অনুবাদ : বিকাশ গণ চৌধুরী
“আর তা-চিহ্’র ব্যাপারে বলছি,তুই কি কখনো শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখেছিস ?”
একদিন সন্ধেয়, ওয়াং সিহ্-কু, ওর বন্ধু ইয়ুন নান-তি-এনের বাড়িতে বেড়াতে এসে এই প্রশ্নটাই করেছিল।
“না, আমি কখনো দেখিনি, তুই দেখেছিস ?”
মেই-তাও-জ়েন আর হুয়ান্-হাও-শান-চি’ইয়াও এর মত তা-চিহ্ ছিলেন মোঙ্গল যুগের একজন শ্রেষ্ঠ চিত্রকর। এই কথাগুলো যখন ওয়াং সিহ্-কু বলছিল ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শিল্পীর বিখ্যাত ছবি - বালুকাবেলা ,আর জড়ানো পট -আনন্দময় বসন্ত ।
“কিন্তু, অদ্ভুত ব্যাপার এটাই, আমি নিজেই নিশ্চিত নই যে ছবিটা আমিই দেখেছি কিনা। আসলে...”
“তুই জানিসই না ছবিটা তুই দেখেছিস না দেখিস নি, তুই কি বলতে চাস যে তুই ঐ ছবিটার কোন নকল দেখেছিস ?”, কৌতূহলী চোখে ইয়ুন নান-তি-এন বলল।
“না, নকল না। আমি আসলটাই দেখেছিলাম। আর আমিই একমাত্র লোক নই যে ওটা দেখেছে। বিখ্যাত সমালোচক ইয়েন-কো আর লিয়েন-চাউ দু’জনেই শরৎ পাহাড়-এর ঘটনাটায় যুক্ত ছিলেন”। এই বলে ওয়াং সিহ্-কু চায়ে চুমুক দিয়ে মুচ্কি একটা হাসি হাসলেন। “এটা শুনে কি তুই বিরক্ত হচ্ছিস ?”
“ঠিক এর উল্টো”, শান্তভাবে মাথা নেড়ে বলল ইয়ুন নান-তি-এন; আর তামার লন্ঠনের আলোটা উস্কে দিল।
#
সেসময় (ওয়াং সিহ্-কু শুরু করলেন) ধ্রুপদী শিল্পী হুয়ান্ তাই বেঁচে। একদিন সন্ধেয় ইয়েন-কোর সঙ্গে চিত্রকলা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে তিনি প্রশ্ন করে বসলেন, আপনি কি তা-চিহ্’র শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখেছেন। জান বোধহয়, ইয়েন-কো ছিলেন তা-চিহ্’র ছবির এক খাঁটি ভক্ত, আর তাই মনে হয় তিনি ওনার কোন ছবি দেখেন নি এমনটা হবার নয়। কিন্তু তিনি কখনোই সেই শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখেন নি।
“না, আমি ওটা দেখিনি”, লজ্জায় মুখ নিচু করে তিনি বললেন,“আর কস্মিনকালেও ও রকম কিছু একটা যে আছে তা শুনি নি।”
“সে ক্ষেত্রে”, হুয়ান তাই বললেন, “দয়া করে ঐ ছবিটা দেখার প্রথম যে সুযোগটা আপনি পাবেন সেটা হাতছাড়া করবেন না। শিল্প হিশেবে ওটা গ্রীষ্ম পাহাড় বা ভ্রাম্যমান ঝঞ্ঝা-র থেকেও অনেক উঁচু দরের। আসলে, যদিও আমি স্থির নিশ্চিত নই তবুও বলব যে ওটাই তা-চিহ্’র সর্বোত্তম ছবি।”
“সত্যি ? ওটা ওনার সবসেরা শিল্পকর্ম ? তবে তো যেভাবেই হোক ওটা আমাকে দেখতে হবে। আমি কি জানতে পারি ছবিটার মালিক কে ?”
“ ওটা হুন শহরের চাং মশাইয়ের বাড়িতে আছে। আপনার যদি কখনও চিন্-শান্ মন্দিরে যাবার সুযোগ হয়, আপনি ওনার সঙ্গে দেখা করে ছবিটা দেখে আসবেন। আপনাকে কি একটা পরিচয়পত্র দিয়ে দেব।”
হুয়ান তাই-এর চিঠিটা পাওয়া মাত্রই ইয়েন-কো হুন শহরে যাবার পরিকল্পনা করে ফেললেন। তিনি ভাবলেন, যে বাড়িতে ওরকম একটা দামী ছবি আছে সেখানে নিশ্চয়ই বিভিন্ন যুগের আরো অনেক বিখ্যাত ছবি আছে। এই ভাবনায় বিভোর হয়ে ইয়েন-কো যাত্রা শুরু করলেন।
হুন শহরে পৌঁছে চাং মশাইয়ের বাড়ি দেখে তো ইয়েন-কো অবাক, বাড়িটার গঠনে একটা সম্ভ্রান্ত ভাব থাকলেও বাড়িটা খুবই ভাঙ্গাচোরা। বাড়িটার দেওয়াল বেয়ে আইভি-লতা পাকিয়ে উঠেছে, বাগান জুড়ে বেড়ে উঠেছে ঘাস আর নল-খাগড়ার বন।বুড়ো মানুষটা এগোতে যেতেই হাঁস, মুরগী আর শষ্যক্ষেতে চড়ে বেড়ানো আরো অন্যসব পাখিরা গলা তুলে তাকে দেখতে লাগলো, এ বাড়িতে কেউ আসতে পারে দেখে তারা যেন একটু অবাকই হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য তিনি হুয়ান তাই-এর কথায় সন্দেহ করলেন আর অবাক হয়ে ভাবলেন তা-চিহ্’র সেই বিখ্যাত ছবিটা এ বাড়িতে এলো কী করে। ওনার কড়া নাড়ায় একটা চাকর বেরিয়ে এলে তিনি তার হাতে চিঠিটা তুলে দিয়ে বললেন যে তিনি অনেক দূর থেকে শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখবার আশায় এসেছেন।
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তাকে একটা বড় হলঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে লাল চন্দনকাঠের ডিভান আর টেবিলগুলো নিয়মমতো ঠিকঠাক জায়গায় থাকলেও সবকিছুতেই লেগে ছিল একটা পুরোনো পচা গন্ধ, আর একটা নিঝুম বিষণ্ণতা, এমন কি মেঝের টালিগুলোতেও। এরপর এলেন সেই বাড়ির মালিক, ফ্যাকাশে মুখ, অসুস্থ চেহারা, কমনীয় হাতের এক সৌম্যকান্তি পুরুষ। এরপর ইয়েন-কো কোনরকম সময় নষ্ট না করে ছোট্ট করে নিজের পরিচয় দিয়ে গৃহকর্তাকে জানালেন তা-চিহ্’র বিখ্যাত ছবি -শরৎ পাহাড়-টা দেখবার সুযোগ পেলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন। তার কথার মধ্যে কেমন যেন একটা তাড়া ছিল, তিনি যেন ভয় পাচ্ছিলেন, যেন তিনি ঐ ছবিটা তক্ষুনি দেখতে পাবেন না, ওটা কোনভাবে কুয়াশার মতো উবে যাবে।
কোনরকম দ্বিধা না করেই চাং মশাই ঐ হলঘরের ন্যাড়া দেওয়ালে ঐ ছবিটা টাঙিয়ে দিলেন।
“এই যে, এটাই সেই শরৎ পাহাড়, যার কথা আপনি বলছিলেন”, উনি বললেন।
প্রথম দেখায় ইয়েন-কো’র তো বিস্ময়ে শ্বাসরোধ হবার অবস্থা। ছবি জুড়ে সবুজ রঙের প্রাধান্য। এক দিক থেকে আর এক দিকে একটা নদী এঁকেবেঁকে চলেছে; নানান জায়গায় তার ওপর সেতু, দু’তীর বরাবর ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। এই সব কিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে মাথা তুলে থাকা পর্ব্বতচূড়ার সারি, যার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে শরতের টুকরো টুকরো মেঘ । বড় পাহাড় আর তার চারপাশের ছোট-ছোট পাহাড় সব টাটকা সবুজ, যেন এক্ষুনি বৃষ্টিতে ভিজেছে, আর পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের লাল পাতায় এক অনৈসর্গিক সৌন্দর্য্য। ওটা কোন সাধারণ ছবি ছিল না, ওটা ছিল এমন একটা ছবি যেখানে রঙ আর বিন্যাস উৎকর্ষতার এক চরম সীমায় পৌঁছেছিল। ওটা ছিল শিল্পে ধ্রুপদী সৌন্দর্য্যবোধ আর নৈসর্গিকতার এক চরম নিদর্শন।
“ তা’, কি ভাবছেন ? ছবিটা আপনার ভালো লাগলো ?”, আধখোলা চোখে ইয়েন-কো’র দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে চাং মশাই বললেন।
“ওহ্, এটা সত্যিই একটা স্বর্গীয় ছবি !” শ্রদ্ধায়-সম্ভ্রমে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইয়েন-কো বলে উঠলো। “হুয়ান্-চি’র অতি-প্রশংসার থেকেও ভালো। আমি আজ অবধি যত ছবি দেখেছি এই ছবির তুলনায় সবই দ্বিতীয় শ্রণির।”
“সত্যি ? আপনি এটাকে এতটাই সেরা বলে ভাবেন ?”
ইয়েন-কো ছবিটা থেকে তার বিস্ময়দৃষ্টি গৃহকর্তার দিকে ফেরাতে পারছিল না। “আপনার কোন সন্দেহ আছে ?”
“আরে,না,না, আমার কোন সন্দেহই নেই,” একটা স্কুলপড়ুয়া বাচ্চার মতো হক্চকিয়ে গিয়ে লজ্জায় মুখ লাল করে চাং মশাই বললেন। সলজ্জভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উনি বলতে থাকলেন : “আসলে যখনই আমি ছবিটার দিকে তাকাই, তখনই আমার মনে হয় আমি যেন চোখ খুলে স্বপ্ন দেখছি। আমার কেবলই মনে হয় শুধুমাত্র আমিই এই সৌন্দর্য্য দেখতে পাই, যা কিনা আমাদের এই পারিপার্শিক জগতের পক্ষে একটু বেশিই প্রগাঢ়। আপনার কথায় আমার সেই অনুভূতিগুলোই ফিরে এল।”
কিন্তু গৃহকর্তার নিজের কথার যথার্থতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা ইয়েন-কো’র মনে কোন রেখাপাতই করল না। ছবিটাই ওর সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল, আর চাং মশাইয়ের কথা শুনে ওর মনে হচ্ছিল উনি এই কথার আড়ালে তার মতামতের কোন এক খামতি ঢাকার চেষ্টা করছেন।
এর পরই, ইয়েন-কো সেই নিঝুম বিষণ্ণ বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
#
এরপর কয়েকটা সপ্তাহ যাবার পরও ইয়েন-কো’র মনে সেই শরৎ পাহাড় জ্বলজ্বল করতে লাগল (আর এক কাপ চা নিয়ে ওয়াং সিহ্-কু আবার শুরু করলেন)। তা-চিহ্’র এই অসাধারণ ছবিটা দেখার পর ওটা পাবার জন্য ও ওর সবকিছু দিয়ে দেবার জন্য তৈরি ছিল। আর ঘাগু সাংগ্রহক হবার দরুন ও জানতো যে ওর বাড়িতে ঝোলানো ছবিগুলোর মধ্যে একটাও - এমন কি পাঁচশো রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে কেনা লি ইয়াং-চিউ’র ভাসমান হিমানী ছবিটাও, শরৎ পাহাড়-এর পাশে দাঁড়াতে পারবে না।
আর কিছুদিন ঐ হুন শহরে থেকে ইয়েন-কো ঐ ছবিটা কেনবার জন্য কথাবার্তা বলতে চাং মশাইয়ের বাড়িতে একটা দালালকে পাঠালো। কিন্তু বারংবার চেষ্টা করেও ও চাং মশাইকে রাজী করাতে পারলো না। প্রত্যেকবারই ঐ ফ্যাকাশে, রুগ্ন ভদ্রলোক বললেন যে উনি ইয়েন-কোর শরৎ পাহাড়-এর ভালোলাগাটাকে শ্রদ্ধা করেন, এমন কি উনি ছবিটা ধার দিতেও রাজী, কিন্তু ছবিটার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ - তা হবার নয়, ওরা যেন ওকে এ ব্যাপারে মাপ করেন।
এই অস্বীকার ইয়েন-কো’র দুর্দমনীয় ইচ্ছেটাকে আরো চাগিয়ে দিল। ও নিজে নিজেই প্রতিঞ্জা করলো, “ ঐ দারুণ ছবিটা আমার হলঘরের দেওয়ালে ঝুলবেই ঝুলবে।” আর ঘটনাটা ঘটবেই এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে অবশেষে ও ব্যাপারটা মেনে নিয়ে শরৎ পাহাড়-কে সাময়িকভাবে ছেড়ে বাড়ি ফিরে এল।
“প্রায় এক বছর পর, আবার হুন শহরে এসে ইয়েন-কো চাং মশাইয়ের সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করার চেষ্টা করলো। কিছুই বদলায়নি : দেওয়াল বেয়ে, বেড়া বেয়ে সেই অগোছালোভাবে পাকিয়ে ওঠা অইভি লতা, আগাছায় ভরা বাগান। কিন্তু ওর কড়া নাড়ায় সাড়া দিয়ে চাকরটা জানালো যে চাং মশাই বাড়ি নেই। যদিও মালিক বাড়ি নেই তবুও কি একটিবার ঐ শরৎ পাহাড়-টা দেখা যাবে - ইয়েন-কোর এই কথায় কোন কাজ হল না, চাকরটাকে বললো : মালিক না আসা অবধি কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেবার অধিকার ওর নেই। আবারও একই কথা বলতে যেতেই লোকটা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠে ইয়েন-কো বেরিয়ে এল আর সেই অসাধারণ ছবিটা জনশুন্য কোন একটা ঘরের কোথাওএকটা পড়ে রইলো।”
#
ওয়াং সিহ্-কু একটু থামলেন।
“এতক্ষণ আমি যা বললাম তা আচার্য ইয়েন-কোর মুখ থেকে শোনা।”
“কিন্তু একটা কথা”, তার শাদা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে ইয়ুন নান-তি-এন বলল, “ইয়েন-কো কি সত্যি সত্যিই শরৎ পাহাড়-টা দেখেছিলেন ?”
“উনি বলেছিলেন যে উনি ওটা দেখেছেন। আসলে দেখেছিলেন না দেখেননি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবো না।আমাকে বাকি গল্পটা বলতে দাও তাহলে তুমি নিজেই বিচার করতে পারবে।”
ওয়াং সিহ্-কু গভীর মনোযোগ দিয়ে ওনার গল্প শুরু করলেন, আর এবার চায়ে চুমুক পর্যন্ত দিলেন না।
#
যখন ইয়েন-কো আমাকে এসব কথা বলেছিলেন (ওয়াং সিহ্-কু বললেন) ততদিনে তাঁর হুন শহরে যাবার প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে। আচার্য হুয়ান্-চি অনেকদিন হয় মারা গেছেন, আর চাং মশাই-এর বিশাল বাড়িটা তার অধঃস্তন দু’পুরুষের হাতে গিয়ে পড়েছে। শরৎ পাহাড় কোথায় আছে তার কোন খবর নেই, খবর নেই সেই জড়ানো-পটের ভালো অংশগুলোই বা কোন চুলোয় গেছে। আমাদের কথোপকথনের সময় বৃদ্ধ ইয়েন-কো সেই রহস্যময় ছবিটার এমন বিশদ বর্ণনা দিয়েছিলেন যে আমার মনে হয়েছিল আমি আমার চোখের সামনে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। ছবিটার সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম কাজ আচার্যকে মোহিত করেনি, তাঁকে বিমুগ্ধ করেছিল ছবিটার সামগ্রিক বর্ণনাতীত সৌন্দর্য্য। আচার্য’র সেই কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই তাঁর হৃদয়ের ভিতরে থাকা সেই সৌন্দর্য্য আমার হৃদয়ের ভিতরে গিয়ে পৌঁছেছিল।
আচার্য’র সঙ্গে কথা হবার মাসখানেক পর আমি দক্ষিণের প্রদেশগুলোয় কাজে গিয়েছিলাম যার মধ্যে হুন শহরও ছিল। ওখানে এক বৃদ্ধকে এ বিষয়ে বলায় তিনি বললেন যে আমি গিয়ে দেখতে পারি, শরৎ পাহাড় সম্ভবতঃ খুঁজে পাওয়া যাবে না, “যদি কখনো ছবিটা দিনের আলো দেখে তবে সেই দিনটা শিল্পের দুনিয়ায় একটা দারুণ দিন হবে।”
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেসময় আমি গভীর উৎকন্ঠায় সেই ছবিটা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু কাজে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে আমি চাং মশাইয়ের বাড়ি যাবার সময় পাবো না। আর এরমধ্যে একটা খবর আমার কানে এল, শুনলাম, ওয়াং নামের কোনএক অভিজাতের হাতে গেছে শরৎ পাহাড় ; আর ছবিটা সম্পর্কে জানা থাকায় শ্রীযুত ওয়াং চাং মশাইয়ের নাতির কাছে শুভেচ্ছা জানিয়ে একজন পত্রবাহক পাঠালেন। শোনা যায় উত্তরে চাং মশাইয়ের নাতি ঐ পত্রবাহকের হাত দিয়ে তাদের পরিবারের পুরনো কাগজপত্র, বংশানুক্রমে তাদের পরিবারে রাখা একটা পাব্বনি-কড়া তা যে কত পুরনো কেউ জানে না, আর আর তা-চিহ্’র শরৎ পাহাড় ছবিটার বর্ণনার সঙ্গে মানানসই একটা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এইসব উপহার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওয়াং মশাই চাং মশাইয়ের নাতির সন্মানে একটা দারুণ ভূরিভোজের আয়োজন করলেন যেখানে সেই যুবককে সন্মানীয় আসনে বসানো হল, দারুণসব সুস্বাদু খাবার, উচ্ছল সঙ্গীত আর মিষ্টি মেয়েদের দিয়ে আপ্যায়িত করা হল, সঙ্গে দেওয়া হল এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
খবরটা শুনে আনন্দে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। অর্ধ শতাব্দীর নানান উত্থান-পতনের মধ্যেও মনে হল শরৎ পাহাড় নিরাপদেই আছে। আর শুধু তাই নয় বাস্তবে ওটা এখন আমার হাতের নাগালের মধ্যে। না নিলেই নয় এরকম কয়েকটা জিনিষ নিয়ে আমি সঙ্গে-সঙ্গেই ছবিটা দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম।
আজও আমার ঐ দিনটার সব খুঁটিনাটি মনে আছে। দিনটা ছিল গ্রীষ্মের প্রথমদিকের একটা ঝক্ঝকে শান্ত বিকেল, ওয়াং মশাইয়ের বাগানে বড়ো বড়ো গোল গোল গোলাপি, লাল, শাদা ফুল ফুটে আছে। এই বাড়িতেই শরৎ পাহাড় আছে এই ভেবে ওয়াং মশাইকে দেখে, ওনাকে প্রথামাফিক অভিবাদন জানানোর আগেই খুশীতে আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি বলে উঠলাম, “ইয়েন-কো কতোগুলো বছর এই ছবিটা আর একবার দেখার জন্য ছট্ফট করছেন, আর আমি কত অনায়াসেই আমার ইচ্ছে পূরণ করতে চলেছি...’’
“আপনি খুব শুভক্ষণে এসেছেন, আজকের দিনটায় আমি ইয়েন-কো’র উপস্থিতি খুব আশা করছিলাম, আর বিখ্যাত সমালোচক লিয়েন-চাউকেও। দয়া করে ভিতরে আসুন, আর যেহেতু আপনিই সবার আগে এসেছেন আপনিই সবার আগে ছবিটা দেখবেন,” এই বলে ওয়াং মশাই শরৎ পাহাড় -টা দেওয়ালে টাঙাতে বললেন। আর আমার চখের সামনে লাফ দিয়ে পড়ল: নদীর ধারের ছোট ছোট গ্রাম, উপত্যকার ওপর ভেসে বেড়ানো মেঘের দল, একটা ভাঁজ করা পর্দার মতো পরতে পরতে খুলে যাওয়া সুদূর প্রসারিত সবুজ সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণি যা - একটা আস্ত জগৎ, আসলে তা-চিহ্ যা সৃষ্টি করেছিলেন, একটা দুনিয়া যা আমাদের দুনিয়াটা থেকে অনেক অনেক সুন্দর। দেওয়ালের ঐ ছবিটার দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকের ধুক্পুকানিই বেড়ে গেল।
এতে কোন ভুল নেই যে এইসব মেঘ, কুয়াশা, উপত্যকা সবই তা-চিহ্’র নিজের হাতের কাজ। তাছাড়া তা-চিহ্ ছাড়া আর কেই বা অঙ্কনশিল্পকে এরকম দক্ষতায় নিয়ে যেতে পারবে, তুলির টানে সবকিছুকে এরকম জীবন্ত করে তুলতে পারবে। উনি ছাড়া আর কেই বা রঙের গভীরতা আর গাঢ়তাকে রঙ-তুলির যান্ত্রিক ছোঁয়া লুকিয়ে প্রকাশ করতে পারবে ? কিন্তু ... কিন্তু একইসঙ্গে আমার এটাও মনে হতে লাগলো যে ইয়েন-কো যে ছবি অনেকদিন আগে দেখেছিলেন এটা সে ছবি নয়। না, মানে এটা দারুণ একটা ছবি, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছিল - যে ছবিটার বর্ণনা তিনি ধর্মীয় নিষ্ঠায় এত ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে করেছিলেন এটা সেটা নয়!
ওয়াং মশাই আর তার সহচরেরা আমার চারদিকে জড়ো হয়ে আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল, তাই আমি আমার উৎসাহের প্রাবল্য প্রকাশ করতে পারছিলাম না। স্বভাবতই, আমি চাইছিলাম না ছবিটার প্রামাণ্যতা নিয়ে ওনার মনে কোন সন্দেহ জাগুক, কিন্তু এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে আমার প্রশংসা ওনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। আর ঠিক তখনই ইয়েন-কো’র, যিনি প্রথম আমাকে শরৎ পাহাড় স্পম্পর্কে বলেছিলেন, আসার কথা ঘোষনা হল। তারপর যখন সেই বৃদ্ধ ওয়াং মশাইকে নিচু হয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন তখন তাঁর ভিতরকার উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু যেই না ওনার চোখ ঐ ছবিটার ওপর পড়লো মনে হল ওনার মুখের ওপর দিয়ে একটা মেঘ চলে গেল।
“আচার্য, আপনার কী মনে হল ?”, ওনাকে ভালোভাবে লক্ষ করতে করতে ওয়াং মশাই প্রশ্ন করলেন। “এক্ষুনি আমরা ওয়াং সিহ্-কু’র প্রবল উৎসাহপূর্ণ প্রশংসা শুনলাম, কিন্তু ...”
“আপনি মশাই খুবই ভাগ্যবান পুরুষ। এই যে আপনি এই ছবিটার মালিকানা অর্জন করেছেন, এর উপস্থিতি আপনার বাড়ির আর সব সম্পত্তির দীপ্তি বাড়িয়ে দেবে।’’
ইয়েন-কো’র সৌজন্য মাখানো কথায় ওয়াং মশাই-এর দুশ্চিন্তা আর বেড়ে গেল বলে মনে হল; আমার মতো উনিও ঐ কথাগুলোর মধ্যে একটা অপলাপের ছোঁয়া লক্ষ করেছিলেন। তারপর বিখ্যাত সমালোচক লিয়েন-চাউ আসরে অবতীর্ন হলে আমরা সকলে একটু স্বস্তি পেলাম। নিচু হয়ে আমাদের অভিবাদন করে উনি ছবিটার দিকে ফিরলেন আর নির্বাক হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে নিজের গোঁফ চিবোতে লাগলেন।
“এটাই মনে হয় সেই ছবি যা আচার্য ইয়েন-কো অর্ধ-শতাব্দী আগে শেষ দেখেছিলেন,” ওয়াং মশাই ওনাকে বোঝাতে লাগলেন। তারপর শুকনো হাসি হেসে বললেন, “এখন আমি আপনার মতামত শুনতে চাই; আপনার তাৎক্ষণিক মতামত।’’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিয়েন-চাউ আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ওয়াং মশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন : “সম্ভবতঃ এটাই তা-চিহ্’র সর্ব্বোত্তম সৃষ্টি। দেখুন, শিল্পী মেঘমালায় কিরকম আলোছায়ার প্রতিভাস সৃষ্টি করেছেন। তুলির কি জোর! লক্ষ করুন গাছপালার রঙ। আর দূরের ঐ শৈল-চূড়া, যা ছবিটার পুরো বিষয়টাকে জীবন্ত করে তুলেছে।’’ কথা বলতে বলতে লিয়েন -চাউ ছবিটার নানান অসাধারণ বৈশিষ্ঠ্য আঙুল তুলে তুলে দেখাতে লাগলেন, আর বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথমে স্বস্তি, তারপরে একটা পরম আনন্দ ওয়াং মশাইয়ের মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
এরইমধ্যে, সকলের চোখের আড়ালে আমি ইয়েন-কো’র সঙ্গে চোখে-চোখে কথা হল।আমি ফিস্ফিস্ করে বললাম, “ আচার্যে, এটা কি আসল শরৎ পাহাড় ?”
বৃদ্ধ এমন এক মাথা নাড়লেন যে কিছুই বোঝা গেল না, কিন্তু তাঁর চোখগুলো পিট্ পিট্ করছিলো।
“এটা সবটাই একটা স্বপ্নের মতো,” উনি বিড়বিড় করছিলেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে চাং মশাই একটা জীন ছিলেন কিনা।”
#
“এটাই শরৎ পাহাড়-এর গল্প,”, একটু থেমে, চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ওয়াং সিহ্-কু বললেন। “পরবর্তী সময়ে মনে হয় ওয়াং মশাই সব রকম পুঙ্খনাপুঙ্খ অনুসন্ধান করিয়েছিলেন, চাং মশাইয়ের বাড়িও গেছিলেন, কিন্তু শরৎ পাহাড় নিয়ে কথা বলতে যেতেই সে বাড়ির যুবক ঐ ছবির অন্য কোন সংস্ক্ররণের কথা অস্বীকার করে। তাই কেউ বলতে পারে না, অত বছর আগে ইয়েন-কো যে শরৎ পাহাড় দেখেছিলেন তা এখনো কোথাও লুকোনো আছে কিনা। অথবা এমনও হতে পারে যে পুরো ব্যাপারটাই একজন বৃদ্ধ মানুষের স্মৃতিভ্রম। যদিও এটা অসম্ভব মনে হয়, তবুও, ইয়েন-কো’র শরৎ পাহাড় দেখতে চাং মশাইয়ের বাড়ি যাওয়াটা সত্যি নাও হতে পারে।”
“যাক্গে, ঘটনাটা যাই হোক না কেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ঐ বিস্ময়কর ছবিটা ইয়েন-কো’র মাথার ভিতর গেড়ে বসেছিল, আর তোর মাথাতেও।
“ঠিক বলেছিস, আমি এখনও দেখতে পাই সেই গাঢ় সবুজ পাহাড়,যেমনটা ইয়েন-কো অত বছর আগে বলেছিলেন। দেখতে পাই ঝোপঝাড়ের লাল সব পাতা, যেন ছবিটা এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে রয়েছে।”
“তা’হলে ছবিটা যদি কখনো নাই বা থেকে থাকে তবুও দুঃখের কিছু নেই!”
আনন্দে হাততালি দিয়ে দু’জনেই হেসে উঠল।
অনুবাদক পরিচিতি
বিকাশ গণ চৌধুরী
আদি নিবাস কুমিল্লা জেলার বুড়িচং গ্রাম হলেও, পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট শহর দেরাদুনে ১৯৬১ সালে জন্ম, ছোটবেলার অনেকটা সেখানে কাটিয়ে বড় হওয়া কলকাতায়, চাকরিসূত্রে অনেকটা সময় কেটেছে এলাহাবাদ আর মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা... লেখেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ; ফরাসি, হিস্পানি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন মন্পসন্দ নানান লেখা, সম্প্রতি শেষ করেছেন পাবলো নেরুদার শেষ কবিতার বই ‘El libro de las preguntas’ –এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ‘প্রশ্ন-পুঁথি’। দীর্ঘদিন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন সবুজপত্র ‘বিষয়মুখ’।
লেখক পরিচিতি
জাপানের ছোট গল্পের রাজা আকুতাগাওয়া রীউনোসুকোর জন্ম ১৮৯২ সালে এবং মৃতু ১৯২৭ সালে। তোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নেন ইংরেজি সাহিত্যের, প্রিয় লেখক অস্কার ওআইল্ড আর প্রিয় কবি উইলিয়াম মরিস। নবযুগের আগমনটা মেনে নিতে পারেন নি আকুতাগাওয়া; জগতের আর সামাজিক সংস্কারের রূঢ় জালের রহস্যে আতঙ্কিত হয়ে, সমাজের প্রতি আস্থা হারিয়ে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে হারিকিরি করে নিজের জীবন শেষ করে দেন।“আর তা-চিহ্’র ব্যাপারে বলছি,তুই কি কখনো শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখেছিস ?”
একদিন সন্ধেয়, ওয়াং সিহ্-কু, ওর বন্ধু ইয়ুন নান-তি-এনের বাড়িতে বেড়াতে এসে এই প্রশ্নটাই করেছিল।
“না, আমি কখনো দেখিনি, তুই দেখেছিস ?”
মেই-তাও-জ়েন আর হুয়ান্-হাও-শান-চি’ইয়াও এর মত তা-চিহ্ ছিলেন মোঙ্গল যুগের একজন শ্রেষ্ঠ চিত্রকর। এই কথাগুলো যখন ওয়াং সিহ্-কু বলছিল ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শিল্পীর বিখ্যাত ছবি - বালুকাবেলা ,আর জড়ানো পট -আনন্দময় বসন্ত ।
“কিন্তু, অদ্ভুত ব্যাপার এটাই, আমি নিজেই নিশ্চিত নই যে ছবিটা আমিই দেখেছি কিনা। আসলে...”
“তুই জানিসই না ছবিটা তুই দেখেছিস না দেখিস নি, তুই কি বলতে চাস যে তুই ঐ ছবিটার কোন নকল দেখেছিস ?”, কৌতূহলী চোখে ইয়ুন নান-তি-এন বলল।
“না, নকল না। আমি আসলটাই দেখেছিলাম। আর আমিই একমাত্র লোক নই যে ওটা দেখেছে। বিখ্যাত সমালোচক ইয়েন-কো আর লিয়েন-চাউ দু’জনেই শরৎ পাহাড়-এর ঘটনাটায় যুক্ত ছিলেন”। এই বলে ওয়াং সিহ্-কু চায়ে চুমুক দিয়ে মুচ্কি একটা হাসি হাসলেন। “এটা শুনে কি তুই বিরক্ত হচ্ছিস ?”
“ঠিক এর উল্টো”, শান্তভাবে মাথা নেড়ে বলল ইয়ুন নান-তি-এন; আর তামার লন্ঠনের আলোটা উস্কে দিল।
#
সেসময় (ওয়াং সিহ্-কু শুরু করলেন) ধ্রুপদী শিল্পী হুয়ান্ তাই বেঁচে। একদিন সন্ধেয় ইয়েন-কোর সঙ্গে চিত্রকলা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে তিনি প্রশ্ন করে বসলেন, আপনি কি তা-চিহ্’র শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখেছেন। জান বোধহয়, ইয়েন-কো ছিলেন তা-চিহ্’র ছবির এক খাঁটি ভক্ত, আর তাই মনে হয় তিনি ওনার কোন ছবি দেখেন নি এমনটা হবার নয়। কিন্তু তিনি কখনোই সেই শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখেন নি।
“না, আমি ওটা দেখিনি”, লজ্জায় মুখ নিচু করে তিনি বললেন,“আর কস্মিনকালেও ও রকম কিছু একটা যে আছে তা শুনি নি।”
“সে ক্ষেত্রে”, হুয়ান তাই বললেন, “দয়া করে ঐ ছবিটা দেখার প্রথম যে সুযোগটা আপনি পাবেন সেটা হাতছাড়া করবেন না। শিল্প হিশেবে ওটা গ্রীষ্ম পাহাড় বা ভ্রাম্যমান ঝঞ্ঝা-র থেকেও অনেক উঁচু দরের। আসলে, যদিও আমি স্থির নিশ্চিত নই তবুও বলব যে ওটাই তা-চিহ্’র সর্বোত্তম ছবি।”
“সত্যি ? ওটা ওনার সবসেরা শিল্পকর্ম ? তবে তো যেভাবেই হোক ওটা আমাকে দেখতে হবে। আমি কি জানতে পারি ছবিটার মালিক কে ?”
“ ওটা হুন শহরের চাং মশাইয়ের বাড়িতে আছে। আপনার যদি কখনও চিন্-শান্ মন্দিরে যাবার সুযোগ হয়, আপনি ওনার সঙ্গে দেখা করে ছবিটা দেখে আসবেন। আপনাকে কি একটা পরিচয়পত্র দিয়ে দেব।”
হুয়ান তাই-এর চিঠিটা পাওয়া মাত্রই ইয়েন-কো হুন শহরে যাবার পরিকল্পনা করে ফেললেন। তিনি ভাবলেন, যে বাড়িতে ওরকম একটা দামী ছবি আছে সেখানে নিশ্চয়ই বিভিন্ন যুগের আরো অনেক বিখ্যাত ছবি আছে। এই ভাবনায় বিভোর হয়ে ইয়েন-কো যাত্রা শুরু করলেন।
হুন শহরে পৌঁছে চাং মশাইয়ের বাড়ি দেখে তো ইয়েন-কো অবাক, বাড়িটার গঠনে একটা সম্ভ্রান্ত ভাব থাকলেও বাড়িটা খুবই ভাঙ্গাচোরা। বাড়িটার দেওয়াল বেয়ে আইভি-লতা পাকিয়ে উঠেছে, বাগান জুড়ে বেড়ে উঠেছে ঘাস আর নল-খাগড়ার বন।বুড়ো মানুষটা এগোতে যেতেই হাঁস, মুরগী আর শষ্যক্ষেতে চড়ে বেড়ানো আরো অন্যসব পাখিরা গলা তুলে তাকে দেখতে লাগলো, এ বাড়িতে কেউ আসতে পারে দেখে তারা যেন একটু অবাকই হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য তিনি হুয়ান তাই-এর কথায় সন্দেহ করলেন আর অবাক হয়ে ভাবলেন তা-চিহ্’র সেই বিখ্যাত ছবিটা এ বাড়িতে এলো কী করে। ওনার কড়া নাড়ায় একটা চাকর বেরিয়ে এলে তিনি তার হাতে চিঠিটা তুলে দিয়ে বললেন যে তিনি অনেক দূর থেকে শরৎ পাহাড় ছবিটা দেখবার আশায় এসেছেন।
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তাকে একটা বড় হলঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে লাল চন্দনকাঠের ডিভান আর টেবিলগুলো নিয়মমতো ঠিকঠাক জায়গায় থাকলেও সবকিছুতেই লেগে ছিল একটা পুরোনো পচা গন্ধ, আর একটা নিঝুম বিষণ্ণতা, এমন কি মেঝের টালিগুলোতেও। এরপর এলেন সেই বাড়ির মালিক, ফ্যাকাশে মুখ, অসুস্থ চেহারা, কমনীয় হাতের এক সৌম্যকান্তি পুরুষ। এরপর ইয়েন-কো কোনরকম সময় নষ্ট না করে ছোট্ট করে নিজের পরিচয় দিয়ে গৃহকর্তাকে জানালেন তা-চিহ্’র বিখ্যাত ছবি -শরৎ পাহাড়-টা দেখবার সুযোগ পেলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন। তার কথার মধ্যে কেমন যেন একটা তাড়া ছিল, তিনি যেন ভয় পাচ্ছিলেন, যেন তিনি ঐ ছবিটা তক্ষুনি দেখতে পাবেন না, ওটা কোনভাবে কুয়াশার মতো উবে যাবে।
কোনরকম দ্বিধা না করেই চাং মশাই ঐ হলঘরের ন্যাড়া দেওয়ালে ঐ ছবিটা টাঙিয়ে দিলেন।
“এই যে, এটাই সেই শরৎ পাহাড়, যার কথা আপনি বলছিলেন”, উনি বললেন।
প্রথম দেখায় ইয়েন-কো’র তো বিস্ময়ে শ্বাসরোধ হবার অবস্থা। ছবি জুড়ে সবুজ রঙের প্রাধান্য। এক দিক থেকে আর এক দিকে একটা নদী এঁকেবেঁকে চলেছে; নানান জায়গায় তার ওপর সেতু, দু’তীর বরাবর ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। এই সব কিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে মাথা তুলে থাকা পর্ব্বতচূড়ার সারি, যার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে শরতের টুকরো টুকরো মেঘ । বড় পাহাড় আর তার চারপাশের ছোট-ছোট পাহাড় সব টাটকা সবুজ, যেন এক্ষুনি বৃষ্টিতে ভিজেছে, আর পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের লাল পাতায় এক অনৈসর্গিক সৌন্দর্য্য। ওটা কোন সাধারণ ছবি ছিল না, ওটা ছিল এমন একটা ছবি যেখানে রঙ আর বিন্যাস উৎকর্ষতার এক চরম সীমায় পৌঁছেছিল। ওটা ছিল শিল্পে ধ্রুপদী সৌন্দর্য্যবোধ আর নৈসর্গিকতার এক চরম নিদর্শন।
“ তা’, কি ভাবছেন ? ছবিটা আপনার ভালো লাগলো ?”, আধখোলা চোখে ইয়েন-কো’র দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে চাং মশাই বললেন।
“ওহ্, এটা সত্যিই একটা স্বর্গীয় ছবি !” শ্রদ্ধায়-সম্ভ্রমে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইয়েন-কো বলে উঠলো। “হুয়ান্-চি’র অতি-প্রশংসার থেকেও ভালো। আমি আজ অবধি যত ছবি দেখেছি এই ছবির তুলনায় সবই দ্বিতীয় শ্রণির।”
“সত্যি ? আপনি এটাকে এতটাই সেরা বলে ভাবেন ?”
ইয়েন-কো ছবিটা থেকে তার বিস্ময়দৃষ্টি গৃহকর্তার দিকে ফেরাতে পারছিল না। “আপনার কোন সন্দেহ আছে ?”
“আরে,না,না, আমার কোন সন্দেহই নেই,” একটা স্কুলপড়ুয়া বাচ্চার মতো হক্চকিয়ে গিয়ে লজ্জায় মুখ লাল করে চাং মশাই বললেন। সলজ্জভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উনি বলতে থাকলেন : “আসলে যখনই আমি ছবিটার দিকে তাকাই, তখনই আমার মনে হয় আমি যেন চোখ খুলে স্বপ্ন দেখছি। আমার কেবলই মনে হয় শুধুমাত্র আমিই এই সৌন্দর্য্য দেখতে পাই, যা কিনা আমাদের এই পারিপার্শিক জগতের পক্ষে একটু বেশিই প্রগাঢ়। আপনার কথায় আমার সেই অনুভূতিগুলোই ফিরে এল।”
কিন্তু গৃহকর্তার নিজের কথার যথার্থতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা ইয়েন-কো’র মনে কোন রেখাপাতই করল না। ছবিটাই ওর সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল, আর চাং মশাইয়ের কথা শুনে ওর মনে হচ্ছিল উনি এই কথার আড়ালে তার মতামতের কোন এক খামতি ঢাকার চেষ্টা করছেন।
এর পরই, ইয়েন-কো সেই নিঝুম বিষণ্ণ বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
#
এরপর কয়েকটা সপ্তাহ যাবার পরও ইয়েন-কো’র মনে সেই শরৎ পাহাড় জ্বলজ্বল করতে লাগল (আর এক কাপ চা নিয়ে ওয়াং সিহ্-কু আবার শুরু করলেন)। তা-চিহ্’র এই অসাধারণ ছবিটা দেখার পর ওটা পাবার জন্য ও ওর সবকিছু দিয়ে দেবার জন্য তৈরি ছিল। আর ঘাগু সাংগ্রহক হবার দরুন ও জানতো যে ওর বাড়িতে ঝোলানো ছবিগুলোর মধ্যে একটাও - এমন কি পাঁচশো রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে কেনা লি ইয়াং-চিউ’র ভাসমান হিমানী ছবিটাও, শরৎ পাহাড়-এর পাশে দাঁড়াতে পারবে না।
আর কিছুদিন ঐ হুন শহরে থেকে ইয়েন-কো ঐ ছবিটা কেনবার জন্য কথাবার্তা বলতে চাং মশাইয়ের বাড়িতে একটা দালালকে পাঠালো। কিন্তু বারংবার চেষ্টা করেও ও চাং মশাইকে রাজী করাতে পারলো না। প্রত্যেকবারই ঐ ফ্যাকাশে, রুগ্ন ভদ্রলোক বললেন যে উনি ইয়েন-কোর শরৎ পাহাড়-এর ভালোলাগাটাকে শ্রদ্ধা করেন, এমন কি উনি ছবিটা ধার দিতেও রাজী, কিন্তু ছবিটার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ - তা হবার নয়, ওরা যেন ওকে এ ব্যাপারে মাপ করেন।
এই অস্বীকার ইয়েন-কো’র দুর্দমনীয় ইচ্ছেটাকে আরো চাগিয়ে দিল। ও নিজে নিজেই প্রতিঞ্জা করলো, “ ঐ দারুণ ছবিটা আমার হলঘরের দেওয়ালে ঝুলবেই ঝুলবে।” আর ঘটনাটা ঘটবেই এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে অবশেষে ও ব্যাপারটা মেনে নিয়ে শরৎ পাহাড়-কে সাময়িকভাবে ছেড়ে বাড়ি ফিরে এল।
“প্রায় এক বছর পর, আবার হুন শহরে এসে ইয়েন-কো চাং মশাইয়ের সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করার চেষ্টা করলো। কিছুই বদলায়নি : দেওয়াল বেয়ে, বেড়া বেয়ে সেই অগোছালোভাবে পাকিয়ে ওঠা অইভি লতা, আগাছায় ভরা বাগান। কিন্তু ওর কড়া নাড়ায় সাড়া দিয়ে চাকরটা জানালো যে চাং মশাই বাড়ি নেই। যদিও মালিক বাড়ি নেই তবুও কি একটিবার ঐ শরৎ পাহাড়-টা দেখা যাবে - ইয়েন-কোর এই কথায় কোন কাজ হল না, চাকরটাকে বললো : মালিক না আসা অবধি কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেবার অধিকার ওর নেই। আবারও একই কথা বলতে যেতেই লোকটা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠে ইয়েন-কো বেরিয়ে এল আর সেই অসাধারণ ছবিটা জনশুন্য কোন একটা ঘরের কোথাওএকটা পড়ে রইলো।”
#
ওয়াং সিহ্-কু একটু থামলেন।
“এতক্ষণ আমি যা বললাম তা আচার্য ইয়েন-কোর মুখ থেকে শোনা।”
“কিন্তু একটা কথা”, তার শাদা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে ইয়ুন নান-তি-এন বলল, “ইয়েন-কো কি সত্যি সত্যিই শরৎ পাহাড়-টা দেখেছিলেন ?”
“উনি বলেছিলেন যে উনি ওটা দেখেছেন। আসলে দেখেছিলেন না দেখেননি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবো না।আমাকে বাকি গল্পটা বলতে দাও তাহলে তুমি নিজেই বিচার করতে পারবে।”
ওয়াং সিহ্-কু গভীর মনোযোগ দিয়ে ওনার গল্প শুরু করলেন, আর এবার চায়ে চুমুক পর্যন্ত দিলেন না।
#
যখন ইয়েন-কো আমাকে এসব কথা বলেছিলেন (ওয়াং সিহ্-কু বললেন) ততদিনে তাঁর হুন শহরে যাবার প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে। আচার্য হুয়ান্-চি অনেকদিন হয় মারা গেছেন, আর চাং মশাই-এর বিশাল বাড়িটা তার অধঃস্তন দু’পুরুষের হাতে গিয়ে পড়েছে। শরৎ পাহাড় কোথায় আছে তার কোন খবর নেই, খবর নেই সেই জড়ানো-পটের ভালো অংশগুলোই বা কোন চুলোয় গেছে। আমাদের কথোপকথনের সময় বৃদ্ধ ইয়েন-কো সেই রহস্যময় ছবিটার এমন বিশদ বর্ণনা দিয়েছিলেন যে আমার মনে হয়েছিল আমি আমার চোখের সামনে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। ছবিটার সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম কাজ আচার্যকে মোহিত করেনি, তাঁকে বিমুগ্ধ করেছিল ছবিটার সামগ্রিক বর্ণনাতীত সৌন্দর্য্য। আচার্য’র সেই কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই তাঁর হৃদয়ের ভিতরে থাকা সেই সৌন্দর্য্য আমার হৃদয়ের ভিতরে গিয়ে পৌঁছেছিল।
আচার্য’র সঙ্গে কথা হবার মাসখানেক পর আমি দক্ষিণের প্রদেশগুলোয় কাজে গিয়েছিলাম যার মধ্যে হুন শহরও ছিল। ওখানে এক বৃদ্ধকে এ বিষয়ে বলায় তিনি বললেন যে আমি গিয়ে দেখতে পারি, শরৎ পাহাড় সম্ভবতঃ খুঁজে পাওয়া যাবে না, “যদি কখনো ছবিটা দিনের আলো দেখে তবে সেই দিনটা শিল্পের দুনিয়ায় একটা দারুণ দিন হবে।”
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেসময় আমি গভীর উৎকন্ঠায় সেই ছবিটা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু কাজে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে আমি চাং মশাইয়ের বাড়ি যাবার সময় পাবো না। আর এরমধ্যে একটা খবর আমার কানে এল, শুনলাম, ওয়াং নামের কোনএক অভিজাতের হাতে গেছে শরৎ পাহাড় ; আর ছবিটা সম্পর্কে জানা থাকায় শ্রীযুত ওয়াং চাং মশাইয়ের নাতির কাছে শুভেচ্ছা জানিয়ে একজন পত্রবাহক পাঠালেন। শোনা যায় উত্তরে চাং মশাইয়ের নাতি ঐ পত্রবাহকের হাত দিয়ে তাদের পরিবারের পুরনো কাগজপত্র, বংশানুক্রমে তাদের পরিবারে রাখা একটা পাব্বনি-কড়া তা যে কত পুরনো কেউ জানে না, আর আর তা-চিহ্’র শরৎ পাহাড় ছবিটার বর্ণনার সঙ্গে মানানসই একটা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এইসব উপহার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওয়াং মশাই চাং মশাইয়ের নাতির সন্মানে একটা দারুণ ভূরিভোজের আয়োজন করলেন যেখানে সেই যুবককে সন্মানীয় আসনে বসানো হল, দারুণসব সুস্বাদু খাবার, উচ্ছল সঙ্গীত আর মিষ্টি মেয়েদের দিয়ে আপ্যায়িত করা হল, সঙ্গে দেওয়া হল এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
খবরটা শুনে আনন্দে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। অর্ধ শতাব্দীর নানান উত্থান-পতনের মধ্যেও মনে হল শরৎ পাহাড় নিরাপদেই আছে। আর শুধু তাই নয় বাস্তবে ওটা এখন আমার হাতের নাগালের মধ্যে। না নিলেই নয় এরকম কয়েকটা জিনিষ নিয়ে আমি সঙ্গে-সঙ্গেই ছবিটা দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম।
আজও আমার ঐ দিনটার সব খুঁটিনাটি মনে আছে। দিনটা ছিল গ্রীষ্মের প্রথমদিকের একটা ঝক্ঝকে শান্ত বিকেল, ওয়াং মশাইয়ের বাগানে বড়ো বড়ো গোল গোল গোলাপি, লাল, শাদা ফুল ফুটে আছে। এই বাড়িতেই শরৎ পাহাড় আছে এই ভেবে ওয়াং মশাইকে দেখে, ওনাকে প্রথামাফিক অভিবাদন জানানোর আগেই খুশীতে আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি বলে উঠলাম, “ইয়েন-কো কতোগুলো বছর এই ছবিটা আর একবার দেখার জন্য ছট্ফট করছেন, আর আমি কত অনায়াসেই আমার ইচ্ছে পূরণ করতে চলেছি...’’
“আপনি খুব শুভক্ষণে এসেছেন, আজকের দিনটায় আমি ইয়েন-কো’র উপস্থিতি খুব আশা করছিলাম, আর বিখ্যাত সমালোচক লিয়েন-চাউকেও। দয়া করে ভিতরে আসুন, আর যেহেতু আপনিই সবার আগে এসেছেন আপনিই সবার আগে ছবিটা দেখবেন,” এই বলে ওয়াং মশাই শরৎ পাহাড় -টা দেওয়ালে টাঙাতে বললেন। আর আমার চখের সামনে লাফ দিয়ে পড়ল: নদীর ধারের ছোট ছোট গ্রাম, উপত্যকার ওপর ভেসে বেড়ানো মেঘের দল, একটা ভাঁজ করা পর্দার মতো পরতে পরতে খুলে যাওয়া সুদূর প্রসারিত সবুজ সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণি যা - একটা আস্ত জগৎ, আসলে তা-চিহ্ যা সৃষ্টি করেছিলেন, একটা দুনিয়া যা আমাদের দুনিয়াটা থেকে অনেক অনেক সুন্দর। দেওয়ালের ঐ ছবিটার দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকের ধুক্পুকানিই বেড়ে গেল।
এতে কোন ভুল নেই যে এইসব মেঘ, কুয়াশা, উপত্যকা সবই তা-চিহ্’র নিজের হাতের কাজ। তাছাড়া তা-চিহ্ ছাড়া আর কেই বা অঙ্কনশিল্পকে এরকম দক্ষতায় নিয়ে যেতে পারবে, তুলির টানে সবকিছুকে এরকম জীবন্ত করে তুলতে পারবে। উনি ছাড়া আর কেই বা রঙের গভীরতা আর গাঢ়তাকে রঙ-তুলির যান্ত্রিক ছোঁয়া লুকিয়ে প্রকাশ করতে পারবে ? কিন্তু ... কিন্তু একইসঙ্গে আমার এটাও মনে হতে লাগলো যে ইয়েন-কো যে ছবি অনেকদিন আগে দেখেছিলেন এটা সে ছবি নয়। না, মানে এটা দারুণ একটা ছবি, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছিল - যে ছবিটার বর্ণনা তিনি ধর্মীয় নিষ্ঠায় এত ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে করেছিলেন এটা সেটা নয়!
ওয়াং মশাই আর তার সহচরেরা আমার চারদিকে জড়ো হয়ে আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল, তাই আমি আমার উৎসাহের প্রাবল্য প্রকাশ করতে পারছিলাম না। স্বভাবতই, আমি চাইছিলাম না ছবিটার প্রামাণ্যতা নিয়ে ওনার মনে কোন সন্দেহ জাগুক, কিন্তু এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে আমার প্রশংসা ওনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। আর ঠিক তখনই ইয়েন-কো’র, যিনি প্রথম আমাকে শরৎ পাহাড় স্পম্পর্কে বলেছিলেন, আসার কথা ঘোষনা হল। তারপর যখন সেই বৃদ্ধ ওয়াং মশাইকে নিচু হয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন তখন তাঁর ভিতরকার উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু যেই না ওনার চোখ ঐ ছবিটার ওপর পড়লো মনে হল ওনার মুখের ওপর দিয়ে একটা মেঘ চলে গেল।
“আচার্য, আপনার কী মনে হল ?”, ওনাকে ভালোভাবে লক্ষ করতে করতে ওয়াং মশাই প্রশ্ন করলেন। “এক্ষুনি আমরা ওয়াং সিহ্-কু’র প্রবল উৎসাহপূর্ণ প্রশংসা শুনলাম, কিন্তু ...”
“আপনি মশাই খুবই ভাগ্যবান পুরুষ। এই যে আপনি এই ছবিটার মালিকানা অর্জন করেছেন, এর উপস্থিতি আপনার বাড়ির আর সব সম্পত্তির দীপ্তি বাড়িয়ে দেবে।’’
ইয়েন-কো’র সৌজন্য মাখানো কথায় ওয়াং মশাই-এর দুশ্চিন্তা আর বেড়ে গেল বলে মনে হল; আমার মতো উনিও ঐ কথাগুলোর মধ্যে একটা অপলাপের ছোঁয়া লক্ষ করেছিলেন। তারপর বিখ্যাত সমালোচক লিয়েন-চাউ আসরে অবতীর্ন হলে আমরা সকলে একটু স্বস্তি পেলাম। নিচু হয়ে আমাদের অভিবাদন করে উনি ছবিটার দিকে ফিরলেন আর নির্বাক হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে নিজের গোঁফ চিবোতে লাগলেন।
“এটাই মনে হয় সেই ছবি যা আচার্য ইয়েন-কো অর্ধ-শতাব্দী আগে শেষ দেখেছিলেন,” ওয়াং মশাই ওনাকে বোঝাতে লাগলেন। তারপর শুকনো হাসি হেসে বললেন, “এখন আমি আপনার মতামত শুনতে চাই; আপনার তাৎক্ষণিক মতামত।’’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিয়েন-চাউ আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ওয়াং মশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন : “সম্ভবতঃ এটাই তা-চিহ্’র সর্ব্বোত্তম সৃষ্টি। দেখুন, শিল্পী মেঘমালায় কিরকম আলোছায়ার প্রতিভাস সৃষ্টি করেছেন। তুলির কি জোর! লক্ষ করুন গাছপালার রঙ। আর দূরের ঐ শৈল-চূড়া, যা ছবিটার পুরো বিষয়টাকে জীবন্ত করে তুলেছে।’’ কথা বলতে বলতে লিয়েন -চাউ ছবিটার নানান অসাধারণ বৈশিষ্ঠ্য আঙুল তুলে তুলে দেখাতে লাগলেন, আর বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথমে স্বস্তি, তারপরে একটা পরম আনন্দ ওয়াং মশাইয়ের মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
এরইমধ্যে, সকলের চোখের আড়ালে আমি ইয়েন-কো’র সঙ্গে চোখে-চোখে কথা হল।আমি ফিস্ফিস্ করে বললাম, “ আচার্যে, এটা কি আসল শরৎ পাহাড় ?”
বৃদ্ধ এমন এক মাথা নাড়লেন যে কিছুই বোঝা গেল না, কিন্তু তাঁর চোখগুলো পিট্ পিট্ করছিলো।
“এটা সবটাই একটা স্বপ্নের মতো,” উনি বিড়বিড় করছিলেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে চাং মশাই একটা জীন ছিলেন কিনা।”
#
“এটাই শরৎ পাহাড়-এর গল্প,”, একটু থেমে, চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ওয়াং সিহ্-কু বললেন। “পরবর্তী সময়ে মনে হয় ওয়াং মশাই সব রকম পুঙ্খনাপুঙ্খ অনুসন্ধান করিয়েছিলেন, চাং মশাইয়ের বাড়িও গেছিলেন, কিন্তু শরৎ পাহাড় নিয়ে কথা বলতে যেতেই সে বাড়ির যুবক ঐ ছবির অন্য কোন সংস্ক্ররণের কথা অস্বীকার করে। তাই কেউ বলতে পারে না, অত বছর আগে ইয়েন-কো যে শরৎ পাহাড় দেখেছিলেন তা এখনো কোথাও লুকোনো আছে কিনা। অথবা এমনও হতে পারে যে পুরো ব্যাপারটাই একজন বৃদ্ধ মানুষের স্মৃতিভ্রম। যদিও এটা অসম্ভব মনে হয়, তবুও, ইয়েন-কো’র শরৎ পাহাড় দেখতে চাং মশাইয়ের বাড়ি যাওয়াটা সত্যি নাও হতে পারে।”
“যাক্গে, ঘটনাটা যাই হোক না কেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ঐ বিস্ময়কর ছবিটা ইয়েন-কো’র মাথার ভিতর গেড়ে বসেছিল, আর তোর মাথাতেও।
“ঠিক বলেছিস, আমি এখনও দেখতে পাই সেই গাঢ় সবুজ পাহাড়,যেমনটা ইয়েন-কো অত বছর আগে বলেছিলেন। দেখতে পাই ঝোপঝাড়ের লাল সব পাতা, যেন ছবিটা এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে রয়েছে।”
“তা’হলে ছবিটা যদি কখনো নাই বা থেকে থাকে তবুও দুঃখের কিছু নেই!”
আনন্দে হাততালি দিয়ে দু’জনেই হেসে উঠল।
অনুবাদক পরিচিতি
বিকাশ গণ চৌধুরী
আদি নিবাস কুমিল্লা জেলার বুড়িচং গ্রাম হলেও, পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট শহর দেরাদুনে ১৯৬১ সালে জন্ম, ছোটবেলার অনেকটা সেখানে কাটিয়ে বড় হওয়া কলকাতায়, চাকরিসূত্রে অনেকটা সময় কেটেছে এলাহাবাদ আর মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা... লেখেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ; ফরাসি, হিস্পানি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন মন্পসন্দ নানান লেখা, সম্প্রতি শেষ করেছেন পাবলো নেরুদার শেষ কবিতার বই ‘El libro de las preguntas’ –এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ‘প্রশ্ন-পুঁথি’। দীর্ঘদিন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন সবুজপত্র ‘বিষয়মুখ’।
1 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভাল লাগলো।
উত্তরমুছুন