কৃষণ চন্দরের গল্প : পেশোয়ার এক্সপ্রেস

এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সশব্দে। পেশোয়ার ছাড়বার পর। এবার বুকখানা শান্ত হলো।

আমার কামরাগুলোতে প্রায় তিল ধারণেরও ঠাঁই নেই। সবই শরণার্থীতে ভরা। ওরা হিন্দু আর শিখ। সীমান্ত প্রদেশের নানা জায়গার বাসিন্দা। পেশোয়ার, হোতি মরদান, কোহাট, চরসাদ্দা, খাইবার, লান্ডিকোটাল, বান্নু, নওশেরা আর মনশেরার। কিন্তু আজ ওরা ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসেছে।

সব স্টেশনেই মিলিটারির কড়া পাহারা বসেছে। লোকগুলো বড় হুঁশিয়ার। তার ওপর ক্ষিপ্রগতি। তা সত্ত্বেও শরণার্থীদের মনে এক ফোঁটা শান্তি নেই। এক অশুভ চিন্তায় সবাই যেন কুঁকড়ে ছিল। এতক্ষণে মনে একটু সাহস পেয়েছে। ধোঁয়া ছেড়ে আমি নড়ে উঠবার পর। আমার সামনে যে স্বপ্নে ভরা পঞ্চনদের দেশ। ওই পাঠানগুলোকে যদি অন্য পাঠানদের ভেতর ছেড়ে দেওয়া যায়, তাহলে আর কেউ ওদের আলাদা করে চিনে নিতে পারবে না। কেননা, চেহারায় ওরা আর সব পাঠানের মতোই সুপুরুষ। শারীরিক গঠনেও তাদেরই মতো লম্বা-চওড়া আর মজবুত। ওদের পরনে লুঙ্গি বা সালোয়ার, মাথায় টুপি। আর ওরা কথা বলে কর্কশ গোছের পশতু ভাষায়। তাও আর সব পাঠানেরই মতো।

আমার প্রত্যেকটি কামরা পাহারা দিচ্ছে দু’জন বালুচ সেপাই। রাইফেল কাঁধে নিয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে। মুখে ভাঙা ভাঙা হাসি। তারা চায় হিন্দু পাঠানগুলোকে সান্ত্বনা দিতে, যারা স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে নিয়ে শত শত বছরের আত্মীয়তার বাঁধনে বাঁধা জন্মভূমি ছেড়ে আজ পালিয়ে এসেছে। শত শত বছরের নীড় ভেঙে। এবং এখন কেবল ভয়ে আর দুঃখে ডুবে আছে।

অথচ একদিন ওই পাহাড়-ভরা দেশের শক্ত মাটি ছিল ওদের শক্তির উৎস। ওদেশের ঝরনার বরফ-গলা জলে ওরা তেষ্টা মেটাত। তার ওপর ছিল রোদ-ঝলমল আঙুর ক্ষেতের টুসটুসে আঙুর। সেসব জিনিস আজও ওদের স্মৃতির মণিকোঠায় জমে আছে। যদিও দেশটা হয়ে গেছে অকস্মাৎ ভিনদেশ। যা ছিল একান্ত আপন, তা এখন একেবারেই অনাত্মীয়।

এই দেশ এখন ওদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে। ওদের পা শিথিল। তবু ওরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেননা, ওরা এখন চায় এই দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যেতে। না গিয়ে উপায় কী? বিপর্যয়ের বন্ধুর ভূমি ছেড়ে যে এবার শান্তির সমতল ভূমিতে আশ্রয় নিতে হবে। তাই তো ওরা একে একে চলে এসেছে। মনের আসল ইচ্ছে যেমনি হোক ওদের আর এখানে থাকবার কোনো উপায়ে নেই।

ওরা চলে এসেছে। ওদের জীবন, হাতের কিছু পুঁজি আর মেয়েদের মর্যাদা আপাতত নিরাপদ। তার জন্য ওরা হয়তো ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু মন ওদের তীব্র ও দুঃখ আর ক্ষোভে রক্তাক্ত। দৃষ্টি যেন এখনও বিঁধে আছে পেছনে_ ফেলে আসা জন্মভূমির শুভ্রশুচি মাটিতে। ওদের মুখে বিলাপ, জিজ্ঞাসা আর অভিযোগ_ মা, তোমার সন্তানদের তুমি কেন বুক থেকে সরিয়ে দিলে? বাচ্চা মেয়েগুলোকে কেন তোমার বুকের নরম কবোষ্ণতা থেকে বঞ্চিত করেছ? কেন তুমি তাদের আর তোমার কোলে ঠাঁই দিতে চাও না? অসহায় মেয়েগুলো একদিন আঙুর লতার মতো তোমার বুকে ছড়িয়ে ছিল। তোমাকেই আঁকড়ে ধরে। তাদের তুমি কেন হঠাৎ ছুড়ে ফেলে দিলে? কেন, মাগো বলো, কেন?

আমি এখন খটখট আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলেছি। একটা উপত্যকার পথ ধরে। শরণার্থীরা এখন আমার আসনগুলোতে বিহ্বল হয়ে বসে আছে। চোখ বেদনায় নীল, পিপাসায় ভরা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি মেলে ওরা চেয়ে রয়েছে দু’পাশের অপসৃয়মাণ সমতল শস্যক্ষেত, সবুজ উপত্যকা, ছোট-বড় পাহাড় আর ক্ষীণকায়, মৃদুভাষিণী নদীর দিকে। ওসব বারবার দেখেও যেন ওদের মন ভরছে না। দু’পাশের ওই প্রান্তরের প্রতি এ যে ওদের বিদায় অভিবাদন। দৃষ্টি মেলে দিয়ে এমন করে সম্ভাষণ জানাবার অবকাশ ওরা আর কি পাবে? হয়তো এই-ই শেষ।

ওদের চোখ এখন তাই জলে ভরা। দৃষ্টি হয়ে গেছে ঝাপসা। বুকের তলায় এক আকুল কামনা। আহা, ওই বনমালা, ওই ধূসর প্রান্তর, ওই দিগন্ত, ... ওগুলো কি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় না? বুক দিয়ে আগলে, বুকের ভেতর উঠিয়ে? ওই কামনাই বুঝি দৃষ্টির পথে কণা কণা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রান্তরের কোণে কোণে, ধূলিরেণুর গায়ে গায়ে।

আমার চাকাগুলোও ভারি হয়ে আসছে। লজ্জা আর বেদনার জড়তায়। আমি যে আর চলতে পারছিনে। আমার এ কী হলো? আমি কি আর কখনও চলতে পারব?

হাসান আবদাল স্টেশনে আরও কিছু শরণার্থী আশ্রয় নিল আমার কামরাগুলোতে।

এরা সবাই শিখ। কোমরে লম্বা কৃপাণ ঝোলানো। এরা এসেছে পাঞ্জাসাহেব থেকে। মানুষগুলোর মুখ ভয়ে বিবর্ণ-মলিন। আয়তচোখ বাচ্চাগুলোও যেন অজানা এক ভয়ে আর আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছে। আমার কামরায় ঢুকে দলের সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

এদের কারও বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কারও বা সম্বল এখন কেবল পরনের জামা আর পায়জামা। একজনের আফসোস, সে জুতা জোড়াও পায়ে দিয়ে আসতে পারেনি। কোণের দিকের লোকটি ভাগ্যবান। তাকে কিছুই ফেলে আসতে হয়নি। এমনকি ভাঙা খাটিয়াখানাও। একটি লোক একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। সে এখন নীরব-নিথর। দুঃখে আর ভাবনায় লোকটি বড্ড মুষড়ে পড়েছে। তার পাশে আর একজন মানুষ। সে মানুষের আর এক রূপ। জীবনে সে হয়তো একটি পয়সাও জমাতে পারেনি। কিন্তু এখন ফেঁদে বসেছে গল্প। তার ক্ষতির পরিমাণ নাকি লাখ টাকা। সে এখন মুসলমানদের শাপশাপান্ত করছে। লোকটির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটি বালুচ সেপাই। সে নীরবে লোকটির কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। শুধু মুখে লেগে আছে ঠোঁট-টেপা হাসি।

তক্ষশীলায় আমায় অনেকক্ষণ থামতে হলো। গার্ড ভদ্রলোক এর কারণ জানার জন্য স্টেশন মাস্টারের কাছে যান। স্টেশন মাস্টার বলছেন, আশপাশের গ্রামগুলো থেকে একদল হিন্দু শরণার্থী আসছে। তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গাড়ি ছেড়ে দেওয়া এখন কিছুতেই সম্ভব নয়।

শরণার্থী দলটির জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার পুরো একটি ঘণ্টা কেটে গেল।

আমি দাঁড়িয়েই আছি।

শরণার্থীরা এখন কামরার ভেতর খাবারের পুঁটলি খুলে বসেছে।

খাবার বলতে বিশেষ কিছুই কেউ আনতে পারেনি। সবাইকেই তো পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাড়াহুড়ো করে। তারই মধ্যে যা কিছু নিয়ে আসা গেছে, তাই দিয়েই ওরা এবার জ্বালা মেটাবে।

খাওয়ার পর শিশুদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তরুণী মেয়েদের চোখ চলে গেছে বাইরে। তারা জানালায় মুখ রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বৃদ্ধরা এখন হুঁকো নিয়ে ব্যস্ত।

হঠাৎ দূর থেকে ঢোলের আওয়াজ শোনা গেল। একদল হিন্দু শরণার্থীর তো ওদিক থেকেই আসার কথা। ওই বুঝি তারা এসে পড়ল। তাদের স্লোগানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ এমনিভাবেই কেটে গেল।

শরণার্থীরা এখন আরও কাছে এসে পড়েছে। ঢোলগুলো যেন পাগলের মতো উদ্দাম। আওয়াজে কান পাতা দায়। তারই মধ্যে শোনা গেল একঝাঁক বুলেটের শব্দ। সে শব্দ যেন এসেছে বাতাসকে ছিঁড়ে ফেলে, আকাশটা ফাটিয়ে দিয়ে। সে যেন ঝাঁকবাঁধা বুলেটের ঝড়। তরুণী মেয়েগুলো ভয় পেয়ে চোখের পলকে সরে গেছে। তারা এখন কামরার ভেতরে পলাতক। পারলে হয়তো বা উঠেই যেত।

হ্যাঁ, হিন্দু শরণার্থীরা এসে গেছে। মুসলিম প্রতিবেশীদের নিরাপদ তত্ত্বাবধানে। পথে ওদের কোনো বাধা-বিঘ্নের সামনেই পড়তে হয়নি। ওরা চেয়েছিল গ্রাম থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে। স্টেশনে এসেছে মুসলিম প্রতিবেশীদের কাঁধে চেপে। প্রত্যেক প্রতিবেশীর কাঁধেই একটি করে কাফেরের লাশ।

তারা লাশ এনেছে দু’শো। সকল বিপদ-আপদ থেকে সযত্নে বাঁচিয়ে স্টেশনে এসে লাশগুলো একে একে বালুচ প্রহরীদের হাতে সঁপে দিয়ে তারা দাবি জানাল, এই মৃত শরণার্থীদের সসম্মানে হিন্দুস্তানে নিয়ে যেতে হবে! এদের আত্মার যেন কোনো রকম অসম্মান না হয়।

এ এক পবিত্র দায়িত্ব। বালুচ সৈন্যগুলো দায়িত্বটি মাথা পেতে নিল। শরণার্থীদের জায়গার জন্যও ভাবনা নেই। প্রতিটি কামরাতেই কিছু না কিছু লাশ ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।

মুসলিম প্রতিবেশীরা আবার যেন আকাশ চৌচির করে ফেলল। এক ঝাঁক ফাঁকা আওয়াজ করে। তারপর স্টেশন মাস্টারের উদ্দেশে তাদের নির্দেশ, এবার গাড়ি ছেড়ে দাও।

আমি আবার পথ চলতে শুরু করলাম।

কিন্তু দু’গজ যেতে না যেতেই শেকল টেনে আমাকে থামিয়ে দেওয়া হলো।

এবার মুসলিম প্রতিবেশী দলটির নেতা আমার একটি কামরার দরজার কাছে দাঁড়ালেন। তারপর শুনি, তিনি বলছেন, আমাদের গ্রাম থেকে দু’শো মানুষ ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ গ্রাম বাঁচবে কেমন করে? সব যে একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামটাকে তো আর এভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। আমরা তাই ঠিক করলাম, গাড়ির হিন্দু আর শিখ শরণার্থীদের ভেতর থেকে দু’শো জনকে এখানে রেখে দেব।

যে যা-ই বলুক না কেন, স্বদেশের জনসংখ্যার এমন ক্ষতি কখনও সহ্য করা যায় না। এর একটা প্রতিকার চাই। এ ক্ষতি অবশ্যই পুষিয়ে নিতে হবে।

বালুচ প্রহরীরা দলনেতার প্রস্তাবটি সানন্দে মেনে নিল। এমন গভীর যাদের দেশপ্রেম, তাদের কথা কি কখনও উপেক্ষা করা যায়? হাততালি সহযোগ নেতাকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রহরীরা একটু পরে দু’শো শরণার্থীকে টেনে বাইরে নিয়ে এসে জনতার দিকে ঠেলে দিল।

দলনেতা প্রতিপত্তিশালী জমিদার। আশপাশের গ্রামগুলোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

শরণার্থীদের হাতে পেয়েই তিনি হুঙ্কার ছাড়লেন, এই কাফেরের দল, সার বেঁধে দাঁড়া।

কিন্তু শরণার্থীরা যেন পাথর। তারা যেন মৃত্যুর তুহিন স্পর্শে এরই মধ্যে একদম জমে গেছে। জনতা তাদের কোনো রকমে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিল।

জনতার সামনে এখন দু’শ’ মানুষ। কিন্তু তারা জীবন্ত শব। তদের কাছে সবকিছুই স্পষ্ট। ভয়ে তাই তাদের ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। রক্তপায়ী এক ঝাঁক তীরের খোঁচায় চোখগুলো যেন দীর্ণ। দৃষ্টির সম্মুখে আছে যেন কেবল দুর্বার রক্তলোলুপতা।

শুরুটা হলো বালুচ সৈন্যদের হাতে।

মৃত্যুর প্রথম ছোবল খেলো পনেরোজন শরণার্থী। প্রথমে থরোথরো কাঁপুনি, তারপর আর্তনাদ। সবশেষে বিস্ফারিত মুখে ভূমিশয্যা গ্রহণ।

জায়গাটির নাম তক্ষশীলা!

দ্বিতীয়বারে লুটিয়ে পড়ল বিশজন।

হ্যাঁ, এটা তক্ষশীলাই বটে। যেখানে একদিন গড়ে উঠেছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। যার বুকে শত শত বিদ্যার্থী পাশাপাশি বসে মানব সভ্যতার প্রথম ইতিহাসের প্রথম পাঠ নিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী।

মৃত্যুর হিমশীতল আলিঙ্গনে আরও পঞ্চাশজন শরণার্থী কুঁকড়ে গেল।

এই তক্ষশীলার জাদুঘর একদা ভরে উঠেছিল অপরূপ ভাস্কর্যকীর্তিতে আর অতুলনীয় শিল্পকলায় ঋদ্ধ অলঙ্কারে। ভাস্কর্য আর শিল্পকলার সেই সব দুর্লভ সৃষ্টি, আমাদের গৌরবময় সভ্যতার জ্বলন্ত, উজ্জ্বল প্রদীপের মতো সেই নিদর্শনগুলো একদিন বর্ণবিভায় ঝলমল করেছে, সকলের চোখ ঝলসে দিয়েছে।

এবার আরও পঞ্চাশজন শরণার্থীর চোখ থেকে পৃথিবীর আলো আর আকাশের নীল মুছে গেল।

তক্ষশীলাতেই একদা গড়ে উঠেছিল সিরকোপের রাজপুরী এবং এক বিশাল ক্রীড়াভূমি। সেও কি কিছু কম গৌরবের কথা? এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে, আমার ফেলে আসা পথের পাশে ছড়িয়ে আছে কিছু ধ্বংসাবশেষ। তাদের সাক্ষ্য, একদিন সেখানে সভ্যতার ধ্বজা উড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক সমৃদ্ধ নগরী এবং সে নগরীর নাম তক্ষশীলা। একদিন সেখানেই কণিষ্ক পত্তন করেছিলেন তার রাজ্যের। যার কাছে প্রজাকুল পেয়েছে শান্তি, সভ্যতা আর ভ্রাতৃত্ববোধ।

এবারের শিকার বিশজন।

ওই গ্রামগুলোর আকাশ-বাতাস একদিন মুখর ছিল ভগবান বুদ্ধের বিশ্বমোহন সঙ্গীতে। ওখানে বসেই ভিক্ষুর দল ধ্যাননেত্রে অবলোকন করেছেন প্রেম, সত্য আর সৌন্দর্যের রূপ, জীবনের নতুন পথের প্রসার।

বাকি শরণার্থীরা এখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।

ভারতে ইসলামের সূর্য এই দিগন্তেই উদিত হয়। সে দেখা দিয়েছিল বুকে উদার আদর্শ নিয়ে। তার কণ্ঠে ছিল সাম্য, মৈত্রী আর মানবতার এক উদাত্ত ঘোষণা।

এখন আর কেউ জীবিত নেই।

আল্লাহু আকবর।

সারাটা প্লাটফরম এখন রক্তের নিচে তলিয়ে গেছে। এ যেন রক্তের বন্যা। আবার যখন আমি চলতে শুরু করলাম, আমার ভয় হতে লাগল, লোহার চাকাগুলো যদি পিছলে যায়।

আমার কামরাগুলোয় মৃত্যুর নিথরতা। প্রতিটি কামরায় একই দৃশ্য। মাঝখানে লাশ, চারদিকেও লাশ। তবে, প্রথম দল মৃত, অন্যগুলো জীবন্মৃত। যারা জীবন্মৃত তাদের মুখ থেকে রক্তের শেষ বিন্দুটিও বুঝি হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাচ্চারা কেঁদে উঠছে। কিন্তু মায়েরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের থামিয়ে দিচ্ছে। এ সময়ে টুঁ-শব্দটিও করা চলবে না। তাই সদ্যবিধবা স্ত্রীরাও মৃত স্বামীর কোলের কাছে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে। আর আমি, কেবল ছুটে পালাচ্ছি। ভয়ে আর আতঙ্কে, ঊর্ধ্বশ্বাসে।

আবার আমি থামলাম রাওয়ালপিন্ডি এসে।

এখানে আমার জন্য কোনো শরণার্থী বসে নেই। প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে কেবল কয়েকটি মুসলিম তরুণ। সঙ্গে একদল গুণ্ঠনবর্তী মহিলা। প্রায় বিশজন। তরুণরা তাদের নিয়ে আমার একটি কামরায় ঢুকে পড়ল। হ্যাঁ, এখন সবই দেখা যাচ্ছে। তরুণদের সাথে রয়েছে যুদ্ধের সরঞ্জাম। রাইফেল আর গুলি।

ঝিলাম আর গুজারখানের মাঝামাঝি পৌঁছে মুসলিম তরুণ ক’টি আমায় থামিয়ে দিয়ে একে একে নেমে পড়তে লাগল।

আর তক্ষুনি ঘটে গেল এক আকস্মিক কাণ্ড।

তাদের সঙ্গিনীরা ঘোমটা খুলে ফেলে চিৎকার করে উঠল, আমরা হিন্দু, আমরা শিখ। ওরা আমাদের ধরে এনেছে। জোর করে।

তরুণরা হাসিমুখেই অভিযোগটা মেনে নিল, হ্যাঁ, সুখের ঘর ভেঙে ওদের আমরা জোর করেই ধরে এনেছি। কিন্তু ওরা আমাদের লুটের মাল। ওদের নিয়ে আমরা যা খুশি তা-ই করব। দেখি না, কে ঠেকায়! কার এমন বুকের পাটা?

দু’জন হিন্দু পাঠান লাফ দিয়ে নিচে নেমে পড়ল। মেয়েগুলোকে বাঁচাবার জন্য। বালুচ সৈন্যরা উত্তেজনার ধার ধারে না। তারা বেশ শান্ত হাতেই পাঠান হিন্দুর উত্তেজনা থামিয়ে দিল। কেবল প্রথম দু’জনই নয়, পরে যারা এগিয়ে এলো, তাদেরও। এবং বলতে গেলে চোখের পলকে।

মেয়েগুলোকে নিয়ে তরুণরা এবার জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ল।

আমার বড় লজ্জা লাগছিল। কালো ধোঁয়ায় মুখ লুকিয়ে আমি জায়গাটি থেকে পালিয়ে এলাম। আমার ফুসফুসটা লোহার। তবু মনে হতে লাগল, ফুসফুসটা এক্ষুনি ফেটে যাবে, তার থেকে টকটকে লাল আগুনের লেলিহান শিখা বেরিয়ে গাছপালায় ভরা ওই বিশাল অরণ্য পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। অরণ্যটি আমাদের কলঙ্কের একমাত্র সাক্ষী। এবং বিরাট। তবু আমার আগুনের মুখে সে হয়তো একদম বিরান, একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

লালামুসায় পৌঁছানোর আগেই দেখি, লাশগুলো পচে গেছে। এখন প্রচণ্ড গন্ধ ছাড়ছে। এ দুর্গন্ধ সইবার ক্ষমতা বালুচ প্রহরীদেরও নেই। সুতরাং লাশগুলো ফেলে দেয়া ছাড়া আর উপায় কী? এবং অচিরেই তাদের মাথায় একটি পন্থাও এসে গেল। পন্থাটি একেবারে নিখুঁত! ওই যে বিচ্ছিন্ন চেহারার মানুষগুলো বসে আছে, যাদের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করে না, তারাই লাশগুলো উঠিয়ে নিয়ে আসুক না! তারপর আসল কাজ। তারা লাশ নিয়ে দরজার কাছে আসামাত্র ধাক্কা মারো। একেবারে খোলা দরজার মুখ থেকে। তাতে পচে ওঠা লাশও বিদায় হবে, বিচ্ছিরি চেহারার লোকগুলোও।

লালামুসার পর এসে থামলাম ওয়াজিরাবাদে।

ওয়াজিরাবাদ পাঞ্জাবের নামকরা শহর। ভারতের মানুষ যত ছোরা-ছুরি আর তলোয়ার ব্যবহার করে, তার প্রায় সবই যায় এখান থেকে। আর, ওই অস্ত্র দিয়েই চলে হিন্দু-মুসলমানে হানাহানি। ওরই জোরে একজন নেয় আর একজনের প্রাণ।

কিন্তু ওয়াজিরাবাদের নাম কেবল অস্ত্রের জন্যই নয়। তার খ্যাতির আরও একটি কারণ আছে। সে হলো তার বিপুল বৈশাখী উৎসব। যে উৎসবের আয়োজন করে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে মিলে, ফসল তোলার আনন্দে।

আমি কিন্তু ওয়াজিরাবাদে এসে দেখলাম কেবল এক রাশ লাশ। শহরটা স্টেশন থেকে একটু দূরে। সে শহর ঘন ধোঁয়ার আবরণে ঢাকা। আমি স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছতেই একটা কোলাহল শোনা গেল। পিতলের থালা পেটানোর আওয়াজ, বুনো জনতার খলখল হসি আর উন্মত্ত হাততালি। সব মিলিয়ে সে এক উন্মাদের উৎসব। হ্যাঁ, এরই নাম বৈশাখী উৎসব বটে!

একটু পরেই জনতা প্ল্যাটফরমে ঢুকে পড়ল। লোকগুলো একদল উলঙ্গ মেয়েকে ঘিরে নাচছে আর গান গাইছে। হ্যাঁ, মেয়েগুলো একেবারেই দিগ্বসনা। দলে সব ধরনের মেয়েই পাওয়া যাবে। তরুণী তো আছেই। তাদের সঙ্গে বৃদ্ধাও রয়েছে। এমন কি, বাচ্চা মেয়েও। যারা এখনও আবরুর অর্থ বোঝে না, উলঙ্গ হওয়ার লজ্জা কী, তা জানে না। বৈচিত্র্য অবশ্য আরও আছে। দলে নাতনি-ঠাকুরমা, মা-মেয়ে, বউ-বোন এক হয়ে মিশে গেছে। সধবা যেমন আছে, তেমনি কুমারী আর বিধবাও। চারদিক থেকে তাদের ঘিরে রয়েছে এক দল পুরুষ। যারা নাচছে আর গান গাইছে। মেয়েরা হিন্দু আর শিখ, পুরুষরা মুসলমান। এটা তিন জাতির মিলিত বৈশাখী উৎসব!

মেয়েরা ঋজু হয়ে হাঁটছে। তাদের চুল আলুথালু, দেহ আঁচড়-খামচানিতে কলুষিত। তবু তারা হাঁটছে ঋজু হয়ে। তাদের দেহ যেন শাড়ির সহস্র আবরণে আবৃত। তার জন্য তারা গরবিনী। তাদের হৃদয় যেন প্রসন্ন, অন্ধকার মৃত্যুর গাঢ় প্রলেপে ঢাকা। আর, এইটুকুই তাদের সান্ত্বনা। দলের কারও চোখে ঘৃণাও নেই। শত সহস্র সীতার গর্বে আর নিষ্কলুষতায় তারা তাদের শোণিত ধারা শুচিশুদ্ধ করে নিয়েছে। এখন তারা আলোকের মতো উজ্জ্বল, অগ্নিশিখার মতো প্রোজ্জ্বল।

বাঁধনহারা জনতা জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে।

বিচিত্র শোভাযাত্রাটি ক্রমে শরণার্থীদের একেবারে সামনে এসে পড়ল। শরণার্থীরা এতক্ষণ আমার কামরার ভেতর সময় কাটিয়েছে হাত-পা মুড়ে বসে থেকে। শোভাযাত্রাটি দেখে ভেতরের মেয়েরা হাঁটুতে মুখ লুকোল। পুরুষরা জানলাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু বালুচ প্রহরীরা তাতে রাজি নয়। তারা ধমক দিয়ে উঠল, এই, জানলা বন্ধ করো না। ভেতরে একটু টাটকা হাওয়া আসতে দাও।

কিন্তু কে শুনবে তাদের কথা? শরণার্থীরা ঝুঁকে পড়ে বন্ধ জানলাগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখল।

বালুচ প্রহরীরা এবার গুলি চালাল।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন শরণার্থী মুখ থুবড়ে পড়ল।

কিন্তু তাদের জায়গা কেউ খালি থাকতে দেবে না। নতুন কয়েকজন শরণার্থী উঠে এসে তাদের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।

শেষ পর্যন্ত অবশ্যি কোনো জানলাই বন্ধ রাখা গেল না।

শোভাযাত্রীরা উলঙ্গ মেয়েগুলোকে আমার কামরায় ঢুকিয়ে শরণার্থীদের পাশে বসিয়ে দিল। তারপর আমার উদ্দেশে তাদের আন্তরিক বিদায় সম্ভাষণ আর জয়ধ্বনি — কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ জিন্দাবাদ!

একটি ছোট্টো ছিপছিপে ছেলে বেঞ্চি থেকে উঠে এক প্রৌঢ়া মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, মা, তুমি কি এখন স্নান করে এলে?

হ্যাঁ, বাবা। আমার দেশের ছেলেরা, আমার ভাইয়েরা, আমায় স্নান করিয়ে দিয়েছে।

তাহলে তোমার কাপড় কোথায়?

আমার ভাইয়েরা নিয়ে গেছে বাবা, — আমার স্বামীর রক্তে রাঙিয়ে।

দুটি উলঙ্গ মেয়ে জানলা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। দু’জনেই উঠতি বয়সের। তাদের লাফিয়ে পড়তে দেখে ভয়ে আমার সারা গা শিউরে উঠল। আর আমি সইতে পারছিনে। এখন আমি চাই এখান থেকে পালাতে, দূরে কোথাও সরে যেতে। অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে রাত্রির গহ্বরে। নয়তো তার ভেতর মিশে গিয়ে।

এমনি অবস্থাতেই এক সময় এসে পৌঁছলাম লাহোরে। স্টেশনে আমার জায়গা হলো এক নম্বর প্ল্যাটফরমে।

আমি যখন এসে দাঁড়ালাম তখন আমার বিপরীত দিকে, দু’নম্বর প্ল্যাটফরমে আর

একখানি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওখানা এসেছে অমৃতসর থেকে, মুসলমান শরণার্থী নিয়ে।

একটু পরেই একদল ন্যাশনাল গার্ড শুরু করল আমার শরণার্থীদের দেহতল্লাশি। কামরাগুলোর ভেতরে ঢুকে পড়ে। নগদ যা কিছু পাওয়া গেল, সবই তারা নিয়ে নিল। তার ওপর, গয়নাগাটি আর দামি জিনিসপত্রও। সবশেষে তারা বেছে চারশ’ শরণার্থীকে আলাদা করে নিল। এদের মেরে ফেলা হবে।

এই পরিকল্পনাটির একটুখানি ইতিহাস আছে। ওপাশের গাড়িখানা অমৃতসর থেকে মুসলমান শরণার্থী নিয়ে আসার সময় পথে হামলার মুখে পড়ে। সে হামলায় চারশ’ মুসলমান নিহত হয়েছে, আর পঞ্চাশটি মেয়ে চুরি গেছে। এর উত্তর দেওয়া যেতে পারে কেবল একটি উপায়ে। এবং সে উপায়ই মোক্ষমরূপে নির্ভুল। হিন্দু আর শিখ শরণার্থীদের ভেতর থেকে চারশ’জনকে বেছে নিয়ে শেষ করে ফেল। সব লজ্জা মিটিয়ে দাও পঞ্চাশটি মেয়ের। তবেই তো সমতা বজায় থাকবে পাকিস্তানে আর হিন্দুস্তানে। রক্ষিত হবে স্থিতাবস্থা।

মোগলপুরাতে গার্ড বদলি হলো। বালুচ সৈন্যদের জায়গায় এলো শিখ, রাজপুত আর ডোগরা সৈন্য।

আতারি থেকে দেখি, পরিবেশটাও বদলে গেছে। হিন্দু আর শিখ শরণার্থীদের সামনে এখন কেবল মুসলমানের লাশ। রাশি রাশি। শরণার্থীরা যে স্বাধীন ভারতের সীমান্তে পৌঁছে গেছে_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অমৃতসরে আমার একটি কামরায় চারজন ব্রাহ্মণ যাত্রী উঠল। তারা হরিদ্বার যাবে। মাথা একদম ন্যাড়া করা। শুধু মাঝখান থেকে ঝুলে আছে ছয় ইঞ্চি লম্বা এক-একটি টিকি। কপালে তিলক কাটা। গায়ে রামনামের উত্তরীয় জড়ানো। অর্থাৎ তারা তীর্থযাত্রী।

তাদের সাথেই কামরাটিতে উঠল আরও কয়েকজন যাত্রী। হিন্দু আর শিখ। হাতে বন্দুক, বর্শা আর কৃপাণ নিয়ে। অমৃতসর থেকে তারা যাবে পূর্ব পাঞ্জাবে। উদ্দেশ্য শিকারের সন্ধান।

ব্রাহ্মণগুলোকে দেখে একজন শিকারসন্ধানীর মনে সন্দেহ জেগেছে। সে এগিয়ে গিয়ে শুধালো_ বামুন ঠাকুর, তোমরা কোথায় যাবে?

হরিদ্বার।

শিকারসন্ধানীর মুখে একটুখনি হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল_ হরিদ্বার, না পাকিস্তান?

আমরা সত্যিই হরিদ্বার যাচ্ছি। খোদার কিরে।

জাঠ শিকারসন্ধানী আবার হাসলো, খোদাকে সালাম। আমরাও সত্যিই তোমাকে হরিদ্বারে পাঠিয়ে দেব।

তারপর সে চিৎকার করে তার সঙ্গীকে ডাক দিল, নাথু সিং, এদিকে এসো তো। এখানে ভারি মজার একটা খেলা পাওয়া গেছে।

যাত্রীটিকে দু’জনে মিলে মেরে ফেলল।

তার সঙ্গীরাও রেহাই পেল না।

নাথু সিং তাদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে এই তোমাদের হরিদ্বার যাওয়া? এসো, এসো, এদিকে এসো। হরিদ্বার যাওয়ার আগে তোমাদের একবার ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হবে।

ডাক্তারি পরীক্ষায় আকাঙ্ক্ষিত ফলটিই পাওয়া গেল। তিনজন ‘ব্রাহ্মণ’-ই খাৎনা করা।

এবার অমোঘ পরোয়ানা পাওয়া গেছে। মৃত্যুদূতের আর তর সইছে না। সুতরাং তিনজনকেই তখন মেঝেয় লুটিয়ে পড়তে হলো।

এরপর এক সময় আমাকে হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া হলো। একটি ঘন বনের পাশে চারদিকে শুধু ‘সৎশ্রী আকাল’ আর ‘হর হর মহাদেও’ ধ্বনি। এই কর্কশ ধ্বনিতে প্রান্তরটা বুঝি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। প্রহরী আর শরণার্থীরা এখন আমার কামরাগুলো খালি করে নেমে পড়ে বনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাহলে নিশ্চয়ই মুসলমান জনতা আমার পথ আটকে ফেলেছে। এই জন্যই আমার যাত্রী আর প্রহরীরা ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে।

কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল, তা নয়। আমার ভুল হয়েছে। যাত্রী আর প্রহরীরা প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ছুটছে না। কয়েকশ’ মুসলমান আত্মরক্ষার জন্য সপরিবারে বনের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। আমার যাত্রী আর প্রহরীদের লক্ষ্য ওইদিকে। উন্মাদ আক্রোশে তারা হন্যে হয়ে শিকারের কাছে ছুটে যাচ্ছে।

আধ ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ চুকে গেল।

তারপর দেখি, বিজয়ীরা ঝলমলে মুখে ফিরে আসছে। একজন জাঠের বল্লমের ফলায় একটি শিশু গাঁথা। জাঠটি ধেই ধেই করে নেচে নেচে গান গাইছে — আয় বৈশাখী, আয়, আয়, ও বৈশাখী আয়।

আমাকে আরও দু’বার থামিয়ে দেওয়া হলো। পথের পাশের পাঠান গ্রামগুলোতে হামলা করবার জন্য।

কিন্তু পাঠানরাও হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তারা প্রাণপণে লড়াই করে গেল। তাদের রক্ত যেন ফুটন্ত তেলের মতো। সে রক্ত জীবনের শেষ মুহূর্তেও শীতল হয় না। কিন্তু শত্রুর দল সংখ্যায় ভারি। পাঠানদের তাই শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হলো।

তারপর কেবল হত্যা আর হত্যা। গ্রামগুলো একেবারে উজাড় হয়ে গেল। মেয়েদের মান-সম্মান তো হামলার শুরুতেই যায়। তারপরও ওরা তাদের টেনে নিয়ে এলো অশ্বত্থ, সুসান আর হিজল গাছের নিচে।

এই সব গাছের তলায় একদিন এসে দাঁড়াতো সোহ্নী-মোহিওয়াল, হীর-রাঝাঁ, মীর্জা-সাহিবাঁ। সেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের চোখে নীল সমুদ্রের স্বপ্ন তরঙ্গে তরঙ্গে দুলে উঠেছে। এক সময় এই গাছগুলোর তলাতেই দাঁড়িয়ে থাকত প্রেমময়ী বধূরা, লাসসি ভরা ঘড়া হাতে নিয়ে। সে লাস্সি ছিল কর্মক্লান্ত কিষাণের তৃষ্ণা নিবারণের মন-ভরানো উপকরণ। তারা আকণ্ঠ লস্সি খেয়ে দেহ জুড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু মন তখনও তৃপ্ত হতে চায়নি। তারা তাই চেয়ে থেকেছে বধূর মুখের দিকে। যে মুখ শান্ত গোধূলির মতো। আর তখন প্রিয়তোষ চোখের দৃষ্টির উদারতায় ভিজে কোমল দেহগুলোতে লেগেছে বেতস লতার কাঁপুনি, বুকের ভেতর পুলকের শিহরণ।

আজও অশ্বত্থ-সুসান গাছগুলোর তলায় পঞ্চাশটি সোহ্নী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মোহিওয়ালরা সংখ্যায় পাঁচশ’ এবং তারাও মানুষ। তবে তাদের চোখে আছে কেবল নেকড়ের রক্তপায়ী হিংস্রতা, লালাসিক্ত লোভ আর রক্তলোলুপ ক্রোধ।

পাঞ্জাব আজ মৃত। তার সব গান থেমে গেছে, ভাষা হয়েছে বাণীহীন। পাঞ্জাবের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে আজ মৃত্যুর ছাপ। হ্যাঁ, পাঞ্জাব আজ মৃত এবং তার সাথে তার মানুষগুলোও মরে গেছে। মানুষের সাহসভরা বুক আর কুসুমকোমল হৃদয় এখন অতীতের স্মৃতি। আমার দেখবার মতো ইন্দ্রিয় নেই। কিংবা কিছু শোনার। তবু আমি পাঞ্জাবের মৃত্যু স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। তার পদধ্বনিও আমার কাছে আদৌ অশ্রুত নেই।

আম্বালায় যখন পৌঁছুলাম, রাত তখন অনেক। সৈন্যরা একজন মুসলমান ডেপুটি কমিশনারকে তুলে দিয়ে গেল আমার কামরায়। সপরিবারে। কামরাটা প্রথম শ্রেণীর। প্রহরীদের প্রতি কড়া নির্দেশ রইল, তারা যেন ওদের আগলে রাখে। ওদের প্রাণ এবং জিনিসপত্র রক্ষা করবার দায়িত্ব তাদেরই। কারও গায়ে যেন আঁচড়টি না লাগে, কোনো জিনিস যেন নষ্ট না হয়।

আম্বালা ছাড়লাম রাত দুটোয়।

কিন্তু ভালো করে ছাড়তে না ছাড়তেই কে যেন শেকল টেনে আমাকে থামিয়ে দিল। মুসলমান অফিসারটির কামরা ভেতর থেকে বন্ধ। লোকগুলোকে তাই জানলা ভেঙেই ভেতরে ঢুকতে হলো।

অফিসার ভদ্রলোক মারা পড়লেন। তার স্ত্রী আর তিনটি কচি বাচ্চাও। বেঁচে গেল কেবল একটি মেয়ে। মেয়েটি কাঁচা বয়সের। তার ওপর সে পরমা সুন্দরী। এই জন্যই তাকে বাঁচিয়ে রাখা। মেয়েটিকে তারা কেড়ে নিল। সেই সঙ্গে অফিসার ভদ্রলোকের টাকা-পয়সাও। তারপর তারা কামরা থেক নেমে একটা জঙ্গলের দিকে চলে গেল মেয়েটিকে নিয়ে। তার হাতে একখানা বই।

জঙ্গলে তাদের সভা বসল। মেয়েটিকে নিয়ে তারা কী করবে — মেরে ফেলবে, না বাঁচিয়ে রাখবে?

মেয়েটি সমস্যা সমাধানের একটি বাতলে দিল, মেরে ফেলবে কেন? আমাকে তোমাদের ধর্মে নিয়ে নাও। আমি তখন তোমাদেরই একজনকে বিয়ে করব।

তার কথা শুনে একটি তরুণ উত্তর দিল, ঠিক বলেছ। আমার মনে হয়, তোমাকে আমাদের ধর্মে দীক্ষিত করে নেওয়াই উচিত।

কিন্তু পাশের অন্য একটি তরুণ তাকে থামিয়ে দিল মেয়েটির পেটের ভেতর ছুরি ঢুকিয়ে। সে বলল, আমার মনে হয়, এখানেই সব চুকে যাওয়া উচিত। চলো, এবার উঠে পড়ি। গোলটেবিল বৈঠক অনেকক্ষণ চালানো গেছে। এই-ই যথেষ্ট, আর বসে থাকবার দরকার নেই।

মেয়েটি শুকনো ঘাসের ওপর মরে পড়ে রইল। এক গোছা ঘাসের মতোই নিথর, নির্বাক হয়ে। পেট থেকে রক্তের ধারা নেমে ঝকঝকে বইখানা সিক্ত, নোংরা করে দিল। বইখানা জন স্ট্র্যাচির ‘সমাজবাদ : তত্ত্ব ও প্রয়োগ।’

হয়তো মেয়েটি বুদ্ধিমতী ছিল এবং দেশদরদি। তার হয়তো প্রবল বাসনা ছিল সে দেশের এবং দেশের মানুষের সেবা করবে। সে হয়তো কাউকে ভালোবাসতেও চেয়েছে। এক বুক উদগ্র ভালোবাসা নিয়ে। এবং চেয়েছে তারও ভালোবাসা। হয়তো সেই আশ্চর্য কামনা তাকে বেদনামধুর আঘাতে শিহরিত করে যেত। দিনের পর দিন। সন্ধ্যার ধূসর আলোকে অস্পষ্ট সব ভাবনার পথ বেয়ে এসে। সে কামনা বিদ্যুৎ-চমকের মতো বারবার ঝলকে উঠেছে, তাকে ঝলসে দিয়েছে। তার টনটনে বেদনায় হয়তো মনটা ছিঁড়ে যেতে চাইত। হয়তো সে তারপর ঝড়ের পরের প্রশান্তি জমিয়ে নির্জনে প্রার্থনা করেছে, ছায়াদয়িত, তুমি এসো। নিভৃত তৃপ্তির আলিঙ্গনে দু’টি হৃদয় এক হয়ে যাক। হৃদয়মন সূচীমুখ উৎসাহে উঠে আসুক এক জোড়া ঠোঁটের কিনারায়।

কিন্তু সে কামনা কি পূর্ণ হয়েছে? কে জানে! হয়তো তার সব কামনা রূপ নিয়েছিল চোখের কোণে তরল বিন্দুমালায়। তারপর আবার তারা ফিরে গেছে তার বুকের তলায়। মনের স্বপি্নল ভাবনার পথ ধরে। তাই সে চেয়েছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। শান্ত কোনো সকালে তার সৃষ্টি, তার শিশুর কপালে চুমু দেবার বাসনায়। তাই তো সে বুকের ভেতর ভরে রেখেছিল আকাশের নীল, আলো আর বাতাসের স্পর্শভার। পৃথিবীর উদার মমতা চোখে মেখে। সে ছিল নারী, সে ছিল প্রেয়সী এবং স্ত্রী আর জননী। সৃষ্টির গোপন রহস্য।

অথচ এখন সে মরে পড়ে আছে জঙ্গলের ভেতর। সে আজ কেবল ছুড়ে ফেলে দেয়া একটা লাশ, যা একটু পরেই শেয়াল-শকুনে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। দাঁত আর নখের কামড়ে-আঁচড়ে টুকরো টুকরো করে। সে তখন ছড়িয়ে থাকবে কেবল উচ্ছিষ্ট মাংসের কণা হয়ে। ‘সমাজবাদ :তত্ত্ব ও প্রয়োগ’ আজ শ্বাপদের দন্ত-নখরে বিদ্ধ।

আর, আমি এখন ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ছুটে চলেছি রাত্রির বুক চিরে। যে রাত্রির সম্বল আজ কেবল অন্ধকার আর হতাশা। অথচ আমার কামরাগুলোতে যাত্রীরা আকণ্ঠ দেশি মদ টেনে নেশায় বুঁদ হয়ে চিৎকার করে চলেছে_ মহাত্মা গান্ধী কি জয়!

আমার যাত্রা শেষ হলো বোম্বেতে এসে। আরও অনেক পথ পেরিয়ে।

বোম্বেতে আমাকে ধুয়েমুছে সাফ করা হলো। তারপর আমি চলে গেলাম শেডের ভেতর। এবার বিশ্রামের পালা।

এখন আমার কোথাও এক ফোঁটা রক্তের দাগও পাওয়া যাবে না। আমার কামরাগুলো আর রক্তলোলুপ হাসিতে মুখর নয়। আততায়ী সবাই চলে গেছে। তবু আমার বুঝি নিস্তার নেই। রাত্রির অন্ধকারে মৃত শরণার্থীদের আত্মারা একে একে ভিড় করেছে আমার জনহীন কামরাগুলোতে। সবাই যেন ফিরে পেয়েছে দেহাশ্রয়ী জীবন। আহতরা আর্তনাদে ভেঙে পড়ছে। নারী আর শিশুরা ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছে।

আর বুঝি আমি সইতে পারিনে। আমার মনের ভেতর এবার পাক খেয়ে ফিরতে লাগলো কেবল একটি আকুল কামনা_ এমন বীভৎস যাত্রায়, এমন ভীষণ পথে আমাকে যেন আর বেরুতে না হয়। আমি যেন আর এই শেড ছেড়ে বাইরে না যাই। কখনও, কোনো দিন।

আমি আবার পথে বার হবো সেই দিন, যেদিন পাঞ্জাবের প্রান্তর ভরে উঠবে শ্যামল শস্যের জাদুস্পর্শে। হ্যাঁ, কেবল সেই দিন। তখন আমার সামনে থাকবে দীর্ঘ পথ। যে পথ চলে গেছে দেশের মাটির ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে। যার চার পায়ে হিজল গাছের সবুজ পাতা আর বর্ণধনী ফুলের সমারোহ। যেখানে শোনা যায় কেবল হীর-রাঝাঁর অমর প্রেমের অকুণ্ঠ গাথা। ওই পথে আবার যাত্রা শুরু হবে সেই দিন, যেদিন হিন্দু আর মুসলিম ক্ষেতমজুর একসঙ্গে মিলে ফসল বুনবে, একসঙ্গে মিলে ফসল তুলবে, গলা ছেড়ে গান গাইবে একসঙ্গে। সেদিন বুক ভরবার দিন। সব মানুষের বুক সেদিন ভরা থাকবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়, নারীর প্রতি সম্মানবোধে।

নিষ্প্রাণ কাঠে গড়া একখানি গাড়ি ছাড়া আমি আর কিছুই নই। তবু তোমাদের কাছে আমার প্রার্থনা, জঘন্য প্রতিহিংসা আর অসহ্য ঘৃণার ভারে তোমরা আমার দম আটকে দিয়ো না।

পথে আমি আবার বেরুবো। কিন্তু এভাবে নয়। এবার আমি দুর্ভিক্ষের দিনে দিকে দিকে খাবারের বোঝা বয়ে নিয়ে যাবো, শিল্পস্থলীতে পৌঁছে দেব কয়লা, তেল আর লোহা। কিষাণ আমাদের জীবনের কারিগর। আমি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দেব সার আর কলের লাঙল। আমার সাধ, সেদিন যেন আমার কামরাগুলোতে বসে থকে সুখী আর শৃঙ্খলপ্রিয় কিষাণের দল। পদ্মফুলের মতো উজ্জ্বল স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে।

আমার সেই নবযাত্রা কী অপরূপ! সেদিন শিশুরা পথ চলবে দুর্বার আশায় বুক বেঁধে, এগিয়ে যাবে দলে দলে, কিশলয়ের মতো চোখ মেলে নবজীবনের পথে। যে পথ নতুন সূর্যের সজীব আলোয় প্লাবিত। যার টাটকা হাওয়ায় সমুদ্রের স্বাদ। যেখানে হিন্দু বলে কেউ নেই, মুসলমান বলেও কেউ নেই। আছে কেবল মানুষ, প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি।

হ্যাঁ, মানুষ — কেবল মানুষ!



অনুবাদ : জাফর আলম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. মনুষ্য বিদ্বেষ কেবল মাত্র মানুষকেই ধ্ব,ংংংংংংংংংংংংংংংংংংংংংংংংংং

    উত্তরমুছুন
  2. মনুষ্য বিদ্বেষ কেবল মাত্র মানুষকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, এই গল্পে সেটা প্রতিয়মান। পাশাপাশি মানুষ এবং মনুষ্যত্ত্বের জয় একদিন হবেই সেই দিনের অপেক্ষায় আমরা রত! নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবার আশ্বাসবানী এই গল্পেই নিহিত। কিষান চন্দ এখানেই সফল।

    উত্তরমুছুন
  3. উপরের মন্তব্য টি করেন -নাসির সর্দ্দার , আমতলা, মুর্শিদাবাদ।

    উত্তরমুছুন