কোর্টকে অনুমোদন করেছে আর তাই বিচারের জন্য তাকে পাওয়া যাবে। আদালত আগ্রহী হলে আমরা তার ঠিকানাও জানাতে পারি । ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট, লন্ডন।
এই প্রসঙ্গে মৃত্যু অবান্তর। বুশ ও ব্লেয়ারের কেউই মৃত্যু বিষয়ে খুব চিন্তিত না। ইরাকের বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে মার্কিন বোমা ও মিসাইলে অন্তত একলাখ ইরাকী খুন হয়েছিল। এই মানুষগুলি কেউ না, তাদের মৃত্যুর কোন অস্তিত্বই নাই। তারা ফাঁকা। তারা যে মৃত সে রকম কোন রেকর্ডও নাই।
'আমরা মৃতদেহ গুনিনা',মার্কিন সেনানায়ক টমি ফ্র্যাঙ্কস জানিয়েছে।
আক্রমনের শুরুতে বৃটিশ এক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ইরাকী শিশুর গালে চুম্বনরত টনি ব্লেয়ারের ছবি ছাপা হয়েছিল - 'এক কৃতজ্ঞ শিশু'। কিছুদিন পরে আরেকটা গল্প আর ছবি ছিল সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায়, একটি চার বছরের ইরাকী ছেলে, দুই বাহু বিচ্ছিন্ন। তার পুরো পরিবার উড়ে গেছে মিসাইলে । শিশুটিই কেবল বেঁচে আছে। 'আমি আমার হাত দুটি কবে ফেরত পাবো?' ছেলেটা জানতে চেয়েছিল। এ নিয়ে আর কিছু লেখা হয় নাই। টনি ব্লেয়ার তো আর এই শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছিল না, অন্য কোন বিকলাঙ্গ শিশুকেও না। রক্ত নোংরা, রক্ত শার্ট আর টাই নোংরা করে টেলিভিশানে অকৃত্রিম বক্তৃতা দেয়ার সময়।
দুইহাজার মার্কিনীর মৃত্যু একটা লজ্জার ব্যাপার। তাদেরকে রাতের অন্ধকারে কবর দেয়া হয়। জানাজাও হয় চুপিসারে, কাউকে বিরক্ত না করে। বিকলাঙ্গরা বিছানায় পচে, কেউ সারাজীবন, তাই মৃত আর বিকলাঙ্গ সবাই পচে, তফাৎ শুধু কবরের ভিন্নতা। পাবলো নেরুদার একটি কবিতার অংশ 'আই এ্যা্ম এক্সপ্লেইনিং এ ফিউ থিংগস্ ' (আমি কিছু কৈফিয়ৎ দিচ্ছি) নীচে বলছি.
আর এক সকালে,সেই সবকিছু পুড়ছিলপ্রথমেই বলে নেই যে নেরুদার কবিতা উদ্ধৃত করে আমি কোনভাবেই গণপ্রজাতন্ত্রী স্পেইনএর সাথে সাদ্দামের ইরাকের তুলনা করছিনা। আমি নেরুদার উদ্ধৃতি দিলাম কারণ সমসাময়িক কোন কবিতাতেই সাধারণ মানুষের উপর বোমা হামলার এমন নাড়িছেঁড়া বিবরণ আমি দেখি নাই। আমি আগেও বলেছি সে যুক্তরাষ্ট্র এখন তার তুরুপের তাস দেখানোর ব্যাপারেও দিলখোলা। মার্কিন ঘোষিত নীতিই এখন সর্বাঙ্গীন আধিপত্য। এই নাম আমি দেই নাই, তারাই দিয়েছে।
এক সকালের বন-ফায়ার
মাটি থেকে সটান লাফিয়ে
গ্রাস করলো মানুষকে,
আর তারপর থেকে আগুনকে,
বারুদকে তারপর থেকে, এবং অতঃপর রক্ত।
উড়োজাহাজ আর বিস্তীর্ণ জলাভূমির মালিক দস্যুরা,
অঙ্গুরী আর রাজকণ্যাদের প্রভু দস্যুরা,
কালো ধর্মভাইদের নিয়ে দস্যুরা এলো আকাশপথে
আশীর্বাদ ছিটাতে ছিটাতে শিশুর হত্যার জন্য।
আর শিশুদের রক্ত গড়ালো রাস্তায় গোলমাল ছাড়াই,
শিশুর রক্তের মতন।
শেয়াল যাদের শেয়ালও ঘৃণা করবে
পাথর যাতে শুকনো কাঁটাগাছও পারেনা দাঁত বসাতে,
কালসাপ যারা কালসাপের কাছেও ঘৃণ্য।
তোমার সঙ্গে মুখোমুখি আমি দেখেছি
স্পেনের রক্ত জলোচ্ছাসের মতই উথলে উঠছে
একটা ঢেউয়েই তোমায় ডোবাবে
ছুড়ি চাকু এবং অহং সমেত।
বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কেরা;
দেখ আমার মরা বাড়ী; ভাঙ্গা স্পেনকে দেখ:
প্রতিটা ঘর থেকে বইছে পোড়া ধাতুর নালা
ফুলের বদলে স্পেনের প্রতিটা রন্ধ্র থেকে স্পেন
আবির্ভুত হয় আর
প্রতিটা মৃত শিশুর থেকে চক্ষুষ্মান রাইফেল
আর প্রতিটা অপরাধ থেকে জন্মায় বুলেট
যারা একদিন খুঁজে নেবে তোমার
বুকের ঠিক মাঝখানটিকে।
এবং তোমরা জানতে চাইবে: কেন তার কবিতা
স্বপ্ন আর পাতার কথা বলেনা
আর বলেনা তার দেশজ আগ্নেয়গিরির কথা।
এসো আর রাস্তাগুলোয় রক্ত গড়ায় দেখো।
এসো আর দেখো
রাস্তায় রক্ত গড়ায়।
এসো আর দেখো রক্ত
গড়ায় রাস্তায়!
'সর্বাঙ্গীন আধিপত্য' মানে ভূমি, সমুদ্র, বাতাস, মহাশূন্য এবং আর সব সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রন। ১৩২ টি দেশে ৭০২ টি সামরিক স্থাপনা আমেরিকার অধিকৃত (একমাত্র সম্মানজনক ব্যতিক্রম সুইডেন)। আমেরিকার কাছে আছে ৮০০০ সক্রিয় এবং ক্ষেপনযোগ্য পারমানবিক অস্ত্র। এর মধ্যে ২০০০ টি আছে 'হেয়ার ট্রিগার এলার্ট'এ। বিপদসংকেতের ১৫ মিনিটের মধ্যেই নিক্ষেপ করা যাবে এদের । আরো উন্নত পারমানবিক ব্যবস্থা তৈরী করছে তারা যা বাঙ্কার বাস্টার হিসাবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের চিরসহযোগী বৃটিশরাও মনস্থ করেছে তাদের নিজেদের পারমানবিক মিসাইল ট্রাইডেন্ট কে বদলাবে। কার দিকে তাক করা আছে এসব? ওসামা বিন লাদেন? আপনার? আমার? জো ডোক্স? চীন? প্যারিস? কে জানে।
আমরা জানি যে এই শিশুসুলভ পাগলামী - পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং সংরক্ষণ অবস্থান করছে মার্কিন রাজনৈতির দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক প্রশাসন বজায় রাখছে স্থায়ীভাবেই এবং এতে শৈথিল্যের কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ মানুষ সরকারের এ সকল কর্মকান্ডে রাগান্বিত, লজ্জিত, কান্ত কিন্তু হায়, রাজনৈতির বাহিনীর অংশ তারা এখনো নয়। যে বাড়তে থাকা ভয়, উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে মার্কিনিদের মধ্যে তা লাঘব হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
একজন লেখকের জীবন খুব অরক্ষিত, তার সব কর্মকান্ড প্রায় নগ্নতার মত প্রকাশ্য। এ নিয়ে কান্নাকাটির কিছু নাই। লেখক বেছে নেয় তার জীবন আর তা নিয়েই বাঁচতে হয় তাকে। লেখক জীবনের নিশ্চিত কোন পরিণাম নাই, কারো পরিণাম হতে পারে রক্তহিম করা ভয়ঙ্কর। লেখক একা, তার কোথাও কোন আশ্রয় নাই, রক্ষাকারী নাই। যদি না সে মিথ্যা বলে - সে ক্ষেত্রে তার নিজের আশ্রয় তৈরী করে সে নিজেই, এ পর্যায়ে সে হয়তো রাজনীতিবীদ হয়ে যায়।
আমি আজ বেশ কয়েকবার মৃত্যুর কথা বলেছি। এখন আমার নিজের একটা কবিতার উদ্ধৃতি দিব। কবিতার নাম মৃত্যু ।
কোথায় পাওয়া গেল মৃতদেহ?আমরা যখন আয়নায় প্রতিচ্ছবি দেখি, আমরা ভাবি মুখোমুখি প্রতিবিম্বটি বুঝি নির্ভুল। অথচ এক মিলিমিটার সরলেই ছবিটা বদলে যায়। আমরা আসলে দেখতে থাকি এক অশেষ প্রতিবিম্ব। কিন্তু মাঝে মাঝে লেখককে আয়না ভেঙে ফেলতে হয়। কারণ আয়নার অপর পাশ থেকেই সত্য আমাদের দিকে চেয়ে থাকে।
মৃতদেহ কে খুঁজে পেল?
মৃতদেহ কি মৃত ছিল যখন পাওয়া গেল?
কিভাবে পাওয়া গেল মৃতদেহ?
মৃতদেহটি কে ছিল? কে ছিল পিতা বা কন্যা
বা ভাই বা চাচা বা বোন বা মা বা ছেলে
মৃত আর পরিত্যক্ত দেহের? দেহটি কি মৃত ছিল,
পরিত্যক্ত যখন হলো? দেহটি কি পরিত্যক্ত ছিল?
পরিত্যক্ত তাকে কে করেছিল?
মৃতদেহটি নগ্ন ছিল?
না সফরের কাপড় ছিল গায়ে?
কি কারণে মৃতদেহকে মৃত বলে ঘোষণা দিলে?
তুমি কি ঘোষণা করেছিলে মৃতদেহকে মৃত?
মৃতদেহটিকে তুমি কতটুকু জানতে?
মৃতদেহ মৃত ছিল কি করে তা জানলে?
মৃতদেহকে গোসল কি করালে তুমি?
তার চোখের পাতা তুমি বুঁজে দিলে?
দেহটিকে তুমি কবর দিলে?
পরিত্যাগ তুমি তাকে করেছিলে?
মৃতদেহকে তুমি চুমু খেলে?
আমার বিশ্বাস ব্যাপক এই বিরুদ্ধচারণ সত্ত্বেও নাগরিক হিসাবে অনঢ় অবিচলতায় দৃঢ়তার সাথে সত্যের অনুসন্ধান এবং আমাদের জীবন ও সমাজে তাকে সংজ্ঞায়িত করা আমাদের দায়িত্ব। অবশ্য কর্তব্য। এই দৃঢ়তা আমাদের রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত না হলে আর কোনদিনই আমরা ফিরে পাবনা যা প্রায় হারিয়েছি - মানুষের সম্মান।
0 মন্তব্যসমূহ