রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ উপস্থাপনা করছেন ১৯৮৩ সাল থেকে। একই সাথে অধ্যাপনা করছেন সাভার কলেজে। ছাত্র জীবনে যুক্ত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নে । খুলনা নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক জান্তা এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ও সংগঠক। ছাত্র জীবন শেষে যুক্ত হন সাংবাদিকতায় এবং একই সাথে যুক্ত হন উদীচীর সাথে। উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাটি ও মানুষের উপস্খাপক হিসেবে গত ৩২ বছর ধরে কৃষকদের সাথে কাজ করছেন। সফল কৃষকদের সামনে আনা, কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং কৃষকের অধিকার রক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
সাধারণ মানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ একজন মানুষ হিসেবে তার সাথে ১৬ মার্চ ২০১৪—২৮ এপ্রিল ২০১৪ ফেসবুকের আড্ডাঘরে লিখে লিখে দেশভাগ নিয়ে আলোচনা হয়।।এখানে তার মতামত ও উপলব্ধি তুলে ধরা হয়েছে।
কুলদা রায় : হিন্দুদের ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া দেখেন?
কুলদা রায় : এই যে হিন্দুদের যে অংশটি রয়েছে ১৯৪৭ সালের পরে বাংলাদেশে ভূখণ্ডে, এরা অধিকাংশই নিন্ম বর্গের নিম্ন বর্ণের হিন্দু। তারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে থাকতে চেয়েছিল। তাদের নেতা যোগেন মণ্ডল বলেছিলেন বর্ণহিন্দুদের দ্বারা মুসলমানরা যেমন নিপীড়িত নিন্মবর্ণের হিন্দুরাও নিপীড়িত। তাদের দু তরফের আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। ভারতের সঙ্গে থেকে গেলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ফলে যোগেন মণ্ডল পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন। জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন—পাকিস্তানে এই হিন্দুদেরকে মুসলমান্দেরকেও সম মর্যাদায় দেখা হবে। দেবেশ রায়ের উপন্যাস বরিশালের যোগেন মণ্ডল বইটিতে এটা আছে। যোগেন মণ্ডল যে পদত্যাগ পত্র দিয়েছিলেন আইন মন্ত্রীত্ব থেকে—সেখানেও এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই দাঙ্গা, হাঙ্গামা, নিপীড়ন নির্যাতন ও গণহত্যার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়।
কুলদা রায় : মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে গুড বাই জানিয়ে দিয়েছে বাঙালীরা। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছে। কিন্তু তবুও এই ২০১৪ সাল পর্যন্ত নানা সময়েই দেখতে পাই--দেশভাগেরর রাজনীতির মধ্যে যে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছিল--সেটা শেষ হয়ে যায়নি। বরং নানা কায়দায় সেই দেশত্যাগের ঘটনাটি নীরবে-সরবে ঘটে চলেছে। এর কারণ কি মনে করেন?
সাধারণ মানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ একজন মানুষ হিসেবে তার সাথে ১৬ মার্চ ২০১৪—২৮ এপ্রিল ২০১৪ ফেসবুকের আড্ডাঘরে লিখে লিখে দেশভাগ নিয়ে আলোচনা হয়।।এখানে তার মতামত ও উপলব্ধি তুলে ধরা হয়েছে।
---------------------------------------------------------------------------------------
কুলদা রায় : . দেশভাগ শব্দটি আপনি
কখন, কিভাবে, কোন প্রসঙ্গে প্রথম
শুনতে পেয়েছিলেন?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : ১৯৭৬ /৭৭ সালে আমি যখন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হই, তখনই এ বিষয়টি আমি বুঝি। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক ক্লাসে- সম্ভবত রতন
সেন, কামরুল সিদ্দিকী, ফিরোজ আহমেদ,
মাণিক সাহা- এরা বোঝাতেন, বাংলাদেশকে বিভক্ত করার ইতিহাস তখনই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী
থেকে শুনি। এর আগে শুনলেও সেটার কোনো অর্থ আমার কাছে ছিল না। ছাত্র রাজনীতিতে এসেই
এ বিষয়ে জানতে পারি।
কুলদা রায় : . পারিবারিভাবে কি দেশভাগ
নিয়ে কোনো কথা শুনেছেন কখনো? শুনলে কি ধরনের ছিল সেই আলাপগুলো?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : আমার দাদা মানে পিতামহ বৃটিশ সরকারের
অধীনে চাকরি করতেন, সে হিসেবে ভারতে যাওয়া আসা ছিল। পরিবোরে কারো কারো
মাঝে মুসলিম লীগের প্রভাবও ছিল। আবার কংগ্রেসও করতেন কেউ কেউ। দেশভাগ নিয়ে কারো প্রকট
সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি টের পাই নাই। তবে তারা স্মৃতি নিয়ে থাকতেন, কলিকাতায় কি
হলো না হলো- পুজো পার্বন এই
বিষয়গুলো
থাকতো আলোচনায়। পারিবারিকভাবে আমাদের সাথে
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে এক চমৎকার সম্পর্ক ছিল। এখনো আছে। এমনকি চরম রক্ষণশীলতার
যুগেও পারিবারিক নিমন্ত্রণ প্রথা চালু ছিল
যা এখনো বর্তমান।এখনো যে কোনো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ
প্রথা চালু আছে।
কুলদা রায় : দেশভাগের ফলে
পশ্চিম বঙ্গ থেকে চলে আসা কোনো মুসলমান পরিবার বা পুর্ব বঙ্গ থেকে পশ্চিম বঙ্গে
চলে যাওয়া কোনো পরিবারের লোকজনকে কি পেয়েছেন আপনার কাছাকাছি? তারা এই
দেশভাগ, বা দেশভাগ জনিত আনন্দ বা বেদনার কথা কি কিছু
জানতে পেরেছেন কখনো? যদি জানার সুযোগ ঘটে সেগুলোর একটু বর্ণনা দিন।
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : কোলকাতায় বসবাসরত অনেক বাঙালীর সাথে কথা হয়েছে।
যারা আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। এই দেশ ছেড়ে গেলেও এখনো তারা দেশটাকে আপন মনে করেন।
সংকটে খোঁজ নেন, আনন্দে উচ্ছসিত হন।
বিভিন্ন সময়ে কোলকাতায় গিয়েছি-- প্রবীণ মানুষেরা যারা এই এলাকার
অধিবাসী ছিলেন, তারা অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন এই বাংলার কাউকে পেলে।
বাংলাদেশ থেকে চলে গেছেন অতি সম্প্রতি মানে ৯০ এর পর, এমন অনেককে
চিনি যারা সেখানেও ভাল নেই- কিন্তু এখানে থাকতে নিরাপদ বোধ করেন নি।
দেশভাগের যন্ত্রনা তো হৃদয়ভাগের মতোই। তবে দেশভাগের
কারণে যারা মাইগ্রেট করেছেন তাদের মধ্যে অন্য ধর্মের
প্রতি
সহনশীলতা কম, হয়তোবা ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা
নিগৃহীত হয়েছেন বলেই এমন হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা এই
অঞ্চলে এসেছেন তাদের অনেকের মধ্যে দেশভাগের বিষয়ে যন্ত্রণাও আছে। আবার কেউ কেউ
সাম্প্রদায়িক কারণে সেখানে স্বচ্ছন্দ বোধ করেননি এমনও মনে হয়েছে।
ওখান থেকে মুসলিমরা এখানে এসে ঘটি, ওখানে
হিন্দুরা বাঙাল হয়ে বেচে আছেন- দুই পক্ষই না ঘরকা- না
ঘাটকা।
কুলদা রায় : অর্থাৎ তারা একটু সাম্প্রদায়িক হয়ে আছেন?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : অনেক
ক্ষেত্রেই। সবার ক্ষেত্রে বলা যাবে না। তবে যারা কিছুটা
নিগৃহীত হয়েছেন, বা যে সব পরিবারে ধর্মীয়
উগ্রতা ছিল সেখানে সাম্প্রদায়িক হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কুলদা রায় : যারা ১৯৪৭ সালের দিকে দেশ ত্যাগ করেছেন তারা কী ধরনের
কথা বলেন? তাদের স্মৃতিচারণ কী ধরনের হয়? তারা কি কি মিস
করেন?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : ধর্মীয় সাম্প্রায়িকতায় তারা দেশ ছেড়েছেন- কিন্তু
আঞ্চলিকতার কারণে কষ্টে থাকেন। ১৯৪৭ এর দেশত্যাগীদের মাঝে
নস্টালজিয়া কাজ করে। অনেকে ভিটে দেখতে চান, নিজের জীবন, ছেলেবেলা- বাবা দাদার কাছ থেকে শোনা গল্প এবং তার উপকরণের
স্বাদ নিতে চান।
কোলকাতায় এক প্রবীন ডাক্তার খুটিয়ে
খুটিয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন স্টেশনগুলো কথা-- রাজশাহীর ঘোড়ার গাড়ীর পাবনার বণমালী ইনস্টিটিউট
এর
কথা। প্রকৃতি, নদী, জীবন এই সব
কথা। স্কুল জীবন, বিভিন্ন জনের সাথে বন্ধুত্ব এই সব স্মৃতি তাদের তাঁড়িয়ে বেড়ায়।
কুলদা রায় : সে সময়ের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কেমন
ছিল--হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে কী বলেন?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : সাধারণের সম্পর্ক ভালই ছিল। যেটুকু দ্বন্দ্ব ছিল
সেটা ক্ষমতার, কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক।
কুলদা রায় : সেটা কি ওরা বলেন এখনো?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : আসলে
সবাই যে ক্ষমতাসীনদের দাবার ঘূটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সেটা অনেকেই বোঝেন। তবে-
খুব সাধারণ মানুষ যারা ( যাদের মধ্যে শিক্ষা ও রাজনীতি বোধ
কম) তারা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাই প্রধান বলে মনে করেন। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা, সম্পদের
নিরাপত্তা, এগুলো তো ছিলই।
কুলদা রায় : মুসলমান প্রতিবেশিদের বিষয়ে কোনো স্মৃতিচারণ করেন না? শুধু কি
ভিটে মাটি গাছপালা নিয়েই হাহাকার করেন?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : খুব
একটা শুনি না। তার প্রধান কারণ হয়তো বা মুসলিমদের কোনো অপকর্ম-এর বিষয়টি বলতে গিয়ে
আমাকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছেন কিনা সেটা হয়তো চিন্তা করেন। আমরা যতই বলি না কেন-
সময়ের সুযোগ যে কেউ নেয়নি তা তো নয়। তাছাড়া প্রাথমিকভাবে যারা দেশ ছেড়ে গেছেন তারা অধিকাংশেই
উচ্চ বর্ণের হিন্দু। ব্যবসায়ী ও অভিজাত
শ্রেনী। মুসলমানদের উপরও তাদের প্রভাব ছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুসলমানরা
যখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন কেউ কেউ তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। অতএব প্রতিবেশিদের
সাথে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক অনেকেরই ভাল ছিল না।
কারো কারো জমি যেমন খোয়া গেছে- মুসলিম প্রতিবেশীদের কাছে- তেমনি
কেউ কেউ আবার কে জমি ৪/৫ জনের কাছে লিখে দিয়ে গেছে এমন উদাহরণও আছে।
কুলদা রায় : তারা এই সাম্প্রদায়িকতা বা দেশভাগের কারণ কি বলে মনে
করেন? দেশভাগের ফলে মুসলমান
সম্প্রদায় কি উপকৃত হয়েছেন?।
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : দেশভাগে
এই প্রধান কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বলেই মনে করা হয়। এর সাথে ধর্মীয় বিষয় যুক্ত হয়ে সেটাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই
মূখ্য বলে ধরা হয়। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক মনোজগতটাই প্রাধান্য পেয়েছে।
দেশ পরিচালনায়- সক্ষমতা অর্জনে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে ছিল।
অতএব তারা নিজেদের জন্য একটা স্পেস চেয়েছিল। তাছাড়া বৃহত্তর ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু থাকার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের
হীনমণ্যতা তৈরি হতেই পারে। সেখান থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র আকাঙ্খা কাজ করেছে।
সাম্প্রদায়িকতা বা দেশভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আহাজারি কিছুটা
আছে। তবে চরম অসন্তুষ্টিটাও দেখি না।
আমার আত্মীয়-স্বজনরা খুব সক্রিয়
রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। আবার প্রগতি বা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানো তাদের ছিল না। তবে
স্মৃতি মন্থন করতেন। সেখানেও আহাজারি শুনিনি। এক
ধরনের মেনে নেওয়ার প্রবণতা কাজ করেছে।
দেশভাগের ফলে এই অঞ্চলের মুসলমানরা ব্যবসায় বাণিজ্যে এক ধরনের
সক্ষমতা অর্জন করে। চাকুরি বাকরিতেও এগিয়ে যায়। কেউ কেউ সম্পদ দখল করে বিত্ত
বৈভবের মালিক হয়।
কুলদা রায় : আপনি কি মনে করেন দেশভাগ না হয়ে অবিভক্ত বাংলা থাকলে মুসলমান জনগোষ্ঠীর এই
উন্নয়নটা ঘটতো না?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : থিউরি অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই
টিকে থাকে। আর বটবৃক্ষের নিচে কি পৃথক কোনো গাছ জন্ম নেয়? দেশভাগ হওয়াতে মুসলিমরা একটা ফাঁকা মাঠ পেয়েছে। অতএব গোল করতে সুবিধা
হয়েছে। তবে দেশভাগ না হলে কি মুসলিমরা এগোতো না? অবশ্যই
এগোতো। তবে এভারেট হ্যাগেনের তত্ত্ব অনুযায়ী তার
জন্য ২/৩
প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হতো।
দেশ ভাগ আমরা চাই বা না চাই এর মাধ্যমে কারো কারো যেমন ক্ষতি
হয়েছে, তেমনি কারো কারো কপালও ফিরেছে। তাছাড়া যেটি হয়েছে সে টি না হলে কি হতো সেটা
বলা মুস্কিল। বরং যেটা হয়েছে সেটার প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা সহজ।
কুলদা রায় : দেশভাগের ফলে মানুষ ভাগ হয়ে গেল। তারা মানুষের চেয়ে
হিন্দু-মুসলমান হয়ে দাঁড়াল। একদল দেশত্যাগের ফলে নিঃস্ব হয়ে গেল। যারা
ভারতে চলে গিয়েছিল তারা কী ধরনের জীবন-যাপনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে আপনার
ধারণা কী?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : এটাতো ঠিক নিজ বাসভূমি ছেড়ে যাওয়ার পর মানুষের
জীবন হতাশায় ডুবে থাকে। একে তো নিজের সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব
ব্যক্তিতে
পরিণত হওয়া, অপর দিকে নুতন জায়গায় মূল স্রোতের সাথে নানা দ্বান্দিক অবস্থান জীবনকে
আরো কঠিন করে তোলে। পাকিস্তানে মুসলিমরা যত সহজে নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছিল-
ভারতে হিন্দু ততটা অনুকূল পরিবেশ পায় নি। বরং উঠতে বসতে নানা
কথা শুনতে হয়েছে। যে কারণে পশ্চিম বঙ্গে বসবাসরত পূর্ব বঙ্গের মানুষের কাছে
বাংলাদেশটা এখনো পরদেশ বলে মনে হয় না।
পশ্চিম বঙ্গে বসবাসরত পূর্ব বঙ্গের মানুষকে কঠোর সংগ্রামের মধ্য
দিয়ে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে হয়েছে। তাছাড়া এখনো অনেক স্থানে সেই বাঙাল গালি শুনতে
হয়। অন্তত আমার বন্ধুরা তাই মনে করেন। এ কারণে যারা পশ্চিমবঙ্গে জন্ম লাভ
করেছে তারাও এই পূর্ব বঙ্গে তাদের পুর্বপুরুষের ভূমিকে তীর্থ বলে
মনে করে।
কুলদা রায় : দেশভাগের কারণে ১৯৪৭ পরবর্তী প্রভাবগুলি কি কি ছিল?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : দেশভাগের পরবর্তী প্রভাব খুব সুখকর নয়। যারা ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল
তারাও যেমন ভাল ছিলেন না, তেমনি বাংলাদেশে যারা থেকে গেলেন ক্রমেই তারা পরিণত হলেন দুর্বল
শক্তিতে।
এক ধরনের হতাশায় নিমজ্জিত থাকলেন। আবার ভারত থেকে চলে
আসা একদল চরম হিন্দু বিদ্বেষীদের কারণে বাংলাদেশের
মাঝেও সাম্প্রদায়িকতা জন্মাতে থাকে।
আমার ছোটবেলায় যাদের দেখেছি- কিছু সম্পন্ন মানুষ এলাকা ছেড়েছে-
দেশ ছেড়েছ।পড়ে আছে কেবল দরিদ্র ও ওখানে যাওয়ার
সাহস না পাওয়া কতক মানুষ। কিন্ত এখনো তাদের বার বার মালাউন শব্দ শুনতে হয় এবং
ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের
মধ্য থেকে ঘটে।
বিএনপি মনে করে - এরা কেনো দিন তাদের ভোট দেবে না। আওয়ামী লীগ
মনে- এরা যাবে কই? তাই বিশেষ কিছু
করার দরকার নেই। এরা থাকবেই। আসলে কেউ দায়িত্ব পালন করে না।
কুলদা রায় : সাধারণ হিন্দু
মুসলমানের মধ্যে এর প্রভাব কী ধরনের হয়েছে?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে
সৃষ্ট পাকিস্তানকে গুডবাই জানানো হয়েছে।
আমি যতটা দেখেছি প্রগতিশীল আন্দোলনগুলোতে হিন্দু মুসলমান এক সাথে কাজ করেছে। প্রগতিশীল কমিউনিস্টরা
সব সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের জন্য কৌশলগত জায়গা বন্টন করেছে। নেতৃত্বে স্থান দিয়েছে। সাধারণ হিন্দু সমাজ
স্বাধীকার আন্দোলনে সমর্থন যুগিয়েছে- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবেঃ পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনটিকে
তারা তাদের অস্তিত্বে অবস্থান থেকেই বিবেচনা করতো। সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে
এ নিয়ে অতটা সক্রিয়তা ছিলনা যতটা হিন্দুদের মাঝে ছিল। যে কারণে পাকিস্তান
সবসময় এই ঘটনাকে হিন্দুদের আন্দোলন ও উস্কানি বলে অভিযোগ করতে পেরেছে।
রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে হিন্দু সাধারণ মানুষ
তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় ছিল। আর তাদের অবস্থান ছিল প্রগতিশীলদের
পক্ষে। সাধারণ মুসলমানরা প্রথমে মুসলিম লীগের প্রভাবে থাকলেও ভাষা আন্দোলন
সহ অন্যান্য আন্দোলনের কারণে সমর্থন মুসলিম
লীগের বিরুদ্ধে যায়। ন্যাপ কমিউনিস্ট দের পক্ষে সমর্থন এলেও মূল সমর্থন চলে যায়
আওয়ামী লীগের পক্ষে।
মুসলিম লীগের একটি অংশ আওয়ামী লীগে চলে আসে- যে কারণে তাদের
মধ্যে হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাব ছিল।
রাজনৈতিক কারণে প্রকট না হলে সুপ্ত এই বিদ্বেষ পারতপক্ষে সাম্পদায়িকতাকে
লালন করেছে।
কুলদা রায় : এই হিন্দু বিদ্বেষ কি এখনো আছে? থাকলে সেটা বেড়েছে, না,
কমেছে?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : আমার ধারণা এখনো আছে। আমার কলেজে হিন্দু
হওয়ার কারণে যাদের চাকরি হয় নাই, তারা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ পেয়েছে- তবে সেটা আওয়ামী
লীগের আমলে পেয়েছে। হিন্দু বিদ্বেষ প্রকাশ পায় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। সুপ্ত না থাকলে তা
প্রকাশ পাওয়ার প্রশ্ন আসতো না। তবে এখন ভদ্রতার মুখোশ থাকার কারণে প্রকাশ
হয় টেকনিকালি। বেড়েছে কিনা তা বলতে পারবো না তবে আছে - এবং মধ্যবিত্ত
এবং উচ্চবিত্ত সকল ক্ষেত্রেই আছে।
কুলদা রায় : দেশভাগের জন্য
হিন্দু সম্প্রদায় কতটা দায়ী?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : দেশভাগের জন্য সাধারণ হিন্দু বা মুসলমান কাউকে দায়ি করা যাবে
না। যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছিল তারাই দাযী। তবে এক্ষেত্রে মুসলমানদের
মধ্যেই দেশ ভাগ করার আকাঙ্খা বেশি ছিল। সম্ভবত হিন্দু আধিপত্য থেকে নিজেদের জন্য
একটি
স্পেস তৈরির জন্য।
তাছাড়া কিছু আগেই মুসলিম শাসন ছিল ভা্রতে, সেখানে বৃটিশ
আসার পর মুসলমানদের আধিপত্য খর্ব হয়- কারণ মুসলমানরা লেখা
পড়ায় পিছিয়ে ছিল। আবার মুসলমানরা এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটেও ছিল। অতএব তাদের পৃথক রাষ্ট্র
দরকার ছিল বলে তারা মনে করে। এটা যৌক্তিক কিনা জানিনা। তবে এ কারণে মুসলমানরা দেশভাগকে থামানোর চেষ্টা করেনি- বরং বেনিফিট
পাবে মনে করে চুপ করে ছিল।
কুলদা রায় : দেশভাগ নিয়ে চলচ্চিত্র
নির্মাণ করেছেন ঋত্বিক ঘটক। তাঁর মুভি যখন আপনি দেখেন, আপনার পরিবারের লোকজন দেখেন বা দেখেছেন,
বা অন্য বন্ধুবান্ধবেরা দেখেন--তখন তাদের
কী ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন আপনি?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা : এটা তো আসলে ব্যক্তির গড়ে ওঠা বা বেড়ে ওঠার উপর নির্ভরশীল। যাদের মাঝে দেশভাগের
বিষয়টি কেবল মুসলিম হিসেবে একটি দেশ পাওয়া বা সেই রকম বিষয়- তারা তো একরকম
ভাবে দেখবেন। তবে সচেতন রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া আর কেউ বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো
প্রতিক্রিয়া দেখায় না। একদল দেশভাগের বিপক্ষে অবস্থান
নেয, একদল পক্ষে। তবে অধিকাংশ মানেুষের প্রতিক্রিয়াটি
সক্রিয় নয়, যখন যারা পাওয়ারে থেকেছে তাদের প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে অধিকাংশ মানুষ
কুলদা রায় : আপনি মাটি মানুষ
অনুষ্ঠান নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়ান। গ্রামের মানুষের সঙ্গে আপনার দেখা-সাক্ষাৎ হয়। ভাব বিনিময় হয়। তারা এই দেশভাগটিকে
এখনো কিভাবে দেখেন বলে মনে হয় আপনার?
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা :মনোজগতটা সাম্প্রদায়িক হয়েই আছে। ক্ষেত্রবিশেষে সেটা
বেড়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানরা এখন দেশভাগ নিয়ে তেমন কিছু ভাবে বলে আমার মনে
হয় না।
কুলদা রায় : হিন্দুদের ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া দেখেন?
রেজাউল করিম সিদ্দিক
রানা :হিন্দুদের মধ্যে দু ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে। প্রথমত: তাদের মাঝে
সবসময় একটা শঙ্কা কাজ করে। কারণ দেশটাকে কখন জানি ছেড়ে যেতে হয়। তাছাড়া একধরনের
গুটিসুটি হয়ে থাকার প্রবণতা কাজ করে। আবার অনেকেই কখন এখান
থেকে চলে যাওয়া যায় সে সময়টি খোঁজে।
আমার মনে হয় নিজের শক্তি দিয়ে এই প্রতিকুল অবস্থাকে তারা
মোকাবেলা করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে সেটা সম্ভবও না। এক ধরনের নিজেকে আড়াল
করে রাখার মনোবৃত্তি কাজ করে।
আবার কেউ কেউ নিজেকে প্রকাশ করেন দৃঢ়ভাবে।
কিন্তু তার সংখ্যা খুবই কম।
রেজাউল করিম সিদ্দিক
রানা : আসলে মুসলিম লীগ তো কথা রাখেনি। খুলনার হিন্দুরাও মুসলিম লীগের নেতা সবুর খানের
অুনরাগী ছিল। কিন্তু সবুর খান তাদের সম্পদ নামমাত্র দামে কিনে নিয়েছে। ১/২ টাকায় বাড়ী জমি বেচা কেনা হয়েছে
খুলনাতে। মুসলিম লীগের লোকজন বড় লোক হয়েছে
হিন্দুদের সম্পত্তি গ্রাস করে। যখন আওয়ামী রাজনীতির বিকাশ ঘটে- তখন এ কারণে মুসলিম লীগের বদলে হিন্দুরা আওয়ামী এবং কমিউনিস্টদের উপর আস্থা রেখেছে। কিন্তু আওয়ামী
লীগের অনেক নেতাও মুসলিম লীগের নেতাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। এটাই বাস্তব।
রেজাউল করিম সিদ্দিক
রানা : মনোজগতের সাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তান চলে
গেছে । কিন্তু দেশভাগে সময়ে উত্থিত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প রয়ে গেছে। কথা আছে সুস্বাস্থ্য
সংক্রামক নয়--
রোগ সংক্রামক। অতএব রোগটা আছেই--কখনো বেড়েছে কখনো থেমেছে। কিন্তু কখনোই লীন হয়ে
যায় নি। আবার ভারতে বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা,
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণেও এখানে বিষটা ক্রিয়াশীল থেকেছে। ধর্মটা থেকে গেছে
রাজনীতির উপাদান হিসে্বে।
তাছাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তি মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, এগুলোকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র
হিসেবে প্রচার করেছে। ফারাক্কা, তিস্তার মতো ঘটনা, সীমান্তে হত্যাকান্ড এসব কারণেও
মানুষ ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছে। আর এই ভারত বিরোধীতা প্রকারান্তরে ধর্মীয়
দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ককে দুই দেশই রাজনৈতিক,
দ্বিপাক্ষিক, অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। এটি
ব্যাখ্যা করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। এ কারণে ১৯৪৭ থেকে ২০১৪
পর্যন্ত একই রকম ভাবে সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
1 মন্তব্যসমূহ
১৯৪৭ এর দেশভাগ, কি হলো? ১৯৪৮ এ পূব আকাশের স্বপ্ন ভঙ্গ। এক ধাক্কায় ১৯৪১ এর ৩০ হয়ে গেল ২২। দাঙ্গা, রক্তপাত ওসব কথা থাক। ১৯৬৫ তে হয়ে গেরাম শত্রু। ১৯৭১ এ নতুন দেশের জন্ম হলো, বাংলাদেশ, আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালবাসি ....! কি পেলাম, হাঁ দিতে হয়ত চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকেই তো থাকতে দিল না। তিনি শুধু পরিবর্তন করে দিয়ে গেলেন ষ্ট্যাটাস, শত্রু থেকে ‘অর্পিত’। কিন্তু কার হাতে অর্পিত???
উত্তরমুছুন