![]() |
--হোসে মার্তি
----------------------------------------------------------------------
সারা পৃথিবী জুড়ে সেই একই বস্তাপচা চলচ্চিত্র, সেই বিরক্তিকর যন্ত্র, সেই প্লাস্টিক অথবা অ্যালুমিনিয়মের অত্যাচার, সেই একই ঘোরানো-প্যাঁচানো প্রচারণার ভাষা, ইত্যাদি। অন্যদিকে (উন্নয়নশীল দুনিয়ায়) অতীতের মাটিতে শেকড় গাড়তে চাইছে, উঁচুতে তুলে ধরছে জাতীয় সত্তাকে। খুলে দিতে চাইছে উপনিবেশবাদী ব্যক্তিত্বের অধ্যাত্মবাদী আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসী চেহারা। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় যদি অংশগ্রহণ করতে হয়, তাহলে ওই একই সময়ে দরকার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী হওয়া। এ জন্যে প্রয়োজন সমস্ত বিশুদ্ধ আর সরল অতীতকে বর্জন করা।
--পল রিকোয়ের

কিউবার মুক্তিসংগ্রামের এক মহানায়ক হোসে মার্তি, সেই সঙ্গে প্রখ্যাত মার্কিন দার্শনিক পল রিকোয়ার; লেখাটি শুরু করেছি এ দু-জনের দুটো উদ্ধৃতি দিয়ে। দু-জনেই প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে সাহিত্য যে আশা-আকাক্সক্ষার সর্বোচ্চ শিখাটাকে উঁচুতে তুলে ধরতে পারে অথবা উন্মোচন করতে পারে এর আভ্যন্তর সংকট, ব্যক্ত করেছেন সেই অভিমত। বাংলাদেশের উপন্যাসে এই পরস্পর প্রতিস্পর্ধী প্রসঙ্গ কীভাবে উপজীব্য হয়েছে, জাতিরাষ্ট্র ও উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রের আকাঙ্খা ও সংকট কীভাবে আমাদের ঔপন্যাসিকেরা মূর্ত করতে পেরেছেন, এই লেখার মূল ভাববস্তু সেটাই।

১.
আধুনিক সমালোচনারীতি অনুসারে এখন যে-কোনো রচনাই হচ্ছে বয়ান, যার ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ডিসকোর্স। কথাসাহিত্যকে আরও বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয় ন্যারেটিভ বা বিবরণ বলে। উপন্যাস এই কথাসাহিত্যেরই অন্তর্ভুক্ত অত্যন্ত শক্তিশালী সৃজনী গদ্যমাধ্যম। বয়ান অবশ্য কোনো সরল-সহজ বিবরণমাত্র নয়; বয়ানের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক তার জীবনার্থকে রূপ দিয়ে থাকেন। ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টি, আকাক্সক্ষা, ভাবনা, কাহিনীর আধারে নানা আঙ্গিকে, ভাষাবৈচিত্র্যে, উপমা-রূপকের অনুসূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় উপন্যাসে।
ব্যক্তিক আত্মসংকট, আত্মদ্বন্দ্ব আর আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের বহুমাত্রিক রূপই হচ্ছে উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিজীবন এভাবেই কোনো একটি কাহিনীকে ঘিরে আবর্তিত হয়, বিকাশ লাভ করে এবং অন্তিম পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়। কাহিনী নির্বাচন করতে গিয়ে ঔপন্যাসিক বেছে নিতে পারেন যে-কোনো একটি ক্ষেত্র, হতে পারে তা গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত, কিংবা নাগরিক প্রতিবেশে, অথবা কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা জনপদকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারে উপন্যাসের কাহিনী। বিষয়ের কেন্দ্রে থাকতে পারে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, পারিবারিক সংকট, সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, প্রেম, ইতিহাস-ঐতিহ্য বা রাজনীতি। বাংলাদেশের উপন্যাসেও লক্ষ করা যাবে এই বিষয়বৈচিত্র্য। এতে সমকালীন দেশকাল, বিশেষ করে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব এবং উপনিবেশবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদী সমাজের নানা অনুসূক্ষ্ম প্রসঙ্গ কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও পরোক্ষে উপজীব্য হয়েছে। উপন্যাস হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বয়ান।
কিন্তু এর স্বরূপ কী ছিল, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ অথবা এখন যে বিষয়টি আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে -- সেই বিশ্বায়নকে তাদের উপন্যাসে কিভাবে উপস্থাপন করেছেন, এর ব্যক্তিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য কী -- এসব নিয়েই লেখা হয়েছে বর্তমান প্রবন্ধটি। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তৃত বলবার আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান ও প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্তটি খুব সংক্ষেপে বুঝে নেয়া জরুরি; আর এরই প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে বাংলাদেশের উপন্যাসে ধৃত উত্তর-উপনিবেশবাদের প্রকৃত চারিত্র্য। এসব দিক বিবেচনা করে বর্তমান প্রবন্ধটিতে তিনটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে:
প্রথমত, উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ;
দ্বিতীয়ত, উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদের সঙ্গে উপন্যাসের আন্তসম্পর্ক;
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উপন্যাসে উপজীব্য উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদের স্বরূপ এবং এসবের সৃজনী তাৎপর্য।
২.
বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন দিয়েছিলেন জাতির একটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যা যার সঙ্গে উপন্যাসের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। অ্যান্ডারসন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, উপন্যাসই জাতিগঠন করেছে, জাতিগঠনে পালন করেছে প্রধান ভূমিকা। তার মতে জাতি হচ্ছে একধরনের ‘কল্পিত জনগোষ্ঠী’। এই জনগোষ্ঠী, জাতিরাষ্ট্র ও আধুনিক জাতীয়তাবাদ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে দু’টি ছাপা-মাধ্যম : সংবাদপত্র ও উপন্যাস। এ দুটি মাধ্যমই নির্মাণ করে দিয়েছে জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। সামন্তবাদের অবসানের পর যখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটছিল, তখনই এই কল্পিত জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। সংবাদপত্র, উপন্যাস এবং যোগাযোগের নতুন নতুন মাধ্যম সংস্কৃতির এমন একটি রূপ দাঁড় করায় যে-সংস্কৃতির প্রতি সবাই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, অংশগ্রহণ করেছিলেন; সৃষ্টি হয়েছিল নতুন নতুন শব্দ ও বিশেষ ভাষাভঙ্গি। সংবাদপত্র ও উপন্যাস, অর্থাৎ ‘মুদ্রণ পুঁজিবাদে’র প্রভাবে এভাবেই সৃষ্টি হয় একটি মান্য বা প্রমিত ভাষারীতির, যে-ভাষারীতিকে ঘিরে গড়ে ওঠে ওই কল্পিত জনগোষ্ঠী যারা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের প্রধান উৎস।
অ্যান্ডারসনের এই ব্যাখ্যা ইউরোপ ও আমেরিকার জন্যে প্রযোজ্য হলেও অবশিষ্ট পৃথিবীর জন্যে যে সমভাবে কার্যকর হতে পারে না, সে-সম্পর্কে আপত্তি তুলেছেন ‘তল থেকে দেখা ইতিহাসে’র অন্যতম প্রবক্তা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অ্যান্ডারসন যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে ইতিহাসের ভাবকল্প হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা আর আমরা -- অর্থাৎ উত্তর-উপনিবেশবাদী পৃথিবীর মানুষ হচ্ছি ওই আধুনিকতার ভোক্তামাত্র। তারা ঔপনিবেশিক জ্ঞানদীপ্তির নামে উপনিবেশ স্থাপন ও শোষণ করেছে, আবার আমাদের উপনিবেশবিরোধী প্রতিরোধ, আন্দোলন ও উত্তর-ঔপনিবেশিক দূরবস্থাকে অগ্রাহ্য করেছে, এমনকি আমাদের কল্পনাকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। তার মতে জাতীয়তাবাদ আসলে এভাবে সৃষ্টি হয়নি, জাতীয়তাবাদের প্রকৃত সূত্রপাত ঘটেছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং সেই আন্দোলন ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। পশ্চিমের স্বাধীনতা, ব্যক্তিক আত্মমুক্তি ও মানবিকতার ধারণাকে পূবের দেশগুলোকে তাই ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। সংস্কৃতিকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি করতে হবে জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স, ভারতীয় ভাবুক-শিল্পীরা এভাবেই জাতীয়মুক্তির পথে অগ্রসর হয়েছিলেন -- পার্থ সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আরেক নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী বলেছেন, ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ একত্রে মিলে “সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক গোষ্ঠী জাতিরাষ্ট্রের একটা সর্বজনীন রূপ দাঁড় করিয়েছে (চক্রবর্তী ১৯৯২ : ১৯)।”
দেশকালের এই ভাবনা কী শুধু এখনি ঘনিয়ে উঠছে আমাদের মধ্যে? এ আসলে এক চিরায়ত প্রক্রিয়া, কিন্তু আধুনিক কালে আমাদের জীবন অনেক বেশি রাজনীতিসম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে দেশকালের প্রসঙ্গটি প্রাধান্য পাচ্ছে। সাহিত্য যে দেশকালের সঙ্গে যুক্ত হয়েই মানবিকতার দিকে এগিয়ে যায়, বঙ্কিমমচন্দ্র সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সেকথা, “... বাংলাদেশে আমরা সাহিত্যের ভিতর দিয়া নিজের চিত্তকে উপলব্ধি করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম”; আর কবি ইয়েট্স সম্পর্কে তার অভিজ্ঞান : “কবি ভাবের আলোককে কেবল প্রকাশ করেন তাহা নহে, তিনি যে দেশের মানুষ সেই দেশের হৃদয়ের রঙ দিয়া তাহাকে একটু বিশেষ ভাবে সুন্দর করিয়া প্রকাশ করেন।” (ঠাকুর ১৩৯৮ : ৬৬৭-৬৬৯)
কিন্তু এটাই শেষকথা নয়, কেননা রাষ্ট্রিক মতাদর্শ হয়ে উঠতে হলে সেই মতবাদের মধ্যে সমগ্র জনগোষ্ঠীর স্থান হতে হবে। কিন্তু ‘কল্পিত জনগোষ্ঠী’ খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে কারা ওই গোষ্ঠীতে আছে, কিন্তু তাদের ভাবনা থেকে বাদ পড়ে গেছে প্রান্তিক মানুষ -- যেমন নারী,১ নিম্নশ্রেণী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী, বর্ণভেদের শিকার মানুষ। ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসবিদেরা এলিট শ্রেণীর ওই ইতিহাসকে খ-িত আখ্যা দিয়ে নিম্নবর্গীয় মানুষকে তাদের বিষয় করে তুলেছেন। রণজিৎ গুহ বলেছেন, নিম্নবর্গের অবদানকে শুধু এলিট শ্রেণীর ইতিহাস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না, দেখতে হবে ‘তাদের নিজেদের মতো করে’। তার মতে ‘জনগণের সচেতন চৈতন্যকে কখনও আধিপত্যের সঙ্গে মিলিয়ে’ জাতীয় মুক্তির কথা ভাবা হয়নি (গুহ ১৯৮২ : ৫-৬)। এখন নিম্নবর্গীয় সমীক্ষণ শুধু নিম্নবর্গীয় মানুষ কীভাবে উপনিবেশের শিকার হয়েছিল সেই ইতিহাস নয়, কীভাবে পুঁজিবাদী সমাজের অংশ করে তুলে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা হচ্ছে, কীভাবে তারা উত্তর-উপনিবেশবাদের অংশ হয়ে উঠেছে, সে-সব ব্যাখ্যা করছে (বোজ্জোলি ও ডেলিয়াস ১৯৯০ : ৩৪)।
শহীদ আমিন দেখিয়েছেন, জাতিই হচ্ছে জনগোষ্ঠী, কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে বহুবিচিত্র মানুষ; শুধু কার সঙ্গে কার ঐক্য রয়েছে কিংবা কারা সমজাতিক ঐতিহ্যের অধিকারী, সে-সব বিবেচনা করাই বড়ো কথা নয়, বরং অনৈক্যের উৎসগুলো খুঁজে দেখতে হবে, দেখতে হবে জাতিরাষ্ট্র থেকে বাদ পড়লো কারা, অবদমিত থাকছে কারা, আধিপত্য বিস্তার করা হচ্ছে কাদের উপর এবং কেন (আমিন ১৯৯৫ : ৩)। কিন্তু উপনিবেশবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত উত্তর-উপনিবেশবাদী সমাজে কীভাবে শুরু করা হবে এই কাজ? বিশেষ করে উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রকাঠামো যেখানে ধারণ করেছে অনেক জটিল রূপ, সেখানে বুদ্ধিজীবী লেখক-শিল্পীদের অবস্থান কেমন হবে? রাষ্ট্র, শাসনযন্ত্র এবং নির্যাতন-আধিপত্যের স্বরূপ তারা কীভাবে উন্মোচন করে দেখাবেন? ফ্রানৎজ ফানোঁ এ প্রসঙ্গে লেখকদের বিপ্লবী সক্রিয়তা আর গণআন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তির উপর জোর দিয়েছেন এভাবে :
এটা সম্ভব নয় সেই অতীতে ফিরে যাওয়া যেখান থেকে জনগণের উদ্ভব ঘটেছে; বরং আমরা যোগ দিতে পারি সেইসব টালমাটাল আন্দোলনে যে আন্দোলনকে তারা আকার দিতে চাইছে। যখন এটা শুরু হবে তখনই সবকিছু সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে, এরকম আলামতই দেখা যাবে। এতে কোনো ভুল করা যাবে না, এটা সেই অনিশ্চিত অবস্থা যা নিয়ে কাজ করছে জনগণ; আমাদের এতে অংশগ্রহণ করতেই হবে। এটা এমনই একটা বিষয় যেখানে আমাদের আত্মা স্ফটিকায়িত হচ্ছে; আমাদের বোধ এবং আমাদের জীবন উদ্ভাসিত হচ্ছে আলোয়। (ফানোঁ ১৯৬৩)
অ্যামিকার কাবরাল ওই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন আবার ‘জাতীয় সংস্কৃতি’র ইতিবাচক এবং মূল্যবোধ-আশ্রয়ী আন্দোলনের মধ্যে। তিনি মনে করেন, “কোনো সংস্কৃতিই বিশুদ্ধ নয়, চূড়ান্ত নয়। ইতিহাসের মতো সংস্কৃতি সবসময় প্রসারিত হয় এবং তা বিকাশমান (কাবরাল ১৯৯৪ : ১৬)।” জাতি কোনো স্থির ধ্রুব বিষয় নয়, এটি নিরন্তর বিকাশমান; আর সেজন্যেই তা সময়ান্তরে পুনঃকল্পিত হতে হবে; বার বার রাষ্ট্রভাবনাকে জনগণের স্বার্থে নবায়িত করে নিতে হবে। লেখক-শিল্পীদের কাজ হলো এটাই, অতীত ভাবকল্পের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রকল্পনার পথে এগিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বিবেচনা করি তাহলে আমাদের সৃজনশীল লেখায়, বিশেষ করে উপন্যাসে, যাকে আমি বয়ান বলে উল্লেখ করেছি, কীভাবে এই জাতিরাষ্ট্র, উপনিবেশবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদের প্রসঙ্গটি উপস্থাপিত হয়েছে? কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা সমকালীন রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, কেননা রাজনীতিই ছিল এবং এখনও রয়েছে অধিকাংশ লেখকের ভাবনার কেন্দ্রে। একই সঙ্গে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা ও সংকটের উৎস কী, উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে আধুনিকতার পথে কীভাবে অগ্রসর হয়েছি, সংকট ও সম্ভাবনার সেই দিকগুলোও আলোচিত হবে এই লেখায়।
৩.
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির অধীন ছিল : ঔপনিবেশিক কাল এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক কাল। ঔপনিবেশিক কালের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে, পরবর্তীকালে যা প্রলম্বিত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসনকাল পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে প্রথমে দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং পরে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ; প্রবেশ করে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের মতো বাঙালি মুসলমানেরা শুরু থেকেই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের তীব্র বিরোধিতা করলেও পাকিস্তানি রাষ্ট্রসৃষ্টিতে আন্দোলন করার পাশাপাশি ওই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আত্মবিলোপের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ভ্যান শেনডেল বলেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ‘ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’কে অবলম্বন করে। সেই সময় এই বদ্বীপ এলাকার মুসলমানেরা নিজেদের প্রথমে মনে করেছিল মুসলমান, তারপর বাঙালি। তারা স্বপ্ন দেখেছিল এমন এক বাংলাদেশের যেখানে ইসলামি মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালির জীবনধারা যাবে বদলে। বাঙালি মুসলমানেরা এই লক্ষ্যেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেছিল, সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু তারা বাঙালিত্বকে বিসর্জন দিতে চায়নি, বাংলা ভাষাকেও নয় (ভ্যান শেনডেল ২০০৯ : ১০৭)। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় তাই যখন বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালিয়ে উপনিবেশবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তখনই তারা ওই শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে, তাই বলা বাহুল্য, সক্রিয় ছিল স্বাতন্ত্র্যের বোধ আর একক জাতি হয়ে ওঠার প্রেরণা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবদুর রাজ্জাকের মন্তব্য :
বাংলাদেশের মানুষ একটা জাতি, কারণ তারা একটা জাতি হতে চায়, অন্য কিছু নয়। ... এই জাতিকে তৈরি করেছে তার অনমনীয় গর্ব, সুখে-দুঃখে আট কোটি মানুষের সঙ্গে একই পরিচয় বহন করা, অন্য কিছু নয়, শুধু বাঙালি হতে চাওয়ার জেদ (রাজ্জাক ২০০১ : ৪৪)।
বাংলাদেশের মানুষেরা এভাবেই পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের মতো ‘সর্বভারতীয় সভ্যতার মায়াবিনী হাতছানির শিকার’ যেমন হয়নি, তেমনি পাকিস্তানি জাতিসত্তার মধ্যেও বিলীন হয়ে যেতে চায়নি। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত জাতির মতো, বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় জাতির মতো “আমাদের জাতির দেয়ার মতো কিছুই নেই। তথাপি যা আমাদের একত্রে ধরে রেখেছে, পরিণত করেছে এক জাতিতে, তা হচ্ছে আমাদের শুধু এই জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়ার ঐকান্তিক কামনা।” (রাজ্জাক ২০০১ : ৪৪)
পৃথক জাতি হয়ে ওঠার ওই সক্রিয় উপনিবেশবিরোধী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে, লক্ষণীয়, বাঙালি মুসলমানেরা গ্রহণ করেছিল যে রাজনৈতিক মতাদর্শকে সেটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ভেন শেনডেল এই পরিবর্তিত অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :
তারা প্রথমে ছিল বাঙালি, তারপর মুসলমান। নতুন সমাজ গড়ে উঠবে এমনসব নীতির উপর যার চর্চা ও বিকাশ ঘটেছে পশ্চিমে। পশ্চিমী এই নীতিরই প্রয়োগ ঘটানো হবে আঞ্চলিক পরিবেশে, আর তা হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বেশিরভাগ মানুষের সংস্কৃতি হিসেবে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তবে সেই ধর্মীয় বিশ্বাস চর্চিত হবে ব্যক্তিগত স্তরে, কিন্তু তা জাতীয় পরিচয় হয়ে উঠবে না (ভ্যান শেনডেল ২০০৯ : ১৮৩)।
আধুনিক কালে জাতীয়তাবাদের দুটি ধারা আমরা লক্ষ করি : উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ। সম্প্রতি এই জাতীয়তাবাদকে আবার ভিন্ন দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে : রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ এবং সংঘালঘু জাতীয়তাবাদ (কাইমলিকা ও স্ট্রায়েল ১৯৯৯ : ৬৬)। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ যে রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছিল, সেটি ছিল উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন; বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামে যা পরিচিত। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির অব্যবহিত মুহূর্তে, সাম্প্রতিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা অনুসারে, উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদ থেকে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে জাতি হয়ে ওঠার জন্যে যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন, তাও ছিল বিদ্যমান ও সক্রিয়। বাংলাদেশের একক জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, জাতি বলতে কী বুঝবো আমরা? কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করবো?
৪.
লেখাটা শুরু করেছিলাম মার্তি আর রিকোয়ারের বয়ান দিয়ে, ফিরে যাচ্ছি সেই প্রসঙ্গে আর এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উপন্যাসে কীভাবে উত্তর-উপনিবেশবাদী বাংলাদেশের উপস্থাপনা ঘটেছে, আলোচিত হবে সেই প্রসঙ্গ। মার্তির কাছে, উদ্ধৃতিটি লক্ষণীয়, সাহিত্য হচ্ছে জাতীয় অস্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। মহৎ এই সাহিত্যই জনগণের ঐক্যের কথা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জাতির অস্তিত্বের কথা জানান দিতে পারে। আধুনিক কালে উপনিবেশবাদের অবসান ও জাতিসৃষ্টিতে সাহিত্য যে কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে, চিনুয়া আচেবে, ওলে সোয়েঙ্কা, জর্জ ল্যামিং, ন্যাদিন গর্ডিমার, এম জে কোয়েৎজির লেখায় সেই দূরদৃষ্টির উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। সাহিত্য তাদের উপন্যাসে রাজনৈতিক রূপান্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। লেখকদের সৃষ্টিশীল লেখার মধ্য দিয়েই রচিত হয় নতুন সাংস্কৃতিক পটভূমি যা জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিতে সহায়তা করে। মার্তি যথার্থই ভেবেছেন, উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রসৃষ্টিতেও সাহিত্য পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাষ্ট্রযন্ত্রের গণতান্ত্রিক অথবা আধিপত্যবাদী, জনবান্ধব বা নির্যাতনমূলক দুই ধরনের চেহারাই চমৎকারভাবে উন্মোচিত হয় সাহিত্যে, বিশেষ করে উপন্যাসে। ধারণাগত দিক থেকে সাহিত্য ও জাতি তাই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।
বিউপনিবেশীকরণের পৃথিবীতে, মার্তি ঠিকই ভেবেছেন, মহৎ সাহিত্য হচ্ছে জাতির চিহ্ন; জাতিও আরেকটি বিশেষ চিহ্ন -- এই চিহ্ন হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতার, যথার্থ স্বার্বভৌমত্বের, আত্মনির্ভরতার। এই ভাবনার উপর নির্ভর করেই উপনিবেশবিরোধী জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠী। জাতির আকাক্সক্ষা পূরণের কিংবা ইতিবাচক অর্জনের জন্যে প্রয়োজন দেখা দেয় সমগ্র রাজনৈতিক স্থাপনা ও সম্ভাবনার উৎসগুলো জনস্বার্থে ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ব্যবহার করা। কিন্তু রিকোয়ার যেমনটা বলেছেন, রাজনীতি এই সম্ভাবনাকে সীমিত করে ফেলতে পারে। কেননা রাষ্ট্র শুধু অতীতের স্মৃতিবাহী ঔপনিবেশিক চিহ্নমাত্র নয়, আধুনিকতারও চিহ্ন। এই আধুনিকতার পথে অগ্রসর হতে হলে আমাদের হতে হবে প্রগতিবাদী; গ্রহণ করতে হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাজারপুঁজি; গড়ে তুলতে হবে যৌক্তিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনব্যবস্থা।
কিন্তু এ হলো আধুনিকতার একটা দিক, এর অন্য দিকটা হচ্ছে এমন এক সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো বা পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে যা অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সামাজিক অস্তিত্বের একেবারে কেন্দ্রে স্থাপন করবে। এই প্রক্রিয়াটাকেই কখনও কখনও ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যা রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের পরেও অক্ষুণœ থাকতে পারে। এই প্রক্রিয়াটাই যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে অথবা যে বিউপনিবেশীকরণ চলছে, তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বিউপনিবেশীকরণের জন্যে তাই রাজনৈতিক স্বাধীনতাই শেষকথা নয়, সামাজিক অস্তিত্বের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন, যা আবার পশ্চিমের তুলনায় পৃথক, অনারোপিত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক, প্রার্থিত। লক্ষ করলে দেখা যাবে উপনিবেশের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পরও, অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও উপনিবেশমুক্ত দেশগুলো, যার অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ, জনমানুষের স্বপ্নপূরণ করতে পারেনি বা এগিয়ে আসেনি। কিন্তু বাংলাদেশের উপন্যাসে কীভাবে জাতি, রাষ্ট্র ও জনমানুষের কথা উপস্থাপিত হয়েছে সে-সব বিষয় আলোচিত হয়েছে এই লেখায়। বলা বাহুল্য, আমার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে কেন্দ্রে রেখে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বয়ান, দেশজ ও পশ্চিমী ভাবনাজাত বয়ান, আধুনিক প্রগতিবাদী উন্নয়নধর্মী বয়ান, আধুনিকতার সঙ্গে সংযুক্ত জাতীয়তাবাদী বয়ান, রাজনৈতিক ভূমিকাসূচক বয়ান কীভাবে বিভিন্ন ঔপন্যাসিকের লেখায় উপজীব্য হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রণয়ন করা।
৫.
প্রায় চার দশক হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই স্বাধীনতার পটভূমিতে সক্রিয় ছিল দুটি ঔপনিবেশিক শক্তি -- ব্রিটেন ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের উপন্যাস পাকিস্তান সৃষ্টির কাল থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের উপন্যাসে সর্বপ্রথম উপনিবেশবাদের পটভূমি নির্মিত হয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত লালসালু উপন্যাসে। এই উপন্যাসের নায়ক মজিদ ধর্মীয় কুসংস্কারের আশ্রয় নিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে জয়ী হয়, কিন্তু তার এই বানানো ধর্মবোধ পরাজিত হয় তার দ্বিতীয় স্ত্রী অল্পবয়সী জমিলার কাছে। আগেই বলেছি, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রসৃষ্টির প্রধান প্রেরণা, ঔপন্যাসিক ওয়ালীউল্লাহ সেই ধর্মকেই কৌতুকে পরিণত করেছেন, মজিদ হয়ে উঠেছে এক খলনায়ক। উপন্যাসটি এভাবেই পরিণত হয়েছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদবিরোধী বয়ানে। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে পাকিস্তান রাষ্ট্রসৃষ্টির অন্তঃসারশূন্যতা প্রথম শৈল্পিকভাবে উপজীব্য হয়েছে আবু ইসহাকের সূর্যদীঘলবাড়িতে। ব্রিটিশ উপনিবেশমুক্ত পরিবেশে বাংলাদেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষ সমকালের পাকিস্তান রাষ্ট্রপরিসরে বেঁচে থাকার রাজনৈতিক অধিকার পেলেও তাদের সেই অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি, বিশেষ করে নারী পারিবারিক-সামাজিক স্তরে অর্জন করতে পারেনি মর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা, বেঁচে থাকার জন্যে তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে। আহমদ ছফার ওঙ্কার উপন্যাসে আবার নারীচরিত্রের মধ্য দিয়ে ঘোষিত ও বিবৃত হয়েছে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায়, “একটি জনগোষ্ঠী থেকে পরিপূর্ণ একটি জাতিতে পরিচিত হওয়ার সংকল্প (ইলিয়াস ২০০৩ : ১০৩)।” শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তকে সামন্তবাদী সমাজ ও ঔপনিবেশিক শক্তি কীভাবে সাধারণ মানুষকে শোষণ করে আর সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে কীভাবে আন্দোলন করেছে, গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ, জড়িয়ে পড়েছে জাতিরাষ্ট্র গঠনে, এই উপন্যাসের নায়ক জাহেদের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের মধ্যে পাওয়া যায় তারই চমৎকার বয়ান। এই উপন্যাসটি, গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, হয়ে উঠেছে ফ্রেডিরিক জেমিসন যাকে চিহ্নিত করেছেন ‘জাতীয় রূপকে’ (national allegory) (জেমিসন ১৯৮৬)। শওকত ওসমানের উপন্যাসেও এই জাতীয় রূপকের বিষয়টি আরও স্পষ্ট। তার জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা। আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাসের বিষয়বস্তুও মুক্তিযুদ্ধ। তবে সরল অর্থে নয়, এর নায়ক সুদীপ্ত শাহিন কিভাবে মধ্যবিত্তের পিছুটান এড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল, পাওয়া যায় তার বিবরণ।
তবে বাংলাদেশের উত্তর-উপনিবেশবাদী সমাজ আরও স্পষ্টভাবে উপজীব্য হয়েছে আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের উপন্যাস চিলেকাঠের সেপাইতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ব্যক্তিজীবন তখন এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল যে ঊনসত্তরের উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্যেও এর নায়ক ওসমান চিলেকোঠার মধ্যেই আত্মরতি আর মরবিডিতে আক্রান্ত হয়েছে, কেঁপে কেঁপে উঠেছে মিছিল আর শ্লোগানের অভিঘাতে। কিন্তু তার দ্বিতীয় উপন্যাস খোয়াবনামায় তিনি ফিরে গেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির মুহূর্তে। শহুরে জীবন নয়, গ্রামীণ মানুষের জীবনই যে পাকিস্তান আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত হয়েছিল, পাওয়া যায় সেই রাজনৈতিক-ব্যক্তিক ন্যারেটিভ; আর কাহিনীর নেপথ্যে সক্রিয় থেকেছে অনতিদূর কালের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি আর তেভাগা আন্দোলন। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিল যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, সেই জাতীয়তাবাদের কথাও চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে, সেইসঙ্গে শ্রেণীবিভক্তির সূক্ষ্ম দিকও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। শওকত আলীর উপন্যাসগুলোতে পাওয়া যায় আরেক ধরনের জটিল উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রের ইতিবৃত্ত। তার দক্ষিণায়নের দিনে সমকালীন মার্কসবাদী আন্দোলনের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানের বিষয়টি বেশ চমৎকারভাবে উপজীব্য হয়েছে। তবে উত্তর-উপনিবেশবাদী সমাজ যার উপন্যাসে সবচেয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে উপজীব্য হয়েছে তিনি হচ্ছেন সেলিনা হোসেন। তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস, যেমন হাঙর নদী গ্রেনেড, যাপিত জীবন, কাঁটাতারে প্রজাপতি, গায়ত্রীসন্ধায় ব্রিটিশবিরোধী ঔপনিবেশিক সংগ্রাম ও উত্তর-উপনিবেশবাদী বাংলাদেশের সমাজের উপস্থিতি ও বয়ান বেশ উল্লেখযোগ্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অন্য যেসব ঔপন্যাসিকের রচনায় উপনিবেশবাদী এবং উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র ও সমাজের ছবি পাওয়া যায় তারা হলেন, রশীদ করীম, রশীদ হায়দার, আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখ। অন্যদের তুলনায় কিছুটা বিলম্বে হলেও হাসান আজিজুল হক লিখেছেন আগুনপাখি শীর্ষক উপন্যাস, যার মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে দেশভাগের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে। মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোনের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধ; সমকালের এক তরুণ কিভাবে রাষ্ট্রিক সংকটের মধ্যেও ব্যক্তিক-পারিবারিক সংকটে বিপন্ন বোধ করেছে, উত্তর-উপনিবেশবাদের এই স্থবির চিত্রই এর মূল বিষয়।
তবে পঞ্চাশ ও ষাটের ঔপন্যাসিকেরাই নন, স্বাধীনতা পরবর্তীকালের তরুণতর ঔপন্যাসিক বা সমকালের ঔপন্যাসিকদের রচনায় উত্তর-উপনিবেশবাদী বাংলাদেশের অবক্ষয়িত, ভঙ্গুর, জনবিরোধী চরিত্র আরও স্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এদের উপন্যাসেই উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে চমৎকারভাবে। এসব ঔপন্যাসিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন মঞ্জু সরকার, মইনুল হাসান সাবের, ইমদাদুল হক মিলন, ইমতিয়ার শামীম, সাদ কামালী, হরিপদ দত্ত, নাসরীন জাহান, আনিসুল হক, হারুণ হাবিব, জাকির তালুকদার, আহমদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, শাহনাজ মুন্নী, শাহীন আখতার প্রমুখ। বিশেষভাবে এখানে উল্লেখ করতে চাই শহীদুল জহিরের কথা। উপন্যাস রচনার নিজস্ব শৈলী চমৎকারভাবে আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সমকালের নগরজীবনের সংকীর্ণ পরিবেশে কীভাবে উত্তর-উপনিবেশবাদী সমাজের আর্ত-দীর্ণ চরিত্রগুলো জীবনযাপন করে, তার উপন্যাসে পাওয়া যায় এই জীবনের অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। সামগ্রিকভাবে উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও উত্তর-উপনিবেশের বহুমাত্রিক বিষয় মূর্ত হয়েছে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের রচনায় আর তা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ডিসকোর্স বা বয়ান। তবে এই সাফল্য সত্ত্বেও উত্তর-উপনিবেশবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ই এখনও তাদের রচনায় অনুক্ত থেকে গেছে। কিছু কিছু প্রসঙ্গ স্থানাভাবের কারণে বর্তমান প্রবন্ধে উল্লেখ করা সম্ভবপর হয়নি, বিশেষ করে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে যে অগণতান্ত্রিক অপশাসন, সামরিকায়ন, দুর্নীতি, লুণ্ঠন, আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, বিশ্বায়ন প্রভাবিত আর্থব্যবস্থা, বৈদেশিক ঋণ, মৌলবাদের উত্থান ইত্যাদি প্রসঙ্গ বাংলাদেশের উপন্যাসে কীভাবে উপজীব্য হয়েছে, তা বিবেচনা করে দেখা জরুরি।
৬.
সমকালীন ইউরো-মার্কিন বয়ানে উত্তর-উপনিবেশবাদকে তৃতীয় বিশ্বের নিজেদের সৃষ্ট সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হয়। যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো একসময় উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর সেই আশা-আকাক্সক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয়নি। অপশাসন, অগণতান্ত্রিকতা, সামরিকায়ন, আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক ঋণ ও পরনির্ভরশীলতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের নির্বিচার লুণ্ঠন, ব্যাপক প্রকাশ্য দুর্নীতি, সশস্ত্র মৌলবাদের আস্ফালন ও উত্থান এই দেশগুলোর সাধারণ মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়; রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মধ্যে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যের হাতে নিহত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানকে, আবদুর রাজ্জাক যাকে উল্লেখ করেছিলেন ‘আমাদের যুগের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব’ বলে (রাজ্জাক ২০০১ : ৪৪)।২ সেই শুরু, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নভঙ্গ আর সামরিকায়নের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ গণতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে মৌলবাদের দিকে ঝুকে পড়ে। বৃহত্তর বৈশ্বিক পরিসরে প্রকাশ্যে ইসলাম কিন্তু সংগোপনে লাদেনীয় রাষ্ট্রদর্শনের অনুকরণে মৌলবাদী রাষ্ট্রের (যেমনটা দেখা গিয়েছিল আফগানিস্তানে) স্বপ্নে বাংলাদেশের অনেক তরুণ এখন বিভ্রান্ত, ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে সশস্ত্র রাষ্ট্রবিপ্লবের। এ হলো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের সংকটের একটা দিক। অন্য আরেকটি দিকও ভয়াবহ আর মারাত্মক। দ্বিমেরু পৃথিবীর অবসানের পর এককেন্দ্রিক মার্কিন পরাশক্তির প্রভাবে বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক শ্রেণী শাসকদের সহায়তায় বাংলাদেশের সীমিত সম্পদকে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে তৎপর। জনগণের সম্পদ ও জীবনকে এদেশের উত্তর-উপনিবেশবাদী শাসকেরা কখনই গুরুত্ব দেয়নি, একারণেই ঘটতে পেরেছে ফুলবাড়ির মতো ঘটনা। সাধারণ মানুষের জীবনমানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের দীর্ঘকালের যে দ্বন্দ্ব তারও অবসান ঘটেনি। এমনকি একই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে বাঙালিরা নিজেদের ‘মূলধারা’র অংশ মনে করে তাদের ‘প্রান্তিক’ বলে বিবেচনা করে। কিন্তু পাহাড়িদের ক্ষেত্রে প্রান্তিকতার ব্যবহার যে ভুল, বিভ্রান্তিকর ও আধিপত্যবাদী, সাধারণ বাঙালিরা তা বুঝতেই পারে না। এ রকম নানা অসঙ্গতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
ব্যক্তি ও জনজীবনের ছোট ছোট পরিসরে প্রতিদিন আরও ঘটছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নানা ঘটনা। পারিবারিক বলয়ে নারী শিকার হচ্ছে ফতোয়ার, প্রকাশ্যে বাড়ছে বোরখার ব্যবহার, ক্ষুদ্র চাষিরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করে কমিয়ে ফেলছে জমির স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক উর্বরতার ক্ষমতা, লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশবান্ধব বীজ, ক্ষুদ্র ঋণের নামে সর্বশান্ত হচ্ছে অনেক মানুষ, বৈশ্বিক উন্নয়নের জোয়ারে প্রকৃতি থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য, ইন্টারনেটের যৌনজগতে বিচরণ বাড়ছে তরুণ-তরুণীদের, নাগরিক ব্যক্তিজীবনও অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে, বাড়ছে দাম্পত্য টানাপোড়েন। এর সবই ঘটছে উত্তর-উপনিবেশবাদী বাংলাদেশ রাষ্ট্র নতুন চেহারায় আবির্ভুত হয়েছে বলে। প্রত্যাশার কথা, শাসকবর্গ ও লুম্পেনশ্রেণী যে পথেই অগ্রসর হোক না কেন, এখনও একশ্রেণীর তারুণ্য প্রতিরোধের প্রেরণায় প্রদীপ্ত। সচেতন এই তরুণেরাই বুকে পুষে রেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আকাক্সক্ষা, নতুন এক আধুনিক বিজ্ঞানধর্মী বাংলাদেশের স্বপ্ন।
তো এই স্বপ্ন শুধু তরুণদেরই নয়, সৃজনশীল লেখকদেরও দেখতে হবে, দেখাতে হবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে চোরাস্রোতের মতো উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রের ভেতর ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে যে অসংগতি তাকে দেখার ও দেখাবার দায়িত্ব তো তাদেরই। কিন্তু সমকালের ক-জন ঔপন্যাসিক এই কাজটি করতে পেরেছেন বা করছেন? লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর কীভাবে পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশ, শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও সংকট, তার কোনো সৃজনী বয়ান রচনায় উৎসাহী হতে দেখা যায়নি বাংলাদেশের কোনো ঔপন্যাসিককে। একইভাবে বাংলাদেশের উপন্যাসে আজও উপজীব্য হয়নি বিশ্বায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।৩ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, যা এখন আরও সম্প্রসারিত হয়েছে বৈশ্বিক পটে, কেউ কি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন কোনো উপন্যাস?৪ লেখা হয়েছে কি ফুলবাড়ি বা সম্পদলুণ্ঠনের কোনো বয়ান? বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের ঔপন্যাসিকদের দৃষ্টি রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে যতটা প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে যতটা ধারণা থাকা দরকার, তা তাদের অধিকাংশেরই নেই; যেমনটা ছিল শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও শহীদুল জহিরের।
আমাদের নিশ্চয়ই আর বেশিদিন এরকম ঔপন্যাসিকের অপেক্ষায় থাকতে হবে না?
টীকা
১ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তাই উল্লেখ করছি, উপনিবেশবিরোধী মুক্তিসংগ্রামের ভুবনখ্যাত ভাবুক ফ্রানৎস ফানোঁ নিজেও নারীমুক্তির কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন : If we want to destroy the structure of Algerian Society, its capacity for resistance, we must first of all conquer the women; we must go and find them behind the veil where they hide themselves and in the houses where the men keep them out of sight. It is the situation of woman that was accordingly taken as the theme of action. The dominant administration solemnly undertook to defend this woman, pictured as humiliated, sequestered, cloistered…transformed by the Algerian man into an inert, demonetized, indeed dehumanized object…After it had been posited that the woman constituted the pivot of Algerian society, all efforts were made to obtain control over her. (Fanon 1989: 37-38)
২ আবদুর রাজ্জাক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা হিসেবে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা এরকম : “(স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে) ওই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোকে যে কোটি কোটি জনতা, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক (রাজ্জাক ২০০১ : ৪৫)।”
৩ এ বিষয়টির কিছুটা প্রভাব পড়েছে যে উপন্যাসে সেটি ইংরেজি ভাষায় লেখা মনিকা আলীর ব্রিক লেন।
৪ জাকির তালুকদারের মুসলমানমঙ্গল প্রাসঙ্গিক এই বিষয়টিকে ছুঁয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র
ইলিয়াস, আখতারুজ্জামান (২০০৩) ‘আহমদ ছফার উপন্যাস’, অগ্রন্থিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ঢাকা : ঐতিহ্য।
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ (১৩৯৮) ‘কবি য়েট্স’, পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খ-, কলিকাতা : বিশ্বভারতী।
রাজ্জাক, আবদুর (২০০১), বাংলাদেশ জাতির অবস্থা, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ।
Amin, Shahid (1995) Event, Metaphor, Memory, Chauri Chaura 1922-1992, Delhi: Oxford University Press.Bozzoli, B. and Delius, P. (1990) ‘Radical History and South African Society’, Radical History Review 46/47: pp. 13-45.Chakrabarty, Dipesh (1992) ‘Postcoloniality and the Artifice of History, Who Speaks for Indian Pasts?’, Representations 37 Winter: pp. 1-24.Fanon, Frantz (1963) The Wretched of the Earth, trans. C. Farrington, New York: Grove Press.___ (1989) Studies in a Dying Colonialism trans. H. Chevalier, London: Earthscan Publications Ltd.Guha, Ranajit (1982) ‘On Some Aspects of the Historiography of Colonial India’, in Ranajit Guha (ed.) Subaltern Studies, vol. 1, New Delhi: Oxford University Press, pp. 1-8.Jameson, Frederic (1986) ‘Third World Literature in the Era of Multinational Capitalism’, Social Text 15, Fall: pp. 65-88.Kymlicka, Will and Christine Straehle (1999) ‘Cosmopolitanism, Nation-States, and Minority Nationalism: A Critical Review of Recent Literature’, European Journal of Philosophy 7:1, pp. 65–88.
Van Schendel, Willem (2009) A History of
Bangladesh, Cambridge: Cambridge University Press.
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ (১৩৯৮) ‘কবি য়েট্স’, পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খ-, কলিকাতা : বিশ্বভারতী।
রাজ্জাক, আবদুর (২০০১), বাংলাদেশ জাতির অবস্থা, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ।
Amin, Shahid (1995) Event, Metaphor, Memory, Chauri Chaura 1922-1992, Delhi: Oxford University Press.Bozzoli, B. and Delius, P. (1990) ‘Radical History and South African Society’, Radical History Review 46/47: pp. 13-45.Chakrabarty, Dipesh (1992) ‘Postcoloniality and the Artifice of History, Who Speaks for Indian Pasts?’, Representations 37 Winter: pp. 1-24.Fanon, Frantz (1963) The Wretched of the Earth, trans. C. Farrington, New York: Grove Press.___ (1989) Studies in a Dying Colonialism trans. H. Chevalier, London: Earthscan Publications Ltd.Guha, Ranajit (1982) ‘On Some Aspects of the Historiography of Colonial India’, in Ranajit Guha (ed.) Subaltern Studies, vol. 1, New Delhi: Oxford University Press, pp. 1-8.Jameson, Frederic (1986) ‘Third World Literature in the Era of Multinational Capitalism’, Social Text 15, Fall: pp. 65-88.Kymlicka, Will and Christine Straehle (1999) ‘Cosmopolitanism, Nation-States, and Minority Nationalism: A Critical Review of Recent Literature’, European Journal of Philosophy 7:1, pp. 65–88.
![]() |
ক্যাপশন যুক্ত করুন |
অনুবাদক পরিচিতি
মাসুদুজ্জামান
পিএইচডি
অধ্যাপক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
সর্বশেষ প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :
প্রবন্ধ--
কাফকার প্রেম [অবসর প্রকশনী],
অনুবাদ--
অধ্যাপক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
সর্বশেষ প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :
প্রবন্ধ--
কাফকার প্রেম [অবসর প্রকশনী],
নারী যৌনতা রাজনীতি [বেঙ্গল পাবলিকেসন্স]
দেবদূত পুরুষ ও যৌনরাজনীতি [শুদ্ধস্বর প্রকাশনী],
অনুবাদ--
টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা । আত্মস্মৃতি সাক্ষাৎকার [অঙ্কুর প্রকাশনী]
0 মন্তব্যসমূহ