মোজাফ্ফর হোসেন
বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব সিরিয়াস সাহিত্যিকই কম বেশি শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। হয়ত একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাঁদেরকে এই কাজটা করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সকলে যে শতভাগ সফল হয়েছেন সে কথা বলা মুশকিল। শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাদের উপযোগী সাহিত্য রচনা করা চারটে খানিক কাজ না। তবে যেহেতু প্রত্যেক মানুষের ভেতরে, সে যত কঠিনই হোক না কেন, একটি করে শিশু বাস করে, বাস করে বিরাট একটা শৈশব, তাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে কাজটা বোধহয় আর ততটা কঠিন থাকে না।
হাসান আজিজুল হকের শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্যের বহর খুব সীমিত। এ-পর্যন্ত এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে যে দুটো বই আমরা পেয়েছি, তা হল-- ‘লাল ঘোড়া আমি’ ও ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। ‘লাল ঘোড়া আমি’ একটি উপন্যাসিকা বা বড় গল্প। অন্যটি একটি গল্পগ্রন্থ, সাতটি ক্ষীণকায় গল্প আছে এখানে। হাসানের অন্য কোনও লেখায় যে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ঘটেনি তা কিন্তু নয়। তাঁর বিখ্যাত ‘শকুন’ গল্পটির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে-- ‘কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়সা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল’। (‘শকুন’, ১৯৬০) কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুন কেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রি যাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরা গল্প। শেষ অবধি সেখান থেকে যে সত্য বের হয়ে আসে, সে সত্যের নাগাল শিশু-কিশোররা পায় না। এছাড়াও, গল্পটিতে গদ্যের গাঁথুনী, শব্দের সংস্থাপন, উপমার উপস্থাপন কোনকিছুই শিশু-কিশোর উপযোগী নয়। তাই শেষতক, গল্পটি হয়ে ওঠে একটি সিরিয়াস বড়দের গল্প। ‘শকুন’ গল্পের কিছুকাল পরেই রচনা করেন ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’ (১৯৬৩) গল্পটি। কিশোর রেজার বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও শারীরিক যে টানাপোড়েন তার উপস্থিতি ঘটেছে এই গল্পে। গল্পটি সর্বাশে কিশোর উপযোগী গল্প হয়ে উঠেছে। পরের বছর রচনা করেন আরও একটু গভীর জীবনবোধ সর্বস্ব ‘সারাদুপুর’ (১৯৬৪) গল্পটি। কাঁকন নামক নিঃসঙ্গ এক কিশোররের আত্মপোলব্ধির গল্প এটা। কাঁকন তার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। সে অনুভব করে-- ‘শীতে গাছের পাতাগুলোকে বিশ্রী দেখচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠাণ্ডা আর ঘাসের ভেতর রাস্তার রং দুধের মতো সাদা। ঘাস এখনও হলদে হয়নি -- হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো -- কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না।’ (‘সারাদুপুর’) বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে ওঠে তার হাহাকার, হতাশা ও জীবন সম্পর্কে কৌতূহল। গল্পটি হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এ অন্তর্ভুক্ত। অগ্রগণ্য আলোচকদের পাশাপাশি লেখক নিজেও হয়ত এটাকে বড়দের গল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আমি হলপ করে বলতে পারি, কিশোররাও এই গল্পের রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবে, চমৎকার এই গল্পের চমৎকারিত্বে চমৎকৃত হবে তাদের জীবনবোধ। হাসান আজিজুল হক আত্মজীবনী লিখেছেন দুই খণ্ডে, সেখানেও একজন শিশু ও কিশোর হাসান আজিজুল হকের জীবন বৃত্তান্ত বিধৃত হলেও সেটা মূলত বড়দের জন্যেই লেখা, শিশু-কিশোরদের জন্যে তা মোটেও সুখপাঠ্য হবে না।
প্রথম ভাগ : ‘লাল ঘোড়া আমি’
শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয় হাসান আজিজুল হক-এর কৃশকায় কিশোর উপন্যাস (নভেলা) ‘লাল ঘোড়া আমি’ (১৯৮৪)। এটি একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এ ধরনের বইকে ইংরেজিতে ‘ভরপঃরড়হধষ ঢ়ড়হু নড়ড়শ’ বলা হয়। ঘোড়াটি নিজেই বলে চলেছে তার আত্মকথা। হাসান আজিজুল হক এখানে একটি ঘোড়ার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, অর্থাৎ তিনি এখানে ঘোড়ার চোখ দিয়ে পৃথিবীর প্রকৃতি ও প্রাণিজগত প্রত্যক্ষ করছেন। আর প্রত্যক্ষ করছেন মানুষ। কখনো কখনো মনে হয়, তিনি ঘোড়ার মুখে ভাষা তুলে দিয়ে খানিকটা দূরে সটকে পড়েছেন, দূর থেকে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার চোখ দিয়ে দেখছেন নিজেকে বা টোটাল মানব সমাজকে। আবার কখনো কখনো মনে হয়, তিনি নিজেই ঘোড়ার দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন, সময় ও সুযোগ পেলে টীকা বা টিপ্পনী টুকতে ভুলছেন না। ঘটনা যায় হোক, ঘটানোর কাজটা সহজ না মোটেও।
বিশ্বসাহিত্যে এ-ধাঁচের বেশ কিছু রচনার সন্ধান মেলে। কানাডিয়ান লেখক সাউনডার লিখেছেন ‘সুন্দর জো : একটি কুকুরের আত্মজীবনী’ (১৯৩০)। এই উপন্যাসে একটি কুকুরছানার বেড়ে ওঠার কাহিনী ও মনিবের নিষ্ঠুর আচরনের আদ্যোপ্রান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে গল্প কথকের অবস্থানে অবতীর্ণ হয়েছে জো নামের একটি কুকুর। মিরান্ডা সোয়ান লিখেছেন ‘একটি বিড়ালের আত্মজীবনী’। তবে যে বইটির কথা এখানে বেশ গুরুত্ব সহকারে বলতে হচ্ছে সেটি হলো, আনা সুয়েল-এর লেখা একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘কালো সুন্দর’ (ইষধপশ ইবধঁঃু, ১৮৭৭; অহহধ ঝববিষষ, ১৮২০-১৮৭৮)। বইটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে যায়। উপন্যাসটি হাসান আজিজুল হক যে পড়েছেন সে কথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে ‘কালো সুন্দর’ উপন্যাসটির সাথে তাঁর ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসটির অনেক কিছুই মিলে যায়। কারণ হয়ত এটাই যে দুজনেই একটি ঘোড়ার আত্মজীবনী লিখছেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেরই বাসিন্দা হোক না কেনো, ঘোড়াদের জীবনের যে খুব বেশি হেরফের হয়না তা আমাদের সকলেরই জানা। দুটি উপন্যাসের ঘোড়াই দেখতে বেশ পরিপাটি-- একটির গায়ের গড়ন কুচকুচে কালো অন্যটির অসম্ভব লাল; তবে দুজনেরই পা সাদা এবং মাথার মাঝখানে সাদা একটি স্পট আছে। দুটি উপন্যাসই প্রথম পুরুষের বর্ণনায় লেখা (ঋরৎংঃ ঢ়বৎংড়হ হধৎৎধঃরাব) অর্থ্যাৎ বর্ণনাকারী হচ্ছে উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট ঘোড়া নিজেই। ‘কালো সুন্দর’ উপন্যাসে একটি কালো রঙের ঘোড়া হাত বদলের মাধ্যমে মানব সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে থাকে। এই জ্ঞান সবসময় সুখকর হয় না। ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে; শুধু স্থান, কাল, পাত্র ও প্রকাশের পদ্ধতিটা ভিন্ন-- পার্থক্য এই যা। দুটি উপন্যাসের মধ্যে আরও অনেক মিল লক্ষ্য করার মতো। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা শুধু হাসান আজিজুল হকের শিশু-কিশোর উপযোগী রচনাগুলোর মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।¬¬
‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসটির উপক্রমণিকা ঘটেছে এইভাবে-- ‘সে অনেককাল আগের কথা। তখন আমার চার বছর বয়েস।’ অর্থ্যাৎ হাসান আজিজুল হক মধ্যযুগীয় ‘ফোক টেল’ বা ‘ওরাল ট্রাডিশন’কে অনুসরণ করছেন। সাধারণত শিশু কিশোরদের কোনও অবিশ্বাস্য ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্যে তাকে চিলের মতোন ছোবল মেরে অন্য একটি সময়ে নিক্ষেপ করা হয়। তারপর যা বলা হয়, তা তখন তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। আলোচ্য গল্পেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। গল্পের কথক একজন ঘোড়া। গল্পের শুরুতেই সে আমাদেরকে তার বাল্যকালে নিক্ষেপ করেছে। সেখান থেকে এখন আর বের হবার জো নেই। বের হতে হলে গল্পের কথকের হাত ধরেই হতে হবে। মানুষ শৈশবে স্বভাবতই খুব গল্প প্রিয় হয়। তারা চায়, নাম্বির মতো কিংবা এ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনারের মতো কেউ একজন যাদুর জগত তৈরি করে গল্পের ফুলঝুড়ি ঝরাতে থাকুক আর তারা তা মন্ত্রমুদ্ধ হয়ে শুনতে থাকবে-- এর পরে কি ঘটে, তার পরে কি ঘটে! শিশু কিশোরদের এই মনস্তত্ত্বে মনঃসংযোগ ঘটিয়েই হাসান আজিজুল হক তাঁর এই উল্লেখযোগ্য উপন্যাসটি রচনা করেছেনে যেখানে একটি ঘোড়া বলে চলে তার আত্মকথা অর্থ্যাৎ সম্পূর্ণ গল্পটা বিধৃত হয় প্রথম পুরুষের বয়ানে।
আমরা জানি, কিশোররা সাধারণত ভূত-পেত্মী, দৈত্য-দানবের গল্প শুনে ভয় পেতে ভালোবাসে, দুঃসাহসিক গল্প শুনে শিউরে উঠতে পছন্দ করে, আর ভালোবাসে গল্পের অণুতে-পরমাণুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাসির আঁচে ঝলসে যেতে। হাসান আজিজুল হক এর সবটাই জানেন, জানেন বলেই তাঁর এ গল্পে এ সব উপকরণের কম বেশি বন্দবস্তও করেন। তবে এটা আলাদা ভাবে হাসির গল্প না, ভূত-পেত্মীর গল্পও না, আবার, গায়ে কাটা দেবার মতো কোনো এডভেঞ্চার নেই এখানে, নেই কোনো দানব আর দৈত্যপুরীর গল্প। এই গল্পের প্রটাগনিস্ট হল একটা ঘোড়া, ঘোড়ায় এখানে একমাত্র কথক বা বয়ন শিল্পী। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমরা এই গল্পে যতটা না ঘোড়াদের সম্পর্কে জানতে পারি তার থেকে ঢের বেশি জানতে পারি মানুষ সম্পর্কে। যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো সরাসরি বললে তো আর শিশু-কিশোররা শুনবে না, তাই হাসান আজিজুল হক একটি ফন্দি এঁটেছেন। গল্প যতো এগিয়ে যায়, বোঝা যায় কিশোররা তাঁর কৌশলে তৈরি করা ফাঁদে ফেঁসে গেছে-- তিনি তাঁর পাঠকদের হাসাচ্ছেন, হঠাত হঠাত করে একটু ভড়কে দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য অন্য কিছু। পাঠকরা কিশোর বয়সের স্বভাবজাত উচ্ছ্বাস নিয়ে গল্পটি শুরু করছে বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর কিশোর থাকছে না। হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে একটি ঘোড়ার মুখ থেকে জেনে নিচ্ছে এই জগত সংসারের গাঢ় ও গূঢ় রহস্য। ঘোড়ার বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশু কিশোরদের চিন্তা চেতনারও ট্রানসেন্ড ঘটছে। শেষের দিকে এসে পাঠকদের নির্দিষ্ট বয়স বলে আর কিছু থাকছে না।
‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের ঘোড়াটি দেখতে বেশ আজব। গায়ের রঙ টকটকে লাল, কপাল আর কানদু’টো ধবধবে সাদা, হাঁটুর নিচে থেকে পা দুটোও সাদা। এটা একটা শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পের ঘোড়া, তাই আর পাঁচটা ঘোড়া থেকে একটু আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। ঘোড়ার ভাষায়-- ‘পায়ের রঙ শাদা ছিল বলে যখন দৌঁড়াতাম লোকে ভাবত আমি বুঝি শূন্যে ভেসে যাচ্ছি।’ ঘোড়াটির কথা বলার পাশাপাশি আর যে সব মানবিক গুনাবলী আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিউমর করবার ক্ষমতা। হাসান আজিজুল হক নিজের আদলেই গড়ে তুলেছেন (চবৎংড়হরভরবফ) করেছেন ঘোড়াটিকে। কাজেই, ঘোড়াটিকে কখনও মনে হয় বড্ড রসিক আবার কখনও মনে হয় প্রচণ্ড সিরিয়াস।
খ.
উপন্যাসের স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে হাসির উপকরণ। তবে সেটার স্পর্শ পেতে হলে পাঠককে একটু সেনসিটিভ হতে হবে। এমনিতেই হাসান আজিজুল হক যথেষ্ট রসিক মানুষ-- সেটা তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তারা জানেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম পড়েও তা জানা যায়। তবে তাঁর মতো সিরিয়াস কথাসাহিত্যিক ফাজলামো করে হাসাবেন না এটাই স্বাভাবিক।
একটি ঘোড়া মানুষের সংস্কৃতি রপ্ত করে মানুষের ভাষায় কথা বলছে। সে বলছে--
‘চার পায়েই বাত হয়েছে বাত হয়েছে। পেছনের পায়ের হাঁটু ফুলে ওলকপির মতো হয়ে গেছে।’
কিংবা, ‘টাকাগুলো পেয়ে আমার মনিব আবার এমন পেঁচার মতো মুখ করে সেগুলো গুনতে লাগল যে আমার হাসি পেয়ে গেল। হাসির চোটে চিঁহিঁহিঁ করে ডেকে উঠলাম।’
ঘোড়াটির এইভাবে কথা বলার ধরন দেখে শিশু কিশোররা যথেষ্ট মজা পাবে। এতোদিন তারা দাদা-দাদি, নানা-নানির মুখ থেকে গল্প শুনে এসেছে। এখন তারা যতোবারই ভাবে যে তারা একটা ঘোড়ার সাথে কথা বলছে, তার মুখেই তার গল্প শুনছে ততবারই ভাবে-- কী আজব ঘোড়ারে বাবা ! আনন্দে আপ্লুত হয় তাদের মন।
এছাড়াও গল্পের বহু জায়গায় কখনো মুখ টিপে কখনোবা মুখের লাগাম ছেড়ে হাসতে হবে পাঠককে। ঘোড়াটির নতুন মনিবের ছেলে মেয়েরা তার সাথে কুকুরের এটাওটা নিয়ে তুলনা শুরু করলে ঘোড়াটি বলে ওঠে-- ‘আমি দেখলাম, আমার সম্মান আর থাকে না।...’ ঘোড়াটির সেন্স অব হিউমর আমাদের হাসতে বাধ্য করে। মনিবের গোয়াল ঘরে একটা সাদা বলদের সাথে ঘোড়াটির যে বাগ-বিতন্ডা হয় তাও হাসির উদ্রেগ ঘটায়। ঘোড়াটির পঞ্চম মনিব হোমিওপ্যাথ ডাক্তার যখন ওষুধ দিয়ে ভূতের সর্দি সারানোর গল্প করছিলেন তখন ঘোড়াটির সাথে সাথে আমরাও না হেসে পারি না।
গ.
গল্পের প্রধান চরিত্র ঘোড়া হলেও, এটি ঘোড়াদের সমাজের গল্প নয়। ঘোড়ার চোখে দেখা মানবপ্রকৃতির বর্ণনা উঠে এসেছে গল্পটির আদ্যো-প্রান্ত জুড়ে। মানুষ সম্পর্কে একটা বলিষ্ট ধারনা শিশু-কিশোররা পাবে এই গল্পটি পাঠ থেকে। তবে এই ধারনা সুখকর নয় মোটেও। গল্পের বিভিন্ন অংশে মানুষ সম্পর্কে প্রথম যে স্টেটমেন্টগুলো প্রদান করা হয়েছে সেদিকে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে বিষয়টি--
‘তবে তারা (মানুষ) প্রায়ই মিথ্যে কথা বলে তা আমি অনেকবার দেখেছি।’
‘বিনা কারণে হল্লা করা মানুষের স্বভাব।’
‘মানুষরা নিজেরা প্রায়ই ভালো হয় না। তবে তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক সময় ভালোই হয়।’
‘মানুষের এই আর একটা বদ অভ্যাস, খালি তোষামোদ করবে আর পিঠ চাপড়াবে।’
‘কেমন খারাপ স্বভাব দ্যাখো এই মানুষ জাতের! তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করবে তাও আমাদের পিঠের উপর চড়ে। আমাদের স্বভাব আগে ভালোই ছিল। মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে এখন আমাদের স্বভাবও অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘মানুষের বাচ্চা তো! লাই দিলেই মাথায় চড়ে বসবে।’
‘যে আমার পিঠে চড়বে বলেছিল, সে তখন এগিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে ঠোঁটদুটোকে ছুঁচোর মতো করে চুঁঅক চুঁঅক শব্দ করতে লাগল। মানুষের মুখের এই শব্দটা শুনতে আমার ঘেন্না লাগে। এমন বিচ্ছিরি শব্দ মানুষ ছাড়া আর কোনো জানোয়ার করতে পারে না।’
‘সেই আমার জীবনে প্রথম বিনা কারণে মার খাওয়া। তার পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি, বিনা কারণে মারধোর করাই মানুষের স্বভাব। নিজেদের মধ্যেও তারা তাই করে। মানুষের বদমায়েশির এত প্রমাণ আমি পেয়েছি যে আজকাল আর একটুও অবাক হই না।’
‘আর মানুষ প্রায় সবাই সমান পাজি। যদি তেমন কোনো জায়গা থাকত যেখানে মানুষ নেই, তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে চলে যেতাম।’
‘ঘোড়ায় ঘোড়ায় তফাত কিছু আছে বটে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের একি তফাত! আমার প্রথম মনিব তো বলতে গেলে ছিল ভিখিরি। জমিদারবাবু যদি মানুষ হন, তাহলে আমার প্রথম মনিবও মানুষ নয়, দ্বিতীয় মনিবও নয়।’
‘ময়লা কাগজে (টাকা) দারোগা সায়েবের পকেট ফুলে উঠতো।’
‘...মানুষরা এই ময়লা কাগজগুলো (টাকা) খুব ভালোবাসে।’
‘একদিন তার (ডাক্তার) গল্প শুনে আমিও তাজ্জব বনে গেলাম। এমন ডাহা মিথ্যেও মানুষ বলে!
মানুষের দৈহিক বর্ণনাও করা হয়েছে নেতিবাচক ভাবে। প্রথম মনিব সম্পর্কে ঘোড়াটির মন্তব্য ছিল-- মানুষদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে খারাপ দেখতে। তার মুখ দিয়ে এমন থুথু আর পচা গন্ধ বেরুত যে ঘেন্নায় তার (ঘোড়াটির) গা পাক দিত। দ্বিতীয় মনিব সম্পর্কে তার উক্তি-- ‘মুগুরের মতো চেহারা লোকটার।’ ঘোড়াটি দারোগার বিবরণ দিয়েছে এই বলে-- ‘লোকটা ভীষণ ভারি। জালার মতো পেট। চর্বির গরমে সব সময়েই হাঁশফাঁশ করছেন।’ ঘোড়াটির পঞ্চম মনিব সম্পর্কে তার উক্তি হচ্ছে-- ‘প্যাঁকাটির মতো রোগা লম্বা চেহারা ডাক্তারের। চেয়ারে বসে আছেন যেন নেংটি ইঁদুর।’ এবং ‘ছোট ন্যাড়া মাথাটি তাঁর ঠিক বেলের মতো,..’
মানুষের ভেতর ও বাইরের যে রূপ এখানে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে তাকে কোন ক্রমেই অস্বীকার করবার উপায় নেই। এজন্যেই, ঘোড়ার মতো প্রাণীকুলের অন্যান্য সদস্যরাও যদি প্রশ্ন করে বসে-- ‘মানুষ আবার দেখতে সুন্দর হল কবে?’ তাহলে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানুষের পক্ষে বড় মুশকিল হয়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন হল অন্যখানে। হাসান আজিজুল হক শিশু-কিশোরদের জন্যে একটা উপন্যাস লিখছেন, খুবই ভাল কথা, তো সেখানে মানুষকে এমন নৈরাশ্যজনকভাবে উপস্থাপন করা কেন? শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পে তিনি কেনইবা শিশু-কিশোরদের কথা না বলে হাজার বছর ধরে চলে আসা, বুড়ো, মরচেপড়া মানব সভ্যতার কথা বলছেন? জমিদারের বিভৎস অত্যাচারের অনেক খোলামেলা উপস্থাপন এবং জমিদারের শেষ পরিণতির বিবরণ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে-- শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পে এত সাংঘাতিক ঘটনার বিবরণ কেন? কারণ হয়ত এটাই যে তিনি শিশু-কিশোরদের নিচ্ছক বিনোদন দেবার জন্যে লিখছেন না। সাহিত্যের কাজ তো সঙ্গীতের মতো মানুষের মনোরঞ্জন করা নয় আবার ধর্মগ্রন্থের মতো জীবন যাপনের একটি নির্দিষ্ট মানচিত্র এঁকে দেয়াও নয়, সাহিত্যের কাজ হলো মানুষের মানসিক রোগ বা সমস্যাগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করা (ংঃঁফু ড়ভ যঁসধহ ফরংবধংব)। কাজেই সাহিত্য-সচেতন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক খানিকটা শিশু-কিশোরদের অবস্থানে নেমে এসে এবং কিছুটা নিজের অবস্থানে অবস্থান করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মানুষের ভেতরকার নোংরামির কথা। মানুষের ভেতর-বাহির নেড়েচেড়ে ওলটপালট করে দেখিয়ে দিচ্ছেন মানুষ হওয়ার যন্ত্রণাটা আসলে কোথায়। এইদিক থেকে গল্পটি একটি স্যোসাল-পলিটিক্যাল এলিগরি। ঘোড়াটি এমন একটি শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে যে শ্রেণির মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক সবদিক থেকে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের সবকিছুই সহ্য করতে হয় নীরবে। ভাষা থেকেও যেন ঘোড়াটির মতোই ভাষাহীন তারা।
বরাবরই হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে প্রাণিজগত শক্তিশালী ইমেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাঁর সাহিত্যে খুব সাধারণ একটি শকুন, সাপ, ষাড়, হরিণছানা এবং আলোচ্য গল্পের লাল ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, বলদ, কুকুর প্রত্যেকে সিম্বলিক অর্থ বহন করে।
লাল ঘোড়ার মুখের কথাগুলো যদি হাসান আজিজুল হকের মুখের কথা হিসেবে ধরে নিই, তাহলে তাঁকে আপাত দৃষ্টিতে বেশ নিরাশাবাদী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি আসলে বাস্তববাদী। তাইতো তিনি মানুষের ভালো রূপটিকেও একেবারে এড়িয়ে যাননি। ঘোড়াটি যখন বলে-- ‘...হাশেমের মা যে একদিন রাতের বেলা আমার কপালে হাত দিয়ে বলেছিল, ঠিক যেন চাঁদের মতন-- সে আনন্দ কোদিন ভুলতে পারব! আসলে ভালবাসা একটি আলাদা ব্যাপার।’ এবং নানান সমস্যার কথা জানান দিয়ে ঘোড়াটি যখন বলে-- ‘কিন্তু যাই-ই বল দেশটা আমার ভালো লাগত।’ তখন আমরা জীবনের প্রকৃত সত্যটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ঘোড়াটি যখন মৃত্যুসজ্জায় তখন সে চোখ বুঝতেই দেখতে পায় তার মাকে, অতঃপর দেখে হাশেমের মা ও হাশেমকে-- যেন শেষপর্যন্ত ভালবাসার কাছে পরাজিত হয় সবকিছু। বস্তুত, লেখক এখানে একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেননি। তিনি নির্মম বাস্তবের অসহায় দর্শক। শিশু-কিশোরদের আসন্ন এই পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত করে তোলায় হয়ত তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি বলতে চাচ্ছেন-- আর কত ভুলিয়ে রাখা, সত্যটা তারা এবার জানুক !
ঘ.
‘লাল ঘোড়া আমি’ গল্পে হাসান আজিজুল হক বেশ সহজ সরল ভাষা ব্যবহার করেছেন। কথাসাহিত্যে তাঁর যে মজবুত ভাষার বুনন তা কিছুটা হলেও ঢিলে করেছেন শিশু-কিশোর সাহিত্যে এসে। একটি ঘোড়ার মুখ থেকে আমরা পুরো গল্পটা শুনছি, তাই ভাষা সরল হওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে ভুলে গেলে চলবে না-- ঘোড়াটা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের, তাই এই গল্পের ভাষা যে তাঁর সহজাত ঢঙ থেকে বের হতে পারবে না সেটাও খুব স্বাভাবিক।
গল্পে প্রকৃতির বনর্ণা এবং উপমা (ঝরসরষব) ও রূপকের (সবঃধঢ়যড়ৎ) ব্যবহার লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে তাঁর ভাষা নিয়ে খেলবার শৈল্পিক দক্ষতা কতখানি। বিষয়টি আরও পরিস্কার করার জন্যে টেক্সটের কিছু যায়গায় দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে--
‘পেছনের দু পায়ের হাঁটু ফুলে ওলকপির মতো হয়ে গেছে।’
‘আকাশে চাঁদ উঠেছে আর সেই চাঁদের আলোয় সমস্ত মাঠ ভেসে যাচ্ছে।’
‘এখন দেখলাম সেই মাঠের এক কোণে সূয্যি ঢলে পড়েছে আর তার এক কিনার দিয়ে দেশলাইয়ের বাকসের মতো একটা লাল রঙের ট্রেন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।’
‘গায়ের রঙ লাল টকটকে, রক্ত যেন ফেটে পড়ছে। চওড়া ছাতি দেখে মনে হয় যেন একজোড়া মজবুত দরজা। ...চোখদুটো তাঁর জবা ফুলের মতো লাল। তারপর যখন কথা বললেন, মনে হল মেঘ ডেকে উঠল গরগর শব্দে।’
‘কি রকম সোনার চাদরের মতো রোদ আকাশ থেকে নেমে এসে মাঠঘাট গাছপালার উপর বিছিয়ে রয়েছে।’
‘একটু পরে পুবদিকে চাঁদ উঠল গোল একটা সোনার থালার মতো।’
উপমাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে তিনি বেশ সচেতন ভাবেই সেগুলো ব্যবহার করছেন যাতে করে গল্পের মেজাজটা বা শিল্পের জায়গাটা অক্ষুন্ন থাকে সাথে পাঠকদেরও বুঝতে অসুবিধা না হয়। তবে এই সময়ের শিশু-কিশোর, যারা এই গল্পের টার্গেট রিডার, তাদের কাছে অতি সুখপাঠ্য হবে গল্পটি, এমন আশা আমি করছি না। এর প্রধান কারণ হল মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান-- যে ঘোড়াটির কথা এখানে বলা হচ্ছে সে হলো জমিদার আমলকার। তখনকার গ্রামীণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। তাই পাঠকদের গল্পের ভেতরে প্রবেশ করতে খানিকটা সময় লাগবে। তাছাড়া যে উপমাগুলো এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তার সবটা তাদের পক্ষে ধরা মুশকিল। এছাড়াও, কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার এখানে করা হয়েছে, যেমন-- মুগুর, প্যাকাটি, দুদ্দাড়, রগড়াতে রগড়াতে ইত্যাদি, যে শব্দগুলো বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোর, বিশেষ করে শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের পক্ষে বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তবে তাদের মধ্যে যারা এডভান্স রিডার, যাদের সাহিত্যরস আস্বাদন করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের কাছে যে গল্পটির যথেষ্ট আবেদন তৈরি হবে সে কথা নিশ্চত করে বলা যায়।
দ্বিতীয় ভাগ : ‘ফুটবল থেকে সাবধান’
‘ফুটবল থেকে সাবধান’ গল্পগ্রন্থে সাতটি গল্প আছে। প্রথম গল্প ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। এই গল্পটি ভল্টু, পল্টু ও লেদু নামক তিনজন কিশোরকে ঘিরে। নামগুলোর মতো গল্পটাও বেশ মজার। ফুটবল খেলতে গিয়ে ভল্টুর পা ভেঙ্গে যায়। ভল্টুর পা ‘টেনিস বলের’ মতো ফুলে ওঠে। সে প্রতিজ্ঞা করে ‘জীবনে আর আমি ফুটবলের চেহারা দেখবো না’। বাড়িতে এই খবরটা ফাঁস হয়ে গেলে বিপদ বাড়বে বয় কমবে না, তাই তো ভল্টু ভান করে বিছানায় পড়ে থাকে আর অন্যদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-- ‘হায়রে, আমার কি এমন কেউ আছে যে দুটো খাবার এনে দেয় এখানে! আমার জন্যে একটু ভাবে এমন কেউ নেই এ বাড়িতে। এই যে এখন আমি অ্যালজেব্রা কষব-- আর সেসব কী সাংঘাতিক সাংঘাতিক অ্যালজেব্রা-- ভাবলে নাড়িভুড়ি বাইরে চলে আসে-- সে সম্বন্ধে কারুর কি কোনো ভাবনাচিন্তা আছে?’ আবার যখন অতি কষ্টে সে বাড়ির বাইরে যাবার চেষ্টা করে তখন বাবা সামনে পড়ে গেলে বলে, ‘ভল্টু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এমন মারাত্মক একটা হাসি ছাড়লো যে আব্বার মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়’। বাবা কোথায় যাচ্ছে জানতে চায়লে সে বলে-- ‘জি না, আমার কিছু হয়নি’-- চোরের মন যে পুলিশ পুলিশ সে কথা আমাদের সকলেরই জানা! এমন সব হাসি-উদ্দীপক সহজ সরল বর্ণনার মধ্যে দিয়ে গল্পটি এগিয়ে যায়। গল্পটিতে মাস্টার মশাইয়ের শরীরের বর্ণনা ও তাঁর গালির ধরন কিশোর মনে হাসির উদ্রেগ ঘটাতে বাধ্য।
‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপাথি’ গল্পটিও বেশ মজার। গাঁয়ে তোরাপ ও অঘোর নামে দুজন ডাক্তার ছিল-- একজন হোমিওপ্যাথ, অন্যজন অ্যালোপাথ। তারা কীভাবে ডাক্তার হয়েছে তা কেউ জানে না। অ্যালোপাথ তোরাপ ডাক্তারের চিকিৎসার ধরনটাই এমন যে তাকে দেখলেই রোগীর পিলে চমকে যেত এবং রোগ সটকে পড়তো। আর হোমিওপ্যাথ অঘোর ডাক্তারের ওষুধ হাতে নিয়েই রোগী জিজ্ঞেস করতো-- ‘ডাক্তারবাবু ভালো হবে তো?’ তারা আবার একে অন্যের জন্ম শত্র“। দুজনই সুবিধাবাদি ডাক্তার, রোগীর থেকে আয় রোজগারের দিকে নজর বেশি। এ ধরনের হাতুড়ে ডাক্তার গ্রামে গঞ্জে এখনো লক্ষ্য করা যায়। আর এখনকার শহরের শিক্ষিত ডাক্তাররা তো ডাকাতকেও হার মানাবে। গল্পটির ভাষা বেশ সরল হলেও হাসান আজিজুল হকের সহজাত গদ্য ঢঙ দু’এক জায়গায় চোখে পড়ে; যেমন, তিনি এক জায়গায় বলছেন-- ‘তোরাপ ডাক্তারের দেহের কাঠামো ছিল বিরাট-- কিন্তু কেমন যেন লোনা-ধরা পুরোনো ইটের বাড়ির মতো। সারা দেহটা তাঁর হলবল নড়বড় করছে!’
‘লড়াই মানে ফাইট’ গল্পটি সব শ্রেণির পাঠকের পাঠ করার মতো। বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পও বোধহয় এটি। গল্পের ছেলেটির নাম নসু। মা বাদে সবাই তাকে নস্যা বলে ডাকে। ছেলেটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে যখন বলে-- “...আমার একটা হাত, একটা পা কাজের না হলে কী হবে, আমি খুব ‘ফাইট’ করতে পারি। ‘ফাইট’ না করে আমি কোনকিছু ছেড়ে দিই না।...আমি জানি, ‘ফাইট’ না দিলে বাঁচতে পারব না।” তখন মানব সভ্যতার অতি নির্মম একটি সত্য বের হয়ে আসে। শুধু বিকলাঙ্গ নসু না, ফাইট করে বেঁচে থাকে নসুর নিংস্ব মাও। তারা ফাইট করে মাটি, শীত, রাতের অন্ধকার, ড্রেনের নোংরা পানি, যানবাহন, ক্ষুধা, ডাস্টবিন, কুকুর আর মানুষের সাথে। নসু বলে-- ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখছি, দুনিয়ায় এত জিনিস, তা দুনিয়া আমাদের কিচ্ছুটি দেবে না, খালি ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে সরাবে। মনে হয়, দুনিয়ার মতলব হচ্ছে আমাদের ধাক্কা দিয়ে একেবারে কিনারায় নিয়ে গড়িয়ে ফেলে দেয়া।’ নসুর মতো যারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে তাদের ব্যথা ধারন করেই যেনো গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩৬) বলেছেন-- ‘...সংসারে কোন কিছুরই অভাব নেই, তবু দুনিয়ার অজস্র ধন সম্পদের সামনে জনগণ অনশনে, ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটায়।...চারিদিকে এত অঢেল খাবার অথচ তারা ক্ষিদের অনলে জ্বলবে কেন? চারিদিকে এত বুদ্ধির আলো তবে ওরা এত অন্ধকারে থাকে কেন?’ (মা, ১৯০৬; তর্জমায় : বর্তমান আলোচক)
এই বইয়ের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের নাম হল ‘চরু’। চরু একটি হরিণছানার নাম। একদল শিকারি চরুর মাকে বন্দুক দিয়ে শিকার করে তারপর মহল্লায় এনে তার মাংস টুকরো টুকরো করে কেটে গাঁয়ে বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়ে, শুধু পড়ে থাকে ‘বাদামির ওপর সাদা ছিটেঅলা চামড়াটা আর দুটো নীল চোখ-অলা শিংসুদ্ধ মাথাটা।’ চরু এসবের নীরব সাক্ষী। মায়ের সাথে সাথে তাকেও ধরে আনা হয়েছে। কারণ, তাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তুলতে পারলে আরও কিছু কামানো যাবে। চরুর শিশু মন এখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করে-- হালুম-এর থেকেও দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ সব পশু বাস করে ডাঙায়, হয়ত তাদের হাত থেকে বাঁচতেই তার মার মতো অনেক পশু পাখি আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। তবে চরুর ভাগ্য ভালো যে ঐ বাড়ির বোবা কালা ছেলেটি এখনও পৃথিবীর হালচাল বোঝেনি। তার শিশু মন অবলা হরিণছানাটির মতোই পবিত্র তাইতো তারা প্রকৃতিগত ভাবেই একে অন্যের আপনজন হয়ে ওঠে। তাদের সখ্য বোঝবার ক্ষমতা এই নিষ্ঠুর সভ্যতার নেই, ফলত তারা অপেক্ষা করে কবে হরিণছানাটি ভোগ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। তাদের সেই সুযোগ আর হয় না। বোবা কালা ছেলেটি হরিণছানাটিকে জবাই করার ঠিক আগ মুহুর্তে নদীর ওপারে জঙ্গলে রেখে আসে। একটি বোবা কালা ছেলের কাছে পরাজিত হয় তথাকথিত সুস্থ কিছু মানুষ কিংবা বলা যায় আমাদের প্রতিষ্ঠিত এই টোটাল সমাজ ব্যবস্থা। এখানেই হাসান আজিজুল হকের বিশেষত-- সুন্দর ও সত্যের জয় যেনো অবধারিত।
‘ভূতে বিশ্বাস নেই’, ‘গজভুক্ত কপিত্থ’ ও ‘ব্যাঘ্রবধের ব্যাপার’ গল্প তিনটি শিশু কিশোরদের জন্যে বেশ সুখপাঠ্য হবে সে কথা নির্দিধায় বলা যায়। এই গল্পগুলোতে হাসানের গদ্যের বেশ খানিকটা হেরফের ঘটেছে। তিনি হয়ত সচেতন ভাবেই স্রেফ মজা করার জন্যে এই গল্পগুলো রচনা করেছেন। যেমন, ‘ব্যাঘ্রবধের ব্যাপার’ গল্পের শেষটার কথায় ধরা যাক-- বাঘটিকে মেরে ফেলার পর মাধাই উঠে দাড়ালো এক মুখ হাসি নিয়ে। তার কাঁধ বেয়ে রক্ত ঝরছে অথচ তার অট্টহাসি থামছেই না। পরে দেখা গেল, বাঘ ডান গালের সব মাংস তুলে নিয়েছে, ফলে সব দাঁত বের হয়ে গেছে। ‘মাংস চামড়াই নেই, দাঁত ঢাকবে কী দিয়ে? ভালো হয়ে গিয়েছিল সে তিন মাস পর। কিন্তু হাসি আর থামাতে পারেনি। হেসেই গেল চিরদিন। বোধহয় মরবেও হাসতে হাসতে।’ ‘গজভুক্ত কপিত্থ’ গল্পটি নিয়ে একটু মজা করে সুশীল সাহা তাঁর একটি সমধর্মী আলোচনায় লিখেছেন-- “ভাগ্যিস এমন দুর্বল গল্পও তিনি লিখেছেন, নইলে ‘লড়াই মানে ফাইট’ কিংবা ‘চরু’-র শ্রেষ্ঠত্ব কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হত!” (কিশোরমনের তলকুঠুরী : কথা সাহিত্যের অন্য আর এক ভূবনের প্রেক্ষিতে হাসান আজিজুল হক, ‘মহাযান’)
হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকে আর কোন শিশু-কিশোর উপযোগী রচনা আমরা পাবো কি-না জানি না। হয়ত ইচ্ছা থাকলেও বড় কোনও কাজের চাপে সে ফুসরত তিনি পাবেন না। তবুও যে গুটি কতক রচনা তিনি লিখেছেন সেটা উপযুক্ত পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারলে তাঁর শ্রম সার্থক হবে। আলাদা করে ‘লাল ঘোড়া আমি’, ‘তরু’ ও ‘লড়াই মানে ফাইট’ গল্পগুলোর কথা বলা যেতে পারে। শিশু-কিশোরদের জন্যে শিক্ষামূলক বিনোদন হিসেবে এই রচনাগুলো যথেষ্ট মনোযোগের দাবীদার বলে মনে করছি।
মোজাফ্ফর হোসেন
সম্পাদক, শাশ্বতিকী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজশাহী।
০১৭১৭ ৫১৩০২৩
বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব সিরিয়াস সাহিত্যিকই কম বেশি শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। হয়ত একটা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাঁদেরকে এই কাজটা করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সকলে যে শতভাগ সফল হয়েছেন সে কথা বলা মুশকিল। শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাদের উপযোগী সাহিত্য রচনা করা চারটে খানিক কাজ না। তবে যেহেতু প্রত্যেক মানুষের ভেতরে, সে যত কঠিনই হোক না কেন, একটি করে শিশু বাস করে, বাস করে বিরাট একটা শৈশব, তাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে কাজটা বোধহয় আর ততটা কঠিন থাকে না।
হাসান আজিজুল হকের শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্যের বহর খুব সীমিত। এ-পর্যন্ত এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে যে দুটো বই আমরা পেয়েছি, তা হল-- ‘লাল ঘোড়া আমি’ ও ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। ‘লাল ঘোড়া আমি’ একটি উপন্যাসিকা বা বড় গল্প। অন্যটি একটি গল্পগ্রন্থ, সাতটি ক্ষীণকায় গল্প আছে এখানে। হাসানের অন্য কোনও লেখায় যে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ঘটেনি তা কিন্তু নয়। তাঁর বিখ্যাত ‘শকুন’ গল্পটির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে-- ‘কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়সা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল’। (‘শকুন’, ১৯৬০) কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুন কেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রি যাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরা গল্প। শেষ অবধি সেখান থেকে যে সত্য বের হয়ে আসে, সে সত্যের নাগাল শিশু-কিশোররা পায় না। এছাড়াও, গল্পটিতে গদ্যের গাঁথুনী, শব্দের সংস্থাপন, উপমার উপস্থাপন কোনকিছুই শিশু-কিশোর উপযোগী নয়। তাই শেষতক, গল্পটি হয়ে ওঠে একটি সিরিয়াস বড়দের গল্প। ‘শকুন’ গল্পের কিছুকাল পরেই রচনা করেন ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’ (১৯৬৩) গল্পটি। কিশোর রেজার বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও শারীরিক যে টানাপোড়েন তার উপস্থিতি ঘটেছে এই গল্পে। গল্পটি সর্বাশে কিশোর উপযোগী গল্প হয়ে উঠেছে। পরের বছর রচনা করেন আরও একটু গভীর জীবনবোধ সর্বস্ব ‘সারাদুপুর’ (১৯৬৪) গল্পটি। কাঁকন নামক নিঃসঙ্গ এক কিশোররের আত্মপোলব্ধির গল্প এটা। কাঁকন তার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। সে অনুভব করে-- ‘শীতে গাছের পাতাগুলোকে বিশ্রী দেখচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠাণ্ডা আর ঘাসের ভেতর রাস্তার রং দুধের মতো সাদা। ঘাস এখনও হলদে হয়নি -- হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো -- কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না।’ (‘সারাদুপুর’) বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে ওঠে তার হাহাকার, হতাশা ও জীবন সম্পর্কে কৌতূহল। গল্পটি হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এ অন্তর্ভুক্ত। অগ্রগণ্য আলোচকদের পাশাপাশি লেখক নিজেও হয়ত এটাকে বড়দের গল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আমি হলপ করে বলতে পারি, কিশোররাও এই গল্পের রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবে, চমৎকার এই গল্পের চমৎকারিত্বে চমৎকৃত হবে তাদের জীবনবোধ। হাসান আজিজুল হক আত্মজীবনী লিখেছেন দুই খণ্ডে, সেখানেও একজন শিশু ও কিশোর হাসান আজিজুল হকের জীবন বৃত্তান্ত বিধৃত হলেও সেটা মূলত বড়দের জন্যেই লেখা, শিশু-কিশোরদের জন্যে তা মোটেও সুখপাঠ্য হবে না।
প্রথম ভাগ : ‘লাল ঘোড়া আমি’
শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয় হাসান আজিজুল হক-এর কৃশকায় কিশোর উপন্যাস (নভেলা) ‘লাল ঘোড়া আমি’ (১৯৮৪)। এটি একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এ ধরনের বইকে ইংরেজিতে ‘ভরপঃরড়হধষ ঢ়ড়হু নড়ড়শ’ বলা হয়। ঘোড়াটি নিজেই বলে চলেছে তার আত্মকথা। হাসান আজিজুল হক এখানে একটি ঘোড়ার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, অর্থাৎ তিনি এখানে ঘোড়ার চোখ দিয়ে পৃথিবীর প্রকৃতি ও প্রাণিজগত প্রত্যক্ষ করছেন। আর প্রত্যক্ষ করছেন মানুষ। কখনো কখনো মনে হয়, তিনি ঘোড়ার মুখে ভাষা তুলে দিয়ে খানিকটা দূরে সটকে পড়েছেন, দূর থেকে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার চোখ দিয়ে দেখছেন নিজেকে বা টোটাল মানব সমাজকে। আবার কখনো কখনো মনে হয়, তিনি নিজেই ঘোড়ার দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন, সময় ও সুযোগ পেলে টীকা বা টিপ্পনী টুকতে ভুলছেন না। ঘটনা যায় হোক, ঘটানোর কাজটা সহজ না মোটেও।
বিশ্বসাহিত্যে এ-ধাঁচের বেশ কিছু রচনার সন্ধান মেলে। কানাডিয়ান লেখক সাউনডার লিখেছেন ‘সুন্দর জো : একটি কুকুরের আত্মজীবনী’ (১৯৩০)। এই উপন্যাসে একটি কুকুরছানার বেড়ে ওঠার কাহিনী ও মনিবের নিষ্ঠুর আচরনের আদ্যোপ্রান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে গল্প কথকের অবস্থানে অবতীর্ণ হয়েছে জো নামের একটি কুকুর। মিরান্ডা সোয়ান লিখেছেন ‘একটি বিড়ালের আত্মজীবনী’। তবে যে বইটির কথা এখানে বেশ গুরুত্ব সহকারে বলতে হচ্ছে সেটি হলো, আনা সুয়েল-এর লেখা একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘কালো সুন্দর’ (ইষধপশ ইবধঁঃু, ১৮৭৭; অহহধ ঝববিষষ, ১৮২০-১৮৭৮)। বইটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে যায়। উপন্যাসটি হাসান আজিজুল হক যে পড়েছেন সে কথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে ‘কালো সুন্দর’ উপন্যাসটির সাথে তাঁর ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসটির অনেক কিছুই মিলে যায়। কারণ হয়ত এটাই যে দুজনেই একটি ঘোড়ার আত্মজীবনী লিখছেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেরই বাসিন্দা হোক না কেনো, ঘোড়াদের জীবনের যে খুব বেশি হেরফের হয়না তা আমাদের সকলেরই জানা। দুটি উপন্যাসের ঘোড়াই দেখতে বেশ পরিপাটি-- একটির গায়ের গড়ন কুচকুচে কালো অন্যটির অসম্ভব লাল; তবে দুজনেরই পা সাদা এবং মাথার মাঝখানে সাদা একটি স্পট আছে। দুটি উপন্যাসই প্রথম পুরুষের বর্ণনায় লেখা (ঋরৎংঃ ঢ়বৎংড়হ হধৎৎধঃরাব) অর্থ্যাৎ বর্ণনাকারী হচ্ছে উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট ঘোড়া নিজেই। ‘কালো সুন্দর’ উপন্যাসে একটি কালো রঙের ঘোড়া হাত বদলের মাধ্যমে মানব সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে থাকে। এই জ্ঞান সবসময় সুখকর হয় না। ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে; শুধু স্থান, কাল, পাত্র ও প্রকাশের পদ্ধতিটা ভিন্ন-- পার্থক্য এই যা। দুটি উপন্যাসের মধ্যে আরও অনেক মিল লক্ষ্য করার মতো। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা শুধু হাসান আজিজুল হকের শিশু-কিশোর উপযোগী রচনাগুলোর মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।¬¬
‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসটির উপক্রমণিকা ঘটেছে এইভাবে-- ‘সে অনেককাল আগের কথা। তখন আমার চার বছর বয়েস।’ অর্থ্যাৎ হাসান আজিজুল হক মধ্যযুগীয় ‘ফোক টেল’ বা ‘ওরাল ট্রাডিশন’কে অনুসরণ করছেন। সাধারণত শিশু কিশোরদের কোনও অবিশ্বাস্য ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্যে তাকে চিলের মতোন ছোবল মেরে অন্য একটি সময়ে নিক্ষেপ করা হয়। তারপর যা বলা হয়, তা তখন তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। আলোচ্য গল্পেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। গল্পের কথক একজন ঘোড়া। গল্পের শুরুতেই সে আমাদেরকে তার বাল্যকালে নিক্ষেপ করেছে। সেখান থেকে এখন আর বের হবার জো নেই। বের হতে হলে গল্পের কথকের হাত ধরেই হতে হবে। মানুষ শৈশবে স্বভাবতই খুব গল্প প্রিয় হয়। তারা চায়, নাম্বির মতো কিংবা এ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনারের মতো কেউ একজন যাদুর জগত তৈরি করে গল্পের ফুলঝুড়ি ঝরাতে থাকুক আর তারা তা মন্ত্রমুদ্ধ হয়ে শুনতে থাকবে-- এর পরে কি ঘটে, তার পরে কি ঘটে! শিশু কিশোরদের এই মনস্তত্ত্বে মনঃসংযোগ ঘটিয়েই হাসান আজিজুল হক তাঁর এই উল্লেখযোগ্য উপন্যাসটি রচনা করেছেনে যেখানে একটি ঘোড়া বলে চলে তার আত্মকথা অর্থ্যাৎ সম্পূর্ণ গল্পটা বিধৃত হয় প্রথম পুরুষের বয়ানে।
আমরা জানি, কিশোররা সাধারণত ভূত-পেত্মী, দৈত্য-দানবের গল্প শুনে ভয় পেতে ভালোবাসে, দুঃসাহসিক গল্প শুনে শিউরে উঠতে পছন্দ করে, আর ভালোবাসে গল্পের অণুতে-পরমাণুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাসির আঁচে ঝলসে যেতে। হাসান আজিজুল হক এর সবটাই জানেন, জানেন বলেই তাঁর এ গল্পে এ সব উপকরণের কম বেশি বন্দবস্তও করেন। তবে এটা আলাদা ভাবে হাসির গল্প না, ভূত-পেত্মীর গল্পও না, আবার, গায়ে কাটা দেবার মতো কোনো এডভেঞ্চার নেই এখানে, নেই কোনো দানব আর দৈত্যপুরীর গল্প। এই গল্পের প্রটাগনিস্ট হল একটা ঘোড়া, ঘোড়ায় এখানে একমাত্র কথক বা বয়ন শিল্পী। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমরা এই গল্পে যতটা না ঘোড়াদের সম্পর্কে জানতে পারি তার থেকে ঢের বেশি জানতে পারি মানুষ সম্পর্কে। যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো সরাসরি বললে তো আর শিশু-কিশোররা শুনবে না, তাই হাসান আজিজুল হক একটি ফন্দি এঁটেছেন। গল্প যতো এগিয়ে যায়, বোঝা যায় কিশোররা তাঁর কৌশলে তৈরি করা ফাঁদে ফেঁসে গেছে-- তিনি তাঁর পাঠকদের হাসাচ্ছেন, হঠাত হঠাত করে একটু ভড়কে দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য অন্য কিছু। পাঠকরা কিশোর বয়সের স্বভাবজাত উচ্ছ্বাস নিয়ে গল্পটি শুরু করছে বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর কিশোর থাকছে না। হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে একটি ঘোড়ার মুখ থেকে জেনে নিচ্ছে এই জগত সংসারের গাঢ় ও গূঢ় রহস্য। ঘোড়ার বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশু কিশোরদের চিন্তা চেতনারও ট্রানসেন্ড ঘটছে। শেষের দিকে এসে পাঠকদের নির্দিষ্ট বয়স বলে আর কিছু থাকছে না।
‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসের ঘোড়াটি দেখতে বেশ আজব। গায়ের রঙ টকটকে লাল, কপাল আর কানদু’টো ধবধবে সাদা, হাঁটুর নিচে থেকে পা দুটোও সাদা। এটা একটা শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পের ঘোড়া, তাই আর পাঁচটা ঘোড়া থেকে একটু আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। ঘোড়ার ভাষায়-- ‘পায়ের রঙ শাদা ছিল বলে যখন দৌঁড়াতাম লোকে ভাবত আমি বুঝি শূন্যে ভেসে যাচ্ছি।’ ঘোড়াটির কথা বলার পাশাপাশি আর যে সব মানবিক গুনাবলী আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিউমর করবার ক্ষমতা। হাসান আজিজুল হক নিজের আদলেই গড়ে তুলেছেন (চবৎংড়হরভরবফ) করেছেন ঘোড়াটিকে। কাজেই, ঘোড়াটিকে কখনও মনে হয় বড্ড রসিক আবার কখনও মনে হয় প্রচণ্ড সিরিয়াস।
খ.
উপন্যাসের স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে হাসির উপকরণ। তবে সেটার স্পর্শ পেতে হলে পাঠককে একটু সেনসিটিভ হতে হবে। এমনিতেই হাসান আজিজুল হক যথেষ্ট রসিক মানুষ-- সেটা তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তারা জানেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম পড়েও তা জানা যায়। তবে তাঁর মতো সিরিয়াস কথাসাহিত্যিক ফাজলামো করে হাসাবেন না এটাই স্বাভাবিক।
একটি ঘোড়া মানুষের সংস্কৃতি রপ্ত করে মানুষের ভাষায় কথা বলছে। সে বলছে--
‘চার পায়েই বাত হয়েছে বাত হয়েছে। পেছনের পায়ের হাঁটু ফুলে ওলকপির মতো হয়ে গেছে।’
কিংবা, ‘টাকাগুলো পেয়ে আমার মনিব আবার এমন পেঁচার মতো মুখ করে সেগুলো গুনতে লাগল যে আমার হাসি পেয়ে গেল। হাসির চোটে চিঁহিঁহিঁ করে ডেকে উঠলাম।’
ঘোড়াটির এইভাবে কথা বলার ধরন দেখে শিশু কিশোররা যথেষ্ট মজা পাবে। এতোদিন তারা দাদা-দাদি, নানা-নানির মুখ থেকে গল্প শুনে এসেছে। এখন তারা যতোবারই ভাবে যে তারা একটা ঘোড়ার সাথে কথা বলছে, তার মুখেই তার গল্প শুনছে ততবারই ভাবে-- কী আজব ঘোড়ারে বাবা ! আনন্দে আপ্লুত হয় তাদের মন।
এছাড়াও গল্পের বহু জায়গায় কখনো মুখ টিপে কখনোবা মুখের লাগাম ছেড়ে হাসতে হবে পাঠককে। ঘোড়াটির নতুন মনিবের ছেলে মেয়েরা তার সাথে কুকুরের এটাওটা নিয়ে তুলনা শুরু করলে ঘোড়াটি বলে ওঠে-- ‘আমি দেখলাম, আমার সম্মান আর থাকে না।...’ ঘোড়াটির সেন্স অব হিউমর আমাদের হাসতে বাধ্য করে। মনিবের গোয়াল ঘরে একটা সাদা বলদের সাথে ঘোড়াটির যে বাগ-বিতন্ডা হয় তাও হাসির উদ্রেগ ঘটায়। ঘোড়াটির পঞ্চম মনিব হোমিওপ্যাথ ডাক্তার যখন ওষুধ দিয়ে ভূতের সর্দি সারানোর গল্প করছিলেন তখন ঘোড়াটির সাথে সাথে আমরাও না হেসে পারি না।
গ.
গল্পের প্রধান চরিত্র ঘোড়া হলেও, এটি ঘোড়াদের সমাজের গল্প নয়। ঘোড়ার চোখে দেখা মানবপ্রকৃতির বর্ণনা উঠে এসেছে গল্পটির আদ্যো-প্রান্ত জুড়ে। মানুষ সম্পর্কে একটা বলিষ্ট ধারনা শিশু-কিশোররা পাবে এই গল্পটি পাঠ থেকে। তবে এই ধারনা সুখকর নয় মোটেও। গল্পের বিভিন্ন অংশে মানুষ সম্পর্কে প্রথম যে স্টেটমেন্টগুলো প্রদান করা হয়েছে সেদিকে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে বিষয়টি--
‘তবে তারা (মানুষ) প্রায়ই মিথ্যে কথা বলে তা আমি অনেকবার দেখেছি।’
‘বিনা কারণে হল্লা করা মানুষের স্বভাব।’
‘মানুষরা নিজেরা প্রায়ই ভালো হয় না। তবে তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক সময় ভালোই হয়।’
‘মানুষের এই আর একটা বদ অভ্যাস, খালি তোষামোদ করবে আর পিঠ চাপড়াবে।’
‘কেমন খারাপ স্বভাব দ্যাখো এই মানুষ জাতের! তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করবে তাও আমাদের পিঠের উপর চড়ে। আমাদের স্বভাব আগে ভালোই ছিল। মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে এখন আমাদের স্বভাবও অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘মানুষের বাচ্চা তো! লাই দিলেই মাথায় চড়ে বসবে।’
‘যে আমার পিঠে চড়বে বলেছিল, সে তখন এগিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে ঠোঁটদুটোকে ছুঁচোর মতো করে চুঁঅক চুঁঅক শব্দ করতে লাগল। মানুষের মুখের এই শব্দটা শুনতে আমার ঘেন্না লাগে। এমন বিচ্ছিরি শব্দ মানুষ ছাড়া আর কোনো জানোয়ার করতে পারে না।’
‘সেই আমার জীবনে প্রথম বিনা কারণে মার খাওয়া। তার পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি, বিনা কারণে মারধোর করাই মানুষের স্বভাব। নিজেদের মধ্যেও তারা তাই করে। মানুষের বদমায়েশির এত প্রমাণ আমি পেয়েছি যে আজকাল আর একটুও অবাক হই না।’
‘আর মানুষ প্রায় সবাই সমান পাজি। যদি তেমন কোনো জায়গা থাকত যেখানে মানুষ নেই, তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে চলে যেতাম।’
‘ঘোড়ায় ঘোড়ায় তফাত কিছু আছে বটে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের একি তফাত! আমার প্রথম মনিব তো বলতে গেলে ছিল ভিখিরি। জমিদারবাবু যদি মানুষ হন, তাহলে আমার প্রথম মনিবও মানুষ নয়, দ্বিতীয় মনিবও নয়।’
‘ময়লা কাগজে (টাকা) দারোগা সায়েবের পকেট ফুলে উঠতো।’
‘...মানুষরা এই ময়লা কাগজগুলো (টাকা) খুব ভালোবাসে।’
‘একদিন তার (ডাক্তার) গল্প শুনে আমিও তাজ্জব বনে গেলাম। এমন ডাহা মিথ্যেও মানুষ বলে!
মানুষের দৈহিক বর্ণনাও করা হয়েছে নেতিবাচক ভাবে। প্রথম মনিব সম্পর্কে ঘোড়াটির মন্তব্য ছিল-- মানুষদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে খারাপ দেখতে। তার মুখ দিয়ে এমন থুথু আর পচা গন্ধ বেরুত যে ঘেন্নায় তার (ঘোড়াটির) গা পাক দিত। দ্বিতীয় মনিব সম্পর্কে তার উক্তি-- ‘মুগুরের মতো চেহারা লোকটার।’ ঘোড়াটি দারোগার বিবরণ দিয়েছে এই বলে-- ‘লোকটা ভীষণ ভারি। জালার মতো পেট। চর্বির গরমে সব সময়েই হাঁশফাঁশ করছেন।’ ঘোড়াটির পঞ্চম মনিব সম্পর্কে তার উক্তি হচ্ছে-- ‘প্যাঁকাটির মতো রোগা লম্বা চেহারা ডাক্তারের। চেয়ারে বসে আছেন যেন নেংটি ইঁদুর।’ এবং ‘ছোট ন্যাড়া মাথাটি তাঁর ঠিক বেলের মতো,..’
মানুষের ভেতর ও বাইরের যে রূপ এখানে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে তাকে কোন ক্রমেই অস্বীকার করবার উপায় নেই। এজন্যেই, ঘোড়ার মতো প্রাণীকুলের অন্যান্য সদস্যরাও যদি প্রশ্ন করে বসে-- ‘মানুষ আবার দেখতে সুন্দর হল কবে?’ তাহলে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানুষের পক্ষে বড় মুশকিল হয়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন হল অন্যখানে। হাসান আজিজুল হক শিশু-কিশোরদের জন্যে একটা উপন্যাস লিখছেন, খুবই ভাল কথা, তো সেখানে মানুষকে এমন নৈরাশ্যজনকভাবে উপস্থাপন করা কেন? শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পে তিনি কেনইবা শিশু-কিশোরদের কথা না বলে হাজার বছর ধরে চলে আসা, বুড়ো, মরচেপড়া মানব সভ্যতার কথা বলছেন? জমিদারের বিভৎস অত্যাচারের অনেক খোলামেলা উপস্থাপন এবং জমিদারের শেষ পরিণতির বিবরণ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে-- শিশু-কিশোর উপযোগী গল্পে এত সাংঘাতিক ঘটনার বিবরণ কেন? কারণ হয়ত এটাই যে তিনি শিশু-কিশোরদের নিচ্ছক বিনোদন দেবার জন্যে লিখছেন না। সাহিত্যের কাজ তো সঙ্গীতের মতো মানুষের মনোরঞ্জন করা নয় আবার ধর্মগ্রন্থের মতো জীবন যাপনের একটি নির্দিষ্ট মানচিত্র এঁকে দেয়াও নয়, সাহিত্যের কাজ হলো মানুষের মানসিক রোগ বা সমস্যাগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করা (ংঃঁফু ড়ভ যঁসধহ ফরংবধংব)। কাজেই সাহিত্য-সচেতন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক খানিকটা শিশু-কিশোরদের অবস্থানে নেমে এসে এবং কিছুটা নিজের অবস্থানে অবস্থান করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মানুষের ভেতরকার নোংরামির কথা। মানুষের ভেতর-বাহির নেড়েচেড়ে ওলটপালট করে দেখিয়ে দিচ্ছেন মানুষ হওয়ার যন্ত্রণাটা আসলে কোথায়। এইদিক থেকে গল্পটি একটি স্যোসাল-পলিটিক্যাল এলিগরি। ঘোড়াটি এমন একটি শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে যে শ্রেণির মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক সবদিক থেকে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের সবকিছুই সহ্য করতে হয় নীরবে। ভাষা থেকেও যেন ঘোড়াটির মতোই ভাষাহীন তারা।
বরাবরই হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে প্রাণিজগত শক্তিশালী ইমেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাঁর সাহিত্যে খুব সাধারণ একটি শকুন, সাপ, ষাড়, হরিণছানা এবং আলোচ্য গল্পের লাল ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, বলদ, কুকুর প্রত্যেকে সিম্বলিক অর্থ বহন করে।
লাল ঘোড়ার মুখের কথাগুলো যদি হাসান আজিজুল হকের মুখের কথা হিসেবে ধরে নিই, তাহলে তাঁকে আপাত দৃষ্টিতে বেশ নিরাশাবাদী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি আসলে বাস্তববাদী। তাইতো তিনি মানুষের ভালো রূপটিকেও একেবারে এড়িয়ে যাননি। ঘোড়াটি যখন বলে-- ‘...হাশেমের মা যে একদিন রাতের বেলা আমার কপালে হাত দিয়ে বলেছিল, ঠিক যেন চাঁদের মতন-- সে আনন্দ কোদিন ভুলতে পারব! আসলে ভালবাসা একটি আলাদা ব্যাপার।’ এবং নানান সমস্যার কথা জানান দিয়ে ঘোড়াটি যখন বলে-- ‘কিন্তু যাই-ই বল দেশটা আমার ভালো লাগত।’ তখন আমরা জীবনের প্রকৃত সত্যটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ঘোড়াটি যখন মৃত্যুসজ্জায় তখন সে চোখ বুঝতেই দেখতে পায় তার মাকে, অতঃপর দেখে হাশেমের মা ও হাশেমকে-- যেন শেষপর্যন্ত ভালবাসার কাছে পরাজিত হয় সবকিছু। বস্তুত, লেখক এখানে একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেননি। তিনি নির্মম বাস্তবের অসহায় দর্শক। শিশু-কিশোরদের আসন্ন এই পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত করে তোলায় হয়ত তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি বলতে চাচ্ছেন-- আর কত ভুলিয়ে রাখা, সত্যটা তারা এবার জানুক !
ঘ.
‘লাল ঘোড়া আমি’ গল্পে হাসান আজিজুল হক বেশ সহজ সরল ভাষা ব্যবহার করেছেন। কথাসাহিত্যে তাঁর যে মজবুত ভাষার বুনন তা কিছুটা হলেও ঢিলে করেছেন শিশু-কিশোর সাহিত্যে এসে। একটি ঘোড়ার মুখ থেকে আমরা পুরো গল্পটা শুনছি, তাই ভাষা সরল হওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে ভুলে গেলে চলবে না-- ঘোড়াটা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের, তাই এই গল্পের ভাষা যে তাঁর সহজাত ঢঙ থেকে বের হতে পারবে না সেটাও খুব স্বাভাবিক।
গল্পে প্রকৃতির বনর্ণা এবং উপমা (ঝরসরষব) ও রূপকের (সবঃধঢ়যড়ৎ) ব্যবহার লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে তাঁর ভাষা নিয়ে খেলবার শৈল্পিক দক্ষতা কতখানি। বিষয়টি আরও পরিস্কার করার জন্যে টেক্সটের কিছু যায়গায় দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে--
‘পেছনের দু পায়ের হাঁটু ফুলে ওলকপির মতো হয়ে গেছে।’
‘আকাশে চাঁদ উঠেছে আর সেই চাঁদের আলোয় সমস্ত মাঠ ভেসে যাচ্ছে।’
‘এখন দেখলাম সেই মাঠের এক কোণে সূয্যি ঢলে পড়েছে আর তার এক কিনার দিয়ে দেশলাইয়ের বাকসের মতো একটা লাল রঙের ট্রেন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।’
‘গায়ের রঙ লাল টকটকে, রক্ত যেন ফেটে পড়ছে। চওড়া ছাতি দেখে মনে হয় যেন একজোড়া মজবুত দরজা। ...চোখদুটো তাঁর জবা ফুলের মতো লাল। তারপর যখন কথা বললেন, মনে হল মেঘ ডেকে উঠল গরগর শব্দে।’
‘কি রকম সোনার চাদরের মতো রোদ আকাশ থেকে নেমে এসে মাঠঘাট গাছপালার উপর বিছিয়ে রয়েছে।’
‘একটু পরে পুবদিকে চাঁদ উঠল গোল একটা সোনার থালার মতো।’
উপমাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে তিনি বেশ সচেতন ভাবেই সেগুলো ব্যবহার করছেন যাতে করে গল্পের মেজাজটা বা শিল্পের জায়গাটা অক্ষুন্ন থাকে সাথে পাঠকদেরও বুঝতে অসুবিধা না হয়। তবে এই সময়ের শিশু-কিশোর, যারা এই গল্পের টার্গেট রিডার, তাদের কাছে অতি সুখপাঠ্য হবে গল্পটি, এমন আশা আমি করছি না। এর প্রধান কারণ হল মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান-- যে ঘোড়াটির কথা এখানে বলা হচ্ছে সে হলো জমিদার আমলকার। তখনকার গ্রামীণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। তাই পাঠকদের গল্পের ভেতরে প্রবেশ করতে খানিকটা সময় লাগবে। তাছাড়া যে উপমাগুলো এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তার সবটা তাদের পক্ষে ধরা মুশকিল। এছাড়াও, কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার এখানে করা হয়েছে, যেমন-- মুগুর, প্যাকাটি, দুদ্দাড়, রগড়াতে রগড়াতে ইত্যাদি, যে শব্দগুলো বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোর, বিশেষ করে শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের পক্ষে বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তবে তাদের মধ্যে যারা এডভান্স রিডার, যাদের সাহিত্যরস আস্বাদন করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের কাছে যে গল্পটির যথেষ্ট আবেদন তৈরি হবে সে কথা নিশ্চত করে বলা যায়।
দ্বিতীয় ভাগ : ‘ফুটবল থেকে সাবধান’
‘ফুটবল থেকে সাবধান’ গল্পগ্রন্থে সাতটি গল্প আছে। প্রথম গল্প ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। এই গল্পটি ভল্টু, পল্টু ও লেদু নামক তিনজন কিশোরকে ঘিরে। নামগুলোর মতো গল্পটাও বেশ মজার। ফুটবল খেলতে গিয়ে ভল্টুর পা ভেঙ্গে যায়। ভল্টুর পা ‘টেনিস বলের’ মতো ফুলে ওঠে। সে প্রতিজ্ঞা করে ‘জীবনে আর আমি ফুটবলের চেহারা দেখবো না’। বাড়িতে এই খবরটা ফাঁস হয়ে গেলে বিপদ বাড়বে বয় কমবে না, তাই তো ভল্টু ভান করে বিছানায় পড়ে থাকে আর অন্যদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-- ‘হায়রে, আমার কি এমন কেউ আছে যে দুটো খাবার এনে দেয় এখানে! আমার জন্যে একটু ভাবে এমন কেউ নেই এ বাড়িতে। এই যে এখন আমি অ্যালজেব্রা কষব-- আর সেসব কী সাংঘাতিক সাংঘাতিক অ্যালজেব্রা-- ভাবলে নাড়িভুড়ি বাইরে চলে আসে-- সে সম্বন্ধে কারুর কি কোনো ভাবনাচিন্তা আছে?’ আবার যখন অতি কষ্টে সে বাড়ির বাইরে যাবার চেষ্টা করে তখন বাবা সামনে পড়ে গেলে বলে, ‘ভল্টু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এমন মারাত্মক একটা হাসি ছাড়লো যে আব্বার মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়’। বাবা কোথায় যাচ্ছে জানতে চায়লে সে বলে-- ‘জি না, আমার কিছু হয়নি’-- চোরের মন যে পুলিশ পুলিশ সে কথা আমাদের সকলেরই জানা! এমন সব হাসি-উদ্দীপক সহজ সরল বর্ণনার মধ্যে দিয়ে গল্পটি এগিয়ে যায়। গল্পটিতে মাস্টার মশাইয়ের শরীরের বর্ণনা ও তাঁর গালির ধরন কিশোর মনে হাসির উদ্রেগ ঘটাতে বাধ্য।
‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপাথি’ গল্পটিও বেশ মজার। গাঁয়ে তোরাপ ও অঘোর নামে দুজন ডাক্তার ছিল-- একজন হোমিওপ্যাথ, অন্যজন অ্যালোপাথ। তারা কীভাবে ডাক্তার হয়েছে তা কেউ জানে না। অ্যালোপাথ তোরাপ ডাক্তারের চিকিৎসার ধরনটাই এমন যে তাকে দেখলেই রোগীর পিলে চমকে যেত এবং রোগ সটকে পড়তো। আর হোমিওপ্যাথ অঘোর ডাক্তারের ওষুধ হাতে নিয়েই রোগী জিজ্ঞেস করতো-- ‘ডাক্তারবাবু ভালো হবে তো?’ তারা আবার একে অন্যের জন্ম শত্র“। দুজনই সুবিধাবাদি ডাক্তার, রোগীর থেকে আয় রোজগারের দিকে নজর বেশি। এ ধরনের হাতুড়ে ডাক্তার গ্রামে গঞ্জে এখনো লক্ষ্য করা যায়। আর এখনকার শহরের শিক্ষিত ডাক্তাররা তো ডাকাতকেও হার মানাবে। গল্পটির ভাষা বেশ সরল হলেও হাসান আজিজুল হকের সহজাত গদ্য ঢঙ দু’এক জায়গায় চোখে পড়ে; যেমন, তিনি এক জায়গায় বলছেন-- ‘তোরাপ ডাক্তারের দেহের কাঠামো ছিল বিরাট-- কিন্তু কেমন যেন লোনা-ধরা পুরোনো ইটের বাড়ির মতো। সারা দেহটা তাঁর হলবল নড়বড় করছে!’
‘লড়াই মানে ফাইট’ গল্পটি সব শ্রেণির পাঠকের পাঠ করার মতো। বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পও বোধহয় এটি। গল্পের ছেলেটির নাম নসু। মা বাদে সবাই তাকে নস্যা বলে ডাকে। ছেলেটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে যখন বলে-- “...আমার একটা হাত, একটা পা কাজের না হলে কী হবে, আমি খুব ‘ফাইট’ করতে পারি। ‘ফাইট’ না করে আমি কোনকিছু ছেড়ে দিই না।...আমি জানি, ‘ফাইট’ না দিলে বাঁচতে পারব না।” তখন মানব সভ্যতার অতি নির্মম একটি সত্য বের হয়ে আসে। শুধু বিকলাঙ্গ নসু না, ফাইট করে বেঁচে থাকে নসুর নিংস্ব মাও। তারা ফাইট করে মাটি, শীত, রাতের অন্ধকার, ড্রেনের নোংরা পানি, যানবাহন, ক্ষুধা, ডাস্টবিন, কুকুর আর মানুষের সাথে। নসু বলে-- ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখছি, দুনিয়ায় এত জিনিস, তা দুনিয়া আমাদের কিচ্ছুটি দেবে না, খালি ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে সরাবে। মনে হয়, দুনিয়ার মতলব হচ্ছে আমাদের ধাক্কা দিয়ে একেবারে কিনারায় নিয়ে গড়িয়ে ফেলে দেয়া।’ নসুর মতো যারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে তাদের ব্যথা ধারন করেই যেনো গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩৬) বলেছেন-- ‘...সংসারে কোন কিছুরই অভাব নেই, তবু দুনিয়ার অজস্র ধন সম্পদের সামনে জনগণ অনশনে, ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটায়।...চারিদিকে এত অঢেল খাবার অথচ তারা ক্ষিদের অনলে জ্বলবে কেন? চারিদিকে এত বুদ্ধির আলো তবে ওরা এত অন্ধকারে থাকে কেন?’ (মা, ১৯০৬; তর্জমায় : বর্তমান আলোচক)
এই বইয়ের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের নাম হল ‘চরু’। চরু একটি হরিণছানার নাম। একদল শিকারি চরুর মাকে বন্দুক দিয়ে শিকার করে তারপর মহল্লায় এনে তার মাংস টুকরো টুকরো করে কেটে গাঁয়ে বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়ে, শুধু পড়ে থাকে ‘বাদামির ওপর সাদা ছিটেঅলা চামড়াটা আর দুটো নীল চোখ-অলা শিংসুদ্ধ মাথাটা।’ চরু এসবের নীরব সাক্ষী। মায়ের সাথে সাথে তাকেও ধরে আনা হয়েছে। কারণ, তাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তুলতে পারলে আরও কিছু কামানো যাবে। চরুর শিশু মন এখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করে-- হালুম-এর থেকেও দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ সব পশু বাস করে ডাঙায়, হয়ত তাদের হাত থেকে বাঁচতেই তার মার মতো অনেক পশু পাখি আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। তবে চরুর ভাগ্য ভালো যে ঐ বাড়ির বোবা কালা ছেলেটি এখনও পৃথিবীর হালচাল বোঝেনি। তার শিশু মন অবলা হরিণছানাটির মতোই পবিত্র তাইতো তারা প্রকৃতিগত ভাবেই একে অন্যের আপনজন হয়ে ওঠে। তাদের সখ্য বোঝবার ক্ষমতা এই নিষ্ঠুর সভ্যতার নেই, ফলত তারা অপেক্ষা করে কবে হরিণছানাটি ভোগ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। তাদের সেই সুযোগ আর হয় না। বোবা কালা ছেলেটি হরিণছানাটিকে জবাই করার ঠিক আগ মুহুর্তে নদীর ওপারে জঙ্গলে রেখে আসে। একটি বোবা কালা ছেলের কাছে পরাজিত হয় তথাকথিত সুস্থ কিছু মানুষ কিংবা বলা যায় আমাদের প্রতিষ্ঠিত এই টোটাল সমাজ ব্যবস্থা। এখানেই হাসান আজিজুল হকের বিশেষত-- সুন্দর ও সত্যের জয় যেনো অবধারিত।
‘ভূতে বিশ্বাস নেই’, ‘গজভুক্ত কপিত্থ’ ও ‘ব্যাঘ্রবধের ব্যাপার’ গল্প তিনটি শিশু কিশোরদের জন্যে বেশ সুখপাঠ্য হবে সে কথা নির্দিধায় বলা যায়। এই গল্পগুলোতে হাসানের গদ্যের বেশ খানিকটা হেরফের ঘটেছে। তিনি হয়ত সচেতন ভাবেই স্রেফ মজা করার জন্যে এই গল্পগুলো রচনা করেছেন। যেমন, ‘ব্যাঘ্রবধের ব্যাপার’ গল্পের শেষটার কথায় ধরা যাক-- বাঘটিকে মেরে ফেলার পর মাধাই উঠে দাড়ালো এক মুখ হাসি নিয়ে। তার কাঁধ বেয়ে রক্ত ঝরছে অথচ তার অট্টহাসি থামছেই না। পরে দেখা গেল, বাঘ ডান গালের সব মাংস তুলে নিয়েছে, ফলে সব দাঁত বের হয়ে গেছে। ‘মাংস চামড়াই নেই, দাঁত ঢাকবে কী দিয়ে? ভালো হয়ে গিয়েছিল সে তিন মাস পর। কিন্তু হাসি আর থামাতে পারেনি। হেসেই গেল চিরদিন। বোধহয় মরবেও হাসতে হাসতে।’ ‘গজভুক্ত কপিত্থ’ গল্পটি নিয়ে একটু মজা করে সুশীল সাহা তাঁর একটি সমধর্মী আলোচনায় লিখেছেন-- “ভাগ্যিস এমন দুর্বল গল্পও তিনি লিখেছেন, নইলে ‘লড়াই মানে ফাইট’ কিংবা ‘চরু’-র শ্রেষ্ঠত্ব কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হত!” (কিশোরমনের তলকুঠুরী : কথা সাহিত্যের অন্য আর এক ভূবনের প্রেক্ষিতে হাসান আজিজুল হক, ‘মহাযান’)
হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকে আর কোন শিশু-কিশোর উপযোগী রচনা আমরা পাবো কি-না জানি না। হয়ত ইচ্ছা থাকলেও বড় কোনও কাজের চাপে সে ফুসরত তিনি পাবেন না। তবুও যে গুটি কতক রচনা তিনি লিখেছেন সেটা উপযুক্ত পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারলে তাঁর শ্রম সার্থক হবে। আলাদা করে ‘লাল ঘোড়া আমি’, ‘তরু’ ও ‘লড়াই মানে ফাইট’ গল্পগুলোর কথা বলা যেতে পারে। শিশু-কিশোরদের জন্যে শিক্ষামূলক বিনোদন হিসেবে এই রচনাগুলো যথেষ্ট মনোযোগের দাবীদার বলে মনে করছি।
মোজাফ্ফর হোসেন
সম্পাদক, শাশ্বতিকী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজশাহী।
০১৭১৭ ৫১৩০২৩
1 মন্তব্যসমূহ
লড়াই মানে ফাইট, চরু, লাল ঘোড়া আমি পড়ার ক্ষিধে চাগিয়ে ওঠলো। সুন্দর আলোচনা। পুরো বইয়ের সিনোপসিস ভালো লাগলো। ধন্যবাদ ভাই।
উত্তরমুছুন