কোথাও সুপ্ত - কাফকা' কে নিয়ে মিলান কুন্দেরা -১

অনুবাদ : শমীক ঘোষ


 কোন কবি কবিতার সৃষ্টি করেন না
কবিতাটা শুরু থেকেই কোথাও সুপ্ত আছে
বহু কাল ধরে সেইখানেই ছিল
কবি শুধু সেটা আবিষ্কার করেন

-       জ্যান স্ক্যাকেল  



আমার বন্ধু জোসেফ স্কভোরেকি তাঁর বইয়ে এই সত্যি ঘটনাটা লিখেছিলেন:

       প্রাগের একজন ইঞ্জিনিয়ার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন লন্ডনের একটি পেশাদারি আলোচনা সভায়। তিনি সেইখানে গেলেন, অংশগ্রহণ করলেন এবং প্রেগে ফিরে এলেন। ফিরে আসার কয়েক ঘন্টা পরে, তাঁর অফিসে বসে, তিনি তুলে নিয়েছিলেন রুড প্রাভো – পার্টির দৈনিক মুখপত্র – এবং পড়েছিলেন – লন্ডনের একটি আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত এক চেক ইঞ্জিনিয়ার, পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর সমাজতান্ত্রিক স্বদেশ সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করে পশ্চিমেই থেকে গেছেন।
        অবৈধ অভিবাসন এমন কুরুচিকর মন্তব্যের পর, খুব সহজ বিষয় নয়। কুড়ি বছরের জেল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু লেখাটা যে তাঁর সম্পর্কেই, তা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তাঁর সহায়ক অফিসে এসে তাঁকে দেখে অবাকহা ভগবান, আপনি ফিরে এসেছেন! আমি বুঝতে পারছি না – দেখেছেন আপনার সম্পর্কে কী লিখেছে?
        ইঞ্জিনিয়ার সহায়কের চোখে ভয় দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু কিই বা করবেন? ছুটে গেলেন রুডো প্রাভোর অফিসে। খুঁজে বার করলেন লেখাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদককে। সম্পাদক ক্ষমা চাইলেন, হ্যাঁ, বিষয়টা সত্যিই অস্বস্তিকর, কিন্তু তাঁর কিছু করার নেই, লেখাটার তিনি পেয়েছিলেন অভ্যন্তরীন মন্ত্রক থেকে।
ইঞ্জিনিয়ার অতঃপর পৌছালেন অভ্যন্তরীন মন্ত্রকে। সেখানে তাঁকে বলা হল যে হ্যাঁ এটা একটা ভুল, কিন্তু তাঁদেরও কিছু করার নেই কারণ প্রকৌশলবিদ সম্পর্কে এইরকমই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন লন্ডন দূতাবাসের গোয়েন্দা বিভাগ। ইঞ্জিনিয়ার অনুরোধ করলেন খবরটা প্রত্যাহার করার জন্য। না, তাঁরা জানালেন প্রত্যাহার করার নিয়ম নেই, কিন্তু তাঁরও কোন সমস্যা হবে না, কোন চিন্তা নেই।
    কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনিয়ারের চিন্তার অনেক কারণ ঘটল। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারলেন যে তাঁকে নজরে রাখা হচ্ছে, তাঁর টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, এবং তাঁকে রাস্তায় অনুসরণ করা হচ্ছে। তাঁর ঘুম বন্ধ হয়ে গেল, তিনি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, অবশেষে আর চাপ না নিতে পেরে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে বেআইনি ভাবে দেশত্যাগ করলেন। এবং সত্যি সত্যিই রাজনৈতিক কারণে অভিবাসন নিতে বাধ্য হলেন।




যে গল্পটা আমি এই মাত্র বললাম, সেই ধরণের গল্পকে আমরা প্রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বলি কাফকা-সদৃশ এই যে পরিভাষাটি, একজন শিল্পীর কাজ থেকে নেওয়া, একজন লেখকের তৈরী দৃশ্যের থেকে নির্নয় করা, হল  সেই সব পরিস্থিতির (সাহিত্যে কিংবা সত্যি জীবনে) একমাত্র সাধারণ বিভাজক যা অন্য কোন শব্দ বোঝাতে পারে না এবং কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব কোন উত্তর দিতে পারে না। 
        কিন্তু কি এই কাফকা-সদৃশ? 
এর কিছু বৈশিষ্ট বর্ণনা করার চেষ্টা করা যাক। 
এক:
আমাদের ইঞ্জিনিয়ার যে ক্ষমতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তার মধ্যে একটা অসীম গোলকধাঁধার বৈশিষ্ট আছে। তিনি কোনোদিনই এই অসমপনীয় করিডোরের উপান্তে পৌঁছাতে পারবেন না, জানতে পারবেন না তাঁর কে এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা দিয়েছিলেন। তাঁর পরিস্থিতি যেন আদালতের সামনে জোসেফ কেএর মত, কিংবা ক্যাসেল এর সামনে জমির সার্ভেয়ার কেএর মতই। এঁদের তিনজনেই এমনটা একটা জগতের যেখানে আর কিছুই নেই শুধু একটা প্রকাণ্ড গোলকধাঁধার মত প্রতিষ্ঠান আছে, যার থেকে তাঁদের নিস্তার নেই এবং যাকে বোঝার কোন উপায় নেই।
কাফকার আগের ঔপন্যাসিকরা অনেক সময়েই প্রতিষ্ঠানের মুখোস খুলেছেন এমন ভাবে যেন এইগুলো আসলে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সর্বজনীন অভীপ্সার সংঘর্ষের জায়গা। কাফকায় প্রতিষ্ঠান এমন এক প্রক্রিয়া যে স্বতন্ত্র নিয়মে চলে, কেউ জানে না কে এই নিয়মগুলির প্রোগ্রামার বা কবে প্রোগ্রাম করেছিলেন; যার কাছে মানুষের চিন্তার কোন মূল্য নেই এবং তাই বোধাতীত।
দুই:
দ্য ক্যাসেল –এর পঞ্চম অনুচ্ছেদে, গ্রামের মেয়র বিস্তারিত ভাবে কেকে বোঝাচ্ছেন তাঁর ফাইলের দীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপেবহুদিন আগে, একজন জমির সার্ভেয়ারকে নিয়োগ করার একটা প্রস্তাব ক্যাসেল থেকে এসেছিল। মেয়র এই প্রস্তাবে সায় দেন নি (তিনি লিখেছিলেন যে কোন জমির সার্ভেয়ারকে নিয়োগের দরকার নেই), কিন্তু তাঁর সেই জবাব ভুল দপ্তরে চলে যায়, এবং একটা খুব দুর্বোধ্য, দীর্ঘ বছর ধরে চলা, আমলাতান্ত্রিক ভুল বোঝবুঝির পরম্পরার পর, ভুল করে কে.-কে নিয়োগ করা হয়, ঠিক সেই সময় যখন সব কটা দপ্তর মিলে পুরোনো অচল সেই প্রস্তাবটিকে বাতিল করার কাজ করছে। তাই দীর্ঘ সফরের পর কেআসলে ভ্রান্তিবসত সেই গ্রামে চলে এসেছে। যদি এটা মেনে নেওয়া হয় যে কে.এর আসলে ক্যাসেল এবং এই গ্রামটি ছাড়া অন্য কোন অস্তিত্ব নেই, তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ অস্তিত্বটাই একটা ভুল।
এই কাফকা-সদৃশ জগতে ফাইল আসলে একটা প্লেটোনিক ধারণার ভূমিকা নেয়। তা যেন প্রকৃত বাস্তবের প্রতিনিধি,  অন্যদিকে মানুষের শারীরিক অস্তিত্ব যেন একটা অলীকতার পর্দায় একটা ছায়া মাত্র। সত্যি এই জমির সার্ভেয়ার আর প্রেগের ইঞ্জিনিয়ার যেন শুধু তাঁদের ফাইলের ছায়া, বা তার চাইতেও কম, তাঁরা আসলে তাঁদের ফাইলের একটা ভুলের ছায়ামাত্র, ছায়া যাদের ছায়া হিসাবেও বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
 কিন্তু যদি মানুষের জীবন শুধুই একটা ছায়াই হয় আর প্রকৃত বাস্তব থাকে অন্য কোথাও, যেখানে পৌছানো যায় না, মনুষ্যতর বা মনুষ্যতম কোন অস্তিত্বে, তাহলে আমরা ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রবেশ করি। সত্যিই কাফকার প্রথম আলোচকরা তাঁর উপন্যাসের ব্যাখা করেছিলেন ধর্মীয় রূপক হিসাবে।
কিন্তু আমি মনে করি এই ধরণের ব্যাখান ভ্রান্ত (কারণ এই ব্যাখায় আছে রূপক, যেখানে কাফকা আত্মস্থ করেছিলেন মানুষ জীবনের সুনির্দিষ্ট ঘটনা) কিন্তু জানায়যখনই ক্ষমতা নিজেকে অমান্য করে, তখনই সে সৃষ্টি করে তার নিজস্ব ধর্মতত্ত্ব; যখনই তা ভগবানের মত আচরণ করে, তা নিজের প্রতি জাগিয়ে তোলে এক ধর্মীয় বোধ; এমন জগতের বর্ণনা শুধু ধর্মতত্ত্বের পরিভাষাতেই সম্ভব।
কাফকা ধর্মীয় রূপক লেখেন নি, কিন্তু কাফকা-সদৃশ  তার ধর্মতত্ত্ব (বা ছদ্মধর্মতত্ত্ব) – এর থেকে  অবিচ্ছেদ্য।
        তিন:
       রাস্কালনিকোভ তাঁর অনুশোচনার ভার বহন করতে পারছিলেন না, শান্তি পেতে তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর শাস্তিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। এটা হল খুব পরিচিত সেই পরিস্থিতি যেখানে অপরাধ শাস্তি চায়।
        কাফকায় এই যুক্তি উলটে যায়। শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটি জানেন না কেন তাঁর এই অপরাধ। শাস্তির উদ্ভটতা এতই অসহনীয় যে শান্তি পেতে শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটি তাঁর দণ্ডের একটি ন্যায্যতা খোঁজেনশাস্তি অপরাধ খোঁজে।
         প্রেগের ইঞ্জিনিয়ারের শাস্তি ছিল প্রগাঢ় পুলিশি পাহারা। এই শাস্তি দাবী করে এমন অপরাধ যেটা করাই হয় নি, দেশত্যাগে অভিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার অবশেষে সত্যিই দেশত্যাগ করেন। শাস্তি অবশেষে অপরাধ খুঁজে নেয়
        তাঁর বিরুদ্ধে কি অভিযোগ না জেনে, দ্য ট্রায়ালের সপ্তম অধ্যায়ে কে. তাঁর পুরো অতীতটাকেই “পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে” পরীক্ষা করবে বলে ঠিক করে। “স্বয়ংদণ্ডপ্রদান” যন্ত্র চলতে শুরু করে। দণ্ডিত তার অপরাধ খোঁজে।
        একদিন, অ্যামেলিয়া ক্যাসেলের একজন পদাধিকারীর থেকে একটি অশ্লীল চিঠি পান। রেগে গিয়ে তিনি চিঠিটা ছিড়ে ফেলেন। অ্যামেলিয়ার এহেন ব্যবহারের তিরষ্কার পর্যন্ত দরকার পড়ে না ক্যাসেলের। ভয় (সেই ভয় যা আমাদের ইঞ্জিনিয়ার দেখেছিলেন তাঁর সেক্রেটারীর চোখে) নিজেই তার কাজ করে। কোন আদেশ ছাড়া, ক্যাসেল থেকে আসা কোন বোধগম্য নির্দেশ ছাড়াই, সবাই অ্যামেলিয়ার পরিবারকে মহামারীর মত এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
        অ্যামেলিয়ার বাবা তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেইখানেও একটি সমস্যা দেখা দেয়শুধু এই শাস্তিত সিদ্ধান্তের উৎস খুঁজে পাওয়াই অসম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্তেরই আসলে  কোন অস্তিত্ব নেই। পুনর্বিচারের জন্য, ক্ষমা চাওয়ার জন্য, আগে দণ্ডপ্রাপ্ত হতে হবে! অ্যামেলিয়ার বাবা তাই ক্যাসেলের কাছে অপরাধ ঘোষণা করবার জন্য ভিক্ষা চান। অতএব শুধু এইটুকু বললেই চলে না যে যে শাস্তি অপরাধ খোঁজে। এই ছদ্মধর্মতত্ত্বের জগতে, দণ্ডিত তার দণ্ডের প্রকৃত কারণ- অপরাধ-এর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ভিক্ষা চায়!
        আজকাল অনেক সময়ে দেখা যায় যে বদনাম হওয়া কোন মানুষ সামান্যতম কাজটুকুও জোটাতে পারেন না। বারবার নিষ্ফল হয়ে তাঁদের অপরাধ করেছেন এবং সেই কারণে তাঁদের কাজ পাওয়া নিষিদ্ধ এমন সার্টিফিকেট চাইতে হয়। আর শাস্তির কোন সিদ্ধান্ত খুঁজেই পাওয়া যায় না। প্রেগে যেহেতু আইনত কাজ করা বাধ্যতামূলক, এঁরা অবশেষে পরজীবি হিসেবে অভিযুক্ত হন, যার মানে তাঁরা কাজ এড়িয়ে চলার দায়ে অভিযুক্ত হন। শাস্তি অভিযোগ খুঁজে নেয়।
চার:
        প্রেগের ইঞ্জিনিয়ারের গল্পটা অনেকটা মজার গল্পের মত, একটা রসিকতা হাসির উদ্রেক করে।
        দু’জন ভদ্রলোক, একেবার সাধারণ ( ফ্রেঞ্চ অনুবাদে যেমন আছে তেমন “ ইন্সপেক্টর” নন), একদিন সকালে জোসেফ কে.-কে হতভম্ব করে তাঁর শোয়ার ঘরে উপস্থিত হন, তাঁকে জানান যে তাঁকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, এবং তাঁর ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেন। কেএকজন খুব নিয়মনিষ্ঠ সরকারী কর্মচারী তাঁদের ফ্ল্যাট থেকে বার না করে দিয়ে, রাতপোশাক পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ আত্মপক্ষ সমর্থন করতে থাকেন। কাফকা যখন তাঁর বন্ধুদের সামনে দ্য ট্রায়ালের  প্রথম অধ্যায়টা পড়ে শোনান, তখন সব্বাই হেঁসে উঠেছিলেন, এমনকি লেখক নিজেও।
        ফিলিপ রথের দ্য ক্যাসেলের কাল্পনিক ফিল্ম ভারশানেগ্রাউচো মার্ক্স ল্যাণ্ড সার্ভেয়র কেএর ভূমিকায়, আর চিকো আর হার্পো তাঁর দুই সহকারী। হ্যাঁ, রথ খুবই সঠিককাফকা-সদৃশ জগতের মূল নির্যাস থেকে কমিককে আলাদা করা যায় না।
        কিন্তু তাঁর গল্পটা কমিক এটা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে স্বস্তির কারণ নয়। তিনি তাঁর নিজের জীবনের রসিকতায় আবদ্ধ, যেমন পাত্রে মাছ; তাঁর কাছে এটা মজার নয়। সত্যিই রসিকতা ততক্ষণ রসিকতা যতক্ষণ আপনি পাত্রের বাইরে; উলটো দিকে কাফকা আমাদের নিয়ে যান ভিতরে, রসিকতার অভ্যন্তরে, কমিকের বীভৎসতায়।
        কাফকা-সদৃশ জগতে কমিক ট্র্যাজিকের উলটো দিক নয় (ট্র্যাজি-কমিক) যেমন শেক্সপীয়ারে; এখানে তা ট্রাজিককে আরো সহনীয় করে তোলার জন্য তার স্বরকে নরম করে না, এটা ট্র্যাজিকের সাথেও যায় না, এটা ট্রাজিককেতার ডিমের মধ্যে ধ্বংস করে এবং তাই তার শিকারকে, তাঁদের সামান্যতম উপসম – ট্রাজিকের (সত্যি অথবা ধরে নেওয়া) মহিমার থেকেও বঞ্চিত করে। ইঞ্জিনিয়ার তার স্বদেশ হারান, আর সব্বাই হেসে ফেলেন।



        আধুনিক ইতিহাসে এমন অনেক সময় আছে যখন জীবন কাফকার উপন্যাসের মত হয়ে যায়।
        আমি যখন প্রেগে থাকতাম, আমি অনেক সময়েই শুনতে পেতাম লোকে পার্টির সদর দপ্তরকে (একটা কুৎসিত, বলা চলে আধুনিক বাড়ি) “দ্য ক্যাসেল” বলে উল্লেখ করতে। একইভাবে প্রায়শই আমি শুনতে পেতাম পার্টির দ্বিতীয় প্রধানকে ( যাঁর নাম ছিল কমরেড হেন্ড্রিক) “ক্লাম”( চেক ভাষায় যেটা অনেক বেশী সুন্দর কারণ ক্লাম মানে “মরিচিকা” বা “ঠগ”) বলে ডাকা হচ্ছে।
        কবি এ., একজন বিরাট কম্যুনিস্ট ব্যক্তিত্ব, পঞ্চাশের দশকের একটা স্তালিনিস্ত বিচারের পর জেলে যান। তাঁর সেলে তিনি এক গুচ্ছ কবিতা লেখেন, যাতে সমস্ত ভীতিজনক অভিজ্ঞতার পরেও তিনি নিজেকে কম্যুনিজমের প্রতি বিশস্ত বলে অবিহিত করেন। কাপুরুষতার জন্য নয়। কবি তাঁর বিশস্ততাকে (তাঁকে শাস্তিপ্রদানকারীদের প্রতি বিশস্ততাকে) তাঁর গুনের পরিচায়ক হিসেবে দেখেছিলেন, তাঁর সততা হিসেবে। প্রেগে যাঁরা এই কবিতাগুচ্ছের কথা জানতে পারেন, বক্রাঘাত করে, তার নাম দেন “ জোসেফ কে.-এর কৃতজ্ঞতা।”
          কাফকার উপন্যাসের দৃশ্য, পরিস্থিতি, এমনকি স্বতন্ত্র বাক্যগুলোয় প্রাগের জীবনের অংশ ছিল।
        এটা বললে, অবশ্য অনেকে ভেবে বসতে পারেন যে কাফকার দৃশ্যগুলো প্রাগে জীবিত কারণ সেইগুলো স্বৈরতন্ত্রের অনুমান করে।
        এই চিন্তাটাকে অবশ্যই ঠিক করতে হবেকাফকা-সদৃশ জগত কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক ধারণা নয়। কাফকার উপন্যাসগুলোক শিল্পায়িত সমাজের, শোষণের, বিচ্ছিন্নতাবোধের – এক কথায় ধনতন্ত্রের বুর্জুয়া মূল্যবোধের সমালোচনা বলে ভাবানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কাফকার মহাবিশ্বে ধনতন্ত্রের উপাদানগুলো নেই:নেই অর্থ বা তাঁর বল, বানিজ্য, সম্পত্তি বা মালিকানা বা শ্রেণী সংগ্রাম।
        কাফকা স্বৈরতন্ত্রের কোন সংজ্ঞার সাথেও যান না। কাফকার উপন্যাসে দল, মতাদর্শ বা তার পরিভাষা বা রাজনীতি, পুলিশ বা সৈন্য কারুরই কোন উল্লেখ নেই।
        বরং বলা উচিত কাফকা মানুষ ও তার জগতের একটি মৌলিক সম্ভাবনার পরিচায়ক, এমন একটা সম্ভাবনা যা ঐতিহাসিক ভাবে নির্ণিত নয় এবং যা মানুষের কাছে খানিকটা চিরন্তন।
        কিন্তু এই সংশোধন  প্রশ্নটা উড়িয়ে দেয় না: কিভাবে প্রাগে কাফকার উপন্যাস জীবনের সাথে অঙ্গীভূত হয় আর প্যারিসে সেই একই উপন্যাসকে দেখা হয় একজন লেখকের সম্পূর্ণ আত্মগত দুর্বোধ্য  অভিব্যক্তি হিসাবে? এর কি মানে দাঁড়ায় যে মানুষ ও তার জগতের একটি সম্ভাবনা যাকে আমরা কাফকা-সদৃশ বলে অবিহিত করি তা প্যারিসের থেকে প্রাগে অনেক সুনির্দিষ্টভাবে মানুষের ব্যক্তিগত ভাগ্যে পর্যবসিত হয়।
        আধুনিক ইতিহাসে এমন অনেক প্রবণতা পাওয়া যায় যা বৃহত্তর সামাজিক মাত্রায় কাফকা-সদৃশের নির্মাণ করে:ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণ, নিজের দেবত্ব-আরোপের প্রবণতা, সামাজিক কর্মকাণ্ডের আমলাতন্ত্রীকরণ যা সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে অসীম গোলকধাঁধায় পর্যবসিত করে; এবং তার ফলে ব্যক্তির সাতন্ত্রতা নষ্ট করে।
        স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র, এই সমস্ত প্রবণতার একটা চরম কেন্দ্র হয়ে, কাফকার উপন্যাস এবং বাস্তবজীবনের নিকট সম্পর্ক দেখিয়ে দেয়। কিন্তু পশ্চিমে যদি মানুষ এই সম্পর্ক দেখতে না পায় তা শুধু এই আমরা যাকে গনতান্ত্রিক সমাজ বলি সেইগুলো আজকে প্রাগের থেকে কম কাফকা-সদৃশ এই কারণেই নয়। এই কারণেও বলে আমি মনে করি, এইখানে, বাস্তব এর বোধটাই নির্মমভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।
        আসলে, যে সমাজকে আমরা গনতান্ত্রিক বলি তাও আমলাতন্ত্রীকরণ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ধ্বংসের প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত, এই পুরো গ্রহটাই এই প্রক্রিয়ার একটা মঞ্চ হয়ে উঠেছে। কাফকার উপন্যাস আসলে এরই এক কাল্পনিক, স্বপ্নময় অতিরঞ্জন এবং বস্তুবাদী অতিরঞ্জন।
        কিন্তু কাফকাই কেন এই পৃথিবী প্রথম ঔপন্যাসিক যিনি এই প্রবণতাকে ধরতে পেরেছিলেন, যা তাঁর মৃত্যুর অনেক পরের ইতিহাসে খুব পরিস্কার এবং নির্মমভাবে আবির্ভূত হয়েছিল।



        কিংবদন্তি এবং রহস্যমণ্ডিত করা ছাড়া, কাফকার রাজনৈতিক আগ্রহ সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য সূত্র নেই; সেই অর্থে বলতে গেলে, তিনি তাঁর প্রাগের বন্ধুদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন, ম্যাক্স ব্রড, ফ্রানজ ওয়েরফেল, এরগন এরিউন কিশ, আর সব আঁভা-গার্দ, যাঁরা ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি জানতেন বলে দাবী করতেন, যাঁরা ভবিষ্যৎকে জানার ভেলকিবাজীর আশকারা অনুভব করতেন।
        তাহলে কি করে তাঁদের সৃষ্টির বদলে তাঁদের একা, মুখচোরা, নিজের জীবন ও শিল্পে ডুবে থাকা সহচর আজ একটি সামাজিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবানী হিসাবে স্বীকার করা হচ্ছে, এবং একই কারণে গোটা দুনিয়ার একটা বিরাট অংশে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে?
        এই রহস্যের কথা আমার মাথায় এসেছিল একদিন আমার এক পুরোণো বন্ধুর বাড়িতে একটা ছোট্ট দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে। আমার এই বন্ধু মহিলাটি ১৯৫১ সালে, প্রাগে স্তালিনিস্ট বিচার চলার সময়, গ্রেফতার হন এবং এমন সব অপরাধে দোষী সাবস্ত হন যা তিনি করেননি। সেই সময় কয়েকশো কম্যুনিস্টের এই অবস্থা হয়েছিল। সারা জীবন তাঁরা নিজেদের পার্টির থেকে আলাদা করে ভাবতে পারেননি। যখন সেই পার্টিই তাঁদের অভিযুক্ত করল, তখন তাঁরা জোসেফ কে.-এর মতই  রাজি হয়ে গেলেন নিজেদের “সমগ্র অতীতটাকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করে” লুকিয়ে থাকা অপরাধ খুঁজে বার করতে, এবং অবশেষে, কাল্পনিক অপরাধ স্বীকার করে নিতে। আমার বন্ধুটি নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর অসাধারণ সাহসের জন্য যে কারণে তিনি তাঁর কমরেডদের মত, কবি এ.-এর মত “অপরাধ খুঁজতে” সম্মত হননি। শাস্তিপ্রদানকারীদের সাহায্য করতে অসম্মত হওয়ার জন্য তিনি  ছিলেন চুড়ান্ত বিচারের প্রদর্শনীতে অব্যবহার্য। তাই ফাঁসির বদলে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। চোদ্দ বছর জেল খাটার পর তাঁকে সম্পূর্ণ পুনর্বাসন এবং মুক্তি দেওয়া হয়।
        এই ভদ্রমহিলার গ্রেফতারের সময় একটি এক বছরের ছেলে ছিল। তাই জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, তিনি তাঁর পনের বছরের ছেলের সাথে পুনর্মিলিত হন এবং তার সাথে তাঁর নগন্য একাকিত্ব ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ পান। তিনি যে তাঁর ছেলের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হবেন সেটা সম্পূর্ণ বোধগম্য। একদিন আমি তাঁদের সাথে দেখা করতে যাই- ততদিনে তাঁর পুত্রের বয়স পঁচিশ। মা সেই সময় অভিমানে এবং রাগে কাঁদছিলেন। কারণটা খুব তুচ্ছ :ছেলেটি বেশী সময় ধরে ঘুমিয়ে ছিল বা এমন কিছু। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করিএত তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে তুমি এত ভাবিত কেন? এটা কি কাঁদার মত কিছু? তুমি বেশিবেশি করে ফেলছ না?”
        মায়ের হয়ে ছেলেটি আমায় উত্তর দিল না, আমার মা বেশিবেশি করেননি। আমার মা একজন অসাধারণ সাহসী ভদ্রমহিলা। যখন সবাই ভেঙে পড়ছিল তখন তিনি একা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি চান আমি একজন প্রকৃত মানুষ হই। এটা সত্যি, যে আমি বেশি ঘুমিয়েছি, কিন্তু মা আমাকে যে কারণে আমার নিন্দা করছে তার কারণ অনেক গভীরে। সেটা হল আমার মনোভাবের কারণে। আমার স্বার্থপর মনোভাব। আমি আমার মা যা চায় সেইরকম হতে চাই। আপনাকে স্বাক্ষী রেখে আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি সেইরকমই হব।”
        যা পার্টি তার মায়ের উপর করতে পারেনি, মা তার ছেলের উপর করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাঁকে বাধ্য করেছেন একটা উদ্ভট অভিযোগ খুঁজে বার করতে, “ নিজের অপরাধ খুঁজে নিতে,” সবার সামনে স্বীকারোক্তি করতে। আমি বোকার মত এই ক্ষুদ্র স্তালিনীয় বিচার প্রক্রিয়া দেখে গেলাম, এবং অনুভব করলাম বিরাট ( আপাত অর্থে বিস্ময়কর এবং অমানবিক) ঐতিহাসিক ঘটনায় মনস্তত্ত্বের যে প্রক্রিয়া কাজ করে, সেই একই প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত ( খুব সামান্য এবং মানবিক) ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।


       বাবাকে লেখার এবং কোনদিন না পাঠানো কাফকার সেই বিখ্যাত চিঠি দেখায় যে আসলে পরিবার থেকেই, অবিভাবকদের দেবত্ব আরোপিত ক্ষমতার সাথে শৈশবের সম্পর্কের থেকেই কাফকা তাঁর দণ্ডপ্রদান পদ্ধতির  জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, যা পরে তার আখ্যানের একটা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। লেখকের পরিবারিক অভিজ্ঞতার সাথে নিকটভাবে সম্পৃক্ত ছোট গল্প “দ্য জাজমেন্ট”, যেখানে বাবা তাঁর ছেলেকে অভিযুক্ত করছেন এবং তাঁকে আদেশ দিচ্ছেন জলে ডুবে মরবার জন্য। ছেলে সেই কাল্পনিক অভিযোগ মেনে নিচ্ছেন এবং জলে ঝাঁপ দিচ্ছেন  ততটাই বাধ্য হয়ে, যতটা বাধ্যভাবে জোসেফ কে. একটা রহস্যাবৃত সংগঠন দ্বারা নির্দেশিত হয়ে, নিজের হত্যার সম্মতি দিচ্ছেন। এই দু’টো অভিযোগের, দু’টো দণ্ডপ্রদানের, দু’টো হত্যার সদৃশ্যতা, কাফকার লেখার, আসল সংযুক্তিটা দেখিয়ে দেয়, পরিবারের ব্যক্তিগত “স্বৈরতন্ত্র”-এর সাথে তাঁর মহান সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিমার। 
        স্বৈরতন্ত্রী সমাজ, বিশেষত তার চরম সংস্করণে, সর্বজনীন ও ব্যক্তিগতর ভেদরেখা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে; ক্ষমতা, তা যত অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে, তত বেশী করে চায় যে তার নাগরিকদের জীবন স্বচ্ছ হয়ে উঠুক। গোপনীয়তাবিহীন জীবন-এর আদর্শবাদ একটা আদর্শ পরিবারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণএকজন নাগরিকের কোন অধিকার নেই পার্টি বা রাষ্ট্রের থেকে কোন কিছুকে গোপন রাখার, ঠিক যেমন একটি শিশুর কোন অধিকার নেই তার বাবা বা মায়ের থেকে কোন কিছু গোপন রাখার। এই প্রচারের দ্বারা, স্বৈরতন্ত্রী সমাজগুলো নিজেদের একটা সরল ও মনোরম ছবি প্রক্ষেপিত করেতারা নিজেদের দেখতে চায় “এক বিরাট পরিবার হিসাবে।  
        অনেক সময় এইভাবেও বলা হয় যে কাফকার উপন্যাস আসলে সমষ্টির সাথে মানুষের যোগাযোগের একটা তীব্র বহিঃপ্রকাশ, যে শিকড়বিহীন কে.-এর আসলে একটাই উদ্দেশ্যএকাকিত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচা। কিন্তু এটা আসলে একটা ক্লিশে, একটা ক্ষুদ্রায়িত ব্যাখ্যা, একটা ভুল ব্যাখা। 
        ল্যান্ড-সার্ভেয়র কেকোনভাবে মানুষ এবং তাঁর উষ্ণতা অন্বেষণ করেননি, সার্ত্র-এর ওরেস্টিসের মত তিনি “মানুষের মধ্যে মানুষ” হয়ে উঠতে চাননি; তিনি মানুষের থেকে স্বীকৃতি চাননি চেয়েছেন প্রতিষ্ঠানের থেকে। সেটা পেতে গেলে, তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হবেতাঁকে তাঁর একাকীত্ব বর্জন করতে হবে। আর এটাই তাঁর জন্য নারকীয়:তিনি কখনোই আর একা নন, ক্যাসেল থেকে পাঠানো তাঁর দুই সহচর সবসময় তাঁকে অনুসরণ করছেন। যখন তিনি প্রথমবার ফ্রিডার সাথে মিলিত হচ্ছেন, এই লোকদুটো উপস্থিত, যার নিচে প্রেমিক-প্রেমিকারা মিলিত হচ্ছেন, সেই কাফের কাউন্টারের উপর বসে রয়েছেন, এবং তার পর থেকে কখনোই তাদের বিছানার থেকে দূরে নন।  
        নিঃসঙ্গতার অভিশাপ নয়, একাকিত্বের লঙ্ঘন-এ কাফকা আবিষ্ট হয়ে ছিলেন! 
        কার্ল রসম্যানকে সবাই সবসময় জ্বালাতন করততাঁর জামাকাপড় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর বাবা মায়ের একমাত্র ছবিটা নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, ডর্মিটরিতে তার বিছানার পাশে, ছেলেদের বাক্স প্রায়শই তাঁর উপর এসে পড়ত;  রুক্ষ-প্রকৃতির দু’জন রবিনসন আর ডেলামার্ক জোর করে তাঁকে তাঁদের সঙ্গী করতেন আর ছিল মোটা ব্রুনেল্ডা, যাঁর বিলাপ ঘুমের মধ্যেও তিনি শুনতে পেতেন। 
        জোসেফ কে.-এর গল্পটাও আসলে শুরু হয় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধর্ষণের মধ্য দিয়েদু’জন অপরিচিত মানুষ তাঁর বিছানায় তাঁকে গ্রেফতার করতে আসেন। এরপর থেকে কখনোই তিনি আর একা ননআদালত সব সময় তাঁকে অনুসরণ করে, তাঁর উপর লক্ষ্য রাখে, কথা বলে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়, তাঁর পিছু নেওয়া একটা রহস্যময় সংগঠন তাকে গিলে ফেলে।             
        আবেগতাড়িত কিছু মানুষ, যাঁরা গোপনীয়তার বিলোপ এবং ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছতার প্রচার চালান, তাঁরা বোঝেন না যে এই ভাবে আসলে তাঁরা কোন প্রক্রিয়ার পথ অবারিত করে দিচ্ছেন। স্বৈরতন্ত্রের শুরু অনেকটা দ্য ট্রায়ালের  শুরুর মতআপনার অজান্তে তাঁরা আপনার বিছানার পাশে এসে হাজির হবেন। তাঁরা আসবেন যেমন আসতেন আপনার মা কিংবা বাবা।
        অনেক সময় মানুষ ভাবেন যে কাফকার উপন্যাসগুলো তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ও গোপনীয় দ্বন্দ্বের প্রক্ষেপণ, কিংবা “সামাজিক যন্ত্র”-এর একটা বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা।
        কাফকা-সদৃশ আসলে ব্যক্তিগত বা সর্বজনীন কোন একটাতে আবদ্ধ নয়, তা এই দু’টোকেই আবৃত করে। সর্বজনীনতা ব্যক্তিগতর আয়না, ব্যক্তিগত সর্বজনীনের প্রচ্ছায়া।


        ক্ষুদ্র-সামাজিক প্রয়োগ যা কাফকা-সদৃশ-এর নির্মাণ করে তার কথা বলতে গিয়ে, আমি শুধু পরিবারের কথাই বোঝাতে চায়নি তার সাথে সেই সংগঠন যেখানে কাফকা তাঁর পরিণত জীবন কাটিয়েছেন, সেই অফিসের কথাও বোঝাতে চেয়েছি।
        কাফকার নায়কদের অনেক সময় বৌদ্ধিকতার রূপক প্রক্ষেপণ হিসাবে বুঝতে চাওয়া হয়, কিন্ত গ্রেগর সাসমার কোন বৌদ্ধিকতা ছিল না। একটি গুবরে পোকায় রূপান্তরিত হয়ে জেগে ওঠার পর, তাঁর একটাই চিন্তা ছিলএই নতুন অবস্থায়, তিনি কিভাবে সময়ের মধ্যে অফিসে পৌছাবেন। জীবিকার কারণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আনুগত্য আর নিয়মানুবর্তিতা, ছাড়া তাঁর মাথায় আর কিছুই ছিল নাতিনি একজন কর্মচারি, একজন কর্মভারপ্রাপ্ত, যেমন কাফকার সব চরিত্রেরা; একজন কর্মভারপ্রাপ্ত সামাজিক অর্থে (যেমন জোলায়) নয় বরং একটি মানবিক সম্ভাবনা হিসাবে, বেঁচে থাকবার একটা প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসাবে।
        দ্বিতীয়ত, একজন কর্মভারপ্রাপ্ত, বিরাট এক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, যার মূল উদ্দেশ্য বা ব্যাপ্তির ব্যাপারে কোন ধারণা ছাড়াই , তার ক্ষুদ্রতম অংশ সম্পাদন করেনএটা সেই জগত যেখানে প্রত্যেকটা ক্রিয়া আসলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে আর মানুষ তাঁর কাজের অর্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
        তৃতীয়ত, একজন কর্মভারপ্রাপ্ত শুধু কিছু অচেনা মানুষ আর ফাইলের সাথে সময় অতিবাহিত করেনএটা হল বিমূর্তের জগত।
        এইরকম আনুগত্যপূর্ণ, যান্ত্রিক, বিমূর্ত একটা জগতে, যেখানে মানুষের একমাত্র কর্মকাণ্ড হল এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাওয়া, উপন্যাসের প্রস্তাবনা হল মহাকাব্যের মূল রসের সম্পূর্ণ বিপরীতে। এইটাই প্রশ্ন: এরকম ধূসর, কবিতাবিরোহিত জিনিসকে কাফকা কি করে উপন্যাসে রূপান্তরিত করলেন?
        এর উত্তর পাওয়া যায় মিলেনা কে লেখা তাঁর একটা চিঠিতেঅফিস আসলে একটা বোকা প্রতিষ্ঠান নয়; এর ক্ষেত্র আসলে বোকার চাইতে অনেক বেশী বিচিত্র ও কল্পনাপূর্ণ।” এই বাক্যের মধ্যে কাফকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রহস্য লুকিয়ে আছে। যা অন্য কেউ দেখতে পাননি তিনি তাই দেখেছিলেন: মানুষের জন্য আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অসীম গুরুত্ব শুধু নয়, তাঁর অবস্থা বা ভবিষ্যতের জন্যও শুধু নয়, বরং (খুব বিস্ময়করভাবে) অফিসের ফ্যান্টাসমিক     (এমন কিছু যা আপাতভাবে আছে কিন্তু প্রকৃতভাবে নেই) প্রকৃতির মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন কাব্যিক সম্ভাবনা।
        কিন্তু যখন বলা হয়ে যে অফিসের ক্ষেত্র আসলে বিচিত্র ও কল্পনাপূর্ণ তখন কি বোঝানো হয়?
        প্রাগের ইঞ্জিনিয়ার বুঝবেনতাঁর ফাইলের একটা ভুল তাঁকে লন্ডনে প্রক্ষেপিত করেছিল; তাই তিনি প্রাগে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন একজন যথার্থ ফ্যান্টমের (ভূত) মত, তাঁর হারিয়ে যাওয়া শরীর খুঁজতে খুঁজতে, আর যে অফিসগুলোতে তিনি যাচ্ছিলেন সেইগুলো যেন কোন এক অজানা পুরাণের অসীম গোলকধাঁধা ।
        আমলাতন্ত্রের মধ্যে যে বিচিত্র এবং কাল্পনিক জগত কাফকা পেয়েছিলেন, তার উৎকৃষ্টতাই তাঁকে, এর আগে যা অকল্পনীয় বলে ভাবা হয়েছিল, তাই করতে দিয়েছিলতিনি প্রবল আমলাতান্ত্রিক সমাজের প্রগাঢ় কাব্যহীনতাকে উপন্যাসের মহান কাব্যিকতায় উত্তীর্ণ করতে পেরেছিলেন; তিনি একজন মানুষের, প্রতিশ্রুত একটা চাকরী না পাওয়ার (যা আসলে ক্যাসেলের গল্প), সাধারণ একটা গল্পকে উত্তীর্ণ করেছিলেন মিথে, মহাকাব্যে, এমন এক সৌন্দর্যে যা কেউ আগে দেখেনি।
        আমলাতান্ত্রিক পারিপার্শিকতাকে মহাবিশ্বের বিশাল মাত্রায় উন্নিত করে, কাফকা অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা ছবি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার সাথে  তাঁর না দেখা একটা সমাজের সাযুজ্য, আজকের প্রাগের মত, আমাদের মুগ্ধ করে।
        স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র আসলে এক, বৃহৎ প্রশাসন যেহেতু সব কাজই আসলে রাষ্ট্রের জন্য, তাই সব পেশার সব মানুষ আসলে একজন কর্মচারী। একজন শ্রমিক আর শ্রমিক নন, একজন বিচারক আর একজন বিচারক নন, একজন দোকানদা আর একজন দোকানদার নন, একজন পুরোহিত আর শুধু একজন পুরোহিত নন; তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে রাষ্ট্রের কর্মভারপ্রাপ্ত। “আমি কোর্টের একজন,” ধর্মযাজক জোসেফ কে.-কে বলেছিলেন ক্যাথিড্রালের ভিতর। কাফকায় আইনজীবিরাও কোর্টের জন্য কাজ করে। আজকের প্রাগের একজন নাগরিক এতে অবাক হবেন না। তিনি কে.-এর থেকে বেশী কোন আইনি সহায়তা পাবেন না। তাঁর আইনজ্ঞরা আর বিবাদীর জন্য কাজ করেন না, করেন কোর্টের জন্য।


       গুরুগম্ভীর এবং জটিল গভীরতায় পরিপূর্ণ অথচ শিশুসুলভ সারল্যে ভরা একশোটি কোয়ার্টেনের একটি সাইকেলে, মহান চেক কবি লিখেছেন-
     কোন কবি কবিতার সৃষ্টি করেন না
কবিতাটা শুরু থেকেই কোথাও সুপ্ত আছে
     বহু কাল ধরে সেইখানেই ছিল
     কবি শুধু সেটা আবিষ্কার করেন

       কবির জন্য, তাহলে, লেখা মানে হল একটা দেওয়াল ভাঙা যার পিছনে একটা অপরিবর্তনীয় কিছু (“কবিতা”) অন্ধকারে লুকোনো আছে। এই কারণেই (এই বিস্ময়কর এবং হঠাৎ প্রকাশের কারণে) “কবিতা” আমাদের প্রথমে চোখ ধাঁধানো কিছু হিসাবে আঘাত করে।
       দ্য কাসেল  আমি প্রথম পড়ি যখন আমার বয়স চোদ্দ, এই বইটা আর কখনো আমাকে ওইভাবে মুগ্ধ করেনি, যদিও সেই সময় ওর ভিতরের বিস্তৃত বোধ (কাফকা-সদৃশ-এর প্রকৃত উপাদান) সেই সময় আমার বোধগম্য হয়নি:আমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।
       পরে যখন আমার চোখ “কবিতা”-র আলোয় অভ্যস্ত হল আর আমি যাতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দেখতে পেলাম; যদিও আলোটা তখনো ছিল।
       “কবিতা” জন স্ক্যাকেলের মতে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল, অপরিবর্তনীয় ভাবে, “বহু কাল ধরে।” কিন্তু নিয়ত পরিবর্তনশীল এই দুনিয়ায় অপরিবর্তনীয় কি শুধুই বিভ্রম নয়?
       না। মানুষের কৃত প্রতিটি অবস্থা শুধু ততটাই ধারণ করতে পারে যতটা মানুষ ধারণ করে, অতএব একজন ভাবতে পারেন যে এই অবস্থা (এবং তার সমস্ত অধিবিদ্যীয় নিহিতার্থ) মানবিক একটা সম্ভাবনা হিসাবে বিদ্যমান ছিল “ বহু কাল ধরে।”
       তাহলে ইতিহাস ( যা পরিবর্তনশীল) কবির কাছে কি মানে নিয়ে আসে?
        অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু একজন কবির চোখে ইতিহাসের অবস্থান কবির নিজের মতইইতিহাস সৃষ্টি করে না, ইতিহাস আবিষ্কার করে। নতুন অবস্থার মধ্যে দিয়ে, ইতিহাস দেখায় মানুষ কি, তার মধ্যে কি আছে “বহু কাল ধরে,” কি তার সম্ভাবনা।
       যদিও “কবিতা” আগে থেকেই থাকে, তাহলে কবিকে ভবিষ্যৎদর্শি  হিসাবে ভাবা অযৌক্তিক, তিনি শুধু একটা মানবিক সম্ভাবনাকে (“কবিতা” যা ছিলই “অনেক অনেক দিন থেকে”) আবিষ্কার করেন যেটা ইতিহাসও একদিন আবিষ্কার করবে।
       কাফকা কোন ভবিষ্যৎবানী করেননি। তিনি শুধু দেখেছিলেন যা আগে থেকেই “সুপ্ত” ছিল। তিনি জানতেন না যে তাঁর দেখাও আসলে ভবিষ্যৎকে দেখা। তিনি একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মুখোস খুলে দেখাতে চাননি। তিনি শুধু আলো ফেলেছিলেন সেই সমস্ত যান্ত্রিকতায় যা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত এবং ক্ষুদ্র সামাজিক মানবিক প্রয়োগের মাধ্যমে জেনেছিলেন, এটা সন্দেহ না করে যে পরবর্তী পর্যায় এই সমস্ত যান্ত্রিকতাকেই ইতিহাসের বৃহত্তর মঞ্চে অবতীর্ণ করবে।
       ক্ষমতার মন্ত্রমুগ্ধকর দৃষ্টি, নিজের অপরাধ খুঁজে বার করার নিদারুণ হতাশা, বিছিন্নতা এবং তার তীব্র যন্ত্রণা, নিন্দিত হয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা, বাস্তবের ফ্যান্টামাস্টিকতা এবং ফাইলের জাদুবাস্তবতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অনন্ত ধর্ষণ, ইত্যাদি- এই সমস্ত পরীক্ষা ইতিহাস মানুষের উপর করে দেখেছে তার অসংখ্য টেস্টটিউবে, কাফকা করেছিলেন (কয়েক বছর আগে) তাঁর উপন্যাসে।
          কাফকার “কবিতার” সাথে বাস্তব জীবনে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রের সমধর্মীতা সবসময়েই কিছুটা অবাস্তব, এবং সেইটি সব সময়েই সাক্ষ্য দেবে যে কবির কাজ, একদম মূলে,পরিমাপযোগ্য নয়; এবং হেঁয়ালীপূর্ণকাফকার উপন্যাসের প্রবল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং “ভবিষ্যৎদর্শীতা” বোধ যথাযথভাবে তাদের “অনাবদ্ধতার” মধ্যে পাওয়া যায়, অর্থাৎ যথার্থভাবে বলতে হলে, সেইটি সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম, মতাদর্শগত ধারণা এবং ভবিষ্যতের পূর্বাভাষের থেকে স্বতন্ত্র বলে।
       যদি কবি “কোথাও সুপ্ত” “কবিতাটিকে” না খুঁজে নিজেকে “ব্যস্ত” রাখেন প্রথম থেকে জানা সত্যের সেবায় (যা নিজে থেকেই সামনে আসে এবং “গোচরে”), তাহলে তিনি কবিতার লক্ষ্য থেকে চ্যূত হয়েছেন। আর এই পূর্বধারণ করা সত্যের নাম বিপ্লব না মতপার্থক্য, ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাস না নাস্তিকতা, তা বেশী সমর্থনযোগ্য না কম সমর্থনযোগ্য তা দিয়ে কিছুই এসে যায় না; যে কবি আবিষ্কারের অপেক্ষায় (যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়) থাকা সত্য ছাড়া অন্য কোন সত্যের সেবা করেন তিনি মিথ্যা কবি।
       আমি কাফকার উত্তরাধিকারকে উজ্জ্বলভাবে বহন করি, আমি যদি এটাকে আমার ব্যক্তিগত ঐতিহ্য বলে  রক্ষা করে থাকি, তা এই কারণে নয় যে আমি মনে করি অন-অনুকরণীয়ের অনুকরণ (এবং কাফকা-সদৃশ-এর পুনরাবিষ্কার) করা উচিত বরং এই কারণে যে তা উপন্যাসে মৌলিক স্বাতন্ত্রের (উপন্যাসের কবিতার) জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। এই স্বাতন্ত্রের কারণে কাফকা আমাদের মানবিক অবস্থার (যা আমাদের শতকে সামনে আসছে) কথা বলতে পেরেছিলেন যা অন্য কোন সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তা পারেনি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ