অভিনয় একধরনের মুখোশ উপস্থাপন। সুনিপুনভাবে মুখোশই উপস্থাপন। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তার একটা মুখোশ আছে, অন্য সমাজে, বা আমাদের কাছে। অভিনেতারা সেই মুখোশের ভেতরে প্রবেশ করেন, মুখোশের চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলেন।
সব প্রাণীর একটা মুখোশ আমরা যোগাড় করতে পারি, কেবল একটাই পারি। তার মানে গরু কিংবা গাধা, এমনকি বাঘ, কোনোদিন অন্য কোনো প্রাণীর হতে চেয়েছে বলে মনে হয় না। বরং আরো বেশি গরু, আরো বেশি গাধা, আরো বেশি বাঘ হতে চেয়েছে, পেরেছে। সব মিলিয়ে গরু একটা, গাধা একটা, বাঘও একটা। কিন্তু মানুষ? মানুষ কত কি না হতে চেয়েছে, কেবল...। তবে মানুষ শুধু মুখোশ নয়, চরিত্রও হতে চেয়েছে।
ইউজিন আইনেস্কো’র ‘দ্য রাইনোসরাস’ নাটক দেখছিলাম একদিন, শিল্পকলা একাডেমির আলো-আঁধারি গ্যালারিতে বসে। শহরের মানুষগুলো সব গণ্ডার হয়ে যাচ্ছে, একে একে। কাছের বন্ধু-বান্ধব, এমনকি প্রিয়তম প্রেমিকাও। কী দুঃসহ! কিন্তু গণ্ডার হলে হবে কি, মঞ্চে কোনো গণ্ডার আসেনি। ওরা অভিনয় করে না যে। সত্যি গণ্ডার। সব গণ্ডারের চামড়ার ভেতর অভিনেতারাই গণ্ডার। গণ্ডার মারতে হঠাৎ ইচ্ছে করছিল আমার। গ্যালারির আবছা অন্ধকারে বসে উসখুস হচ্ছিল। পরে মনে হলো, আমি তখন মানুষ ছিলাম না। তবে কী?
মেটাল মরিসলিংকের ‘নীলপাখি’ নাটকে- ও মা, নীলপাখি দেখি মানুষ। একে খোঁজে সবাই। লালন ফকির খোঁজেন অচেনারে, যাবে আপনারে চেনা। যার আপন খবর, আপনার হয় না...। আবার দেখেছি, মানুষ প্রজাপতি হয়ে উঠছে। আর আমি, একটা খ্যাপাটে কুকুরের মতো প্রজাপতি ধরতে চাইছি। খাঁচা পুরে দেখব? তা হয় তো নয়। খাব? প্রজাপতি, আমার পেট ভরবে কি না ভাবিনি তো। ধরতে ইচ্ছে হয়ে ছিল খুব। স্বভাব কবি গান-
‘কত ভাবে বিরাজিছ বিশ্ব মাজারে
মত্ত এ চিত তবু তর্ক বিচারে...’
আহা, একই অঙ্গে কত রূপ। কোথায় এতো রূপ? কবি বলেন- পাখির নীড়ের মতো চোখ বা পটল ছেড়া নয়ন বা পদ্ম লোচন। চাঁদের মতো মুখ, চিচিংগার মতো লকলকে বাহু, ঢেঁরসের মতো আঙুল, গোলাপের মতো ঠোঁট। এসব তো রিনির নেই, আমার নেই। কোথায় সে সব? দুইহাতে অফিসের কলম পিসে চলেছি, চোখ কখনো ছানাবড়া হয়ে যায়, ঝাপসা দেখি। ঠোঁট ফাঁক হলে দুইপাটি দাঁতের ভেতর জিহ্বা পল্টি খায়। মুখে যা বলি, তা তো ওই একান্ত বলার বলেই বলি। অভিনয়ের কিছু নেই। হাতে পয়সা নেই, পারিবারিক সংকট, যখন-তখন চাকুরি হারানো ভয়-মুখটা তাই কালো, বা ফ্যাকাশে। কাছের কেউ মরে গেছে শুনলে-চোখে জল গড়ায়, বিহ্বল হই, অন্তত কিছু সময় তো বটেই। নিজের হাত দেখি, আঙুল দেখি। শুনেছি, আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়। ফার্মগেটে যে গোদ রোগি প্রতিদিন তার মোটা হাতটা দেখিয়ে ভিক্ষে করে, সে কি তবে?
হয় বৈকি। অফিসের বস, শুনেছি তার আঙুল ফুলে কলাগাছ, আমি তার আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখেছি অনেক দিন। বলেন-আপনি একটা আস্ত গাধা। ছাগল কোথাকার। সেই মাত্র অনুভব করি, মুখোশ না পড়েও গাধা-ছাগল থাকে। তাহলে আর মঞ্চে গণ্ডার, পাখির মুখোশ পড়া কেন? অফিসে আমার ইনচার্চ বলেন- আপনি একটা মেরুদণ্ডহীন প্রাণী। কেঁচো কি? তিনি বলেননি। তেলাপোকা, গ্রেগর সামসার মতো? তাও বলেননি। সেই ছাত্র জীবনে পড়েছিলাম কাফকার ‘মেটামরফোসিস’। তখন বুঝিনি।
মাঝে মধ্যে রিনি বলে-তুমি একটা কাপুরুষ। আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও লাইফ ইন্স্যুরেন্সের রিস্কটুকু নিতে চাও না। তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছো। কই! কোথায়?
স্কুল বেলায়, বর্ষায় বুক সমান জল ভেঙে রাকিবদের বাড়ির উঠোনে, অনেকের সঙ্গে উঠোনে দাঁড়িয়ে আমি আর সাধন, শুক্রবারের সিনেমা দেখছিলাম। দস্যুটা নায়কের ছোট বোনকে ধর্ষণ করে, অনেক ক্ষণ ধরে করে। আমি নাবালক শিশ্নটা দুই থোড়ার চিপায় ফেলে দেখছিলাম তা। উপভোগ্য। কই তেমন তো রিনির সঙ্গে কখনো করিনি। রাকিব আমাকে সেদিন পাড়ার ছেলের পরিচয়টুকুও দেয়নি। ওর বড় বোন, সাবিয়া আপা, আমাদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাস করে। দরজার চিপায় পরে সাধনের বাম হাতের বৃদ্ধাঙুল গেল ফেটে। সাধন চিৎকার করে কেঁদে ওঠলে সাবিয়া আপা কেবল ওকে ঘরের ভেতরে নেয়। সবার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন আবার। আমি আর সাধন একসাথে ফিরি। সাধন আমার কথা বলেছিল, তাই আমাকেও ভেতরে টেনে নিলেন। একে একে খালি হয়ে যায় উঠোন। ভেতরের মানুষদের সঙ্গে গাদাগাদি করে দেখলাম-নায়ক তার ছোট বোনের ইজ্জত নষ্ট করা প্রতিশোধ নিলো। কী বেধড়ক পেটানোটাই না পেটালো দস্যু আর তার সাঙ্গদের। নায়কোচিত ভাবে। আমরাও দেখলাম, বিরোচিত অনুভূতিতে। প্রতিশোধ নিলাম, সেও উপভোগ্য দারুন। কই তেমনটা তো রিনি কখনো বলেনি, কেউ তার ইজ্জত নষ্ট করেছে। বললে কি আর প্রতিশোধ নিতাম না? নিতাম, অবশ্যই নিতাম। কি নিতাম? জানি না। পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি রিনির-ছেলে ভাদাইম্যা, বেকার, তাই; বলেছিলেন রিনির বড় ভাই, এই কথা।
সেদিন ঘরের ভেতর আমাকে আর সাধনকে একটা জলচোকি দিয়েছিল, ভাগাভাগি করে বসার জন্য। আর আমাদের হাতে দিয়ে ছিল, বাড়িতে বানানো ঝোলাগুড়ে পাক দেয়া মুড়ির মোয়া। আসার সময় সাবিয়া আপা আগবাড়িয়ে বলেছিলেন-তোমরা আবার এসো, কিছু মনে করো না, হ্যাঁ। আমি সাধনকে বলে ছিলাম-তুই একটা বেশরম।
শরম আমার আছে। তাই রিনির বাবার বাড়ির অনেক অনুষ্ঠানে আমি যাই না।
রিনি একদিন, চোখে দুঃখ-আক্ষেপের দাগ ফুটিয়ে বলেছিল-কী হয়েছে, তোমার কি কোনো সমস্যা? শান্ত-শীতল নদীর মতো আমরা। রিনি ঢেউ চায়। যদি কূল ভাঙে, পাড়ের বসতি হারিয়ে যায়? তবু চায়। দু’তিনটা বলশালীকরন ট্যাবলেট খেয়ে রিনির নদীতে নৌকা চালাই। দাঁড় টানি রাতভর। সকাল গড়িয়ে রিনি ঘুম থেকে ওঠে, ভরকে যাওয়া চেহারায় বলে-তুমি একটা জানোয়ার, আস্ত জানোয়ার।
অনেকে নায়ক হতে চায়, অনেকে ভিলেন। মানুষ আধার হতে চায়, আধেয়ও হতে চায়। ‘ঘুনাই বিবি’ যাত্রায় মঙ্গল দা’ ভিলেনের হয়ে ছিলেন। পুরো মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করতেন মঙ্গল দা’। তিনি যখন ঘুনাইকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন তখন দর্শকরা তিনদিক থেকে জুতা ছুড়ে ছিল। জোড়া ভাঙ্গা জুতায় ভরে ওঠেছিল মঞ্চ, তার আশপাশ। মঙ্গল দা’ একটা জুতা কপালে ঠেকিয়ে বলে ছিলেন-এটা জুতা না, আমার আশির্বাদ, আমার অভিনয় জীবনের সেরা পাওয়া। আমি অন্তত অভিনয় দিয়ে আপনাদের মনে ঘৃণার উদ্বেক ঘটাতে পেরেছি। এ আমার পুরস্কার। আমার পুরস্কার।
মঙ্গল দা’ এখন বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। মঙ্গল দা’কে কেউ মনে প্রাণে সত্যি ঘৃণা করেনি? করেনি সেদিন?
লেইস-ফিতা-হরেক মালের ফেরিওয়ালারা আসতো আমাদের গ্রামে, আমাদের হাটি বাড়িতে। ডালা বিছিয়ে বসতো উঠোনে। আমার আপা, চাচাতো বোনেরা, পরশি খালামনি-সবাই যুবতী তখন, ঘিরে বসতো ফেরিওয়ালাকে। ওরা কিনতো আর হাসাহাসি করতো। নানান কিছু কিনতো ওরা-চুলের ফিতা, ক্লিপ, পাতা ধরে টিপ, আয়না-চিরুনি, স্নো, পাউডার। শুধু ব্রা কিনতো আমাকে আড়াল করে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম, পাশে। বলতো, তুই কি নিবি? আমাকে কাঁচ বসানো টিনের আঙটি কিনে দিয়েছিল, দুই টাকা দিয়ে। আঙটির কাঁচের নিচে হলুদ কাগজে লেখাছিল-সাথী। আমি আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতাম। অনায়ত্ব-অনিশ্চিত স্বপ্নের খুশিতে, কাদা-জলে খলসে মাছের মতো খলবলিয়ে উঠতো মন, হাসতাম নিজে নিজে। আঙটিটা একদিন বাঁকা হয়ে কেমন কামড়ে ধরেছিল আমার আঙুল, সেই ছোট বেলায়। আমি কাঁদ ছিলাম, ভ্যাত ভ্যাত করে কাঁদ ছিলাম। আমার চাচাত ভাই নজরুল, তখন মাঠ থেকে ফিরেছেন মাত্র। মাথা থেকে ঘাসের বোঝা নামিয়ে, ধারালো কাস্তে দিয়ে আঙটি কেটে আঙুল মুক্ত করেছিল। আমার হাতে লেগে গিয়েছিল কাঁচা ঘাসের গন্ধ। নজরুল ভাই বিহ্বল স্বরে বলেছিলেন, এই আঙটি তোর হাতে আটকে গেল কেন জানিস? আমি বলেছিলাম, না। ‘কারণ তোকে তোর বউ অনেক কষ্ট দিবে’-বলেছিলেন রহস্যের হাসি হেসে। তারপর অনেক দিন, এই ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আবার জাগলো।
আবার জাগলো আমার কিছু হতে না পারি মাঝে, তা-কি রোদ, কি অফিসের কর্মকর্তা। অথচ আমার কিছুই হওয়ার কথা ছিল না। কিচ্ছু হওয়ার কথা ছিল না। অথচ এখন একটা পাকা বাড়িতে থাকি, রীতিমতো ফ্ল্যাট। অফিসার নই, তবু একটা ভাল বেতনে চাকুরি করি। তাই জীবন বদল করি না। এভাবে আরো দূর যাওয়া যাবে হয়তো। মুখোশ পড়লে আরো দ্রুত। কিন্তু মুখোশেই আমার আলস্য। একথা রিনিকে বলি, অফিসকে বলি, সবাইকে বলি-আমি মুখোশে আমার আলস্য।
কবি বলেন-
‘মুখের কথা একলা হয়ে
রইলো পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।’
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি নিম্নবর্গের মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। ঢাকা কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।
alatehasan@yahoo.com, +88 01714 784 385
সব প্রাণীর একটা মুখোশ আমরা যোগাড় করতে পারি, কেবল একটাই পারি। তার মানে গরু কিংবা গাধা, এমনকি বাঘ, কোনোদিন অন্য কোনো প্রাণীর হতে চেয়েছে বলে মনে হয় না। বরং আরো বেশি গরু, আরো বেশি গাধা, আরো বেশি বাঘ হতে চেয়েছে, পেরেছে। সব মিলিয়ে গরু একটা, গাধা একটা, বাঘও একটা। কিন্তু মানুষ? মানুষ কত কি না হতে চেয়েছে, কেবল...। তবে মানুষ শুধু মুখোশ নয়, চরিত্রও হতে চেয়েছে।
ইউজিন আইনেস্কো’র ‘দ্য রাইনোসরাস’ নাটক দেখছিলাম একদিন, শিল্পকলা একাডেমির আলো-আঁধারি গ্যালারিতে বসে। শহরের মানুষগুলো সব গণ্ডার হয়ে যাচ্ছে, একে একে। কাছের বন্ধু-বান্ধব, এমনকি প্রিয়তম প্রেমিকাও। কী দুঃসহ! কিন্তু গণ্ডার হলে হবে কি, মঞ্চে কোনো গণ্ডার আসেনি। ওরা অভিনয় করে না যে। সত্যি গণ্ডার। সব গণ্ডারের চামড়ার ভেতর অভিনেতারাই গণ্ডার। গণ্ডার মারতে হঠাৎ ইচ্ছে করছিল আমার। গ্যালারির আবছা অন্ধকারে বসে উসখুস হচ্ছিল। পরে মনে হলো, আমি তখন মানুষ ছিলাম না। তবে কী?
মেটাল মরিসলিংকের ‘নীলপাখি’ নাটকে- ও মা, নীলপাখি দেখি মানুষ। একে খোঁজে সবাই। লালন ফকির খোঁজেন অচেনারে, যাবে আপনারে চেনা। যার আপন খবর, আপনার হয় না...। আবার দেখেছি, মানুষ প্রজাপতি হয়ে উঠছে। আর আমি, একটা খ্যাপাটে কুকুরের মতো প্রজাপতি ধরতে চাইছি। খাঁচা পুরে দেখব? তা হয় তো নয়। খাব? প্রজাপতি, আমার পেট ভরবে কি না ভাবিনি তো। ধরতে ইচ্ছে হয়ে ছিল খুব। স্বভাব কবি গান-
‘কত ভাবে বিরাজিছ বিশ্ব মাজারে
মত্ত এ চিত তবু তর্ক বিচারে...’
আহা, একই অঙ্গে কত রূপ। কোথায় এতো রূপ? কবি বলেন- পাখির নীড়ের মতো চোখ বা পটল ছেড়া নয়ন বা পদ্ম লোচন। চাঁদের মতো মুখ, চিচিংগার মতো লকলকে বাহু, ঢেঁরসের মতো আঙুল, গোলাপের মতো ঠোঁট। এসব তো রিনির নেই, আমার নেই। কোথায় সে সব? দুইহাতে অফিসের কলম পিসে চলেছি, চোখ কখনো ছানাবড়া হয়ে যায়, ঝাপসা দেখি। ঠোঁট ফাঁক হলে দুইপাটি দাঁতের ভেতর জিহ্বা পল্টি খায়। মুখে যা বলি, তা তো ওই একান্ত বলার বলেই বলি। অভিনয়ের কিছু নেই। হাতে পয়সা নেই, পারিবারিক সংকট, যখন-তখন চাকুরি হারানো ভয়-মুখটা তাই কালো, বা ফ্যাকাশে। কাছের কেউ মরে গেছে শুনলে-চোখে জল গড়ায়, বিহ্বল হই, অন্তত কিছু সময় তো বটেই। নিজের হাত দেখি, আঙুল দেখি। শুনেছি, আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়। ফার্মগেটে যে গোদ রোগি প্রতিদিন তার মোটা হাতটা দেখিয়ে ভিক্ষে করে, সে কি তবে?
হয় বৈকি। অফিসের বস, শুনেছি তার আঙুল ফুলে কলাগাছ, আমি তার আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখেছি অনেক দিন। বলেন-আপনি একটা আস্ত গাধা। ছাগল কোথাকার। সেই মাত্র অনুভব করি, মুখোশ না পড়েও গাধা-ছাগল থাকে। তাহলে আর মঞ্চে গণ্ডার, পাখির মুখোশ পড়া কেন? অফিসে আমার ইনচার্চ বলেন- আপনি একটা মেরুদণ্ডহীন প্রাণী। কেঁচো কি? তিনি বলেননি। তেলাপোকা, গ্রেগর সামসার মতো? তাও বলেননি। সেই ছাত্র জীবনে পড়েছিলাম কাফকার ‘মেটামরফোসিস’। তখন বুঝিনি।
মাঝে মধ্যে রিনি বলে-তুমি একটা কাপুরুষ। আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও লাইফ ইন্স্যুরেন্সের রিস্কটুকু নিতে চাও না। তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছো। কই! কোথায়?
স্কুল বেলায়, বর্ষায় বুক সমান জল ভেঙে রাকিবদের বাড়ির উঠোনে, অনেকের সঙ্গে উঠোনে দাঁড়িয়ে আমি আর সাধন, শুক্রবারের সিনেমা দেখছিলাম। দস্যুটা নায়কের ছোট বোনকে ধর্ষণ করে, অনেক ক্ষণ ধরে করে। আমি নাবালক শিশ্নটা দুই থোড়ার চিপায় ফেলে দেখছিলাম তা। উপভোগ্য। কই তেমন তো রিনির সঙ্গে কখনো করিনি। রাকিব আমাকে সেদিন পাড়ার ছেলের পরিচয়টুকুও দেয়নি। ওর বড় বোন, সাবিয়া আপা, আমাদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাস করে। দরজার চিপায় পরে সাধনের বাম হাতের বৃদ্ধাঙুল গেল ফেটে। সাধন চিৎকার করে কেঁদে ওঠলে সাবিয়া আপা কেবল ওকে ঘরের ভেতরে নেয়। সবার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন আবার। আমি আর সাধন একসাথে ফিরি। সাধন আমার কথা বলেছিল, তাই আমাকেও ভেতরে টেনে নিলেন। একে একে খালি হয়ে যায় উঠোন। ভেতরের মানুষদের সঙ্গে গাদাগাদি করে দেখলাম-নায়ক তার ছোট বোনের ইজ্জত নষ্ট করা প্রতিশোধ নিলো। কী বেধড়ক পেটানোটাই না পেটালো দস্যু আর তার সাঙ্গদের। নায়কোচিত ভাবে। আমরাও দেখলাম, বিরোচিত অনুভূতিতে। প্রতিশোধ নিলাম, সেও উপভোগ্য দারুন। কই তেমনটা তো রিনি কখনো বলেনি, কেউ তার ইজ্জত নষ্ট করেছে। বললে কি আর প্রতিশোধ নিতাম না? নিতাম, অবশ্যই নিতাম। কি নিতাম? জানি না। পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি রিনির-ছেলে ভাদাইম্যা, বেকার, তাই; বলেছিলেন রিনির বড় ভাই, এই কথা।
সেদিন ঘরের ভেতর আমাকে আর সাধনকে একটা জলচোকি দিয়েছিল, ভাগাভাগি করে বসার জন্য। আর আমাদের হাতে দিয়ে ছিল, বাড়িতে বানানো ঝোলাগুড়ে পাক দেয়া মুড়ির মোয়া। আসার সময় সাবিয়া আপা আগবাড়িয়ে বলেছিলেন-তোমরা আবার এসো, কিছু মনে করো না, হ্যাঁ। আমি সাধনকে বলে ছিলাম-তুই একটা বেশরম।
শরম আমার আছে। তাই রিনির বাবার বাড়ির অনেক অনুষ্ঠানে আমি যাই না।
রিনি একদিন, চোখে দুঃখ-আক্ষেপের দাগ ফুটিয়ে বলেছিল-কী হয়েছে, তোমার কি কোনো সমস্যা? শান্ত-শীতল নদীর মতো আমরা। রিনি ঢেউ চায়। যদি কূল ভাঙে, পাড়ের বসতি হারিয়ে যায়? তবু চায়। দু’তিনটা বলশালীকরন ট্যাবলেট খেয়ে রিনির নদীতে নৌকা চালাই। দাঁড় টানি রাতভর। সকাল গড়িয়ে রিনি ঘুম থেকে ওঠে, ভরকে যাওয়া চেহারায় বলে-তুমি একটা জানোয়ার, আস্ত জানোয়ার।
অনেকে নায়ক হতে চায়, অনেকে ভিলেন। মানুষ আধার হতে চায়, আধেয়ও হতে চায়। ‘ঘুনাই বিবি’ যাত্রায় মঙ্গল দা’ ভিলেনের হয়ে ছিলেন। পুরো মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করতেন মঙ্গল দা’। তিনি যখন ঘুনাইকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন তখন দর্শকরা তিনদিক থেকে জুতা ছুড়ে ছিল। জোড়া ভাঙ্গা জুতায় ভরে ওঠেছিল মঞ্চ, তার আশপাশ। মঙ্গল দা’ একটা জুতা কপালে ঠেকিয়ে বলে ছিলেন-এটা জুতা না, আমার আশির্বাদ, আমার অভিনয় জীবনের সেরা পাওয়া। আমি অন্তত অভিনয় দিয়ে আপনাদের মনে ঘৃণার উদ্বেক ঘটাতে পেরেছি। এ আমার পুরস্কার। আমার পুরস্কার।
মঙ্গল দা’ এখন বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। মঙ্গল দা’কে কেউ মনে প্রাণে সত্যি ঘৃণা করেনি? করেনি সেদিন?
লেইস-ফিতা-হরেক মালের ফেরিওয়ালারা আসতো আমাদের গ্রামে, আমাদের হাটি বাড়িতে। ডালা বিছিয়ে বসতো উঠোনে। আমার আপা, চাচাতো বোনেরা, পরশি খালামনি-সবাই যুবতী তখন, ঘিরে বসতো ফেরিওয়ালাকে। ওরা কিনতো আর হাসাহাসি করতো। নানান কিছু কিনতো ওরা-চুলের ফিতা, ক্লিপ, পাতা ধরে টিপ, আয়না-চিরুনি, স্নো, পাউডার। শুধু ব্রা কিনতো আমাকে আড়াল করে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম, পাশে। বলতো, তুই কি নিবি? আমাকে কাঁচ বসানো টিনের আঙটি কিনে দিয়েছিল, দুই টাকা দিয়ে। আঙটির কাঁচের নিচে হলুদ কাগজে লেখাছিল-সাথী। আমি আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতাম। অনায়ত্ব-অনিশ্চিত স্বপ্নের খুশিতে, কাদা-জলে খলসে মাছের মতো খলবলিয়ে উঠতো মন, হাসতাম নিজে নিজে। আঙটিটা একদিন বাঁকা হয়ে কেমন কামড়ে ধরেছিল আমার আঙুল, সেই ছোট বেলায়। আমি কাঁদ ছিলাম, ভ্যাত ভ্যাত করে কাঁদ ছিলাম। আমার চাচাত ভাই নজরুল, তখন মাঠ থেকে ফিরেছেন মাত্র। মাথা থেকে ঘাসের বোঝা নামিয়ে, ধারালো কাস্তে দিয়ে আঙটি কেটে আঙুল মুক্ত করেছিল। আমার হাতে লেগে গিয়েছিল কাঁচা ঘাসের গন্ধ। নজরুল ভাই বিহ্বল স্বরে বলেছিলেন, এই আঙটি তোর হাতে আটকে গেল কেন জানিস? আমি বলেছিলাম, না। ‘কারণ তোকে তোর বউ অনেক কষ্ট দিবে’-বলেছিলেন রহস্যের হাসি হেসে। তারপর অনেক দিন, এই ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আবার জাগলো।
আবার জাগলো আমার কিছু হতে না পারি মাঝে, তা-কি রোদ, কি অফিসের কর্মকর্তা। অথচ আমার কিছুই হওয়ার কথা ছিল না। কিচ্ছু হওয়ার কথা ছিল না। অথচ এখন একটা পাকা বাড়িতে থাকি, রীতিমতো ফ্ল্যাট। অফিসার নই, তবু একটা ভাল বেতনে চাকুরি করি। তাই জীবন বদল করি না। এভাবে আরো দূর যাওয়া যাবে হয়তো। মুখোশ পড়লে আরো দ্রুত। কিন্তু মুখোশেই আমার আলস্য। একথা রিনিকে বলি, অফিসকে বলি, সবাইকে বলি-আমি মুখোশে আমার আলস্য।
কবি বলেন-
‘মুখের কথা একলা হয়ে
রইলো পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।’
লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি নিম্নবর্গের মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। ঢাকা কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।
alatehasan@yahoo.com, +88 01714 784 385
1 মন্তব্যসমূহ
ভালো লেগেছে আপনার লেখা।।
উত্তরমুছুন