বিশ্বে মার্কেজ একজনই ।। হাসান আজিজুল হক

মার্কেজের বই প্রথম পাই সত্তরের দশকের শেষের দিকে। আমরা তখন বই অনেক পরে পেতাম, অনেক দেরিতেই আসত এবং এটা লজ্জাকরও বটে আমাদের জন্য। মার্কেজের প্রথম যে বইটা পাই, তার নাম ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’। মনে হয় যেন খবরের কাগজের একটা খবর। একটা খবরকে যে উপন্যাসের রূপ দেয়া যেতে পারে ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’-ই তার প্রমাণ। একজনের মৃত্যু হবেই হবে অর্থাৎ এটি একটি পূর্বনির্ধারিত মৃত্যুর ঘটনা। সে এক অদ্ভুদ বই। মার্কেজের লেখা প্রথম পড়া বই এটি। যতদূর মনে পড়ে, বইটি আমি পড়েছিলাম সত্তরের শেষের দিকে।

‘ক্রনিকল অব এ ডেথ’ বইটি পড়ার পরপরই আমি ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুট’ (নিঃসঙ্গতার এক শ বছর) বইটি পড়ি। এটি আমার পড়া মার্কেজের সেরা উপন্যাস। অসাধারণ এক উপন্যাস, বেশ বড় লেখা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বইটি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে, একই সঙ্গে কত জিনিস যে এক বইয়ের ভেতর পাইয়ে দেবে, সে কল্পনা করা যায় না। লাতিন আমেরিকান তথা কলাম্বিয়ান সমাজ, আদিবাসীদের জীবনা-যাপন, জীবন ব্যবস্থা ইত্যাদি উঠে এসেছে এ বইয়ে।


কলাম্বিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী একটি গ্রামের নাম মাকান্দো। সেখানে মার্কেজের নানা বাড়ি। ওই অঞ্চলে নানা-নানির কাছেই মার্কেজ বড় হয়েছেন। তার নানা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন।

লাতিন আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থা অনেকটা আমাদের ভারতবর্ষের মতো— ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে মিলবে না। স্প্যানিশ জগৎ আলাদা। সেটা আমি সারভান্তেস পড়ে বুঝেছি। এটা জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ইতালির মতো নয়। অনেকাংশেই আমাদের মতো। নানা-নানি, দাদা-দাদির কাছে সন্তান রেখে মানুষ করা ইত্যাদি আমাদের মতো তাদেরও ছিল।

যাহোক, তিনি নানির কাছে মানুষ হওয়ার সময় নানি তাকে নানা গল্প বলতেন। গল্পগুলো এমনভাবে বলতেন যে, সত্য মিথ্যার কোনো প্রভেদ থাকত না। আর নানা রকম প্রবচন— যেমন আমাদের দেশে আছে— দুপুরবেলা কাক ডাকলে সেটা অশুভ, দুই শালিক দেখলে শুভ, জলভরা পাত্র দেখা ভালো, জলশূন্য পাত্র দেখা মানে যাত্রা অশুভ ইত্যাদি। এরকম কথাবার্তা গ্রামে প্রচলিত আছে। এসব বৈজ্ঞানিক কথা নয়। তবে মানুষ বিশ্বাস করে। এরকম প্রবচন-কুসংস্কার ইত্যাদিতে ভর্তি ছিল মার্কেজের নানির মাথা। তিনি সেগুলো ব্যবহার করতেন।


আগেই বলেছি স্প্যানিশ জগৎ একটু আলাদা। নানি বলতেন, আমার স্বামী কত নারীর সংসর্গে যে গিয়েছেন এবং তাদের প্রত্যেকের ঘরেই অন্তত একটি করে ছেলে হয়েছে। এসব ছেলেরাও তো এ বংশেরই ছেলে। (স্প্যানিশ ওয়ার্ল্ডের যৌনতা একটি স্বাভাবিক উন্মুক্ত বিষয়। পুরুষরা এ সুবিধা পুরোমাত্রায় ভোগ করে। নারীরাও করে, তবে পুরষদের মতো নয়।) তো মার্কেজের নানি তাঁর স্বামী সম্পর্কে এসব গল্প করতেন। মার্কেজ এসব গল্পই তাঁর নানির বলা ভঙ্গিতেই ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুট’ উপন্যাসে তুলে ধরেন। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় মাকান্দোতে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন।

কিউবায় যেমন প্রচুর আখ হয় তেমনি কলাম্বিয়াতেও প্রচুর আখ হতো। মাকান্দোতে ছিল বিশাল ইক্ষুমাঠ। সেখানে একবার আখশ্রমিকরা বিদ্রোহ করে। এতে অংসখ্য শ্রমিককে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এসব চাপা পড়ে যায়। ইতিহাস আর কথা বলে না। ইতিহাস যখন কথা বলে না তখন সেটা সমাজের নিস্তব্ধতা। ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুট’ হচ্ছে শতবছরের নিস্তব্ধতা। যেমন অসাধারণ নাম তেমনই অসাধারণ লেখা। এখন তো এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়। জি এইচ হাবিবের অনুবাদটা মন্দ হয়নি। রাম শরণের অনুবাদটাও বেশ ভালো।

আমি মার্কেজের এই বইটি পড়েছি। ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’ পড়েছি। তারপর ‘লিফস্টর্ম’ (Leaf Storm—1955) পড়েছি। ‘ইন ইভিল আওয়ার’ (In Evil Hour—1962), পড়েছি এবং তার আত্মজীবনী ‘লিভিং টু টেল দ্য টেল’ (Living to Tell the Tale—2002), ‘নিউজ অব এ কিডনাপিং’ (News of a Kidnapping — 1996), ‘মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস’ (Memories of My Melancholy Whores — 2004), ‘দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’ (The General in His Labyrinth —1989), তারপর ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (Love in the Time of Cholera—1985) পড়েছি। এটি মার্কেজের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। ‘দি ইনক্রেডিবল এন্ড স্যাড টেল অব ইননোসেন্ট এরেন্দিরা এন্ড হার হার্টলেস গ্রান্ডমাদার (The Incredible and Sad Tale of Innocent Erendira and Her Heartless Grandmother — 1978), কালেক্টেড স্টোরিজ (Collected Stories—1984) প্রভৃতি গল্প, ছোটগল্পও পড়েছি। অর্থাৎ মার্কেজকে আমি বেশ ভালো করেই পড়েছি, যদিও অনুবাদে পড়েছি।

মার্কেজ প্রসঙ্গে অনেকেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা বলেন। সৃজনশীল সাহিত্যে আমি কোনো রকম ইজম বা মতবাদের পক্ষপাতী না। আমি মনে করি যে, ইজম করে কেউ কোনোদিন লেখক হয় না। মার্কেজ কখনোই নিজেকে ম্যাজিক রিয়ালিস্ট বলে দাবিও করেন নাই।

‘দি ফ্রাগ্রেন্স অব গুয়েভা’ (The Fragrance of Guava—1982) —পেয়ারার সুবাস বলে একটা বই আছে। সেখানে তিনি বলেছেন, আমার নানি-দাদিরা যেভাবে গল্প বলতেন আমিও সেভাবেই বলি, এটা ম্যাজিক রিয়ালিজম কী-না জানি না। আপনি যদি মনে করেন, আপনার নানি-চাচিরা যেভ‍াবে গল্প করেন আপনিও সেভাবেই লিখবেন। এটা হতেই পারে। আমি যেমন অনেকটা ‘আগুনপাখি’-তে করেছি। কিন্তু তাই বলে তো আর ‘আগুনপাখি’ মার্কেজ প্রভাবিত নয়। কিন্তু এক ধরনের ম্যাজিক রিয়ালিস্ট তো বটেই। লাতিন আমেরিকার অন্যদের লেখায়ও তো ম্যাজিক রিয়ালিজম আছে। কিন্তু তারাও তো মার্কেজের মতো নন। অর্থাৎ লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজমও এক রকম নয়। যেমন ম্যাক্সিকান সাহিত্যের প্রধান পুরুষ হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো-তেও তো ম্যাজিক রিয়ালিজম আছে। আবার মারিও বার্গাস য়োসাকেও তো বলা হয় ম্যাজিক রিয়ালিস্ট। যারা সমালোচক তারা এসব তত্ত্ব আবিষ্কার করে। আর নতুন প্রজন্মের যারা লেখক হচ্ছেন, তারা এসব পড়ে উত্তেজিত হয়। কিন্তু এসব তত্ত্বে উত্তেজিত বা বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না, উত্তেজিত হলেই বরং লেখার ক্ষতি। ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে আমি কখনই হৈ-হল্লা করিনি। তবে এর একটা জোরজবরদস্তি প্রভাব অনেকের মধ্যেই পড়েছে। যেমন শহীদুল জহিরের একটি উপন্যাসে উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে, একজন বেশ্যার দুজন লোকের উপর রাগ ছিল। সে তাদের বলল যে, ভাই আমাকে নৌকায় নিয়ে চলো। তারপর সে নৌকাতে ওই দুজনের সঙ্গে এমন রমণক্রিয়ায় মত্ত হলো যে শেষ পর্যন্ত ওই দুজনের মৃত্যুই ঘটল। আমি বলেছি, এগুলো বেশ কষ্টকল্পিত। এ ধরনের লেখা বাঙালি লেখকদের পক্ষে সম্ভব না। সৈয়দ শামসুল হক বা এমন অনেকেই বলছেন, এগুলো নিয়ে মাতামাতির কোন অর্থ হয় না। এগুলো বাংলা সাহিত্য কেন সব সাহিত্যেই বহুকাল ধরে আছে।

কিন্তু মার্কেজ ম্যাজিক রিয়ালিজমেই ফুরিয়ে যান না। তার প্রত্যেকটি গল্প, প্রত্যেকটা চরিত্রের প্রতীকী মূল্য আছে। এজন্যই মার্কেজ এত বিখ্যাত। দুখিনী এরেন্দিরা বারবার ধর্ষিত হচ্ছে এটা যেন সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনে লাঞ্ছিত দেশমাতৃকারই প্রতিচ্ছবি। আমার ‘সাবিত্রী’ উপাখ্যানেও এরকম চিত্র আছে। মার্কেজের মৃত্যুতে আমার মনে হলো যেন একটা ইন্দ্র পতন হলো, আকাশ থেকে একটা জ্যোতিষ্ক যেন খসে পড়ল। কিন্তু স্বান্ত্বনার বিষয় হলো এই যে মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর, এই বয়সে এসে তার বিশ্বকে নতুন কিছু দেওয়ারও ছিল না।

মার্কেজের সাহিত্য আমাদের সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে সত্য কিন্তু যেভাবে প্রভাবিত করেছে তার ধরনটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। আমি মনে করি যে পৃথিবীতে কোনো দুজন লেখক এক রকম নন— যদি তিনি প্রকৃত লেখক হন। আবার ইচ্ছে করলেও দুজন লেখক এক রকম হতে পারেন না, হওয়া যায় না। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ থেকে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। পৃথিবীতে দুজন মানুষ অবিকল এক রকম পাওয়া যায় না। এটা হয় স্রষ্টার অক্ষমতা না হয় তিনি চান না যে দুজন এক রকম হোক। লেখকরাও তো ওই রকম স্রষ্টা, তারা যেসব সন্তান উৎপাদন করবে তা তো হুবহু হওয়ার কথা নয়। সুতরাং যারা একজন লেখকের সঙ্গে আরেকজনের তুলনা করেন, তারা হয় বোকা না হয় মুর্খ।

অতএব বিশ্বে মার্কেজও একজনই। কেউ চেষ্টা করলেও আরেকজন মার্কেজ হতে পারবেন না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. হাসান আজিজুল হক শেষ প্যারায় যে কথাগুলি বলেছেন সে গুলি অনুধাবন যোগ্য , পড়ে লেখকরা উপকৃত হবেন । প্রভাব এবং হতাশা দু-ই কাটিয়ে উঠতে পারবেন

    উত্তরমুছুন