গল্প লেখার গল্প : অমর মিত্রের 'যুদ্ধে যা ঘটেছিল'

অমর মিত্র ভীন্ন ধারার কথাশিল্পী। সমকালকে পুরাকালের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার অসামান্য কারিগর তিনি। তাঁর হাতে কালের ব্যবধান ঘুচে যায়। তিনি অনায়াসে দেখান মানুষের মৌল সত্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। জীবনের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রটি একই থাকে--প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর সে দ্বন্দ্বকে বহন করে মাত্র। আমরা নানা কায়দায় তার পুণর্বয়ান পাঠ করি মাত্র। ফলে অমর মিত্রের গল্প-উপন্যাস হয়ে ওঠে বাস্তবতার উল্টোপিঠে যাদু-বাস্তবের দোলাচাল। তিনি এঁকে বলেন ফ্যান্টাসী। তবে তিনিই বাংলা ভাষার সার্থক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।

বাংলাদেশ-ভারতে বেশ কিছু ছিটমহল আছে। তার অধিবাসীদের অভিশপ্ত জীবন নিয়ে লিখেছেন 'যুদ্ধে যা ঘটেছিল' গল্পটি। গল্পটিতে একটি আবেদন পত্র রয়েছে। সেটাই মূল গল্প। নিচে লেখকের টিকা সংযোজন করেছেন মাত্র। গল্পটি আখ্যান আর অমর মিত্রের অসামান্য ভাষা আমাদের বোধের আকাশকে ফুঁটো করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে এই গল্পটি অসামান্য একটি নির্মাণ।

এই 'যুদ্ধে যা ঘটেছিল' গল্পটির নির্মাণের গল্পটি জানার জন্য অমর মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোনে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন। তখন তাঁকে অনুরোধ করা হয় সেটা লিখে দেওয়ার জন্য। নিচের লেখাটি অমর মিত্রের পাঠিয়েছেন। লেখাটি ছোট, কিন্তু লেখার গল্পটির মূল কথাগুলো আছে।


ছিটমহল এখন আমার কৌতুহলের বিষয়। একটি বছর ধরে ছিটমহল গেছি এসেছি। অনেক গ্রাম ঘুরেছি। ইন্ডিয়ার ভিতরে বাংলাদেশ, আবার বাংলাদেশি ছিটে ঘেরা ইন্ডিয়া। এই টুকরো ছিট-গ্রামগুলি, মানে ইন্ডিয়ার ভিতরে থাকা বাংলাদেশ, কোনো দেশের মানচিত্রে নেই। এইসব গ্রাম এমন ছন্নছাড়া হয়ে এদেশ-ওদেশে ঢুকে যাওয়ার পিছনে অনেক তত্ব আছে, তার ভিতরে একটি তত্ব হলো জুয়া খেলা। ব্রিটিশ করদ রাজ্য কোচবিহার এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রংপুরের জমিদারের জুয়ায় জেতা হারা। তা আমার গল্পেই আছে।

এই গল্পটি লেখা হয়েছে একটি লিখিত আবেদন পত্রের আঙ্গিকে। ছিটের মানুষ কোচবিহারের জেলা শাসককে দরখাস্ত দিচ্ছে। দরখাস্তের ভিতরেই গল্প। এই আঙ্গিকে আমি এর আগেও আমার উপন্যাস কৃষ্ণগহ্বরে আছে তা একটি চ্যাপ্টার হয়ে। সেখানে ভূমি অধিগ্রহণে গ্রাম চলে যাওয়ার সময় নিরূপায় মানুষ, কোথাও কোনো আশ্বাস না পেয়ে বাবা বড় কাছারির নিকট দরখাস্ত পেশ করে নিজেদের দুর্ভোগ জানিয়ে ( ১৯৯৩-৯৪-এ লেখা) । বাবা বড় কাছারি জাগ্রত দেবতা। কলকাতার নিকটে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় তিনি আছেন। তার থানের নিকটের প্রাচীন বটের ঝুরিতে দরখাস্ত ঝুলিয়ে দিয়ে মনস্কামনা নিবেদন করতে হয়। সেই অংশটি প্রথমে গল্প হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল, সাড়া পেয়েছিলাম। 

১৯৮০ সালে আমি লিখেছিলাম দানপত্র। এই গল্পটি একটি হস্তান্তর-দলিলের আঙ্গিকে লেখা। দানপত্র পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল আমেরিকার জাতি সঙ্ঘে লেখা রেড ইন্ডিয়ান উপজাতি সর্দারের সেই আবেদন পত্রের কথা( সাহিত্য একাডেমির আধুনিক বাংলা গল্প সংকলন, চতুর্থ খন্ডের ভূমিকা)। দানপত্র নামে আমার একটি গল্পের বই ছিল, এখন আর পাওয়া যায় না। সুতরাং ছিটমহলের এই গল্পের আঙ্গিক নতুন কিছু নয়। আমি মামলা মোকদ্দমার রায় নিয়ে, যে ভাবে রায় দেওয়া হয়,বাদী বিবাদীর সাক্ষ্য নিয়ে, সেই আঙ্গিকেও গল্প লিখেছি। জমি আর মানুষকে কিছুটা হয় তো চিনি। এই গল্প তা থেকেই জন্ম নিয়েছে।


অমর মিত্রের 'যুদ্ধে যা ঘটেছিল' গল্পটি পড়ুন-- লিঙ্ক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. 'যুদ্ধে যা ঘটেছিল'- অসাধারণ এক লেখা । হঠাত ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে পড়ে ফেলা।
    বহুদিন সাহিত্য পাঠের যেকোন জানালা থেকে দূরে ছিলাম। গল্প টা পড়ে যেন ঝুপ করে নেমে গেলাম, ছিটমহলে কোন একজনের উঠোনে, মনে হল অনেক মানুষ - কেরোসিনে তেলের কুপি জ্বালিয়ে লিখতে বসেছে - সবাই মিলে বসেছে, একজন লিখছে - এক খানা আবেদন পত্র । আর সবার চোখে জল, সাথে আমার ও, যেন আমিও আছি সেখানে ।

    এরপর অমর মিত্র' র আরও লেখা খুঁজতে গিয়ে পাই - দেশভাগের বেদনার গল্প, সাথে দেশ, মানুষ আর মানুষের মানচিত্র ... সে গল্প পাঠ এ ডুবে যাই, জেগে উঠি, আবার ডুবি ...

    উত্তরমুছুন