নিহারুল ইসলাম দেশভাগ দেখেননি। তাঁর আব্বা-আম্মা দেশভাগ দেখেছেন।
নীহারুল ইসলামের সঙ্গে ফেসবুকে আড্ডা-ঘরে দেশভাগ নিয়ে কথা শুরু হয় ১৫ মার্চ, ২০১৪।
নীহার থাকেন মুর্শিদাবাদের লালগোলায় নামের একটি ছোটো শহরে। একটি স্কুলের শিক্ষকতা করেন। পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসের বই প্রকাশিত হয়েছে।
নীহার থাকেন মুর্শিদাবাদের লালগোলায় নামের একটি ছোটো শহরে। একটি স্কুলের শিক্ষকতা করেন। পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসের বই প্রকাশিত হয়েছে।
নীহারুলের পরিবার দেশভাগের সময় দেশত্যাগ করেননি। তবে ১৯৬০ সালে তাঁর বাবা সে সময়ে ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু মন টানেনি দেশত্যাগ করতে। ফিরে গেছেন করে মুর্শিদাবা্দে। লাল্গোলা নামের ছোটো শহরেই থেকে গেছেন।
নীহারুল ইসলামের গল্পে মুসলমান জনগোষ্ঠীর আখ্যান ও ভাষা সহজ সুন্দর করে প্রাণ পায়।
দেশভাগ নিয়ে ফেসবুকের আড্ডা-ঘরে এরপর এই লেখালেখি চলে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এর মধ্যে নীহারুল মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেজন্য এই আলোচনাটা এইখানেই শেষ করতে হয়।
--কুলদা রায়
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
কুলদা রায় : . দেশভাগ শব্দটি আপনি কখন, কিভাবে,
কোন প্রসঙ্গে প্রথম শুনতে পেয়েছিলেন?
নীহারুল ইসলাম : ১৯৭১ সাল আমার ৪ বছর বয়স। মামার বাড়িতে থাকি। স্পষ্ট
মনে আছে। একদিন কন্টলনানার বাড়ির দরজায় জোতকমলের কুড়ানমিস্ত্রী গরুরগাড়ির চাকা
বাঁধছেন। কন্টলনানা পাশেই নিমগাছের ছায়ায় শুয়ে আছেন ইজি-চেয়ারে। কোথায় মাটি
কাঁপানো দুমদাম আওয়াজ হচ্ছে। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। কন্টলনানা জিজ্ঞেস করেন, কুড়ান কীসের আওয়াজ রে! কুড়ানমিস্ত্রী বলেন,
জয়বাংলার যুদ্ধ। শেষপর্যন্ত যুদ্ধ লাগল তাহলে! এই স্মৃতির ৮ বছর
পর ১৯৭৯ সাল। নিজের বাড়িতে সদ্য এসেছি। লালগোলা এম এন একাডেমীতে সপ্তম শ্রেণীতে
ভর্তি হয়েছি। আব্বার সঙ্গে পদ্মাপাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ইলিশ কিনতে। পদ্মার অপর
পাড়ে আর একটি দেশ দেখেছিলাম। ঠিক যেন আমার দেশ। আকাশ, গাছপালা,
মেঘের মতো গ্রাম সব আমার চেনা। অথচ দেশটা আমার দেশ নয়। বিএসএফ
রাইফেল ঘাড়ে টহল মারছে। যাতে আমি পদ্মা হেলে পদ্মার অপর পাড়ের দেশে চলে না যায়।
অথচ মাছ ধরা ডিঙি ঘুরে বেড়াচ্ছে পদ্মার জলে। ডিঙি গুলি দু’রকম পতাকায় বিভক্ত। ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হয়নি।
আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়েই আব্বা শুনিয়েছিলেন দেশভাগের ইতিহাস।
সেই প্রথম 'দেশভাগ' শব্দটি আমি শুনেছিলাম।
কুলদা রায় . আব্বার কাছে দেশভাগ বিষয়ে কি শুনেছিলেন সেটা একটু বিস্তারিত
বলুন?
নীহারুল ইসলাম : ৬০-এর দশকের
প্রথম পর্বে আব্বা পূর্ব পাকিস্তান গিয়েছিলেন। ১৯ দিন ঢাকায় ছিলেন আমাদের বাড়িতে
থেকে পড়াশুনো করা একজনের আশ্রয়ে। তিনি তখন পাকিস্তান সরকারের আমলা। আব্বার ইচ্ছা
ছিল ঢাকায় থেকে যাওয়ার। কিন্তু ওই ভদ্রলোকের মানসিকতার সঙ্গে আব্বার মানসিকতা না
মেলায়, আব্বা ফিরে আসেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি আমাদের পূর্ব পুরুষরা কিন্তু বাঙালি ছিলেন
না। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এখনও হিন্দি ভাষার চল আছে। অথচ ওই ভদ্রলোক বাঙালি হয়েও
দেশভাগের সমর্থক হয়ে বড় আমলা হয়েছিলেন। আব্বা সেটা মানতে পারেননি। তাই চলে
এসেছিলেন। রিফিউজি হয়ে বাঁচা যে কত অপমানের আব্বা অনুধাবন করেছিলেন কিভাবে, সেই সব
কথা সেদিনের পর আরো অনেকবার শুনেছি। সেখান থেকেই দেশভাগ সম্পর্কে আমার ধারণা,
যন্ত্রণা...
কুলদা রায় : . আপনার আব্বা কেনো পাকিস্তানে যেতে চেয়েছিলেন? আপনার
পরিবার কেনো পশ্চিম বঙ্গ ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন--সেই কারণটি বলুন?
নীহারুল ইসলাম : আমার ঠাকুরদা
এলাকায় পন্ডিত নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি আব্বার বিয়ে দিয়েছিলেন তার জিগরি দোস্ত
দানেশ রহমান নামে এলাকার আর এক একজন খ্যাতিমান মানুষের মেয়ের সঙ্গে। সে বিয়ে সুখের
হয়নি। আব্বা আবার বিয়ে করেছিলেন। সেটা আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা মেনে নিতে পারেননি।
আব্বাকে তাঁরা প্রায় ত্যাজ্য করে রেখেছিলেন। সেই দুঃখে আব্বা মাকে নিয়ে ঢাকায়
বসবাসের ভাবনা ভেবে পরিস্থিতি বুঝতে একা সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে
আব্বার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা ছিল খুব পীড়াদায়ক। আব্বা মেনে নিতে পারেননি। মাকে
সেখানে নিয়ে যাওয়ার বদলে ১৯ দিন পর নিজেই ফিরে এসেছিলেন। আব্বা যদি সেদিন দেশভাগ
পরবর্তী মানুষের অপমান মেনে নিয়ে মাকে নিয়ে গিয়ে বসবাস শুরু করতেন, হয়ত আমি
এবং আমার দুই ভাই ও দুই বোন জন্মগত ভাবে আজ বাংলাদেশের নাগরিক হতাম। ভাগ্যিস সেটা
হয়নি...
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো- আব্বা দ্বিতীয় স্ত্রী অর্থাৎ আমার
মায়ের সঙ্গে আব্বার প্রেম ছিল। সেটা বাড়িতে কেউ জানত না। এমনকি ঠাকুরদা যখন তাঁর
দোস্তের মেয়ের সঙ্গে আব্বার বিয়ে ঠিক করলেন। আব্বা তখনও কাউকে কিছু বললেন না।
বাধ্য ছেলের মতো বিয়ের পিড়িতে বসে পড়লেন। তারপর তিনবছর সেই দাম্পত্য চলেছিল। এক
পুত্র, এক কন্যার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু ওই যে বলে না, মন
আছে কচুর বনে, কী হবে সিংহাসনে? আব্বার
অবস্থাটাও ঠিক ওরকম, আব্বা সবার অজান্তে দ্বিতীয় বিয়ে করে
বসেছিলেন...
কুলদা রায় : দেশভাগের কারণ কি? এই কারণ কি যথার্থ?
নীহারুল ইসলাম : দেশভাগের কারণ নিয়ে
অনেক কচকচানি আছে। আমি ওসবের মধ্যে যেতে চাই না। খুব সাধারণ মানুষের
যে ভাবনা দেশভাগ সম্পর্কে আমার ভাবনাও তাই। দেশভাগের কারণ নেহরু-জিন্নার ক্ষমতার
লোভই মুখ্য। এবং ওই লোভকে কেন্দ্র করে আরও কিছু কারণ গবেষকরা বের করেন, সেগুলি গৌণ। বরং বলা যায় ওই দুই
বুদ্ধিমানের লোভকে কেদ্র করেই দেশভাগের মতো এক ভয়ংকর অভিশাপ কাল কাল ধরে আমাদের বয়ে
বেড়াতে হবে। থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই।
আমরা কথায় কথায় ইংরেজদের 'ভাগ ও শাসন'-এর কথা বলে পরিত্রাণ পেতে চাই। সেটাও একটা মস্ত ভুল। আসলে আমাদের নেহরু, আমাদের জিন্না
যতই পন্ডিত হোন না কেন, তাঁরা তাদের ক্ষমতার লোভে এমনই আচ্ছন্ন
ছিলেন যে দেশভাগের পরিণাম ভাবার ক্ষমতা তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন...
কিংবা পরিণাম নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। দুজন দুই রাষ্ট্রের
প্রধান হবেন- এই আনন্দে তাঁরা মশগুল ছিলেন...
কুলদা রায় : দেশভাগের কারণে কী কী ধরনের সমস্যা হয়েছিল?
নীহারুল ইসলাম : তখন আমি জন্মাইনি। আমার আব্বার বয়স ৫
বছর। আব্বার মুখেও তেমন কিছু শুনিনি। ঠাকুরদা (আমি বলতাম
দাদো), মামার বাড়িতে থাকার কারণে তাঁর সঙ্গে আমার সেরকম সখ্যতা
গড়ে ওঠেনি। কিংবা তাঁর অপছন্দের মেয়ে আমার মা বলে। যাইহোক, বিখ্যাত গণসংগীত
শিল্পী অজিত পাণডের মুখে শুনেছিলাম, একটি ঘটনার কথা,
সেটাই বলছি। মুর্শিদাবাদে মুসলিমদের বাস বেশী
বলে লালগোলার মুসলিমরা লালগোলা পাকিস্তান হয়ে গেছে বলে এম এন একাডেমীর মাঠে পাকিস্তানি
পতাকা উড়িয়েছিল। সেই পতাকা উড়েছিল ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত। তারপর ব্যাপারটা ঠিকঠাক
জানাজানি হলে এখানকার একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ধর্ম মিত্তির ( বিনয় কুমার
মিত্র) ও আরও কয়েকজন এসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ভারতীয় পতাকা
উড়িয়েছিলেন। অজিত পাণডে তখন ছোট, কিন্তু তিনি জাতীয় সংগীত গেয়েছিলেন সেই
পতাকা তলে দাঁড়িয়ে।
এই ঘটনার বাইরে লালগোলা বা মুর্শিদাবাদের আর কোনও ঘটনা আমার জানা
নেই। তবে সুযোগ সন্ধানীরা যেমন এপার থেকে ওপারে গেছিলেন, ওপার থেকে
এপারেও এসেছিলেন। এপ্রসঙ্গে একটা গল্প আমি জানি। গল্প বলছি এই কারণে
যে সেটা আমি চোখে দেখিনি। কানে শুনেছি। লালগোলার একজন বিখ্যাত মানুষ ফেকনবাবু (আমার ঠাকুরমার
জ্যাঠামশাই) এক হিন্দু বিধবা মহিলাকে নিয়ে পালিয়ে গেছিলেন। লালগোলার রাজপরিবারে
সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। যার সূত্রে সম্পর্ক তিনিও ওই মহিলার প্রতি আসক্ত ছিলেন। এটা ফেকনবাবু জানতেন
বলেই হয়ত তিনি পালিয়েছিলেন। এটা আমার অনুমান। দেশভাগ বা হিন্দু-মুসলমান এক্ষেত্রে
কোনও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তার পরে ব্যাপারটা হয়েছিল। ১৯৯০ কি ৯১ সালে আমি
যখন হাসানদার (আজিজুল হক) 'শকুন' গল্প
পড়ে তাঁর সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করতে যায়, আমি
গিয়ে উঠেছিলাম ফেকনবাবুর দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র নাথু সাহেবের বাড়িতে। নাথু সাহেবের বাড়িটা
ছিল রাজশাহী 'অলকা' সিনেমা হলের কাছে। সেখানে আমি আতিথেয়তা
পেয়েছিলাম। তবে সেটা লাথ-ঝাঁটা খেয়ে। (গল্পটা বললাম, অভিজ্ঞতা কাল বললে হয় না দাদা?
কুলদা রায় : দেশভাগের সময়ে আপনার এলাকার মুসলমান জনগোষ্ঠী কি গ্রামকে
গ্রাম উজাড় করে পূর্ব বঙ্গে চলে গিয়েছিল?
নীহারুল ইসলাম : না , সেটা হয়নি। আগেই বলেছি শুধুমাত্র
সুযোগ সন্ধানীরা গেছিল। এখান থেকে একটা, ওখান থেকে দুটো। যারা গেছিল, শিক্ষিতরাই
গেছিল, স্যরি নিরক্ষররা কেউ যায়নি।
কুলদা রায় : যারা যায়নি তারা গেল না কেন?
নীহারুল ইসলাম : নিজের ভিটেমাটির
টান। কিংবা যাদের ভিটেমাটি ছিল না, তারা তাদের আকাশটাকে ছেড়ে যায়নি। মুখ্য ব্যাপার এখানে
কেউ জানমালের নিরাপত্তার অভাব বোধ করেনি।
বরং ওপার থেকে গ্রাম কে উজাড় করে আসা মানুষকে ভাই মনে করে আশ্রয়
দিয়েছিল। গ্রাম গড়ে উঠেছিল। বাহাদুরপুর, গোলাপনগরের
মতো গ্রামগুলি তার প্রমাণ।
কুলদা রায় : যারা ওপার থেকে এসেছিলেন তারা তো নিঃশ্ব হয়েই এসেছিলেন।
তারা যখন আপনাদের এলাকায় এলেন তাদের মধ্যে কী কোনো ক্ষোভ বা প্রতিশোধস্পৃহা হয়েছিল
স্থানীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর?
নীহারুল ইসলাম : দু-চারজন
বাদে বাকি সবাই নি:স্ব ছিলেন। কিন্তু এখানে এসে দাঁড়ানো র মাটি পেয়েছিলেন। ঘর করার
বাশকাঠ পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় যেটা সেটা সহমর্মিতা পেয়েছিলে ন। যেটা আজও তারা
ভোলেননি।তাদের বংশধর রা ভোলেনি।স্বভাবতই প্রথম থেকে ভাই ভাই সম্পর্ক এখানকার
হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে...
সাতচল্লিশ পরবর্তী ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান/বাংলাদেশের বহু
জায়গায় বহু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সেদিক থেকে লালগোলা তথা মুর্শিদাবাদ
সাম্প্রদায়িকতা থেকে একেবারে মুক্ত।।
মুর্শিদাবাদ বাসী হিসেবে এটা নিয়ে আমি গর্ব করি...
কুলদা রায় : এটা কিভাবে
সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন?
নীহারুল ইসলাম : আসলে
মুরশিদাবাদ অনেককিছুর সাক্ষী। সেই নবাবী আমল থেকে পলাশীর যুদধ পর্যন্ত।
বিশ্বাসঘাতকতা, বেইমানি, হানাহানি করে যে ক্ষতি বই লাভ কিছু
হয় না- এটা এখানকার আকাশ, এখানকার বাতাস, এখানকার জল এখানকার মানুষকে এই শিক্ষা দেয়...
পিছিয়ে পড়া একটা জেলা। প্রথাগত শিক্ষা নেই। তবু মানুষগুলো বড্ড
ভালো। অভাব আছে। কাংগালপনা নেই। স্বাস্থ নেই কিন্তু দরাজ দিল আছে।
সেবলে দু-চারজন খুনি, চোরাকারবারি, নারী পাচারকারী যে নেই একথা বলব না। আছে। তবে সংখ্যায় তারা খুবই
নগণ্য...
কুলদা
রায় : ১৯৪৭ সালের পরে ১৯৫০ সালে
কোলকাতায় একবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। পরে ১৯৬৪ সালের দিকে আরেকটা দাঙ্গা হয়েছিল।
আরেকটা বড় ঘটনা ঘটেছিল আহমেদাবাদে মুসলমান হত্যাকাণ্ড এবং পরে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র
করে সহিংসতা। এগুলোর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বাংলাদেশেও এ সময়ে সংখ্যা লঘু হিন্দুরা
আক্রান্ত হয়ে। বারবার দেশ্ত্যাগের শিকার হয়েছে। তারা সার্বিকভাবে আতংকগ্রস্থ অবস্থায়
থাকে। এটাই হয়তো আমাদের মত দেশগুলির নিয়তি। কিন্তু ভারতে বা পশ্চিম বঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের
মানুষকে সে দেশটি ত্যাগ করতে দেখা যায় না। এই পরিস্থিতিটা তারা কিভাবে সামলান?
নীহারুল ইসলাম : বাবরি ধংসের সময় আমাদের এখানে
একটা চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল বটে। তবে খারাপ কিছু ঘটেনি। আমরা সজাগ ছিলাম। প্রশাসন
সজাগ ছিল। মনে পড়ে আমরা শান্তি মিছিলে হেটেছিলাম...
দেশত্যাগ
ব্যাপারটা আমাদের স্বপ্নেও নেই। কারণটা হয়ত আমাদের জানমালের হেফাজত। হয়ত আমাদের আকাশ,
আমাদের বাতাস, আমাদের জল ছেড়ে আমরা কোথাও যেতে চাই না।
কুলদা
রায় : এই দেশে থাকাটা শুধু আপনার আমার উপরে নির্ভর করে
না। এর সঙ্গে অন্য কমিউনিটি, রাজনৈতিক পার্টি, আইন-আদালত, সরকারকেও নিরপেক্ষ থাকা
দরকার। সেক্যুলার থাকা দরকার। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
নীহারুল
ইসলাম : দেখুন কখনও কখনও দাঙ্গার মতো ভয়ংকর ব্যাপার কোথাও
কোথাও ঘটেছে। সদ্য উত্তরপ্রদেশের মুজফফপুরে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম
কোর্ট উত্তর প্রদেশ সরকারকে ধিক্কার জানাল। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলল। এথেকে প্রমানিত
হয় আমাদের আইন ব্যবস্থার ওপর, শাসন ব্যবস্থার ওপর এখানকার মুসলমানদের যথেষ্ট আস্থা
রয়েছে। তাছাড়া প্রায় কুড়ি কোটি ভারতীয় মুসলিম চলে যেতে চাইলেও কোথায় যাবে? পাকিস্তান
বা বাংলাদেশে এত মানুষের যে সংকুলান সম্ভব নয়, সেটাও এখানকার মুসলিমরা অনুধাবন করে।
আর একটা কারণ, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে আমাদের জীবনযাত্রার
মান উন্নত। তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি প্রতিরোধ করে এখানে থাকাটা
এখানকার মুসলিমরা শ্রেয় মনে করে বলে আমি মনে করি...
কুলদা
রায় : মানুষ কি দেশভাগের পরিস্থিতি
নিয়ে ভাবে এখনো?
নীহারুল ইসলাম : সেভাবে ভাবে না।
কুলদা রায় : পুরণো মানুষ হয়ত কিছু আছেন, তারা ভাবেন। নতুন প্রজন্ম একেবারেই ভাবে
না..
পশ্চিম বঙ্গে মুসলমানদের জীবন নিয়ে লেখালেখি কেমন হয়? এ বিষয়ে
প্রতিক্রিয়া কেমন লেখক, পাঠক, প্রকাশক, সম্পাদকদের?
লেখক হিসেবে কি কখনো মনে হয়—আপনি, নীহারুল ইসলাম, একজন সংখ্যালঘু। ইনসিকিউরড।
লেখক হিসেবে কি কখনো মনে হয়—আপনি, নীহারুল ইসলাম, একজন সংখ্যালঘু। ইনসিকিউরড।
নীহারুল ইসলাম : একজন সংখ্যালঘু হিসেবে আমি কখনওই নিরাপত্তার অভাব
বোধ করিনা। তবে একজন মানুষ হিসেবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করি। মানুষের বড় অভাব এই পৃথিবীতে।
এই অভাব আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করি। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, আগুন পাখি কিংবা ঋত্বিকের সিনেমা
আমাকে কাঁদায়। আমি কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে যখন ক্লান্ত বোধ করি, লেখার চেষ্টা করি। আমার
লেখার বিষয় অবশ্যই মুসলিম জনজীবন। আমার আগেও এই জীবন নিয়ে লিখেছেন, এখনও লিখছেন। কিন্তু
আমার লেখা একটা নির্দিষ্ট ভূগোলে সীমাবদ্ধ। প্রতিক্রিয়া যা পাই, ভালো। খুব অল্প হলেও
আমার লেখার পাঠক আছে। তবে প্রকাশক নেই। তাদের কথা- মুসলিম জনজীবনের জটিলতা নাকি হিন্দুরা
বুঝতে পারেন না...
কুলদা রায় : এ জন্য কি কোনো প্রকাশক, সম্পাদক মুসলমান জীবন নিয়ে লিখতে বারণ করেছেন?
নীহারুল ইসলাম : আমাকে আজ অব্দি এরকম কথা কথা কোনও সম্পাদক বলেননি। তবে একজন প্রকাশক বলেছিলেন। সেটা তাঁর ভুল ধারণা। কেননা, মুসলিম জনজীবনের গল্প এ-বাংলাতেও জনপ্রিয় হয়েছে। পুরস্কৃত হয়েছে। অলীক মানুষ উপন্যাস তার অন্যতম দৃষ্টান্ত...
1 মন্তব্যসমূহ
দেশভাগ নিয়ে নীহারুলের বক্তব্য বেশ ইনটারেস্টিং।
উত্তরমুছুনতবে একটা কথা, এটা নীহারুলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নয়; ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ, মালদার চিত্রটা একটু অন্যরকম ছিল। সে কথা ইতিহাস তেমন ভাবে বলে না।
পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তিই শুধু নয়, ঠিক এক বছর আগে ঘটে যাওয়া গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর দগদগে স্মৃতি তখন প্রশমিত হয়নি। এমনতর বহু কথাই বলা যায়।