কিন্তু ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ – এটুকু জেদ না-থাকলে কারও শিল্পচর্চায় হাত দেওয়ার দরকার কী?
লেখকের দায় - আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
সাহিত্যে পুরস্কার দেয়ার সময় লেখককে একটি অলিখিত শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, তা হল এই যে : তোমার লেখা অব্যাহত রাখতে হবে, এবং লেখার মান বাড়ুক কি নাই বাড়ুক অর্জিত মান যেন পড়ে না যায় সে দিকে লক্ষ রাখবে। এই শর্ত যে-কোনো লেখককে সবসময় তটস্থ রাখার পক্ষে যথেষ্ট। একথা, আমার মনে হয়, উপন্যাস-লেখকের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।
উপন্যাসের সৃষ্টি ঔপনিবেশিক যুগে, অথচ এর অবস্থান ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিপক্ষেই। উপন্যাসে সব স্তরের মানুষের যে-বিপুল সমাবেশ ঘটে, শ্রেণী গোষ্ঠী সম্প্রদায় নির্বিশেষে যে-জীবন্ত মানুষ সৃষ্টি হয়, মানুষের সৃজনশীল কল্পনার যে-বাঁধভাঙা প্রকাশ ঘটে তা ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থার প্রতি তো রীতিমতো হুমকি। একজন্যই কি দন কিহোতে-র মতো শিল্পকর্মকে দুশো বছর লাতিন আমেরিকার স্প্যানিশ উপনিবেশগুলোয় নিষিদ্ধ করা হয়? কিন্তু উপন্যাসের খোলামাঠে বিপুল লোকসমাগম ও মানুষের স্ফূর্ত কল্পনার উড়াল ঠেকায় কে? স্পেনের ক্ষয়িষ্ণু অভিজাতের কাহিনী তাই মদের পিপেয় চালান হয়ে দিব্যি ঢুকে পড়ে বলিভিয়ায়, পেরুতে, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। প্রায় চারশো বছর আগে সের্ভান্তেস সাহেব তাঁর নাইটকে সে রুগ্ণ ঘোড়ায় চাপিয়েছিলেন তা এখন দাপিয়ে বেড়ায় দুনিয়া জুড়ে। ওই রুগ্ণ ঘোড়ার দাপটে সত্যিই অভিভূত না-হয়ে পারা যায় না।
উপন্যাস বড় হয়েছে ব্যক্তির বিকাশ ঘটতে ঘটতে। আবার ব্যক্তির বিকাশ ঘটাতেও উপন্যাসের ভূমিকা কম নয়। ওদিকে পাশ্চাত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার উন্মেষ না-ঘটতেই তা রূপান্তরিত হয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে। এখন দেখি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পর্যবসিত হয়েছে ব্যক্তিসর্বস্বতায়। উপন্যাসে ব্যক্তি আসছে নানান রঙে, নানান ঢঙে।
আমাদের এই উপমহাদেশে ব্যক্তির বিকাশ প্রথম থেকেই বাধা পেয়ে এসেছে। এখানে ব্যক্তিপ্রবরটি জম্ন থেকেই পঙ্গু ও দুর্বল। পাশ্চাত্যের সর্বত্রই যেহেতু ব্যক্তিসর্বস্বতার জয়গান, আমাদের এখানেও তাই জন্মরোগা ব্যক্তিটির দিকেই আমাদের লেখকদের অকুন্ঠ মনোযোগ। বাংলা উপন্যাসে প্রথমে এই রুগ্ণ ব্যক্তির শরীরে একটু তেজ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নকল তেজ তাকে শক্তি জোগাতে পারেনি। কেবল তা-ই নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাসগুলোয় বরং দেশের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের মর্যাদাই দেওয়া হয়। অথচ, অন্যান্য সাহিত্যের উপন্যাসে তখন প্রচলিত সংস্কার, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে অবিরাম আঘাত করা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শক্তির উপহার এই খঞ্জ ব্যক্তিটিই হয়ে ওঠে লেখকদের আদরের ধন। তাকে নানাভাবে তোয়াজ করাই হল আমাদের ঔপন্যাসিকদের প্রধান কাজ। দেশের অসংখ্য শ্রমজীবি মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এজন্য শ্রমজীবি, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি তখনও পাকেপ্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিই মধ্যবিত্তকে এবং শক্তসমর্থ, জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশূন্য করে তৈরী করি। বাংলাদেশে এখন চলছে শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া। ফলে আমাদের সংস্কৃতির বুনিয়াদ চলে যাচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে। আমাদের গান, আমাদের ছবি, আমাদের কবিতার উৎস যে-জীবন ও সংস্কৃতি তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায়, সংখ্যার দিক দিয়ে বিস্ফোরণ হলেও, আমাদের উপন্যাস দিনদিন রক্তহীন হয়ে পড়ছে। একই কাহিনী নানান বয়ানে শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। তবে ক্লান্তিও লেখকরা লুফে নেন এবং জীবনে একেই একমাত্র সত্য বলে জাহির করার সুযোগ খোঁজেন।
বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে দেরিতে। বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমাজে উপন্যাসের চর্চা শুরু হয়েছে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার অনেক পরে। বাংলাদেশের প্রধান ঔপন্যাসিক প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কুসংস্কারকে গৌরব দেওয়ার কাজে লিপ্ত হননি। বরং, এই সমাজের ধর্মান্ধতাকেই তিনি প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের শেকড়সন্ধানের প্রয়াস এবং পশ্চাৎপদ সংস্কারকে আঘাত করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন একই সঙ্গে। তাঁর শেষ উপন্যাসে তাই তাঁকে একটি স্বকীয় ভাষারীতিও তৈরী করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ না-করে আমরা বরং পাঠকের মনোরঞ্জনের কাজেই নিয়োজিত রয়েছি। আমরা কৃশকায় মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তরল ও পানসে দুঃখবেদনার পাঁচালি গাই, কিন্তু এতে উপন্যাসে কি ব্যক্তিটির যথাযথ সামাজিক অবস্থানটি কোনোভাবেই প্রকাশিত হয়? এতে শেষে যে-ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করি সে কিন্তু রেনেসাঁসের সেই শক্তসমর্থ, উচ্চাকাংঙ্ক্ষী মানুষ নয়, বরং দায়িত্বহীন, ফাঁপা এক প্রাণীমাত্র।
আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি অনুসন্ধান করলে সেখানে বাঙালি জাতির একটি অভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পরিচয় খোঁজা তো দূরের কথা, আমরা শিক্ষিত মানুষেরা, আমাদের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো, আমাদের স্ফীতোদর রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ দীর্ঘদিন থেকে সম্প্রদায়গুলোকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিই। সমগ্র জাতির বিকাশে এমন আচরণ কখনোই সহায়ক হতে পারে না। নিঃসন্দেহে, সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি অনুসন্ধান করা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ – এটুকু জেদ না-থাকলে কারও শিল্পচর্চায় হাত দেওয়ার দরকার কী?
আজ এই পুরস্কার নিতে আনন্দের সঙ্গে আমার একটু সংকোচও হয় বইকী। দেশের কী জাতির সংস্কৃতির গোড়ায় না-গিয়ে যদি নিজের আর বন্ধুদের আর আত্মীয়স্বজনের স্যাঁতসেঁতে দুঃখবেদনাকেই লালন করি তো তাতে হয়তো মধ্যবিত্ত কী উচ্চবিত্তের সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, কিন্তু তা থেকে তারা নিজেদের জীবনযাপনে যেমন কোন অস্বস্তিও বোধ করবে না, তেমনই পাবে না কোন প্রেরণাও। তা হলে আমার যাবতীয় সাহিত্যকর্ম ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে মনে হবে নেহাতই তোতলা বাখোয়াজি।
0 মন্তব্যসমূহ