অলাত এহ্সানের গল্প : বোতল

বারি শেখ একটা বিশেষ কারণে মাসে দু’একবার বাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত অশ্লীল ও উগ্রভাবে এলাকার মাতবরদের বকাবকি করে। তার আগে সে একটু পান করে নেয়। এই পান করার অভ্যাস তার বহুদিনের। তবে কখনো বাংলা মদ ছাড়া অন্যকিছু খায় না। কারণ বাংলা খেলে মুখে একধরনের টক টক গন্ধ হয়, তা তার ভাল লাগে। তাতে যে কেউ বুঝতে পারে বারি আজ পান করেছে। তখন ভরা বাজারে দাঁড়িয়ে এলাকার হাওলাতি-খয়রাতি-নিয়ারা-আজুড়ে-খামোখা মাতবরকে বকাবকি করলে কেউ কিছুই মনে করে না। ওই সব মাতবররা কখনোই তাকে কিছু বলতো না। এলাকার সবাই ঐকিক নিয়মের মতো বারি শেখের আগেকার কায়-কাহিনী মনে রেখে ধরেই নিয়েছে, বারি শেখের কাছে মাতবররা এমনভাবে ধরা যে, তার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস রাখে না।
আর কিছু না হোক, যেহেতু বারি’র বৌ-টাকে আহমদ মাদবর ভাগিয়ে নিয়েছে, তার জন্য হলেও বারি এলাকার মাতবরদের বকাবকি করতেই পারে, মদের বোতল তাদের পাছা দিয়ে ভরে দেয়ার কসম কাটতেই পারে। এতোদিনে সবাই অন্তত একটা ব্যাপার খেয়ায় হয়েছে, এতো উত্তেজনার মধ্যেও বারি কখনো মদের বোতল ভাঙে না। ফেলেও যায় না। যারা তার বাড়ি গেছে, বলেছে, তারা বারি শেখের বাড়িতে কোথাও মদের বোতল জমিয়ে রাখতে দেখে নাই। তাহলে করেছেটা কি? সবাই বাজারের আসে-পাশে, ডোবায় কিংবা রাস্তার ধারে কাশের সিরাপের বোতল, একটু দূর্লব হলেও ফেনসিডিলের বোতল দেখেছে; কিন্তু বারি’র মদের বোতলগুলো কোথায় গেছে তা কেউ বলতে পারে না। অবশ্য এই নিয়ে কেউ সবিশেষ খোঁজও নেয় নাই। তারা বেফাঁস মদ খাওয়া নিয়ে সামান্য বলাবলি করেছে আর মদের বোতলগুলো কি কি কাজে লাগে তা নিয়ে বিস্তর বাক্য ব্যয় করেছে।

বারি শেখ প্রথম প্রথম খেজুর রসের মাটির হাঁড়িতে মদ খেত। কিন্তু নাড়াচাড়ায় সমস্যা আর ভিজে যাওয়ার ভয় থাকে বলে তা বদলে ফেলেছে। সে বিদেশি মদের কাচের বোতলে মদ খেতে শুরু করে। প্লাস্টিকের বোতল তার চেয়ে হালকা হলেও কখনোই তাতে মদ খেতো না। বারি শেখ বলে, ছোট লোকের বোতলে খেতে তার ঘেন্না হয়। কেউ তাকে- বাংলা মদ কম দামি- বললে তার দিকে চোখ স্থির করে বলে, ‘ওইড্যা ফকিন্নীর বাইচ্চা গো কইস। আমার টাকা আছে হ্যারপরও আমি বাংলা খাই। আর শালা ছুঁচোর জাত, গোয়া মারলে বাইরাইবো না দুই পয়সা, শালারা ছ্যাবলামি কইর‌্যা বছরে একদিন বিদেশে খাইয়্যা সারা বছর কুক পারে আর গল্প মারায়।’ তবে তাকে কখনো পুরনো বোতলে নতুন মদ খায় বললে বেজায় খেপে যায়। খুব অবজ্ঞা করে বলে, ‘না, বিদেশি বোতলে দেশি মদ খাই। এক বোতলে দুই বার মদ খাই ন্যা। যা খাই সবার সামনেই খাই। কারো মতো পরের ঘরের বেড়া ভাঙ্গি ন্যা।’

সত্যি তাই। বারি শেখ যখন শিকারীপাড়া থেকে বোতল ভরে মদ কিনে আনে, তখন রাস্তা দিয়ে বুক ফুলিয়ে আসে। বোতলের লম্বা গলাটা এমনভাবে ধরে রাখে, যেন রাস্তার সব সমালোচকদের গলা চিপে ধরে আছে। তবে বারি শেখকে কখনো লোক সমাজে মদের গুণ কেত্তন করতে দেখেনি। বারি শেখ আগে থেকেই মদ খায় জানলেও কেউ কখনো খেতে বা মাতলামি করতে দেখেনি। সবার মনে আছে, যখন তার বৌ-টা আহমদ সিকদারের ঘরে গেল, তখন সে বিদেশে, দেশে ফিরেই সে প্রকাশ্যে মদ খেতে শুরু করে এবং গ্রামের মাদবরদের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে শুরু করে। তার বিশ্রী বকাঝকায় এলাকার পর্দান মা-বোন ও ভদ্র লোকের নাক ঝ্যা ঝ্যা করলেও গায়ের অনেকে মনে মনে খুশিই হতো। কারণ তারাও ওইসব মদবর দ্বারা কম-বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছে। এতে তাদের মনের জ্বালাও খানিকটা মিটতো। আসলে বারি শেখই প্রথম প্রকাশ্যে এইসব মাতবরদের ধুয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে কারণে বারি শেখ প্রকাশ্যে মদ খেতে শুরু করলো তার কথা এলে সবাই সামান্য করুণা প্রকাশ করেই বলে- ও কিছু না, যে দামে কিনছে সেই দামেই বেচছে, মাঝখান থেকে ছাতাটাই লাভ।

এই ছাতা লাভের ব্যাপারটা একটু আলাদা। একটা চোরের কাহিনী। গ্রামের এক গরু চোর বহু চেষ্টায় একটা গরু চুরি করে গঞ্জের হাটে তুলেছে। হাটে নেয়ার সময় ছেলেকে বলেছিল, বিকেল বিকেল একটা ব্যাগ নিয়ে হাটে যেতে, গরু বেচে একেবারে হাট-সদাই করে বাড়ি আসবে। চোরটা হাটে গরু উঠানোর পর পরই দুইজন টাউট-বাটপারের পাল্লায় পরে। সে বহু কষ্ট করে গরু চুরির বিদ্যাটা রপ্ত করলেও বাটপারি শেখে নাই। বাটপাররা ক্রেতা সেজে এসে গৃহস্থের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গরু দেখে ও গরুর বিভিন্ন দিক নিয়ে কথাবার্তা বলে। গরুচোর আর বাটপার, দুজনের মনেই যেহেতু চুরি, তাই খুববেশি খেচাখেচি না করে একটা ভাল দামই ঠিক হলো। এসময় ক্রেতা, মানে বাটপার বললো, আপনার গরু হাঁটতে পারে তো? গরুওয়াল, মানে চোরটা তো অবাক, বলে কি! নিজে হাঁটিয়ে এনেছে। সে শতভাগ, পারে তো আরো বেশি গ্যারান্টি দিয়ে বললো হাঁটতে পারে। কিন্তু ক্রেতা হাঁটিয়ে দেখা ছাড়া বিশ্বাস করতেই চায় না। যেহেতু ভাল দাম পাচ্ছে আর গরু কিনবে এই বিশ্বাসও জন্মে গেছে, তাই গরুওয়ালা বেশি কিছু বললো না। তখন ক্রেতা বললো, আপনে আমার ছাতাটা একটু ধরুন আমি একটু হাঁটিয়ে দেখি। সেই যে লোকটা গরু হাঁটিয়ে দেখতে গেল আর আসে না, সে বোকার মতো ছাতা ধরে দাঁড়িয়েই আছে। তার ছেলে এসে যখন দেখলো, বাবার হাতে গরু নেই, মানে বিক্রি হয়েছে; তাই সে জিজ্ঞেস করলো, বাবা গরু কতো বিক্রি করেছ? ততক্ষণে গরুচোর নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, তার গরু আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তখন লোকটা হতোদ্যোমে হাতের ছাতা দেখিয়ে বললো, আরে বাবা যে দামে কিনছি সেই দামেই বিক্রি করছি। মাঝখান থেকে এই ছাতাটাই লাভ। দুই বছর আগে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে এলাকার রমিজ মুন্সিই বলেছিল এই গল্প। তখন থেকেই তা সবার মুখে ফিরে।

লোকজন এ কথা এই জন্যই বলে যে, বারি শেখও পরের বৌ বিয়ে করেছিল। তবে একটু অন্যভাবে।

মা মরা বারি শেখ নানার বাড়িতেই মানুষ। একটু বড় হওয়ার পর প্রথমে সে বেশ কিছু দিন ঢাকায় থাকতো। বারি শেখ যখন ঢাকায় থাকে তখন গ্রামের লোকজন ঠিকমতো ঢাকাই চিনতো না। মামলা-মোকদ্দমা থাকলে তারিখ ধরে ধরে কিংবা জমির দলিলের ডুপ্লিকেট কপি দরকার হলে বছরে দু’একবার লোকজন ধরে ঢাকায় যেত। কাজ সেরে আবার দিনাদিনের মধ্যেই গ্রামে ফিরে আসতো। বারি শেখ তখন ঢাকার ধোলাই খালে লোহালক্কারের দোকানে কাজ করতো। ভালই আয়-উপার্জন করতো। তারপর একসময় এই সব ভাঙ্গারির দোকানের সাথে লিয়াজো করে গ্রামে ফিরে ভাঙ্গারির দোকান দেয়। সে সময় যেসব বাকবাহি ভাঙ্গাড়ি গ্রামে গ্রামে ঘুরে খাজা-নিমকি-চানাচুর-কটকটি-সনপাপড়ি-টানা বা মিষ্টি আলুর বিনিময়ে লোহা-কাঁচের ভাঙা জিনিসপত্র আনতো তা বারি শেখের কাছে ধরা (পাঁচ কেজিতে এক ধরা) মাপে বিক্রি করতো। তারপর বারি’র কাছে যখন অনেক ভাঙ্গাড়ি জমতো তখন তা এক সাথে করে গন্নার নৌকায় করে শহরে চালান করতো। তবে কোনো গৃহস্থ যদি ঘরের চালের-বেড়ার পোড়া টিন বদলাতো, তখন সেই টিন কেনার জন্য বারিকে খবর দিতো। তখন বারি নিজে গিয়ে তা কিনে আনতো। তাছাড়া বারি কখনো কখনো সামান্য নষ্ট কোনো জিনিস সারাই-টারাই করে কম দামে বিক্রি করতো। এ রকমভাবে ভাবে রমিজ মুন্সির বাড়ি পুরনো মাল কিনতে গিয়ে হামেদার সাথে তার দেখা। বলতে গেলে অন্তর চোক্ষে দেখা। সে প্রথমে চিনতে পারেনি, হামেদাই তাকে চিনেছে। হামেদা যখন জিজ্ঞেস করলো,‘ভাই কেমন আছেন?’ বারি বাজ পড়া মানুষের মতো ঝিম ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হামেদা পরিচয় দিলে চিনতে পারে- হামেদা তার দাদার বাড়ির পাশের মেয়ে। দরিদ্র ঘরের সন্তান। তাই ছোট বেলায় যেমন ছিল লিকলিকে, তেমনি অপরিষ্কার। একেবারে হাত পায়ের তল দিয়ে যায়। বারিরা কখনো তার দিকে ফিরেও তাকাতো না। বারি’র মা মারা যাওয়ার পর বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন সে নানা বাড়ি চলে আসে। সে সময় হামেদার বয়স সাত কি আট। বারি যখন ঢাকায় তখন বারো বছরের হামেদার বিয়ে হয় রমিজ মুন্সির সঙ্গে। প্রথম বৌ সন্তান হতে গিয়ে মরার পর হামেদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রমিজ মুন্সির সাথে বিয়ে হয়। বয়সে রমিজ মুন্সি হামেদার দি’গুণেরও বেশি। তবে এখন সেই হামেদাকে কেউ চিনতে পারবে না। পুরো জোয়ান বেটি, বাইশ বছরের ভরা যৌবন তার। শরীর স্বাস্থ্য ভাল, গায়ের রঙও বেশ পরিষ্কার হয়েছে। তার মুখে ভাই ডাক শুনে বারি তো পরাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম। ধু ধু বালু চরের মধ্যে একটা পাতা ঝাপড়ানো গাছ পাওয়ার মতো। বারি যেন এই জগৎ-সংসারে একজন আত্মীয় খুঁজে পেল। বাপ-মা মরা হামেদাও যেন এই দূর দেশে আপন কাউকে খুঁজে পায়। তারপর থেকে দোকানের ক্যাশে কাউকে বসিয়ে রেখে বারি যখন-তখন হাওয়া হয়ে যেত। রমিজ মুন্সির তার বাড়িতে বারি’র যাওয়া-আসা, খুসুর-খুসুর একদম পছন্দ করতো না। তখন গাওয়ালের নাম করে, পুরনো ভাঙাচোড়া আছে কিনা, পিতলের একটা নতুন কুপি পেয়েছে ইত্যাদি নানান ছুতোয় যেতো। নানান রকম সৌখিন খাবার দাবার নিয়ে যেতো। হামেদা তার কাছে দাম্পত্বের টানাপোড়েন, নানান অশান্তির কথা বলতো। এই পারিবারিক অশান্তির কথা একদিন গ্রামের সবার কাছে প্রকাশ্য হয়ে উঠলো। রমিজ মুন্সি তাকে মারধর করতে শুরু করলো। গ্রামের একদল আলগা মাতবরের সুবাদে এই বিষয়টা বাজারের চায়ের হোটেলের আলাপের বিষয় হয়ে উঠলো। পরে উপায়ান্তর না দেখে একদিন শালিস বসলো, হাই স্কুলের দেয়াল ঘেরা মাঠের ভিতরে। এটা সংসারের নারী-পুরুষের বিষয়, মান ইজ্জাতের বিষয়। তাই অল্প বয়স্কদের প্রবেশ একবারে রহিত করে গ্রামের বাছা বাছা মুরব্বি-মাতবরদের বলা হয়। আর রাত বেশি হওয়ার কথা চিন্তা করে দুপুরের পরপরই বিচারে বসে। তারপরও অন্য যেকোনো বিচারের চেয়ে অনেক বেশি লোকই হয়। গ্রামের বিচার-শালিসে এখন কথা বলে কারা, সবই তো ঐ বারির বন্ধু বান্ধব, নিজেদের লোকজন। আহমদ সিকদার-মিন্টু সিকদার-শাহজাহান দেওন-সামাদ ভূঁইয়া-করিম শেখ। এরা সারাদিন বারি শেখের ভাঙ্গারির গুদামে বসে জুয়া খেলে, মদ গাঁজা খায় আর নানান জায়গার বিচার-আচার, জায়গা দখল, দালালি করে বেড়ায়। ফায়সালা কি হবে তা বারি’র আগে থেকেই টিপ্পনি ছিল। তবে তাদের বেশি পেরেশানি করতে হলো না। হামেদা ভরা মজলিসে দাঁড়িয়ে বলে দিল, সে আর রমিজ মুন্সির ভাত খাবে না। কেন খাবে না? এই হুংকারে রমিজ মুন্সি ও তার ভাই বেড়াদার একবারে ভেঙে পড়লো। দগদগে কয়লার আগুনে মাঝে এক বালতি পানি ঢেলে দেয়ার মতো ধপ করে সব থামিয়ে দিল হামেদা নিজে। বললো, ‘বারো হাত গভীর কুয়ার পানি তুলতে দুই হাত রশিওয়ালা বালতি দিয়ে কি হইব?’ ব্যাস, আরো কোনো কথা না। বিচারিকরা বলে উঠলো, এই সংসার টিকবে না, রমিজ মুন্সি কিছুতেই আর এই বৌ রাখতে পারবে না, তাতে এলাকার বদম বাড়বো। এ কথাতেই বিচার শেষ, খালি হিসেব পাতি করতে যা দেরি। ওই মজলিসেই তাদের ছাড়াখাড়া হয়ে গেল। কিন্তু মসিবত হলো রমিজ মুন্সির পরিবারেরই। রমিজ মুন্সি যদি না-ই পারে, তাহলে তার প্রথম স্ত্রী সন্তান হতে গিয়ে মরলো কি করে? তাহলে কি রমিজ মুন্সির ঘরে পর পুরুষ যায়? নাকি তার ভাই বেড়াদারই...?

এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রমিজ মুন্সির মুখ দেখানোই দায়। রমিজ মুন্সির তেমন বয়স কৈ, ওই জোব্বা-দাড়ির জন্যই যা। সংসার করার বয়স এখনো তার যায় নাই। কিন্তু দুই-চার এলাকার কোনো মেয়ের বাপ-ই তার কাছে মেয়ে দিতে চায় না। মেয়েরা তো রাজি হয়ই না, বরং হাসাহাসি করে। এমনকি রাস্তায় ছেলেপুলেরাও তাকে তামাসা করে, মুখটিপে হাসে। বলে-বন্দুক আছে গুলি নাই। শেষমেশ, রমিজ মুন্সি তাবলীগের তিন চিল্লায় গিয়ে ফরিদপুরের কোন গৈগ্রাম থেকে এক স্বামী পরিত্যাক্তা মহিলাকে এক পাখি জমি দিয়ে বিয়ে করে, খুব গোপনে নিয়ে আসে। তাকে তো পর্দার মধ্যে রাখেই, পুরো বাড়িটাকেই বেড়া দিয়ে আটকে দিয়েছে। বাড়ির বাইরে একদমই আসেতে দেয় না।

রমিজ মুন্সির সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কিছু দিন পরই বারি শেখ হামেদাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে। কিন্তু বারি শেখ ভুলে গিয়েছিল, শাপের কামড়ে শাপুড়ে মরে, আর খুনির হাতেই খুনি। যে আহমদকে নিয়ে সে এই কাজ করলো সেই আহমদই তার হামেদাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবে। গ্রামে এই ঘটনা পর সবাই বলে, বারি শেখ বুঝে নাই, ঘু মাখাইলে যমে ছাড়ে না। কিন্তু বারি তা মানতে পারে না এই জন্য যে, সে-ই এইসব আলগা মাতবরদের বসার জায়গা দিয়েছে। অন্যের মাথায় বাড়ি দিয়ে থানায় গেলে বহুবার টাকা পয়সা দিয়ে আহমদকে ছাড়িয়ে এনেছে। মানুষের বাড়ির বৌ-ঝি’র সাথে আকাম কু-কাম করতে গিয়ে ধরা খেলে বাঁচিয়েছে। নেশা-পানি করা, খারাপ পাড়ায় যাওয়ার টাকা দিয়েছে। ধার দিয়ে কোনো দিন ফেরত নেয়নি। গুষ্ঠি সুদ্ধ যখন না খেয়ে মরার জো তখন খাবার দিয়ে বাঁচিয়েছে। সেই কুত্তাই কিনা তার ঘরে মুখ দিয়েছে। বারি তাই ইদানিং গালিদেয়, শালারা যে থালে খায় সেই থালই ছেদা করে। কুত্তার লেজ বাইশ বছর চুঙ্গায় রাখলেও সোজা হয় না।

বারি এখন বুঝে, আহমদ কেন এত ভাবি সাহেবার খবর নিত। বাজার করলে বাড়ি দিয়ে আসতো। ওয়াক্তে-অনওয়াক্তে খাওয়ার জন্য উপস্থিত হতো। তবে চালে যে বারি এতোটা কাঁচা তা সেই দিন টের পেল, যখন রমিজ মুন্সির বাড়িতে বড় রকমের চুরি হলো। আর চুরির বেবাক মাল পাওয়া গেল বারি শেখের ভাঙ্গারির গুদামে। সুযোগ পেয়ে রমিজ মুন্সি পুরনো অপমানের প্রতিশোধের নেশায় একেবারে উন্মাদ হয়ে গেল। লাঠিসোটা নিয়ে যখন বাজারে বারি শেখকে মারতে এলো, তখন বারি শেখের লোকজনের মধ্য থেকেই কার বাড়ি যেন গিয়ে পড়লো রমিজ মুন্সির ছোট ভাইয়ের মাথায়। সেও যেন মরার ছুঁতো খুঁজতে এসেছিল। এক বাড়িতেই শেষ! বারি কিছু বুঝতেই পারলো না। মিষ্টির গন্ধে পিপড়ার মতো কোথায় থেকে যেন পুলিশ এসে হাজির। তখন কোনো মতো পালিয়ে রক্ষা। জেল-ফাঁসির ভয়ে একবার গ্রাম ছাড়া। শেষ পর্যন্ত একটা গলা ভিসায় বিদেশ। যাওয়ার সময় আহমদকে বলেছিল তার বৌকে দেখে রাখতে। বিদেশ থেকে নিয়মিত টাকা পাঠাতো তার সংসারের খরচ আর কেস মীমাংসা করার জন্য। কিন্তু আহমদ সব টাকা নিজের কাছে রেখেছে। নিজের নামে চকে ধানি জমি রেখেছে। এমনকি হামেদাকে বুঝিয়েছে, তার স্বামী সৌদিতে আরেকটা বিয়ে করেছে। এবং আগের বৌ থাকায় আহমদ মাতবর হামিদাকে নিয়ে বাজারের কাছে ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। আহমদ এখন হামেদার কাছেই থাকে। অথচ বারি যতই বিদেশ থেকে জানতে চেয়েছে, বলেছে, পরিস্থিতি খারাপ, দেশে আসা ঠিক হবে না। কিন্তু দেশে এসে সব দেখে বারি চোখ চড়কগাছ। সেদিন রমিজ মুন্সির ছোট ভাই মরে নাই। চিকিৎসা-পাতি করে ঠিক হয়েছে। বারির টাকায় আহমদ কেস মিটিয়ে ফেলেছে। বারির ব্যবসায় নিজে বসেছে। এমনকি হামেদাকে পর্যন্ত তার ঘরে তুলেছে। বারি বহু চেষ্টা করেছে, আর কিছু না হোক হামেদাকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু সে দিন বারির ফুরিয় গেছে। আর হামেদাও কেন যেন আসতে চায় না। তবে বারির সাথে অভিসার করে, কথা বলে, আদর করে। আর এই সব কিছুদিন না পেলে বারি মদ খেয়ে বাজারের বকাবকি করে। যারা ব্যাপারটা জানতো বা বুঝতো, বলতো, ‘ওই যে বারি’র মাথা গরম ওইছে। আইল্যা ঘি দ্যা ভিজান লাগবো।’ কিন্তু একসময় দেখা গেল যে বারি ঘন ঘন মদ খাচ্ছে, বাজারে বকাবকি করছে। তখন তারা বলতো, বারি এখন সত্যি পাগল হয়েছে।

কিন্তু কখনোই যা ঘটে না তাই একদিন ঘটলো। সেদিন সকাল সকাল বারি মদ খেয়ে বাজারের চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর বকাবাজ্জি করছে। বিশ্রী ও অশ্লিলভাবে। কখনো খেপাটেভাবে আহমদের দোকানের ঝাপে হোটেলের শুকনো চলা দিয়ে দুরুম-দারুম পিটাপিটি করছে। দোকানটা সেদিন বন্ধ ছিল। এমন কি দোকানটা আগুন লাগিয়ে দেয়ার প্রকাশ্য হম্বিতম্বি করলো। তখন ঠিক দুপুর, প্রচন্ড রোদে পুড়ে যাচ্ছে মাটি। বারি এই রোদে মধ্যে শরীর ছায়া যেন মাটিতে গেঁথে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না। পরে দেখা গেল, দুপুর বেলা আহমদ ও হামেদা রিকশা থেকে নামছে। গঞ্জে গিয়ে ছিল তারা, ডাক্তার দেখাতে। হামেদা চেহারায় কিসের যেন দ্যুতি রোদের মতো ঠিকরে বেরুচ্ছে। সে মিটিমিটি হাসছে, যেন কৌশলে কোনো যুদ্ধ জয়ের বহিঃপ্রকাশ। হামেদা মা হবে। খবরটা মুহুর্তেই সারা বাজারময় ছেয়ে গেল। কিন্তু যে কাজ গত পাঁচ বছরে করেনি, বারি সেদিন সেই কাজটাই করলো। সে রাস্তার মোড়ে পর পর মদের চারটা কাঁচের বোতল আছড়ে ভেঙে ফেললো। একটার মধ্যে খানিকটা মদও ছিল। রাস্তার উপর ভিজে চারপাশে তার মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। বারি বিদ্যুত গতিতে গিয়ে আহমদের কলার ধরে চেহারা বরাবর পটাপট কয়েকটা ঘুসি চড়িয়ে দিলো। নাকের উপর একটা ঘুসি খেয়ে আহমদ উল্টে গিয়ে পড়লো হামেদার পায়ের কাছে। আহমদের নাক দিয়ে দর দর করে রক্ত ঝড়ছে। হামেদাও যেন কেমন সন্দোর্পনে একটু সরে গেল। তবে সব আজব ঘটনা ঘটল তখনই যখন আহমদ কোনো প্রতিরোধই করলো না। যেন আগে থেকেই আধমরা হয়ে আছে। সবাই ফেরাতে ফেরাতে বারি তার গায়ে আরো কয়েকটা লাথি দিয়ে মুখ বরাবর থুথু ছিটিয়ে আরেক দিকে চলে গেল।

পরের দিন সবাই দেখলো বারি আশ্চর্যজনকভাবে নিরব। এই বিস্ময় কাটতে না কাটতে সবাই আহমদও যেন কেমন মন মরা, অসুস্থ মতন ছন্নছাড়া। তার চোখে মুখে এই বয়সেও পিতৃত্ব লাভের কোনো আনন্দ ঝিলিক নেই। ঠিকঠাক মতো দোকানেও আসে না। কিছুদিন পর শুনলো, আহমদ সিকদারের নাকি রোগ হয়েছে। কঠিন রোগ, ডাক্তারও ধরতে পারছে না। দিনে দিনে শুধু শুকিয়ে যাচ্ছে। সবাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পরলো। চিন্তা করলো, তার একভাই, যে আহমদের মতোই হারামি ছিল, সে বাউশি রোগে পাছা দিয়ে রক্ত পরতে পরতে শেষ পর্যন্ত মারাই গেছে। তারও কি তবে সেই রোগ হলো? একদিন সবাই চিন্তা করলো তারা গিয়ে আহমদকে দেখে আসবে, সেই সাথে হামেদাকেও দেখে আসা যাবে।

বিকাল গড়ান্ত সবাই আহমদের ভাড়া বাড়িতে গেলো। বাড়িতে উঠার পথে রাস্তার পাশে টিউবওয়েলের পানি জমা কাঁদায় কয়েকটা কাঁচের ভাঙা বোতল গেঁথে থাকতে দেখতে পেলো। কিন্তু তা নিয়ে বিশেষ কিছু আর চিন্তা করলো না। বাড়িতে গিয়ে ঘরের ভেড়ানো দরজা ধাক্কা দিতেই যেন আরেক জগৎ খুলে গেল। ঘরময় আফসা অন্ধকার। ঘরের একপাশে আহমদ একটা খাটের উপর উদাশ, দৃশ্যত প্রায় আধমরা, শুয়ে আছে। হামেদা অন্যপাশে, আরেকটা খাটে বসা। একটা জানালা খুলে বেশ খুশি মনে ছোট নকশি কাঁথা সেলাই করছে। চোখে মুখে মাতৃত্বের গর্বিত উজ্জ্বলতা। আবার কিসের জন্য যেন উসর অপেক্ষা। কিন্তু এই অপেক্ষা কারো আগমন না বিদায়ের জন্য তা বোঝা যায় না। হামেদা তাদের দেখে খানিক তৎপরতার সঙ্গে বসতে দেয়। কিন্তু আহমদের মধ্য কোনো ক্রিয়া নেই। শিশুর ভোলানোর জন্য শোয়ার বিছানার উপর টাঙানো রঙিন কাগজের ফুল-কলসের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো সে এক ধিয়ানে সিথানের উল্টোপাশে তাকের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে চোখ যেতেই সবাই যারপরনাই বিস্মিত হলো। তাকের উপর মুড়ি ভর্তি বড় বড় বোতল সাজানো। কারোর আর চিনতে বাকি রইলো না যে, এগুলো কিসের বোতল। হামেদা খুশি মনে সেগুলোর একটা থেকে সবাইকে ঘরে ভাজা মুড়ি পরিবেশন করলো। ০


লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান

জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি নিম্নবর্গের মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। ঢাকা কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।

alatehasan@yahoo.com; +88 01714 784 385

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ