গল্পপাঠ : সোমেন চন্দের ইঁদুর গল্পটি পড়েছেন?
এমদাদ রহমান : -ইঁদুর? সোমেন চন্দের ইঁদুর! হ্যাঁ। এই গল্প পাঠকালে, আমার আত্মা যেন কাঁপছিল।
গল্পপাঠ : পড়লে কখন পড়েছেন?
এমদাদ রহমান : -এমন এক সময়ে গল্পটি আমি পড়ি... মনে হচ্ছিল, ঠিক এই সময়ে লেখাটা না পড়লেই ভাল হতো। সবকিছু যেন – পরিবার, লোকজন, সম্পর্ক, বন্ধন—সবকিছু—এক অক্ষম ক্রোধ; নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বলেই বোধ করি আত্মায় ঘা লেগেছিল। এমনি শক্তি লুকিয়ে আছে গল্পটির ভিতর।
গল্পপাঠ : কার মাধ্যমে বা কিভাবে গল্পটি পেয়েছিলেন?
এমদাদ রহমান : -আর কেউ না, প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ বিভিন্ন স্মৃতিকথায়, সাক্ষাৎকারে তাঁর লেখালেখির শুরুর দিককার কথা বলতে গিয়ে সব সময় এই গল্পটির কথা বলতেন!
গল্পপাঠ : গল্পটি পড়ার পরে আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
এমদাদ রহমান : -গল্পটি পড়বার সময়টুকু মনে আছে। বেশি দিন আগে না। এগারো কি বার বছর আগে হবে। এক দগদগে সময়, দারিদ্রতা, আমরা যে খুব খারাপ অবস্থার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি—এইসব কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাবার চা বাগানের চাকরি চলে গেল। বাগানের টিলা বাবু ছিলেন তিনি। ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বেতন পেতেন। এই টাকায় আমাদের চলতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লেখক আবুল বাশারের এক স্মৃতিকথায় পড়েছিলাম, তিনি বলছেন-; আমি হলাম পেটে ক্ষুধা নিয়ে বড় হওয়া লেখক'! না, আমার অবশ্য এই অবস্থায় পড়তে হয়নি। ভাত খেয়েছি। তবে টাকা পয়সার টানাটানি ছিল ভয়ানক। অভাবের ব্যাপকতা বুঝতে পেরেছিলাম বাবার মৃত্যুর আগের দিন। মায়ের কাছে দশ হাজার টাকাও ছিল না। আমরা তখন নানার বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকি।
হ্যাঁ, তখন সিলেটে ছিল কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের বইপত্র। সেখান থেকে কিনেছিলাম এক আশ্চর্য বই। মফস্বলি বৃত্তান্ত। লেখক দেবেশ রায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষুধার বর্ণনা। আর রাজনীতি, মানে ভোটের রাজনীতি। তা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায়, তবু; আমাদের সঙ্গেও যে এই ক্ষুধা আর ভোট আর রাজনীতি অনেকটাই মিলে যায়! বোন্দা-বাঁধা পোস্টারের ভিতর যেন বন্দি হয়ে গেছে আমাদের সবার জীবন। তো, মানুষের পেটের তীব্র ক্ষুধার কথা ছিল দেবেশের লেখায়। আমি পড়তে পড়তে হঠাৎ বমি করা শুরু করলাম। পেটের ভিতর থেকে টক জল মুখের ভিতর এসে জমা হয়ে গেলে চ্যারকেটু সেই জল না ফেলে ফের পেটেই চালান করে দেয়। কী বর্ণনা। হ্যাঁ, এই উপন্যাস পাঠের অল্প কিছুদিন পর ইঁদুর গল্পটি পড়া হল। যেন আমাকেই পাঠ করলাম। যেন সোমেন চন্দ আমার কথাই লিখে ফেললেন। ইঁদুর মারার কল কিনতেও পয়সা লাগে—এই বোধ গল্পের সুকু’র মতো আমার ভিতরেও ভয়ানকভাবে জন্ম নিতে শুরু করে। সীমাহীন মরুভূমির মতো একটা কিছু বুকের ভিতর জেগে উঠতে চায়। মায়ের মুখ গভীর শোকে পাণ্ডুর হয়ে থাকে, চোখদুটি গরুর চোখের মতো করুণ। বাবার চাকরি নেই। আমিও লেখাপড়া শেষ করে বেকার। বই পড়ি। কাগজে রাতদিন কি-সব লিখি। বাজারে আগুন। জিনিশপত্রের দাম খালি বাড়ে।
অসময়ে, অভাবের দিনে, কুকুরের মতো কামড়াকামড়ি করতে থাকে মানুষ। গল্পটি একবার না, বার বার পড়ছিলাম, মফস্বলি বৃত্তান্তের পর এই ইঁদুর! মনের ভিতর ভয়ানক তোলপাড়। বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছিল। আত্মহত্যাপ্রবন হয়ে পড়েছিলাম। কী অভিঘাত তৈরি হয় লেখকের লেখার পাঠকৃতি থেকে! গল্পের সবকিছুই হুবহু মিলে যাচ্ছিল, দৃশ্যের পর দৃশ্যে... সুকু’র বাবা তার মাকে গালি দিচ্ছেন—‘ শয়তান মাগি, বেরিয়ে যা।’ পড়ছিলাম। এখনও মনে পড়ে, বুকটা যন্ত্রণায় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল সেদিন। সোমেন চন্দ হুবহু আমারি গল্প লিখে ফেললেন কী করে! আমারও এক সময় মনে হতে থাকে, মা, বাবা, বোন আমরা কেউ যেন শৈশবটাকে এখনও অতিক্রম করতে পারিনি। কত ছোট আর কতই না অসহায় সবাই। কী জানি কেন, বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিলে যায় এরকম আরেকটি লেখাও পড়েছিলাম তখন। নানার হাতি। ভৈকম মহম্মদ বশীর! তারপর বিভূতিভূষণের আশ্চর্য গল্প- -ভণ্ডুলমামার বাড়ি। বাংলার দারিদ্র্যতার বিশ্বস্থ দলিল।
হ্যাঁ, কী অদ্ভুত আনন্দও যে লুকিয়ে থাকে চরম দুঃখের ভিতর! কেননা- মধ্যরাত্রির ইতিহাস আরও বিস্ময়কর। বাবা গলার স্বর খাদে নামিয়ে ডাকছেনঃ
কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছ?
গল্পপাঠ : গল্পটি পড়ার পরে আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া কি ছিল? এই সময়ে গল্পটি বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি।
এমদাদ রহমান : -গল্পটি পড়ে আর নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে মনে হচ্ছিল বাবা যেন শুধু মাকেই ডাকছেন না। আমাদের সবাইকেই ডেকে তুলতে চাইছেন তিনি। কেননা, মানুষ নিঃসঙ্গ। মানুষ একা। সোমেন চন্দ কোন ইচ্ছা পূরণের গল্প লিখেন নাই। জীবনের গভীর বোধ তাঁর হৃদয়ে ছিল বলেই ইঁদুর লেখা সম্ভব হয়েছে। জীবনকে তিনি ভেঙে ভেঙে কাটাছেঁড়া করেছেন। ছোট্ট ব্যাপারগুলোর ওপর টর্চের তীব্র আলো ফেলেছেন। ‘কনক, ও কনক’, এই ডাকের ভিতর দিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিতে চেয়েছেন। কোন মুখোশ পরেন নি। চোখে চশমাও নাই। চোখের সামনে তাই যাপিত-জীবনের কংকাল, জেগে উঠেছে। এই এখন একটি গল্পের কথা মনে এল। হ্যাঁ, কমলকুমার মজুমদারের। সংলাপটি এমন- ‘ও প্রাণ, ও প্রাণ’। মতিলাল পাদরির সংলাপ। এই একটি মাত্র কথায়, সংলাপে, জীবন যেন নগ্ন হয়ে পাঠকের মনের ভিতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। জীবনকে নানা ভাগে ভেঙে দেখবার আর দেখাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তইরি করে দেয় এরকম লেখা। সোমেন চন্দের গল্পটিও তাই।
----------------------------------
সোমেন চন্দের ইঁদুর গল্পটি পড়ার লিঙ্ক :
লেখক পরিচিতি
এমদাদ রহমান
জন্ম ১ জানুয়ারী ১৯৭৯।
মৌলভীবাজার জেলার কমলাপুর থানার বাদে সোনাপুর গ্রামে।
পড়াশুনা : শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সান্ডারল্যান্ড বিশ্ববদ্যালয়, ইংল্যান্ড।
গল্পকার। অনুবাদক।
গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।
0 মন্তব্যসমূহ