হামীম কামরুল হক
১.
জীবনকে আবেগে উৎসাহে ও উদ্দীপনায় নিত্যদিন একই রকমভাবে ধরে রাখাটা খুব সোজা ব্যাপার নয়। অথচ মানুষ মূলত আনন্দকামী। এই আনন্দ পেতে চাওয়াটাও তার নানা রকমের ব্যথা-বেদনার একটা উৎস। তারপরও জীবনের সঙ্গে তাকে যুক্ত থাকতে হয়। যে সব মানুষ প্রতিনিয়ত তার নানা রক্তক্ষরণের কারণ, তাঁদের সঙ্গে তাকে বসবাস করতে হয়। মানুষের সঙ্গে সংযোগহীন হয়ে মানুষ তো বাঁচতে পারে না। সে রকমেরই একটা সংযোগ তৈরি হয় উপন্যাসের মাধ্যমে। এটা একটা নান্দনিক সংযোগ, যা তাকে জীবনকে আগের চেয়ে একটু ভালো করে বুঝে নিতে সহয়তা করতে পারে। একটি প্রকৃত উপন্যাস পাঠের পর কোনো পাঠকই আর আগের জায়গায় থাকতে পারেন না। যে কোনো শিল্পের মতো এখানেও এ ঘটনাটি ঘটে- এবং তা এমনভাবেই ঘটে পাঠক সেটি টেরও পান না। অনেকটা রোগিকে বুঝতেই না দেওয়া যে তার চিকিৎসা চলছে, উপন্যাস সেভাবেই ব্যক্তি মানুষের ও মানবসমাজের গভীর গহন ক্ষতের ওপর নতুন প্রাণের ও উদ্দীপনার প্রলেপ বোলায়।
ফলে উপন্যাস-পাঠ মানেই একটা অদৃশ্য নিরাময়ের ঘটনা ঘটা। ভ্যান গগ ‘উপন্যাসের পাঠক’ নামের যে ছবিটি এঁকেছিলেন তাতে একজন নারী সোফায় বসে হলুদ রঙের মলাটের একটা বই পড়ছে। এবং এর পটভূমিটাও মূলত হলুদ। হলুদ কী আনন্দের রং? তাহলে উপন্যাস পাঠ মাত্রই একটা আনন্দের আবহ পাঠককে ঘিরে ফেলে? না বিষাদের রং হলুদ? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে রঙের ওই আবেদন বলে আলাদা। সে যাই হোক, উপন্যাসের রঙ ও তাঁর পরিপার্শ্বের রঙ এক হয়ে গেছে এ ছবিতে। তাঁর পেছন দিকে উঠে গেছে একটা সিঁড়ি। এ সিঁড়িটাও ‘ওপরে ওঠার’ ইঙ্গিত দেয় নাকি? সে নিজে পরে আছে কালচে রঙের পোশাক। বোধ করি কালো যে রহস্য ও জ্ঞানের রঙ তাও কি এখানে লক্ষ্যণীয়। সর্বোপরি মনে হবে একজন নারীকে কেন দেখানো হল উপন্যাসের পাঠক হিসেবে?
এর একটা উপপ্রমেয়মূলক জবাব দেওয়া যায়: উপন্যাস মূলত নারীবাদী না হলেও নারীকেন্দ্র্রিক ব্যাপার, ওই মহাকাব্যের মতোও তলে তলে কি প্রকাশ্যভাবে এতে কাজ করে যায়। ‘রামায়ণে’র সীতা হরণ নিয়ে তৈরি হয় এর মূল সঙ্কট। ‘মহাভারতে’ দ্রৌপদীর অপমান কুরু-পা-বের বিদ্বেষকে তীব্রতা দেয়। ‘ইলিয়াডে’র হেলেন নিয়ে লড়াই আর ‘অডিসি’তে পেনিলোপের অপেক্ষা- সর্বত্রই নারী হয়ে আছে এর প্রধানতম প্রতিপাদ্য। পুরুষের কাজ হচ্ছে কেবল তার দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি উপন্যাসের কেন্দ্র দেখব নারীকেই। এটা কেন ঘটে? কারণ কোনো সমাজের অবস্থা বুঝে নেওয়ার একটা উপায় হল সেই সমাজের নারীরা কেমন পরিস্থিতির মধ্যে আছে সেটা দেখিয়ে দেওয়া। একজন নারীর অবস্থান তাই যে কোনো পরিস্থিতিতে মানব অস্তিত্বের স্মারক। মানবিকতাকে চিনে নেওয়ার উপায়ও। এবং বলতে দ্বিধা নেই, নারীকে আধুনিক করে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশে সে দেশের উপন্যাস পাঠ বড় রকমেরই ভূমিকা রেখেছে।
ফলে পবিত্র মন ও শরীর নিয়ে কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার আগে যেমন মনে ও শরীরে পবিত্র হতে হয়, উপন্যাস পাঠের আগে একটা ‘মানবিক মন’ নিয়ে পাঠককেও পড়তে বসা লাগে বইকি। কী এই ‘মানবিক মন’ সেটি এক কথায় ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। উপন্যাস মূলত ও ভিত্তিগতভাবে একান্তই পার্থিব একটা ব্যাপার। পাঠকেরা উপন্যাস পড়ার আগে সেই মানবিক মনটা নিয়ে বসেন কিনা বলা মুশকিল। তবে উপন্যাস তাকে আগের চেয়ে সামান্য হলেও ওই মানবিকতার স্পর্শ দিয়ে যায়। তাই যখন সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলে, এমন কি যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁদের অনেকেই কথাসাহিত্য তথা ফিকশন তথা উপন্যাস পড়েন না- সেখানে একটা ঘুন তার কাজ শুরু করে দেয়। জীবনের সরসতা, উত্তাপহারা এককাট্টা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে তাঁরা নিজেকে যেমন নিরস করে তোলেন, তেমন দূরে সরে যান সময়ের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্বরের কাছ থেকে। ফলে ‘এখনকার উপন্যাস আর কিচ্ছু হচ্ছে না- এসব ছাইপাশ পড়ে সময় নষ্ট’- মনে করেন তাঁরা একটু একটু করেই কী ক্ষতি সাধন করেন তা আলোচনার ক্ষেত্রে এটা নয়। আমরা কেবল বলতে চাই, নিজেকে সংবেদনশীল, উদ্দীপ্ত ও সরস রাখতে উপন্যাসের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের বই পড়ার সময় মনে থাকে না যে কোনো বই পড়ছি।’ কথাটা যে কোনো বইয়ের ক্ষেত্রে যতটা সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য বোধ করি উপন্যাসের ক্ষেত্র। ওই বই জীবনের এক বিকল্প জীবনে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। তার অন্তর্লোকে আলো কী আগুন জ্বালে। তাকে দগ্ধ করে। তিনি জীবন সম্পর্কে প্রকৃষ্টভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। বোধ করি একেই বলে- ‘গ্রন্থে’র প্রহার’। এ প্রহার শুদ্ধ-সুস্থ-বুদ্ধিবৃত্তিক হতে পারে; বা অশুদ্ধ বিভ্রান্ত- মনকে সুস্থতা আনয়নের দিকেও হতে পারে।
যাঁরা বই-পত্র পাঠ করেন তাঁরা জানেন সত্যিই গ্রন্থের এক ধরনের প্রহারও আছে। এক ধরনের প্রহারে যেমন ছাত্রের আরো অবনতি হয়, আরেক ধরনের প্রহারে পাঠের প্রতি ভালোবাসা জাগে। তাই ‘গ্রন্থের প্রহারে’রও ইতি- নেতি দুটো দিকই আছে। দুটোই প্রকট। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের সূচনালগ্নেই এই প্রহার শুরু করেছিলেন বঙ্কিম স্বয়ং। নীরদচন্দ্র চৌধুরী বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধি তাহাকে হৃদয়হীন করে নাই, হৃদয় তাঁহাকে বুদ্ধিহীন করে নাই।’ এবং তাঁর মতে, বঙ্কিমের যে রচনাগুলোকে সাম্প্রদায়িক উসকানির উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হয়েছে সেসব আদতে শুরু হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। সেদিক থেকে বলা যায় বঙ্কিমের গ্রন্থে’র মাধ্যমে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ অনেকটাই উপন্যাস-পাঠকের দায় নয়, কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং বুদ্ধিজীবী ও কিছু লেখকের কাজ। কবি আল মাহমুদের মতে, বঙ্কিমের লেখার কারণে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ভেতরে যে বিরোধ তৈরি হয়ে গেছে তা আর মিটবার নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মনে করেন, ‘কোনো দেশের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সেখানের উপন্যাসের মূল প্রবণতা হল ঔপনিবেশিক প্রভুর বিরোধিতা, সেখানে বঙ্কিম কিনা একেবারে ইংরেজের স্তুতিবাদ করে গেছেন তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে। উপন্যাস যেখানে প্রচলিত প্রথা ও ধারণার বিরোধিতা করে, সেদিক থেকেও বঙ্কিম উল্টো কাজটা করেছেন।’ অন্যদিকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, উপন্যাসের সত্যিকারের ভাষার জন্য ইউরোপকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় চারশো বছর। মানে ফ্লবেয়ার পর্যন্ত। সেখানে বাংলা উপন্যাসের পথিকৃৎ বঙ্কিম আজো পর্যন্ত উপন্যাসের ভাষাগত বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক। সর্বশ্রেষ্ঠ দিয়েই শুরু এর বা শুরুতেই সর্বশ্রেষ্ঠকে পাওয়া। তাঁর পরে বাংলা উপন্যাসের প্রধান দুই জন হলেন- রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্পর্কে মনে করা হয়, তিনিও এ-ক্ষেত্রে অনেকটাই ম্লান। এবং শরৎচন্দ্র তো উপন্যাসকে রীতিমতো পিছনের দিকে চালিত করেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ তো মনে করেন শরৎচন্দ্রের মাধ্যমেই আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জীবনের প্রকৃত অনুভূতি ও ভাষ্য তৈরি হয়েছে। মানিক কী রমানাথ রায়-এর মতো লেখকেরা তাঁদের লেখালেখি বা সাহিত্যচর্চার সূচনার মূল প্রেরণা শরৎচন্দ্রকে মনে করেন। কেউবা মনে করেন, বাংলা উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের ধারায় পেতে পারত তাঁর প্রকৃত শক্তি। কি ভাষা কি চিন্তায় কি আধুনিকতায় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের প্রকৃত স্বাদ খুব কম বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পেরেছে।
ওপরের কথাগুলো বলবার কারণ, উপন্যাস পাঠকেরা যে কত রকমের ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি, মত ও অমতের ভেতরে পড়তে পারেন সেটি দেখে নেওয়া। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন লেখকদের লেখা প্রবন্ধ পড়লেও এরকম বিভ্রান্তি বাড়বে বই কমবে না। সত্যি বলতে কি এই গোলকধাঁধা লেখকেরাই অন্য লেখক সম্পর্কে তৈরি করে থাকেন। সন্দীপনের কাছে শরৎচন্দ্র অপ্রয়োজনীয় লেখক। আবার সন্দীপনের কাছে যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুতূল্য তার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র। সুতরাং সমীকরণটা বেশ গোলমেলে। তলস্তয়ের কাছে শেক্সপিয়ার রীতিমতো বাজে লেখক। তিনি যতবার শেক্সপিয়ার পড়েছেন ততবারই তাকে হীন থেকে হীনতর লেখক মনে হয়েছে। তলস্তয় পছন্দ করতেন গ্যেটের লেখা, সেই গ্যেটের কাছে শেক্সপিয়ারের ওপর লেখক নেই। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ রীতিমতো অপাঠ্য একটা লেখা। তাঁর পছন্দ ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সমরেশ বসু আক্ষেপ করে সমরেশ মজুমদারকে বলেছিলেন, জীবনে কিছুই হল না। তারাশঙ্করের মতো একটা লাইনও লিখতে পারেননি।
উপরের এই কথাগুলো বলার আর একটা উদ্দেশ্য হল : উপন্যাস-- পাঠকেরা যেন নিজের ওপর আস্থা না হারান এবং আমরা দেখব যে উপন্যাসের পাঠক হতে হলে আমাদের ঠিক করেই নিতে হয় কমপক্ষে দুটো বিষয়, এক. কোন কোন উপন্যাস আমরা পড়তে চাই এবং কোন কোন লেখকের লেখা আমরা পড়তে পারি। জোসেফ ক্যাম্পবেল তাঁর ‘মিথের শক্তি’ বইটিতে একটা মূল্যবান কথা বলেছেন, তাহলো : যার যার রকমের পথ তাকে তাকে খুঁজে নিতে হবে। এবং এর অনেকগুলো উপায়ের মধ্যে একটা হল, নিজের লেখককে বের করা এবং তার বইগুলো পড়া। ‘হোয়াই দ্য নভেল ম্যাটারস’-এডিএইচ লরেন্স লিখেছিলেন, ‘আমি একজন মানুষ এবং একজন জীবন- মানুষ। আর এই কারণেই আমি একজন ঔপন্যাসিক। একজন সন্ত, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক এবং কবি, এঁরা প্রত্যেকেই মানুষের কাছে তাঁদের ক্ষেত্র-অনুযায়ী বিরাট ও মহান হিসেবেই পরিগণিত হন। কিন্তু তার জীবনকে একটা বিরাট বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে সামগ্রিকভাবে নিজের ভেতরে গ্রহণ করতে পারেন না। আর একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি এঁদের চেয়ে এজন্যই অবস্থানগতভাবে নিজেকে উচ্চতর মনে করি। একমাত্র উপন্যাসে জীবনের সমস্ত কিছুকে সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করা যায়।’ তাঁর মতে, ‘দ্য নভেল ইজ দ্য ওয়ান ব্রাইট বুক অব লাইফ।’ তাহলে উপন্যাস-পাঠকও এই কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারেন যে তিনিও ঔপন্যাসিকের সমানতালে জীবনকে সামগ্রিকভাবে নিজের ভেতরে গ্রহণ করতে পারেন?
আরো একটা বিবেচনার বিষয় হল, কেবল একজন উপন্যাস লিখল আর জীবনকে সামগ্রিকভবে তাঁর দেখা হয়ে গেল- বিষয়টা নিশ্চয়ই তা নয়। এর জন্য তাঁকে অন্যান্য বিষয়ে অনেক কিছু জেনে নিতে হয়। ওই জানাশোনার কাজটা চালিয়ে গেলেই কোনো উপন্যাস তখন তাঁর ওই জানাটাকে সামগ্রিকতা দান করতে পারে। উপন্যাস পাঠক যদি কবিতা না পড়েন, তার যদি রাজনীতি-অর্থনীতি, সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসের প্রণোদনাগুলো যদি জানা না থাকে তাহলে কেবল উপন্যাস পড়ে কি জীবনকে সামগ্রিকভাবে পাওয়া হয়? দাবি কি করতে পারি তিনি কেবল উপন্যাস পড়েই সেটা পেয়ে যেতে পারেন? যেমন কেউ যদি দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসটি পড়েন তাহলে জীবন সম্পর্কে তিনি একটা নতুন বোধে উদ্দীপ্ত হবেন। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ পড়লেও এই ব্যাপারটি ঘটতে পারে। ব্যাপারটি ঠিক ভালো কবিতা পাঠের মতো। কিন্তু আধুনিক কবিতার পাঠক সেই কবিতা তার ভালো লেগে গেলেও তা তখনই বোধগম্য হয় যদি তার জানা থাকে শিল্পসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, ধারা-প্রবণতা ও জ্ঞানের অন্যান্য বিষয়। ফলে উপন্যাস যর্থাথ অর্থে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য লেখা বই। আবার অন্যদিকে বিশ্বের অন্যভাষার উপন্যাসের পাঠ করতে বাঙালি উপন্যাস-পাঠক সুবিধা পাবেন নিত্যনতুন অনুবাদের মাধ্যমে, বা একজন জার্মান তার হাল আমলের জার্মান ভাষায়, ধরা যাক সতীনাথ ভাদুড়ী পড়বেন, সেই ব্যাপারটা ঘটেই চলবে। ফলে ‘ডন কিহোতে’ নতুন অনুবাদ পড়াটা যতটা বাঙালি পাঠকের জন্য সহি, স্প্যানিশ পাঠকের সেখানে তা মূলেই পড়তে হবে, পড়তে হবে সতের শতকের ভাষায়। তবে বাঙালি পাঠক বঙ্কিম বা কমলকুমার বাংলায় পড়ার পাশাপাশি এদের ইংরেজি অনুবাদে পড়তে পারেন- তাও চলতে পারে। তা চলতে পারে স্প্যানিশ পাঠক যদি হাল আমলের ফরাসি বা ইতালীয় বা জার্মানে বা ইংরেজি বা পর্তুগিজে ‘ডন কিহোতে’ পড়ে নেন।
বলা বাহুল্য এ ধরনের পাঠককে উপন্যাসের দুর্ধর্ষ পাঠকই বলব। এরা হয়তো নিজেরাই উপন্যাস লিখতে চান বা লেখেন, বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক গবেষক। কিন্তু আমরা তো সাধারণ পাঠকের কথাও ভুলে যেতে পারি না। সাধারণ পাঠকের জন্য আর কিছু নেই? স্রেফ তাকে একটা তালিকা ধরিয়ে দিলেই হল? আজকাল কেউ ইন্টারনেটে ‘সর্বকালের সেরা উপন্যাস’ কথাটা ইংরেজিতে লিখে খোঁজ করলে তার সেটা পেতে দেরি হবে না। তিনি একইভাবে পেয়ে যাবেন সর্বকালের সেরা ১০০টি ইংরেজি উপন্যাসসহ ওই নিয়মে অন্যান্য ভাষার উপন্যাসের তালিকা। সেখানে পাওয়া যায় ৩০ বছর বয়সের আগে কোন বইগুলো পড়ে নেওয়া দরকারÑ এমনি সব তালিকাও। কিন্তু তালিকা ধরে ধরে কি উপন্যাস পড়া হয়?
এখানে একটা মজার ব্যাপার হল, এর ভেতরে প্রায় সবরকমের তালিকায় কিছু বই আছে সাধারণ হিসেবে থাকবে, মানে ‘কমন’, আবার কিছু লেখকের বইও পাবেন যার নাম আপনি এই প্রথমবারের মতো জানছেন। তবে একটি প্রকৃত উপন্যাস পাঠ করলেই উপন্যাস-পাঠক সত্যিকার অর্থে ঢুকে পড়বেন সাহিত্যের ত্রিকালবিস্তারী অন্যান্য সব রচনা আস্বাদনের জন্যও। তিনি বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ কি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাসের ‘মহাভারত’ কি হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’র জগতের দিকে এগিয়ে যাবেন।
পাঠক মানে তো আলাদা পাঠক নয়। হ্যাঁ, এঁদের কারো ঝোঁক কবিতার দিকে হতে পারে, কারো প্রবন্ধ ও ইতিহাস-রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতির দিকে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত পাঠক মাত্রই পড়তে চাইবেন সার্ভেনেসের ‘ডন কিহোতে’, স্তাঁদালের ‘স্কারলেট অ্যান্ড ব্ল্যাক’, ফ্লবেয়ারের ‘মাদাম বোভারি, হারম্যান মেলভিলের ‘মবিডিক’, দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ বা ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’, তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ বা ‘আন্না কারেনিনা’, মার্সেল প্রুস্তে ‘রিমেমবারেন্স অব থিংস পাস্ট’, টমাস মানের ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেইন’, কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ ও ‘দ্য ক্যাসেল’, গুন্টার গ্রাসের ‘দ্য টিন ড্রাম’, কু-েরার ‘দ্য আন বিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’, মার্কেসের ‘দ্য ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’-এর মতো বইগুলো। তেমনি বাংলায় তাকে যেতে হবে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, ধূর্জটিপ্রসাদ, অন্নদাশংকর, গোপাল হালদার, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ বহু লেখকের কাছে। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের যে লেখক-তালিকা তা কোনো ছোট তালিকা নয়।
২.
উপন্যাস পাঠক কেবল বইটা খুলে পড়ে যাবেন এই তো যথেষ্ট। আর তিনি যদি সত্যিকারের কোনো উপন্যাস পড়েন তাহলে উপন্যাসের অন্যতম যে কাজটি ‘চৈতন্যের আলোড়ন’ সেটি ঘটবে। ফলে তিনি একটি উপন্যাস পাঠ করে উপন্যাসমুখী হয়ে উঠতে পারেন। তিনি পড়ে নিতে পারেন বিশ্ব-উপন্যাসের ইতিহাস। এর বিকাশ, প্রতিষ্ঠা ও নিত্য নতুন হয়ে ওঠার ক্রমবিবর্তনটি।
উপন্যাস এমন এক অপ্রতিরোধ্য শিল্পাঙ্গিক হয়ে উঠছে যে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে বারবার নিজেকে নবায়ন করে নিয়েছে। যদিও সতেরো শতকে উৎপত্তি, আঠারো শতকে এর বিকাশ এবং উনিশ শতকে এর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটে, কিন্তু কুড়ি শতকের দুইয়ের দশকে উপন্যাস তা প্রচল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এর পেছনে জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মানের ভূমিকা ছিল। তবে এ ভূমিকা আরো পরে অনুভূত হয়েছে। কেবল ইউরোপীয় উপন্যাসের দিকে তাকালেই চলে না- উপন্যাসের যে বিশ্ব-ঐতিহ্য সেদিকে তাকালে আমেরিকান, লাতিন আমেরিকান, আফ্রিকান উপন্যাসের দিকগুলো খেয়াল করতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সত্যিকারের এশিয় উপন্যাসের কোনো শক্তিশালী ধারা এখনো তৈরি হয়নি। তারপরও আরবি, চীনা এবং ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলের উপন্যাসের বিচিত্র প্রয়াস চোখে পড়ার মতো। একমাত্র জাপানী উপন্যাস ছাড়া এশিয় আর কোনো দেশের উপন্যাস ইউরোপীয় উপন্যাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। এখন যদি বলা হয় এশীয়ার ভেতরে জাপানেই শিল্প-প্রযুক্তির বিকাশ অপেক্ষাকৃত প্রবল বলে সেখানে উপন্যাসের আদলটা এতো স্পষ্ট, তাহলে বলতে হয় আফ্রিকায় উগান্ডা, কেনিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও নাইজেরিয়া থেকে আসা উপন্যাসের-স্রোত কমবেশি পরিচিতি লাভ করেছে তা সেখানের পুঁজিবাদী বা শিল্পনির্ভর সমাজ বিকাশ কি বিনাশের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এর মূলে আছে কিছু ব্যক্তির ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্থান, শিক্ষা লাভের ব্যাপার স্যাপার। এমনকি লাতিন আমেরিকায় সাহিত্যের যে ‘বুম’ তার পেছনেও বিভিন্ন লেখকের ইউরোপে গমন ও ফিরে আসার পর নিজের দেশের রাজনীতি, সমাজবাস্তবতা ও লোকাচার ও ইউরোপীয় নন্দনের সংমিশ্রণেই একে পরিণতি দিয়েছে বলে মনে হয়।
এ সময়ের উপন্যাসের সবচেয়ে আধুনিক ব্যাখ্যাকার মিলান কুণ্ডেরা উপন্যাসকে দেখতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় ইউরোপের উপন্যাসের বিবর্তনকে সামনে রেখে। তাঁর মতে, উপন্যাস বর্তমানে যে স্তরে এসে পৌঁছেছে তাতে মানব-অস্তিত্বকে তুলে ধরাই এর মুখ্যকাজ। আগে উপন্যাসে ইতিহাস, রাজনীতি ও দর্শনের যে ছায়া প্রবলভাবে এর পটভূমিকে রঞ্জিত করে রাখতো, সেখানে মানবের অস্তিত্বের বয়ানই কুণ্ডেরার মতে আধুনিক উপন্যাসের প্রধানতম রঞ্জক। উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠক এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান লাভ করেন, যা কেবল উপন্যাসের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। তা দর্শন-ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান নয়। বলা যায় জীবনের মতোই এর পুরোটা বোধ করি তাঁদের কেউ-ই দেখিয়ে দিতে পারেনি। পাঠকের উপন্যাসের পথে চলার জন্য কিছুই বই বিশেষ সহায়তা করতে পারে। এর ভেতরে হেনরি জেমসের ‘দ্য হাউস অব ফিকশন’, ই. এম. ফরস্টারের ‘আসপেক্টস অব দ্য নভেল’, র্যালফ ফক্সের ‘দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল’, গেয়র্গি লুকাচের ‘দ্য থিওরী অব দ্য নভেল’, মিখালই বাখতিনের নানান রচনা উপন্যাস নামের শিল্পাঙ্গিকটার ওপর বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলেছে। এবং বলা যায় জীবনের মতোই এর পুরোটা বোধ করি তাঁদের কেউ-ই দেখিয়ে দিতে পারেনি। এছাড়াও উপন্যাস-পাঠকেরা পড়তে পারেন দেশ-বিদেশের আরো অনেক লেখক-সমালোচাকের উপন্যাস ও উপন্যাসতত্ত্ব-বিষয়ক লেখা।
বাংলাভাষায় উপন্যাসের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা খুব একটা পাওয়া যাবে না। তার বদলে কালকেন্দ্রিক ও কালানুক্রমিক লেখক ও তাঁদের গ্রন্থ নিয়ে অবশ্য অনেক বই-ই পাওয়া যায়। এর শীর্ষে নিঃসন্দেহে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’ বইটি। এতে মূলত বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসটি সুবিন্যস্ত হয়েছে। কিন্তু উপন্যাস কী? কীভাবে? কেন? এমনি দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা উপন্যাস নিয়ে বিচ্ছিন্ন আলোচনা হলেও আস্ত একটা ‘আঁকরগ্রন্থ’ ধরনের কোনো বাংলা বই বোধ করি এখনো লেখা হয়নি। তারপরও অমিয়ভূষণ মজুমদার, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক, সুবিমল মিশ্র, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বেশ কিছু প্রবন্ধ উপন্যাস-পাঠককে উপন্যাসের স্বরূপ চিনিয়ে দিতে সহায়তা করতে পারে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।
0 মন্তব্যসমূহ