শোনা যায় প্রকাশকমহল আজকাল ছোটগল্প-সংকলন প্রকাশে বড় শীতল। কারণ গল্পের বইয়ের কাটতি কম, মানে পাঠক কম। অথচ গল্পের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ নাকি সর্বকালের এবং সর্বদেশের। ছোটগল্প তো আবার শুধু গল্প নয়, একটু বেশি কিছু। অর্থাৎ গল্প যখন, গল্পত্ব তো থাকবেই- বাস্তবিক হোক, কি মানসিক, সংঘটিত ঘটনাও থাকবে। তবে বেশি থাকবে ঘটনাটি দেখার বিশেষ কোণ, গল্পটি বলার বিশেষ ঢঙ, অন্তস’ পরিপার্শ্বের ওপর আলোকসম্পাতের বিশেষ বিন্যাস, এবং বহিস’ দূর-দর্শনের বিশেষ ব্যবসা (বিন্দুতে সিন্ধু শিশিরবক্ষে মহাকাশ)।
এ ছাড়াও আজকের দ্রুতগতি মানুষের বিচিত্রদৃক জীবনের যেহেতু অখণ্ড রূপের চেয়ে খণ্ডরূপই স্পষ্টতর, অধুনার যুগমানসের লক্ষণ হিসাবে যেহেতু ধারাবাহিকতার চেয়ে অভিনবত্বই প্রকটতর, সেহেতু এসবের সম্যক প্রতিফলনের জন্য ছোটগল্পেরই যোগ্যতম মাধ্যম হওয়ার কথা।
তবু ছোটগল্প কেন আজ তার স্বকালেই অনাদৃত? ঘরেতে পরবাসী? স্মর্তব্য যে গল্পের চারণভূমি সমগ্র বিশ্বে ব্যাপৃত হলেও জন্মভূমি ভারতবর্ষ। আবার বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের প্রথম সিদ্ধপুরুষ রবীন্দ্রনাথও (জ. ১৮৬১) ফরাসি সিদ্ধপুরুষ মোপাসাঁর (জ. ১৮৫০) প্রায় সমসাময়িক।
প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন, এ যুগে গল্প পড়বার :
‘এপিডেমিক থেকে মুক্ত শুধু নিরক্ষর লোক- যেমন বেরি-বেরি থেকে মুক্ত শুধু নিরন্ন লোক।
কিন’ একটু চোখ চেয়ে দেখলেই দেখা যায় যে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি সকল যুগেই মানুষের র্স্বপ্রধান মানসিক আহার হচ্ছে গল্প। পৃথিবীর অন্যান্য ভূ-ভাগের কথা ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ভারতবর্ষের অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায়, সে অতীত গল্পপ্রাণ। এ দেশে পুরাকালে যত গল্প বলা হয়েছে ও লেখা হয়েছে, অন্য কুত্রাপি তার তুলনা নেই। আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে বিশ্বে পরিচিত। কিন’ যুগ যুগ ধরে আমাদের ধর্মের বাহন হয়েছে, মুখ্যত গল্প। রামায়ণ মহাভারত বাদ দিলে হিন্দুধর্মের পনেরো আনা বাদ পড়ে যায়, আর জাতক বাদ দিলে বৌদ্ধধর্ম দর্শনের কচকচি মাত্র হয়ে ওঠে।
রামায়ণ, মহাভারত, জাতক ছাড়াও এ দেশে অসংখ্য গল্প আছে, যা সেকালে সাহিত্য বলেই গণ্য হত। এ দেশের যত কাব্যনাটকের মূলে আছে গল্প। তা ছাড়া আখ্যায়িকা ও কথা নামে দুটি বিপুল সাহিত্য সেকালে ছিল, এবং একালেও তার কতক অংশের সাক্ষাৎ মেলে। আখ্যায়িকাই বলো আর কথাই বলো, ও দুই হচ্ছে একই বস’…শুধু নাম আলাদা। ইংরাজি লজিকের ভাষায় যাকে বলে মবহঁং এক ংঢ়বপরবং আলাদা।…
এর থেকে স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভারতবর্ষের লৌকিক অলৌকিক সকল সাহিত্যের প্রাণ হচ্ছে কথা-সাহিত্য।
কথা-সাহিত্য এ দেশে বিলেত থেকে আমদানি-করা নূতন সাহিত্য নয়। বরং সত্য কথা এই যে, পুরাকালে ও সাহিত্য ভারতবর্ষে রচিত হয়ে, তারপর দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এককালে পঞ্চতন্ত্র ও জাতকের প্রচলন য়ুরোপের লোকসমাজে যে অতি বিস্তৃত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উপরন’ বহু পণ্ডিতের মতে আরব্য উপন্যাসের জন্মভূমিও হচ্ছে ভারতবর্ষ।
আজ যে আমরা সকলেই গল্প শুনতে চাই, তার কারণ এ প্রবৃত্তি আমরা আমাদের র্পূ্বপুরুষদের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি।’ (সবুজ পত্র, দশম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা ॥ পৌষ, ১৩৩৩)।
আসলে মানুষের ইতিহাস যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, তার গল্পও আরম্ভ হয়েছে সেদিন থেকে। শ্রমপর্বের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে অভিজ্ঞ করে তোলা এবং বিশ্রামপর্বে আনন্দ পরিবেশন করার দ্বৈত প্রেরণা থেকেই মনুষ্যজীবনে গল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। (স্মরণ করুন : মানবজীবনের আদিতে দিনভর অ্যাডামের মাটি কোপানো এবং ইভের কাপড় বানানোর শেষে সন্ধ্যার অবসরে সন্তানদের কাছে তাঁদের গল্প করার কথা)। পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং আনন্দলাভের প্রয়োজনে সব দেশের মানুষই মোটামুটি অভিন্ন ধারায় গল্প কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। প্রধান দুটি ধারা- নীতিশিক্ষা আর রূপকথার উপকরণও প্রায় একই রকম। সম্ভবত সকল গল্পের প্রথম নায়কও ছিল অভিন্ন- সূর্য। কারণ প্রাচীন মানুষকে সূর্য আলো দিয়ে নিরাপদ করতো, রোদ দিয়ে তার ফসল ফলাতো, তেজ দিয়ে ফল পাকাতো, বরফ গলাতো, মাছ ভাসাতো এবং আরও অনেক উপকার করতো।
গল্পসাহিত্যের ভাগ মোটামুটি তিনটি : ঋধনষব অথবা কথা, অহবপফড়ঃব বা আকর্ষণীয় ঘটনা এবং ঞধষব কিংবা আখ্যায়িকা। প্রথমটাতে ছোটগল্পের সঙ্কেত, দ্বিতীয়টাতে গল্পের আমেজ আর তৃতীয়টাতে উপন্যাসের আভাস। ঋধনষব বা কথা বহু পূর্বেই বিলুপ্ত। বিষ্ণুশর্মা বা ঈশপের মতো প্রাণী-নির্ভর কিংবা মানব-আশ্রয়ী নীতিধর্মী ছোট ছোট গল্পের রেওয়াজ আজ আর নেই। সে-বস’ বলতে গেলে উনিশ শতকের রুশ সাহিত্যের কথার জাদুকর ইভান ক্রাইলভের (ওাধহ কৎরষড়া) সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। কিন’ টেল্ বা আখ্যায়িকা বা কাহিনী এবং অ্যানিক্ডোট বা কিস্সা কিংবা কোনো বিশেষ ঘটনার বৃত্তান্ত ছোট গল্পের ছদ্মবেশে এখনও বিদ্যমান। তাই এ-দুটি প্রকরণ সম্বন্ধে ধারণাটা স্পষ্ট রাখা দরকার।
‘আখ্যায়িকা’ অতি পুরাতন কথাসাহিত্য এবং তা একাই জমিয়ে রেখেছে জাতক, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎ-সাগর, দশকুমার-চরিত, শুকসপ্ততি, আরব্য উপন্যাস (আল্ফ লায়লা), তার নবতর সংস্করণ পারস্য উপন্যাস (হাজার আফসানে), দেকামেরন এবং উপদেশাত্মক গল্পমালার বৃহত্তম ইয়োরোপীয় সংস্করণ গেস্তা রোমানোরাম (রোমানদের কার্যকলাপ) বা সংক্ষেপে গেস্তা, ক্যান্টারবেরি টেল্স, গায়গাঁতুয়া, পাঁতাগ্রুয়েল। সংকলিত এসব আখ্যান গল্পরসে টইটম্বুর এবং বৈচিত্র্যে জমজমাট। কিন’ খণ্ডতার মধ্যে অখণ্ডের হদিস এরা দেয় না। মানুষের সহজাত গল্প বলার প্রেরণা থেকেই এদের উদ্ভব। তাই সাধারণত কোনো ব্যঞ্জনা নিহিত থাকে না এদের বুনটে, পাওয়া যায় না ইঙ্গিতধর্মী একমুখিতা বা অনন্য কোনো মহামুহূর্ত। পাওয়া যায় বরং ঘটনাবহুল, এমনকি দ্বন্দ্ব-সংঘাতময়, শিথিল-পৃথুল উপন্যাসেরই জৌলুস। বর্ণিত নেতিধর্মী এবং ইতিধর্মী, এইসব চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই আখ্যায়িকা ছোট হলেও ছোট গল্প হয়ে ওঠে না; ভেজাল হিসাবে ছোটগল্পের দলে ভিড়ে গেলেও সহজেই ধরা পড়ে যায়।
কিন’ তেমন সহজে ধরা পড়ে না ‘অ্যানিকডোট’-নামক ছদ্মবেশী ছোটগল্প। কারণ সে জন্মগতভাবে ছোটগল্পেরই সহোদর। দুই ভাইয়ের মধ্যে ‘শর্ট স্টোরি’ যেন কবি-স্বভাবের দার্শনিক আর ‘অ্যানিকডোট’ যেন ব্যবহারিক স্বভাবের সাংসারিক। ‘ছোটগল্প’ গৃহী-সন্ন্যাসীও হতে পারে, কিন’ ‘বৃত্তান্ত’ নিতান্তই গৃহী। এই গৃহীটিকে চেনার প্রথম উপায়টি হল তার দ্ব্যর্থহীন অন্তিম যতি। ওটি এমনই পূর্ণতা-সূচক যে এর পরে যেমন তার নিজের কোনো কথা থাকে না, তেমনি পাঠকেরও কোনো কথা জন্মায় না। কারণ ওটা এমন একটা ‘ঘটিত’ ঘটনা- যা পড়বার পরে একান্তভাবেই শেষ হয়ে যায়- ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ বলে মনে হয় না পাঠকের। ফলে ‘শেষ’ করার আকুলিবিকুলিতে তাঁর মনে নিজস্ব কোনো সৃষ্টি-প্রক্রিয়াও আনাগোনা করে না। কারণ অ্যানিকডোট একটা ‘ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট’, প্রতিপক্ষে ছোটগল্প যেন ‘আন্ফিনিশ্ড’।
অ্যানিকডোটের সমার্থক যুৎসই কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমি পাচ্ছি না বলে এর প্রতিশব্দস্বরূপ সংস্কৃত থেকে ধার নিয়ে ‘কথানক’ বলা যায়। তবে আমার কথা হল- ইঙ্গিতপূর্ণ এবং ব্যঞ্জনাময় ‘শর্ট স্টোরি’-কে আমরা যখন ‘ছোট গল্প’ বলছি যা শেষ হয়ে হয় না যে শেষ, তখন ইঙ্গিতবিহীন-ব্যঞ্জনাহীন ‘অ্যানিকডোট’কে তো ‘স্টোরি’ বা ‘গল্প’ও বলতে পারি যা ‘শেষ হয়ে হইল’ যে ‘শেষ’। অতএব আমার পরিভাষায় ‘টেল্’ হল ‘কাহিনী’, ‘ফেবল’ বা কথার জায়গায় চলুক ‘ছোটগল্প’ আর ‘অ্যানিকডোট’কে বলা হোক ‘গল্প’।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে গল্প হলেই ছোটগল্প হল না। গল্পটির একটা কৌতূহলোদ্দীপক আরম্ভ থাকতে পারে, থাকতে পারে একটা চমকপ্রদ অন্তও। কিন’ গল্পের ভেতরে অন্তর্বয়ান, কিংবা বিভিন্ন তাৎপর্যের বিবিধ স্তর, অথবা মানবপ্রকৃতির প্রতি কৌণিক দৃষ্টি না-থাকলে, বা অভিনব কোনো অভিমুখ কিংবা জগজ্জীবনে মানবের সি’তি বিষয়ে বিচিত্র কিছু আলোকপাত না-থাকলে- সেটা গল্পই থেকে যাবে, ছোটগল্পের পরিভাষাটি পাবে না। এ-কারণে মহৎ ছোটগল্পকারও বিশেষ কোনো আবেগের কিংবা মোহের বশে তাঁর হয়ে-ওঠা ছোটগল্পটিরও সীমা অতিক্রম করে চলে যান বিস্তৃত একটি গল্পের দেশে। দুজন বীপষঁংরাব পষধংং বা স্বতন্ত্র শ্রেণীর ছোটগল্পকারের দুটি উদাহরণই স্মরণ করুন- রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এবং মোপাসাঁর ‘সেমিয়াঁৎ’ (ঝবসরধহঃব)। পরিভাষা হিসাবে ছোটগল্প যা বোঝায় তা এরা নয়। এরা হয়ে গিয়েছে নেহাতই গল্প।
এর মানে ছোটগল্পে ‘ঘটনা থাকবে না’ তা কিন’ নয়। ঘটনা অবশ্যই থাকতে পারে, তবে ওটা নিছক কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অপর পক্ষে ঘটনা পরিহার করেও যদি একটি বিশেষ ভাব বা মূডের মধ্যেই একটি মহামুহূর্তের উদ্ভব কোনো লেখক তাঁর গল্পে ঘটাতে পারেন এবং মানবচরিত্র বা তার জীবনরহস্যের কোনো গভীরতা বা বিশালতার দিক্দর্শন করাতে পারেন তবে সেটাও সার্থক ছোটগল্প হতে পারে বইকি। এমনি একটি মহৎ ছোটগল্পের উদাহরণ মার্কিন গল্পকার জেরোম ওয়াইডম্যানের ‘মাই ফাদার সিট্স ইন দ্য ডার্ক’-নামক শ্রেষ্ঠগল্প-গ্রনে’র নামগল্পটি।
অন্যত্র প্রমথ চৌধুরী বলেছেন :
‘মাসিক সাহিত্যের প্রধান সম্বল হচ্ছে ছোটোগল্প। এই ছোটোগল্প কী ভাবে লেখা উচিত সে বিষয়েও আজকাল আলোচনা শুরু হয়েছে। এও আর-একটি প্রমাণ যে, লেখবার বিষয়ের অভাববশতই লেখবার পদ্ধতির বিচারই আমাদের দায়ে পড়ে করতে হয়। এ সম্বন্ধে আমার দুটি কথা বলবার আছে। আমার মতে ছোটোগল্প প্রথমে গল্প হওয়া চাই, তার পরে ছোটো হওয়া চাই; এ ছাড়া আর-কিছুই হওয়া চাই নে।
যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে ‘গল্প’ কাকে বলে, তার উত্তর ‘লোকে যা শুনতে ভালোবাসে’। আর যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন ‘ছোটো’ কাকে বলে, তার উত্তর ‘যা বড়ো নয়’। এই উত্তরে পাঠক আপত্তি করতে পারেন যে ডেফিনিশন্টি তেমন পরিষ্কার হল না। এ স’লে আমি ছোটোগল্পের তত্ত্ব নির্ণয় করবার চেষ্টা করছি। এবং আশা করি সকলে মনে রাখবেন যে তত্ত্বকথা এর চাইতে আর পরিষ্কার হয় না। এর জন্য দুঃখ করবারও কোনো কারণ নেই; কেননা, সাহিত্যের তত্ত্বজ্ঞানের সাহায্যে সাহিত্য রচনা করা যায় না। আগে আসে বস’, তার পরে তার তত্ত্ব। শেষটি না থাকলেও চলে, কিন’ প্রথমটি না থাকলে সাহিত্যজগত শূন্য হয়ে যায়।’ (পৃ. ১৫৮, টীকা ও টিপ্পনি, বীরবলের হালখাতা)।
প্রসঙ্গত কবিতাধর্মী গদ্য প্রকরণ ছোটগল্প বিষয়ক সারকথাটি সম্যক অনুধাবনের জন্য কৃতী ছোটগল্পকার ও বরেণ্য অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রদত্ত সংজ্ঞাটি পাঠক-লেখকদের একান্তই স্মৃতিধার্য জ্ঞানে এখানে উদ্ধৃত হল :
‘ছোট গল্প হচ্ছে প্রতীতি (ওসঢ়ৎবংংরড়হ) জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্য-কাহিনী যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা কোনো পরিবেশ বা কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক-সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।’ (সাহিত্যে ছোট গল্প / দ্বিতীয় খণ্ড, রূপতত্ত্ব, পৃ. ৫০৫, না. গ. র, দ্বাদশ খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ)।
উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞার আলোকে উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের চাহিদা হ্রাসের জন্য পাঠক হিসাবে আমার কাছে লেখককেই দায়ী মনে হয়। যেমন গত মৌসুমের ঈদসংখ্যার বিপুল ফসল ঘরে তুলেছিলাম এবং মোটামুটি সন্তোষজনক ছোটগল্প পেয়েছিলাম মাত্র একটি। বাকি গল্পগুলি পড়ে মনে হয়েছে লেখক হয়তো মজাদার কেচ্ছা বয়ান করেছেন, নয়তো চটকদার খবর পরিবেশন করেছেন, অন্যথায় কোনো অনটন পীড়িত নটনটীর অভিশপ্ত দৈনন্দিনের ওপর সুলিখিত রিপোর্ট পেশ করেছেন- কিন’ শিল্পসম্মত ছোটগল্প রচনা করেন নি।
সম্ভবত মজাদারিত্ব আর চটকদারিত্বের মোহে পড়েই বিচিত্র পটভূমি, সাধারণ্যে কম-জানা জীবন, কম-চেনা পেশা কিংবা চমকপ্রদ বিষয়-ব্যাপার ইত্যাদির কদরই বেশি দেখা গিয়েছে গল্পকারের কাছে। এবং গল্পকারও হয়ে পড়েছেন প্রদিবেদকই। অনেকে আবার শুধুমাত্র প্ল্লটের চাতুর্য কিংবা আঙ্গিকের অভিনবত্বকেই যেন সার করেছেন। কিন’ ছোটগল্প তো রহস্য-রোমাঞ্চ অঞ্চলের কিছু নয়- একটি যেখানে শেষ হয়ে শেষ হয় না, আরেকটি সেখানে ফাঁস হতেই নিঃশেষ হয়ে যায়।
আমি পাঠক, আপনি লেখক। আমি আপনার গল্পটি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়তে শুরু করেছি এবং এটুকুই আপনার সঙ্গে যাত্রায় আমার মোট পুঁজি বিনিয়োগ। কিন’ লেখক হিসেবে যেহেতু আপনিই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন, আমাকে আপনার কিছু একটার অংশী করতে চেয়েছেন, সেহেতু আপনাকেই আপনার রচনার সারাটি পথ আমাকে নানান কিছু দিয়ে উৎসাহ জুগিয়ে পরিতুষ্ট রেখে অন্তটুকু পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। এবং সেখানেও শেষ নয়। আমাদের এই সহযাত্রা শেষ হয়েও শেষ হতে পারবে না- আমার মনোপথে একটা নিজস্ব যাত্রার খাতও খুলে দিয়ে যাবে আপনার রচনা, বেশ কিছু রাহাখরচসহ যে-পথে আমার আরো অনেক দূর দেখবার থাকবে, অনেক কিছু বুঝবার থাকবে।
কেননা, আমার সঞ্চয়ে কিছু আসার এবং থেকে যাবার ব্যবসা না থাকলে আমার বিনিয়োগটুকু গচ্চা গিয়েছে দেখে আমি বেশ বিরক্ত হবো, আপনার রচনাটি পড়ার সময়টুকু শুধু পেটে-ভাতে কাটিয়ে যেতে পেরে সন’ষ্ট হবো না মোটেই। অর্থাৎ আপনার রচনায় আমার বোধের, উপলব্ধির, চিন্তার, ভাবনার, যথেষ্ট উপাদান থাকবে, ব্যথিত হওয়ার, মথিত হওয়ার, আনন্দিত হওয়ার, পুলকিত হওয়ার, চকিত হওয়ার, চমকিত হওয়ার, ক্ষুব্ধ হওয়ার, উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর্যাপ্ত উস্কানি থাকবে।
এই যে যথেষ্ট হওয়া, পর্যাপ্ত হওয়া- এর পরিমাপটি কী? মাপটি একেবারে সোজাসুজি। মানে রচনা যতটুকু, ওই উপাদান- তথা উস্কানিও থাকবে ততটুকু জুড়েই। এক কথায়, বর্ণিত মনোহারিত্ব কেবল পর্বে পর্বে, প্যারায় প্যারায় নয়, একেবারে ছত্রে ছত্রে শব্দে শব্দেই থাকবে। পুরোপুরি এমনটি থাকলে রচনাটি সর্বাংশে সার্থক হবে, মোটামুটি থাকলে মোটামুটি সার্থক, আর তাও না থাকলে রচনাটি অসার্থক এবং পাঠকের জন্য অসন্তোষজনক হবে। এই উক্তিটির সত্যাখ্যান করার জন্য এখানেই লেখাটা বন্ধ করে আমি একটা টোটকা পরীক্ষার পন’া অবলম্বন করেছিলাম এবং সত্যতা সমর্থিতও পেয়েছিলাম।
হাত বাড়িয়ে শেল্ফ থেকে ‘গল্পগুচ্ছ’ নিয়ে চোখ বুঁজে যে কোনো পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চোখ খুলতেই যেখানে দৃষ্টি পড়লো সেখানটাই পড়ে দেখলাম যে লেখকের কেবল প্যারাই নয়, বাক্য মাত্রই স্বয়ম্ভর- অর্থাৎ কোনো-না-কোনোভাবে নিজেই পাঠকের সন্তোষবিধানে সক্ষম এবং সে জন্যে রচনাটি সেটুকুতেও স্বতন্ত্রভাবে সার্থক। উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বাড়ানো নিষপ্রয়োজন। গ্রন’খানি ঘরে ঘরেই বিদ্যমান এবং সকলেই খেয়ালের এই খেলাটি খেলে একটু দেখে নিতে পারেন।
বলতে চাচ্ছি, রচনাগুলির সর্ব অবয়বই একাধিক কিংবা কোনো-না-কোনো রসে মণ্ডিত বলে তার সর্বত্রই পাঠকের কিছু-না-কিছু প্রাপ্তিযোগের নিশ্চয়তা বিধান রয়েছে। শুধুমাত্র মাত্রভেদেই একটি গল্প আরেকটি গল্পের তুলনায় উৎকৃষ্ট অথবা নিকৃষ্ট।
কীভাবে ঘটেছে এটা? প্রশ্নটির উত্তর অন্বেষণের সময় প্রতিটি রচিত বাক্যের পেছনেই রচয়িতার সচেতন উপসি’তি লক্ষণীয়। লেখক তাঁর ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্য, এমনকি প্রতিটি শব্দের ভেতরেই পাঠকের জন্য উপঢৌকন পুরে দিয়েছেন- যত রকমের সম্ভব। অন্যকথায় বলা যায় যে কথাশিল্পী তাঁর কথামালাকে, কখনোই কেবল একমুখী নয়, সর্বদাই বহুমুখী দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন- শুধু তথ্য, শুধু তত্ত্ব, শুধু রূপ-রস-সৌন্দর্যের উপস’াপনের দায়িত্বে নয়, সর্বমুখী পরিবেশনের দায়িত্বে। তাতে পাঠকের প্রাপ্তিযোগও ঘটেছে সর্বমুখী। ফলে যে রচনা উত্তম হয়নি, সেটিও হয়েছে নিদেনপক্ষে ভালো, একেবারেই অনুত্তীর্ণ থেকে যায়নি। এমন লেখককে পাঠক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান করবেন এবং পড়ার আগ্রহ কখনোই হারাবেন না।
এটা বস’ত কেবল কথাশিল্পের ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণভাবে গদ্যশিল্পের ক্ষেত্রেও সত্য। এই গুণাবলী সংবলিত গদ্যে রচিত শুধু কথাসাহিত্য কেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সন্দর্ভ সমালোচনা সবই সৃষ্টিধর্মিতার প্রসাদগুণে প্রসন্ন হয়ে উঠে, যার দরুন দারুণ পাঠ্য এবং উপভোগ্যও। যেমন বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ-প্রমথ এঁরা এঁদের কোন গদ্য রচনাকেই তথ্য পরিবেশন করা কি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা কি রস সৃষ্টি করার মতো কেবল একটিমাত্র গুণ দিয়ে গরিব করে রাখেননি, যে কারণে পাঠকের রুচিও কখনো একঘেঁয়েমি কি ক্লান্তির শিকার হয়ে পড়েনি।
কোন্ মন্ত্রবলে কথাশিল্পীর কথাসমগ্র অমন কামধেনুতে রূপান্তরিত হয়? প্রতিভা? ওটার অবদান কতখানি আর অভিজ্ঞতারই বা কতখানি, সেই চিরায়ত বিতর্কে না গিয়েই আমি শুধু আয়াস-প্রয়াসের কথাই বলবো- যেসব ছাড়া প্রতিভাও বড়জোর অসার আতসবাজিই দেখাতে পারে, অনির্বাণ আলো জ্বালাতে পারে কি না সন্দেহ। এই ব্যাপারটিকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন- সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা বেশি ছিল আর বঙ্গিমচন্দ্রের ছিল প্রতিভার গিন্নীপনা বেশি।
যাক, আমার ধারণা যে শিল্প-বস’টি শিল্পীর মগজে কিংবা মনে দৈববাণীর মত এককালীন নাজেল হয় না, চিরকালীনরূপে। সাক্ষাত জননী ধরনী তাঁর হীরের টুকরোটিকেও তার চূড়ান্ত বৈভবে প্রসব করেন না- হীরকের আলোকটি পূর্ণরূপে বিকশিত হয় শিল্পীর কাটছাঁটে এবং সুকঠিন আয়াসে-প্রয়াসেই। ন্যাচারাল পার্লের চেয়ে ‘কালচার্ড পার্ল’-এর মূল্য হয় বহুগুণ বেশি। আসলে কালচার ছাড়া সফিস্টিকেশন লভ্য নয়। ওটা ছাড়া আবার আধুনিক মনের সাড়াও লভ্য নয়, যেহেতু আধুনিক মন সফিস্টিকেটেড। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে সফিস্টকেটেড কথাটির অর্থ কিন’ ভেজাল, জটিল কৃত্রিম। এবং শিল্পের উৎকর্ষ ও উত্তরণের জন্য অতি বিশিষ্ট এক ধরনের কৃত্রিমতা অপরিহার্য।
কৃত্রিমতা? হায়, তবে রিয়েলিজমের কি হবে? যথাযথতার, স্বাভাবিকতার, বাস্তবতার? আতঙ্ক অমূলক, যেহেতু ওগুলির কোনোটিরই কোন ধ্রুব অর্থ নেই। বাস্তব অনবরতই বদলাচ্ছে, না বদলালেও তাকে বদলাতে হতো; স্বভাবও অব্যয়-অক্ষয় কিছুরই নয়; হয় আরোপিত, নয় অনভিপ্রেত, অতএব না বদলালেও তাকেও বদলাতে হত। এবং এই বদলানোর অন্তত পরোক্ষ দায়িত্ব থেকে শিল্পকর্মীও মুক্ত নয়, অন্যান্য কর্মীর সে দায়িত্ব যদি প্রত্যক্ষও হয়ে থাকে। এক কথায়, কথাশিল্পীর রচনার যথাযথতা বিবেচিত হবে তাঁর রচিত বাস্তবেরই পরিপ্রেক্ষিতে।
উপরোক্ত কালচারের ধারায় অর্থাৎ কৃত্রিমতার সূত্রে রচনায় অস্বাচ্ছন্দ্য এসে পড়বে না? শিল্প-বিচারে স্বাচ্ছন্দ্য বিষয়টিকেই বরং কিঞ্চিৎ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে হবে? পটভূমি-বিচ্ছিন্ন বিচারে যা অস্বচ্ছন্দ বলে প্রতীয়মান হতে পারে, তাই যথানুপাতিক বিবেচনায় স্বাচ্ছন্দ্য বলে গণ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দেশি-বিদেশি অনেক মান্যগণ্য শিল্পীর নাম সর্বজনবিদিত।
এছাড়া, স্বাচ্ছন্দ্যের ধরনও এক নয়। দেউলেও একরকমের স্বচ্ছন্দ, নির্ভার। তাই বলে দেউলেপনা কতকানি কাম্য? আদিবাসী-জীবনের প্রসন্ন স্বস্তিময়তা কি অধিবাসীর জীবনের থাকে?
তা তো থাকেই না, বরং থাকে উল্টোটি- অর্থাৎ জটিলতা, ভারাক্রান্ততা। নাগরিক তার জাতিক জীবনটুকু নিয়েই ছিল হাঁসফাস, তার ওপর আজ সে হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক। তাকে ঘিরে বন বন ঘুরছে কেবল ‘ইস্যু’-র মিছিল অষ্টপ্রহর, তার সর্বত্র অনবরত আছড়ে পড়ছে দুনিয়ার যত প্রশ্ন, যেসব প্রশ্ন বিতর্ককবলিত আর সারা বিশ্ব কূটতর্কে মুখরিত তার প্রতিটি প্রকোষ্ঠে- কি জর্জরিত ভবের, কি মানবের মনের। আধুনিক মানুষকে তাই আজ এককালীন বহু কিছু জানতে হয়, শুনতে হয়, ভাবতে হয়, করতে হয়। এ জন্য সময়ের অপটিমাম বা সম্ভবশ্রেষ্ঠ সদ্ব্যবহারে সে এখন শুধু অভ্যস্তই নয়, বাধ্যও, বিকল্পে বরং সে রীতিমত বেকার বোধ করে।
অতএব সহজেই বোধ্য যে আজকের পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানের জন্য ভিন্ন ধরনের জোগানেরই প্রয়োজন- এবং সেটা কথাসাহিত্যেও।
এ ছাড়াও আজকের দ্রুতগতি মানুষের বিচিত্রদৃক জীবনের যেহেতু অখণ্ড রূপের চেয়ে খণ্ডরূপই স্পষ্টতর, অধুনার যুগমানসের লক্ষণ হিসাবে যেহেতু ধারাবাহিকতার চেয়ে অভিনবত্বই প্রকটতর, সেহেতু এসবের সম্যক প্রতিফলনের জন্য ছোটগল্পেরই যোগ্যতম মাধ্যম হওয়ার কথা।
তবু ছোটগল্প কেন আজ তার স্বকালেই অনাদৃত? ঘরেতে পরবাসী? স্মর্তব্য যে গল্পের চারণভূমি সমগ্র বিশ্বে ব্যাপৃত হলেও জন্মভূমি ভারতবর্ষ। আবার বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের প্রথম সিদ্ধপুরুষ রবীন্দ্রনাথও (জ. ১৮৬১) ফরাসি সিদ্ধপুরুষ মোপাসাঁর (জ. ১৮৫০) প্রায় সমসাময়িক।
প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন, এ যুগে গল্প পড়বার :
‘এপিডেমিক থেকে মুক্ত শুধু নিরক্ষর লোক- যেমন বেরি-বেরি থেকে মুক্ত শুধু নিরন্ন লোক।
কিন’ একটু চোখ চেয়ে দেখলেই দেখা যায় যে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি সকল যুগেই মানুষের র্স্বপ্রধান মানসিক আহার হচ্ছে গল্প। পৃথিবীর অন্যান্য ভূ-ভাগের কথা ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ভারতবর্ষের অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায়, সে অতীত গল্পপ্রাণ। এ দেশে পুরাকালে যত গল্প বলা হয়েছে ও লেখা হয়েছে, অন্য কুত্রাপি তার তুলনা নেই। আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে বিশ্বে পরিচিত। কিন’ যুগ যুগ ধরে আমাদের ধর্মের বাহন হয়েছে, মুখ্যত গল্প। রামায়ণ মহাভারত বাদ দিলে হিন্দুধর্মের পনেরো আনা বাদ পড়ে যায়, আর জাতক বাদ দিলে বৌদ্ধধর্ম দর্শনের কচকচি মাত্র হয়ে ওঠে।
রামায়ণ, মহাভারত, জাতক ছাড়াও এ দেশে অসংখ্য গল্প আছে, যা সেকালে সাহিত্য বলেই গণ্য হত। এ দেশের যত কাব্যনাটকের মূলে আছে গল্প। তা ছাড়া আখ্যায়িকা ও কথা নামে দুটি বিপুল সাহিত্য সেকালে ছিল, এবং একালেও তার কতক অংশের সাক্ষাৎ মেলে। আখ্যায়িকাই বলো আর কথাই বলো, ও দুই হচ্ছে একই বস’…শুধু নাম আলাদা। ইংরাজি লজিকের ভাষায় যাকে বলে মবহঁং এক ংঢ়বপরবং আলাদা।…
এর থেকে স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভারতবর্ষের লৌকিক অলৌকিক সকল সাহিত্যের প্রাণ হচ্ছে কথা-সাহিত্য।
কথা-সাহিত্য এ দেশে বিলেত থেকে আমদানি-করা নূতন সাহিত্য নয়। বরং সত্য কথা এই যে, পুরাকালে ও সাহিত্য ভারতবর্ষে রচিত হয়ে, তারপর দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এককালে পঞ্চতন্ত্র ও জাতকের প্রচলন য়ুরোপের লোকসমাজে যে অতি বিস্তৃত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উপরন’ বহু পণ্ডিতের মতে আরব্য উপন্যাসের জন্মভূমিও হচ্ছে ভারতবর্ষ।
আজ যে আমরা সকলেই গল্প শুনতে চাই, তার কারণ এ প্রবৃত্তি আমরা আমাদের র্পূ্বপুরুষদের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি।’ (সবুজ পত্র, দশম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা ॥ পৌষ, ১৩৩৩)।
আসলে মানুষের ইতিহাস যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, তার গল্পও আরম্ভ হয়েছে সেদিন থেকে। শ্রমপর্বের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে অভিজ্ঞ করে তোলা এবং বিশ্রামপর্বে আনন্দ পরিবেশন করার দ্বৈত প্রেরণা থেকেই মনুষ্যজীবনে গল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। (স্মরণ করুন : মানবজীবনের আদিতে দিনভর অ্যাডামের মাটি কোপানো এবং ইভের কাপড় বানানোর শেষে সন্ধ্যার অবসরে সন্তানদের কাছে তাঁদের গল্প করার কথা)। পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং আনন্দলাভের প্রয়োজনে সব দেশের মানুষই মোটামুটি অভিন্ন ধারায় গল্প কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। প্রধান দুটি ধারা- নীতিশিক্ষা আর রূপকথার উপকরণও প্রায় একই রকম। সম্ভবত সকল গল্পের প্রথম নায়কও ছিল অভিন্ন- সূর্য। কারণ প্রাচীন মানুষকে সূর্য আলো দিয়ে নিরাপদ করতো, রোদ দিয়ে তার ফসল ফলাতো, তেজ দিয়ে ফল পাকাতো, বরফ গলাতো, মাছ ভাসাতো এবং আরও অনেক উপকার করতো।
গল্পসাহিত্যের ভাগ মোটামুটি তিনটি : ঋধনষব অথবা কথা, অহবপফড়ঃব বা আকর্ষণীয় ঘটনা এবং ঞধষব কিংবা আখ্যায়িকা। প্রথমটাতে ছোটগল্পের সঙ্কেত, দ্বিতীয়টাতে গল্পের আমেজ আর তৃতীয়টাতে উপন্যাসের আভাস। ঋধনষব বা কথা বহু পূর্বেই বিলুপ্ত। বিষ্ণুশর্মা বা ঈশপের মতো প্রাণী-নির্ভর কিংবা মানব-আশ্রয়ী নীতিধর্মী ছোট ছোট গল্পের রেওয়াজ আজ আর নেই। সে-বস’ বলতে গেলে উনিশ শতকের রুশ সাহিত্যের কথার জাদুকর ইভান ক্রাইলভের (ওাধহ কৎরষড়া) সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। কিন’ টেল্ বা আখ্যায়িকা বা কাহিনী এবং অ্যানিক্ডোট বা কিস্সা কিংবা কোনো বিশেষ ঘটনার বৃত্তান্ত ছোট গল্পের ছদ্মবেশে এখনও বিদ্যমান। তাই এ-দুটি প্রকরণ সম্বন্ধে ধারণাটা স্পষ্ট রাখা দরকার।
‘আখ্যায়িকা’ অতি পুরাতন কথাসাহিত্য এবং তা একাই জমিয়ে রেখেছে জাতক, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎ-সাগর, দশকুমার-চরিত, শুকসপ্ততি, আরব্য উপন্যাস (আল্ফ লায়লা), তার নবতর সংস্করণ পারস্য উপন্যাস (হাজার আফসানে), দেকামেরন এবং উপদেশাত্মক গল্পমালার বৃহত্তম ইয়োরোপীয় সংস্করণ গেস্তা রোমানোরাম (রোমানদের কার্যকলাপ) বা সংক্ষেপে গেস্তা, ক্যান্টারবেরি টেল্স, গায়গাঁতুয়া, পাঁতাগ্রুয়েল। সংকলিত এসব আখ্যান গল্পরসে টইটম্বুর এবং বৈচিত্র্যে জমজমাট। কিন’ খণ্ডতার মধ্যে অখণ্ডের হদিস এরা দেয় না। মানুষের সহজাত গল্প বলার প্রেরণা থেকেই এদের উদ্ভব। তাই সাধারণত কোনো ব্যঞ্জনা নিহিত থাকে না এদের বুনটে, পাওয়া যায় না ইঙ্গিতধর্মী একমুখিতা বা অনন্য কোনো মহামুহূর্ত। পাওয়া যায় বরং ঘটনাবহুল, এমনকি দ্বন্দ্ব-সংঘাতময়, শিথিল-পৃথুল উপন্যাসেরই জৌলুস। বর্ণিত নেতিধর্মী এবং ইতিধর্মী, এইসব চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই আখ্যায়িকা ছোট হলেও ছোট গল্প হয়ে ওঠে না; ভেজাল হিসাবে ছোটগল্পের দলে ভিড়ে গেলেও সহজেই ধরা পড়ে যায়।
কিন’ তেমন সহজে ধরা পড়ে না ‘অ্যানিকডোট’-নামক ছদ্মবেশী ছোটগল্প। কারণ সে জন্মগতভাবে ছোটগল্পেরই সহোদর। দুই ভাইয়ের মধ্যে ‘শর্ট স্টোরি’ যেন কবি-স্বভাবের দার্শনিক আর ‘অ্যানিকডোট’ যেন ব্যবহারিক স্বভাবের সাংসারিক। ‘ছোটগল্প’ গৃহী-সন্ন্যাসীও হতে পারে, কিন’ ‘বৃত্তান্ত’ নিতান্তই গৃহী। এই গৃহীটিকে চেনার প্রথম উপায়টি হল তার দ্ব্যর্থহীন অন্তিম যতি। ওটি এমনই পূর্ণতা-সূচক যে এর পরে যেমন তার নিজের কোনো কথা থাকে না, তেমনি পাঠকেরও কোনো কথা জন্মায় না। কারণ ওটা এমন একটা ‘ঘটিত’ ঘটনা- যা পড়বার পরে একান্তভাবেই শেষ হয়ে যায়- ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ বলে মনে হয় না পাঠকের। ফলে ‘শেষ’ করার আকুলিবিকুলিতে তাঁর মনে নিজস্ব কোনো সৃষ্টি-প্রক্রিয়াও আনাগোনা করে না। কারণ অ্যানিকডোট একটা ‘ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট’, প্রতিপক্ষে ছোটগল্প যেন ‘আন্ফিনিশ্ড’।
অ্যানিকডোটের সমার্থক যুৎসই কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমি পাচ্ছি না বলে এর প্রতিশব্দস্বরূপ সংস্কৃত থেকে ধার নিয়ে ‘কথানক’ বলা যায়। তবে আমার কথা হল- ইঙ্গিতপূর্ণ এবং ব্যঞ্জনাময় ‘শর্ট স্টোরি’-কে আমরা যখন ‘ছোট গল্প’ বলছি যা শেষ হয়ে হয় না যে শেষ, তখন ইঙ্গিতবিহীন-ব্যঞ্জনাহীন ‘অ্যানিকডোট’কে তো ‘স্টোরি’ বা ‘গল্প’ও বলতে পারি যা ‘শেষ হয়ে হইল’ যে ‘শেষ’। অতএব আমার পরিভাষায় ‘টেল্’ হল ‘কাহিনী’, ‘ফেবল’ বা কথার জায়গায় চলুক ‘ছোটগল্প’ আর ‘অ্যানিকডোট’কে বলা হোক ‘গল্প’।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে গল্প হলেই ছোটগল্প হল না। গল্পটির একটা কৌতূহলোদ্দীপক আরম্ভ থাকতে পারে, থাকতে পারে একটা চমকপ্রদ অন্তও। কিন’ গল্পের ভেতরে অন্তর্বয়ান, কিংবা বিভিন্ন তাৎপর্যের বিবিধ স্তর, অথবা মানবপ্রকৃতির প্রতি কৌণিক দৃষ্টি না-থাকলে, বা অভিনব কোনো অভিমুখ কিংবা জগজ্জীবনে মানবের সি’তি বিষয়ে বিচিত্র কিছু আলোকপাত না-থাকলে- সেটা গল্পই থেকে যাবে, ছোটগল্পের পরিভাষাটি পাবে না। এ-কারণে মহৎ ছোটগল্পকারও বিশেষ কোনো আবেগের কিংবা মোহের বশে তাঁর হয়ে-ওঠা ছোটগল্পটিরও সীমা অতিক্রম করে চলে যান বিস্তৃত একটি গল্পের দেশে। দুজন বীপষঁংরাব পষধংং বা স্বতন্ত্র শ্রেণীর ছোটগল্পকারের দুটি উদাহরণই স্মরণ করুন- রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এবং মোপাসাঁর ‘সেমিয়াঁৎ’ (ঝবসরধহঃব)। পরিভাষা হিসাবে ছোটগল্প যা বোঝায় তা এরা নয়। এরা হয়ে গিয়েছে নেহাতই গল্প।
এর মানে ছোটগল্পে ‘ঘটনা থাকবে না’ তা কিন’ নয়। ঘটনা অবশ্যই থাকতে পারে, তবে ওটা নিছক কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অপর পক্ষে ঘটনা পরিহার করেও যদি একটি বিশেষ ভাব বা মূডের মধ্যেই একটি মহামুহূর্তের উদ্ভব কোনো লেখক তাঁর গল্পে ঘটাতে পারেন এবং মানবচরিত্র বা তার জীবনরহস্যের কোনো গভীরতা বা বিশালতার দিক্দর্শন করাতে পারেন তবে সেটাও সার্থক ছোটগল্প হতে পারে বইকি। এমনি একটি মহৎ ছোটগল্পের উদাহরণ মার্কিন গল্পকার জেরোম ওয়াইডম্যানের ‘মাই ফাদার সিট্স ইন দ্য ডার্ক’-নামক শ্রেষ্ঠগল্প-গ্রনে’র নামগল্পটি।
অন্যত্র প্রমথ চৌধুরী বলেছেন :
‘মাসিক সাহিত্যের প্রধান সম্বল হচ্ছে ছোটোগল্প। এই ছোটোগল্প কী ভাবে লেখা উচিত সে বিষয়েও আজকাল আলোচনা শুরু হয়েছে। এও আর-একটি প্রমাণ যে, লেখবার বিষয়ের অভাববশতই লেখবার পদ্ধতির বিচারই আমাদের দায়ে পড়ে করতে হয়। এ সম্বন্ধে আমার দুটি কথা বলবার আছে। আমার মতে ছোটোগল্প প্রথমে গল্প হওয়া চাই, তার পরে ছোটো হওয়া চাই; এ ছাড়া আর-কিছুই হওয়া চাই নে।
যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে ‘গল্প’ কাকে বলে, তার উত্তর ‘লোকে যা শুনতে ভালোবাসে’। আর যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন ‘ছোটো’ কাকে বলে, তার উত্তর ‘যা বড়ো নয়’। এই উত্তরে পাঠক আপত্তি করতে পারেন যে ডেফিনিশন্টি তেমন পরিষ্কার হল না। এ স’লে আমি ছোটোগল্পের তত্ত্ব নির্ণয় করবার চেষ্টা করছি। এবং আশা করি সকলে মনে রাখবেন যে তত্ত্বকথা এর চাইতে আর পরিষ্কার হয় না। এর জন্য দুঃখ করবারও কোনো কারণ নেই; কেননা, সাহিত্যের তত্ত্বজ্ঞানের সাহায্যে সাহিত্য রচনা করা যায় না। আগে আসে বস’, তার পরে তার তত্ত্ব। শেষটি না থাকলেও চলে, কিন’ প্রথমটি না থাকলে সাহিত্যজগত শূন্য হয়ে যায়।’ (পৃ. ১৫৮, টীকা ও টিপ্পনি, বীরবলের হালখাতা)।
প্রসঙ্গত কবিতাধর্মী গদ্য প্রকরণ ছোটগল্প বিষয়ক সারকথাটি সম্যক অনুধাবনের জন্য কৃতী ছোটগল্পকার ও বরেণ্য অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রদত্ত সংজ্ঞাটি পাঠক-লেখকদের একান্তই স্মৃতিধার্য জ্ঞানে এখানে উদ্ধৃত হল :
‘ছোট গল্প হচ্ছে প্রতীতি (ওসঢ়ৎবংংরড়হ) জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্য-কাহিনী যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা কোনো পরিবেশ বা কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক-সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।’ (সাহিত্যে ছোট গল্প / দ্বিতীয় খণ্ড, রূপতত্ত্ব, পৃ. ৫০৫, না. গ. র, দ্বাদশ খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ)।
উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞার আলোকে উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের চাহিদা হ্রাসের জন্য পাঠক হিসাবে আমার কাছে লেখককেই দায়ী মনে হয়। যেমন গত মৌসুমের ঈদসংখ্যার বিপুল ফসল ঘরে তুলেছিলাম এবং মোটামুটি সন্তোষজনক ছোটগল্প পেয়েছিলাম মাত্র একটি। বাকি গল্পগুলি পড়ে মনে হয়েছে লেখক হয়তো মজাদার কেচ্ছা বয়ান করেছেন, নয়তো চটকদার খবর পরিবেশন করেছেন, অন্যথায় কোনো অনটন পীড়িত নটনটীর অভিশপ্ত দৈনন্দিনের ওপর সুলিখিত রিপোর্ট পেশ করেছেন- কিন’ শিল্পসম্মত ছোটগল্প রচনা করেন নি।
সম্ভবত মজাদারিত্ব আর চটকদারিত্বের মোহে পড়েই বিচিত্র পটভূমি, সাধারণ্যে কম-জানা জীবন, কম-চেনা পেশা কিংবা চমকপ্রদ বিষয়-ব্যাপার ইত্যাদির কদরই বেশি দেখা গিয়েছে গল্পকারের কাছে। এবং গল্পকারও হয়ে পড়েছেন প্রদিবেদকই। অনেকে আবার শুধুমাত্র প্ল্লটের চাতুর্য কিংবা আঙ্গিকের অভিনবত্বকেই যেন সার করেছেন। কিন’ ছোটগল্প তো রহস্য-রোমাঞ্চ অঞ্চলের কিছু নয়- একটি যেখানে শেষ হয়ে শেষ হয় না, আরেকটি সেখানে ফাঁস হতেই নিঃশেষ হয়ে যায়।
আমি পাঠক, আপনি লেখক। আমি আপনার গল্পটি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়তে শুরু করেছি এবং এটুকুই আপনার সঙ্গে যাত্রায় আমার মোট পুঁজি বিনিয়োগ। কিন’ লেখক হিসেবে যেহেতু আপনিই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন, আমাকে আপনার কিছু একটার অংশী করতে চেয়েছেন, সেহেতু আপনাকেই আপনার রচনার সারাটি পথ আমাকে নানান কিছু দিয়ে উৎসাহ জুগিয়ে পরিতুষ্ট রেখে অন্তটুকু পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। এবং সেখানেও শেষ নয়। আমাদের এই সহযাত্রা শেষ হয়েও শেষ হতে পারবে না- আমার মনোপথে একটা নিজস্ব যাত্রার খাতও খুলে দিয়ে যাবে আপনার রচনা, বেশ কিছু রাহাখরচসহ যে-পথে আমার আরো অনেক দূর দেখবার থাকবে, অনেক কিছু বুঝবার থাকবে।
কেননা, আমার সঞ্চয়ে কিছু আসার এবং থেকে যাবার ব্যবসা না থাকলে আমার বিনিয়োগটুকু গচ্চা গিয়েছে দেখে আমি বেশ বিরক্ত হবো, আপনার রচনাটি পড়ার সময়টুকু শুধু পেটে-ভাতে কাটিয়ে যেতে পেরে সন’ষ্ট হবো না মোটেই। অর্থাৎ আপনার রচনায় আমার বোধের, উপলব্ধির, চিন্তার, ভাবনার, যথেষ্ট উপাদান থাকবে, ব্যথিত হওয়ার, মথিত হওয়ার, আনন্দিত হওয়ার, পুলকিত হওয়ার, চকিত হওয়ার, চমকিত হওয়ার, ক্ষুব্ধ হওয়ার, উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর্যাপ্ত উস্কানি থাকবে।
এই যে যথেষ্ট হওয়া, পর্যাপ্ত হওয়া- এর পরিমাপটি কী? মাপটি একেবারে সোজাসুজি। মানে রচনা যতটুকু, ওই উপাদান- তথা উস্কানিও থাকবে ততটুকু জুড়েই। এক কথায়, বর্ণিত মনোহারিত্ব কেবল পর্বে পর্বে, প্যারায় প্যারায় নয়, একেবারে ছত্রে ছত্রে শব্দে শব্দেই থাকবে। পুরোপুরি এমনটি থাকলে রচনাটি সর্বাংশে সার্থক হবে, মোটামুটি থাকলে মোটামুটি সার্থক, আর তাও না থাকলে রচনাটি অসার্থক এবং পাঠকের জন্য অসন্তোষজনক হবে। এই উক্তিটির সত্যাখ্যান করার জন্য এখানেই লেখাটা বন্ধ করে আমি একটা টোটকা পরীক্ষার পন’া অবলম্বন করেছিলাম এবং সত্যতা সমর্থিতও পেয়েছিলাম।
হাত বাড়িয়ে শেল্ফ থেকে ‘গল্পগুচ্ছ’ নিয়ে চোখ বুঁজে যে কোনো পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চোখ খুলতেই যেখানে দৃষ্টি পড়লো সেখানটাই পড়ে দেখলাম যে লেখকের কেবল প্যারাই নয়, বাক্য মাত্রই স্বয়ম্ভর- অর্থাৎ কোনো-না-কোনোভাবে নিজেই পাঠকের সন্তোষবিধানে সক্ষম এবং সে জন্যে রচনাটি সেটুকুতেও স্বতন্ত্রভাবে সার্থক। উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বাড়ানো নিষপ্রয়োজন। গ্রন’খানি ঘরে ঘরেই বিদ্যমান এবং সকলেই খেয়ালের এই খেলাটি খেলে একটু দেখে নিতে পারেন।
বলতে চাচ্ছি, রচনাগুলির সর্ব অবয়বই একাধিক কিংবা কোনো-না-কোনো রসে মণ্ডিত বলে তার সর্বত্রই পাঠকের কিছু-না-কিছু প্রাপ্তিযোগের নিশ্চয়তা বিধান রয়েছে। শুধুমাত্র মাত্রভেদেই একটি গল্প আরেকটি গল্পের তুলনায় উৎকৃষ্ট অথবা নিকৃষ্ট।
কীভাবে ঘটেছে এটা? প্রশ্নটির উত্তর অন্বেষণের সময় প্রতিটি রচিত বাক্যের পেছনেই রচয়িতার সচেতন উপসি’তি লক্ষণীয়। লেখক তাঁর ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্য, এমনকি প্রতিটি শব্দের ভেতরেই পাঠকের জন্য উপঢৌকন পুরে দিয়েছেন- যত রকমের সম্ভব। অন্যকথায় বলা যায় যে কথাশিল্পী তাঁর কথামালাকে, কখনোই কেবল একমুখী নয়, সর্বদাই বহুমুখী দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন- শুধু তথ্য, শুধু তত্ত্ব, শুধু রূপ-রস-সৌন্দর্যের উপস’াপনের দায়িত্বে নয়, সর্বমুখী পরিবেশনের দায়িত্বে। তাতে পাঠকের প্রাপ্তিযোগও ঘটেছে সর্বমুখী। ফলে যে রচনা উত্তম হয়নি, সেটিও হয়েছে নিদেনপক্ষে ভালো, একেবারেই অনুত্তীর্ণ থেকে যায়নি। এমন লেখককে পাঠক নির্ভরযোগ্য জ্ঞান করবেন এবং পড়ার আগ্রহ কখনোই হারাবেন না।
এটা বস’ত কেবল কথাশিল্পের ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণভাবে গদ্যশিল্পের ক্ষেত্রেও সত্য। এই গুণাবলী সংবলিত গদ্যে রচিত শুধু কথাসাহিত্য কেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সন্দর্ভ সমালোচনা সবই সৃষ্টিধর্মিতার প্রসাদগুণে প্রসন্ন হয়ে উঠে, যার দরুন দারুণ পাঠ্য এবং উপভোগ্যও। যেমন বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ-প্রমথ এঁরা এঁদের কোন গদ্য রচনাকেই তথ্য পরিবেশন করা কি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা কি রস সৃষ্টি করার মতো কেবল একটিমাত্র গুণ দিয়ে গরিব করে রাখেননি, যে কারণে পাঠকের রুচিও কখনো একঘেঁয়েমি কি ক্লান্তির শিকার হয়ে পড়েনি।
কোন্ মন্ত্রবলে কথাশিল্পীর কথাসমগ্র অমন কামধেনুতে রূপান্তরিত হয়? প্রতিভা? ওটার অবদান কতখানি আর অভিজ্ঞতারই বা কতখানি, সেই চিরায়ত বিতর্কে না গিয়েই আমি শুধু আয়াস-প্রয়াসের কথাই বলবো- যেসব ছাড়া প্রতিভাও বড়জোর অসার আতসবাজিই দেখাতে পারে, অনির্বাণ আলো জ্বালাতে পারে কি না সন্দেহ। এই ব্যাপারটিকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন- সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা বেশি ছিল আর বঙ্গিমচন্দ্রের ছিল প্রতিভার গিন্নীপনা বেশি।
যাক, আমার ধারণা যে শিল্প-বস’টি শিল্পীর মগজে কিংবা মনে দৈববাণীর মত এককালীন নাজেল হয় না, চিরকালীনরূপে। সাক্ষাত জননী ধরনী তাঁর হীরের টুকরোটিকেও তার চূড়ান্ত বৈভবে প্রসব করেন না- হীরকের আলোকটি পূর্ণরূপে বিকশিত হয় শিল্পীর কাটছাঁটে এবং সুকঠিন আয়াসে-প্রয়াসেই। ন্যাচারাল পার্লের চেয়ে ‘কালচার্ড পার্ল’-এর মূল্য হয় বহুগুণ বেশি। আসলে কালচার ছাড়া সফিস্টিকেশন লভ্য নয়। ওটা ছাড়া আবার আধুনিক মনের সাড়াও লভ্য নয়, যেহেতু আধুনিক মন সফিস্টিকেটেড। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে সফিস্টকেটেড কথাটির অর্থ কিন’ ভেজাল, জটিল কৃত্রিম। এবং শিল্পের উৎকর্ষ ও উত্তরণের জন্য অতি বিশিষ্ট এক ধরনের কৃত্রিমতা অপরিহার্য।
কৃত্রিমতা? হায়, তবে রিয়েলিজমের কি হবে? যথাযথতার, স্বাভাবিকতার, বাস্তবতার? আতঙ্ক অমূলক, যেহেতু ওগুলির কোনোটিরই কোন ধ্রুব অর্থ নেই। বাস্তব অনবরতই বদলাচ্ছে, না বদলালেও তাকে বদলাতে হতো; স্বভাবও অব্যয়-অক্ষয় কিছুরই নয়; হয় আরোপিত, নয় অনভিপ্রেত, অতএব না বদলালেও তাকেও বদলাতে হত। এবং এই বদলানোর অন্তত পরোক্ষ দায়িত্ব থেকে শিল্পকর্মীও মুক্ত নয়, অন্যান্য কর্মীর সে দায়িত্ব যদি প্রত্যক্ষও হয়ে থাকে। এক কথায়, কথাশিল্পীর রচনার যথাযথতা বিবেচিত হবে তাঁর রচিত বাস্তবেরই পরিপ্রেক্ষিতে।
উপরোক্ত কালচারের ধারায় অর্থাৎ কৃত্রিমতার সূত্রে রচনায় অস্বাচ্ছন্দ্য এসে পড়বে না? শিল্প-বিচারে স্বাচ্ছন্দ্য বিষয়টিকেই বরং কিঞ্চিৎ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে হবে? পটভূমি-বিচ্ছিন্ন বিচারে যা অস্বচ্ছন্দ বলে প্রতীয়মান হতে পারে, তাই যথানুপাতিক বিবেচনায় স্বাচ্ছন্দ্য বলে গণ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দেশি-বিদেশি অনেক মান্যগণ্য শিল্পীর নাম সর্বজনবিদিত।
এছাড়া, স্বাচ্ছন্দ্যের ধরনও এক নয়। দেউলেও একরকমের স্বচ্ছন্দ, নির্ভার। তাই বলে দেউলেপনা কতকানি কাম্য? আদিবাসী-জীবনের প্রসন্ন স্বস্তিময়তা কি অধিবাসীর জীবনের থাকে?
তা তো থাকেই না, বরং থাকে উল্টোটি- অর্থাৎ জটিলতা, ভারাক্রান্ততা। নাগরিক তার জাতিক জীবনটুকু নিয়েই ছিল হাঁসফাস, তার ওপর আজ সে হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক। তাকে ঘিরে বন বন ঘুরছে কেবল ‘ইস্যু’-র মিছিল অষ্টপ্রহর, তার সর্বত্র অনবরত আছড়ে পড়ছে দুনিয়ার যত প্রশ্ন, যেসব প্রশ্ন বিতর্ককবলিত আর সারা বিশ্ব কূটতর্কে মুখরিত তার প্রতিটি প্রকোষ্ঠে- কি জর্জরিত ভবের, কি মানবের মনের। আধুনিক মানুষকে তাই আজ এককালীন বহু কিছু জানতে হয়, শুনতে হয়, ভাবতে হয়, করতে হয়। এ জন্য সময়ের অপটিমাম বা সম্ভবশ্রেষ্ঠ সদ্ব্যবহারে সে এখন শুধু অভ্যস্তই নয়, বাধ্যও, বিকল্পে বরং সে রীতিমত বেকার বোধ করে।
অতএব সহজেই বোধ্য যে আজকের পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানের জন্য ভিন্ন ধরনের জোগানেরই প্রয়োজন- এবং সেটা কথাসাহিত্যেও।
0 মন্তব্যসমূহ