অলাত এহসানের গল্প : পানি

টিনের বালতি থেকে ডাট ভাঁঙ্গা মগে দুধ মেপে দিতে দিতে খদ্দেরের কথার তর্ক ধরে রইসুদ্দি। ‘তাগো কত বড় মগ, যে নদীর পানি মাইপ্যা দিব? নদী কি কারো বাপের নিকি?’ তারপর বালতির তলায় জমে থাকা দুধটুকু এমনিতেই তার জগে ঢেলে দেয়।


অল্প বয়সী খদ্দের, গ্রামেরই ছেলে, হয়তো ঢাকায়-টাকায় পড়ে, সে ব্যাপারটা স্থানীয় ভাবে সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করে।‘তারা ওপারে বাঁধ দিয়েছে। ঐ যে, কাইশ্যাখালি বেড়ি বাঁধ আছে না?’ আঙ্গুল অদৃশ্যের দিকে তুলে বলে,‘সে রকম। আর বর্ষাকালে তিতপালদিয়া সুইচ দিয়ে যেমনে আছতে আছতে পানি ছাড়ে, সে রকম মেপে মেপে পানি দেয়। সে জন্যই তো, আমাদের এখানে পানি নাই। কাকা, পানির জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাচ্ছে।’

এবার রইসুদ্দি কিছুটা বুঝতে পারে। তবুও সবটা তার আয়ত্বে আসে না। বেড়িবাঁধ তো জমিনের উপর। তাহলে পদ্মার চেয়েও উষার নদীতে আবার বাঁধ দেয় কি করে? নদী তো কারো নিজের না। খোদার নিয়ামত। তাতে বাঁধ দিবেই বা কেন, আর পানিই আটকে রাখবে কেন? তার চোখে তখন নানান দৃশ্য ভর করে। বর্ষার পানির চাপে বাঁধ কি রকম ভেঙে যেতে চায়। তখন ভয় হয়, একরাতে না বাঁধ ভেঙে তার ঘর-বাড়ি, জমি-জেরাত সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাহলে নদীর ওপর বাঁধ আর থাকে কি করে? বর্ষায় ক্ষেত ভরা আউশ-আমন ধান, পাট-ধইঞ্চা। সুইচ গেটের নিচ দিয়ে ডাক ছেড়ে পানি ছোটে। খালের স্রোতে তখন উচা জালেই মাছ উঠে। সুইচ গেটের পাকা চাতালে মুঠো হাত সমান এক একটা শোল-নওলা-ভেটকা-মিরকা-পাবদা-টাকি মাছ লাফিয়ে উঠে। ছেলে পুলেরা হৈ চৈ করে তা ধরে। রইসুদ্দিরা তখন দু’একটা মাছ খেতে পারে। তার মনে তখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে বাঁধের কাছের মানুষ কি খুব মাছ খায়? খোদ্দেরের টাকা হাতে নিয়ে বৌয়ের ফরমায়েশের কথা মনে করতে থাকে রইসুদ্দি। লবণ, কদু আর মাছ নিতে বলেছে। টাকাগুলো পকেটে রাখতে রাখতে রাখতে ভাবে, আজ থাক, দু’দিক পর শুক্রবারের হাট থেকেই মাছ কেনা যাবে। এই কয় দিনও তার বৌ বাড়ির পাশের শাকপাতা দিয়ে চালিয়ে নিতে পারবে। টাকা এখন তার খুব দরকার। গতকাল মেশিন সাড়াই করা হয়েছে। তাতে কতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল! এজন্য অবশ্য বাড়ির পুরনো কড়ই গাছ বিক্রি করতে হয়েছে।

দাম বাড়ার কারণে এক গ্যালনের জায়গায় দুই লিটার ডিজেল নিয়েই বাড়ির দিকে দ্রুত পা চালায়। ছেলেটার স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তাকে না পেলে আজকের মতোও শ্যালো বন্ধ রাখতে হবে। বয়স হয়েছে তার। মেশিনা স্টার্ট দেয়া এখন আর তার ধর্তব্যের মধ্যে নেই। যেতে যেতে খোদ্দেরের কথাগুলো মনে পড়ে রইসুদ্দির। কি কি যেন বললো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা সে ভাবতে পারে না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা তার মনে পড়ে। যুদ্ধের সে কিছুই দেখে নাই। তবু সেই সময়ের আকালে গ্রাম কি গ্রাম উজার হয়েছে গেল। সে নিজেও মানুষের বাড়ি পেটে ভাতে থেকেছে। তার মা মিয়া বাড়ির মেয়ে বলে, রাতের আঁধারে ফুলাল ব্যাপারির বাড়ি ধান বেনে খাবার আনতো। চোখের সামনে তার দাদি শুকিয়ে শুকিয়ে মারা গেল। চক-পাথারের মরা গরু-ছাগলের পাশে মানুষও পড়ে থাকতো। শকুনগুলোও আর খেতে পারছিল না। রইসুদ্দি এখন আর যুদ্ধ নিয়ে ভাবে না, ভাবে আকালের কথা। ভাবে ঋণের কথা। গত বারের মতো এবারও বৃষ্টি না হলে কিস্তির টাকা শোধ করতে তাকে মেশিনটাই বিক্রি করতে হবে।

বাড়িতে উঠার রাস্তার পাশে কেটে নেয়া গাছের ডাল টানতে টানতে রইসুদ্দি তার স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে হাঁক দেয়,‘সিরাজ।’ সিরাজ জানে এখন তাকে কেন ডাকা হচ্ছে। এখন সিরাজের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এসময় সে মাঠে যেতে চায় না। তবুও তাকে নানান কথা আর ধমক-ধামকি দিয়ে মাঠে নিয়ে যায় তার বাবা।

মাঠ ফেঁটে চৌচির, ধানের চারাগুলো আধমরা। শূন্যের উপর ঢেউ খেলে রোদ। কয়েক বার হ্যান্ডেল ঘোরানোর পর ক্লান্ত হয়ে পরে সিরাজ। বৃষ্টিতে ঘরের বেড়ার মতো শরীর থেকে ঘাম বেরহতে থাকে তার। কিন্তু মেশিন স্টার্ট হয় না। সঙ্গে বালতিতে করে পানি পাইপের মুখে ঢেলে, তেলের পাইপ খুলিয়ে লাগিয়ে, মুখ লাগিয়ে চোষোণ দিয়ে চেষ্টা করে। কিছুই হয় না। মাঠের তাকিয়ে মায়া হয় রইসুদ্দির, সে আরো জোরে ঘোরাতে বলে। ক্লান্ত সিরাজ, স্কুলে যাওয়ার সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে, খুব খেপে উঠে সে। বাবার ছাটা-ছাটিতে রাগের সাথে হ্যান্ডেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ হাত ফসকে যায় তার। হ্যান্ডেলের বাড়ি লেগে খেকিয়ে উঠে।

‘কৈলাম এবছর পাইপ দুইড্যা বারান লাগবো। পানি নিচে নাইম্যা গেছে। শুনলো না আমার কতা। এই পুর‌্যান মিশিন তুমার জান খায়বো। তুমি থাকো তোমার মেশিন নিয়ে, আমি আর পারলাম না।’ বলেই বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সিরাজ। মাঠের অবস্থা দেখে ছেলের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের অবকাশ পায় না রইসুদ্দি। পেছন থেকে খিস্তি করতে থাকে।

‘হারাম জাদার কামে আইলেই কষ্ট। ভাত জুটে কনথ্যা ট্যার পায় না। নুয়াবের বাইচ্চা যায়!’ বয়স কালে রইসুদ্দি এর চেয়ে কত বড় বড় মেশিন কত চালিয়েছে। শেষ কাটালে এসে ছেলে দিয়েও কাজ করাতে পারবে না! এই ধান হলে সংসার চলবে কি করে, ভাছে কেউ? নিজেকে স্থির থাকতে পারে না রাইসুদ্দি, নিজেই হ্যান্ডেল ধরে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘোরাতে থাকে। ঘোরাতে ঘোরাতে কোথায় থেকে যেন একরাশ কালো ধোঁয়া চারপাশ আচ্ছন্ন করে দেয়। দু’চোখে অন্ধকার দেখে রইসুদ্দি।
তারপর এক সময় অনুভব করে তার হাত আর হ্যান্ডেলে নেই। অবস থুতনি ঠেকে আছে পানির ট্যাংকির উপর। মেশিনের হুইলারও ঘুরছে না, তার খিচুনী ওঠা বৌয়ের মতো দোল খাচ্ছে তার শরীর । কোনো কিছু বোধ করে উঠতে পারে না সে। সব কিছু ঝাঁপসা ঠেকে। একটু কুঁজো হয়েই বেহুঁসের মতো বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কোথায় কোন পা পড়ছে কিছুই খেয়াল নেই। হঠাৎ পা ফঁসকে খর খরে ড্রেনের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে রইসুদ্দি। ঢুলু ঢুলু মাথায় উঠতে গিয়ে পাথুরে মাটিতে কয়েক বার ঠোকোর খায়। দর দর করে তার শুষ্ক পক্ক চোখ থেকে পানি বেড়িয়ে আসে। অনেক দিন সে এতো কাছের পানির অবারিত উৎসটি টের পায়নি। শুধুই খুঁজে মরেছে। দপ দপ করে জ্বলতে থাকা ডান হাঁটু থেকে রক্তের ধারা ছুটছে। রইসুদ্দি একপাশে হেলিয়ে পরে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট ভাবে বেরিয়ে আসে কয়েকটি শব্দ, পানি-আকাল-তৃতীয় বিশ্ব-যুদ্ধ।



লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
গল্পকার
সাংবাদিক

alatehasan@yahoo.com +88 01714 784 385

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ