গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সম্পূর্ণ উপন্যাস : কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না

অনুবাদ : বিপাশা মণ্ডল


ভূমিকা
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ সম্ভবত পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর অধিকাংশ বই-ই বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘সহস্র বছরের নিঃসঙ্গতা’ পড়ার পরে এক সমালোচকের লেখায় ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ বিষয়ে একছত্র লেখা পড়ে মূল বইটি পড়তে খুব কৌতুল বোধ করি। কিন্তু বইটির বঙ্গানুবাদ যোগাড় করতে অসমর্থ হই। শেষ পর্যন্ত আমার পিতৃদেব কলকাতা থেকে বাংলা ভাষার নয় ইংরেজি ভাষার ছোট উপন্যাসিকাটি এনে দেন। বইটি পড়ে এমন তাড়না অনুভব করি যে মনে হয় সব দেশে সবকালে আত্মমর্যাদাবোধ ও বাস্তবতার সঙ্কটে জর্জরিত কর্নেলরা ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তাই বইটির ভাষান্তর শুরু করি। অনুবাদের ক্ষেত্রে তথ্যগত বিষয়গুলোতে একনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করা হয়েছে। মার্কেজের জাদুবাস্তবতার দ্বন্দ্ববিহ্বল, স্বপ্নময় সংরক্ত ও জীবনঘনিষ্ট জগতে পাঠককে স্বাগতম।

--বিপাশা মণ্ডল
---------------------------------------------------------------------------------------------

কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না


কর্নেল কফির কৌটাটার ঢাকনা তুলে নিলেন এবং দেখলেন যে সেখানে মাত্র ছোট্ট একচামচ কফি রয়ে গেছে। তিনি আগুনের ওপর থেকে পাত্রটা তুলে নিলেন, মাটির মেঝেতে অর্ধেকটা জল ঢেলে দিলেন, এবং একটা ছুরি দিয়ে কফির শেষ কণাটিও চেঁছে তুলে ফেললেন এতে কৌটার একটু জংও উঠে এল, এরপর কফিপাত্রে তিনি কফিটুকু ঢেলে দিলেন।

পাথরের ফায়ার প্লেসের বিপরীতে একটি আত্মবিশ্বাস এবং সরল প্রত্যাশার সঙ্গে যখন তিনি কফির জলটা ফুটে ওঠার অপেক্ষা করছিলেন, কর্নেলের কেমন মনে হল তাঁর পেটের মধ্যে ছত্রাক আর বিষাক্ত লিলিরা শেকড় বসাচ্ছে। ওটা ছিল অক্টোবর মাস। এমন কী তাঁর মতো একজন লোকের পক্ষেও সকালটা পার করা কঠিন, যে কিনা, এরকম বহু সকালে সংগ্রাম করে বেঁচে গেছেন-- ষাট বছরের কাছাকাছি হল-- গত গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পরে থেকে-- কর্নেল শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করেননি। যেসব জিনিসগুলো এসে শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে পৌঁছেছে তার মধ্যে অক্টোবর একটা জিনিস।

তাঁর স্ত্রী তাঁকে কফি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকতে দেখে মশারীটা তুললেন। গতরাতে হাঁপানির আক্রমণে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন, এখনো তিনি ঘুমভাবে আচ্ছন্ন। কিন্তু তিনি সোজা হয়ে বসে কাপটা নিলেন।

‘তোমার কফি?’ তিনি বললেন।

‘আমি নিজেরটা আগেই খেয়ে নিয়েছি।’ কর্নেল মিথ্যা কথা বললেন, ‘ওখানে তখনও বড় এক চামচ কফি ছিল।’

ঠিক ঐ মুহূর্তে ঘন্টা বাজতে লাগল। কর্নেল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথাটা ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী যখন কফি পান করছিলেন, তিনি তাঁর দড়ির ঝোলানো খাটটা একপাশ থেকে খুললেন, অন্য দিকে গোল করে ওটাকে গড়িয়ে নিয়ে দরজার পিছনে নিয়ে গেলেন। নারীটি মৃত লোকটি আজ যার অন্ত্যেষ্টি হবে তার কথা ভাবতে লাগলেন। তিনি বললেন,

‘সে জন্মেছিল ১৯২২ সালে, ঠিক আমাদের ছেলের জন্মের একমাস পরে, এপ্রিলের সাত তারিখ।’

তিনি ঘড়ঘড় শব্দ করে শ্বাস গ্রহণ করছেন আর তার ফাঁকে ফাঁকে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। একটা দৃঢ় শিরদাঁড়ার ওপর ছোট্ট একটা শাদার পি- ছাড়া তিনি এখন আর কিছুই নন। হাঁপানির টানের জন্য তাঁর কথাগুলো তাঁকে দৃঢ়তার সঙ্গে সোজাসুজি বলতে হয়। কফি শেষ করেও তিনি ঐ মৃত লোকটির কথা ভাবতে থাকলেন।

‘অক্টোবরে কবরে যাওয়া নিশ্চয়ই ভয়ংকর,’ তিনি বললেন। কিন্তু তাঁর স্বামী সে কথায় কোনো মনোযোগ দিলেন না। ভদ্রলোক জানালা খুলে দিলেন। বাইরের অলিন্দেও এসে হাজির হয়েছে অক্টোবর। গাঢ় সবুজ রঙে ঘাস-লতা-পাতারা ফেটে পড়ছে, কেঁচোরা মাটির ওপর বানিয়ে তুলেছে খুদে-খুদে মাটির ঢিবি, কর্নেল আরো একবার তাঁর অন্ত্রের মধ্যে এই পাপী মাসটাকে অনুভব করলেন।

‘আমার হাড়ের মধ্যে পর্যন্ত ভেজা ভাব বোধ করছি,’ তিনি বললেন।

স্ত্রী উত্তর দিলেন, ‘শীত পড়েছে, বর্ষাকাল শুরু হবার পর থেকেই তোমাকে বলছি মোজা পরে ঘুমাতে।’

‘এক সপ্তাহ ধরেই মোজা পরে ঘুমাচ্ছি।’

অবিরাম কিন্তু ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। গায়ে একটা পশমের চাদর জড়িয়ে দড়ির বিছানায় আবার শুয়ে পড়তে ভালো লাগতো কর্নেলের। কিন্তু ঘণ্টার ভাঙ্গা আওয়াজ তাঁকে জোর করে অন্ত্যেষ্টির কথা মনে করিয়ে দিল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘এটা অক্টোবর,’ এবং ঘরের ঠিক মাঝখানের দিকে হেঁটে গেলেন। শুধুমাত্র তখনই তিন স্মরণ করতে পারলেন যে মোরগটা বিছানার পায়ের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। এটা একটা লড়াকু মোরগ।

রান্নাঘরে কাপটা রেখে, তিনি কারুকাজ করা কাঠের কেসের পেন্ডুলাম ঘড়িটায় দম দিলেন। বসার ঘরটা ঠিক শোয়ার ঘরের মত নয়, ছোট শোয়ার ঘরটা হাঁপানির রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য খুবই সংকীর্ণ, বসার ঘরটা অনেক বড়, একটি ছোট টেবিলের উপরে টেবিলক্লথ এবং একটি প্লাস্টারের বিড়ালসহ চারপাশে চারটি রকিংচেয়ার পাতা আছে। ঘড়িটার উল্টোদিকের দেয়ালে রেশমি নেটের কাপড় পরা একজন নারীর ছবি, গোলাপভর্তি একটি নৌকার চারধারে ছোট ছোট কিউপিডের মূর্তি।

সাতটা বিশের সময় তিনি ঘড়িটায় দম দেয়া শেষ করলেন।

এরপর তিনি মুরগীটাকে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে, চুলাটার একটা পায়ায় সঙ্গে বেঁধে দিলেন সেটাকে, ক্যানের জল বদলে দিলেন আর একমুঠো শস্য দানা রাখলেন তার পাশে। বেড়ার ফাঁকটার ভেতর দিয়ে একদঙ্গল বাচ্চাকাচ্চা এসে হাজির। তারা মোরগটাকে ঘিরে বসলো, এখন নীরবে ওটাকে দেখবে।

‘প্রাণীটার দিকে তাকানো বন্ধ করো,’ কর্নেল বললেন, ‘যদি অত বেশি বেশি মোরগের দিকে তাকাও তাহলে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।’

বাচ্চারা নড়লো না। একজন তার হারমনিকায় একটা জনপ্রিয় গানের সুর তুললো একটু। ‘আজ ও-গান বাজিও না,’ কর্নেল তাকে বললেন, ‘শহরে একজন মারা গেছে।’ বাচ্চাটি তার হারমনিকা প্যাণ্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো, আর কর্নেল, অন্ত্যেষ্টিতে যাবার পোশাক পরার জন্য শোবার ঘরে চলে গেলেন।

স্ত্রীর হাঁপানির জন্য তাঁর শাদা স্যুটটা ইস্ত্রি করা হয়নি। কাজেই বিয়ের পর থেকে বিশেষ-বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার করা সেই পুরনো কালো স্যুটটাকেই তাঁকে পড়তে হলো। ট্রাঙ্কটার একেবারে তলা থেকে ওটাকে খুঁজে বার করতে বেশ একটু ঝামেলাই করতে হলো তাঁকে, খবরকাগজ দিয়ে মোড়ানো, পোকায় যাতে না-কাটে সেইজন্য ছোটো-ছোটো ন্যাপথালিনের দানা ছড়ানো চারপাশে। বিছানায় পা ছড়িয়ে শুয়ে তাঁর স্ত্রী তখনও মৃত লোকটির কথা ভেবে চলেছেন।

‘এর মধ্যেই হয়তো অগাস্টিনের সঙ্গে ওর দেখা হয়ে গেছে,’ স্ত্রী বললেন। ‘অগাস্টিনের মৃত্যুর পর থেকে আমরা কী দশায় পড়ে আছি, সে কথা হয়তো ও বলে দেবে না।’

‘এ মুহূর্তে ওরা হয়তো মোরগগুলোর কথাই বলছে’, বললেন কর্নেল।

ট্রাঙ্কের মধ্যে তিনি একটা বিশাল পুরানো ছাতা খুঁজে পেলেন। কর্নেলের দলের জন্যে টাকা তোলবার জন্যে যে-লটারি খেলার আয়োজন করা হয়েছিলো, তাতে তাঁর স্ত্রী জিতেছিলেন এই ছাতাটা । সেই রাত্তিরেই তাঁরা বাইরে একটা অনুষ্ঠানে যেতে পেরেছিলেন, বৃষ্টির জন্যে যেটা বাতিল করে দিতে হয়নি ছাতাটাকে পেয়ে। কর্নেল, তাঁর স্ত্রী, আর তাঁদের ছেলে, অগাস্টিন-- ওর বয়েস তখন ছিলো আট-- শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটা দেখেছিলেন, এই বিশাল ছাতাটার তলায় বসে। এখন অগাস্টিন মৃত, এবং সাটিনের কাপড়ে তৈরি ছাতাটা পোকায় কেটে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে।

‘দ্যাখোতো, সার্কাসের ভাঁড়ের ছাতাটার দশা কী হয়েছে’, এবং কর্নেল তাঁর আগেকার দিনের একটা প্রবাদ বললেন। ছোটো-ছোটো ধাতুর শিকের এক রহস্যময় ব্যবস্থাপনা খুলে গেলো তাঁর মাথার ওপর। ‘এখন আকাশের তারা গোনবার পক্ষেই এটাকে দারুণ মানাবে।’

মৃদু হাসলেন কর্নেল। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ছাতাটার দিকে তাকিয়ে দেখারও চেষ্টা করলেন না। ‘সবকিছুরই তো ঐ দশা’, ফিসফিস করে বললেন তাঁর স্ত্রী। ‘আমরা জ্যান্ত পঁচছি।’ এই বলে তিনি চোখ বুজলেন, যাতে মৃত লোকটার কথাই মন দিয়ে ভাবতে পারেন।

অনেকদিন ধরেই আয়না নেই তাই হাত বুলিয়ে দাড়ির অস্তিত্ব অনুভব করে দাড়ি কামিয়ে নিলেন কর্নেল-- নিঃশব্দে পোশাক পরতে লাগলেন। ট্রাউজারজোড়া পায়ে আঁটসাঁট হলো, যেন লম্বা পাজামার মতো অন্তর্বাস পরেছেন; ট্রাউজারের গোড়ালির কাছটা ফিতে দিয়ে বাঁধতে হয়, আর কোমরের কাছে ঐ একই কাপড়ের দুটো ফিতে, প্রায় কিডনির কাছাকাছি দিয়ে দুটো সোনালি বকলসের মধ্য দিয়ে গলিয়ে নিতে হয় ফিতেগুলোকে। কর্নেল কোনো বেল্ট পরেন না। তাঁর শার্টটার রং পুরানো ম্যানিলা কাগজের মতো, আর তেমনি সেটা কঠোর শক্ত, তামার কোণতোলা বোতাম দিয়ে লাগাতে হয়, ঐ বোতামগুলোই ঘাড়ের আলগা কলারগুলোকে আটকে রাখে। কিন্তু কলারটা ছেঁড়া, কাজেই কর্নেল গলায় ওটা বাঁধার ইচ্ছে বাদ দিলেন।

প্রত্যেকটা কাজ তিনি এমনভাবে করলেন যেন এ কাজগুলো একটা উত্তরণ ঘটার মত কাজ। তাঁর হাতের হাড়গুলো টান-টান খসখসে চামড়ায় ঢাকা, ঠিক ঘাড়ের কাছে যেমন অল্প দাগ আছে হাতও তেমনি হালকা দাগে ভরা। পেটেন্ট চামড়ার জুতো জোড়া পরে নেবার আগে শেলাইয়ের ওপরের শুকনো মাটিকে ঝেড়ে টেড়ে পরিস্কার করে নিলেন। ঐ মুহূর্তে স্ত্রী তাকালেন তাঁর দিকে, তাঁর মনে হলো স্বামী যেন ঠিক তাঁদের বিয়ের দিনের মতো সেজেছেন। শুধুমাত্র তখনই প্রথম তাঁর খেয়াল হলো কতটা বুড়িয়ে গেছেন স্বামী।

‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো বিশেষ উৎসবের জন্যে সেজেছো’, স্ত্রী বললেন।

‘এই যে সৎকার--এটা একটা বিশেষ ঘটনাই’, কর্নেল বললেন। ‘অনেক বছর পর এই প্রথম আমাদের এখানে স্বাভাবিক কারণে কারুর মৃত্যু হলো।’

নটার পর আবহাওয়া পরিস্কার হলো। কর্নেল বাইরে যাবেন বলে তৈরি হয়েছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী তাঁর কোটের হাতা চেপে ধরলেন।

‘চুল আঁচড়াও’, স্ত্রী বললেন।

কর্নেল তাঁর ইস্পাত-রঙা কর্কশ চুলগুলোকে একটা হাড়ের চিরুনি দিয়ে পোষ মানানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওটা ছিল একটা অর্থহীন চেষ্টা।

‘আমাকে নিশ্চয়ই একটা কাকাতুয়ার মতো দেখাচ্ছে’, তিনি বললেন।

স্ত্রী তাঁকে নিরীক্ষণ করলেন। তাঁর মনে হলো তাঁর স্বামীকে মোটেই ওরকম দেখাচ্ছে না। কর্নেলকে মোটেই কোনো কাকাতুয়ার মতো দেখাচ্ছে না। সে ছিল একজন শুকনো মানুষ, নিরেট হাঁড়গুলো নাট ও বলটু দিয়ে যুক্ত করা। শুধুমাত্র তার চোখে দৃশ্যমান সজীবতার জন্যেই মনে হয় যে তিনি ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা নন।

‘ওভাবেই তুমি চমৎকার’, তাঁর স্ত্রী স্বীকার করলেন, এবং স্বামী যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি আরো যোগ করলেন, ‘আর ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করো তো এ বাড়িতে ওর গায়ে আমরা ফুটন্ত জল ঢেলে দিয়েছিলাম নাকি।’

তাঁরা থাকেন শহরের এক কিনারে, তাঁদের বাড়ির ছাদ তালপাতায় ছাওয়া, দেয়ালের চুনকামের পাতলা চলটা উঠে যাচ্ছে। গুমোট ভ্যাপসা ভাবটা তেমনি আছে, যদিও বৃষ্টি থেমে গেছে। দু-পাশে ঠাসাঠাসি করা বাড়ি-ঘরের মধ্যেকার একটা ছোটো গলি দিয়ে হেঁটে কর্নেল পৌঁছলেন প্লাজায়। যেই না তিনি বড় রাস্তায় ঢুকলেন, ঠা-ায় কাঁপতে থাকলেন। যতদূর চোখ যায় শহরটায় যেন ফুলের একটা গালিচা বিছানো। দরজার কছে বসে কালো পোশাক পরা স্ত্রীলোকেরা অন্ত্যেষ্টিযাত্রার জন্যে অপেক্ষা করছে।

প্লাজায় আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। বিলিয়ার্ড হলের মালিক তার দরজা থেকেই দেখতে পেলেন কর্নেলকে, দু-হাত বাড়িয়ে তিনি চেঁচিয়ে বললেন :

‘কর্নেল, একটু দাঁড়ান, আমি আপনাকে একটা ছাতা ধার দিচ্ছি।’

কর্নেল ঘুরে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন :

‘ধন্যবাদ আপনাকে। আমি এভাবেই ঠিক আছি।’

এখনও চার্চ থেকে অন্ত্যেষ্টিমিছিল বেরোয়নি। পুরুষরা--গায়ে শাদা পোশাক, গলায় কালো টাই-- নিচু দরজাটার সামনে নিজেদের ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। তাদের একজন দেখতে পেলেন কর্নেল প্লাজার জলে-ভরা গর্তগুলো লাফিয়ে-লাফিয়ে পেরোচ্ছেন।

সে চিৎকার করে বলল, ‘আরে বন্ধু এখানে, ছাতার তলায় এসো!’

সে সরে দাঁড়িয়ে তার ছাতার তলায় জায়গা করে দিলে।

বললেন কর্নেল বললেন, ‘ধন্যবাদ, বন্ধু’,

কিন্তু আমন্ত্রণটা তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি মৃতের মাকে শোক আর সান্ত¡না জানাতে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়লেন। প্রথমেই যেটা তিনি টের পেলেন, সেটা হচ্ছে নানারকম আলাদা আলাদা ফুলের গন্ধ। এরপরে গরমটা অনেক বাড়ল। শোবার ঘরে গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে থেকেই কর্নেল পথ করে চলে যাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউ একজন তাঁর পিঠে একটা হাত রাখল, তাঁকে হতভম্ব লোকজনদের ভীড়ের মধ্য দিয়ে ঘরের পেছনে ঠেলে নিয়ে এলো, যেখানে খোলামেলা দেখা গেলো মৃতের নাকের গভীর ছিদ্র দুটো।

ওখানে মৃতের মা ছিলেন, একটা ঝালর-লাগানো তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করে তিনি কফিন থেকে মাছি তাড়াচ্ছিলেন। অন্য সব মেয়েরা, কালো পোশাক-পরা, তাকিয়ে দেখছে মৃতদেহটা, একই রকম অভিব্যক্তিতে যেভাবে লোকে তাকিয়ে তাকিয়ে নদীর স্রোত দেখে। তক্ষুনি ঘরের পিছন থেকে কার গলার আওয়াজ শুরু হলো। কর্নেল একজন মেয়েকে পাশে সরিয়ে মৃতের মার মুখোমুখি দাঁড়ালেন, এবং তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন।

‘আমি খুবই দুঃখিত,’ বললেন তিনি।

উনি তাঁর মুখ ফেরালেন না। শুধু মুখটা হাঁ করলেন আর চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। কর্নেল আঁৎকে উঠলেন। মনে হলো এক আকারহীন ভিড় যেন তাঁকে মৃতদেহটার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আর সুর করে টেনে-টেনে ডুকরে উঠছে। হাত দুটোর জন্য একটা শক্ত-কিছুর অবলম্বন চাইলেন তিনি, কিন্তু দেয়ালটাকে নাগালে পেলেন না। সে জায়গায় অন্য সব লোকের শরীর দাঁড়িয়ে আছে।। কে যেন তাঁর কানে কানে, আস্তে, খুব কোমল স্বরে বললে: ‘একটু সামলিয়ে নাও, কর্নেল।’ তিনি মুখটা ঘোরালেন, আর অমনি মৃতের একেবারে মুখোমুখি হলেন। কিন্তু তাকে তিনি চিনতেই পারলেন না, কারণ শরীরটা কেমন আড় ধরা আর সজীব, আর তাঁরই মতো যেন হতচকিত, শাদা কাপড়ে তার সারা গা মোড়ানো, হাতে তার শিঙাটা। কর্নেল যখন চীৎকারের মধ্য থেকে একটু হাওয়া চেয়ে মাথা তুললেন, দেখতে পেলেন বন্ধ বাক্সটা লাফিয়ে লাফিয়ে দরজার দিকে চলেছে, ফুলের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে, ফুলের রাশি দুপাশে ছিটকে যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। কর্নেল একেবারে ঘেমে উঠেছেন। তাঁর হাড়ের জোড়াগুলো ব্যথা করছে। মুহূর্ত পরেই তিনি টের পেলেন যে তিনি রাস্তায় এসে পড়েছেন, কারণ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁঁট তাঁর চোখের পাতায় আঘাত করছে, আর কেউ একজন তাঁকে টেনে ধরেছে, এবং বলছে :

‘জলদি করো, দোস্ত, আমি তোমারই জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।’

সে হলো সাবাস, তাঁর মৃত ছেলের ধর্মবাপ; তাঁর দলের সে একমাত্র নেতা, যে রাজনৈতিক নির্যাতন এড়াতে পেরেছে আর শহরের মধ্যেই ভালোভাবে থাকতে পেরেছে সবসময়। ‘ধন্যবাদ, দোস্ত,’ বললেন কর্নেল, ছাতার তলায় নীরবে হাঁটতে লাগলেন তিনি। বাজনাদারেরা অন্ত্যেষ্টিমিছিলের সুর বাজাতে শুরু করল। কর্নেল লক্ষ্য করলেন এটা বাজছে শিঙ্গা ছাড়াই এবং প্রথমবারের মতো এটা নিশ্চিত হলো যে মৃত মানুষটি মারাই গেছে।

‘বেচারা,’ মৃদু স্বরে তিনি বিড়বিড় করলেন।

সাবাস গলা পরিস্কার করলো। ছাতাটা সে তার বাঁ হাতে ধরে আছে, হাতলটা ঠিক তার মাথার সমান উঁচুতে, কারণ সে কর্নেলের চেয়ে খাটো। কফিন নিয়ে মিছিল যখন প্লাজা থেকে বেরুলো, তাঁরা কথা বলতে শুরু করলেন। সাবাস কর্নেলের দিকে ফিরলো তখন, তার মুখটায় কাতরভাব, এবং বলল :

‘বন্ধু, মুরগীটার কোনো নতুন খবর আছে ?’

‘সে এখনও আছে ওখানে,’ উত্তর দিলেন কর্নেল।

ঠিক তক্ষুনি কার একজনের চীৎকার শোনা গেলো :

‘ওরা মৃতদেহটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে ?’

চোখ তাকালেন কর্নেল। দেখলেন ব্যারাকের বারান্দায় খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়র। তার পরনে ফ্লানেলের অন্তর্বাস। তার দাড়ি না কামানো গাল দুটো ফোলা। বাজনদারেরা হাঁটা থামিয়ে দিল। একমুহূর্ত পরেই কর্নেল চিনতে পারলেন ফাদার আন্হেলের গলা, মেয়রকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে কিছু বলছে। ছাতার ওপর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের মাঝেই তিনি তাদের দুজনের আলাপটা শুনতে পেলেন।

‘তবে?’ জিজ্ঞাসা করল সাবাস।

‘তবে, কিচ্ছু না।’ উত্তর দিলেন কর্নেল। ‘অন্ত্যেষ্টিমিছিল পুলিশ-ব্যারাকের সামনে দিয়ে যেতে পারবে না।’

‘ও হো, ভুলেই গিয়েছিলাম,’ সাবাস ব্যাখ্যা করল, ‘আমরা যে, সামরিক শাসনে আছি, এ কথাটা আমি শুধুই ভুলে যাই।’

‘কিন্তু এ তো আর কোনো বিদ্রোহ নয়,’ বললেন কর্নেল, ‘এ তো নেহাৎই একজন দরিদ্র মৃত বাজনাদার।’

অন্ত্যেষ্টিমিছিল দিক পালটাল। গরিব প্রতিবেশী পাড়াগুলোর মেয়েরা তাকিয়ে-তাকিয়ে নীরবে নখ চিবাতে চিবাতে দেখল কফিন নিয়ে তাদের যাওয়া। কিন্তু তারপরেই তারা নেমে এলো রাস্তার মাঝে, আর হাউ-হাউ করে উঠলো প্রশংসা কৃতজ্ঞতা আর বিদায় জানিয়ে, যেন তাদের ধারণা মরা মানুষটা কফিনের মধ্যে শুয়ে তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে। কবরখানায় কর্নেলের কেমন অসুস্থ বোধ হলো। যখন কফিন-বাহকদের যাবার রাস্তা করে দিয়ে সাবাস তাঁকে ঠেলে সরিয়ে এনে দেয়ালের পাশে দাঁড় করালো, সে তার হাসিমুখটা তার দিকে ফিরিয়ে দেখতে পেলে কঠোর এক মুখের ছবি।

‘ব্যাপার কী, বন্ধু ?’ সাবাস জিজ্ঞাসা করল।

কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।

‘এটা অক্টোবর।’

একই রাস্তা ধরে ফিরে এলো তারা। এটা পরিষ্কার হ’য়ে গেছে; গভীর, তীব্র নীল আকাশ। কর্নেল ভাবলেন, আর বৃষ্টি পড়বে না এখন, এবং তিনি কিছুটা ভালো বোধ করতে লাগলেন, তবে এখনও তাঁর মনটা খারাপ হয়ে আছে। সাবাস তাঁর ভাবনায় বাধা দিলো।

‘একজন ডাক্তারকে দেখাও।’

‘আমি অসুস্থ নই,’ কর্নেল বললেন। ‘সমস্যা এটাই যে অক্টোবর এলে আমার মনে হয় আমার অন্ত্রের মধ্যে যেন কতগুলো জানোয়ার আছে।’

সাবাস বললে, ‘আহ্!’ বাড়ির কাছে এসে সে বিদায় জানালো। তার বাড়িটা নতুন, দোতলা সমান উঁচু, জানলার কাঠামো পেটা লোহার তৈরি। কর্নেল তাঁর নিজের বাড়িমুখো চললেন, এই পোশাকি সাজটা খুলে ফেলার জন্য ব্যস্ত তিনি। একমুহূর্ত পরেই আবার বেরোলেন মোড়ের দোকানটা থেকে এক কৌটো কফি আর মোরগটার জন্যে আধ পাউন্ড শস্যদানা কিনতে।

বৃহস্পতিবার তাঁর দড়িরখাটে শুয়ে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে তা সত্ত্বেও তিনি মোরগটার সেবাযতœ করলেন। কয়েকদিন ধরে আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে না। এই সপ্তাহের মধ্যে তাঁর পেটের বিষাক্ত উদ্ভিদরা মঞ্জরিত হয়ে উঠলো। স্ত্রীর হাঁপানির টানের শব্দ শুনে কষ্ট পেতে-পেতে পর-পর কয়েকটা নির্ঘুম রাত কাটালেন তিনি। কিন্তু শুক্রবার বিকেলে অক্টোবর সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল। অগাস্টিনের সঙ্গীরা--দরজির দোকানে কাজ করে, যেমন অগাস্টিন নিজেও কাজ করতো, এবং সবাই একেকজন মোরগের লড়াইয়ে খুব মেতে থাকে; এই অবসরে তারা মোরগটাকে দেখতে এলো। মুরগীটা ভাল অবস্থায়ই আছে।

একা হবার পর কর্নেল শোবার ঘরে স্ত্রীর কাছে ফিরে এলেন। স্ত্রী সেরে উঠেছেন।

‘কী বললো ওরা ?’ স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘খুবই আগ্রহান্বিত’ কর্নেল তাঁকে জানালেন। ‘মোরগটাকে নিয়ে বাজি ধরবে বলে সŸাই তাদের টাকা বাঁচিয়ে জমাচ্ছে।’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এরকম একটা কুৎসিত মোরগের মধ্যে তারা কী দেখে আমি জানি না, ওটাকে দেখলে একটা আজব উদ্ভট কিছু মনে হয়; ওর পায়ের তুলনায় মাথাটা কী ছোট্ট!’

কর্নেল জবাব দিলেন,

‘ওরা তো বলে জেলার মধ্যে ওই সবার সেরা,’ কর্নেল উত্তর দিলেন। ‘অন্তত পঞ্চাশ পেসো দাম হবে ওর।’

সে এটা নিশ্চিত যে, এই যুক্তিতেই মোরগটাকে কাছে রাখবার জন্যে তাঁর জেদটাকে যে মানানো যাবে; ন-মাস আগে এক মোরগের লড়াইয়ের আসরে গোপন ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে তাঁর ছেলে গুলি খেয়ে মারা গেছে, মুরগীটা তারই উত্তরাধিকার। ‘একটি ব্যয়বহুল কল্পনা,’ স্ত্রী বললেন। ‘শস্য দানা ফুরিয়ে যাবার পর ওটাকে নিজেদের যকৃত খাওয়াতে হবে।’ ভাববার জন্যে অনেকটা সময় নিলেন কর্নেল, এরমধ্যে তিনি কাপড় রাখার তাকে তার সাদা ডাক প্যান্ট খুঁজলেন।

‘কয়েকটা মাসের তো ব্যাপার,’ তিনি বললেন। ‘এটা তো আমরা জেনে গিয়েছি যে জানুয়ারিতে মোরগের লড়াই হবে। তারপর এটাকে আরো চড়া দামে বেচে দেয়া যাবে।’

প্যান্টগুলো ইস্ত্রি করা দরকার। কর্নেলের স্ত্রী চুল্লির পাশে টান-টান ক’রে সেগুলো বিছিয়ে রাখলেন--উনুনে দুটো ইস্তিরি গরম হচ্ছে।

‘তোমার বাইরে যাবার জন্য এত তাড়াতাড়ি কেন?’ স্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘চিঠির জন্য।’

‘আজ যে শুক্রবার, সে-কথা ভুলেই গিয়েছিলাম,’ শোবার ঘরে ফিরে যেতে-যেতে তিনি মন্তব্য করলেন। কর্নেল জামা পড়েছেন, তবে প্যাণ্ট এখনও পরেননি। তিনি তাঁর জুতো জোড়ার দিকে তাকালেন !

‘এই জুতোগুলো ফেলে দিলেই হয়,’ স্ত্রী বললেন। ‘তোমার ঐ পেটেণ্ট চামড়ার জুতোজোড়া পরলেই পারো।’

কর্নেলের খুব মন খারাপ লাগলো।

‘ওদের যেন অনাথ লোকের জুতোর মতো দেখায়,’ প্রতিবাদ করে বললেন তিনি। ‘প্রত্যেকবার ওই জুতো-জোড়া পায়ে দেবার সময় মনে হয় যেন কোনো পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছি।’

‘আমরা তো আমাদের ছেলেরই অনাথ,’ নারীটি বললেন।

এবারও তাঁর স্ত্রী শেষপর্যন্ত মত পালটাতে বাধ্য করলেন। লঞ্চের ভেঁপু বেজে ওঠবার আগেই কর্নেল গিয়ে পৌঁছালেন বন্দরে। পেটেণ্ট চামড়ার জুতো, বেল্ট ছাড়া সাদা ডাকের প্যান্ট, আলগা কলার না-লাগানো শার্ট, তামার উঁচু বোতাম দিয়ে গলার কাছে আটকানো। সিরিয়ার মোসেসের দোকান থেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, লঞ্চগুলো জেটিতে এসে ভিড়লো। যাত্রীরা নামল, আট ঘণ্টা অনড় বসে থেকে একেক জন জমে গেছে। সবসময়েই একই যাত্রীর দল: ফিরিওলা আর বড়ো শহরে যারা কাজ করতে যায়--আগের সপ্তাহে গিয়েছিলো, এখন যথারীতি ফিরে এসেছে।

চিঠির লঞ্চটা সবার শেষে। কাতর উৎকণ্ঠার সঙ্গে কর্নেল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, সেটা জেটিতে এসে ভিড়লো। তিনি খেয়াল করে দেখলেন, ছাদের ওপর, নৌকোর বড়ো খুঁটির গায়ে বাঁধা আর একটা অয়েলক্লথ বিছিয়ে নিরাপদে রাখা পোস্ট অফিসের ব্যাগটাকে। পনেরো বছরের অপেক্ষা তাঁর ইনটুইশনকে তীক্ষè করে তুলেছে। মোরগটা ধারালো করে তুলেছে তাঁর উদ্বিগ্নতাকে। যে-মুহূর্তে পোস্টমাস্টার লঞ্চের ওপর গেল, ব্যাগটাকে খুলে নিয়ে কাঁধের ওপর ঝোলালো, তখন থেকেই তাকে চোখে চোখে রাখলেন কর্নেল।

বন্দরের সমান্তর গেছে যে রাস্তাটা সেটা দিয়েই তাঁকে অনুসরণ করলেন কর্নেল, কত দোকান আর ঝুপড়ি রঙিন বেসাতি গুলো গোলকধাঁধাঁর মতো সাজিয়ে বসে আছে। প্রত্যেকবার যখনই তিনি এভাবে পোস্টমাস্টারের পেছন নেন, তখনই কর্নেলের অন্য এক ধরনের উদ্বিগ্নতার অভিজ্ঞতা হয়, ঠিক ভয় নয় কিন্তু ভয়ের মতো পীড়াদায়ক একটা কিছু। ডাক্তার পোস্ট অফিসে খবর কাগজের জন্যে অপেক্ষা করছিলো।

‘আমার স্ত্রী তোমায় জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন, আমাদের বাড়িতে আমরা কি তোমার ওপরে গরম জল ঢেলে দিয়েছিলাম নাকি।’ বললেন কর্নেল।

ডাক্তার বয়েসে তরুণ, মাথাটা মসৃণ কালো চুল ঢাকা। তার দাঁতের গঠন এতই নিখুঁত আর সুঠাম যে মনে হয় যেন অবিশ্বাস্য কিছু। সে হাঁপানি রোগির শরীরের অবস্থা জানতে চাইলো। কর্নেল তাকে সব খুঁটিনাটি সমেত বিশদ একটা বিবরণ দিলেন বটে, কিন্তু সারাক্ষণ একবারও পোস্টমাস্টারের ওপর থেকে নজর সরাননি, লোকটি চিঠিগুলো বেছে বেছে ছোটো ছোটো কুঠুরিতে রাখছে। তার বিস্তৃত ও নড়াচড়ার ধীর ভঙ্গি কর্নেলকে ভীষণ অধৈর্য করে তুললো।

ডাক্তার তার খবর কাগজের মোড়ক সহ সব কাগজপত্র পেয়ে গেলো। ওষুধের বিজ্ঞাপন আর বিবরণগুলো সে একপাশে সরিয়ে রাখল, তারপর তার ব্যক্তিগত চিঠিগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। এরই মধ্যে অন্য যারা এসেছিলো তাদের কাছে ডাক বিলি করে দিয়েছে পোস্টমাস্টার। বর্ণমালার যে হরফটায় তাঁর নাম শুরু, সেটা যে কুঠুরিটার গায়ে লেখা, তার ওপর নজর রেখেছিলেন কর্নেল। নীল বর্ডার দেয়া একটা এয়ার মেলের চিঠি তাঁর বুকের ধুকপুকুনি আরো বাড়িয়ে তুলেছিলো।

ডাক্তার খবরকাগজের মোড়কের ওপর মোহরটা ছিঁড়ে ফেললো। প্রধান শিরোনামগুলোর ওপর সে যখন চোখ বোলাচ্ছে, কর্নেল, ঐ ছোট্ট কুঠুরিটায় তাঁর চোখ বসানো, অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন পোস্টমাস্টার তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সে ওদিকে এলোই না। ডাক্তার তার খবরকাগজ পড়া থামালেন; কর্নেলের দিকে তাকালেন একবার, তারপর টেলিগ্রাফের চাবিগুলোর সামনে বসে থাকা পোস্টমাস্টারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, এরপর আবার কর্নেলের দিকে তাকালেন।

‘আমরা যাচ্ছি,’ বললে সে।

পোস্টমাস্টার তার মাথা তুললো না। বললো,

‘কর্নেলের জন্য কিচ্ছু নেই।’

‘আমি অবশ্য কিছুরই প্রত্যাশা করিনি,’ মিথ্যে বললেন কর্নেল। একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো ডাক্তারের দিকে ফিরে বললেন, ‘আমাকে কেউ কিছু লেখে না।’

নিঃশব্দেই ফিরে চললেন তাঁরা। ডাক্তার খবর কাগজগুলোতেই মন বসিয়ে রেখেছে। আর কর্নেল তাঁর অভ্যেসমতো এমনভাবে হাঁটছেন যা দেখলে মনে হয় কেউ বুঝি তার পয়সাকড়ি হারিয়ে ফেলে সন্তর্পণে আবার রাস্তা দেখতে দেখতে ফিরছে। বিকেলটা উজ্জ্বল, ঝকঝকে। প্লাজার বাদামগাছগুলো তাদের শেষ পচা পাতাগুলো ঝরাচ্ছে। ডাক্তারখানার দরজার এসে যখন তাঁরা পৌঁছালেন, তখন অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।

‘কী আছে খবর ?’ কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন।

ডাক্তার তাঁকে কয়েকটা খবরকাগজ দিয়ে দিলেন।

‘কেউ জানে না,’ ডাক্তার বললেন। ‘সেন্সর যেসব কথা লিখতে দেয় তার আড়ালে আসলে কী লেখা আছে, সেটা বোঝা একেবারেই দুঃসাধ্য।’

কর্নেল প্রধান শিরোনামগুলো পড়লেন। আন্তর্জাতিক সকল খবর। ওপরের দিকে চার কলাম জুড়ে সুয়েজ খাল সম্বন্ধে একটা প্রতিবেদন। সামনের পাতাটা প্রায় পুরোটাই পয়সা দিয়ে ছাপানো অন্ত্যেষ্টির বিজ্ঞপ্তিতে ভর্তি।

‘নির্বাচনের কোনো আশাই নেই,’ কর্নেল বললেন।

‘অত সরল হবেন না, কর্নেল।’ বললে ডাক্তার, ‘কোনো অবতার এসে আমাদের বাঁচিয়ে দেবেন, একথা ভাবার মতো বয়েস কিন্তু আমাদের নেই।’

কর্নেল খবরকাগজগুলো ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু ডাক্তার ওগুলো নিতে রাজি হল না।

‘ওগুলো আপনি বাড়ি নিয়ে যান’, ডাক্তার বললেন, ‘আজ রাতে পড়ে নেবেন, আমাকে কাল ফিরিয়ে দিলেই হবে।’

সাতটার একটু পরে মিনারের ঘণ্টা বেজে সিনেমার শ্রেণীটাকে বুঝিয়ে দিলো। ফাদার আনহেল এই ঘণ্টাটা বাজিয়েই কোনো সিনেমার নৈতিক শ্রেণীটা বুঝিয়ে দেন--ডাকে প্রতি মাসেই তাঁর কাছে সেন্সরের শ্রেণীমান আসে। কর্নেলের স্ত্রী বারোটা ঘণ্টার শব্দ গুণলেন।

‘কারুরই দেখার যোগ্য নয়’, তিনি বললেন। ‘প্রায় একবছর হতে চললো, সব ছবিই সবার দেখার অযোগ্য।’

মশারিটা ফেলে দিয়ে আপনমনে তিনি বললেন, ‘জগৎটাই বদ।’ কিন্তু কর্নেল কোনো হুঁ-হাঁ করলেন না। শুয়ে পড়ার আগে মোরগটাকে নিয়ে এসে তিনি খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে দিলেন। বাড়িটার দরজা-জানলায় খিল লাগিয়ে শোবার ঘরে এসে তিনি কিছুটা পোকামারা ওষুধ ছিটিয়ে দিলেন। তারপর বাতিটা মেঝেতে রেখে, তাঁর দড়ির খাট টানিয়ে নিলেন, এবং খবরের কাগজগুলো পড়তে শুয়ে পড়লেন।

কাগজগুলো পড়লেন কালানুক্রমিকভাবে অনুযায়ী, প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত, বিজ্ঞাপনগুলোসহ। এগারোটার সময় তূরীর শব্দে কারফিউ জানান দিল। কর্নেল আরো আধঘণ্টা পরে তাঁর পড়া শেষ করলেন, দুর্ভেদ্য রাতটার মধ্যে পেছনের বারান্দার দরজা খুলে দেয়ালের গায়ে হিসি করলেন, মশারা হিসি করার সময় তাঁকে আক্রমণ করল। শোবার ঘরে যখন ফিরলেন, তখন তাঁর স্ত্রী জেগে উঠেছেন।

‘প্রাক্তন সৈন্যদের কথা কিছু নেই ?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

‘না’। বললেন কর্নেল। দড়ির খাটে উঠে পড়ার আগে তিনি বাতিটা নিভিয়ে দিলেন। ‘প্রথমদিকে অন্তত নতুন কারা কারা পেনশন পেলো তাদের নাম ছাপাতো। কিন্তু পাঁচ বছর হয়ে গেলো, ওরা কিচ্ছুই বলছে না।’

মাঝরাতের পরে বৃষ্টি নামলো। কর্নেল কোনোক্রমে ঘুমিয়ে পরেছিলেন, কিন্তু পরমুহূর্তেই জেগে উঠলেন, তাঁর পেটের অন্ত্রের বিপদ সংকেতে। তিনি আবিষ্কার করলেন, ঘরের ছাদের কোনো-একটা জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। কান পর্যন্ত একটা পশমের চাদরে মুড়ে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই তিনি বের করবার চেষ্টা করলেন ছিদ্রটা কোথায়। হিমজমাট ঘামের একটা ফোঁটা তাঁর মেরুদ- বেয়ে গড়িয়ে নামলো। তাঁর জ্বর এসে গেছে। তাঁর মনে হলো একটা জেলির পুকুরের মধ্যে তিনি ক্রমাগত ছোটো-হতে-থাকা বৃত্তের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ভাসছেন। কে যেন কথা বলল। কর্নেল উত্তর দিলেন তাঁর বিদ্রোহীর ছোট্ট খাট থেকে।

‘কার সঙ্গে কথা বলছো?’ জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর স্ত্রী।

‘কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার শিবিরে যে ইংরেজটি বাঘের ছদ্মবেশ ধরে এসেছিলো’, কর্নেল উত্তর দিলেন। জ্বরে পুড়তে পুড়তে ঘোরের মধ্যে পাশ ফিরলেন তিনি তাঁর দড়িরখাটে। ‘ও হলো মার্লবরোর ডিউক, মামব্রুক।’

ভোরবেলায় আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলো। খ্রিস্ট যাগ এর জন্যে দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়তেই কর্নেল তাঁর দড়িরখাট থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে নিজেকে দাঁড় করালেন এক জটপাকানো বাস্তবতায়, যেটা মোরগটার কোঁকর-কো ডাকে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। তাঁর মাথাটা এখনও একইভাবে ঘুরে-ঘুরে পাক খাচ্ছে। বমি-বমি লাগছে তাঁর। বাইরে বারান্দায় গিয়ে সোজা তিনি ছুটলেন টয়লেটের দিকে, শীতকালের অস্ফুট সব ফিশফিশ আর আঁধার গন্ধের মধ্য দিয়ে। দস্তার ছাদবসানো ছোট্ট কাঠের কামরাটার ভেতরে পায়খানার এমোনিয়ার গন্ধে হাওয়া কেমন ঝিম হয়ে আছে। ঢাকাটা তুলতেই, গর্তের মধ্য থেকে মশামাছির একটা তিনকোণা মেঘ ছুটে বেরিয়ে এলো।

ওটা ছিল একটা মিথ্যা সংকেত। পালিশ না-করা কাঠের পাটাতনের ওপর উবু হয়ে বসে, কর্নেল একটা বেগ আর মোচড় এবং ঠিক প্রণালীতে পায়খার চাপের বদলে কেমন একটা ভোঁতা ব্যথা জীবন্তু হয়ে উঠেছে এখন। ‘সন্দেহ নেই আর’, আস্তে বিড়বিড় করলেন কর্নেল, ‘প্রতিবারই অক্টোবর এলে এইরকম হয়।’ আবার তিনি আস্থা আর সরল প্রত্যাশার ভঙ্গিতে উবু হয়ে বসলেন যতক্ষণ না তাঁর নাড়িভুঁড়ির মধ্যে গজানো ব্যাঙের ছাতাগুলো শান্ত হলো। তারপর তিনি মোরগটার জন্যে শোবার ঘরে এসে ঢুকলেন।

‘কাল রাতে তুমি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিলে,’ তাঁর স্ত্রী বললেন।

একসপ্তাহের লাগাতার হাঁপানির টান থেকে রেহাই পেয়ে তিনি এর মধ্যেই ঘরের মধ্যেটা গোছাতে শুরু করেছেন। কর্নেল মনে করে দেখবার চেষ্টা করলেন।

‘জ্বর না ঠিক’, মিথ্যে কথা বললেন কর্নেল। ‘ঐ মাকড়শার জালের স্বপ্নটাই আবার ঝামেলা করছিলো।’

সবসময়েই যেমন হয়, তাঁর স্ত্রী হাঁপানির টান থেকে অপরিমেয় স্নায়বিক শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছেন। সকালের মধ্যেই তিনি পুরো বাড়িটা তিনি প্রায় ওলোটপালোট করে ফেললেন। সবকিছু সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে সাজালেন ঘর। শুধু ঘড়িটা আর সেই তরুণীর ছবিটা একই জায়গায় রইলো। কর্নেলের স্ত্রী এতই রোগা, আর এমনভাবে কোচকানো শীর্ণ, যে কাপড়ের চপ্পল পায়ে, গায়ের কালো পোশাকটার সবগুলো বোতাম এঁটে, এমনভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছেন যেন তাঁর দেয়ালের মধ্য দিয়েও হাঁটবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু বারোটার আগেই খানিকটা দেহভার ফিরে পেলেন তিনি, তাঁর মানুষের ওজন। বিছানায় তিনি ছিলেন একটা ফাঁকা জমি মাত্র। এখন, ফার্ন আর বেগোনিয়ার ফুলের টবগুলোর মধ্যে তিনি যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁর উপস্থিতি যেন সারা বাড়িটায় উপচে পড়ছিল। ‘অগাস্টিনের শোকের বছরটা যদি শেষ হয়ে যেতো, আমি হয়তো গান গাইতে শুরু করতাম,’ বললেন তিনি ডেকচিটায় খুন্তি নাড়তে-নাড়তে, উষ্ণম-লের দেশে মাটিতে যা যা উৎপাদিত হয় সব কুচি কুচি করে কেটে ডেকচিতে সিদ্ধ করা হচ্ছিলো।

‘তোমরা যদি গান গাইতে ইচ্ছে করে, গাও না,’ বললেন কর্নেল। ‘গান প্লীহার পক্ষে ভালো।’

ডাক্তার এলো দুপুরের খাওয়ার পর। কর্নেল আর তাঁর স্ত্রী রান্নাঘরে বসে যখন কফি খাচ্ছেন, ডাক্তার রাস্তার দরজা ঠেলে খুলে চেঁচিয়ে বলল:

‘সবাই কি মরে গেছে না কি?’

তাকে স্বাগত জানাতে কর্নেল উঠে পড়লেন।

‘তাই তো মনে হচ্ছে, ডাক্তার,’ বসার ঘরে গিয়ে তিনি বললেন। ‘আমি চিরকাল বলেছি তোমার ঘড়ি একেবারে বাজপাখির সঙ্গে সময় মিলিয়ে চলে।’

কর্নেলের স্ত্রী চলে গেলেন শোবার ঘরে, পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত হতে। ডাক্তার বসার ঘরেই কর্নেলের সঙ্গে থেকে গেলেন। গরম সত্ত্বেও, তার নিভাঁজ সুতি কাপড়ের স্যুট থেকে সতেজ একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। কর্নেলের স্ত্রী যখন জানালেন যে তিনি এবার তৈরি, ডাক্তার কর্নেলের হাতে একটা খামের মধ্যে ভরা তিন তা কাগজ তুলে দিলে। শোবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাক্তার বলল, ‘খবরকাগজগুলো গতকাল যা ছাপেনি, এটা হচ্ছে ওগুলো।’

কর্নেলও সেটাই অনুমান করেছিলেন। দেশে কী ঘটছে না ঘটছে, এ তারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ, গোপনে বিলি করার জন্যে মিমিওগ্রাফে ছাপা। দেশের অভ্যন্তরে সামরিক প্রতিরোধের খবর তাতে উদঘাটিত। কর্নেলের নিজেকে কেমন হেরে যাওয়া মনে হল। দশ বছরের এই গোপন খবর এখনও তাঁকে শেখায়নি যে আগামী মাসের খবরটার চেয়ে চমকপ্রদ আর কিছুই চোখে পড়বে না। ডাক্তার যখন আবার বসার ঘরে ফিরে এলো, তখন তাঁর পড়া শেষ হয়েছে।

‘রোগির স্বাস্থ্য তো আমার চাইতেও ভালো,’ ডাক্তার বললে। ‘ওরকম হাঁপানির টান নিয়ে আমি একশো বছর বাঁচতে পারতাম।’

কর্নেল তার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকালেন। একটা কথাও না বলে তিনি তার হাতে খামটা ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু ডাক্তার সেটা কিছুতেই ফিরিয়ে নেবে না।

‘আরেকজন কারু কাছে চালান করে দেবেন,’ ফিসফিস করে তিনি বললেন।

কর্নেল খামটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিলেন। কর্নেলের স্ত্রী বেরিয়ে এলেন শোবার ঘর থেকে, বলতে বলতে, ‘এসব দিনগুলোর একদিনে, আমি উঠবো আর মরবো, আর তোমাকেও আমার সাথে নরকে নিয়ে যাবো, ডাক্তার।’ ডাক্তার সাড়া দিলো তার দাঁতের সেই চেনা এনামেল নিঃশব্দে বের করে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সে ছোট্ট টেবিলটার কাছে বসে পড়লো, আর তারপর ব্যাগ থেকে স্যাম্পল ওষুধের শিশিগুলো বের করলো। কর্নেলের স্ত্রী রান্নাঘরে চলে গেলেন।

‘বসো, আমি কফিটা গরম করে আনি।’

‘না, ধন্যবাদ,’ বললে ডাক্তার। ব্যবস্থাপত্রের প্যাড খুলে সেওষুধের ঠিকঠাক মাত্রাগুলো লিখে দিল। ‘আমাকে বিষ খাইয়ে মারার কোনো সুযোগ আমি আপনাকে কিছুতেই দেবো না !’

কর্নেলের স্ত্রী রান্নাঘর থেকেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। লেখা শেষ করে ডাক্তার ব্যবস্থাপত্রটা জোরে জোরে পড়ে শোনালেন, কারণ এটা সে ভালোই জানে তার হাতের লেখার পাঠোদ্ধার করার ক্ষমতা কারোর নেই। কর্নেল মন বসাবার চেষ্টা করলেন। রান্নাঘর থেকে ফিরে স্ত্রী স্বামীর মুখে আবিষ্কার করলেন গত রাত্রের ক্লান্তির ছাপ।

‘এই সকালে ওর জ্বর হয়েছিলো,’ স্বামীর দিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘গৃহযুদ্ধ নিয়ে দু ঘণ্টা যাবত সব আবোলতাবোল প্রলাপ বকছিলো।’

কর্নেল চমকে উঠলেন।

‘ওটা কোন জ্বর না,’ সংবিৎ ফিরে পেয়ে তিনি আবারও জোর দিয়ে বললেন। ‘তা ছাড়া, যেদিন বুঝবো, আমার অসুখ করেছে সেদিন আমি নিজেই নিজেকে ময়লার বাক্সে ছুঁড়ে ফেলবো।’

খবরকাগজগুলো আনতে তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন।

‘আপনার প্রশংসার জন্যে ধন্যবাদ,’ ডাক্তার বলল।

দুজনে প্লাজার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বাতাস শুকনো। গরমে রাস্তার পীচ গলতে শুরু করেছে। ডাক্তার যখন বিদায় জানালে, কর্নেল নিচু স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করলেন :

‘তোমার কাছে আমাদের কত ধার হয়েছে ডাক্তার ?’

‘এখন তো কিছুই হয়নি,’ ডাক্তার বলল, তার কাঁধে আলতো চাপড় দিয়ে আবার বলল, ‘মেরাগটা জিতলে, আমি আপনাকে মোটা বিল পাঠিয়ে দেবো।’

অগাস্টিনের সহযোদ্ধাদের ঐ গোপন চিঠিটা দেবেন বলে, কর্নেল দরজির দোকানে গিয়ে ঢুকলেন। তাঁর সহযোদ্ধারা সবাই নিহত, বা শহর থেকে বহিষ্কৃত হবার পর এটাই তাঁর একমাত্র আশ্রয় এবং তিনি এখন এমন একজন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন, শুক্রবার চিঠির জন্যে অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া যার আর কোনো কাজ নেই।

বিকেলবেলায় গরম কর্নেলের স্ত্রীর স্নায়বিক শক্তিকে তাতিয়ে দিয়েছিলো। একটা ছেড়া কাপড়ের টুকরোয় ভরা বাক্সের পাশে তিনি বারান্দার বোগোনিয়াদের মধ্যে বসেছিলেন, একেবারে কিছু-না থেকে নতুন পোশাক তৈরি করার চিরন্তন অলৌকিক কাজটায় তিনি শুরু করে দিয়েছেন। হাতার কাপড় কেটে গলাবন্ধ, পিঠের কাপড় এবং চৌকো ফালি থেকে আস্তিনের ডগা, সব একেবারে নিখুঁত হলো, যদিও কাপড়ের টুকরোগুলো ছিলো নানা রঙের। একটা ঝিঁঝি-পোকা বারান্দায় বারান্দায় বসে একটানা কিড়-র-র করে ডাকতে লাগল। সূর্যের রঙ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এলো। কিন্তু রোদ যে বোগোনিয়ার ওপর থেকে ধীরে ধীরে নেমে গেলো, তা তিনি দেখতেই পেলেন না। সন্ধের সময় কর্নেল যখন বাড়ি ফিরে এলেন, কেবল তখনই তিনি মাথা তুললেন। তারপর দু হাত দিয়ে ঘাড়টা ধরলেন, হাতের আঙুল ফোটালেন, এবং বললেন :

‘মাথাটা একেবারে তক্তার মতো আড়ষ্ট হয়ে আছে।’

‘সে তো সবসময়ই ঐরকম ছিলো,’ বললেন কর্নেল, কিন্তু তারপরেই চোখে পড়লো স্ত্রীর সারা শরীর রঙিন কাপড়ের টুকরোয় ঢাকা পড়ে গেছে। ‘তোমাকে একটা ম্যাগপাই পাখির মতো দেখাচ্ছে,’

‘তোমার কাপড় বানাতে গেলে কাউকে অর্ধেক ম্যাগপাই-ই হতে হবে,’ বললেন স্ত্রী। গলাবন্ধ আর আস্তিনের ডগা ছাড়া--সেগুলো সব একই রঙের--তিনটে ভিন্ন-ভিন্ন রঙের কাপড়ে তৈরি-করা একটা শার্ট তুলে দেখালেন তিনি। ‘কার্নিভালে তোমাকে কেবল গায়ের কোটটা খুলে নিলেই চলবে।’

সন্ধে ছটার ঘণ্টা তাঁর কথায় বাধা দিলে। ‘প্রভুর দেবদূত এসে মেরিকে জানাচ্ছেন,’ তিনি সশব্দেই শুরু করে দিলেন প্রার্থনা, আর শোবার ঘরে চলে গেলেন। মোরগটাকে দেখতে আসা স্কুলে পড়া ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে কর্নেল সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। তারপর তাঁর মনে পড়ে গেলো পরের দিনের জন্য কোন শস্য দানা নেই, এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে টাকা চাইতে তিনি শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন।

‘বড়োজোর পঞ্চাশ সেন্ট আছে,’ স্ত্রী বললেন।

পয়সাটা রেখেছিলেন জাজিমের তলায়, একটা রুমালের কোনে গিঁট দিয়ে বেঁধে। অগাস্টিনের শেলাইকলটা বিক্রি করে যা পাওয়া গিয়েছিলো, এ তারই অবশিষ্ট। নয়মাস ধরে প্রতিটি পাই পাই পয়সা হিসেব করে এই টাকাটা তাঁরা খরচ করেছেন, তাঁদের নিজেদের চাহিদা আর মোরগটার প্রয়োজন এই দুইয়ের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে। এখন শুধু দুটি বিশ সেণ্টের আর একটা দশ সেণ্টের পয়সাই পড়ে আছে।

‘এক পাউন্ড শস্যদানা কিনে নিয়ো,’ স্ত্রী বললেন, ‘বাকি পয়সায়, কালকের জন্যে কফি আর চার আউন্স পনীর।’

‘আর দরজার পথে ঝুলানোর জন্যে একটা সোনার হাতি,’ কর্নেল বলতে লাগলেন, ‘শুধু শস্যদানা কিনতেই বিয়াল্লিশ সেণ্ট লাগবে।’

তারা দুজনে একমুহূর্ত ভাবলেন। নারীটি প্রথমে বললেন, ‘মোরগটা যেহেতু একটা জীব, এবং তাই সে অপেক্ষা করতে জানে,’। কিন্তু তাঁর স্বামীর অভিব্যক্তি দেখে তাঁকে আরো চিন্তা করতে হলো। কর্নেল বিছানায় বসে আছেন, কনুই দুটি হাঁটুর ওপর, হাতের মধ্যে পয়সাগুলো টুনটুন করে বাজাচ্ছেন। ‘এটা আমার জন্যে নয়,’ একটু পরে তিনি বললেন, ‘আমার ওপর যদি নির্ভর করতো, তবে মোরগটাকে কেটেকুটে আজ রাতেই স্টু বানাতাম। পঞ্চাশ পেসো খরচ-করা বদহজম খুবই ভালো লাগতো।’ ঘাড়ের ওপর একটা মশাকে চাপড় মারার দেবার জন্য একটু থামলেন। তারপর তাঁর চোখের দৃষ্টি ঘরের মধ্যে তাঁর স্ত্রীর চলাফেরা অনুসরণ করলো।

‘আমার যেটা খারাপ লাগছে তা হলো ওই বেচারা ছেলেগুলো পয়সা জমাচ্ছে।’ এরপর স্ত্রীও ভাবতে শুরু করলেন। পোকামারা বোমা নিয়ে তিনি পুরো ঘুরে গেলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে কর্নেলের সবটাই কেমন অবাস্তব বলে মনে হলো, যেন পরামর্শ চাইবার জন্যে তাঁর স্ত্রী বাড়ির আত্মাগুলোকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। অবশেষে বোমাটা তিনি রাখলেন ছবিওলা ছোট্ট পূজাপালন পদ্ধতির বইটার ওপর, তারপর নিজের সিরাপ-রঙা চোখ রাখলেন কর্নেলের সিরাপ-রঙা চোখে স্থির রেখে তিনি বললেন,

‘শস্যদানাই কেনো। আমাদের কেমন করে চলবে, তা ভগবানই জানেন।’



‘এ হলো গিয়ে বহুপ্রসবিনী রুটির অলৌকিক ব্যাপার’, পরের সপ্তাহে প্রতিবারই টেবিলে বসে বলতেন কর্নেল। রিফু, শেলাই, জোড়া-তালি দেয়া--এর বিস্ময়কর প্রতিভার বলেই তাঁর স্ত্রী যেন কোনো টাকা ছাড়াই সংসারখরচ চালাবার অলৌকিক চাবিটা খুঁজে পেয়েছেন। অক্টোবর প্রলম্বিত করে দিল তার সন্ধি। গুমোটটা কমে গিয়ে এখন ঢুলু-ঢুলু ভাব শুরু হয়েছে। তামার মতো সূর্যের সান্ত¡না পেয়ে, কর্নেলের স্ত্রী পর-পর তিনটি বিকেল কাটালেন তাঁর চুলের জটিল পরিচর্যায়। ‘বড়ো মাস শুরু হয়ে গেছে,’ একদিন বিকেলে তাঁর স্ত্রী যখন তাঁর লম্বা নীল বেনী থেকে জটগুলো ছাড়াচ্ছেন একটা দাতপড়া চিরুনি দিয়ে, কর্নেল জানালেন। দ্বিতীয় দিন বিকেলে, কোলে একটা শাদা কাপড় নিয়ে বারান্দায় বসে, তাঁর স্ত্রী আরো একটা মিহি দাঁতের চিরুনি দিয়ে উকুন বার করছিলেন, হাঁপানির টান যখন বেড়েছিলো, তখন উকুনরাও মনের সুখে বংশবৃদ্ধি করেছিলো। সবশেষে, তিনি তাঁর চুল ধুলেন ল্যাভেন্ডারের জলে, তারপর অপেক্ষা করলেন কতক্ষণে চুল শুকায়, তারপর একটা জাল দিয়ে ঘাড়ের ওপর বেনী দুটোকে খোঁপার মতো গুটিয়ে রাখলেন। কর্নেল অপেক্ষা করে চলেছেন। রাত্তিরে, নিজের দড়ির খাটে নির্ঘুম, তিনি ভীত হয়ে শুয়ে মোরগটার ভবিষ্যতের কথা ভাবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু বুধবারে কুঁকড়োর ওজন নিলেন তারা, এবং সে বেশ ভালোই আছে।

সেইদিনই বিকেলে, অগাস্টিনের সঙ্গীরা যখন মোরগটার বিজয়উৎসবে কাল্পনিক লাভের বখরা গুণতে-গুণতে বিদায় নিল, কর্নেলের নিজেরও যথেষ্ট ভালো লাগলো! তাঁর স্ত্রী তাঁর চুল ছেঁটে দিলেন। ‘তুমি আমার বয়স একেবারে কুড়ি বছর কমিয়ে দিলে,’ হাত বুলিয়ে মাথাটা অনুভব করে বললেন কর্নেল। তাঁর স্ত্রীর মনে হলো কর্নেল সত্যি কথাটা বলছেন।

‘শরীর ভালো থাকলো আমি মরা মানুষকেও বাঁচিয়ে দিতে পারি,’ স্ত্রী বললেন।

কিন্তু নিজের ওপর তাঁর এই আস্থা টিকলো মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা। বাড়িতে আর বিক্রি করার মতো কিছুই নেই-- শুধু ঐ ঘড়িটা আর ছবি বাকি আছে। বৃহস্পতিবার রাত্তিরে, যখন সব উদ্ভাবনী বিদ্যার শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছেন দুজনে, তাঁর স্ত্রী পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁর আশঙ্কাটা বলে ফেললেন।

‘ভয় পেয়ো না,’ কর্নেল তাঁকে সান্ত¡না দিলেন। ‘আগামীকাল চিঠি আসবে।’

পরদিন ডাক্তারখানার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি লঞ্চগুলো কখন আসে, তার অপেক্ষা করছিলেন।

‘উড়োজাহাজ একটা চমৎকার জিনিস’ কর্নেলের বললেন, তাঁর চোখ চিঠির থলের ওপর স্থির। ‘তারা বলে এক রাত্তিরেই নাকি তুমি ইয়োরোপে চলে যেতে পার।’

‘তা ঠিক,’ একটা সচিত্র ম্যাগাজিন দিয়ে নিজেকে হাওয়া করতে-করতে বললে ডাক্তার। কর্নেল চোরা চোখে অনুসরণ করতে থাকলেন, লঞ্চগুলো ভেড়বার জন্যে যারা অপেক্ষা করছে, তাদের ভিড়ের মধ্যে পোস্টমাস্টারও দাঁড়িয়ে আছে, জেটিতে ভিড়লেই সে লাফিয়ে উঠবে লঞ্চে। পোস্টমাস্টারই আগে লাফিয়ে গিয়ে উঠলো। কাপ্তেনের কাছ থেকে গালা দিয়ে শীলমোহর করা একটা খাম পেলো সে, তারপর উঠে গেলো ছাতে। দুটো তেলের পিপের মধ্যে ডাকের ঝোলাটা বাঁধা।

‘তবে তার অবশ্য বিপদও আছে অনেক,’ বললেন কর্নেল। পোস্টমাস্টারকে তিনি দৃষ্টি থেকে হারিয়ে ফেলেছেন, তবে পরক্ষণেই আবার তাকে খুঁজে পেলেন, ফিরিওয়ালাদের গাড়িতে রঙিন শিশি-বোতলগুলোর মধ্যে। ‘মানবজাতি কোন দাম না দিয়ে অগ্রসর হতে পারে না।’

‘এমনকী এ অবস্থাতেও উড়োজাহাজগুলো একটা লঞ্চের চেয়ে বেশি নিরাপদ,’ বললো ডাক্তার। ‘কুড়ি হাজার ফিট ওপরে আপনি তো আবহাওয়ারও ওপরে উড়ছেন।’

‘কুড়ি হাজার ফিট,’ কর্নেলের কথাটা ফিরে আওড়ালেন, কেমন হকচকিয়ে গিয়ে, এই সংখ্যাটার মানে কী তা তাঁর অনুমানে আসেনি।

ডাক্তার যথেষ্ট কৌতুহলী হয়ে উঠল। দু-হাত দিয়ে হাতের পত্রিকাটা বিছিয়ে ধরল সে, একটুও যাতে না-কাঁপে।

‘একে বলে নিখুঁত স্থিরতা,’ সে বললে।

কিন্তু কর্নেল তখন পোস্টমাস্টারের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি থেকে ঝুলছেন। দেখলেন, একটা ফেনাওঠা গোলাপি পানীয় কিনলেন, পানীয়ের গেলাসটা তার বাঁ হাতে ধরা, ডান হাতে সে ধরে আছে চিঠির থলেটা।

‘তাছাড়া, সমুদ্রে কিছু জাহাজ নোঙর ফেলে থাকে, রাতের বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে সবসময়,’ ডাক্তার বলে চললো।

‘অত সতর্কতার জন্যেই লঞ্চের চেয়েও উড়োজাহাজ অনেক নিরাপদ।’

কর্নেল তার দিকে তাকালেন।

‘স্বভাবতই,’ তিনি বললেন, ‘একটা গালিচার মতোই নিশ্চয়ই।’

পোস্টমাস্টার সোজা তাদের দিকেই এগিয়ে এলো। কর্নেল এক পা পেছিয়ে দাঁড়ালেন, কোনো এক অপ্রতিরোধ্য উৎকণ্ঠায় বেঁধা, মোহর করা খামের গায়ে কার নাম লেখা পড়বার জন্যে চেষ্টা করতে করতে। পোস্টমাস্টার তার ঝোলা খুললো। ডাক্তারকে তার খবরকাগজের মোড়কটা দিয়ে দিলে সে, তারপর সে ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের বড়ো খামটা ছিঁড়ে খুললো, সংখ্যা ঠিক আছে কিনা গুণে দেখলো, চিঠির গায়ে পড়লো নাম-ঠিকানাগুলো। ডাক্তার তার খবরকাগজ খুললো।

‘সুয়েজ নিয়ে ঝামেলাটা এখনও চলেছে,’ সে বললে, বড়ো শিরোনামটা পড়তে পড়তে। ‘পশ্চিম এবার পিছু হটছে।’

কর্নেল শিরোনামগুলো পড়েননি। তিনি চেষ্টা করছেন পেটের মোচড়টা সামলাতে। ‘যেদিন থেকে সেন্সরশিপ শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই কাগজগুলো কেবল ইয়োরোপের কথা শোনাচ্ছে,’ তিনি বললেন। ‘ভালো হয় ইয়োরোপের লোকেরা যদি এখানে চলে আসে আর আমরা যদি ইয়োরোপে চলে যাই। তাতে সকলেই জানতে পেতো তার নিজের দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে।’

‘ইয়োরোপের লোকের কাছে, দক্ষিণ আমেরিকা হলো এমন একটা লোক যার আছে গোঁফ, গিটার আর বন্দুক,’ তার খবরকাগজের আড়াল থেকে হেসে বললে ডাক্তার। ‘ওরা সমস্যাটা বোঝেই না।’

পোস্টমাস্টার তার ডাক বিলি করে দিলো। তারপর বাকি সব থলেতে ঢুকিয়ে আবার থলের মুখ বন্ধ করে দিলো। ডাক্তার দুটো ব্যক্তিগত চিঠিতে চোখ বোলাবার উদ্যোগ করলো, কিন্তু খামের মুখ ছেঁড়বার আগে সে একবার কর্নেলের দিকে তাকালো। তারপর তাকালে পোস্টমাস্টারের দিকে।

‘কর্নেলের জন্যে কিছু নেই?’

কর্নেল আতঙ্কে স্তম্ভিত। পোস্টমাস্টার তার কাঁধে থলেটা চাপিয়ে পাটাতন থেকে নেমে পড়লো, ঘাড় না-ফিরিয়েই বলল : ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না।’

অভ্যেসমতো, কর্নেল সরাসরি আর বাড়ি ফিরলেন না। দরজির দোকানে অগাস্টিনের বন্ধুরা যতক্ষণ খবরকাগজগুলোর পাতা ওলটালে, তিনি বসে-বসে এক পেয়ালা কফি খেলেন। নিজেকে খুব প্রবঞ্চিত মনে হচ্ছে । পরের শুক্রবার পর্যন্ত এখানেই থেকে যেতে পারলে ভালো হতো, তাহলে আর খালি হাতে আর রাতে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু দরজির দোকান যখন বন্ধ হয়ে গেলো, তাঁকে বাস্তবের মুখোমুখি হতেই হলো। তাঁর স্ত্রী তাঁর জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন।

‘কিছু নেই?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কিচ্ছু না,’ কর্নেল উত্তর দিলেন।

পরের শুক্রবার আবার তিনি লঞ্চঘাটায় গেলেন। আর, প্রতিটি শুক্রবারের মতোই, প্রার্থিত চিঠিটা ছাড়াই তিনি বাড়ি ফিরে এলেন। ‘অনেক অপেক্ষা করেছি আমরা,’ সেই রাতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন। ‘পনেরো বছর ধরে একটা চিঠির জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হলে ষাঁড়ের মতো ধৈর্য লাগে-- তোমার যেমন আছে।’ কর্নেল খবরকাগজগুলো পড়তে দড়ির খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

‘আমাদের পালা আসা পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতে হবে,’ তিনি বললেন। ‘আমাদের নম্বর ১৮২৩।’

‘আমরা যতদিন থেকে অপেক্ষা করছি, ততদিনে ও নম্বরটা দুইবার এসে গেছে লটারিতে,’ তাঁর স্ত্রী উত্তর দিলেন।

কর্নেল, যথারীতি, প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অব্দি কাগজ পড়লেন, বিজ্ঞাপনগুলো শুদ্ধ। কিন্তু এবারে তিনি আর মন বসাতে পারলেন না। পড়তে-পড়তে তিনি ভাবলেন তাঁর পেনশনের কথা। উনিশ বছর আগে, কংগ্রেস যখন আইনটা পাশ করেছিলো, তাঁর আট বছর লেগেছিলো নিজের দাবিটা প্রতিষ্ঠা করতে। তারপর লেগেছিলো আরো ছ-বছর, যুদ্ধ ফেরৎ সৈন্যদের খাতায় তাঁর নামটা ওঠাতে। সেটাই শেষ চিঠি পেয়েছেন কর্নেল।

কারফিউ-এর তূরী বাজলে তিনি পড়া শেষ করলেন। তিনি যখন বাতি নিভিয়ে দিলেন, তখন টের পেলেন যে তাঁর স্ত্রী তখনও জেগে আছেন।

‘তোমার কাছে সেই কাগজ থেকে কাটা খবরটা আছে তো?’

তার স্ত্রী একটু ভাবলেন।

‘হ্যাঁ। সে নিশ্চয়ই অন্যসব কাগজের মধ্যেই আছে।’

তিনি মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন, কাপড় রাখার আলমারি থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে আনলেন, একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে একগোছা চিঠি বাঁধা, তারিখ অনুযায়ী পরপর সাজানো। তিনি বিজ্ঞাপনটা খুঁজে পেলেন, আইনজীবীদের এক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, তারা যুদ্ধ-ফেরৎ সৈন্যদের পেনশন তাড়াতাড়ি জুটিয়ে দিতে পারবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

‘তোমাকে উকিল পালটাবার কথা বলে যত সময় নষ্ট করেছি, ততদিনে ওই টাকাটা আমরা খরচ করে ফেলতে পারতাম,’ খবরকাগজ থেকে কাটা বিজ্ঞাপনটা স্বামীর হাতে তুলে দিতে-দিতে তিনি বললেন। ‘ইন্ডিয়ানদের যেমন করে তাকে তুলে রাখে ওরা, তেমনিভাবে আমাদেরও একপাশে ঠেলে রেখেছে। এতে আমাদের কোনোই লাভ হচ্ছে না।’

দুবছর আগেকার তারিখ দেয়া বিজ্ঞাপনটা পড়লেন কর্নেল।

দরজার আড়ালে তাঁর কোটের পকেটে সেটা তিনি ঢুকিয়ে রাখলেন।

‘উকিল পালটাতে গেলে টাকা লাগে যে, সেটাই তো মুশকিল।’

‘মোটেই না,’ তাঁর স্ত্রী স্থিরভাবে বললেন। ‘তুমি ওদের লিখে দাও যে পেনশনটা পাবার পর তারা যেন তাদের দালালি কেটে নেয়। শুধু তাহলেই তারা মামলাটা হাতে নেবার গরজ দেখাবে।’

তাই শনিবার বিকেলে কর্নেল তাঁর উকিলের খোঁজে বেরুলেন। সে একটা দড়ির খাটে অলসভাবে গড়াচ্ছিলো। সে এক বিশালদেহ নিগ্রো, তার ওপরের পাটিতে শুধু দুটো শ্বদন্তই আছে এখন। উকিল একজোড়া কাঠের খড়ম পায়ে দিল, তারপর তার অফিস ঘরের জানলা খুললো, একটা ধূলিধূসর পিয়ানোলা পড়ে আছে জানালার তলায়, খোপে-খোপে যত রাজ্যের কাগজের তাড়া ঠাসা : ‘সরকারি গেজেটের কাটা টুকরো, পুরোনো হিসেবের খাতায় আঠা দিয়ে লাগানো, আর একরাশ হিসেব পত্রের কানুননামা।’ রীড হারানো পিয়ানোলাটাই তার ডেস্ক হিশেবে আরেক বার ব্যবহৃত হয়। উকিল একটা রকিং চেয়ারে বসলো। দেখা করার কারণটা বলার আগে কর্নেল তাঁর অস্বস্তি প্রকাশ করলেন।

‘আগেই তো আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম, এ নেহাৎ কয়েকদিনের মামলা নয়,’ কর্নেল থামলে উকিল তাঁকে বলল। সে গরমে হাঁসফাঁস করছিল। চেয়ারটা পেছনে হেলিয়ে সে একটা বিজ্ঞাপনের ব্রশিওর দিয়ে নিজেকে হাওয়া করতে লাগলো।

‘আমার মুহুরীরা প্রায়ই চিঠি লেখে-- অধৈর্য হতে বারণ করে!’

‘পনেরো বছর ধরেই তো এই অবস্থা চলেছে,’ কর্নেল উত্তর দিলেন।’ ‘এ যে দেখছি একটা খাসি-করা মোরগের গল্প হতে চললো।’

উকিল সরকারি অফিসের ভিতর বাইরের একটা নিখুঁত বিবরণ দিল। তার থলথলে পাছার তুলনায় চেয়ারটা অনেক ছোটো। ‘পনেরো বছর আগে ব্যাপারটা আরো সহজ ছিলো,’ সে বললে। ‘তখন শহরে একটা যুদ্ধ-ফেরৎ সৈন্যদের সংগঠন ছিলো, তাতে দুই দলেরই লোক ছিলো।’ তার ফুসফুস ঐ গুমোট হাওয়ায় ভরে গেছে। এমনভাবে সে কথাটা বললে যেন এটা সে এক্ষুনি উদ্ভাবন করেছে : ‘সংখ্যাতেই তো শক্তি।’

‘এ ক্ষেত্রে তা ছিলো না,’ কর্নেল এই প্রথম তাঁর নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করতে পারলেন। ‘আমার সব সহযোদ্ধাই চিঠির জন্য অপেক্ষা করে করে অনেক আগেই মারা গেছেন।’

উকিল মুখের অভিব্যক্তি পালটালো না।

‘আইনটি অনেক দেরি করে পাশ হল,’ বলল উকিল, ‘সকলের তো আর আপনার মতো বিশ বছর বয়েসে কর্নেল হবার মতো সৌভাগ্য হয় না। এছাড়া কোনো বিশেষ মঞ্জুরির কথাও সংযুক্তি নেই, কাজেই সরকারকে বাজেটে অনেক সমন্বয় করতে হয়েছে।’

সবসময় সেই একই গল্প। প্রত্যেকবার তার কথা শুনতে গিয়ে কর্নেল একটা চাপা বীতরাগ অনুভব করেছেন। ‘এ তো আর কোনো দান-ধ্যান নয়,’ তিনি বললেন। ‘আমাদের কোনো দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে আমি বলছি না। প্রজাতন্ত্রকে বাঁচাবার জন্যে আমরা আমাদের শিরদাঁড়া ভেঙেছি।’

উকিল দু-হাত ছুঁড়লো শূন্যে।

‘এটাই নিয়ম,’ সে বলল, ‘মানুষের অকৃতজ্ঞতার কোনো সীমা নেই।’

কর্নেল নিজেও এই গল্পটা জানেন। গল্পটা তিনি শুনতে শুরু করেছিলেন নীয়ারলান্দিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার পরদিন থেকেই, যখন সরকার দুশোজন বিপ্লবী অফিসারকে রাহাখরচ আনুষঙ্গিক ভাতা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। নীয়ারলান্দিয়ার বিশাল রেশম-কার্পাস গাছের তলায় ছাউনি ফেলেছিলো বিপ্লবীদের একটা বাহিনী, বেশির ভাগই ছিলো সদ্য হাইস্কুল থেকে বেরুনো তরুণ ছেলে, তিন মাস ধরে তারা অপেক্ষা করেছিলো। তারপর তারা সবাই যে যার নিজের উপায়ে বাড়ি ফিরে যায়, আর সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রায় ষাট বছর হয়ে গেলো, কর্নেল এখনও অপেক্ষা করেই আছেন।

এসব স্মৃতিতে খানিকটা উত্তেজিত হয়ে তিনি এক ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ভাব বোধ করলেন। উরুর ওপর-- সে-উরু কেবল পেশী দিয়ে সেলাই করা কিছু হাড়গোড় ছাড়া আর কিছু নয়-- উরুর ওপর ডান হাত রেখে, তিনি মৃদুস্বরে বললেন:

‘ঠিক আছে, আমি একটা কাজ করবো বলে ঠিক করেছি।’

উকিল কথাটা শোনার অপেক্ষা করতে লাগলো।

‘যেমন?’

‘উকিল পালটাবো।’

একটা মা হাঁস, তার পেছন পেছন তিনটি বাচ্চা, অফিস ঘরে এসে ঢুকলো, তাদের তাড়িয়ে দেবার জন্যে উঠে বসল উকিল। ‘সে আপনি যা ভালো বোঝেন, কর্নেল।’ হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে দিতে-দিতে সে বলল, ‘এটা আপনি যা ভালো বুঝবেন ঠিক তাই করবেন। আমি যদি অলৌকিক কিছু করতে পারতাম, তাহলে আমি আর এই খোঁয়াড়টায় থাকতাম না।’ বারান্দার দরজায় একটা কাঠের জাল বসিয়ে রেখে সে তার চেয়ারে ফিরে এলো।

‘আমার ছেলেটা সারা জীবন খেটেই গেলো,’ বললেন কর্নেল। ‘আমার বাড়িটা বাঁধা দেয়া। ঐ পেনশনের আইনটা উকিলদেরই সারা জীবনের পেনশন হয়ে উঠেছে।’

‘আমার জন্যে নয়,’ উকিল প্রতিবাদ জানালে। ‘শেষ কপর্দকটা পর্যন্ত মামলার খরচ মেটাতে গেছে।’

যেন তিনি কোনো অন্যায্য কথা বলেছেন এই ভেবে কর্নেল দুঃখ পেলেন।

‘আমি তো সেকথাই বলতে চাচ্ছি,’ নিজেকে সংশোধন কর্নেল। জামার হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। ‘এই গরমে মাথার সব স্ক্রুতেই জং ধরে যায়।’

পরের মুহূর্তে উকিল পাওয়ার অভ অ্যাটর্নিটা খুঁজতে গিয়ে পুরো অফিসটা উল্টেপাল্টে ফেলল। সূর্য এগিয়ে এলো ছোট্ট ঘরটার ঠিক মাঝখানে-- পালিশ না-করা কতগুলো তক্তা দিয়ে ঘরটা বানানো। সবখানে সকল কোণায় ব্যর্থভাবে খোঁজবার পর, উকিল হামাগুড়ি দিতে লাগলো, হাঁসফাঁস করছে সে, তারপর পিয়ানোলাটার নীচ থেকে এক বান্ডিল কাগজ তুলে নিল।

‘এই যে, এটা এখানে।’

সে একটা সীল মারা কাগজ তুলে দিল কর্নেলের হাতে। ‘আমার মুহুরিদের লিখে দিতে হবে, যাতে বাকি নকলগুলো তারা নষ্ট করে ফ্যালে।’ শেষ কথা জানাল সে। কর্নেল কাগজটা থেকে ধুলো ঝেড়ে শার্টের পকেটে রেখে দিলেন।

‘আপনি নিজের হাতেই ওটা ছিঁড়ে ফেলুন,’ বললে উকিল।

‘না,’ কর্নেল উত্তর দিলেন। ‘এ হলো কুড়ি বছরের স্মৃতি।’ তিনি অপেক্ষা করলেন উকিল যাতে আরো খোঁজে, কিন্তু সে তা করলে না, সে চলে গেলো তার দড়ির খাটে, গায়ের ঘাম মুছে ফেলতে। সেখান থেকে সে তপ্ত হাওয়ার ভাপের পর্দার মধ্য দিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল।

‘আমার তো দলিলগুলোও চাই,’ বললেন কর্নেল।

‘কোনগুলো?’

‘দাবিটার প্রমাণপত্র।’

উকিল দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ল।

‘কিন্তু এখন তো তা অসম্ভব, কর্নেল।’

কর্নেল আতঙ্কে ভরে গেলেন। মাকোন্দো জেলার বিপ্লবী তহবিলের খাঞ্ঝাচি হিশেবে তিনি গৃহযুদ্ধের সব টাকাকড়ি একটা খচ্চরের পিঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে, ছ-দিনের এক বিপদপূর্ণ যাত্রায় বেরিয়েছিলেন। নীয়ারলান্দিয়ার ছাউনিতে তিনি পৌঁছেছিলেন খচ্চরটাকে টানতে-টানতে-- খিদেয় খচ্চরটা মরেই গিয়েছিলো-- সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার আধঘণ্টা আগে। আটলান্টিক উপকূলের বিপ্লবী বাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তহবিলের জন্যে রশিদ দিয়েছিলেন, তারপর বিপ্লবীদের যাবতীয় বস্তুর তালিকায় ও-দুটো ট্রাঙ্ককেও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

‘ঐ দলিলগুলোর যে অপরিমেয় মূল্য,’ বললেন কর্নেল। ‘কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার নিজের হাতে লেখা একটা রশিদ ছিলো তাতে।’

‘তা মানি,’ বললে উকিল। ‘কিন্তু ও-সব দলিল তো এতদিনে হাজার লক্ষ হাত ঘুরে ভগবান জানে যুদ্ধমন্ত্রণালয়ের কোন দপ্তরে গিয়ে পৌঁছেছে।’

‘ওরকম কোনো দলিল কোনো কর্মচারীর নজরে না পড়েই পারে না,’ কর্নেল বললেন।

‘কিন্তু গত পনেরো বছরে আমলারাই তো বদল হলো কতবার,’ উকিল বুঝিয়ে বলল। ‘একবার ভেবে দেখুন: মাঝখানে এসেছেন-গেছেন সাত-সাতজন রাষ্ট্রপতি, এবং সব রাষ্ট্রপতিই অন্তত দশবার করে তাঁর মন্ত্রীসভার খোলনলচে পালটেছেন, এবং প্রত্যেক মন্ত্রী অন্তত একশোবার করে পালটেছে তার কর্মচারীদের।’

‘কিন্তু দলিলগুলো তো আর কেউ বাড়ি নিয়ে যায়নি,’ বললেন কর্নেল। ‘প্রত্যেক নতুন আমলাই নিশ্চয়ই ফাইলের মধ্যে সেগুলো পেয়েছে।’

উকিল এবার তার ধৈর্য হারাল।

‘এছাড়া, ওসব কাগজ যদি একবার এখন মন্ত্রীদপ্তর থেকে বার করে আনা হয়, তবে আবার একটা নতুন ক্রমিক নম্বর বসানো হবে তাতে।’

‘তাতে কিছুই এসে যায় না,’ বললেন কর্নেল।

‘এতে তো অনেক শতাব্দী লেগে যাবে।’

‘তাতে কিছুই এসে যায় না। বড়োকিছুর জন্যে যদি অপেক্ষা করতে পারে কেউ, তবে ছোটোখাটো সব জিনিসের জন্যেও অপেক্ষা করা যায়।’



রুলটানা কাগজে একটা প্যাড, দোয়াত আর চোষকাগজ নিয়ে এসে তিনি বসার ঘরের ছোট্ট টেবিলটায় চলে এলেন-- শোবার ঘরের দরজা তিনি খোলাই রেখেছেন, যদি স্ত্রীকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয়। তাঁর স্ত্রী জপের মালা ঘোরাতে ঘোরাতে জপ করছিলেন তখন।

‘আজ কত তারিখ?’

‘সাতাশে অক্টোবর।’

খুব ধীরে ধীরে গোটা গোটা হরফে লিখলেন তিনি, যে হাতটায় কলম ধরা সেটা চোষকাগজের ওপর বসানো, শিরদাঁড়া সোজা, যাতে শ্বাসপ্রশ্বাসের সুবিধে হয়, ঠিক যেমনটা তাঁকে স্কুলে শেখানো হয়েছিলো। বন্ধ বসার ঘরটায় ভ্যাপসা ভাব অসহ্য হয়ে উঠেছে। একফোঁটা ঘাম পড়লো চিঠির ওপর। কর্নেল চোষকাগজ দিয়ে সেটা শুষে নিলেন। তারপর তিনি যে-সব হরফ ঝাপসা হয়ে গেছে সেগুলো মুছবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মাঝখান থেকে সেগুলো লেপটে গেলো কাগজে। তিনি ধৈর্য হারালেন না মোটেই। পাশে একটা তারা এঁকে মার্জিনে লিখলেন, ‘অর্জিত অধিকার’। তারপর তিনি আস্ত অনুচ্ছেদটাই পড়লেন।

‘কবে আমার নাম উঠেছিলো তালিকায়?’

তাঁর স্ত্রী ভেবে দেখার জন্যে জপ থামালেন না।

‘বারোই আগস্ট, ১৯৪৯।’

পরক্ষণেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। কর্নেল একটা গোটা পাতা আঁকিবুঁকি কেটে ভর্তি করলেন, ঠিক যে-সব আঁকিবুঁকি তিনি শিখেছিলেন মানাউর এর পাবলিক স্কুলে। তারপরে তিনি দ্বিতীয় একটা পাতার একেবারে মাঝখান অব্দি লিখে নিজের নাম সই করলেন।

স্ত্রীকে তিনি চিঠিটা পড়ে শোনালেন। তাঁর স্ত্রী ঘাড় নেড়ে প্রতিটি বাক্যই মঞ্জুর করলেন। পড়া শেষ করে কর্নেল খামটা সীল করে বাতি নিভিয়ে দিলেন।

‘কাউকে তোমার জন্য এটাকে কাউকে টাইপ করে দিতে বলা উচিত।’

‘না,’ কর্নেল উত্তর দিলেন। ‘লোকের কাছে ঘুরে সুবিধা নিতে নিতে আমি একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছি।’

তালপাতার ছাউনির ওপর বৃষ্টি পড়ছে, আধঘণ্টা ধরে সে শব্দ শুনলেন তিনি। শহরটা এক প্লাবনে ডুবে গেলো। কারফিউ যখন বাজলো, বাড়ির কোথাও একটা ছিদ্র দিয়ে জল পড়তে শুরু করলো।

‘অনেকদিন আগেই এ-কাজটা করা উচিত ছিলো,’ তাঁর স্ত্রী বললেন। ‘নিজের কাজ নিজে করাই সবসময় ভালো।’

‘কখনোই বেশি দেরি হয়ে যায় না,’ ছিদ্রটার দিকে মনোযোগ দিতে-দিতে কর্নেল বললেন। ‘হয়তো বাড়িটার কিস্তির টাকা দেবার সময় ব্যাপারটা চুকে যাবে।’

‘সে তো দু বছর,’ তার স্ত্রী বললেন।

কর্নেল বাতিটা জ্বাললেন, বসার ঘরে কোথায় ছিদ্র হয়েছে দেখতে। তিনি মুরগীটার জলের পাত্রটা রাখলেন ছিদ্রের তলায়, তারপর আবার শোবার ঘরে ফিরে এলেন, ফাঁকা পাত্রটার ওপর জল পড়ার ধাতব আওয়াজ তাঁর পিছনে ধাওয়া করে এলো ।

‘সুদটা বাঁচাবার জন্যে ওরা হয়তো জানুয়ারির আগেই সব চুকিয়ে-বুকিয়ে দিতে চাইবে।’ তিনি বললেন, আর বলে নিজেকে কথাটা বিশ্বাস করালেন, ‘ততদিনে, অগাস্টিনের মৃত্যুরও একবছর হয়ে যাবে, আর আমরাও আবার সিনেমা দেখতে যেতে পারবো।’

তাঁর স্ত্রী দম নেবার অবসরে হেসে উঠলেন। ‘আমার আর কার্টুনগুলোর কথা মনেও পড়ে না,’ তিনি বললেন। ‘ওরা “মৃত মানুষের উইল” বলে একটা ছবি দেখাচ্ছিল।’

‘মারামারি ছিলে তাতে ?’

‘আমরা তা দেখতেই পারিনি। ভূত এসে যেই নায়িকার গলার হার ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ঝড় ভেঙ্গে পড়ে।’

বৃষ্টির শব্দ তাঁদের ঘুম পাড়ালো। কর্নেল তাঁর পেটের মধ্যে সামান্য অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ভয় পাননি। আরো একটা অক্টোবর প্রায় টিঁকে গিয়েছেন। একটা পশমি চাদর গায়ে জড়িয়ে একমুহূর্ত শুধু তাঁর স্ত্রীর গভীর ঘড়ঘড় নিশ্বাস নেবার শব্দ শুনলেন-- অনেক দূর থেকে যেন-- তারপর আরেকটা স্বপ্নের মধ্যে ভেসে এলেন। এরপর তিনি কথা বললেন, সম্পূর্ণ সচেতন।

তাঁর স্ত্রী জেগে উঠলেন।

‘তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো?’

‘কারু সঙ্গে না।’ বললেন কর্নেল। ‘ভাবছিলুম যে মাকোন্দোর সেই সভায় আমরা যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে আত্মসমর্পণ করতে বারণ করেছিলাম, আমরা ঠিক কথাই বলেছিলাম। অই থেকেই সবকিছু ধ্বংস হতে শুরু করেছে।’

বৃষ্টি পড়লো সারা সপ্তাহ ধরে। নভেম্বরের দ্বিতীয় দিন-- কর্নেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে-- তাঁর স্ত্রী ফুল নিয়ে গেলেন অগাস্টিনের কবরে। কবরখানা থেকে ফিরেই আরেকবার হাঁপানির টান উঠলো তাঁর। এটা ছিল খুবই কঠিন একটা সপ্তাহ। অক্টোবরের কঠিন চারটি সপ্তাহের চেয়েও কঠিন-- আর তখনই কর্নেল ভেবেছিলেন এবারে তিনি আর বাঁচবেন না। ডাক্তার অসুস্থ ভদ্রমহিলাকে দেখতে এলেন, আর ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলেন: ‘ও রকম হাঁপানি থাকলে আমি পুরো শহরটাকেই কবর দিয়ে দিতে পারতাম!’ কিন্তু তিনি কর্নেলের সঙ্গে আড়ালে একা কথা বললেন, আর একটা বিশেষ পথ্য লিখে দিলেন।

কর্নেলেরও আবার ভীষণরকম শরীর খারাপ করলো । অনেক ঘণ্টা পায়খানায় থাকতে হল, বরফশীতল ঘামের মধ্যে, এমন মনে হচ্ছিল যেন তিনি পচে যাচ্ছেন, এবং তাঁর অন্ত্রের মধ্যে লতাপাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাঁকে খাচ্ছে। ‘শীতকাল,’ ধৈর্যের সঙ্গে কথাটা তিনি বার বার বললেন। ‘বৃষ্টি একবার থামলেই সবকিছু বদলে যাবে।’ আর তিনি, সত্যি-বলতে, বিশ্বাসও করলেন কথাটা, এটা নিশ্চিত চিঠিটা যখন এসে পৌঁছুবে, তখনও তিনি বেঁচে থাকবেন।

এবার তিনিই সংসারের অর্থনীতিটায় জোড়াতালি লাগালেন। পাড়ার দোকানে ধার চাইবার আগে কতবার তাঁকে দাঁতে দাঁত চাপতে হলো। ‘আসছে হপ্তা অব্দিই শুধু,’ বলতেন তিনি, কথাটা সত্যি কিনা সে সম্বন্ধে নিজেরই বিশ্বাস থাকতো না। ‘গত শুক্রবারেই অল্পকিছু টাকা আসার কথা ছিলো।’ যখন স্ত্রীর হাঁপানির টান কমে গেলো, স্ত্রী তাঁকে যেন বিভীষিকা নিয়ে নীরিক্ষা করলেন।

‘চামড়া এবং হাড় ছাড়া আর কিছুই তো নেই তোমার।’ স্ত্রী বললেন।

‘নিজেকে যাতে বেঁচতে পারি সেইজন্যে খুবই যতœ নিচ্ছি শরীরের,’ কর্নেল বললেন। ‘একটা ক্লারিওনেট কারখানায় এর মধ্যেই আমায় চাকরি দিয়েছে।’

কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, চিঠির আশাটাও তাঁকে আর বাঁচাতে পারছিলো না যেন। অবসন্ন, তাঁর হাড়গোড় অনিদ্রায় ব্যথা করছে, তিনি একই সঙ্গে মুরগীটা আর নিজের দেখাশোনা করতে পারছিলেন না আর। নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর মনে হলো দুদিন শস্যদানা না পেলে প্রাণীটা বুঝি মরেই যাবে। এরপর তাঁর মনে পড়লো জুলাই মাসে তিনি একমুঠো সীমবিচি চিমনিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। খোশা ছাড়িয়ে শুকনো শুঁটিগুলো তিনি মোরগটার সামনে বাটিতে বিছিয়ে দিলেন।

‘এদিকে এসো,’ স্ত্রী বললেন।

‘এক মিনিট,’ কর্নেল উত্তর করলেন, মুরগীটার প্রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে। ‘ভিখারি তো আর বাছাই করতে পারে না।’

গিয়ে দখতে পেলেন, তাঁর স্ত্রী বিছানায় উঠে বসবার চেষ্টা করছেন। তাঁর দলাপাকানো নড়বড়ে শরীরটা থেকে ওষুধের গন্ধ বের হচ্ছে। তাঁর স্ত্রী একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে, হিসেব করে, কথাটা বললেন,

‘এক্ষুণি এই মুরগীটাকে সরাও।’

এই মুহূর্তটাকে কর্নেল আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। যেদিন বিকেলে তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেইদিন থেকেই তিনি এ মুহূর্তটার অপেক্ষা করছিলেন, আর ঠিক করেছিলেন মোরগটাকে তিনি নিজের কাছে রাখবেন। ভালোভাবে ভেবে দেখবার অনেক সময় পেয়েছেন তিনি।

‘এখন এটার তত দাম নেই’ তিনি বললেন। ‘দু মাসের মধ্যেই লড়াইটা হবে, এরপর আমরা এটাকে ভালো দামে বেচতে পারব।’

‘এটা টাকার প্রশ্ন নয়,’ স্ত্রী বললেন। ‘ছেলেরা এলে ওদের এটা নিতে যেতে বলো, এবং এরপর ওরা ওটার সঙ্গে যা ইচ্ছা করুক।’

‘এটা তো অগাস্টিনের জন্যেই,’ কর্নেল তাঁর তৈরি-করা যুক্তিটাকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘ওর মুখটা মনে কর বাড়ি ফিরে যখন বলতো যে মুরগীটা জিতেছে।

মহিলা, সত্যিই, ছেলের কথাই ভেবেছিলেন।

‘ঐ জঘন্য মোরগগুলোই ওকে শেষ করেছে।’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি। ‘ও যদি তেসরা জানুয়ারি বাড়িতে থাকতো, তার ঐ মৃত্যু মুহূর্ত কখনো আসতো না।’ শুকনো তর্জনীটা বাড়িয়ে ধরে দরজাটা দেখিয়ে তিনি বললেন :

‘এটা এমন মনে হচ্ছে যেন আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি ও মোরগটাকে হাতের নীচে করে বাড়ি থেকে বের হচেছ। আমি ওকে বার বার করে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, মোরগের লড়াইগুলোয় গিয়ে যেন কোনো ঝামেলার মধ্যে না যায়, এবং ও আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আমাকে বলেছিলো, “থামো তো মা; আজ বিকেলে আমরা টাকার ওপর গড়াবো।”’

স্ত্রী অবসন্ন হয়ে নেতিয়ে পড়ে গেলেন। কর্নেল তাঁকে আস্তে আলতো করে বালিশের ওপর শুইয়ে দিলেন। ঠিক তাঁর নিজের চোখের মতো অন্য চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। ‘নড়াচড়া না-করার চেষ্টা করো।’ নিজের ফুসফুসে তিনি অনুভব করলেন স্ত্রীর হাঁপানির টান। স্ত্রী পড়ে আছেন সাময়িকভাবে অচৈতন্য। নারীটি তাঁর চোখের পাতা বুজে ফেলেছেন। যখন তিনি আবার, চোখের পাতা খুললেন তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে।

‘দ্যাখো তো আমাদের কী অবস্থা, একারণে বলছি’ স্ত্রী বললেন। ‘আমাদের মুখ থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে ঐ মুরগীটাকে দিলে মহাপাপ হবে।’

চাদর দিয়ে কর্নেল তাঁর স্ত্রীর কপাল মুছিয়ে দিলেন।

‘তিন মাসে কেউ মারা যায় না।’

‘এর মধ্যে আমরা খাব কী?’ জিজ্ঞাসা করলেন মহিলা।

‘জানি না,’ বললেন কর্নেল। ‘কিন্তু খিদেতেই যদি আমরা মারা যাব, তবে এর মধ্যেই আমরা মরে যেতাম।’

ফাঁকা খাবার পাত্রটার পাশে ভালোভাবেই বেঁচে ছিলো মুরগীটা। কর্নেলকে দেখেই সে প্রায় মানুষর মতো গাঁক-গাঁক করে এক-তরফা কত-কী বলে ঘাড় হেলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কর্নেল ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।

‘বেঁচে থাকাটা কঠিন, ইয়ার।’

কর্নেল রাস্তায় বেরিয়ে গেলেন। দুপুরের খাবার পর সারা শহর যখন সিয়েস্তায় ঢুলছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন, তিনি ঘুরে বেড়ালেন লক্ষ্যহীন, কিছুর কথাই তিনি আর ভাবছেন না, সমস্যাটার যে কোনো সমাধান আর নেই, একথাটাও নিজেকে বোঝাতে চাচ্ছেন না মোটেই। ভুলে যাওয়া সব অলিগলি দিয়ে হেঁটে চললেন তিনি, যতক্ষণ না তাঁর শরীর ক্লান্ত হয়ে এলো। এরপর তিনি বাড়ি ফিরলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁর বাড়ি ঢোকার শব্দ শুনতে পেয়ে তাঁকে শোবার ঘরে ডেকে পাঠালেন।

‘কী?’

তাঁর দিকে না-তাকিয়েই স্ত্রী তাঁকে বললেন :

‘আমার তো ঘড়িটা বেচে দিতে পারি।’

এ কথাটা কর্নেলও ভেবেছিলেন আগে। ‘আমি ঠিক জানি আলভারো তোমায় তক্ষুণি চল্লিশ পেসো দিয়ে দেবে,’ বললেন মহিলা। ‘ভেবে দ্যাখো কেমন তড়িঘড়ি ও শেলাইকলটা কিনে নিয়েছিলো।’

অগাস্টিন যে দরজির দোকানে কাজ করতো, তার কথাই বলছিলেন তিনি।

‘সকালেই ওর সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়,’ সায় দিলেন কর্নেল।

‘আর ঐ “সকালে কথা বলা-টলা” নয়,’ তিনি গোঁ ধ’রে বললেন। ‘ঘড়িটা এক্ষুণি নিয়ে যাও ওর কাছে। সোজা গিয়ে ঘড়িটা কাউন্টারে রেখে ওকে বলো, “আলভারো, তুমি কিনবে বলে ঘড়িটা আমি নিয়ে এসেছি।” ও তক্ষুণি ব্যাপারটা বুঝে যাবে।’

কর্নেল লজ্জায় মরে গেলেন।

‘এটা তো গির্জের বেদিটা নিয়ে ঘোরার মত ব্যাপার,’ প্রতিবাদ করলেন তিনি। ‘ও-রকম একটা দর্শনীয় জিনিস হাতে যদি আমায় কেউ দ্যাখে তো রাফায়েল এস্কালোনা অমনি আমাকে নিয়ে একটা গান বেঁধে ফেলবে।’

কিন্তু, তাঁর স্ত্রী এবারও, তাঁকে বোঝাতে পারলেন। তিনি নিজেই ঘড়িটা নামিয়ে আনলেন, সেটাকে দিলেন খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ালেন, তারপর তাঁর বাহুতে রাখলেন। ‘চল্লিশ পেসো না নিয়ে বাড়ি ফিরবে না কিন্তু,’ তিনি বললেন। কর্নেল বেরিয়ে গেলেন দরজির দোকানের উদ্দেশে, বগলে মোড়কটা। গিয়ে দ্যাখেন, অগাস্টিনের কমরেডরা দরজার ধারে বসে আছে।

তাদের একজন তাঁকে একটা বসার জায়গা করে দিল। ‘ধন্যবাদ,’ তিনি বললেন। ‘আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।’ আলভারো বেরিয়ে এলো দোকানের ভেতর থেকে। হলঘরের মধ্যে দুটো আংটার মধ্যে তার দিয়ে ঝোলানো শক্ত ডাক কাপড়ের এক ভেজা প্যান্ট, আলভারো কঠোর ধরনের অল্পবয়েসী, শক্ত পেটা শরীরটা বাঁকানো, বন্য চোখ। সেও তাঁকে বসবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল, কর্নেল স্বস্তি বোধ করলেন। দরজার গায়ে চৌকিটা পেতে তিনি বসলেন, আলভারো কতক্ষণে একা হবে, কতক্ষণে কথাটা বলবেন, তারই অপেক্ষায় থাকলেন। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন অভিব্যক্তিহীন কতগুলো মুখ তাঁকে ঘিরে আছে।

‘আমি বাধা দিইনি তো?’ তিনি বললেন।

তারা বললে, ‘না, না, মোটেই না।’ একজন তাঁর দিকে ঝুঁকে এলো। প্রায় অস্ফুট অশ্রুত স্বরে সে বললে :

‘অগাস্টিন লিখে পাঠিয়েছে।’

কর্নেল নিঃসঙ্গ রাস্তাটার দিকে তাকালেন।

‘কী লিখেছে?’

‘সেই একই কথা।’

তারা তাঁর হাতে চোরাই কাগজটা তুলে দিলে। কর্নেল সেটা তাঁর প্যান্টের পকেটে রেখে দিলেন। তারপর তিনি চুপ করে রইলেন, আঙুল দিয়ে মোড়কটার ওপর তালি দিতে দিতে তারপর হঠাৎ তাঁর নজরে এলো কেউ-একজন সেটা লক্ষ করেছে।

‘আপনার হাতে ওটা কী, কর্নেল?’

কর্নেল এরনানের লক্ষ্যভেদী সবুজ চোখ দুটিকে এড়িয়ে গেলেন।

‘কিছু না,’ মিথ্যে কথা বললেন তিনি। ‘ঐ জার্মানটার কাছে ঘড়িটা নিয়ে যাচ্ছি, সারাই করাতে।’

‘বোকার মতো কথা বলবেন না, কর্নেল,’ এরনান মোড়কটা তাঁর হাত থেকে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললে, ‘অপেক্ষা করেন, আমি এটাকে দেখে দিচ্ছি।’

কর্নেল মোড়কটা আঁকড়ে ধরলেন। টুঁ শব্দটাও করলেন না, কিন্তু তাঁর চোখের পাতা দুটো লাল হ’য়ে উঠেছে। অন্যরা জোর দিয়ে বলতে লাগলো।

‘দিন না ওকে দেখতে, কর্নেল। ও যন্ত্রটন্ত্রের ব্যাপার বোঝে।’

‘আমি শুধু শুধুই ওকে ঝামেলায় ফেলতে চাই না।’

‘ঝামেলা? মোটেই ঝামেলা নয়,’ এরনান তর্ক শুরু করল, এবং ঘড়িটা টেনে নিল। ‘জার্মানটা আপনার কাছ থেকে দশ পেসো বের করে নেবে, অথচ ঘড়িটা থেকে যাবে যেমনকে তেমন, সেই একইরকম।’

ঘড়িটা নিয়ে এরনান দরজির দোকানের ভেতরে চলে গেলো।

আলভারো একটা সেলাই কলে কী যেন সেলাই করছে। পেছনে দেয়ালে পেরেকে ঝোলানো একটা গিটারের তলায় এক মেয়ে বসে বসে বোতাম সেলাই করছে।। গিটারটার ওপরে একটা বিজ্ঞপ্তি আটকানো : ‘রাজনীতি নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ।’ বাইরে, কর্নেলের মনে হলো তাঁর শরীরটা যেন অর্থহীন। তিনি চৌকির রেলিংএ পা দুটো নির্ভার করে রাখলেন।

‘ঈশ্বরের দোহাই, কর্নেল।’

কর্নেল বিস্মিত, ‘ঈশ্বরের দোহাইয়ের দরকার নেই?’

আলফোন্সো নাকের ডগায় চশমাটা বাগিয়ে তাঁর পায়ের জুতোজোড়া নিরীক্ষণ করল।

‘আপনার ঐ জুতোজোড়া, কর্নেল,’ সে বললে, ‘আপনি দেখছি চকচকে একজোড়া নতুন জুতো পরে আছেন।’

‘কিন্তু দিব্যি না দিয়েও ও-কথা বলা যেতো,’ কর্নেল বললেন। তারপর তাঁর পেটেন্ট চামড়ার জুতোর শুকতলাটা দেখালেন তাকে। ‘এই দৈত্য জোড়া চল্লিশ বছরের পুরোনো, অথচ এই প্রথম তারা শুনলো যে কেউ ঈশ্বরের নামে দিব্যি দিচ্ছে।’

‘সব ঠিক করে দিয়েছি,’ ভেতর থেকে চেঁচাল এরনান, আর অমনি ঘড়ির ঘণ্টাগুলো বেজে উঠলো। পাশের বাড়ি থেকে একজন স্ত্রীলোক দেয়ালে আঘাত করে চেঁচিয়ে বলল :

‘গিটার বাজিও না! একবছরও হয়নি, অগাস্টিন মারা গেছে।’

কে যেন হো-হো করে হেসে উঠলো।

‘ওটা ঘড়ির শব্দ।’

এরনান মোড়কটা হাতে করে বেরিয়ে এলো।

‘কোনো গন্ডগোল নেই,’ সে বললে, ‘আপনি যদি চান তো আমি আপনার সঙ্গে বাড়ি গিয়ে টাঙিয়ে দেবো।’

কর্নেল তাঁর প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করলেন।

‘কত দিতে হবে?’

‘আরে দূর, কর্নেল,’ দলের মধ্যে জায়গা নিতে নিতে উত্তর দিল, ‘জানুয়ারি মাসে মোরগটাই সব পাওনা মিটিয়ে দেবে।’

এতক্ষন তিনি যে সুযোগটা খুঁজছিলেন, সেটা পেলেন কর্নেল।

‘তোমার সঙ্গে একটা রফা করতে পারি আমি,’ তিনি বললেন।

‘কী?’

‘আমি তোমাকে মোরগটা দিয়ে দেবো,’ কর্নেল চারপাশের মুখগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন, ‘মোরগটা আমি তোমাদের সবাইকে দিয়ে দেবো।’

এরনান তার দিকে বিমূঢ়ভাবে চেয়ে রইলো।

‘ঐ সবের জন্য আমি বড় বেশী বয়েসী,’ কর্নেল বলে চললেন। তাঁর গলার স্বরে তিনি বিশ্বাসযোগ্য গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করছেন। ‘আমার পক্ষে এ একটা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে! গত কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে মোরগটা বুঝি মরতে বসছে।

‘ও নিয়ে ভাববেন না, কর্নেল,’ বললেন আলফোন্সো, সমস্যা হচ্ছে মোরগটা এখন পালক ঝরাচ্ছে। তার ডানায় জ্বর হয়েছে।’

‘ও আসছে মাসেই সেরে যাবে,’ বলল এররান।

‘সে যাই হোক, আমি আর ওকে চাই না,’ বললেন কর্নেল।

এরনানের চোখ দুটি তাঁকে যেন ফুঁড়ে ফেলবে।

সে জোর দিয়ে বলল, ‘বিষয়টা একবার বোঝার চেষ্টা করুন, কর্নেল। অগাস্টিনের মোরগটাকে রিঙের মধ্যে আনতে হবে আপনাকে-- সেটাই প্রধান কাজ।’

কর্নেল ভেবে দেখলেন কথাটা, ‘সে আমি বুঝি,’ তিনি বললেন, ‘সেই জন্যেই এতোদিন তাকে নিজের কাছে রেখেছি।’ তিনি দাঁতে দাঁত চাপলেন, অনুভব করলেন বাকি কথাটাও এবার বলতে পারবেন। ‘সমস্যা হচ্ছে এখনও যে দু-দুটো মাস বাকি।’

সবার মধ্যে শুধু এরনান একাই ব্যাপারটা বুঝতে পারলে।

‘শুধু সেটাই কারণ হয়, তবে কোনো সমস্যা হবে না,’ সে বলল।

আর সে তার তত্ত্বটা বুঝিয়ে বলল। অন্যরাও তা মেনে নিল। সন্ধেবেলায় তিনি যখন মোড়কটা বগলে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, তাঁর স্ত্রী হতাশায় নেতিয়ে পড়লেন।

‘কিছুই হয়নি?’ জিজ্ঞাসা করলেন স্ত্রী।

‘না।’ কর্নেল উত্তর দিলেন। ‘তবে এখন আর তাতে কিছু এসে যায় না। ছেলেরাই মোরগটাকে খাওয়াবার দায়িত্ব নিয়েছে।’



‘একটু দাঁড়াও, বন্ধু, আমি তোমাকে একটা ছাতা ধার দিচ্ছি।’

সাবাস অফিসের দেয়ালে লাগানো একটা দেরাজ খুলল। পাল্লা খুলতেই দেখা গেলো ভেতরটা এলোমেলো নানা জিনিসে ভরা; ঘোড়সওয়ারের জুতো, স্তুপ করে রাখা লাগাম আর জিন, আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের গামলা, ঘোড়সওয়ারী জুতোর নালে ভরা। ওপর দিক থেকে ঝুলছে আধডজন ছাতা আর মহিলাদের বড় ধরনের রৌদ্্র নিবারনী ছাতা । কর্নেলের মনে হলো যেন কোনো ধ্বংসস্তূপ থেকে কুড়িয়ে আনা সব আবর্জনা।

‘ধন্যবাদ, বন্ধু,’ কর্নেল বললেন, জানলার গায়ে হেলান দিয়ে, ‘আমি বরং একটু অপেক্ষা করি, কখন বৃষ্টি ধরে আসে।’ সাবাস দেয়াল-আলমারিটা বন্ধ করল না। সে বসে পড়লো ডেস্কে, একটা বিজলি পাখার সীমার নীচে। তারপর সে ড্রয়ার থেকে বার করে আনল তুলোয় জড়ানো একটা ছোট্ট হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কর্নেল ধূসর বাদাম-গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওটা ছিল একটা শূন্য বিকেল।

‘জানলা থেকে অন্যরকম লাগে বৃষ্টিকে,’ তিনি বললেন। ‘মনে হয় যেন বৃষ্টি আসলে অন্য কোনো শহরে পড়ছে।’

‘যেদিক থেকেই দেখ না কেন, বৃষ্টি বৃষ্টিই,’ উত্তর দিলে সাবাস। কাচের ডেস্কটপের ওপরে সে সিরিঞ্জটা গরম জলে ফোটাল। ‘এ শহরটা পঁচা গন্ধওয়ালা।’

কর্নেল তাঁর কাঁধ ঝাঁকালেন। অফিসঘরটার ঠিক মাঝখানটায় এসে দাঁড়ালেন তিনি: সবুজটালির একটা ঘর, আসবাবগুলো উজ্জ্বল সব কাপড়চোপড়ে সাজানো। পেছনে, এলোমেলোভাবে স্তুপ হয়ে আছে লবনের বস্তা, গাদা গাদা মৌচাক, আর ঘোড়ার জিন ও লাগাম। সাবাস সম্পূর্ণ শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকে অনুসরণ করল।

‘আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, এভাবে ভাবতাম না।’ বললেন কর্নেল।

তিনি বসে পড়লেন এবং পায়ের ওপর পা তুলে দিলেন। তাঁর শান্ত দৃষ্টি ডেস্কের ওপর নুয়ে থাকা লোকটাকে লক্ষ করছে। বেঁটেখাটো একটা লোক, গোলগাল, কিন্তু মুখের চামড়া মাংসল, তাঁর চোখে কটকটে ব্যাঙের বিষাদ লেপ্টে আছে।

‘ডাক্তার দেখাও, দোস্ত,’ বললে সাবাস। ‘অন্ত্যেষ্টির দিন থেকেই তোমাকে কেমন দুঃখী দুঃখী দেখাচ্ছে।’

কর্নেল মাথা তুলে তাকালেন।

‘আমি খুব ভালো আছি,’ তিনি বললেন।

সাবাস সিরিঞ্জের জলটা ফোটার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। ‘আমারও অমন করে বলতে ইচ্ছে হয়,’ সে অভিযোগ করল। ‘তুমি তো ভাগ্যবান কারণ তোমার পেটটা একেবারে ইস্পাতে গড়া।’ সে নিজের রোমশ হাতের পেছনটাকে নিরীক্ষণ করলে, কালো-কালো ফুটফুটে সব দাগ তাতে। বিয়ের আংটির পাশেই তার আঙুলে কালো পাথর বসানো একটা আংটি।

‘তা ঠিক,’ কর্নেল মেনে নিলেন।

অফিসঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বাড়ির বাকি অংশের দিকে তাকিয়ে সাবাস তার স্ত্রীকে ডাক দিল। তারপর সে তার দৈনিক খাবারের একটা বেদনাদায়ক বিবরণ দিল। শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বার করে মটরশুঁটির আকারের একটা শাদা ট্যাবলেট রাখল ডেস্কের ওপর।

‘এটাসহ সবজায়গায় যাওয়াটাই একটা অত্যাচার,’ বলল সে, ‘এ যেন মৃত্যুকে পকেটে করে নিয়ে যাওয়া।’

কর্নেল ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেলেন। তাঁর হাতের তালুতে তিনি ট্যাবলেটটাকে নিয়ে পরীক্ষা করলেন, শেষপর্যন্ত সাবাস তাঁকে ট্যাবলেটটার স্বাদ নেবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।

‘এ শুধু কফি মিষ্টি করার জন্যে,’ ব্যাখ্যা করলে সে। ‘চিনিই, তবে শর্করা ছাড়া।’

‘তা তো নিশ্চয়ই,’ তাঁর মুখের লালা এক দুঃখিত মিষ্টি স্বাদে ভরে গেলো। ‘এ যেন ঘণ্টার ঢং-ঢং শব্দ-- শুধু কোনো ঘণ্টাটাই নেই কোথাও।’

তার স্ত্রী এসে তাকে ইনজেকশন দিয়ে যাবার পর সাবাস তার কনুই রাখল ডেস্কের ওপর, দু হাতের মধ্যে মুখ। কর্নেল ভেবেই পেলেন না তাঁর শরীরটাকে নিয়ে তিনি কী করবেন। সাবাসের স্ত্রী বিজলি পাখাটার প্লাগ থেকে খুলল, পাখাটা সিন্দুকের ওপর রাখল, এরপর কাবার্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

মহিলাটি বলল, ‘ছাতার সঙ্গে মৃত্যুর কিছু একটা সম্পর্ক আছে’।

কর্নেল তাঁর কথায় কোনো মনোযোগ দিলেন না। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন বেলা চারটেয়, চিঠি আসার জন্যে অপেক্ষা করতে, কিন্তু বৃষ্টি তাঁকে সাবাসের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। লঞ্চগুলোর ভোঁ যখন শোনা গেলো, তখনও বৃষ্টি পড়ছে।

‘সবাই বলে মৃত্যু একজন মেয়েমানুষ,’ সাবাসের স্ত্রী বলেই চললো। মহিলা মোটা, স্বামীর চেয়ে লম্বা, এবং ওপরের ঠোঁটের কাছে একটা রোমশ তিল আছে। তার কথা বলার ধরন কাউকে বিজলি পাখার একধরনের গুণগুণ শব্দ মনে করিয়ে দেয়, ‘কিন্তু ওটাকে আমার তাকে কোনো মেয়েমানুষ মনে হয় না।’ সে কাবার্ড বন্ধ করে আবার কর্নেলের চোখের দিকে তাকালো।

‘আমার মনে হয় ওটা নখর থাবাওয়ালা কোনো জন্তু।’

‘হতে পারে,’ কর্নেল সায় দিলেন। ‘কখনো খুব অ™ভূদ ঘটনাও ঘটে।’

তিনি ভাবছিলেন, পোস্টমাস্টার নিশ্চয়ই গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে লাফিয়ে উঠেছে লঞ্চে। উকিল পালটাবার পর একমাস কেটে গিয়েছে। এখন তিনি কোনো উত্তর প্রত্যাশা করতে পারেন। কর্নেলের অন্যমনষ্ক ভাবটা চোখে না পড়া পর্যন্ত সাবাসের স্ত্রী মৃত্যু নিয়ে কথা বলে গেলো।

‘বন্ধু,’ সে বললে, ‘আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।’

কর্নেল উঠে সোজা হয়ে বসলেন।

‘এটা সত্যি বন্ধু’ কর্নেল মিথ্যে বললেন। ‘আমি চিন্তা করছিলাম এর মধ্যে পাঁচটা বেজে গেছে, অথচ মোরগকে এখনও ইনজেকশন দেয়া হয়নি।’

সাবাসের স্ত্রী কেমন বিমূঢ় বোধ করল।

‘একটি মোরগের জন্য ইনজেকশন, যেন সে একটা মানুষ!’ সে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘এ তো পবিত্র বস্তুকে অপবিত্র করার মতো।’

সাবাস আর সহ্য করতে পারলে না। সে তার আরক্ত মুখটা তুললো।

‘এক মিনিটের জন্য মুখটা বন্ধ করবে?’ স্ত্রীকে সে আদেশ দিল। আর প্রকৃতপক্ষেই সাবাসের স্ত্রী হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। ‘তুমি বোকার মতো কথা বলে আমার বন্ধুকে আধঘণ্টা ধরে বিরক্ত করে যাচ্ছো।’

‘না, না, একেবারেই না,’ কর্নেল প্রতিবাদ করলেন।

মহিলাটি সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। ল্যাভেন্ডারে ভেজানো একটা রুমাল দিয়ে সাবাস তার ঘাড় মুছলো। কর্নেল জানলার দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই একইরকম বৃষ্টি পড়ছে। নির্জন প্লাজাটা পেরিয়ে গেলো এক লম্বা-ঠ্যাং মুরগি।

‘এটা কি সত্যি যে মোরগদের ইন্জেকশন দেয়া হয়।’

‘সত্যি,’ বললেন কর্নেল, ‘আগামী হপ্তা থেকে ওর প্রশিক্ষণ শুরু হবে।’

‘ওটা তো পাগলামী,’ বলল সাবাস, ‘ও সব তোমার কাজ নয়।’

‘আমি তা মানি,’ বললেন কর্নেল, ‘তাই বলে তার ঘাড় মোচড়াবারও তো কোনো কারণ নেই।’

‘ওটা শুধু নির্বোধ একগুঁয়েমি,’ জানলার দিকে ফিরে বলল সাবাস। কর্নেল শুনলেন সে দীর্ঘশ্বাস ফেললে, হাঁপরের মতো। বন্ধুর চোখ তাঁর মধ্যে কেমন একটা করুণার ভাব এনে দিল।

‘কোনোকিছুর জন্যেই তত দেরি হয়ে যায় না,’ কর্নেল বললেন।

‘কা-জ্ঞান হারিয়ো না,’ সাবাস আবারও নিজের কথায় জোর দিলে। ‘এ হচ্ছে দু দিকে শান দেয়া ব্যাপার। একদিকে তোমার ঐ ঝামেলা যাবে, অন্যদিকে তুমি নয়শো পেসো পকেটে ঢুকাতে পারবে।’

‘নয়শো পেসো !’ কর্নেল বিস্মিত।

‘নয়শো পেসো।’

কর্নেল সংখ্যাটাকে চোখে দেখার চেষ্টা করলেন।

‘তুমি ভাবছো ঐ মোরগটার জন্য ওরা অত ভালো অঙ্কের টাকা দেবে?’

‘ভাবছি না,’ সাবাস উত্তর দিল, ‘নিশ্চিত জানি।’

বিপ্লবীদের তহবিল ফিরিয়ে দেবার পর এই অঙ্কটাই সবচেয়ে বড়ো অঙ্ক, কর্নেল মাথার মধ্যে পেলেন। সাবাসের অফিস থেকে যখন বিদায় নিলেন, পেটের মধ্যে কেমন একটা প্রচ- মোচড় অনুভব করলেন তিনি, কিন্তু এই মোচড়টা এবার আর আবহাওয়ার প্রকোপে নয়। ডাকঘরে গিয়ে তিনি সোজা পোস্টমাস্টারের কাছে চলে গেলেন।

‘একটা জরুরি চিঠি আসার কথা আছে,’ তিনি বললেন। ‘এয়ার মেলে।’

পোস্টমাস্টার কুঠুরিগুলোর দিকে তাকালো। যখন ঠিকানা পড়া শেষ হলো সে চিঠিগুলোকে আবার ঠিকঠাক কুঠুরিতে সাজিয়ে রাখল, কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। হাত ঝেড়ে না বোধক ভঙ্গি করে সে কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকাল।

‘আজকে চিঠিটা নিশ্চিতভাবে আসার কথা ছিলো,’ বললেন কর্নেল।

পোস্টমাস্টার কাঁধ ঝাঁকাল।

‘নিশ্চিত যে জিনিসটা আসে, সেটা শুধুমাত্র মৃত্যু, কর্নেল।’

কর্নেলকে তাঁর স্ত্রী অভ্যর্থনা করলেন সেদ্ধ দলাপাকানো একথালা ভুট্টা দিয়ে। এক এক চামচ মুখে তোলার আগে অনেকক্ষণ নীরব রইলেন। মুখোমুখি বসে তাঁর স্ত্রী দেখলেন কিছু একটা জিনিস তাঁর স্বামীর মুখের ভাবে বদলে গিয়েছে।

‘কী হয়েছে?’ স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমি ভাবছি সেই লোকটার কথা যে পেনশনের ওপর নির্ভর করে থাকে,’ মিথ্যে করে বললেন কর্নেল। ‘পঞ্চাশ বছর পরে আমরা তো শান্তিতে ছ-ফিট মাটির তলায় থাকবো, অথচ বেচারি তখনও প্রতি শুক্রবারে নিজেকে তিল-তিল করে মারবে তার পেনশনের টাকার অপেক্ষায়।’

‘এটা খারাপ লক্ষণ,’ তাঁর স্ত্রী বললেন। ‘তার মানে তুমি এর মধ্যেই হতাশ হয়ে পড়েছো।’ তিনি তাঁর ঐ ম- খাবার খেয়ে চললেন। কিন্তু একমুহূর্ত পরেই টের পেলেন তাঁর স্বামী এখনও অনেকে দূরে রয়ে গেছেন।

‘এখন তোমার কিন্তু এই ম- খাবারটা আরাম করে খাওয়া উচিত।’

‘খাবারটা খুবই ভালো,’ বললেন কর্নেল। ‘এটা এলো কোথা থেকে?’

‘মোরগটার কাছ থেকে,’ উত্তর দিলেন স্ত্রী। ‘ছেলেগুলো ওর জন্য এত ভুট্টা নিয়ে এসেছিলো যে মোরগটাও আমাদের তার ভাগ দিতে চাইলো। এটাই জীবন।’

‘ওটা ঠিক,’ কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘যা-কিছু উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার মধ্যে জীবনই সব চেয়ে সেরা।’

চুলাটার গায়ে বাঁধা মুরগীটার দিকে তাকালেন তিনি, এবং এবার তাকে কেমন অন্যরকম একটা প্রাণী বলে মনে হলো। তাঁর স্ত্রীও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।

‘আজ বিকেলে ছেলেপুলেগুলোকে লাঠি দিয়ে তাড়াতে হয়েছিলো,’ স্ত্রী বললেন। ‘তারা একটা বুড়ো মুরগি নিয়ে এসেছিলো-- মোরগটার বাচ্চা বানানোর জন্য।’

‘এবারই প্রথম নয়,’ কর্নেল বললেন। ‘ঐ শহরগুলোয় ঠিক এই জিনিসই ওরা করেছিল কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে নিয়ে। তারা তখন ছোট ছোট মেয়েদের আনতো, তাঁর ঔরসে ছেলেপুলে বানাবার জন্যে।’

রসিকতায় তাঁর স্ত্রী হেসে লুটিয়ে পড়ল। মোরগটাও একটা গাঁক করে আওয়াজ করলে। হলঘরটায় সে আওয়াজটাকে শোনালো মানুষের কথার মতো। ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এ প্রাণীটা বুঝি কথা বলবে,’ স্ত্রী বললেন। কর্নেল আবার মোরগটার দিকে তাকালেন।

‘ওর তো সোনার দামে ওজন,’ তিনি বললেন। এক চামচ ম- মুখে দিয়ে মনে মনে কী সব হিসেব করলেন তিনি। ‘ও আমাদের তিন-তিন বছর খাওয়াবে।’

‘তুমি আশা-ভরসাকে চিবিয়ে খেতে পারো না,’ স্ত্রী বললেন।

‘তুমি আশা-ভরসাকে চিবিয়ে খেতে পারো না বটে, কিন্তু আশা-ভরসা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে,’ কর্নেল উত্তর দিলেন। ‘এটা কিছুটা আমার বন্ধু সাবাসের অ™ভূত কা- ঘটানো ট্যাবলেটগুলোর মতো।’

সে রাতে তাঁর খুব অল্প ঘুম হলো, মন থেকে কতগুলো সংখ্যা তিনি মুছে ফেলতে চাচ্ছিলেন। পরদিন দুপুরে খাবার সময় স্ত্রী দু-থালা ম- ভুট্টা পরিবেশন করলেন, আর নিজেরটা খেতে লাগলেন থালার ওপর ঝুঁকে পড়ে, চুপচাপ, একটাও কথা না বলে। কর্নেলের মনে হলো স্ত্রীর খারাপ মেজাজটা বুঝি তাঁকেও ধরে ফেলেছে।

‘কী হয়েছে?’

‘কিছু না,’ স্ত্রী বললেন।

কর্নেলের মনে হলো, এবার বুঝি মিথ্যে কথা বলার পালা তাঁর স্ত্রীর। তিনি স্ত্রীকে সান্ত¡না দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু স্ত্রীর মেজাজটা তেমনি থেকে গেলো।

‘এ কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়,’ স্ত্রী বললেন। ‘আমি ভাবছিলুম, লোকটা মারা গেছে দুই মাস হয়ে গেলো, অথচ আমি কিনা এখনও ওর পরিবারের লোকদের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি।’

সেইজন্য সে রাতেই তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কর্নেল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গেলেন মৃতের বাড়ি পর্যন্ত, তারপর স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়ে সিনেমা হলের দিকে এগুলেন। লাউডস্পীকারের গানগুলো তাঁকে কেমন টান দিচ্ছিলো। অফিসের দরজার কাছে বসে পাদ্রি আন্হেল সিনেমার দরজার দিকে তাকিয়েছিলেন-- তাঁর বারোটা সাবধান ঘণ্টা সত্ত্বেও কে কে ঢুকলো নজর রাখতে। আলোর বন্যা, ঢেউতোলা গান, আর ছেলেমেয়েদের হৈ চৈ পুরো জায়গাটায় যেন একটা শারীরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। একটি বাচ্চা একটা কাঠের বন্দুক তাক করে কর্নেলকে ভয় দেখাল।

‘মোরগটার কী নতুন কোন কিছু খবর আছে, কর্নেল?’ সে খুব কর্তৃত্ব পরায়ণ সুরে বলল।

কর্নেল তার দুহাত উপরে তুললেন।

‘সে আছে এখনও।’

একটা চাররঙা পোস্টার সিনেমা হলের পুরো সামনেটা ঢেকে আছে ‘মধ্যরাতের কুমারী’। সেই কুমারী হলো সান্ধ্য ঢোলাজামা পরা এক স্ত্রীলোক, একটা ঠ্যাং ঊরু পর্যন্ত নগ্ন। কর্নেল তাঁর উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা চালিয়ে গেলেন পাড়াটায়, যতক্ষণ না দূর থেকে এলো বাজের শব্দ, আর বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করলো। তখন তিনি স্ত্রীর খোঁজে ফিরে গেলেন।

স্ত্রী মৃতের বাড়িতে ছিলেন না। নিজেদের বাড়িতেও নয়, কর্নেল হিসেব করে দেখলেন কারফিউ নামার আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন, অনুভব করলেন শহর লক্ষ্য করে ছুটে আসা ঝড়টাকে। তিনি আবার যেই বাইরে বের হবেন বলে তৈরি হলেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী বাড়ি ফিরে এলেন।

কর্নেল মোরগটাকে শোবার ঘরে নিয়ে এলেন। স্ত্রী পোশাক পালটে বসার ঘরে গেলেন জল খেতে, কর্নেল তখন ঘড়িটায় দম দেয়া সবে শেষ করেছেন, আর অপেক্ষা করছেন কখন কারফিউ জারি করে তূরী বাজে।

‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’ কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন।

‘এই, কাছাকাছিই ছিলাম,’ স্ত্রী উত্তর দিলেন। স্বামীর দিকে না-তাকিয়েই গেলাসটা নামিয়ে রাখলেন তিনি বেসিনে, তারপরে শোবার ঘরে ফিরে গেলেন। ‘এত শিগগিরই যে বৃষ্টি নামবে, এটা কেউ আশা করেনি।’ কর্নেল কোনো মন্তব্য করলেন না। যখন কারফিউ বাজলো, তিনি ঘড়িটার কাঁটা এগারোটায় বসালেন, তারপর ঢাকা বন্ধ করে দিলেন, চেয়ারটা ঠেলে ঠিক জায়গায় রেখে দিলেন। আবিষ্কার করলেন স্ত্রী জপমালা ঘোরাচ্ছেন।

‘তুমি কিন্তু আমার কথার কোনো উত্তর দাওনি,’ কর্নেল বললেন।

‘কী?’

‘তুমি ছিলে কোথায়?’

‘ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, কথা বলছিলাম,’ স্ত্রী বললেন। ‘বাড়ি থেকে যে কতদিন পর বেরিয়েছি আজ!’

কর্নেল তাঁর দড়ির খাটটি টানিয়ে নিলেন। বাড়িটার দরজা-জানলা বন্ধ করে কীটনাশক ছেটালেন। তারপর বাতিটাকে মেঝেতে নামিয়ে রেখে শুয়ে পড়লেন।

‘বুঝতে পারি,’ বিষণœ স্বরে বললেন কর্নেল। ‘খারাপ অবস্থা যখন আমাদের মিথ্যা কথা বলায় তখন তা আরো খারাপ হয়ে পড়ে।’

স্ত্রী একটা দীর্ঘ দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন।

‘পাদ্রি আন্হেলের কাছে গিয়েছিলাম।’ তিনি বললেন। ‘আমাদের বিয়ের আংটিগুলো বন্ধক রেখে কিছু টাকা ধার করতে চাচ্ছিলাম।’

‘আর কী বললেন উনি, তোমাকে?’

‘যে পবিত্র জিনিস বেচাকেনা মহাপাপ।’

তাঁর মশারির তলা থেকে তিনি কথা বলেই চললেন। ‘দুই দিন আগে আমি ঘড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলাম,’ তিনি বললেন। ‘কারু কোনো ইচ্ছা নেই, কারণ তারা কিস্তিতে হাল-ফ্যাশনের সব ঘড়ি বিক্রি করছে-- অন্ধকারে যাদের কাঁটা জ্বলজ্বল করে। অন্ধকারেও তুমি কটা বাজে দেখতে পারবে।’ কর্নেল মনে-মনে স্বীকার করলেন যে চল্লিশ বছরের ভাগাভাগির জীবনে, একসাথে ক্ষুধা ভাগ করে নেয়া, একসাথে দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেয়া-- কিছুই যথেষ্ট নয়; এখনও তিনি তাঁর স্ত্রীকে পুরোপুরি জানতে পারেননি। তাঁদের ভালোবাসার মধ্যে আরো কী একটা যেন পুরোনো হয়ে গেছে-- তাঁর মনে হলো।

‘ছবিটাও ওরা চায় না,’ স্ত্রী বললেন। ‘প্রায় সবার কাছেই ঐ একই ছবি আছে। আমি এমনকী তুরানির কাছেও গিয়েছিলাম।’

খুব তেতো লাগলো কর্নেলের।

‘এখন তাহলে সবাই জানে যে আমরা না খেয়ে মরছি।’

‘আমি ক্লান্ত,’ স্ত্রী বললেন। ‘পুরুষ মানুষ কখনও ঘর-সংসারের ঝামেলাগুলো বুঝতে পারে না। কতবার আমি পাথর কুড়িয়ে এনে সেদ্ধ করেছি, যাতে প্রতিবেশীরা বুঝতে না পারে যে আমাদের বাড়িতে অনেক দিনই রান্না হয় না।’

কর্নেল আহত বোধ করলেন।

‘ওটা যে একেবারেই দীন দশা,’ তিনি বললেন।

স্ত্রী মশারির তলা থেকে বেরিয়ে এসে দড়ির খাটটার কাছে চলে এলেন। ‘আমি এ বাড়িতে সব বড়োমানুষি চাল, ভালো সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি,’ তিনি বললেন। তাঁর স্বর ক্রোধে ভারী হয়ে উঠলো। ‘ঐ মর্যাদাবোধ আর হালছাড়া ভাব দেখে দেখে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছি।’

কর্নেল একটা পেশীও নাড়ালেন না।

‘প্রত্যেকবার ভোটের পরে ওরা তোমায় কথা দেয় ঐ ছোটো-ছোটো রঙিন পাখিগুলো দেবে, আর এইভাবে চলেছে কুড়ি বছর ধরে-- অপেক্ষা আর অপেক্ষা। আর এসবের মধ্যে থেকে কী পেলাম আমরা, একটা মরা ছেলে,’ স্ত্রী বলে চললেন, ‘একটা মরা ছেলে ছাড়া আর কিচ্ছু না।’

এ ধরনের নালিশে কর্নেল অভ্যস্ত।

‘আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি।’

‘আর ওরা ওদের কর্তব্য করেছে, কুড়ি বছর ধরে প্রতি মাসে সেনেটে হাজার পেসো করে রোজগার করে,’ স্ত্রী উত্তর দিলেন। ‘এই দ্যাখো না আমাদের বন্ধু সাবাসকে-- দোতলা একটা বাড়িতে সব টাকা ধরাতে পারছে না-- অথচ এ-শহরে ও এসেছিলো জড়িবুটি আর টোটকা ওষুধ বেচতে-- গলায় একটা সাপ জড়িয়ে।’

‘কিন্তু ওতো এখন ডায়াবেটিসে মরতে বসেছে,’ কর্নেল বললেন।

‘এবং তুমি মরতে যাচ্ছো অনাহারে,’ স্ত্রী বললেন। ‘এটা তোমার অনুভব উচিত মর্যাদা খেয়ে কারু পেট ভরে না।’

তাঁর কথায় বাধা দিল বাজ আর বিদ্যুৎ। রাস্তায় একটা বজ্রপাত হলো, ঢুকলো শোবার ঘরে, আর খাটের তলা দিয়ে একরাশ পাথরের মতো গড়িয়ে গেলো। স্ত্রী তাঁর জপমালার জন্য লাফিয়ে মশারির কাছে চলে এলেন।

কর্নেল হাসলেন একটু।

‘জিভকে সংবৃত না করলে অমনই হয়,’ তিনি বললেন। ‘আমি তো চিরকালই বলে এসেছি যে ভগবান আমার পক্ষে আছেন।’

আসলে কিন্তু তিনি তিক্ততাই অনুভব করেছিলেন। পরক্ষণে বাতি নিভিয়ে দিয়ে তিনি ভাবনায় তলিয়ে গেলেন বিদ্যুৎ-ছেঁড়া এক অন্ধকারে। আর মনে পড়ে গেলো মাকোন্দো, কর্নেল তখন নীয়ারলান্দিয়ার প্রতিশ্রুতি পালন করা হবে ভেবে দশ বছর অপেক্ষা করেছেন। আধো তন্দ্রার ঘোরে তিনি দেখলেন একটা হলদে, ধূলিধূসর ট্রেন এসে দাঁড়ালো, নারীপুরুষ জীবজন্তু সবাই গরমে হাঁসফাঁস করছে, অথচ এমনকী ট্রেনের ছাদেও গাদাগাদি ভিড়। সে ছিলো কলার মরশুমের জ্বর।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তারা শহরটাকে আগাপাশতলা বদলে ফেলেছিলো। ‘আমি কেটে পড়ছি!’ কর্নেল তখন বলেছিলেন। ‘কলার গন্ধ আমার ভেতরটা কুরে-কুরে খাচ্ছে।’ আর তিনি ফিরতি ট্রেনেই মাকোন্দো ছেড়ে এসেছিলেন, বুধবার, ২৭ জুন, ১৯০৬, বিকেল দুইটা ১৮ মিনিটে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী লেগেছিলো তাঁর এটা বুঝতে, নীয়ারলান্দিয়ার আত্মসমর্পণের পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও কখনো শান্তি পাননি।

কর্নেল তাঁর চোখ খুললেন।

‘তাহলে আর এ নিয়ে ভাবার আর কিছু নেই,’ তিনি বললেন।

‘কী?’

‘ঐ মুরগীটার সমস্যাটা,’ কর্নেল বললেন। ‘কালই আমি ওকে বন্ধু সাবাসের কাছে নশো পেসোয় বেচে দেবো।’



কাঠগড়ার প্রাণীগুলোর হাউকাউ, তার সঙ্গে মিশে যাওয়া সাবাসের তাঁরস্বরে চিৎকার অফিসের জানালা দিয়ে ধেয়ে এল। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কর্নেল নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করলেন ও যদি আর দশ মিনিটের মধ্যে না-আসে তো আমি চলে যাবো। কিন্তু তিনি আরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করলেন। যখন তিনি চলে যাবার জন্যে পা বাড়াচ্ছেন, একদল কর্মচারীর সঙ্গে সাবাস তার অফিসঘরে এসে ঢুকলো। কর্নেলের দিকে না তাকিয়েই সে তাঁর সামনে পিছনে পায়চারি করতে লাগলো।

‘আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে নাকি, বন্ধু?’

‘হ্যাঁ, বন্ধু,’ বললেন কর্নেল। ‘তবে তুমি যদি এখন ব্যস্ত থাকো, আমি না হয় পরে আবার আসবো।’

দরজার অন্য পাশ থেকে সাবাস তাঁর কথা শুনতেই পেলো না।

‘আমি এক্ষুণি আসছি,’ সে বললে।

দুপুরটা ছিল দম আটকানো। রাস্তার স্বচ্ছ গরমের হলকায় অফিসটা ঝিক মিক করে উঠছে। গরমে কেমন অবশ হয়ে গিয়ে কর্নেল আলগা ভাবে তাঁর চোখ বুজলেন আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্ত্রীর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। সাবাসের স্ত্রী পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে পা টিপে টিপে এসে ঘরে ঢুকলো।

‘না, না, জাগবেন না, বন্ধু,’ বলল সে । ‘আমি শুধু ঝিল্লি নামিয়ে দিতে এসেছি-- অফিসটা যেন একটা নরককু-।’

কর্নেল শূন্য দৃষ্টিতে তাকে অনুসরণ করলেন। জানলা বন্ধ করে দিয়ে সে ছায়া থেকে কথা বলল।

‘আপনি কি প্রায়ই স্বপ্ন দেখেন না কি?’

‘মাঝে মাঝে,’ উত্তর দিলেন কর্নেল, ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে ভারি লজ্জা হচ্ছিলো তাঁর। ‘মোদ্দাকথা, সবসময়, আমি স্বপ্ন দেখি যে আমি একটা মাকড়শার জালে জড়িয়ে পড়ছি।’

‘আমি প্রত্যেক রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি,’ সাবাসের স্ত্রী বললেন। ‘এখন আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঢুকেছে, যাদের একজনের স্বপ্নে দেখা যায়, যে সব অচেনা লোক দেখি তারা আসলে কারা?’

বিজলি পাখাটায় মহিলা প্লাগ দিল। ‘গত হপ্তায় আমার বিছানার মাথার পাশে এক মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো।’ সে বলল, ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পেরেছিলাম, কে সে, আর সে বলেছিলো, “এই ঘরে বারো বছর আগে মারা গিয়েছিলাম।”’

‘কিন্তু বাড়িটা তো বড়জোর দুই বছর আগে বানানো হয়েছে,’ বললেন কর্নেল।

‘তা ঠিক,’ বললে সাবাসের স্ত্রী। ‘তার মানে মৃতরাও ভুল করে।’

পাখার ফরফর ছায়াটাকে নিরেট করে তুলেছে। কর্নেল কেমন অধীর বোধ করলেন, ঘুমভাব আর এই মহিলার বকবকানি দুইই তাঁকে ভীষণ রকম মানসিক পীড়ন করছে, সাবাসের স্ত্রী ততক্ষণে মৃত্যু থেকে পুনর্জন্মে গিয়ে পৌঁছেছে। কর্নেল বিদায় বলবার জন্যে অপেক্ষা করছেন কখন সে থামে, এমন সময় সাবাস তার কর্মীদের সর্দারকে নিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলো।

‘আমি চার-চারবার তোমার সুপ গরম করেছি,’ বলল সাবাসের স্ত্রী।

‘ইচ্ছে হলে দশবারও গরম করতে পারো,’ বললে সাবাস, ‘কিন্তু এখন আমার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করো না।’

সিন্দুক খুলে সে কর্মীদের সর্দারকে একগোছা টাকার সঙ্গে একগাদা নির্দেশ দিল। ফোরম্যান জানালার পর্দা খুললো টাকা গুনবে বলে। সাবাস দেখল কর্নেল অফিসের পেছনে বসে আছেন, কিন্তু তাতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। সে তার ফোরম্যানের সঙ্গেই কথা বলতে থাকলো। দুজনে যখন আবার অফিসঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করছে, কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। দরজা খোলার আগে সাবাস থমকে দাঁড়ালো।

‘তোমার জন্যে কী করতে পারি, বন্ধু?’

কর্নেল দেখলেন, কর্মীদের সর্দার তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

‘না, কিছু না। বন্ধু,’ তিনি বললেন। ‘আমি শুধু তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’

‘ওটা তাড়াতাড়ি বলো,’ বলল সাবাস। ‘আমার নষ্ট করার মতো একটা মিনিটও নেই।’

সাবাস দরজার হাতলে হাত রেখে একটু ইতস্তত করল। কর্নেল অনুভব করলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ পাঁচ সেকেন্ড কাটছে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন।

‘এটা ঐ মোরগটার ব্যাপার’। তিনি মৃদুস্বরে বললেন।

তখন সাবাস দরজা খোলা শেষ করলো। ‘মোরগটার ব্যাপারে কথা,’ সে কথাটা হেসেই পুনর্বার উচ্চারণ করল, আর ফোরম্যানকে ঠেলে হলঘরে বার করে দিল। ‘লোকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে, আর আমার দোস্ত কি না মোরগটাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।’ আর তারপর, কর্নেলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে : ‘ঠিক আছে,বন্ধু। আমি এক্ষুণি আসছি।’

কর্নেল স্থাণুর মতো অফিসঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। হলঘর থেকে দুজনের পায়ের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। এরপর তিনি বেরিয়ে পড়লেন শহরের চারপাশে ঘুরতে, রোববার দুপুরের গাঢ় তন্দ্রায়, সিয়েস্তায়, আস্ত শহর যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে আছে। দরজির দোকানে কেউ নেই। ডাক্তারখানা বন্ধ। সিরিয়ার লোকটার বেসাতির ওপর কেউ নজর রাখছে না। নদী যেন ইস্পাতের একটা পাত। নদীর পাড়ে একটা লোক চারটে তেলের পিপে পর-পর সাজিয়ে তার ওপর ঘুমিয়ে আছে, রোদ থেকে বাঁচবার জন্যে মুখটা টুপি দিয়ে ঢাকা। কর্নেল বাড়ি ফিরে গেলেন, এ-শহরে যে তিনিই একমাত্র সচল বস্তু তাতে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই।

স্ত্রী তাঁর জন্য একটা পরিপূর্ণ মধ্যাহ্ন ভোজ সাজিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

‘আমি সব ধারে কিনে এনেছি, কথা দিয়েছি কাল ভোরেই সব টাকা শোধ করে দেবো।’ তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন।

খেতে খেতে কর্নেল তাঁকে গত তিন ঘণ্টার ঘটনাগুলোর বিবরণ দিলেন। তাঁর স্ত্রী অধৈর্যভাবে সব শুনলেন।

‘মুশকিল এটাই যে, তোমার কোনো মনের জোর নেই,’ তাঁর স্ত্রী বললেন শেষ পর্যন্ত, ‘তুমি এমনভাবে গিয়ে দাঁড়াও যেন তুমি ভিক্ষে চাইছো, যেখানে মাথা উঁচু করে সোজা আমাদের বন্ধুর কাছে গিয়ে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলা উচিত, “বন্ধু, আমি তোমার কাছে মোরগটাকে বিক্রি করে দেবো বলে ঠিক করেছি।”’

‘তুমি এমনভাবে কথা বলো যেন জীবন একঝলক মৃদু হাওয়া,’ কর্নেল বললেন।

তাঁর স্ত্রী উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। সেদিন সকালে তিনি ঘরদোর পরিষ্কার করেছেন, ভারি অদ্ভুতভাবে সেজেছেন, তাঁর স্বামীর পুরোনো জুতো পায়ে, আর অয়েল ক্লথের এপ্রন গায়ে, আর মাথায় একটা কাপড় বাঁধা, কানের পাশে দুটো গিঁট। ‘তোমার এক ফোঁটাও ব্যবসাবুদ্ধি নেই,’ স্ত্রী বললেন। ‘তুমি যখন কিছু বেচতে যাবে তখন তোমার মুখের ভাব এমন করা উচিত যেন তুমি কিনতে গেছো।’

কর্নেল স্ত্রীর চেহারায় যেন ভারি মজার জিনিস খুঁজে পেলেন।

‘যেমন আছো, তেমনি থাকো।’ তিনি হেসে বললেন স্ত্রীকে, বাধা দিয়ে। ‘তোমাকে ঠিক কোয়েকার ওটের লোকটার মতো দেখাচ্ছে।’

তাঁর স্ত্রী মাথা থেকে কাপড়টা খুলে নিলেন।

‘আমি সিরিয়াস কথা বলছি,’ স্ত্রী বললেন। ‘এক্ষুণি আমি নিজে আমাদের বন্ধুর কাছে মোরগটাকে নিয়ে যাচ্ছি আর বাজি ধরে বলতে পারি যদি তুমি চাও আধঘণ্টার মধ্যেই আমি নশো পেসো নিয়ে ফিরে আসবো।’

‘তোমার মাথাটায় আছে একটা গোল্লা,’ কর্নেল বললেন। ‘তুমি আগেভাগেই মোরগটার টাকা নিয়ে বাজি ধরছো।’

স্ত্রীর জেদ ভাঙতে অনেক কষ্ট করতে হল কর্নেলকে। তাঁদের ঐ শুক্রবারের নরকযন্ত্রণা ছাড়াই আগামী তিন বছর কী করে সংসার চালাবেন, সে নিয়ে তিনি সারা সকাল ব্যয় করে হিসেব করেছিলেন। যে সব জিনিস একেবারেই না হলে চলে না, তার একটা ফর্দ তৈরি করেছিলেন তিনি, এমনকী কর্নেলের জন্যে একজোড়া নতুন জুতোর কথাও তিনি ভোলেননি। শোবার ঘরে আয়না বসাবার জন্যে একটা জায়গা ঠিক করে রেখেছেন। তাঁর সব সংকল্পে এই আচমকা বাধা পড়ায় তিনি কেমন লজ্জা আর রাগের একটা মিশেল অনুভূতি অনুভব করলেন।

অল্প একটু ঘুমিয়ে নিলেন তিনি। ঘুম ভেঙে উঠে দেখলেন, কর্নেল বাড়ির ভেতর আঙ্গিনায় বসে আছেন।

‘এখন তুমি কী করছো?’ স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমি ভাবছি,’ কর্নেল বললেন।

‘তাহলেই তো সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেলো। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে ও টাকা আমরা হাতে করে গুনতে পারবো।’

প্রকৃতপক্ষে কিন্তু সেদিনই বিকেলে মোরগটাকে বেচে দেবেন বলে কর্নেল ঠিক করে ফেলেছিলেন। সাবাসের কথা ভেবেছেন তিনি, সে তার অফিসে একা থাকবে, বিজলি পাখাটার সামনে বসে কখন সে তার রোজকার ইনজেকশন নেবে। তিনি তার উত্তর তৈরি করেই রেখেছেন।

‘মোরগটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও,’ যাবার সময় স্ত্রী তাঁকে পরামর্শ দিলেন। ‘তাকে নিজের চোখে দেখলে জাদুর মতো কাজ করবে।’

কর্নেল আপত্তি করলেন। সীমাহীন উদ্বেগ নিয়ে স্ত্রী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজা পর্যন্ত এলেন।

‘ওর অফিসে যদি আস্ত সেনাবাহিনীও বসে থাকে, তাতে কিছুই এসে-যায় না,’ তিনি বললেন। ‘তুমি ওর হাত শক্ত করে ধরবে, নশো পেসো হাতে না দেয়া পর্যন্ত একবারও হাত ছেড়ো না।’

‘ওরা ভাববে আমরা বুঝি কোনো ডাকাতির পরিকল্পনা করছি।’

স্ত্রী তাতে কোন মনোযোগ দিলেন না।

‘মনে রেখো, মোরগটার মালিক হচ্ছো তুমি,’ স্ত্রী আবার তাঁকে জোর দিয়ে বললেন, ‘মনে রেখো, ও না, তুমিই ওকে অনুগ্রহ দেখাচ্ছো।’

‘ঠিক আছে।’

সাবাস ছিলো শোবার ঘরে, ডাক্তারের সঙ্গে। ‘এই-ই আপনার সুযোগ, বন্ধু,’ সাবাসের স্ত্রী কর্নেলকে বলল। ‘ডাক্তার ওকে রেঞ্জে যাবার জন্যে গোছগাছ করে দিচ্ছে, বৃহষ্পতিবারের আগে ও ফিরবে না।’ কর্নেল দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন: মোরগটাকে বিক্রি করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও ভাবছিলেন আর এক ঘণ্টা পরে এলেই ভাল হতো, তাহলে আর সাবাসের সঙ্গে তাঁর দেখাই হতো না।

‘আমি অপেক্ষা করতে পারব,’ কর্নেল বললেন।

কিন্তু সাবাসের স্ত্রী জোর করল। সে তাঁকে শোবার ঘরে নিয়ে এলো সটান, যেখানে তার স্বামী সিংহাসনের মতো একটি পালঙ্কে অর্ন্তবাস পরে বসে আছে, তার রংহীন চোখটা ডাক্তারের ওপর। ডাক্তার রোগীর প্রস্বাবভরা শিশিটা গরম করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন কর্নেল, তারপর ডাক্তার শুঁকলো ঐ প্রস্রাব, সাবাসের দিকে তাকিয়ে সব ঠিক আছে, এমন একটা ভঙ্গি করলে।

‘ওকে গুলি করে না মারলে মরবে না,’ কর্নেলের দিকে ফিরে ডাক্তার বলল। ‘ধনীলোকদের শেষ করার জন্য ডায়াবেটিস হলো খুবই দীর্ঘসূত্রী ব্যাপার।’

‘তোমার ঐ হতচ্ছাড়া ইনসুলিন ইনজেকশনগুলো দিয়ে অনেক তো দেখলে,’ বলল সাবাস, তার মোটা পাছাটা নাড়িয়ে। কিন্তু আমি বাপু অনেক শক্ত আছি-- সহজে ভাঙি না,’ আর তারপর কর্নেলকে :

‘আরে, এসো, এসো, বন্ধু। বিকেলবেলায় তোমার খোঁজে গিয়ে টুপির ডগাটা অব্দি দেখতে পাইনি।’

‘আমি যেহেতু টুপি পরি না, তো সেটা আমাকে খুলতে হয় না।’

সাবাস তার জমকালো পোশাক আশাক পরতে শুরু করল। রক্তের নমুনা ভরা একটা কাচের টিউব তার কোটের পকেটে রাখল ডাক্তার। তারপর সে তার ব্যাগের জিনিসগুলো ঠিক সাজালে। কর্নেল ভাবলেন সে বুঝি চলে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে।

‘আমি যদি তুমি হতাম ডাক্তার তবে বন্ধুর কাছে হাজার পেসোর বিল পাঠাতুম,’ কর্নেল বললেন। ‘এভাবে ও আর এত ভয় পেতো না।’

‘সে পরামর্শ আগেই দিয়েছি ওকে, তবে লাখ টাকার বিল,’ বলল ডাক্তার। ‘বহুমূত্রের সেরা ওষুধ হলো দারিদ্র্য।’

‘ব্যবস্থার জন্যে ধন্যবাদ,’ বলল সাবাস, তার বিশাল পেটটাকে একটা ঘোরসওয়ারী ব্রিচেস এর মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা করতে-করতে। ‘কিন্তু ও-পরামর্শ আমি নেবো না, তারপর বড়োলোক হয়ে তোমার সর্বনাশ হোক আর-কি!’ ডাক্তার দেখলে তার নিজের দাঁতই তার ব্যাগের চকচকে তালাটায় প্রতিফলিত হচ্ছে। কোনো অস্থিরতা না দেখিয়ে সে ঘড়ি দেখল। সাবাস বুট জোড়া পরে নিয়ে হঠাৎ কর্নেলের দিকে ফিরলো।

‘তারপর, বন্ধু, মোরগটার অবস্থা কী?’

কর্নেল বুঝতে পারলেন ডাক্তারও তাঁর জবাব শোনাবার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তিনি দাঁতে দাঁত চাপলেন।

‘তেমন কিছুনা বন্ধু,’ মৃদু স্বরে বললেন কর্নেল। ‘আমি ওটা তোমার কাছে বিক্রি করতে এসেছি।’

সাবাসের বুট পরা শেষ হলো।

‘চমৎকার, বন্ধু।’ কোনো আবেগ না দেখিয়ে সে বলল। ‘এটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে তোমার পক্ষে।’

‘ও সব ঝামেলার পক্ষে খুব বেশি বুড়ো হয়ে পড়েছি আমি,’ ডাক্তারের অভেদ্য অভিব্যক্তির সামনে কর্নেল নিজের সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করলেন। ‘আমার বয়েস যদি কুড়ি বছর কম হতো, তবে না হয় আলাদা কথা ছিলো।’

‘আপনার বয়েস চিরকালই কুড়ি বছর কম থেকে যাবে,’ ডাক্তার বলল।

কর্নেল হাঁপ ছাড়লেন। সাবাস আরো-কী বলে, তা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, কিন্তু সে কোনো কথা বললো না। সাবাস একটা চেন লাগানো চামড়ার কোট গায়ে চাপালো, শোবার ঘর ছেড়ে বের হবার জন্য সে পুরোপুরি তৈরি।

‘তোমার ইচ্ছে হলে আসছে হপ্তায় না-হয় এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে, বন্ধু,’ কর্নেল বললেন।

‘আমিও ঠিক ওই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম,’ বললে সাবাস। ‘আমার হাতে এক মক্কেল আছে-- সে হয়তো তোমাকে চারশো পেসো দেবে। কিন্তু সেজন্যে তো বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

‘কত দেবে?’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলে।

‘চারশো পেসো।’

‘আমি শুনেছি কে যেন বলেছিলো তার দাম আরো অনেক বেশি,’ বলল ডাক্তার।

‘তুমি নিজেই নশো পেসোর কথা বলছিলে,’ কর্নেল বললেন। ডাক্তারের হতভম্ব ভাব দেখে তিনি একটু শক্তি পেয়েছেন। ‘সারা এলাকায় ও হলো সবার চেয়ে সেরা লড়িয়ে মোরগ।’

সাবাস ডাক্তারের কথার উত্তর দিল।

‘অন্য সময় হলে যে কেউ হেসে-খেলে হাজার পেসো দিতো,’ বুঝিয়ে বলল সে। ‘কিন্তু এখন, কেউই কোনো বাহাদুর মোরগকে নিয়ে লড়তে ভয় পায়। সব সময়েই ভয় আছে যে রিং থেকে বেরিয়ে এলেই গুলি খেয়ে মরবে।’ কর্নেলের দিকে তাকিয়ে সে হতাশার ভঙ্গি করল :

‘এই কথাটাই তোমাকে আমি বলতে চাচ্ছিলাম, বন্ধু।’

কর্নেল ঘাড় নাড়লেন।

‘বেশ,’ তিনি বললেন।

তিনি তাকে অনুসরণ করে হলঘরে এলেন। বসার ঘরে, সাবাসের স্ত্রী ডাক্তারকে আটকেছে, সে একটা ওষুধ চাচ্ছে-- ‘ঐ যারা হঠাৎ এসে চড়াও হয় অথচ জানা নেই তারা আসলে কী,’

তাদের জন্যে একটা মোক্ষম ওষুধ।’ কর্নেল অফিস ঘরে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সাবাস সিন্দুক খুলে সবগুলো পকেটে তাড়া তাড়া নোট ঠেসে ঠুসে ভরল, তারপর কর্নেলের দিকে চারটে নোট বাড়িয়ে দিল।

‘এই নাও ষাট পেসো,’ সে বলল। ‘কুঁকড়ো বিক্রি হয়ে গেলে বাকি টাকা মিটিয়ে দেবো।’

কর্নেল ডাক্তারের সঙ্গে-সঙ্গে নদীর ধারের ফিরিওয়ালাদের ঝুপড়িগুলো পেরিয়ে এলে, বিকেলের ঠা-ায় আবার সবকিছু জেগে উঠছে। সুতোর মতো স্রোত দিয়ে আখ-বোঝাই একটা বজরা ভেসে চলেছে। কর্নেলের মনে হলো ডাক্তার যেন অদ্ভুত অভেদ্য হয়ে আছে।

‘আর তুমি, কেমন আছো, ডাক্তার?’

ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকাল।

‘আগের মতোই,’ সে বলল। ‘আমার মনে হচ্ছে আমার একজন ডাক্তার দেখানো দরকার।’

‘এ এই শীতকালটা,’ বললেন কর্নেল। ‘এ আমার ভেতরটা কামড়ে খায়।’

ডাক্তার এমনভাবে তাঁকে তাকিয়ে দেখল যার মধ্যে পেশাদার কোনো কৌতূহলের লেশমাত্র নেই। ঝুপড়িগুলোর সামনে বসা সিরিয়ানদের সে পর-পর নমস্কার করল। ডাক্তারখানার দরজায় দাঁড়িয়ে কর্নেল মোরগটা বিক্রির বিষয়ে নিজের মতটা বললেন।

‘আর কিছু আমার করার ছিল না,’ তিনি বোঝালেন। ‘ঐ প্রাণীটা মানুষের মাংস খেয়ে বাঁচে।’

‘মানুষের মাংস খেয়ে যে বাঁচে সে ঐ সাবাস,’ ডাক্তার বলল, ‘আমি ঠিক জানি মোরগটাকে ও নশো পেসোয় বেচবে।’

‘তোমার এমন মনে হচ্ছে?’

‘আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ,’ ডাক্তার বললে। ‘মেয়রের সঙ্গে তার চমৎকার দেশপ্রেমিক চুক্তির মতোই এ-ব্যাপারটা।’

কর্নেল বিশ্বাস করতে রাজী হলেন না। ‘আমার বন্ধু শুধু নিজের প্রাণ বাঁচাতেই চুক্তিটা করেছিলো।’ তিনি বললেন। ‘শুধু ঐ করেই ও শহরে থাকতে পেরেছে।’

‘আর এইভাবেই ও, যখন ওর দলের সবাইকে মেয়র লাথি মেরে বের করে দিয়েছে, এইভাবেই ও অর্ধেক দামে তাদের সব সম্পত্তি কিনে নিতে পেরেছে,’ ডাক্তার উত্তর দিল। পকেট হাতড়ে চাবি না পেয়ে সে ডাক্তারখানার দরজার কড়া নাড়ল। তারপরে সে কর্নেলের অবিশ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়ালে।

‘অত বোকা হবেন না,’ সে বলল। ‘নিজের প্রাণের চেয়েও সাবাস টাকাকে বেশি ভালোবাসে।’

কর্নেলের স্ত্রী সে রাতে কেনাকাটায় বেরুলেন। তিনি তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে সিরিয়ানদের ঝুপড়িগুলো পর্যন্ত গেলেন, তাঁর মাথায় ডাক্তারের উদ্ঘাটন ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘এখুনি ছেলেগুলোকে খুঁজে বার করো, বলো যে মোরগটাকে বেচে দিয়েছো,’ তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন। ‘ওদের মিথ্যে আশায়-আশায় রাখা ঠিক হবে না।’

‘আমার বন্ধু সাবাস ফিরে না আসা পর্যন্ত মোরগ বিক্রি হবে না,’ কর্নেল উত্তর দিলেন।

কর্নেল গিয়ে দেখলেন আলভারো বিলিয়ার্ডের হলে রুলেটের চাকা নিয়ে জুয়ো খেলছে। রবিবার রাতে আড্ডাটা থৈ-থৈ করে। আরো গুমোট লাগে এখানে, বিশেষ করে পুরো মাত্রায় যখন রেডিওটা গম গম করে বাজতে থাকে। একটা মস্ত কালো অয়েল ক্লথের ওপর জ্বলজ্বলে রঙে সংখ্যা লেখা, আর টেবিলের মাঝখানটায় একটা বাক্সের ওপর হ্যাজাক জ্বলছে। কর্নেলের মজা লাগলো দেখে। আলভারো তেইশ নম্বরে বাজি ধরে হারবে বলে পণ করে আছে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে খেলাটা দেখতে-দেখতে কর্নেল লক্ষ্য করলেন নয়টা চক্করের মধ্যে চার চারবার এগারো নম্বর জিতেছে।

‘এগারো নম্বরে বাজি ধরো,’ আলভারোর কানে কানে তিনি ফিসফিস করলেন। ‘ঐ নম্বারটাই বেশি উঠছে।’

আলভারো টেবিলটাকে নিরীক্ষণ করল। পরের চক্করে কোনো বাজি টাকাই ধরল না। সে পকেট কিছু টাকা বার করল, সঙ্গে একটা কাগজ। টেবিলের তলা দিয়ে কাগজটাকে কর্নেলের হাতে চালান করে দিল।

‘অগাস্টিনের কাছ থেকে এসেছে,’ সে বলল।

কর্নেল গোপন চিরকুটটা পকেটে পুরলেন। আলভারো এগারো নম্বরে অনেক টাকা বাজি ধরল।

‘অল্প টাকা দিয়ে শুরু করো,’ কর্নেল বললেন।

‘হয়তো কেল্লা মেরে দেবো এবার,’ আলভারো জবাব দিল। পাশের অনেক খেলোয়াড়ও অন্য নম্বরের বদলে এগারোতে বাজি ধরল, ততক্ষণ বিশাল চাকাটা ঘুরতে শুরু করেছে। কর্নেলের কেমন দম আটকে এলো। জীবনে এই প্রথমবার জুয়ো খেলার মোহ, উত্তেজনা আর তিক্ততা অনুভব করলেন তিনি।

পাঁচ নম্বর জিতলো।

‘আমি দুঃখিত,’ কর্নেল লজ্জায় অধোবদন হয়ে বললেন। কীরকম একটা বেদনা গ্লানিবোধ হচ্ছিলো তাঁর, যখন কাঠের আঁকড়াটা আলভারোর সব টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। ‘যাতে কোনো বোধ নেই, তাতে নাক গলিয়ে এ রকমই হয় আমার।’

আলভারো তাঁর দিকে না তাকিয়েই মৃদু হাসল।

‘মিথ্যে ভাববেন না, কর্নেল। ভালোবাসায় বিশ্বাস করুন।’

যে ড্রামগুলো একটা মাম্বো বাজাচ্ছিল, সেগুলো হঠাৎ থেমে গেলো। জুয়াড়িরা মাথার ওপর হাত তুলে যে যেদিকে পারে ছিটকে গেলো। কর্নেল একটা শুকনো তীক্ষè আওয়াজ শুনলেন, মুখর, ঠা-া, তীক্ষè আওয়াজ, তাঁর পিঠে কে রাইফেল ঠেকালো। তিনি বুঝতে পারলেন পুলিশের হামলায় এসে পড়েছেন তিনি মারাত্মকভাবে, পকেটে ঐ গোপন চিরকুট। হাত না তুলেই তিনি অর্ধেক ঘুরলেন। আর তারপর তিনি, জীবনে এই প্রথমবার দেখলেন, কে তাঁর ছেলেকে গুলি করেছিলো। লোকটা ঠিক তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, রাইফেলের নলটা কর্নেলের পেটে ঠেকানো। বেঁটেখাটো লোকটা, ইন্ডিয়ান দেখতে, রোদে-জলে মার-খাওয়া চামড়া, আর তার নিশ্বাস যেন একটা শিশুর। কর্নেল দাঁতে দাঁত চেপে, আস্তে রাইফেলের নলটা আঙুলের ডগা দিয়ে সরিয়ে দিলেন।

‘একটু দেখি,’ তিনি বললেন।

দুটো গোল কুৎকুতে বাদুর চোখ তাঁর দিকে তাকিয়ে ঝলকের মধ্যে মনে হলো ঐ চোখ দুটো যেন তাঁকে খেয়ে ফেলছে, চিবিয়ে হজম করে ফেলছে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বের করে দিয়েছে।

‘আপনি যেতে পারেন, কর্নেল।’



এ যে ডিসেম্বর, তা বোঝবার জন্যে জানলা খোলারও দরকার হয় না তাঁর। হাড়ে-মজ্জায় তা তিনি টের পেলেন, রান্নাঘরে বসে যখন মোরগটার নাস্তার জন্যে তিনি ফল কাটছিলেন। তারপর তিনি দরজা খুললেন, আর বাড়ির ভেতরের উঠানের অবস্থাটা তাঁর অনুভূতিকে সমর্থন করলে। চমৎকার দেখাচ্ছে আঙ্গিনাকে, ঘাস, গাছপালা, আর ছোট্ট পায়খানাটা যেন স্বচ্ছ হাওয়ায় ভাসছে, মাটি থেকে এক মিলিমিটার ওপরে।

স্ত্রী বিছানাতেই শুয়ে রইলেন বেলা নয়টা পর্যন্ত। যখন তিনি রান্নাঘরে অবশেষে দেখা দিলেন, কর্নেল ততক্ষণে ঘর পরিস্কার করে মোরগটার চারপাশে ঘিরে বসা বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলছেন। চুলার কাছে যাবার জন্য স্ত্রীকে একটু ঘুরে যেতে হলো।

‘বেরো সামনে থেকে,’ স্ত্রী চ্যাঁচালেন। মোরগটার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকালেন তিনি। ‘ঐ অলুক্ষুণে পাখিটাকে যে কবে বিদেয় করতে পারবো, জানিনা।’ মোরগটাকে নিয়ে স্ত্রীর বদমেজাজকে কর্নেল কোনো গুরুত্ব দিলেন না। মোরগটাকে নিয়ে রাগ করার কিছু নেই। সে এখন লড়াইয়ের কায়দা শেখবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে। তাঁর গলা, আর পালক বসানো বেগুনি ঊরু, তার করাতের মতো মাথার ঝুঁটি-- সব মিলিয়ে দীঘল চেহারা কুঁকড়োর, একটি প্রতিরোধহীন বাতাস।

‘মোরগটার কথা ভুলে গিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দ্যাখো,’ বাচ্চারা চলে গেলে কর্নেল বললেন। ‘এরকম এক সকালবেলায়, যে কারুর একটা ছবি তোলবার ইচ্ছে করে।’

স্ত্রী জানালা দিয়ে ঝুঁকে তাকালেন বটে, কিন্তু মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেল না। ‘গোলাপ গাছ লাগালে হয়,’ তিনি বললেন, উনুনের কাছে ফিরে যেতে যেতে। কর্নেল দাড়ি কামাবার জন্যে আয়নাটা হুকে টানালেন।

‘গোলাপ গাছ লাগাতে ইচ্ছে করলে, লাগাও,’ তিনি বললেন। আয়নাটার দুলুনির সঙ্গে তাল রাখবার চেষ্টা করলেন কর্নেল।

‘শুওরগুলো গোলাপ খেয়ে ফ্যালে,’ স্ত্রী বললেন।

‘সে তো আরো ভালো,’ বললেন কর্নেল। ‘গোলাপফুল খেয়ে মোটা-হওয়া শুওর খেতে নিশ্চয়ই আরো ভালো লাগে।’

আয়নার মধ্যে তাকিয়ে স্ত্রীকে খুঁজলেন কর্নেল, দেখলেন যে এখনও স্ত্রীর মুখের অবস্থা সেই একই রকম। চুলার আঁচে তাঁর মুখটাকে দেখাচ্ছে যেন একই আগুনে বানানো। অজান্তেই তাঁর চোখ স্ত্রীর মুখে আটকে গেলো। কর্নেল হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে দাড়ি কাটলেন, অত বছর যেমন কেটেছেন। তাঁর স্ত্রী চুপচাপ অনেকক্ষণ ধরে কী যেন ভাবছেন।

‘কিন্তু আমি গোলাপগাছ লাগাতে চাই না,’ স্ত্রী বললেন।

‘বেশ,’ কর্নেল বললেন। ‘তবে লাগিয়ো না।’

ভালো লাগছে তাঁর। ডিসেম্বর তাঁর পেটের উদ্ভিদগুলোকে শুকিয়ে কুঁচকে দিয়েছে। নতুন জুতো পায়ে লাগাতে গিয়ে তাঁর একটা আশাভঙ্গ হলো। কিন্তু কয়েক বার চেষ্টার পর তিনি বুঝতে পারলেন যে এটা একটা ব্যর্থ চেষ্টা। এবং পেটেন্ট চামড়ার জুতো জোড়াই পরলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী বদলটা লক্ষ্য করলেন।

‘নতুন জুতো যদি কখনও না পরো, তবে আঁট ভাবটা কাটবে কী করে?’ স্ত্রী বললেন।

‘ও তো খোঁড়াদের জুতো,’ কর্নেল প্রতিবাদ জানালেন। ‘একমাস পরে ঢিলে করা জুতোই ওদের বিক্রি করা উচিত।’

আজ কেন যেন তাঁর মনে হচ্ছে চিঠিটা আসবে-- বিকেল-বেলায়। এই পূর্ববোধ নিয়েই তিনি রাস্তায় বেরুলেন। এখনও যখন লঞ্চ আসার সময় হয়নি, তিনি সাবাসের অফিস ঘরে বসে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু ওরা তাকে জানালে যে সোমবারের আগে সে ফিরবেন না। এ অসুবিধেটা তিনি আশা করেননি, কিন্তু তাই বলে তাঁর সব আস্থা হারালেন না। ‘আগে হোক, পরে হোক, আসতে তো তাকে হবেই,’ নিজেকে বোঝালেন তিনি, তারপর জাহাজঘাটের দিকে চললেন। মুহূর্তটা চমৎকার, এখনও নিষ্কলুষ প্রাঞ্জলতার এক মুহূর্ত!

‘সারা বছরটারই ডিসেম্বর হওয়া উচিত,’ মৃদুস্বরে তিনি বললেন, সিরিয়ান মোসেস এর দোকানে বসে। ‘নিজেকে মনে হয় যেন কাচের তৈরি।’

তার প্রায়-ভুলে-যাওয়া আরবিতে ভাবনাকে তর্জমা করবার একটা চেষ্টা করলে মোসেস। সে এক গোবেচারা আরব, কান পর্যন্ত মসৃন পাতলা চামড়ায় মোড়া, তার নড়াচড়ার ভঙ্গি সবসময় কেমন একটা একটা ডুবন্ত মানুষের মতো কৌশলহীন। প্রকৃত পক্ষে, তাকে দেখে মনে হয় এই বুঝি তাকে জল থেকে টেনে তোলা হয়েছে।

‘আগে তো তা-ই ছিলো,’ সে বলল। ‘এখনও যদি আগের মতো হতো তো আমার বয়েস হতো আটশো সাতানব্বুই বছর। আর আপনার?’

‘পঁচাত্তর,’ বললেন কর্নেল, তাঁর চোখ পিছু নিয়েছে পোস্ট-মাস্টারের। আর শুধু তখনই তিনি আবিষ্কার করলেন সার্কাসটা। ডাকনৌকোর ছাতে তালিলাগানো তাঁবুটা চিনতে পারলেন তিনি একগাদা রঙিন জিনিসের মাঝখানে। এক ঝলকের জন্য পোস্টমাস্টারকে হারালেন তিনি চোখ থেকে, অন্যান্য লঞ্চের ওপর বড়ো-বড়ো খাঁচায় জানোয়ারগুলোকে তাঁর চোখ খুঁজে বেড়ালো। তাদের তিনি খুঁজে পেলেন না।

‘সার্কাস,’ তিনি বললেন। ‘দশ বছরে এই প্রথম একটা সার্কাস এলো।’

সিরিয়ান মোসেস তাঁর খবরটা যাচাই করে দেখল। ভাঙা-ভাঙা আরবি আর স্প্যানিশে সে তার স্ত্রীকে কী বলল। স্ত্রী দোকানের পেছন থেকে উত্তর দিল। সে নিজের মনেই কী একটা মন্তব্য করল, তারপর কর্নেলকে তাঁর উদ্বেগটা অনুবাদ করে বোঝাল।

‘আপনার বেড়ালটা লুকিয়ে রাখুন, কর্নেল। ছেলেরা নয়তো সেটাকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে সার্কাসওলার কাছে বেচে দেবে।’

কর্নেল পোস্টমাস্টারের পেছন নেবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন।

‘এ কোনো বুনো জানোয়ারের খেলা নয়,’ তিনি বললেন।

‘তাতে কিছু এসে-যায় না,’ সিরিয়ান তাঁকে বলল। ‘ঐ যারা দড়ির ওপর হাঁটে, ওরা বেড়াল খায়, যাতে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় না ভাঙে।’

পোস্টমাস্টারকে অনুসরণ করে জলের সামনের দোকানগুলো পেরিয়ে তিনি প্লাজায় এসে পড়লেন। সেখানে মোরগের লড়াইয়ের বিকট চ্যাঁচামেচি তাঁকে বিস্মিত করে দিলে। কে একজন পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাঁর মোরগটা সম্বন্ধে কী একটা মন্তব্য করল। শুধু তখনই তাঁর মনে পড়লো যে আজই হলো মহড়ার দিন।

ডাকঘরটা তিনি পেরিয়ে গেলেন। একমুহূর্ত পরেই তিনি রিঙের খ্যাপা আবহাওয়ার মধ্যে পুরোপুরি ডুবে গেলেন। তিনি দেখলেন, রিঙের মাঝখানে তাঁর মোরগটা দাঁড়িয়ে আছে, একা, প্রতিরোধহীন, ছেঁড়া কাঁপড়ে বাঁধা তার পায়ের ধারাল নখর, তার পা যেভাবে কাঁপছে তাতে ভয়ের মতো কিছু-একটা দেখা যাচ্ছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হলো একটা বিষণœ ছাইরঙা মোরগ।

কর্নেল কোনো আবেগ অনুভব করলেন না। পর পর একই ধরনের অনেকগুলো আক্রমণ হলো। সোৎসাহ জয়ধ্বনির মধ্যে মুহূর্তের জন্য পালক, পা আর ঘাড়ে-ঘাড়ে মাখামাখি। পাটাতনের বেড়ায় ঘা খেয়ে একটা ডিগবাজি খেয়েই প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরে এলো লড়াইতে। কর্নেলের মোরগটা তাকে আক্রমণ করল না। সে শুধু সব হামলাকে ঠেকাল, আবার ঠিক একই জায়গায় পড়ে গেলো। কিন্তু এখন আর তার পা কাঁপছে না।

এরনান বেড়াটার ওপর থেকে ঝাপ দিয়ে রিঙে নেমে পড়ল, দুই হাত দিয়েই তাকে তুলে ধরল, আর তাকে তুলে দেখালো চারপাশের ভিড়কে। হাততালি চিৎকার এবং জয়ধ্বনির সে কী তুলকালাম বিস্ফোরণ। কর্নেল লক্ষ করে দেখলেন লড়াইয়ের তীব্রতা আর জয়ধ্বনির উৎসাহের মধ্যে পার্থক্য কতটা। সবটা তাঁর একটা প্রহসন বলে মনে হলো-- স্বতঃস্ফূর্তভাবেই, সচেতনভাবেই,-- মোরগরাও নিজেদের অল্প করে ছেড়ে দিয়েছে।

একটু নাকসিঁটকানো কৌতূহলের খোঁচায় তিনি বৃত্তাকার রিংটাকে ভালোভাবে দেখলেন। উত্তেজিত একটা ভিড় রিঙের দিকে নেমে আসছে। কর্নেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তপ্ত, উৎকণ্ঠিত, ভীষণ সজীব মুখগুলোকে। এরা নতুন লোক। শহরের যত নবাগত লোকজন। অলুক্ষুণে আশঙ্কার সঙ্গে তাঁর স্মৃতির ধার থেকে মুছে যাওয়া একটা মুহূর্ত যেন আবার সজীব হয়ে উঠেছে তাঁর মধ্যে। তারপর তিনি বেড়া টপকে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন রিঙের দিকে। আর এরনানের শান্ত চোখ দুটির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো। অপলক চোখে তাঁরা পরস্পরকে তাকিয়ে দেখলেন।

‘শুভ সন্ধ্যা কর্নেল।’

কর্নেল তাঁর হাত থেকে মোরগটাকে নিয়ে এলেন। ‘শুভ সন্ধ্যা,’ মুদুস্বরে বললেন তিনি। এবং আর-কিছুই তিনি বললেন না-- কারণ জীবটার উষ্ণ গভীর বুকের শব্দ তাঁর মধ্যে শিহরণ তুলে দিয়েছে। তিনি ভাবলেন যে এর আগে আর কখনো এতো জীবন্ত একটা জিনিস তিনি তাঁর হাতের মধ্যে অনুভব করেননি।

এরনান দ্বিধান্বিত ভাবে বলল, ‘আপনি বাড়ি ছিলেন না।’

এক নতুন জয়ধ্বনি তাঁকে থামিয়ে দিল। কর্নেলের কেমন ভয় লাগলো। কারোর দিকে না তাকিয়েই আবার তিনি ভিড় ঠেলে এগোলেন। হাততালি আর জয়ধ্বনিতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, এবং হাতের মধ্যে মোরগটাকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন রাস্তায়।

সারা শহর-- যত দরিদ্র লোক-- বেরিয়ে এলো তাঁকে দেখতে, রাস্তা দিয়ে চলার সময় স্কুলের বাচ্চাদের দল তাঁকে অনুসরণ করল। একটা টেবিলের ওপর দাঁড়িয়েছিলো এক অতিকায় নিগ্রো, গলায় একটা সাপ জড়ানো, কোনো লাইসেন্স ছাড়াই সে প্লাজায় গাছগাছরা বিক্রি করছে। জাহাজঘাটা থেকে ফেরা এক মস্ত জটলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে তার বাগাড়ম্বর। কিন্তু কর্নেল যখন মোরগটাকে কোলে নিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেলেন, তাদের মনোযোগ পড়লো তাঁর ওপর। বাড়ি ফেরার রাস্তা কোনোদিনই এমন লম্বা ঠেকেনি আগে।

কোনো খেদ নেই তাঁর। দীর্ঘদিন ধরে শহরটা যেন পড়ে ছিলো ঝিম মেরে, দশ বছরের ইতিহাস দ্বারা ছাড়খার হয়েছিলো। ঐ বিকেলে-- চিঠি-বিহীন আরো-একটা শুক্রবারে-- লোকজন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে। কর্নেলের মনে পড়ে গেলো অন্য-এক যুগ। নিজেকে তিনি দেখতে পেলেন স্ত্রীপুত্র সহ অনুষ্ঠান দেখছেন একটা ছাতার নীচে, বৃষ্টি তাদের অনুষ্ঠান দেখাকে ডিস্টার্ব করতে পারছে না। তাঁর মনে পড়ে গেলো দলের নেতাদের, নিখুঁত সাজপোশাক গায়ে, তাঁর বাড়ির ভেতরের উঠানে বসে বাজনার তালে তালে পাখা দিয়ে হাওয়া করছেন নিজেদের। তাঁর পেটের পাকস্থলীর মধ্যে পেতলের ঢাকের আওয়াজটা আবার যেন কাতরভাবে অনুভব করলেন তিনি।

জাহাজটার সমান্তর রাস্তাটা ধরে তিনি হাঁটছেন, আর, সেখানেও, দেখলেন কতকাল আগেকার ভোটের দিনের উত্তেজিত মানুষজন। তারা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছে সার্কাস দলের অবতরণ। একটা তাঁবুর মধ্য থেকে একটা মেয়ে মোরগটা সম্বন্ধে কী যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল। তিনি হেঁটে চললেন বাড়ির দিকে, আত্মমগ্ন, ছেঁড়া-ছেঁড়া ছড়ানো কথা কানে আসছে এখনও, যেন রিঙের মধ্যকার জয়ধ্বনির রেশ এখনও তাড়া করে আসছে তাঁকে।

বাড়ির দরজায় এসে বাচ্চাদের তিনি বললেন :

‘তোমরা সবাই বাড়ি যাও,’ বললেন তিনি, ‘যে ভেতরে আসবে, তাকে কিন্তু পেটাবো।’

তিনি দরজায় খিল লাগিয়ে দিলেন, সোজা রান্নাঘরে চলে গেলেন। তাঁর স্ত্রী অবরুদ্ধ কান্নাসহ শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

‘ওরা জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো,’ তিনি বললেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে। ‘আমি তাদের বললাম যে, যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, কেউ মোরগটাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। কর্নেল চুলাটার পায়ের সঙ্গে মুরগীটাকে বেঁধে রাখলেন। ক্যানের জল পালটে দিলেন, স্ত্রীর কাতর গলা তাঁকে অনুসরণ করছে।

‘ওরা বলল আমাদের মৃতদেহ মাড়িয়েই নিয়ে যাবে,’ স্ত্রী বললেন। ‘ওরা বললে মোরগটা নাকি আমাদের নয়-- বরং সারা শহরের।’

কেবলমাত্র মোরগটার যতœ শেষ হলেই কর্নেল স্ত্রীর মুখোমুখি হলেন। তিনি অবিস্মিতভাবে আবিষ্কার করলেন, যে তাঁর মধ্যে অনুতাপ বা অনুকম্পা, কোন কিছুরই কোনো অনুভূতি নেই।

‘ওরা ঠিকই বলেছিলো,’ শান্তস্বরে তিনি বললেন। আর তারপর, নিজের পকেট হাৎড়ে, অতল মধুর স্বরে বললেন :

‘মোরগটাকে বিক্রি করা হবে না।’

স্ত্রী তাঁকে অনুসরণ করে এলেন শোবার ঘরে। স্বামীকে তাঁর পুরোপুরি একটা মানুষ মনে হলো, কিন্তু যেন অস্পৃশ্য মানুষ, যেন তাঁকে তিনি সিনেমার পর্দায় দেখেছেন। কর্নেল জামা রাখার আলমারি থেকে একগোছা নোট বের করে নিলেন, তার সঙ্গে যোগ করে দিলেন নিজের পকেটে যা-কিছু ছিলো, তারপর পুরোটা গুনলেন, তারপর সব আবার আলমারি রেখে দিলেন।

‘আমার বন্ধু সাবাসকে ফিরিয়ে দেবার জন্যে ঊনত্রিশ পেসো রয়েছে,’ তিনি বললেন। ‘পেনশন যখন আসবে, বাকিটা তাকে দেয়া হবে।’

‘আর যদি তা না আসে?’ স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আসবেই।’

‘কিন্তু যদি না-ই আসে?’

‘ভাল, তাহলে বাকি টাকা ও পাবে না।’

নতুন জুতোজোড়াকে খুঁজে পেলেন খাঁটের তলায়। জুতোর বাক্সের জন্য ক্লোসেটে ফিরে গেলেন, জুতোর তলা মুছলেন ন্যাকড়া দিয়ে, তারপর জুতোজোড়া বাক্সে ভরে দিলেন, ঠিক যেরকমভাবে রোববার রাতে তাঁর স্ত্রী জুতোজোড়া কিনেছিলেন। স্ত্রী একবারও নড়লেন না।

‘জুতোজাড়াও ফিরে যাবে,’ কর্নেল বললেন। ‘বন্ধুর জন্যে আরো তেরো পেসোর ব্যবস্থা হলো।’

‘ওরা আর ফিরিয়ে নেবে না,’ স্ত্রী বললেন।

‘নিতেই হবে,’ কর্নেল উত্তর দিলেন। ‘আমি শুধু দুবার পায়ে দিয়েছি।’

‘তুর্কিরা এসব জিনিস বোঝে না,’ স্ত্রী বললেন।

‘তাদের বুঝতে হবে।’

‘যদি না বোঝে?’

‘ভাল, তবে বুঝবে না।’

না খেয়েই শুয়ে পড়লেন দুজনে। কর্নেল অপেক্ষা করলেন কখন তাঁর স্ত্রীর জপ শেষ হয়, তারপর বাতি নিভিয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর ঘুম এলো না। সিনেমার শ্রেণীভাগ করে বাজা ঘণ্টার শব্দ কানে এলো, আর যেন সঙ্গে সঙ্গেই-- তিন ঘণ্টা পরে-- এলো কারফিউ-এর তূরী। বরফায়িত রাত্রের হাওয়ায় স্ত্রীর বুকের ঘর্ঘর কেমন যন্ত্রণাময় শোনালো। কর্নেলের চোখ তখনও খোলা ছিলো, যখন স্ত্রী শান্ত, আপোষ করা কণ্ঠস্বরে বললেন :

‘জেগে আছো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কারণটা একটু বুঝে দেখার চেষ্টা করো,’ স্ত্রী বললেন। ‘কালকেই বন্ধু সাবাসের সঙ্গে কথা বলবে।’

‘ও সোমবারের আগে আর ফিরবে না।’

‘আরো ভালো,’ বললেন স্ত্রী। ‘তাহলে তো ওকে কী বলবে সে ভাবতে তুমি তিন তিনটি দিন পেয়ে যাবে।’

‘এ সম্বন্ধে ভাবার কিছুই নেই,’ কর্নেল বললেন।



অক্টোবরের বীভৎস আবহাওয়ার জায়গায় চমৎকার একটা মধুর শীতল হাওয়া চলছে। টিট্টিভদের সময়সূচির মধ্যে কর্নেল আবার ডিসেম্বরকে চিনতে পারলেন। যখন দুটো বাজলো, তখনও তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেননি। কিন্তু তিনি এটাও জানেন যে তাঁর স্ত্রীও জেগে আছেন। তিনি দড়ির খাটে পাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করলেন।

‘তুমি ঘুমোতে পারছো না,’ স্ত্রী বললেন।

‘না।’

একমুহূর্ত ভাবলেন তাঁর স্ত্রী।

‘অমন করার মতো অবস্থা আমাদের নয়,’ স্ত্রী বললেন। ‘শুধু একবার ভাবো একসঙ্গে চারশো পেসো কতগুলো টাকা বলোতো।’

‘পেনশন আসতে আর দেরি নেই,’ কর্নেল বললেন।

‘তুমি পনেরো বছর ধরে এই একই কথা বলে আসছো।’

‘সেইজন্যেই,’ কর্নেল বললেন, ‘আর বেশি দেরি হবে না।’

স্ত্রী চুপ করে গেলেন। কিন্তু আবার যখন তিনি কথা বললেন, কর্নেলের মনে হলো কথার ফাঁকে সময় যেন একটুও এগোয়নি।

‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ও টাকা আর কখনো আসবে না,’ স্ত্রী বললেন।

‘আসবে।’

‘আর যদি না-আসে?’

উত্তর দেবার জন্য নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেলেন না কর্নেল। মোরগটার প্রথম ডাকে বাস্তব তাঁকে আঘাত করলো, কিন্তু তিনি আবার ঘন, নিরাপদ, অনুতাপহীন ঘুমে তলিয়ে গেলেন। যখন তাঁর ঘুম ভাঙলো, সূর্য ততক্ষণে আকাশের উঁচুতে উঠে এসেছে। তাঁর স্ত্রী তখনও ঘুমোচ্ছেন। কর্নেল নিয়মমাফিক তাঁর সকালবেলার কাজগুলো সব এক-এক করে সারলেন, দু’ঘণ্টা দেরি করে, এবং অপেক্ষা করতে লাগলেন স্ত্রী কখন নাস্তা খেতে আসবেন।

তিনি জেগে উঠে আদৌ কোনো কথা বলতে চাইলেন না। তাঁরা এক কাপ করে কালো কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন, একটুকরো পনির আর মিষ্টি রোলও খেয়েছেন। সারা সকালটা তিনি দরজির দোকানে কাটিয়ে দিলেন। একটার সময় বাড়ি ফিরে দেখলেন বেগোনিয়ার ঝাড়ের মধ্যে বসে স্ত্রী জামাকাপড় রিফু করছেন।

‘খাবার সময় হলো,’ কর্নেল বললেন।

‘কোনো খাবার নেই।’

কর্নেল কাঁধ ঝাঁকালেন। ভেতরের অঙ্গনের দেয়ালের ফাঁক-ফোকরগুলো বুজিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন তিনি-- বাচ্চারা যাতে রান্নাঘরে ঢুকতে না পারে। যখন হলঘরে ফিরে এলেন, টেবিলে খাবার অপেক্ষা করছে।

খেতে খেতে কর্নেল বুঝতে পারলেন তাঁর স্ত্রী কান্নায় ভেঙে না পড়ার জন্যে ভীষণ চেষ্টা করছেন। সেটা তাঁকে নিশ্চিতভাবে আতঙ্কিত করে তুললো। তিনি তাঁর স্ত্রীর ধাত জানেন, স্বভাবতই তা কঠিন, আর চল্লিশ বছরের দুঃখ-কষ্টের তিক্ততায় তা আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। ছেলের মৃত্যুও তাঁর মধ্য থেকে একফোঁটা চোখের জল নিংড়ে বের করতে পারেনি।

তিনি সোজাসুজি তিরস্কার-ভরা চোখে স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালেন। স্ত্রী ঠোঁট কামড়ে, জামার হাতায় চোখের জল মুছলেন, তারপর খেতে লাগলেন।

‘তোমার কোনো বিবেচনা নেই,’ স্ত্রী বললেন।

কর্নেল কোনো কথা বললেন না।

‘তুমি স্বেচ্ছাচারী, জেদি, অবিবেচক,’ স্ত্রী বললেন আবার। তিনি প্লেটের ওপর তাঁর ছুরি আর কাঁটা আড়াআড়ি করে রাখলেন, কিন্তু পরক্ষণেই কুসংস্কারবশত সেগুলো আলাদা করে ভুলটা শোধরালেন। ‘সারা জীবন ধরে এরকম নোংরা খেয়ে খেয়ে শেষে কী দেখলাম, একটার মুরগীর চেয়েও আমি কম বিবেচনার উপযুক্ত।’

‘ওটা তো আলাদা কথা,’ কর্নেল বললেন।

‘একই কথা,’ স্ত্রী উত্তর করলেন। ‘তোমার বোঝা উচিত যে আমি মরতে বসেছি। এই যে অসুখটা আমার, সেটা তো কোনো অসুখই নয়, তিলে তিলে মৃত্যু।’

কর্নেল খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত আর একটা কথাও বললেন না।

‘ডাক্তার যদি গ্যারান্টি দিতে পারে যে মোরগটাকে বিক্রি করলেই তোমার হাঁপানি সেরে যাবে, আমি তবে এক্ষুণি তাকে বিক্রি করে দেবো,’ কর্নেল বললেন। ‘কিন্তু তা যদি না হয়, তবে না।’

সেদিন বিকেলে মোরগটাকে তিনি রিঙের মধ্যে নিয়ে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন স্ত্রীর আবার হাঁপানীর টান উঠেছে। তিনি হলের মধ্যে পায়চারি করছেন, ঘরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত, তাঁর চুল পিঠে এলিয়ে আছে, হাত দুটো দু-দিকে ছড়ানো, ফুসফুসের মধ্য থেকে দম ফেলবার চেষ্টা করলেন। সন্ধে হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকলেন স্ত্রী। তারপর তিনি স্বামীর সঙ্গে একটাও কথা না বলে শুতে চলে গেলেন ।

কারফিউ নামার একটু পর পর্যন্ত তিনি প্রার্থনা করে গেলেন। তারপর কর্নেল বাতি নেভাবার জন্যে উদ্যোগ করতেই তিনি বাধা দিলেন।

‘আমি অন্ধকারে মরতে চাই না,’ তিনি বললেন।

কর্নেল বাতিটা মেঝেয় নামিয়ে রাখলেন। কী রকম অবসন্ন লাগতে শুরু করেছে তাঁর। যদি সবকিছু ভুলে যেতে পারতেন একবার, যদি একটানা চুয়াল্লিশ দিন ঘুমিয়ে কাটাতে পারতেন, এবং জেগে উঠতে পারতেন ২০ জানুয়ারি বেলা তিনটায়, রিঙের মধ্যে ঠিক যখন মোরগটাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু স্ত্রীর অনিদ্রায় তাঁর ভয় লাগতে লাগলো।

‘সবসময়েই সেই একই কাহিনী,’ স্ত্রী শুরু করলেন পরক্ষণে।

‘আমরা না খেয়ে থাকবো, কারণ অন্যরা যাতে খেতে পারে। চল্লিশ বছর ধরে ঐ এক গল্প।’

কর্নেল সে পর্যন্ত চুপ করে থাকলেন যতক্ষণ না তার স্ত্রী একটু থেমে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি জেগে আছেন কিনা। তিনি উত্তর দিলেন যে জেগে আছেন। মসৃণ, স্বতস্ফূর্ত, নিখুঁত স্বরে স্ত্রী বলে গেলেন।

‘মোরগটাকে নিয়ে বাজি ধরে সবাই জিতবে, কেবলমাত্র আমরা ছাড়া। শুধু আমাদেরই বাজি ধরার মতো একটা সেন্টও নেই।’

‘মোরগটার মালিক শতকরা কুড়ি ভাগ পাবে।’

‘যখন তুমি ওদের জন্য খেটে খেটে ভোটের সময় পিঠটা ভেঙেছিলে, তখনও তোমার একটা জায়গা একটা অবস্থান পাবার কথা ছিলো,’ স্ত্রী উত্তর দিলো। ‘গৃহযুদ্ধের সময় যখন গলাটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো, তখনও কথা ছিলো যে যুদ্ধের পর তুমি একটা ভাতা পাবে। এখন সবাই যে যার আখের গুছিয়ে নিয়েছে, আর তুমি মরতে বসেছো অনাহারে, তিলে তিলে, পুরোপুরি একাকী।’

‘আমি তো একা নই,’ বললেন কর্নেল।

কর্নেল বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঘুম তাঁকে দখল করে বসলো। তাঁর স্ত্রী একটানা কথা বলতে বলতে একসময় টের পেলেন যে স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তিনি মশারির তলা থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকারেই বসার ঘরে পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন। সেখানেও তিনি কথা বলে চললেন, একটানা। কর্নেল ভোরবেলায় তাঁকে ডাকলেন।

দরজায় এসে দাঁড়ালেন স্ত্রী, ভূতের মতো, নিভু-নিভু বাতির আলোয় তলার দিকটা দেখা যায়। মশারির ভেতর ঢোকবার আগে তিনি বাতি নিভিয়ে দিলেন। কিন্তু কথা তাঁর থামলো না।

কর্নেল বাধা দিলেন। ‘আমরা একটা জিনিস করতে যাচ্ছি।’

‘একমাত্র যা আমরা করতে পারি তা হচ্ছে মোরগটাকে বেচে দেয়া,’ বললেন নারীটি।

‘আমরা ঘড়িটাও বিক্রি ক’রে দিতে পারি।’

‘ওরা ও ঘড়ি কিনবে না।’

‘কালকেই আমি দেখবো আলভারো চল্লিশটা পেসো দেবে কি না।’

‘সে তোমাকে দেবে না।’

‘তাহলে আমরা ছবিটা বেচে দেবো।’

স্ত্রী যখন আবার কথা বললেন, তখন তিনি আবার মশারির বাইরে। কর্নেল ওষুধি ভেষজের গন্ধে ভরা তাঁর নিঃশ্বাসের গন্ধ পেলেন।

‘ওরা ওটাও কিনবে না,’ স্ত্রী বললেন।

‘দেখাই যাক!’ নরম সুরে বললেন কর্নেল, স্বরে একফোঁটা বদল নেই। ‘এবার, ঘুমাতে যাও। কাল যদি কিছু বিক্রি করতে না পারি তো অন্য কোনো উপায় ভাবা যাবে।’

তিনি চোখ খুলে রাখবেন বলেই চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ঘুম তাঁর প্রতিজ্ঞাকে ভেঙ্গে দিল। তিনি এমন একটা কিছুর তলায় তলিয়ে গেলেন যার সময় বা স্থান বলে কিছু নেই, যেখানে তাঁর স্ত্রীর কথাগুলোর তাৎপর্য ভিন্ন রকম। কিন্তু পরক্ষণেই টের পেলেন তাঁকে কেউ কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে।

‘জবাব দাও আমার কথার।’

কর্নেল জানেন না যে কখন তিনি একথাগুলো শুনেছেন ঘুমের আগে না ঘুমের পরে। ভোর হয়ে আসছে প্রায়। জানলাটা দেখা যাচ্ছে রোববারের সবুজ প্রাঞ্জলতায়। তাঁর মনে হলো তাঁর জ্বর হয়েছে। তাঁর চোখ দুটো জ্বলছে এবং তাঁর মাথাটা পরিস্কার করতে তাঁকে অনেক চেষ্টা করতে হলো।

‘কী করবো আমরা, যদি কিচ্ছু বিক্রি করতে না পারি?’ স্ত্রী আবারও জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ততদিনে, জানুয়ারির বিশে এসে যাবে,’ কর্নেল পুরোপুরি সজাগ হয়ে বললেন, ‘ঐ দিন বিকেলেই ওরা শতকরা কুড়িভাগ বখরা দেবে।’

‘যদি মোরগটা জেতে,’ বললেন স্ত্রী। ‘কিন্তু যদি সে হেরে যায়? মোরগটা যে হারতেও পারে, এটা বুঝি তোমার মনে হয়নি?’

‘এ হচ্ছে এমন এক মোরগ, যে কখনো হারে না।’

‘কিন্তু, ধরো, ও হারলো।’

‘সে বিষয়ে ভাবার জন্যে চুয়াল্লিশটা দিন আছে এখনও,’ কর্নেল বললেন।

স্ত্রী তার ধৈর্য হারালেন।

‘আর ততদিন আমরা কী খাবো?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কর্নেলের ফ্লানেলের রাত-জামার কলারটা চেপে ধরলেন তিনি। শক্ত করে ঝাঁকুনি দিলেন তাঁকে।

পঁচাত্তর বছর লাগলো কর্নেলের-- তার জীবনের পঁচাত্তরটি বছর, মিনিট মিনিট করে-- এই মুহূর্তটায় পৌঁছুতে। নিজেকে খাঁটি লাগলো তাঁর, স্পষ্ট লাগলো, অজেয় লাগলো ঐ মুহূর্তটায় যখন তিনি উত্তর করলেন:
‘পায়খানা।’




অনুবাদক পরিচিতি
বিপাশা মণ্ডল
পিরোজপুর, বাংলাদেশ

কবি, গল্পকার ও অনুবাদক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ